শব্দদূষণমুক্ত জীবনের প্রত্যাশা

জনসংখ্যার সঙ্গে ঢাকায় বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা; বাড়ছে রাস্তাঘাট, অট্টালিকা, মেগা প্রজেক্টের সংখ্যাও। ফলে দিন দিন বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হচ্ছে ঢাকা; নষ্ট হচ্ছে এর প্রাকৃতিক ভারসাম্য। যান আর জনের চাপে দূষিত হচ্ছে ঢাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, দৃশ্যদূষণ, পানিদূষণ, বস্তি সমস্যা, যানজট ইত্যাদি বাড়ছে তরতর গতিতে। পরিবেশগত এসব সমস্যাগুলো দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতার হচ্ছে। ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এসব। বিশেষ করে বায়ুদূষণ আর শব্দদূষণে ঢাকা যে কত নাজুক অবস্থায় আছে, তা বলাই বাহুল্য।

বায়ুদূষণ আর শব্দদূষণের বিপর্যস্ত অবস্থার কথা উঠে এসেছে সাম্প্রতিক কয়েকটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনেও। কিছু দিন আগেই বিশ্বের দূষিত বায়ুর দেশের তালিকার শীর্ষ স্থানে নাম আসে বাংলাদেশের। সে রেশ কাটতে না কাটতেই শব্দদূষণে ঢাকার শীর্ষস্থান দখল নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দদূষণের মাত্রা বিশ্লেষণ করে করা ‘ফ্রন্টিয়ার্স ২০২২ : নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, শব্দদূষণে বিশ্বে ঢাকা এখন শীর্ষস্থান দখলকরী শহর।

ঢাকার পরেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে ভারতের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। প্রতিবেদন অনুযায়ী শীর্ষে অবস্থানকারী পাঁচটি শহরের চারটি-ই দক্ষিণ এশিয়ার। যার মধ্যে আবার দুটিই বাংলাদেশের। ঢাকা ছাড়া অন্যটি চতুর্থ অবস্থানে থাকা রাজশাহী। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর বাণিজ্যিক এলাকায় তা ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল। সুতরাং ঢাকা ও রাজশাহীর শব্দের তীব্রতা যে কত ভয়াবহ অবস্থায় আছে, তা এ প্রতিবেদন থেকে সহজেই অনুমেয়। রিপোর্টে বাংলাদেশের আরও একটি শহরের কথা উঠে এসেছেÑ টাঙ্গাইল। যেখানে শব্দের তীব্রতা ৭৫ ডেসিবেল। এটি শীর্ষ পাঁচ বা শীর্ষ দশে না থাকলেও একটি দেশেরই তিনটি শহর শব্দদূষণের তালিকায় থাকা কম উদ্বেগের বিষয় নয়।

এলাকাভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা থাকলেও কখনো তা ঠিকমত মানা হয়না। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬- এ বলা হয়েছে, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা, যেখানে কোন ধরনের হর্ন বাজানো যাবে না। অথচ কি হাসপাতাল, কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অফিস-আদালত, সব জায়গায়-ই হরহামেশাই চলে শব্দের ঝনঝনানি। আইনে আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন চালানোয় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানার বালাই নেই।

ঢাকা শহরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রায়শই দেখা যায় দিন নেই রাত নেই চলছে পাইলিংয়ের কাজ; যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে ইট ভাঙার যন্ত্র বা সিমেন্ট মিকচারের। টাইলস, থাই, রড কাটার মেশিন, ড্রিল মেশিনের কাজ করাতো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এমনকি গভীর রাতেও চলে এসব নির্মাণকাজ। যদিও আইনে বলা আছে সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত মিকচার মেশিনসহ নির্মাণকাজে ব্যবহৃত কোনো যন্ত্র চালানো যাবে না। এতে আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে এবং তারা কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’। এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা করার সময় নেই যেন কারও!

শব্দের স্বাভাবিক বা সহনীয় মাত্রা ৫৫ থেকে ৬০ ডেসিবেল। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেলের অধিক শব্দ যদি দীর্ঘসময় ধরে থাকে তাহলে সাময়িক বধিরতা আর ১০০ ডেসিবেলের বেশি হলে স্থায়ী বধিরতা হতে পারে। উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃদ্রোগ, মেজাজ তিরিক্ষি হওয়া, আলসার, হাইপার টেনশন, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি হ্রাস, স্নায়ুর সমস্যা ও বিরক্তিভাব তৈরি হতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে শিশু এবং বয়স্কদের।

এমনকি শব্দদূষণের কারণে ব্যাহত হতে পারে উদ্ভিদের পরাগায়ন; কম হতে পারে ফসলের উৎপাদন; বাধাগ্রস্ত হতে পারে পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের বংশবিস্তার। ইতিমধ্যে ঢাকা শহরে কাকসহ অন্যান্য পাখি ও কীটপতঙ্গের পরিমাণ কমে গেছে বলে গবেষকরা মনে করছেন। অর্থাৎ শব্দদূষণ এখন শুধু একটি দূষণই নয়, বরং এক ধরনের শব্দ সন্ত্রাস, যা নীরবে তিলে তিলে আমাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যে কারণে শব্দদূষণকে এখন নীরব ঘাতক বলেও অভিহিত করা হচ্ছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই নীরব ঘাতক শব্দদূষণের সৃষ্টিকর্তা আমরা নিজেরাই। আমরা অসচেতনভাবেই মাত্রাতিরিক্ত শব্দ তৈরি করে নিজেদের বিপদের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছি।

বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, ঢাকা শহরের শব্দদূষণের অন্যতম উৎস যানবাহন ও মোটরবাইকের হর্ন। ২০১৭ সালে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরের শব্দদূষণের ওপর করা এক জরিপ বলছে, ৮টি শহরেই ৮০ শতাংশ শব্দদূষণ করে যানবাহনের হর্ন। ২০ শতাংশ বাকিগুলো। আর ৮০ শতাংশের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের হর্ন। এ ছাড়া উড়োজাহাজের শব্দ, রেলগাড়ির শব্দ, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও শিল্পকারখানার শব্দ, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলোর হর্ন ইত্যাদি শব্দদূষণের অন্যতম কারণ। এর সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান,বিশেষ দিবস, বিভিন্ন উৎসব ও বিনোদনমূলক আয়োজন এবং নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণাকে কেন্দ্র করে উচ্চশব্দে বাজানো মাইক বা সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহারও শব্দদূষণের উল্লেখযোগ্য কারণ বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

শব্দদূষণ যেহেতু অসচেতনতা আর অবহেলার কারণে আমাদের দ্বারাই সৃষ্টি হচ্ছে, তাই একটু সচেতন হলেই এটি থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। শব্দদূষণের অন্যতম একটি কারণ যানজটে আটকে থাকা গাড়ির হর্ন। আর যানজটের অন্যতম কারণ ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি। তাই ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে আধুনিক পরিবেশসম্মত গণপরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এতে শব্দদূষণ যেমন কমবে, তেমনি কমবে যানজট সমস্যাও। শব্দদূষণের ক্ষেত্রে হাইড্রোলিক হর্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।

তাই মোটরসাইকেলসহ সব যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে কঠোর অভিযান চালাতে হবে। সে সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীরা কোনভাবেই যাতে এটি আমদানি, সরবরাহ ও বিক্রি না করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা শহরের শব্দদূষণ আরেকটি কারণ দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা। এ জন্য ট্রাফিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই। রাস্তায় লেন সিস্টেম বাস্তবায়নসহ আধুনিক ও ডিজিটালাইজড ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় মাইকের অতিরঞ্জিত ব্যবহার রোধে মাইক, সাউন্ড বক্স, লাউড স্পিকারের সংখ্যা নির্ধারণসহ এসব অনুষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ও সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহ আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারি ছুটির দিনগুলো বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত শব্দ উৎপত্তিকারক যন্ত্রের অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার রোধে বিদ্যমান ভবন নির্মাণ নীতিমালা ও শব্দদূষণ বিধিমালার বাস্তবায়ন নিশ্চিতকল্পে কঠোর দমন অভিযান চলমান রাখতে হবে। শব্দদূষণের অপকারিতা ও ক্ষতি সম্পর্কে চালক, মালিক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনাতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রচার পত্র, সামাজিক, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতামূলক তথ্য প্রচার করতে হবে। বিদ্যমান শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী, আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।

কিন্তু বাস্তবে এই আইনের তেমন প্রয়োগতো দেখা যায়-ই না, অধিকন্তু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ আইন অকার্যকর বলে মনে করেন আইনবিদরা। তাই এই আইনের সংস্কারসহ তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি সচেতনতার কোন বিকল্প নাই। আমরা যদি সচেতন হই, যথাযথ আইন মেনে চলি, তবে শব্দ সন্ত্রাস বা নীরব ঘাতক যাই বলি না কেন, খুব সহজেই তা প্রতিহত করা সম্ভব হবে। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে এই নীরব ঘাতক অদূর ভবিষ্যতে যে আমাদরকে একটি বধির, বিকলাঙ্গ ও অতিশয় খিটখিটে মেজাজওয়ালা জাতি উপহার দেবে, তা বলাই বাহুল্য।

[লেখক : প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ,

সাভার সরকারি কলেজ]

মঙ্গলবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৯ ভাদ্র ১৪২৯ ১৬ সফর ১৪৪৪

শব্দদূষণমুক্ত জীবনের প্রত্যাশা

মনিরুল হক রনি

জনসংখ্যার সঙ্গে ঢাকায় বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা; বাড়ছে রাস্তাঘাট, অট্টালিকা, মেগা প্রজেক্টের সংখ্যাও। ফলে দিন দিন বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হচ্ছে ঢাকা; নষ্ট হচ্ছে এর প্রাকৃতিক ভারসাম্য। যান আর জনের চাপে দূষিত হচ্ছে ঢাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, দৃশ্যদূষণ, পানিদূষণ, বস্তি সমস্যা, যানজট ইত্যাদি বাড়ছে তরতর গতিতে। পরিবেশগত এসব সমস্যাগুলো দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতার হচ্ছে। ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এসব। বিশেষ করে বায়ুদূষণ আর শব্দদূষণে ঢাকা যে কত নাজুক অবস্থায় আছে, তা বলাই বাহুল্য।

বায়ুদূষণ আর শব্দদূষণের বিপর্যস্ত অবস্থার কথা উঠে এসেছে সাম্প্রতিক কয়েকটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনেও। কিছু দিন আগেই বিশ্বের দূষিত বায়ুর দেশের তালিকার শীর্ষ স্থানে নাম আসে বাংলাদেশের। সে রেশ কাটতে না কাটতেই শব্দদূষণে ঢাকার শীর্ষস্থান দখল নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দদূষণের মাত্রা বিশ্লেষণ করে করা ‘ফ্রন্টিয়ার্স ২০২২ : নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক প্রতিবেদন বলছে, শব্দদূষণে বিশ্বে ঢাকা এখন শীর্ষস্থান দখলকরী শহর।

ঢাকার পরেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে ভারতের মুরাদাবাদ ও পাকিস্তানের ইসলামাবাদ। প্রতিবেদন অনুযায়ী শীর্ষে অবস্থানকারী পাঁচটি শহরের চারটি-ই দক্ষিণ এশিয়ার। যার মধ্যে আবার দুটিই বাংলাদেশের। ঢাকা ছাড়া অন্যটি চতুর্থ অবস্থানে থাকা রাজশাহী। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর বাণিজ্যিক এলাকায় তা ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকায় এই মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল ও রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল। সুতরাং ঢাকা ও রাজশাহীর শব্দের তীব্রতা যে কত ভয়াবহ অবস্থায় আছে, তা এ প্রতিবেদন থেকে সহজেই অনুমেয়। রিপোর্টে বাংলাদেশের আরও একটি শহরের কথা উঠে এসেছেÑ টাঙ্গাইল। যেখানে শব্দের তীব্রতা ৭৫ ডেসিবেল। এটি শীর্ষ পাঁচ বা শীর্ষ দশে না থাকলেও একটি দেশেরই তিনটি শহর শব্দদূষণের তালিকায় থাকা কম উদ্বেগের বিষয় নয়।

এলাকাভেদে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা থাকলেও কখনো তা ঠিকমত মানা হয়না। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬- এ বলা হয়েছে, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা, যেখানে কোন ধরনের হর্ন বাজানো যাবে না। অথচ কি হাসপাতাল, কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অফিস-আদালত, সব জায়গায়-ই হরহামেশাই চলে শব্দের ঝনঝনানি। আইনে আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন চালানোয় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানার বালাই নেই।

ঢাকা শহরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রায়শই দেখা যায় দিন নেই রাত নেই চলছে পাইলিংয়ের কাজ; যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে ইট ভাঙার যন্ত্র বা সিমেন্ট মিকচারের। টাইলস, থাই, রড কাটার মেশিন, ড্রিল মেশিনের কাজ করাতো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এমনকি গভীর রাতেও চলে এসব নির্মাণকাজ। যদিও আইনে বলা আছে সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত মিকচার মেশিনসহ নির্মাণকাজে ব্যবহৃত কোনো যন্ত্র চালানো যাবে না। এতে আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে এবং তারা কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’। এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা করার সময় নেই যেন কারও!

শব্দের স্বাভাবিক বা সহনীয় মাত্রা ৫৫ থেকে ৬০ ডেসিবেল। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবেলের অধিক শব্দ যদি দীর্ঘসময় ধরে থাকে তাহলে সাময়িক বধিরতা আর ১০০ ডেসিবেলের বেশি হলে স্থায়ী বধিরতা হতে পারে। উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃদ্রোগ, মেজাজ তিরিক্ষি হওয়া, আলসার, হাইপার টেনশন, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি হ্রাস, স্নায়ুর সমস্যা ও বিরক্তিভাব তৈরি হতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে শিশু এবং বয়স্কদের।

এমনকি শব্দদূষণের কারণে ব্যাহত হতে পারে উদ্ভিদের পরাগায়ন; কম হতে পারে ফসলের উৎপাদন; বাধাগ্রস্ত হতে পারে পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের বংশবিস্তার। ইতিমধ্যে ঢাকা শহরে কাকসহ অন্যান্য পাখি ও কীটপতঙ্গের পরিমাণ কমে গেছে বলে গবেষকরা মনে করছেন। অর্থাৎ শব্দদূষণ এখন শুধু একটি দূষণই নয়, বরং এক ধরনের শব্দ সন্ত্রাস, যা নীরবে তিলে তিলে আমাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যে কারণে শব্দদূষণকে এখন নীরব ঘাতক বলেও অভিহিত করা হচ্ছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই নীরব ঘাতক শব্দদূষণের সৃষ্টিকর্তা আমরা নিজেরাই। আমরা অসচেতনভাবেই মাত্রাতিরিক্ত শব্দ তৈরি করে নিজেদের বিপদের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছি।

বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, ঢাকা শহরের শব্দদূষণের অন্যতম উৎস যানবাহন ও মোটরবাইকের হর্ন। ২০১৭ সালে বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরের শব্দদূষণের ওপর করা এক জরিপ বলছে, ৮টি শহরেই ৮০ শতাংশ শব্দদূষণ করে যানবাহনের হর্ন। ২০ শতাংশ বাকিগুলো। আর ৮০ শতাংশের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই হচ্ছে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের হর্ন। এ ছাড়া উড়োজাহাজের শব্দ, রেলগাড়ির শব্দ, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও শিল্পকারখানার শব্দ, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলোর হর্ন ইত্যাদি শব্দদূষণের অন্যতম কারণ। এর সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান,বিশেষ দিবস, বিভিন্ন উৎসব ও বিনোদনমূলক আয়োজন এবং নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণাকে কেন্দ্র করে উচ্চশব্দে বাজানো মাইক বা সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহারও শব্দদূষণের উল্লেখযোগ্য কারণ বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

শব্দদূষণ যেহেতু অসচেতনতা আর অবহেলার কারণে আমাদের দ্বারাই সৃষ্টি হচ্ছে, তাই একটু সচেতন হলেই এটি থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। শব্দদূষণের অন্যতম একটি কারণ যানজটে আটকে থাকা গাড়ির হর্ন। আর যানজটের অন্যতম কারণ ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি। তাই ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে আধুনিক পরিবেশসম্মত গণপরিবহনের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এতে শব্দদূষণ যেমন কমবে, তেমনি কমবে যানজট সমস্যাও। শব্দদূষণের ক্ষেত্রে হাইড্রোলিক হর্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।

তাই মোটরসাইকেলসহ সব যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধে কঠোর অভিযান চালাতে হবে। সে সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীরা কোনভাবেই যাতে এটি আমদানি, সরবরাহ ও বিক্রি না করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা শহরের শব্দদূষণ আরেকটি কারণ দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থা। এ জন্য ট্রাফিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই। রাস্তায় লেন সিস্টেম বাস্তবায়নসহ আধুনিক ও ডিজিটালাইজড ট্রাফিক ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় মাইকের অতিরঞ্জিত ব্যবহার রোধে মাইক, সাউন্ড বক্স, লাউড স্পিকারের সংখ্যা নির্ধারণসহ এসব অনুষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ও সময়সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহ আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারি ছুটির দিনগুলো বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত শব্দ উৎপত্তিকারক যন্ত্রের অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার রোধে বিদ্যমান ভবন নির্মাণ নীতিমালা ও শব্দদূষণ বিধিমালার বাস্তবায়ন নিশ্চিতকল্পে কঠোর দমন অভিযান চলমান রাখতে হবে। শব্দদূষণের অপকারিতা ও ক্ষতি সম্পর্কে চালক, মালিক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনাতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রচার পত্র, সামাজিক, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতনতামূলক তথ্য প্রচার করতে হবে। বিদ্যমান শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী, আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।

কিন্তু বাস্তবে এই আইনের তেমন প্রয়োগতো দেখা যায়-ই না, অধিকন্তু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ আইন অকার্যকর বলে মনে করেন আইনবিদরা। তাই এই আইনের সংস্কারসহ তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি সচেতনতার কোন বিকল্প নাই। আমরা যদি সচেতন হই, যথাযথ আইন মেনে চলি, তবে শব্দ সন্ত্রাস বা নীরব ঘাতক যাই বলি না কেন, খুব সহজেই তা প্রতিহত করা সম্ভব হবে। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে এই নীরব ঘাতক অদূর ভবিষ্যতে যে আমাদরকে একটি বধির, বিকলাঙ্গ ও অতিশয় খিটখিটে মেজাজওয়ালা জাতি উপহার দেবে, তা বলাই বাহুল্য।

[লেখক : প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ,

সাভার সরকারি কলেজ]