জাতীয় সংসদের উপনেতা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। ফুলেল শ্রদ্ধা ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ বিদায় জানানো পর গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
রাজধানী ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রোববার রাত পৌনে ১২টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের এই কা-ারি দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। উচ্চ রক্তচাপসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা নিয়ে আগস্টের শেষের দিকে ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি।
সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এই সদস্যের মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গণে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পৃথক শোক বার্তায় তারা তার রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘দেশের যেকোন সংকটময় মুহূর্তে তার অসীম সাহসিকতা ও আপোষহীন নেতৃত্ব জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছে। তার মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক শূন্যতার সৃষ্টি হলো।’
শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো এবং আমরা একজন প্রবীণ রাজনৈতিক নেত্রীকে হারালাম। সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে আমি একজন প্রকৃত অভিভাবক হারালাম।’
এছাড়া জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন।
রাতে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মরদেহ সিএমএইচেই রাখা হয়। গতকাল সকালে সিএমএইচ থেকে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মরদেহ তার নির্বাচনী এলাকা ফরিদপুরের নগরকান্দায় নিয়ে যাওয়া হয়।
নগরকান্দার উপজেলার নারায়ণ অ্যাকাডেমি মাঠে বেলা সোয়া ১১টায় তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন নগরকান্দা মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক ইসমাতুল্লাহ কাসেমী। এতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাবৃন্দসহ দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন।
জানাজা শেষে ফরিদপুর থেকে মরদেহ ঢাকায় এনে বিকেল ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মরদেহ রাখা হলে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধায় সিক্ত হোন।
শুরুতেই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষ থেকে সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহ উদ্দিন ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল কবির আহমেদ, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এরপর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, হাছান মাহমুদ, দীপু মনিসহ কেন্দ্রীয় নেতারা শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দলের সংকটে তিনি সাহসী নেতা ছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি রণাঙ্গনেও ছিলেন সৈনিক। স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর দেশ পুনর্গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। তারপর আবার সংকট, রক্তাক্ত পঁচাত্তরের পর প্রত্যেকটি সংকটে তিনি ছিলেন। অনেকে জানে না, তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অনেক দিন বন্দী ছিলেন। তার শূন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়।’
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ১৪ দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু। আমির হোসেন আমু বলেন, ‘তিনি একজন অকুতোভয় নির্ভীক সৈনিক ছিলেন। সংকটকালে তিনি সরে যাননি। আপস নিয়ে রাজনীতি করেননি। নতুন প্রজন্মকে ওনার নেতৃত্ব অনুসরণ করা উচিত। তার এই প্রস্থান দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’
রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি, শফিউদ্দিন মোল্লার নেতৃত্বে জাসদ, রেজাউর রশিদের নেতৃত্বে বাসদ, এস কে শিকদারের নেতৃত্বে গণ-আজাদী লীগের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়া গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দলসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
পরে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এছাড়া শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ফরিদপুর-২ আসনের নির্বাচনে সাজেদা চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রয়াত বিএনপি মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে শামা ওবায়েদ।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মরদেহ নেয়া হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন যুবলীগ, কৃষকলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকা ও জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলীয় নেতারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বাদ আছর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে মরহুমের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব মাওলানা মো. রুহুল আমীন জানাজায় ইমামতি করেন।
এসময় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছোট ছেলে শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরী বলেন, ‘আমার আম্মা দেশের জন্য ও আওয়ামী লীগের জন্য আজীবন কাজ করেছেন। তিনি সবসময় দেশের মানুষের কথা ভাবতেন। আপনারা সবাই তার জন্য দোয়া করবেন।’
দ্বিতীয় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সৈয়দা সাজেদা চৌধরীর মরহেদ দাফন হয়। সাজেদা চৌধুরীর মরদেহ বনানী কবরস্থানে পৌঁছালে স্যালুট জানায় পুলিশ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী।
