অমর একুশের সত্তর বছরে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই

মোস্তাফা জব্বার

সুখের বিষয় প্রথমে শহীদ লিপি ও এরপর বিজয়ের জন্ম হওয়ার পর প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার সংকট সম্পূর্ণভাবে কেটে যায়। ৮৭-৮৮ সালে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে আমার তৈরি বিজয় বাংলা কিবোর্ড ও সফটওয়্যার প্রচলনের ফলে বাংলাদেশের প্রকাশনা এক অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছেছে।

১০৮টি বাংলা ফন্ট এবং ম্যাক, উইন্ডোজ, অ্যান্ড্রয়েড ও লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমে এটি প্রচলিত হওয়ার ফলে বাংলা প্রকাশনা মাধুর্য্যময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়েছে। বাংলা একাডেমির

একুশে বইমেলায় প্রকাশিত সকল বই বিজয় দিয়ে প্রকাশিত হয়। দেশের সব সাইনবোর্ড, ব্যানার পোস্টার ইত্যাদি বিজয় ব্যবহার করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রচেষ্টায় ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামেও বাংলা প্রতিষ্ঠিত ভাষা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। ৯১ সালে ইউনিকোড এনকোডিং চালু ও ২০০৫ সালে বিজয় এর ইউনিকোড সংস্করণ চালু হওয়ার পর প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের সংকট একদমই দূরীভূত হয়। এই এনকোডিং ব্যবহার ও সেই অনুপাতে সব ডিজিটাল যন্ত্রে লেখালেখি করার জন্য সফটওয়্যার থাকার ফলে বাংলা প্রযুক্তিতে সম্পূর্ণ সক্ষম একটি ভাষা হয়ে উঠেছে। যদিও ইউনিকোড বা আইকানের সঙ্গে বাংলা প্রচলন বিষয়ে ছোটখাটো কিছু সমস্যা নিয়ে এখনো কাজ করতে হচ্ছে তথাপি কেউ বলতে পারবেনা যে কোন ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা ব্যবহার করা যায় না। এরই সুফল আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা তথ্যবিন্যাসে এখন ব্যাপকভাবেই বাংলার ব্যবহার হচ্ছে। তবে আরও কিছু কারিগরি সক্ষমতা অর্জন করার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এটি একটি সুখবর যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল বিজয়কে বাংলার প্রমিত কিবোর্ড হিসেবে প্রমিত করেছে ২০১৮ সালে। অবস্থা এমন যে ইংরেজি প্রকাশনা বন্ধ হচ্ছে। টিভি চ্যানেলের নামে ইংরেজি ও অনুষ্ঠানে বা বিজ্ঞাপনে বাংলার অপব্যবহার থাকলেও বাংলাই তাদের প্রধান প্রচার মাধ্যম। অন্তত ইংরেজিমিশ্রিত বাংলা তাদের ব্যবহার করতেই হয়। ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে বাংলা ব্যবহৃত হয়।

যন্ত্রের সংকট, পরিভাষার সংকট, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহারের অভিজ্ঞতার অভাব এমনকি দক্ষ টাইপিস্টের অভাবেও বঙ্গবন্ধু সর্বশক্তি দিয়ে সরকারের ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলার সেই সুদিন আর থাকেনি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে সবকিছুর ইংরেজিয়ানা চালু করেন এবং তার আমলেই বাংলার দাপ্তরিক প্রচলন কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় গিয়ে নামে। জয় বাংলাকে তিনি যেমন বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বানান তেমন করে বাংলাকে ইংরেজি দিয়ে স্থলাভিষিক্ত করেন। এরপর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন করলেও বাংলা প্রচলনের স্রোতটাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে পারেননি। বর্তমান সরকার স্বৈরাচারী সরকারসমূহের স্র্রোতটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। কিন্তু এটি বাস্তবতা যে বঙ্গবন্ধু অতি স্বল্প সময়ে যতটা পথ এগুতে পেরেছিলেন আমরা ততটা পথ পাড়ি দিতে পারিনি। সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহার ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হলেও মানুষের জীবনের সর্বস্তরে এর বিস্তারকে আমরা ব্যাপক করতে পারিনি। বরং এটি বাস্তবতা যে সরকারে বাংলা ভাষা প্রচলনের অগ্রগতি হলেও সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের যে আকাক্সক্ষাটি আমাদের রয়েছে সেটির পুরোপুরি বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। বরং প্রযুক্তিগত সব সক্ষমতা থাকার পরেও বাংলা ভাষাকে শেকলবন্দী করার, বাংলা হরফকে বিদায় করার ও ডিজিটাইজেসনের নামে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা বর্ণকে স্থলাভিষিক্ত করার একটি অস্থির প্রক্রিয়া চারপাশে চলমান দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষদের কেউ কেউ এখন বিণা দ্বিধায় রোমান হরফ ব্যবহার করে। ফলে বাংলা ভাষার পাশাপাশি বিপন্ন বাংলা হরফ।

সাম্প্রতিককালে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখার একটি প্রবণতা দিনে দিনে সম্প্রসারিত হচ্ছে। রোমান হরফে বাংলা লেখা বইও নাকি প্রকাশিত হয়েছে। আমি চারপাশে এই রোমান হরফের জয় জয়কার দেখতে পাই। কেউ যদি রোমান হরফ দিয়ে মেইল খুলে বা ফেসবুকের আইডি খুলে তবে তাকে আমি তেমন দায়ী করব না। এমন হতে পারে যে বাংলা হরফ যে এসব খাতে ব্যবহার করা যায় সেটি হয়তো তারা জানেনা। রোমান হরফ ব্যবহার করতে করতে এটি হয়তো তাদের প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা লেখার অদক্ষতাকেও বিবেচনায় নিতে হবে।

আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে বাংলা বা ইংরেজি কোন ভাষার টাইপিং শেখানো হয় না। সারাজীবন তাদের এই অদক্ষতার ভার বহন করতে হয়। ডিজিটাল যুগে সেটি আরও প্রকট হয়েছে। ওরা কোন পেশাদারি কোর্স করলে বা অন্য কোথাও বাংলা টাইপ করতে গেলে প্রায়ই রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লিখতে শেখানো হয়। বিশেষত ইন্টারনেটে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখার একটি হুজুগ কাজ করে। এর সূচনাটি মোবাইল দিয়ে হয়তো শুরু। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে যে সরকার তার নিজের প্রমিত কিবোর্ড সরকারি অফিসে ব্যবহার করায় না। যার যা খুশি সেটাই ব্যবহার করা হয়। বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে চালু করার ক্ষেত্রে এটি হচ্ছে একটি বিশালতম অন্তরায়।

রোমান হরফ দিয়ে আমরা এসএমএস পাঠাতাম বা ফেসবুকে ও মেইলে রোমান হরফ ব্যবহার করতাম যখন এসব ক্ষেত্রে বাংলা লেখার সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখন যখন সব ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা লেখার সুযোগ রয়েছে, তখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেজে রোমান হরফ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। অথচ প্রকৃত অবস্থা হলো ইন্টারনেটে রোমান হরফে বাংলা লেখার কোন প্রয়োজনীয়তাই নেই। ওখানে বাংলা লেখার সব সুবিধাই বিরাজ করে। কারিগরি দিক থেকে মোবাইলে বাংলা প্রচলনে কোন অসুবিধা নেই। এরই মাঝে সরকার সব মোবাইলে বাংলা থাকা বাধ্যতামূলকও করেছে। সরকার মোবাইলের সব তথ্য ব্যবহারকারীকে বাংলা ভাষায় প্রদানের নিয়ম বাধ্যতামূলক করেছে। ফলে মানসিকতা ঠিক করতে পারলে মোবাইলে বাংলা লেখা পরিপূর্র্ণভাবে সফল হবে। অন্যদিকে শুধু মোবাইল ফোনে নয়, অন্য ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার রোমানাইজেশন আরও প্রবলভাবে হচ্ছে। ইন্টারনেট থেকে ফ্রি ডাউনলোড করা যায় এমন একাধিক বাংলা সফটওয়্যারে ইংেরজিতে বাংলা লিখলে সেটি বাংলা হরফে পরিণত হয়। ফলে বাংলা লেখার জন্য বাংলা হরফ জানার দরকার হয় না। যদিও এই পদ্ধতিতে বাংলা পুরোপুরি লেখা যায় না, নির্ভুলভাবে লেখা যায় না বা দ্রুতগতিতে লেখা যায় না তথাপি এটি দিনে দিনে জনপ্রিয় হচ্ছে। কিছু লোক যে কোনভাবে, যে কোন বানানে বা যে কোন উচ্চারণে এভাবে বাংলা লিখছে। বাংলা বিকৃত হলেও তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। আমি আগেই বলেছি এই পদ্ধতিকে সহায়তা করেছে কিছু বিদেশি সংস্থা ও তাদের উপকারভোগী বিভিন্ন সংস্থা। খুব সহজেই তাদের কর্মকা- থেকে ধরে নেয়া যায় যে, বাংলা ভাষা রোমান হরফে লেখার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা এসব মহলের একান্ত দায়িত্ব হয়ে আছে।

