দিনে দিনে বাড়ছে খেলাপি ঋণ

রেজাউল করিম খোকন

বর্তমানে দেশে যে সব কারণে অর্থনীতিতে সংকট বিরাজ করছে, তার মধ্যে অন্যতম খেলাপি ঋণ। নানাভাবে সরকার খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলেও আদতে সেসব উদ্যোগ তেমন ফলদায়ক হয়নি। প্রতি প্রান্তিকেই বাড়ছে খেলাপি ঋণের হার। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে উপযুক্ত গ্রাহক নির্বাচন করে ঋণ বিতরণ করা দরকার। খেলাপি ঋণ কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

২০২২ সালের জুন শেষে এনবিএফআইগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ৬৯ হাজার ৩১৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ২৩ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৪ দশমিক ২৯ শতাংশ।

চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যা ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকার ঋণ। ফলে ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির এ চিত্র নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। ব্যাংক খাতের মতো এ সেক্টরেও খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়েই চলছে। এখনই উচিত হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর হওয়া। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর না হলে এ খাতের খেলাপি ঋণ দিন দিন আরও বাড়তে থাকবে।

ব্যাংকিং খাতকে অর্থনীতির চালিকাশক্তি বলা হয়। ব্যাংকের অন্যতম কাজ হলো দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসার চাকা সচল রাখতে ঋণ দেয়া এবং সময়মতো সে ঋণ আদায় করা। ব্যাংকের প্রধান সম্পদই হলো এ ঋণ। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিরাপদ, কল্যাণমুখী খাতে বিনিয়োগসহ শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থা অপরিহার্য। ব্যাংকের সঙ্গে যাদের লেনদেনের সম্পর্ক তারা বেশির ভাগই শিক্ষিত, সচেতন; সবারই চোখ-কান খোলা। সবাই জানে ও বুঝে, প্রশিক্ষিত ও সৎ কর্মকর্তার সমন্বয়ের সঙ্গে জনস্বার্থ, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ছাড়া কোন ব্যাংক সাফল্য অর্জন করতে পারে না।

অতীত ও বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল স্পষ্ট। দেশের ব্যাংকিং খাতে সমস্যার শেষ নেই। ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব এবং সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট না থাকার কারণেই মূলত খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগিসহ আমানত ‘খেয়ে ফেলা’য় সেখানেও খেলাপির সংখ্যা ভয়াবহ। মোটকথা, ঋণখেলাপিদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ব্যাংকিং খাত।

বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে অনিয়ম রেখে সুষম উন্নয়ন ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। সুশাসনের অভাব, উচ্চ করহার, আর্থিক অপরাধ ও চুরি এবং নীতির ধারাবাহিকতা না থাকার কারণে ব্যবসার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দিন দিন। দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যাংকিং খাতকে ইতিবাচক ধারায় রাখা এবং কোম্পানি, বীমাসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সৎ ও সহজ বোঝাপড়া দরকার, এটি যেন কেউই মনেই করেন না।

দেশের ব্যাংকিং খাত লুটপাটের এমন নিরাপদ এবং অবৈধ পথ কিন্তু এক দিনে হয়নি। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো প্রয়োজনÑএ কথা মুখে বললেও কোন গরজ নেই বা থাকলেও তা অস্পষ্ট। লুটেরাদের পক্ষে সাফাই এবং তাদের বাঁচিয়ে দেয়ার চেষ্টা সব সময়ে স্পষ্ট। দেশের ব্যাংক পরিচালকদের ঋণকা- এখন যেন তেমন কোন অপরাধের ঘটনা নয়। সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শক্ত কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় একে এক প্রকার অধিকারের মধ্যে নিয়ে এসেছেন তারা। এ ব্যাপারে অবশ্য পরিচালকদের পারস্পরিক বোঝাপড়া কিন্তু চমৎকার। ‘ভাগেযোগে’ তাদের মধ্যে বেশ মিলমিশ। তারা পরস্পর যোগসাজশে একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন একপ্রকার মামা বাড়ির মতো।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট-বিআইবিএমের গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যাংকিং খাতে সংঘটিত ৯০ শতাংশ অনিয়ম অপরাধে জড়িত ব্যাংকের নিজস্ব লোকজন। কারণ, পরিচালকদের হাতেই রয়েছে ব্যাংকের বেশির ভাগ ক্ষমতা। ফলে ঋণ খেলাপিরা শাসন বা বাধার পরিবর্তে উল্টো প্রণোদনা পেয়ে চলছেন। সভা-সেমিনারে নানা কড়া কথা বলা হলেও ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়ার ব্যাপারে সরকারের পাকা সিদ্ধান্তের আলামত অস্পষ্ট। তা ব্যাংক খাতকে বৈষম্যের খাদে ফেলে দিয়েছে। খেলাপিরা উৎসাহিত। আরো বেপরোয়া। এর বিপরীতে প্রকৃত বা ভালো গ্রাহকরা হচ্ছেন নিরুৎসাহিত। হতাশ। ব্যাংক পরিচালকরা অন্য ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণে ঋণ নিচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই এতে অন্য ঋণগ্রহীতা বঞ্চিত হচ্ছেন।

বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের বেশির ভাগই দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। ব্যাংক ব্যবসার পাশাপাশি অন্য ব্যবসাও তাদের কব্জায়। আগে পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকেই বেশি মাত্রায় ঋণ নিতেন এবং পরিশোধ করতেন না। যখন খেলাপি হয়ে যান, তখন বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে ওই ঋণ পরিশোধ দেখাতেন। আবার অনৈতিকভাবে নিজেদের ঋণের সুদ মওকুফ করে নিতেন। পরিচালকদের এ অনৈতিক কার্যক্রম ঠেকাতে নিজের ব্যাংক থেকে কী পরিমাণ ঋণ নেয়া যাবে তার একটি সীমা বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে একজন পরিচালকের নিজের ব্যাংক থেকে শেয়ার পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশ ঋণ নেয়ার বিধান রয়েছে। তবে এক ব্যাংকের পরিচালকের অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে এ রকম কোন সীমা টানা নেই। তাই পরিচালকরা কাজে লাগিয়েছেন এই সুযোগ। নিজেদের ব্যবসার প্রয়োজনে দেখিয়ে তারা অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন ফ্রি স্টাইলে।

খেলাপি কমিয়ে আনতে এই খেলাপিদের ডাউন পেমেন্টের সুবিধা দিয়ে ঋণ নিয়মিতকরণসহ আরো নানান সুবিধা দেয়া হয়েছে। এতে খেলাপি ঋণ কমেনি। আরও বেড়েছে। তাদের ঋণ দেয়ার সময় যাচাই-বাছাই থাকছে না। রাজনৈতিক সংযোগ থাকা ঋণগ্রহীতারা এমনিতেই প্রভাবশালী। ব্যাংকের পরিচালক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের শুধু ঋণের ব্যবস্থাই করেন না, ক্ষেত্রবিশেষে তোয়াজও করেন। নিষ্ঠুর ও তামাশাময় এ দৃষ্টান্ত ভাঙার কোন আলামত নেই।

কিছু কিছু ব্যাংকে অনিয়মের পাহাড় জমে গেছে। নামে-বেনামে নিজেদের মধ্যে ঋণ দেয়া হচ্ছে। আবার এসব ঋণের বিপরীতে যে পরিমাণ জামানত নেয়ার কথা তা নেওয়া হয়নি। যে পরিমাণ জামানত নেয়া হয়েছে তার গুণমান খুবই দুর্বল। ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ঋণ পরিশোধ দেখানো হচ্ছে। এভাবে খেলাপি ঋণ আড়াল হয়ে যাচ্ছে। করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা ঋণ শোধ না করেও দুই বছর ব্যাংকের খাতায় ছিলেন ভালো গ্রাহক। এখন ওই সুবিধা উঠে গেছে, তবে অনেক ব্যবসায়ী আগের মতোই ঋণ শোধ করেছেন না। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ, খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া করোনার কারণে দেয়া ছাড় উঠে যাওয়ার পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। নতুন করে অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি করোনায় অর্থনীতি গতি ধরে রাখতে যে এক লাখ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে, তারও বড় একটি অংশ অনাদায়ী হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ব্যাংকের পরিচালকদের ব্যাংক পরিচালন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। এটি অত্যন্ত সময়োপযোগী পরামর্শ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পরিচালনা পর্ষদের সদ্যদের সুপারিশে অনেক বড় বড় ঋণ দিয়ে বিপদে পড়েছে ব্যাংক। আবার কোন গ্রাহককে ঋণ দেয়ার বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদের বিভক্ত মতামতও পরিলক্ষিত হয়েছে। কু-ঋণকে কেন্দ্র করে বেশকিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বিভক্তির খবরও নানা সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে। কাজেই এসব বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ব্যাংকগুলোর বড় গ্রাহকদের পেছনে বেশি ছুটতে দেখা যায়। অথচ ব্যাংকের ঋণ আদায়ের উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধের হার ভালো। অথচ এই শ্রেণীর উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। ব্যবসার বিভিন্ন খাতে ঋণ বিতরণে একটি ব্যাংক যাতে ভারসাম্য বজায় রাখে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৮ ভাদ্র ১৪২৯ ১৫ সফর ১৪৪৪

দিনে দিনে বাড়ছে খেলাপি ঋণ

রেজাউল করিম খোকন

বর্তমানে দেশে যে সব কারণে অর্থনীতিতে সংকট বিরাজ করছে, তার মধ্যে অন্যতম খেলাপি ঋণ। নানাভাবে সরকার খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলেও আদতে সেসব উদ্যোগ তেমন ফলদায়ক হয়নি। প্রতি প্রান্তিকেই বাড়ছে খেলাপি ঋণের হার। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে উপযুক্ত গ্রাহক নির্বাচন করে ঋণ বিতরণ করা দরকার। খেলাপি ঋণ কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

২০২২ সালের জুন শেষে এনবিএফআইগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ৬৯ হাজার ৩১৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার ৯৩৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ২৩ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৪ দশমিক ২৯ শতাংশ।

চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যা ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি টাকার ঋণ। ফলে ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির এ চিত্র নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। ব্যাংক খাতের মতো এ সেক্টরেও খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়েই চলছে। এখনই উচিত হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর হওয়া। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর না হলে এ খাতের খেলাপি ঋণ দিন দিন আরও বাড়তে থাকবে।

ব্যাংকিং খাতকে অর্থনীতির চালিকাশক্তি বলা হয়। ব্যাংকের অন্যতম কাজ হলো দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসার চাকা সচল রাখতে ঋণ দেয়া এবং সময়মতো সে ঋণ আদায় করা। ব্যাংকের প্রধান সম্পদই হলো এ ঋণ। যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিরাপদ, কল্যাণমুখী খাতে বিনিয়োগসহ শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যবস্থা অপরিহার্য। ব্যাংকের সঙ্গে যাদের লেনদেনের সম্পর্ক তারা বেশির ভাগই শিক্ষিত, সচেতন; সবারই চোখ-কান খোলা। সবাই জানে ও বুঝে, প্রশিক্ষিত ও সৎ কর্মকর্তার সমন্বয়ের সঙ্গে জনস্বার্থ, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ছাড়া কোন ব্যাংক সাফল্য অর্জন করতে পারে না।

অতীত ও বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল স্পষ্ট। দেশের ব্যাংকিং খাতে সমস্যার শেষ নেই। ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম, ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক প্রভাব এবং সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট না থাকার কারণেই মূলত খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এ ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগিসহ আমানত ‘খেয়ে ফেলা’য় সেখানেও খেলাপির সংখ্যা ভয়াবহ। মোটকথা, ঋণখেলাপিদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে ব্যাংকিং খাত।

বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে অনিয়ম রেখে সুষম উন্নয়ন ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। সুশাসনের অভাব, উচ্চ করহার, আর্থিক অপরাধ ও চুরি এবং নীতির ধারাবাহিকতা না থাকার কারণে ব্যবসার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দিন দিন। দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যাংকিং খাতকে ইতিবাচক ধারায় রাখা এবং কোম্পানি, বীমাসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সৎ ও সহজ বোঝাপড়া দরকার, এটি যেন কেউই মনেই করেন না।

দেশের ব্যাংকিং খাত লুটপাটের এমন নিরাপদ এবং অবৈধ পথ কিন্তু এক দিনে হয়নি। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো প্রয়োজনÑএ কথা মুখে বললেও কোন গরজ নেই বা থাকলেও তা অস্পষ্ট। লুটেরাদের পক্ষে সাফাই এবং তাদের বাঁচিয়ে দেয়ার চেষ্টা সব সময়ে স্পষ্ট। দেশের ব্যাংক পরিচালকদের ঋণকা- এখন যেন তেমন কোন অপরাধের ঘটনা নয়। সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শক্ত কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় একে এক প্রকার অধিকারের মধ্যে নিয়ে এসেছেন তারা। এ ব্যাপারে অবশ্য পরিচালকদের পারস্পরিক বোঝাপড়া কিন্তু চমৎকার। ‘ভাগেযোগে’ তাদের মধ্যে বেশ মিলমিশ। তারা পরস্পর যোগসাজশে একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন একপ্রকার মামা বাড়ির মতো।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট-বিআইবিএমের গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যাংকিং খাতে সংঘটিত ৯০ শতাংশ অনিয়ম অপরাধে জড়িত ব্যাংকের নিজস্ব লোকজন। কারণ, পরিচালকদের হাতেই রয়েছে ব্যাংকের বেশির ভাগ ক্ষমতা। ফলে ঋণ খেলাপিরা শাসন বা বাধার পরিবর্তে উল্টো প্রণোদনা পেয়ে চলছেন। সভা-সেমিনারে নানা কড়া কথা বলা হলেও ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়ার ব্যাপারে সরকারের পাকা সিদ্ধান্তের আলামত অস্পষ্ট। তা ব্যাংক খাতকে বৈষম্যের খাদে ফেলে দিয়েছে। খেলাপিরা উৎসাহিত। আরো বেপরোয়া। এর বিপরীতে প্রকৃত বা ভালো গ্রাহকরা হচ্ছেন নিরুৎসাহিত। হতাশ। ব্যাংক পরিচালকরা অন্য ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণে ঋণ নিচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই এতে অন্য ঋণগ্রহীতা বঞ্চিত হচ্ছেন।

বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের বেশির ভাগই দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। ব্যাংক ব্যবসার পাশাপাশি অন্য ব্যবসাও তাদের কব্জায়। আগে পরিচালকরা নিজ ব্যাংক থেকেই বেশি মাত্রায় ঋণ নিতেন এবং পরিশোধ করতেন না। যখন খেলাপি হয়ে যান, তখন বেনামি ঋণ সৃষ্টি করে ওই ঋণ পরিশোধ দেখাতেন। আবার অনৈতিকভাবে নিজেদের ঋণের সুদ মওকুফ করে নিতেন। পরিচালকদের এ অনৈতিক কার্যক্রম ঠেকাতে নিজের ব্যাংক থেকে কী পরিমাণ ঋণ নেয়া যাবে তার একটি সীমা বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে একজন পরিচালকের নিজের ব্যাংক থেকে শেয়ার পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশ ঋণ নেয়ার বিধান রয়েছে। তবে এক ব্যাংকের পরিচালকের অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে এ রকম কোন সীমা টানা নেই। তাই পরিচালকরা কাজে লাগিয়েছেন এই সুযোগ। নিজেদের ব্যবসার প্রয়োজনে দেখিয়ে তারা অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন ফ্রি স্টাইলে।

খেলাপি কমিয়ে আনতে এই খেলাপিদের ডাউন পেমেন্টের সুবিধা দিয়ে ঋণ নিয়মিতকরণসহ আরো নানান সুবিধা দেয়া হয়েছে। এতে খেলাপি ঋণ কমেনি। আরও বেড়েছে। তাদের ঋণ দেয়ার সময় যাচাই-বাছাই থাকছে না। রাজনৈতিক সংযোগ থাকা ঋণগ্রহীতারা এমনিতেই প্রভাবশালী। ব্যাংকের পরিচালক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের শুধু ঋণের ব্যবস্থাই করেন না, ক্ষেত্রবিশেষে তোয়াজও করেন। নিষ্ঠুর ও তামাশাময় এ দৃষ্টান্ত ভাঙার কোন আলামত নেই।

কিছু কিছু ব্যাংকে অনিয়মের পাহাড় জমে গেছে। নামে-বেনামে নিজেদের মধ্যে ঋণ দেয়া হচ্ছে। আবার এসব ঋণের বিপরীতে যে পরিমাণ জামানত নেয়ার কথা তা নেওয়া হয়নি। যে পরিমাণ জামানত নেয়া হয়েছে তার গুণমান খুবই দুর্বল। ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ঋণ পরিশোধ দেখানো হচ্ছে। এভাবে খেলাপি ঋণ আড়াল হয়ে যাচ্ছে। করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা ঋণ শোধ না করেও দুই বছর ব্যাংকের খাতায় ছিলেন ভালো গ্রাহক। এখন ওই সুবিধা উঠে গেছে, তবে অনেক ব্যবসায়ী আগের মতোই ঋণ শোধ করেছেন না। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ, খেলাপি ঋণ আদায়ে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া করোনার কারণে দেয়া ছাড় উঠে যাওয়ার পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। নতুন করে অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার তালিকায় যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি করোনায় অর্থনীতি গতি ধরে রাখতে যে এক লাখ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে, তারও বড় একটি অংশ অনাদায়ী হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ব্যাংকের পরিচালকদের ব্যাংক পরিচালন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। এটি অত্যন্ত সময়োপযোগী পরামর্শ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পরিচালনা পর্ষদের সদ্যদের সুপারিশে অনেক বড় বড় ঋণ দিয়ে বিপদে পড়েছে ব্যাংক। আবার কোন গ্রাহককে ঋণ দেয়ার বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদের বিভক্ত মতামতও পরিলক্ষিত হয়েছে। কু-ঋণকে কেন্দ্র করে বেশকিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বিভক্তির খবরও নানা সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে। কাজেই এসব বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ব্যাংকগুলোর বড় গ্রাহকদের পেছনে বেশি ছুটতে দেখা যায়। অথচ ব্যাংকের ঋণ আদায়ের উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধের হার ভালো। অথচ এই শ্রেণীর উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। ব্যবসার বিভিন্ন খাতে ঋণ বিতরণে একটি ব্যাংক যাতে ভারসাম্য বজায় রাখে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]