বর্ণাঢ্য জীবন
১৯৩৫ সালের ৮ মে মাগুরা জেলায় মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তার পিতার নাম সৈয়দ শাহ হামিদ উল্লাহ এবং মাতা সৈয়দা আছিয়া খাতুন। শিক্ষাজীবনে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তার স্বামী রাজনীতিবিদ এবং সমাজকর্মী গোলাম আকবর চৌধুরী। তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। গোলাম আকবর চৌধুরী ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর মারা গিয়েছিলেন।
সাজেদা তরুণ বয়সেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৬৯ সালে তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন সাজেদা চৌধুরী, তখন কলকাতা গোবরা নার্সিং ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ডের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে বাংলাদেশ গার্লস গাইডের ন্যাশনাল কমিশনারও ছিলেন তিনি।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সাজেদা। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে দেশে ফেরার পর তার সঙ্গেও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন সাজেদা। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯২ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীতে ছিলেন।
ফরিদপুর-২ আসন থেকে তিনি অনেকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম সংসদেও তিনি নির্বাচিত হন। এরপর বারবার তিনি ওই আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে টানা সংসদ উপনেতার পদে ছিলেন তিনি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বও শেখ হাসিনা তাকে দিয়েছিলেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনে গঠিত সংসদীয় বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১৯৭৪ সালে গ্রামীণ উন্নয়ন ও শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য ইউনেসকো ফেলোশিপ পান। একই সময়ে তিনি বাংলাদেশ গার্ল-গাইড অ্যাসোসিয়েশনের জাতীয় কমিশনার হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানসূচক সনদ সিলভার এলিফ্যান্ট পদক লাভ করেন। তিনি ২০০০ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট কর্তৃক ওমেন অব দি ইয়ার নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর কফিনে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা -সংবাদ
আরও খবরমঙ্গলবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৯ ভাদ্র ১৪২৯ ১৬ সফর ১৪৪৪
নিজস্ব বার্তা পরিবেশক
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর কফিনে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা -সংবাদ
জাতীয় সংসদের উপনেতা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। ফুলেল শ্রদ্ধা ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ বিদায় জানানো পর গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
রাজধানী ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রোববার রাত পৌনে ১২টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের এই কা-ারি দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। উচ্চ রক্তচাপসহ বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যা নিয়ে আগস্টের শেষের দিকে ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি।
সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এই সদস্যের মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গণে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পৃথক শোক বার্তায় তারা তার রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘দেশের যেকোন সংকটময় মুহূর্তে তার অসীম সাহসিকতা ও আপোষহীন নেতৃত্ব জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছে। তার মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক শূন্যতার সৃষ্টি হলো।’
শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো এবং আমরা একজন প্রবীণ রাজনৈতিক নেত্রীকে হারালাম। সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুতে আমি একজন প্রকৃত অভিভাবক হারালাম।’
এছাড়া জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন।
রাতে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মরদেহ সিএমএইচেই রাখা হয়। গতকাল সকালে সিএমএইচ থেকে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মরদেহ তার নির্বাচনী এলাকা ফরিদপুরের নগরকান্দায় নিয়ে যাওয়া হয়।
নগরকান্দার উপজেলার নারায়ণ অ্যাকাডেমি মাঠে বেলা সোয়া ১১টায় তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন নগরকান্দা মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক ইসমাতুল্লাহ কাসেমী। এতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাবৃন্দসহ দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন।
জানাজা শেষে ফরিদপুর থেকে মরদেহ ঢাকায় এনে বিকেল ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মরদেহ রাখা হলে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধায় সিক্ত হোন।
শুরুতেই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষ থেকে সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহ উদ্দিন ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল কবির আহমেদ, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এরপর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মতিয়া চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, হাছান মাহমুদ, দীপু মনিসহ কেন্দ্রীয় নেতারা শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দলের সংকটে তিনি সাহসী নেতা ছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক বড় অধ্যায় জুড়ে রয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি রণাঙ্গনেও ছিলেন সৈনিক। স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর দেশ পুনর্গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। তারপর আবার সংকট, রক্তাক্ত পঁচাত্তরের পর প্রত্যেকটি সংকটে তিনি ছিলেন। অনেকে জানে না, তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অনেক দিন বন্দী ছিলেন। তার শূন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়।’
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ১৪ দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু। আমির হোসেন আমু বলেন, ‘তিনি একজন অকুতোভয় নির্ভীক সৈনিক ছিলেন। সংকটকালে তিনি সরে যাননি। আপস নিয়ে রাজনীতি করেননি। নতুন প্রজন্মকে ওনার নেতৃত্ব অনুসরণ করা উচিত। তার এই প্রস্থান দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’
রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে ওয়ার্কার্স পার্টি, শফিউদ্দিন মোল্লার নেতৃত্বে জাসদ, রেজাউর রশিদের নেতৃত্বে বাসদ, এস কে শিকদারের নেতৃত্বে গণ-আজাদী লীগের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়া গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দলসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
পরে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এছাড়া শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ফরিদপুর-২ আসনের নির্বাচনে সাজেদা চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রয়াত বিএনপি মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে শামা ওবায়েদ।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মরদেহ নেয়া হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন যুবলীগ, কৃষকলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। আওয়ামী লীগের দলীয় পতাকা ও জাতীয় পতাকায় মোড়ানো কফিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলীয় নেতারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বাদ আছর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে মরহুমের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব মাওলানা মো. রুহুল আমীন জানাজায় ইমামতি করেন।
এসময় সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর ছোট ছেলে শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরী বলেন, ‘আমার আম্মা দেশের জন্য ও আওয়ামী লীগের জন্য আজীবন কাজ করেছেন। তিনি সবসময় দেশের মানুষের কথা ভাবতেন। আপনারা সবাই তার জন্য দোয়া করবেন।’
দ্বিতীয় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সৈয়দা সাজেদা চৌধরীর মরহেদ দাফন হয়। সাজেদা চৌধুরীর মরদেহ বনানী কবরস্থানে পৌঁছালে স্যালুট জানায় পুলিশ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী।
বর্ণাঢ্য জীবন
১৯৩৫ সালের ৮ মে মাগুরা জেলায় মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তার পিতার নাম সৈয়দ শাহ হামিদ উল্লাহ এবং মাতা সৈয়দা আছিয়া খাতুন। শিক্ষাজীবনে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তার স্বামী রাজনীতিবিদ এবং সমাজকর্মী গোলাম আকবর চৌধুরী। তাদের তিন ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। গোলাম আকবর চৌধুরী ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর মারা গিয়েছিলেন।
সাজেদা তরুণ বয়সেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৬৯ সালে তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন সাজেদা চৌধুরী, তখন কলকাতা গোবরা নার্সিং ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৫ সালে তিনি বাংলাদেশ নারী পুনর্বাসন বোর্ডের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে বাংলাদেশ গার্লস গাইডের ন্যাশনাল কমিশনারও ছিলেন তিনি।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সাজেদা। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে দেশে ফেরার পর তার সঙ্গেও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন সাজেদা। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯২ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীতে ছিলেন।
ফরিদপুর-২ আসন থেকে তিনি অনেকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম সংসদেও তিনি নির্বাচিত হন। এরপর বারবার তিনি ওই আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে টানা সংসদ উপনেতার পদে ছিলেন তিনি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্বও শেখ হাসিনা তাকে দিয়েছিলেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনে গঠিত সংসদীয় বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।
সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ১৯৭৪ সালে গ্রামীণ উন্নয়ন ও শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য ইউনেসকো ফেলোশিপ পান। একই সময়ে তিনি বাংলাদেশ গার্ল-গাইড অ্যাসোসিয়েশনের জাতীয় কমিশনার হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানসূচক সনদ সিলভার এলিফ্যান্ট পদক লাভ করেন। তিনি ২০০০ সালে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট কর্তৃক ওমেন অব দি ইয়ার নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে।