শিক্ষার্থী বাড়ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, কমছে বেসরকারিতে

দেশে উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সব জেলায় হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ইতোমধ্যে দেশের প্রায় অর্ধেক জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বাকি জেলাগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোকেও স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বাড়ছে। যদিও বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকায় বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনইউ) অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্সে শিক্ষার্থী কমার আশঙ্কা করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের আশঙ্কা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থী পেতে ‘চ্যালেঞ্জের’ মুখে পড়তে পারে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৩০ জেলায় মোট ৫২টি (চিকিৎসা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ৫১টির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া সুনামগঞ্জে ‘সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তবে এর কার্যক্রম শুরু হয়নি। দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা গ্রহণের ফলশ্রুতিতে নতুন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে।

জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী সংবাদকে বলেন, ‘হঠাৎ করে অনেক সংখ্যা বেড়ে গেলে অবকাঠামোর অভাব হয়, শিক্ষকের অভাব হয়, কোয়ালিটি শিক্ষার্থীর অভাব হয়, শিক্ষা উপকরণের অভাব হয়, শিক্ষার স্যান্ডার্ড ধরে রাখা সম্ভব হয় না। তাই প্ল্যানওয়েতে হওয়া উচিত।’

দেশে ‘ছাত্রছাত্রী সংখ্যা এবং জনসংখ্যাও অনেক’ উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. একে আজাদ বলেন, ‘অনেকেই উচ্চশিক্ষা নিতে চায়। সেক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে পারে... বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে সায়েন্স টেকনোলজি-ইনোভেশন, আইসিটি, ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি। এখন সব লিভারেল আর্টস, কমার্স, আইবিএ, হিস্টোরি, জিওগ্রাফি- এগুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কী দরকার? এসব বিষয় ইন্টারমেডিয়েট পর্যন্ত থাকলেই হয়। আর উপরের দিকের সংখ্যাটা সীমিত করে ফেলা উচিত। কারণ এগুলোর কর্মসংস্থানের সুযোগ কম।’

পাবলিক ইউনিভার্সিটির বিস্তার হতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বিস্তার করতে গিয়ে আমরা যেন স্যান্ডার্ডকে নিচে নামিয়ে না ফেলি।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ধরনের অসুবিধা রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘তারা শিক্ষার্থী পেতে লড়াই করছে। তারা ছাত্রদের বেতন দিয়ে চলে, ছাত্রছাত্রী কম হলে বেতন বন্ধ যায় শিক্ষক-কর্মচারীদের। এভাবে চলতে চলতে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির কোয়ালিটি নিচে নেমে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা উচ্চশিক্ষা দেয়া হচ্ছে যেটি স্যান্ডার্ড নয়, যেটি সমাজের প্রয়োজন হচ্ছে না, ইন্ডাস্ট্রির জন্য প্রয়োজন হচ্ছে না; এটারও একটা সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৩৬টি জেলায় কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এর মধ্যে মন্ত্রিসভা গত ২২ আগস্ট ‘মেহেরপুরে মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও নওগাঁয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০২২’ স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে।

আরও সাতটি জেলায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জেলাগুলো হলো- সাতক্ষীরা, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, পিরোজপুর, ঠাকুরগাঁও ও নাটোর। এই সাত জেলায় নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে আইনের খসড়া ইতোমধ্যে ইউজিসি থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে।

এছাড়া ‘বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আইনটি গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে কার্যকর করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘সব জেলায় কমপক্ষে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।’ সরকারপ্রধানের এই নির্দেশনার আলোকেই সব জেলায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।

একই সঙ্গে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স পাঠদানকারী সরকারি কলেজগুলোতে সংশ্লিষ্ট এলাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এনইউ কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৯২’ সংশোধন না করে এর অধিভুক্ত কোন কলেজকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধিভুক্তির সুযোগ নেই।

তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান সংবাদকে জানিয়েছেন, ‘একনেকে অনুমোদিত’ এনইউর মোট ছয়টি আঞ্চলিক কেন্দ্রের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। মোট ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।

পর্যাক্রমে আইন করে ওইসব কার্যালয়কে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে উপাচার্য বলেন, ‘আমরা যদি মোট ৯টি আঞ্চলিক কেন্দ্র নির্মাণ করি, তাহলে একেকটি আঞ্চলিক কেন্দ্রের অধীনে মোট দুইশ’ থেকে ২২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পড়বে। এই যে ডিসেন্ট্রালাইজেশন তা জাতীয় শিক্ষানীতিতে উল্লেখ আছে।’

আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার ইঙ্গিত দিয়ে এনইউ উপাচার্য বলেন, ‘যদি প্রয়োজন হয়, ভব্যিষতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়া যায় এই ৯টি আঞ্চলিক কেন্দ্র অর্থাৎ জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়কে বিকেন্দ্রীকরণ করে একেকটি স্বতন্ত্র বিশ^বিদ্যালয় করে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেটা শিক্ষানীতিতেও রয়েছে।’

শিক্ষার্থী কমছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে

ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশে ৬৬টি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় ছিল। এগুলোতে শিক্ষার্থী ছিল তিন লাখ ২৮ হাজার ৭৩৬ জন। এরপর ২০১৮ সালে তিন লাখ ৬১ হাজার ৭৯২ জন এবং ২০১৯ সালে দাঁড়ায় তিন লাখ ৪৯ হাজার। কিন্তু ২০২০ সালে প্রায় বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় একশ’। এগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় তিন লাখ ২৮ হাজার ৬৮৯ জনে। এ হিসাবে গত তিন বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়মিত কমছে। বর্তমানে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৯টি।

এ বিষয়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘ভালো’ বেতন-ভাতা দিয়েও ‘ভালোমানের’ শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। আর ‘যেসব বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কম, তাদের আয়-রোজগারও কম। তারা ভালোমানের শিক্ষক পাবেন কোথায়?’

শিক্ষক সংকটের কারণেই অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমছে জানিয়ে ওই ট্রাস্টি বলেন, ‘করোনা মহামারীতেও নামি-দামি কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমেনি, তবে ভর্তিতে প্রতিযোগিতা কমেছে; আগে যেখানে একটি আসনের বিপরীতে ১৫/২০ জন ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিত, এখন আট/দশ জনে নেমে এসেছে। কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমেছে।’

রাজনৈতিক বিবেচনায় সারাদেশেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে অভিযোগ করে এনএসইউর ওই ট্রাস্টি সদস্য বলেন, ‘মানসম্মত উচ্চশিক্ষা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। ঢালাওভাবে প্রতিষ্ঠান বাড়তে থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।’

বিভাগওয়ারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

দেশে বর্তমানে বিশেষায়িত ও মেডিকেল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যার নিরিখে ঢাকা মহানগরী, গাজীপুর ও চট্টগ্রাম শীর্ষে রয়েছে।

ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ১৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি ঢাকা শহরে এবং গাজীপুরে পাঁচটি। এছাড়া সাভার, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগে ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে চারটি এবং চাঁদপুর, রাঙামাটি, নোয়াখালী, কুমিল্লা এবং লক্ষ্মীপুরে একটি করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

খুলনা বিভাগে সাতটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে খুলনায় চারটি এবং যশোর, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরে একটি একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

রাজশাহী বিভাগে সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতে তিনটি এবং পাবনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ এবং নাটোরে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

বরিশাল বিভাগে তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল, পটুয়াখালী এবং পিরোজপুরে অবস্থিত।

সিলেট বিভাগে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি সিলেটে এবং হবিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জে একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

রংপুর বিভাগে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে রংপুর শহর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাটে একটি করে বি বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত।

ময়মনসিংহ বিভাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে চারটি। এর মধ্যে ময়মনসিংহে দুটি এবং নেত্রকোনা ও জামালপুরে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

জেলায় জেলায় হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৮ ভাদ্র ১৪২৯ ১৫ সফর ১৪৪৪

শিক্ষার্থী বাড়ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, কমছে বেসরকারিতে

রাকিব উদ্দিন

দেশে উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য হচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সব জেলায় হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ইতোমধ্যে দেশের প্রায় অর্ধেক জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বাকি জেলাগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোকেও স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বাড়ছে। যদিও বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকায় বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনইউ) অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্সে শিক্ষার্থী কমার আশঙ্কা করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের আশঙ্কা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থী পেতে ‘চ্যালেঞ্জের’ মুখে পড়তে পারে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৩০ জেলায় মোট ৫২টি (চিকিৎসা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ৫১টির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া সুনামগঞ্জে ‘সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তবে এর কার্যক্রম শুরু হয়নি। দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা গ্রহণের ফলশ্রুতিতে নতুন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে।

জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী সংবাদকে বলেন, ‘হঠাৎ করে অনেক সংখ্যা বেড়ে গেলে অবকাঠামোর অভাব হয়, শিক্ষকের অভাব হয়, কোয়ালিটি শিক্ষার্থীর অভাব হয়, শিক্ষা উপকরণের অভাব হয়, শিক্ষার স্যান্ডার্ড ধরে রাখা সম্ভব হয় না। তাই প্ল্যানওয়েতে হওয়া উচিত।’

দেশে ‘ছাত্রছাত্রী সংখ্যা এবং জনসংখ্যাও অনেক’ উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. একে আজাদ বলেন, ‘অনেকেই উচ্চশিক্ষা নিতে চায়। সেক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে পারে... বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে সায়েন্স টেকনোলজি-ইনোভেশন, আইসিটি, ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি। এখন সব লিভারেল আর্টস, কমার্স, আইবিএ, হিস্টোরি, জিওগ্রাফি- এগুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কী দরকার? এসব বিষয় ইন্টারমেডিয়েট পর্যন্ত থাকলেই হয়। আর উপরের দিকের সংখ্যাটা সীমিত করে ফেলা উচিত। কারণ এগুলোর কর্মসংস্থানের সুযোগ কম।’

পাবলিক ইউনিভার্সিটির বিস্তার হতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘বিস্তার করতে গিয়ে আমরা যেন স্যান্ডার্ডকে নিচে নামিয়ে না ফেলি।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ধরনের অসুবিধা রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘তারা শিক্ষার্থী পেতে লড়াই করছে। তারা ছাত্রদের বেতন দিয়ে চলে, ছাত্রছাত্রী কম হলে বেতন বন্ধ যায় শিক্ষক-কর্মচারীদের। এভাবে চলতে চলতে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির কোয়ালিটি নিচে নেমে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা উচ্চশিক্ষা দেয়া হচ্ছে যেটি স্যান্ডার্ড নয়, যেটি সমাজের প্রয়োজন হচ্ছে না, ইন্ডাস্ট্রির জন্য প্রয়োজন হচ্ছে না; এটারও একটা সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ৩৬টি জেলায় কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এর মধ্যে মন্ত্রিসভা গত ২২ আগস্ট ‘মেহেরপুরে মুজিবনগর বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও নওগাঁয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০২২’ স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে।

আরও সাতটি জেলায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জেলাগুলো হলো- সাতক্ষীরা, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, পিরোজপুর, ঠাকুরগাঁও ও নাটোর। এই সাত জেলায় নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে আইনের খসড়া ইতোমধ্যে ইউজিসি থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে।

এছাড়া ‘বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আইনটি গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে কার্যকর করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘সব জেলায় কমপক্ষে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।’ সরকারপ্রধানের এই নির্দেশনার আলোকেই সব জেলায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।

একই সঙ্গে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স পাঠদানকারী সরকারি কলেজগুলোতে সংশ্লিষ্ট এলাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এনইউ কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৯২’ সংশোধন না করে এর অধিভুক্ত কোন কলেজকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধিভুক্তির সুযোগ নেই।

তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান সংবাদকে জানিয়েছেন, ‘একনেকে অনুমোদিত’ এনইউর মোট ছয়টি আঞ্চলিক কেন্দ্রের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। মোট ৯টি আঞ্চলিক কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।

পর্যাক্রমে আইন করে ওইসব কার্যালয়কে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে উপাচার্য বলেন, ‘আমরা যদি মোট ৯টি আঞ্চলিক কেন্দ্র নির্মাণ করি, তাহলে একেকটি আঞ্চলিক কেন্দ্রের অধীনে মোট দুইশ’ থেকে ২২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পড়বে। এই যে ডিসেন্ট্রালাইজেশন তা জাতীয় শিক্ষানীতিতে উল্লেখ আছে।’

আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার ইঙ্গিত দিয়ে এনইউ উপাচার্য বলেন, ‘যদি প্রয়োজন হয়, ভব্যিষতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়া যায় এই ৯টি আঞ্চলিক কেন্দ্র অর্থাৎ জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়কে বিকেন্দ্রীকরণ করে একেকটি স্বতন্ত্র বিশ^বিদ্যালয় করে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেটা শিক্ষানীতিতেও রয়েছে।’

শিক্ষার্থী কমছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে

ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশে ৬৬টি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় ছিল। এগুলোতে শিক্ষার্থী ছিল তিন লাখ ২৮ হাজার ৭৩৬ জন। এরপর ২০১৮ সালে তিন লাখ ৬১ হাজার ৭৯২ জন এবং ২০১৯ সালে দাঁড়ায় তিন লাখ ৪৯ হাজার। কিন্তু ২০২০ সালে প্রায় বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় একশ’। এগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় তিন লাখ ২৮ হাজার ৬৮৯ জনে। এ হিসাবে গত তিন বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা নিয়মিত কমছে। বর্তমানে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৯টি।

এ বিষয়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) ট্রাস্টি বোর্ডের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদকে বলেন, ‘ভালো’ বেতন-ভাতা দিয়েও ‘ভালোমানের’ শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। আর ‘যেসব বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কম, তাদের আয়-রোজগারও কম। তারা ভালোমানের শিক্ষক পাবেন কোথায়?’

শিক্ষক সংকটের কারণেই অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমছে জানিয়ে ওই ট্রাস্টি বলেন, ‘করোনা মহামারীতেও নামি-দামি কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমেনি, তবে ভর্তিতে প্রতিযোগিতা কমেছে; আগে যেখানে একটি আসনের বিপরীতে ১৫/২০ জন ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিত, এখন আট/দশ জনে নেমে এসেছে। কিন্তু অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমেছে।’

রাজনৈতিক বিবেচনায় সারাদেশেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে অভিযোগ করে এনএসইউর ওই ট্রাস্টি সদস্য বলেন, ‘মানসম্মত উচ্চশিক্ষা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। ঢালাওভাবে প্রতিষ্ঠান বাড়তে থাকলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে।’

বিভাগওয়ারি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়

দেশে বর্তমানে বিশেষায়িত ও মেডিকেল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের সংখ্যার নিরিখে ঢাকা মহানগরী, গাজীপুর ও চট্টগ্রাম শীর্ষে রয়েছে।

ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ১৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি ঢাকা শহরে এবং গাজীপুরে পাঁচটি। এছাড়া সাভার, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গোপালগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিভাগে ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে চারটি এবং চাঁদপুর, রাঙামাটি, নোয়াখালী, কুমিল্লা এবং লক্ষ্মীপুরে একটি করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

খুলনা বিভাগে সাতটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে খুলনায় চারটি এবং যশোর, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরে একটি একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

রাজশাহী বিভাগে সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতে তিনটি এবং পাবনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ এবং নাটোরে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

বরিশাল বিভাগে তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল, পটুয়াখালী এবং পিরোজপুরে অবস্থিত।

সিলেট বিভাগে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি সিলেটে এবং হবিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জে একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

রংপুর বিভাগে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে রংপুর শহর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম এবং লালমনিরহাটে একটি করে বি বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত।

ময়মনসিংহ বিভাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে চারটি। এর মধ্যে ময়মনসিংহে দুটি এবং নেত্রকোনা ও জামালপুরে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

জেলায় জেলায় হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়