যদি আরও একটু গভীরে তাকাই তবে আমরা বাংলা ভাষা ও হরফকে নিয়ে আরও অনেক ষড়যন্ত্র দেখতে পাবো। বাংলা ভাষার হরফ পরিবর্তন, যুক্তাক্ষর বাদ দেওয়া, অক্ষরের আকৃতি বদলানো, মূল বর্ণের কয়েকটিকে বাদ দেয়া, বানান ও ব্যাকরণ সংস্কার বা লেখন পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রস্তাবও দেখেছি আমরা। এমনকি যুক্তাক্ষর বর্জন করার প্রস্তাবও আমরা দেখেছি। যন্ত্রে প্রয়োগ করার নামে, ভাষাকে সহজ করার নামে, ব্যবহারের সুলভ পথ খোঁজে বের করার নামে এসব নানা প্রসঙ্গ বহুদিন ধরে বহুভাবেই আলোচিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় এসব প্রস্তাবের পক্ষের ও বিপক্ষের মানুষদের নাম-ধাম সবই পাওয়া যাবে। আমি সেই মহামানবদের নাম পুনরায় স্মরণ করাতে চাই না। তবে কষ্ট হয়, যখন দেখি আমাদের কাছে সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরাও এসব অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তবে আমাদের জন্য সবচেয়ে সুখের বিষয়টি হলো এতসব প্রস্তাবনার পরেও বাংলা ভাষাকে কেউ এখন পর্যন্ত তার মূল স্র্রোত থেকে সরাতে পারেনি। এখনো বাংলা ভাষার হরফমালা অবিকৃত রয়েছে। কেউ কোন হরফকে বাদ দিতে পারেনি বা নতুন কোন পদ্ধতি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেনি।

এখনো বাংলা ভাষার বানানে বৈচিত্র্য রয়েছে এবং নানাভাবে নানা শব্দে বাংলা ভাষা প্রতিদিনই সমৃদ্ধ হচ্ছে। বরং নানা আক্রমণে, নানা বিবর্তনে বাংলা ভাষা তার অকৃত্রিমতা হারায়নি।

কিন্তু বাংলা ভাষার সংকট রয়ে গেছে। এই ভাষার সবচেয়ে বড় সংকটটি হচ্ছে বাংলা প্রচলনে সব মহলের আন্তরিকতার অভাব। এটি বিস্ময়কর মনে হতে পারে যে, বাংলা ভাষার নামে জন্ম নেওয়া দেশে সেই ভাষার জন্য সবার পৃষ্ঠপোষকতা যথাযথ নয় কেন? যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন করতে হবে। যদিও সরকারের প্রধান ব্যবহারগুলো বাংলাকেন্দ্রিক তথাপি উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহার না হওয়াটাও দুঃখজনক। ওখানে বিচারক বাঙালি, বাদি বিবাদি বাঙালি আইন বাংলায় অথচ বিচারকার্য এমনকি রায়ও বাংলাতে হয় না। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেই শেকলটা আমরা ভাঙতে পারিনি। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলন করতে না পারার জন্য একটি মাত্র বিধি (দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারা) সংশোধন করার কথা বলা হয়েছে। এটি কি আমরা ভাবতে পারি যে, এত বছরে একটি বিধি সংশোধন করা যায় না? অন্যদিকে সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও বেশ কিছু বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

সরকারি ডিপিপিগুলো এখনো ইংরেজিতে হয়। অথচ ডিপিপি বাংলায় তৈরিতে কোন অসুবিধা নেই। এমনকি বিদেশিরাও মত দিয়েছে যে বাংলা ডিপিপিতে তাদের কোন সমস্যা হয় না।

গাইডলাইন বা নীতিমালাগুলো ইংরেজির বদলে বাংলায় করা যায়। এখন অবশ্য ইংরেজিকেও বাংলায় রূপান্তর করা হচ্ছে বা অন্তত দ্বিভাষিক করা হচ্ছে। টেলিকম নীতিমালা ও আগের আইনগুলো আমি বাংলা করছি। সরকারি উপস্থাপনাগুলো বাংলাতেই হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই এখন সেটি হচ্ছে।

সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাগুলো বাংলায় সাইনবোর্ড ঝুলানো বাধ্যতামূলক করতে পারে। ২২ সালের একুশে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে এমন একটি উদ্যোগ নিতে দেখেছি। তবে একুশে ফেব্রুয়ারির পর আবার তা হারিয়ে গেছে। আমি কোন কারণ খুঁজে পাই না বাংলাদেশের সাইনবোর্ড কেন বাংলা বর্ণে লেখা হবে না।

একটি অতি দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে যে উচ্চশিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো আমরা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় প্রাপ্ত জ্ঞানভা-ারকে বাংলায় রূপান্তর করিনি। অথচ খুব সহজেই পাঠ্যবই বা বিশ্বের জ্ঞানভা-ার বাংলায় অনুবাদ করা যায়। বাংলা একাডেমি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এই দায়িত্ব নিতে পারে।

এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও এই দায়িত্ব নিতে পারে। অথচ কারও পক্ষ থেকেই এমন উদ্যোগ নেয়ার লক্ষ্মণই দেখছি না।

বাংলা শেখার ক্ষেত্রেও সংকট আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শতকরা দশভাগের এক ভাগেও বাংলা শেখানো হয়না। যে কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো হয় সেগুলোই বাংলায় প্রশাসন চালায় না। তাদের কর্মকা-ে বাংলা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। একই অবস্থা আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে। তারাও তাদের কাজকর্মে বাংলা ব্যবহার করে না। অথচ বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে এমনকি ব্যাঙ্কগুলোও তাদের সব কাজ বাংলায় করত। আন্তর্জাতিক যোগাযোগে ইংরেজি ব্যবহার হতেই পারে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে ইংরেজি ব্যবহার করার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। কিন্তু সেটিই হচ্ছে।

বাংলার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরির জন্য ২০১৭ সালে শুরু করা সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতায় চলমান বাংলা ভাষার উন্নয়ন প্রকল্পটির কাজ অত্যন্তু দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা উচিত। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ইংরেজি বা রোমান

ভাষাগুলোর মতোই দক্ষতাসম্পন্ন হবে। বাংলা বানান শুদ্ধকরণ, ব্যাকরণ শুদ্ধকরণ, কথা থেকে লেখা ও লেখা থেকে কথায় রূপান্তর, ওসিআর, স্বয়ংক্রিয় অনুবাদ ইত্যাদি সবই বাংলায় করা সম্ভব হবে। পাঁচটি বছর যাওয়ার পরও কাজটি তেমন আগায়নি। অমর একুশের ৭০ বছর পূর্তিতে দুটি সুখবর দিতে পারি। এবার আমরা বাংলা এসএমএসের দাম অর্ধেক করার পাশাপাশি মোবাইল থেকে গ্রাহকের কাছে সব তথ্য বাংলায় দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছি।

ঢাকা। ২২ এপ্রিল, ২০২২। আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক, ডিজিটাল প্রযুক্তির অনেক ট্রেডমার্ক, প্যাটেন্ট ও কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী]

মঙ্গলবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ২৯ ভাদ্র ১৪২৯ ১৬ সফর ১৪৪৪

অমর একুশের সত্তর বছরে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই

মোস্তাফা জব্বার

সুখের বিষয় প্রথমে শহীদ লিপি ও এরপর বিজয়ের জন্ম হওয়ার পর প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার সংকট সম্পূর্ণভাবে কেটে যায়। ৮৭-৮৮ সালে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে আমার তৈরি বিজয় বাংলা কিবোর্ড ও সফটওয়্যার প্রচলনের ফলে বাংলাদেশের প্রকাশনা এক অসাধারণ উচ্চতায় পৌঁছেছে।

১০৮টি বাংলা ফন্ট এবং ম্যাক, উইন্ডোজ, অ্যান্ড্রয়েড ও লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমে এটি প্রচলিত হওয়ার ফলে বাংলা প্রকাশনা মাধুর্য্যময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়েছে। বাংলা একাডেমির

একুশে বইমেলায় প্রকাশিত সকল বই বিজয় দিয়ে প্রকাশিত হয়। দেশের সব সাইনবোর্ড, ব্যানার পোস্টার ইত্যাদি বিজয় ব্যবহার করে। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রচেষ্টায় ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামেও বাংলা প্রতিষ্ঠিত ভাষা হিসেবে গণ্য হচ্ছে। ৯১ সালে ইউনিকোড এনকোডিং চালু ও ২০০৫ সালে বিজয় এর ইউনিকোড সংস্করণ চালু হওয়ার পর প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের সংকট একদমই দূরীভূত হয়। এই এনকোডিং ব্যবহার ও সেই অনুপাতে সব ডিজিটাল যন্ত্রে লেখালেখি করার জন্য সফটওয়্যার থাকার ফলে বাংলা প্রযুক্তিতে সম্পূর্ণ সক্ষম একটি ভাষা হয়ে উঠেছে। যদিও ইউনিকোড বা আইকানের সঙ্গে বাংলা প্রচলন বিষয়ে ছোটখাটো কিছু সমস্যা নিয়ে এখনো কাজ করতে হচ্ছে তথাপি কেউ বলতে পারবেনা যে কোন ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা ব্যবহার করা যায় না। এরই সুফল আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা তথ্যবিন্যাসে এখন ব্যাপকভাবেই বাংলার ব্যবহার হচ্ছে। তবে আরও কিছু কারিগরি সক্ষমতা অর্জন করার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। এটি একটি সুখবর যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল বিজয়কে বাংলার প্রমিত কিবোর্ড হিসেবে প্রমিত করেছে ২০১৮ সালে। অবস্থা এমন যে ইংরেজি প্রকাশনা বন্ধ হচ্ছে। টিভি চ্যানেলের নামে ইংরেজি ও অনুষ্ঠানে বা বিজ্ঞাপনে বাংলার অপব্যবহার থাকলেও বাংলাই তাদের প্রধান প্রচার মাধ্যম। অন্তত ইংরেজিমিশ্রিত বাংলা তাদের ব্যবহার করতেই হয়। ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে বাংলা ব্যবহৃত হয়।

যন্ত্রের সংকট, পরিভাষার সংকট, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহারের অভিজ্ঞতার অভাব এমনকি দক্ষ টাইপিস্টের অভাবেও বঙ্গবন্ধু সর্বশক্তি দিয়ে সরকারের ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাংলার সেই সুদিন আর থাকেনি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে সবকিছুর ইংরেজিয়ানা চালু করেন এবং তার আমলেই বাংলার দাপ্তরিক প্রচলন কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় গিয়ে নামে। জয় বাংলাকে তিনি যেমন বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বানান তেমন করে বাংলাকে ইংরেজি দিয়ে স্থলাভিষিক্ত করেন। এরপর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন করলেও বাংলা প্রচলনের স্রোতটাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে পারেননি। বর্তমান সরকার স্বৈরাচারী সরকারসমূহের স্র্রোতটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। কিন্তু এটি বাস্তবতা যে বঙ্গবন্ধু অতি স্বল্প সময়ে যতটা পথ এগুতে পেরেছিলেন আমরা ততটা পথ পাড়ি দিতে পারিনি। সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহার ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হলেও মানুষের জীবনের সর্বস্তরে এর বিস্তারকে আমরা ব্যাপক করতে পারিনি। বরং এটি বাস্তবতা যে সরকারে বাংলা ভাষা প্রচলনের অগ্রগতি হলেও সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের যে আকাক্সক্ষাটি আমাদের রয়েছে সেটির পুরোপুরি বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। বরং প্রযুক্তিগত সব সক্ষমতা থাকার পরেও বাংলা ভাষাকে শেকলবন্দী করার, বাংলা হরফকে বিদায় করার ও ডিজিটাইজেসনের নামে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা বর্ণকে স্থলাভিষিক্ত করার একটি অস্থির প্রক্রিয়া চারপাশে চলমান দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষদের কেউ কেউ এখন বিণা দ্বিধায় রোমান হরফ ব্যবহার করে। ফলে বাংলা ভাষার পাশাপাশি বিপন্ন বাংলা হরফ।

সাম্প্রতিককালে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখার একটি প্রবণতা দিনে দিনে সম্প্রসারিত হচ্ছে। রোমান হরফে বাংলা লেখা বইও নাকি প্রকাশিত হয়েছে। আমি চারপাশে এই রোমান হরফের জয় জয়কার দেখতে পাই। কেউ যদি রোমান হরফ দিয়ে মেইল খুলে বা ফেসবুকের আইডি খুলে তবে তাকে আমি তেমন দায়ী করব না। এমন হতে পারে যে বাংলা হরফ যে এসব খাতে ব্যবহার করা যায় সেটি হয়তো তারা জানেনা। রোমান হরফ ব্যবহার করতে করতে এটি হয়তো তাদের প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা লেখার অদক্ষতাকেও বিবেচনায় নিতে হবে।

আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে বাংলা বা ইংরেজি কোন ভাষার টাইপিং শেখানো হয় না। সারাজীবন তাদের এই অদক্ষতার ভার বহন করতে হয়। ডিজিটাল যুগে সেটি আরও প্রকট হয়েছে। ওরা কোন পেশাদারি কোর্স করলে বা অন্য কোথাও বাংলা টাইপ করতে গেলে প্রায়ই রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লিখতে শেখানো হয়। বিশেষত ইন্টারনেটে রোমান হরফ দিয়ে বাংলা লেখার একটি হুজুগ কাজ করে। এর সূচনাটি মোবাইল দিয়ে হয়তো শুরু। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে যে সরকার তার নিজের প্রমিত কিবোর্ড সরকারি অফিসে ব্যবহার করায় না। যার যা খুশি সেটাই ব্যবহার করা হয়। বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে চালু করার ক্ষেত্রে এটি হচ্ছে একটি বিশালতম অন্তরায়।

রোমান হরফ দিয়ে আমরা এসএমএস পাঠাতাম বা ফেসবুকে ও মেইলে রোমান হরফ ব্যবহার করতাম যখন এসব ক্ষেত্রে বাংলা লেখার সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখন যখন সব ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা লেখার সুযোগ রয়েছে, তখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেজে রোমান হরফ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। অথচ প্রকৃত অবস্থা হলো ইন্টারনেটে রোমান হরফে বাংলা লেখার কোন প্রয়োজনীয়তাই নেই। ওখানে বাংলা লেখার সব সুবিধাই বিরাজ করে। কারিগরি দিক থেকে মোবাইলে বাংলা প্রচলনে কোন অসুবিধা নেই। এরই মাঝে সরকার সব মোবাইলে বাংলা থাকা বাধ্যতামূলকও করেছে। সরকার মোবাইলের সব তথ্য ব্যবহারকারীকে বাংলা ভাষায় প্রদানের নিয়ম বাধ্যতামূলক করেছে। ফলে মানসিকতা ঠিক করতে পারলে মোবাইলে বাংলা লেখা পরিপূর্র্ণভাবে সফল হবে। অন্যদিকে শুধু মোবাইল ফোনে নয়, অন্য ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষার রোমানাইজেশন আরও প্রবলভাবে হচ্ছে। ইন্টারনেট থেকে ফ্রি ডাউনলোড করা যায় এমন একাধিক বাংলা সফটওয়্যারে ইংেরজিতে বাংলা লিখলে সেটি বাংলা হরফে পরিণত হয়। ফলে বাংলা লেখার জন্য বাংলা হরফ জানার দরকার হয় না। যদিও এই পদ্ধতিতে বাংলা পুরোপুরি লেখা যায় না, নির্ভুলভাবে লেখা যায় না বা দ্রুতগতিতে লেখা যায় না তথাপি এটি দিনে দিনে জনপ্রিয় হচ্ছে। কিছু লোক যে কোনভাবে, যে কোন বানানে বা যে কোন উচ্চারণে এভাবে বাংলা লিখছে। বাংলা বিকৃত হলেও তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। আমি আগেই বলেছি এই পদ্ধতিকে সহায়তা করেছে কিছু বিদেশি সংস্থা ও তাদের উপকারভোগী বিভিন্ন সংস্থা। খুব সহজেই তাদের কর্মকা- থেকে ধরে নেয়া যায় যে, বাংলা ভাষা রোমান হরফে লেখার যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা এসব মহলের একান্ত দায়িত্ব হয়ে আছে।

যদি আরও একটু গভীরে তাকাই তবে আমরা বাংলা ভাষা ও হরফকে নিয়ে আরও অনেক ষড়যন্ত্র দেখতে পাবো। বাংলা ভাষার হরফ পরিবর্তন, যুক্তাক্ষর বাদ দেওয়া, অক্ষরের আকৃতি বদলানো, মূল বর্ণের কয়েকটিকে বাদ দেয়া, বানান ও ব্যাকরণ সংস্কার বা লেখন পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রস্তাবও দেখেছি আমরা। এমনকি যুক্তাক্ষর বর্জন করার প্রস্তাবও আমরা দেখেছি। যন্ত্রে প্রয়োগ করার নামে, ভাষাকে সহজ করার নামে, ব্যবহারের সুলভ পথ খোঁজে বের করার নামে এসব নানা প্রসঙ্গ বহুদিন ধরে বহুভাবেই আলোচিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় এসব প্রস্তাবের পক্ষের ও বিপক্ষের মানুষদের নাম-ধাম সবই পাওয়া যাবে। আমি সেই মহামানবদের নাম পুনরায় স্মরণ করাতে চাই না। তবে কষ্ট হয়, যখন দেখি আমাদের কাছে সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরাও এসব অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। তবে আমাদের জন্য সবচেয়ে সুখের বিষয়টি হলো এতসব প্রস্তাবনার পরেও বাংলা ভাষাকে কেউ এখন পর্যন্ত তার মূল স্র্রোত থেকে সরাতে পারেনি। এখনো বাংলা ভাষার হরফমালা অবিকৃত রয়েছে। কেউ কোন হরফকে বাদ দিতে পারেনি বা নতুন কোন পদ্ধতি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারেনি।

এখনো বাংলা ভাষার বানানে বৈচিত্র্য রয়েছে এবং নানাভাবে নানা শব্দে বাংলা ভাষা প্রতিদিনই সমৃদ্ধ হচ্ছে। বরং নানা আক্রমণে, নানা বিবর্তনে বাংলা ভাষা তার অকৃত্রিমতা হারায়নি।

কিন্তু বাংলা ভাষার সংকট রয়ে গেছে। এই ভাষার সবচেয়ে বড় সংকটটি হচ্ছে বাংলা প্রচলনে সব মহলের আন্তরিকতার অভাব। এটি বিস্ময়কর মনে হতে পারে যে, বাংলা ভাষার নামে জন্ম নেওয়া দেশে সেই ভাষার জন্য সবার পৃষ্ঠপোষকতা যথাযথ নয় কেন? যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন করতে হবে। যদিও সরকারের প্রধান ব্যবহারগুলো বাংলাকেন্দ্রিক তথাপি উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহার না হওয়াটাও দুঃখজনক। ওখানে বিচারক বাঙালি, বাদি বিবাদি বাঙালি আইন বাংলায় অথচ বিচারকার্য এমনকি রায়ও বাংলাতে হয় না। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সেই শেকলটা আমরা ভাঙতে পারিনি। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলন করতে না পারার জন্য একটি মাত্র বিধি (দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারা) সংশোধন করার কথা বলা হয়েছে। এটি কি আমরা ভাবতে পারি যে, এত বছরে একটি বিধি সংশোধন করা যায় না? অন্যদিকে সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও বেশ কিছু বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

সরকারি ডিপিপিগুলো এখনো ইংরেজিতে হয়। অথচ ডিপিপি বাংলায় তৈরিতে কোন অসুবিধা নেই। এমনকি বিদেশিরাও মত দিয়েছে যে বাংলা ডিপিপিতে তাদের কোন সমস্যা হয় না।

গাইডলাইন বা নীতিমালাগুলো ইংরেজির বদলে বাংলায় করা যায়। এখন অবশ্য ইংরেজিকেও বাংলায় রূপান্তর করা হচ্ছে বা অন্তত দ্বিভাষিক করা হচ্ছে। টেলিকম নীতিমালা ও আগের আইনগুলো আমি বাংলা করছি। সরকারি উপস্থাপনাগুলো বাংলাতেই হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই এখন সেটি হচ্ছে।

সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাগুলো বাংলায় সাইনবোর্ড ঝুলানো বাধ্যতামূলক করতে পারে। ২২ সালের একুশে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে এমন একটি উদ্যোগ নিতে দেখেছি। তবে একুশে ফেব্রুয়ারির পর আবার তা হারিয়ে গেছে। আমি কোন কারণ খুঁজে পাই না বাংলাদেশের সাইনবোর্ড কেন বাংলা বর্ণে লেখা হবে না।

একটি অতি দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে যে উচ্চশিক্ষার বাহন হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো আমরা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় প্রাপ্ত জ্ঞানভা-ারকে বাংলায় রূপান্তর করিনি। অথচ খুব সহজেই পাঠ্যবই বা বিশ্বের জ্ঞানভা-ার বাংলায় অনুবাদ করা যায়। বাংলা একাডেমি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এই দায়িত্ব নিতে পারে।

এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও এই দায়িত্ব নিতে পারে। অথচ কারও পক্ষ থেকেই এমন উদ্যোগ নেয়ার লক্ষ্মণই দেখছি না।

বাংলা শেখার ক্ষেত্রেও সংকট আছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শতকরা দশভাগের এক ভাগেও বাংলা শেখানো হয়না। যে কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো হয় সেগুলোই বাংলায় প্রশাসন চালায় না। তাদের কর্মকা-ে বাংলা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। একই অবস্থা আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে। তারাও তাদের কাজকর্মে বাংলা ব্যবহার করে না। অথচ বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে এমনকি ব্যাঙ্কগুলোও তাদের সব কাজ বাংলায় করত। আন্তর্জাতিক যোগাযোগে ইংরেজি ব্যবহার হতেই পারে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে ইংরেজি ব্যবহার করার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। কিন্তু সেটিই হচ্ছে।

বাংলার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরির জন্য ২০১৭ সালে শুরু করা সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতায় চলমান বাংলা ভাষার উন্নয়ন প্রকল্পটির কাজ অত্যন্তু দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা উচিত। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ইংরেজি বা রোমান

ভাষাগুলোর মতোই দক্ষতাসম্পন্ন হবে। বাংলা বানান শুদ্ধকরণ, ব্যাকরণ শুদ্ধকরণ, কথা থেকে লেখা ও লেখা থেকে কথায় রূপান্তর, ওসিআর, স্বয়ংক্রিয় অনুবাদ ইত্যাদি সবই বাংলায় করা সম্ভব হবে। পাঁচটি বছর যাওয়ার পরও কাজটি তেমন আগায়নি। অমর একুশের ৭০ বছর পূর্তিতে দুটি সুখবর দিতে পারি। এবার আমরা বাংলা এসএমএসের দাম অর্ধেক করার পাশাপাশি মোবাইল থেকে গ্রাহকের কাছে সব তথ্য বাংলায় দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছি।

ঢাকা। ২২ এপ্রিল, ২০২২। আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২।

[লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাসের চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কিবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং বিজয় ডিজিটাল শিক্ষা সফটওয়্যারের উদ্ভাবক, ডিজিটাল প্রযুক্তির অনেক ট্রেডমার্ক, প্যাটেন্ট ও কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী]