অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি

নাজমুল হুদা খান

বৈশ্বিক অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে অভিবাসী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতি মজবুত করতে জোরালো ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী শ্রমবাজারে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। বিশ্বের ১৭৪টিরও বেশি দেশে প্রায় দেড় কোটি অভিবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করছে এবং শতকরা ১২% জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে। শুধু ২০২১ সালেই অভিবাসী শ্রমিকরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে ১৮৯ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। এসব অভিবাসী শ্রমিকরা উল্লিখিত দেশসমূহে হাসপাতাল, পোশাকশিল্প, বিভিন্ন কলকারখানা, অফিস, কৃষি খামার, মার্কেট, রেস্টুরেন্ট ও গৃহকর্মী ইত্যাদি কর্মকা-ে নিযুক্ত রয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকরা উপসাগরীয় দেশগুলোতে অত্যাধিক গরম, আর্দ্রতা, বায়ুদূষণ, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা, নির্যাতনমূলক কাজের পরিস্থিতিসহ অনেক সমস্যার মুখোমুখি হন।

অভিবাসী শ্রমিকদের অনেক বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়। তারা নানা ধরনের অস্বাস্থ্যকর, নোংরা ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকে।

গৃহস্থালি, রেস্টুরেন্ট, কলকারখানার গরম, আদ্র ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে হয় বলে অনেকেই ডায়রিয়া, যক্ষ্মা, চর্মরোগ, জন্ডিসসহ নানাবিধ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য রয়েছে। পশুপাখির খামারের কর্মরতদের মধ্যে যক্ষ্মা, চোখের নানাবিধ ব্যাধি এবং পেশি ও অস্থিসন্ধিতে দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা ও প্রদাহ দেখা দেয়। খনি ও অন্যান্য কারখানায় কর্মরতদের ফুসফুসের কর্মক্ষমতা হ্রাস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, প্রভৃতি রোগে ভুগতে দেখা যায়। খাবারের রেস্টুরেন্ট ও খাবার তৈরির কাজে নিয়োজিতরা খাদ্যনালি, পরিপাকতন্ত্র, লিভারসহ নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সংক্রামক ব্যাধিতে ভুগে থাকেন।

প্রবাসী শ্রমিকরা বিভিন্ন সামাজিক অসঙ্গতি, বৈষম্য ও অপরিচিত পরিবেশের কারণে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা বৃদ্ধি ঘটে।

অধিকাংশকেই অতিরিক্ত কাজের চাপে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখা যায়; তারপরও মুখ বুজে সহ্য করে এবং নিজের অসুস্থতাকে লুকিয়ে বিদেশের মাটিতে কামড়ে পড়ে থাকতে হয়। শ্রমিকদের অধিকাংশকেই নিরাপত্তাহীন বারান্দা, স্টোর রুম বা চিলেকোঠার অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে রাত্রযাপন করতে হয়। অনেকে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং ডিপ্রেশন, সিজোফ্রেনিয়াসহ নানাবিধ মানসিক ব্যধিতে আক্রান্ত হয়। এমনকি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। উপরন্তু পরিবারের কাছ থেকে দীর্ঘদিন আলাদা থাকা, সামাজিক ও পারিবারিক স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চনা, একাকিত্ব, দারিদ্র্য; সব মিলিয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়।

শ্রমিকরা অসুস্থতার পরও বিভিন্ন বাধাবিঘেœর কারণে অথবা

চিকিৎসাকেন্দ্রসমূহে প্রবেশাধিকার কিংবা ইন্স্যুরেন্স না থাকার

কারণে চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে

হাসপাতালমুখী হতে পারলেও ভাষা সমস্যা বা অদক্ষতার কারণে সঠিক চিকিৎসাটি পায় না। অনেক সময় বেতন কম পাওয়া বা বেতন না পাওয়ার ভয়ে শারীরিক অসুস্থতাকে পুষে রাখে; যা পরবর্তী সময়ে জটিল আকারে রূপ নেয়। অবৈধপথে গমনকারী বা অবৈধ ভিসা পাসপোর্টধারী শ্রমিকদের অবস্থা আরও প্রকট।

শ্রমিকরা বিদেশ গমনকালে ফিটনেস টেস্টেও বিড়ম্বনার শিকার হন; অনেক সময় মেডিকেল পরীক্ষার ফলাফল জালিয়াতি করে ফিটনেসের জন্য অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। ফিট শ্রমিককে আনফিট কিংবা আনফিটকে ফিট করতে অর্থ প্রদানে বাধ্য করা হয়।

প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ, জখম, সুচিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর অঙ্কও বিশাল। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক ও বিভিন্ন মাধ্যম সূত্র মতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়া থেকে এসেছে ৭৮৪টি এবং সৌদি আরব থেকে এসেছে ১০০৮টি লাশ। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী শ্রমিকরাও এ সময়কালে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে।

এ ছাড়া কুয়েত থেকে ২০১, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২২৮, বাহরাইন থেকে ৮৭, ওমান থেকে ২৭৬, জর্ডান থেকে ২৬, কাতার থেকে ১১০, লেবানন থেকে ৪০ সহ মোট তিন হাজার ৫৭ জনের লাশ দেশে ফিরেছে।

এ ছাড়া ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩১৫ জন, ২০১০ সালে ২ হাজার ২৯৯ জন, ২০১১ সালে ২ হাজার ২৩৫ জন, ২০১২ সালে ২ হাজার ৩৮৩ জন, ২০১৩ সালে ২ হাজার ৫৪২ জন, ২০১৪ সালে ২ হাজার ৮৭২ জন, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮৩১ জন, ২০১৬ সালে ২ হাজার ৯৮৫ জন, ২০১৭ সালে ২ হাজার ৯১৯ জনের মরদেহ দেশে ফিরেছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) প্রবাসী নারী শ্রমিকদের ওপর গবেষণার তথ্যমতে, ৩৮ শতাংশ নারী বিদেশে যাওয়ার পর শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, ৫২ শতাংশ নারী শ্রমিককে জোর করে অতিরিক্ত কাজে বাধ্য করা, ৬১ শতাংশ বিদেশে খাদ্য ও পানীর অভাব, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে তথ্য উঠে এসেছে। ৮৭ শতাংশ নারী শ্রমিক প্রবাসে সঠিক চিকিৎসাসেবা পান না বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। চাকরি হারিয়ে বা দেশে ফিরে ৮৫ শতাংশ নারী হতাশাগ্রস্ত, ৬১ শতাংশ ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন, ৫৫ শতাংশ শারীরিকভাবে ও ২৯ শতাংশ মানসিকভাবে অসুস্থতায় ভুগে থাকেন। এমনকি বিদেশ থেকে হেয়প্রতিপন্ন হয়ে দেশে ফেরত আসার পর নারী শ্রমিকরা সমাজ ও পরিবারের নিকট অসম্মানিত হচ্ছেন। ৩৮ শতাংশ নারী চরিত্রহীনা বলে গণ্য, ২৮ শতাংশ দাম্পত্য জীবন ক্ষতিগ্রস্ত এবং ১৫ শতাংশ তালাকপ্রাপ্ত হন। বিদেশ ভ্রমণে প্রাক্কালে নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও সেবাবিষয়ক তথ্যাদি পুরোপুরি অবগত করা হয় না। এবং বিদেশে তাদের চিকিৎসাসেবাবিষয়ক তথ্যসংবলিত চুক্তিনামাও অনেক ক্ষেত্রে থাকে না।

অভিবাসী শ্রমিকের স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিতের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গুরুত্বারোপ করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আইএলও) সব দেশসমূহকে অভিবাসী শ্রমিকদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে কাজ করছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসী শ্রমিক আধিকার কনভেনশন সব অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা; এমনকি অবৈধ শ্রমিকের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের ওপর জোরারোপ করেছে। সুতরাং অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাগতিক দেশসমূহকে শ্রম স্বাস্থ্য আইন সঠিকভাবে নিশ্চিতে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। শ্রমিক নিয়োগকৃত কোম্পানি সমূহকে স্বাস্থ্যসেবা চুক্তিনামা পালনে সংশ্লিষ্টদের কর্মকা-ে নজরদারি বাড়ানো উচিত। মালিকপক্ষের অভিবাসী শ্রমিকদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে এগিয়ে আসা দায়িত্ব ও কর্তব্য।

শ্রমিক নিয়োগ চুক্তিপত্রে হেলথ ইন্স্যুরেন্স, চিকিৎসা সুবিধা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, জখম ও মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়গুলো স্পষ্টিকরণ করা উচিত।

বাংলাদেশে অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি লাঘবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের আলোকে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সুনির্দিষ্ট পলিসি ও ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে। আইএলও এর সহায়তায় অভিবাসী শ্রমিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে তিন বছর মেয়াদি জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছে। অভিবাসী আইন ২০১৩ এবং অভিবাসী কল্যাণ ও নিয়োগ আইন ২০১৬ তে জখম ও মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ এবং শ্রমিকের নিরাপদ ও সম্মানজনক কাজ এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় অভিবাসীগনের সঠিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, হেলথ ইন্স্যুরেন্স, সামাজিক ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং স্বাস্থ্যগত কারণে ফেরত আসা অভিবাসী শ্রমিকের তথ্য-উপাত্তের প্রোফাইল সংরক্ষণের কাজ করছে।

অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব প্রদান করে সব অভিবাসী শ্রম আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অভিবাসী শ্রমিকের অভিবাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে পৃথক স্বায়ত্তশাসিত স্বাস্থ্য বিভাগ গঠন করা যেতে পারে।

সংশ্লিষ্ট এনজিও এবং ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করতে ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসতে হবে। অভিবাসী শ্রমিকের সমাজ ও পরিবারকে তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় ভূমিকা রাখতে হবে।

তাদের যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে মর্যাদা প্রদান করতে হবে। রাষ্ট্রের অর্থনীতি সুদৃঢ়, সামাজিক ও পরিবারের স্বচ্ছলতা আনয়নে জীবনের প্রতিটি স্তরে ঝুঁকি নিয়ে অভিবাসী শ্রমিকরা সাহসী ভূমিকা রাখছে। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংগঠনসমূহ অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও মর্যাদা সুরক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ এ বিষয়ে বহু আগেই পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন ও বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে নিজ নিজ দায়িত্বটি সুচারুরূপে পালনে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের অংশ হিসেবে তাদের পাশে সব সময় আমাদের দাঁড়াতে হবে।

[লেখক : প্রাক্তন সহকারী পরিচালক,

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা]

সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৮ ভাদ্র ১৪২৯ ১৫ সফর ১৪৪৪

অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি

নাজমুল হুদা খান

বৈশ্বিক অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে অভিবাসী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতি মজবুত করতে জোরালো ভূমিকা রাখছে। বিশ্বব্যাপী শ্রমবাজারে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। বিশ্বের ১৭৪টিরও বেশি দেশে প্রায় দেড় কোটি অভিবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করছে এবং শতকরা ১২% জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে। শুধু ২০২১ সালেই অভিবাসী শ্রমিকরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে ১৮৯ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা। এসব অভিবাসী শ্রমিকরা উল্লিখিত দেশসমূহে হাসপাতাল, পোশাকশিল্প, বিভিন্ন কলকারখানা, অফিস, কৃষি খামার, মার্কেট, রেস্টুরেন্ট ও গৃহকর্মী ইত্যাদি কর্মকা-ে নিযুক্ত রয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকরা উপসাগরীয় দেশগুলোতে অত্যাধিক গরম, আর্দ্রতা, বায়ুদূষণ, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা, নির্যাতনমূলক কাজের পরিস্থিতিসহ অনেক সমস্যার মুখোমুখি হন।

অভিবাসী শ্রমিকদের অনেক বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়। তারা নানা ধরনের অস্বাস্থ্যকর, নোংরা ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকে।

গৃহস্থালি, রেস্টুরেন্ট, কলকারখানার গরম, আদ্র ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে হয় বলে অনেকেই ডায়রিয়া, যক্ষ্মা, চর্মরোগ, জন্ডিসসহ নানাবিধ সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য রয়েছে। পশুপাখির খামারের কর্মরতদের মধ্যে যক্ষ্মা, চোখের নানাবিধ ব্যাধি এবং পেশি ও অস্থিসন্ধিতে দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা ও প্রদাহ দেখা দেয়। খনি ও অন্যান্য কারখানায় কর্মরতদের ফুসফুসের কর্মক্ষমতা হ্রাস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, প্রভৃতি রোগে ভুগতে দেখা যায়। খাবারের রেস্টুরেন্ট ও খাবার তৈরির কাজে নিয়োজিতরা খাদ্যনালি, পরিপাকতন্ত্র, লিভারসহ নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সংক্রামক ব্যাধিতে ভুগে থাকেন।

প্রবাসী শ্রমিকরা বিভিন্ন সামাজিক অসঙ্গতি, বৈষম্য ও অপরিচিত পরিবেশের কারণে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা বৃদ্ধি ঘটে।

অধিকাংশকেই অতিরিক্ত কাজের চাপে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখা যায়; তারপরও মুখ বুজে সহ্য করে এবং নিজের অসুস্থতাকে লুকিয়ে বিদেশের মাটিতে কামড়ে পড়ে থাকতে হয়। শ্রমিকদের অধিকাংশকেই নিরাপত্তাহীন বারান্দা, স্টোর রুম বা চিলেকোঠার অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে রাত্রযাপন করতে হয়। অনেকে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং ডিপ্রেশন, সিজোফ্রেনিয়াসহ নানাবিধ মানসিক ব্যধিতে আক্রান্ত হয়। এমনকি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। উপরন্তু পরিবারের কাছ থেকে দীর্ঘদিন আলাদা থাকা, সামাজিক ও পারিবারিক স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চনা, একাকিত্ব, দারিদ্র্য; সব মিলিয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়।

শ্রমিকরা অসুস্থতার পরও বিভিন্ন বাধাবিঘেœর কারণে অথবা

চিকিৎসাকেন্দ্রসমূহে প্রবেশাধিকার কিংবা ইন্স্যুরেন্স না থাকার

কারণে চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে

হাসপাতালমুখী হতে পারলেও ভাষা সমস্যা বা অদক্ষতার কারণে সঠিক চিকিৎসাটি পায় না। অনেক সময় বেতন কম পাওয়া বা বেতন না পাওয়ার ভয়ে শারীরিক অসুস্থতাকে পুষে রাখে; যা পরবর্তী সময়ে জটিল আকারে রূপ নেয়। অবৈধপথে গমনকারী বা অবৈধ ভিসা পাসপোর্টধারী শ্রমিকদের অবস্থা আরও প্রকট।

শ্রমিকরা বিদেশ গমনকালে ফিটনেস টেস্টেও বিড়ম্বনার শিকার হন; অনেক সময় মেডিকেল পরীক্ষার ফলাফল জালিয়াতি করে ফিটনেসের জন্য অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। ফিট শ্রমিককে আনফিট কিংবা আনফিটকে ফিট করতে অর্থ প্রদানে বাধ্য করা হয়।

প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ, জখম, সুচিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর অঙ্কও বিশাল। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক ও বিভিন্ন মাধ্যম সূত্র মতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়া থেকে এসেছে ৭৮৪টি এবং সৌদি আরব থেকে এসেছে ১০০৮টি লাশ। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী শ্রমিকরাও এ সময়কালে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছে।

এ ছাড়া কুয়েত থেকে ২০১, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২২৮, বাহরাইন থেকে ৮৭, ওমান থেকে ২৭৬, জর্ডান থেকে ২৬, কাতার থেকে ১১০, লেবানন থেকে ৪০ সহ মোট তিন হাজার ৫৭ জনের লাশ দেশে ফিরেছে।

এ ছাড়া ২০০৯ সালে ২ হাজার ৩১৫ জন, ২০১০ সালে ২ হাজার ২৯৯ জন, ২০১১ সালে ২ হাজার ২৩৫ জন, ২০১২ সালে ২ হাজার ৩৮৩ জন, ২০১৩ সালে ২ হাজার ৫৪২ জন, ২০১৪ সালে ২ হাজার ৮৭২ জন, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮৩১ জন, ২০১৬ সালে ২ হাজার ৯৮৫ জন, ২০১৭ সালে ২ হাজার ৯১৯ জনের মরদেহ দেশে ফিরেছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) প্রবাসী নারী শ্রমিকদের ওপর গবেষণার তথ্যমতে, ৩৮ শতাংশ নারী বিদেশে যাওয়ার পর শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, ৫২ শতাংশ নারী শ্রমিককে জোর করে অতিরিক্ত কাজে বাধ্য করা, ৬১ শতাংশ বিদেশে খাদ্য ও পানীর অভাব, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে তথ্য উঠে এসেছে। ৮৭ শতাংশ নারী শ্রমিক প্রবাসে সঠিক চিকিৎসাসেবা পান না বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। চাকরি হারিয়ে বা দেশে ফিরে ৮৫ শতাংশ নারী হতাশাগ্রস্ত, ৬১ শতাংশ ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন, ৫৫ শতাংশ শারীরিকভাবে ও ২৯ শতাংশ মানসিকভাবে অসুস্থতায় ভুগে থাকেন। এমনকি বিদেশ থেকে হেয়প্রতিপন্ন হয়ে দেশে ফেরত আসার পর নারী শ্রমিকরা সমাজ ও পরিবারের নিকট অসম্মানিত হচ্ছেন। ৩৮ শতাংশ নারী চরিত্রহীনা বলে গণ্য, ২৮ শতাংশ দাম্পত্য জীবন ক্ষতিগ্রস্ত এবং ১৫ শতাংশ তালাকপ্রাপ্ত হন। বিদেশ ভ্রমণে প্রাক্কালে নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও সেবাবিষয়ক তথ্যাদি পুরোপুরি অবগত করা হয় না। এবং বিদেশে তাদের চিকিৎসাসেবাবিষয়ক তথ্যসংবলিত চুক্তিনামাও অনেক ক্ষেত্রে থাকে না।

অভিবাসী শ্রমিকের স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিতের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গুরুত্বারোপ করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা (আইএলও) সব দেশসমূহকে অভিবাসী শ্রমিকদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে কাজ করছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসী শ্রমিক আধিকার কনভেনশন সব অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা; এমনকি অবৈধ শ্রমিকের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের ওপর জোরারোপ করেছে। সুতরাং অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাগতিক দেশসমূহকে শ্রম স্বাস্থ্য আইন সঠিকভাবে নিশ্চিতে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। শ্রমিক নিয়োগকৃত কোম্পানি সমূহকে স্বাস্থ্যসেবা চুক্তিনামা পালনে সংশ্লিষ্টদের কর্মকা-ে নজরদারি বাড়ানো উচিত। মালিকপক্ষের অভিবাসী শ্রমিকদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে এগিয়ে আসা দায়িত্ব ও কর্তব্য।

শ্রমিক নিয়োগ চুক্তিপত্রে হেলথ ইন্স্যুরেন্স, চিকিৎসা সুবিধা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, জখম ও মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়গুলো স্পষ্টিকরণ করা উচিত।

বাংলাদেশে অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি লাঘবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের আলোকে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সুনির্দিষ্ট পলিসি ও ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে। আইএলও এর সহায়তায় অভিবাসী শ্রমিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে তিন বছর মেয়াদি জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছে। অভিবাসী আইন ২০১৩ এবং অভিবাসী কল্যাণ ও নিয়োগ আইন ২০১৬ তে জখম ও মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ এবং শ্রমিকের নিরাপদ ও সম্মানজনক কাজ এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় অভিবাসীগনের সঠিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, হেলথ ইন্স্যুরেন্স, সামাজিক ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং স্বাস্থ্যগত কারণে ফেরত আসা অভিবাসী শ্রমিকের তথ্য-উপাত্তের প্রোফাইল সংরক্ষণের কাজ করছে।

অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব প্রদান করে সব অভিবাসী শ্রম আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অভিবাসী শ্রমিকের অভিবাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে পৃথক স্বায়ত্তশাসিত স্বাস্থ্য বিভাগ গঠন করা যেতে পারে।

সংশ্লিষ্ট এনজিও এবং ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করতে ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসতে হবে। অভিবাসী শ্রমিকের সমাজ ও পরিবারকে তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় ভূমিকা রাখতে হবে।

তাদের যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে মর্যাদা প্রদান করতে হবে। রাষ্ট্রের অর্থনীতি সুদৃঢ়, সামাজিক ও পরিবারের স্বচ্ছলতা আনয়নে জীবনের প্রতিটি স্তরে ঝুঁকি নিয়ে অভিবাসী শ্রমিকরা সাহসী ভূমিকা রাখছে। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংগঠনসমূহ অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও মর্যাদা সুরক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ এ বিষয়ে বহু আগেই পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন ও বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অভিবাসী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে নিজ নিজ দায়িত্বটি সুচারুরূপে পালনে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের অংশ হিসেবে তাদের পাশে সব সময় আমাদের দাঁড়াতে হবে।

[লেখক : প্রাক্তন সহকারী পরিচালক,

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা]