নানা সংকটে মৃৎশিল্প : ভালো নেই কারিগররা

ভাল নেই দিনাজপুর ঘোড়াঘাটের মৃৎশিল্পের কারিগররা। বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখতে আর সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। আগের মতো নেই আর মাটির পাত্রের চাহিদা। চাহিদা নেই খেলনাসহ মনোহারি পণ্যেরও। শুধু কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের চাহিদা আছে। কিন্তু টিকে থাকার মতো বাজারদর নেই সেগুলোর। সেই সঙ্গে মাটিসহ কাঁচামালের দূষ্প্রাপ্যতা পরিস্থিাতি আরো কঠিন করে দিয়েছে।

আগের যুগে পূর্ব পুরুষরা নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক হিসেবে মাটির তৈরি থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিল, ঘটি-বাটি, বদনা ইত্যাদি ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন সময় এই শিল্প নানা রূপ নানা রঙে সামনে বৈচিত্র নিয়ে হাজির হয়েছে। কিন্তু সেই মাটির তৈরী শিল্পই বর্তমানে হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মাটি দিয়ে কুমাররা তাদের হাতের নিপুণ স্পর্শে কারু কাজের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের জিনিস তৈরী করে। এক কালে মাটির তৈরী শিল্প আমাদের পরিবারের নিত্য দিনের ব্যবহার্য বস্তু ছিল। আস্তে আস্তে এখন এই শিল্পটি মৃত প্রায়! কুমাররা অসম্ভব শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মধ্যে লুকায়িত মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধানো সব কারু কাজ করে থাকেন।

নকশা করা হাঁড়িপাতিল, চাড়ি, কলস, বদনা, পুতুল, ফুলের টব, ফুলদানী, জীবজন্তু, পাখিসহ বাংলার চিরাচরিত সব নিদর্শণ উঠে আসে তাদের তৈরি এসব শিল্পে। প্রযুক্তির অগ্রতি আর বিজ্ঞানের জয়ের ফসল হিসেবে কমদামে অধিক টেকসই সিলভার, মেলামাইন, প্লাস্টিক তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর দাপটে মৃৎ শিল্পের তৈরি সামগ্রীর চাহিদা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। মৃৎ শিল্পের ইতিহাস শত বছরের। এক সময় কুমারদের হাতে তৈরি মাটির জিনিস পত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে মাটি তৈরি হাড়ি-পাতিলের চাহিদা থাকলেও বিলুপ্তির পথে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎ শিল্প। মৃৎ শিল্পের জায়গা দখল করে নিয়েছে সিলভার, প্লাস্টিক ও মেলামাই সামগ্রী।

এই উপজেলার মধ্যে কুমার পরিবার রয়েছে প্রায় অর্ধশত তার মধ্যে পৌরসভায় রয়েছে প্রায় ৪৭ থেকে ৪৮টি পরিবার। এসব পরিবারে শতাধিক সদস্য এখনও মাটির তৈরি জিনিসপত্র নিজ হাতে তৈরী করে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায়। তবে প্লাস্টিকের তৈরি আধুনিক জিনিসপত্রের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কদর কমেছে মাটির তৈরি জিনিস পত্রের। তাই বেকার হয়ে পড়েছে মাটির কারিগর কুমাররা। এরই মধ্যে এই অঞ্চলের অনেকেই কুমার পেশা পরিবর্তন করে ফেলেছেন।

এখন তাদের কেউ পোশাক তৈরির কারখানায়, কেউ দর্জির, কেউ বা আবার পুরানো কাগজ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রির করার কাজ বেছে নিয়েছেন। কুমারদের সব বাড়িতে দিন রাত চলছে কুমারদের কাজ। কেউ মাটিতে পানি মিশিয়ে কাঁদা নরম করছে, কেউ মাটির তৈরি জিনিস রোদে শুকানোর কাজ করছে, কেউ মাটির হাড়িগুলো পোড়ানোর কাজ করছে। আবার অনেকের জিনিসপত্রে রং-তুলির কাজে ব্যস্ত।

ঘোড়াঘাট উপজেলার কুমাররা দিনাজপুর -৬ আসনের এমপি শিবলী সাদিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, যদি আমাদের মাটির কাজকে একটু প্রাধান্য দিয়ে মাটির তৈরি জিনিসের দাম বাড়িয়ে এ খাতে সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন তাহলে হয়তো বা মাটির শিল্পটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো।

স্থানীয়রা জানান, এক সময় মাটির তৈরি জিনিসপত্রের বহু মাত্রিক ব্যবহার ছিল। এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হতো। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মাটির পণ্য বোঝাই ‘ভার’ নিয়ে গ্রাম-গঞ্জে ও পাড়া মহল্লায় বিক্রি করতেন কুমাররা। ভারে থাকত পাতিল, গামলা, দুধের পাত্র, পিঠা তৈরির পণ্য সড়া, চাড়ি গরুর খাবার পাত্র চাড়ি, ধান-চাল রাখার ছোট-বড় পাত্র, কড়াই, মাটির ব্যাংক, শিশুদের জন্য রকমারি নক্সার পুতুল, খেলনা ও মাটির তৈরি পশু পাখিসহ নানান পণ্য। এ সব পন্য ধান বা খাদ্যশস্য ও টাকার বিনিময়ে বিক্রি করতেন। সন্ধ্যায় ধান বোঝাই ভার নিয়ে বাড়ি ফিরতেন তারা।

ওই ধান বিক্রি করে চলত তাদের সংসার খরচ। সেই দিন এখন সুদূর অতীত। তবু পেশা সংশ্লিষ্টদের আশা, হয়তো আবার কদর বাড়বে মাটির পণ্যের। তখন হয়তো পরিবারে ফিরবে সচ্ছলতা। এখন তাদের মানবেতর দিন কাটালেও সেই সুদিনের অপেক্ষায় আজও সকাল-সন্ধ্যা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তারা।

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ৩০ ভাদ্র ১৪২৯ ১৭ সফর ১৪৪৪

নানা সংকটে মৃৎশিল্প : ভালো নেই কারিগররা

প্রতিনিধি, দিনাজপুর

image

দিনাজপুর : ঘোড়াঘাট উপজেলায় মাটি দিয়ে ফুলের টব তৈরি করছেন কারিগররা -সংবাদ

ভাল নেই দিনাজপুর ঘোড়াঘাটের মৃৎশিল্পের কারিগররা। বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখতে আর সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। আগের মতো নেই আর মাটির পাত্রের চাহিদা। চাহিদা নেই খেলনাসহ মনোহারি পণ্যেরও। শুধু কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের চাহিদা আছে। কিন্তু টিকে থাকার মতো বাজারদর নেই সেগুলোর। সেই সঙ্গে মাটিসহ কাঁচামালের দূষ্প্রাপ্যতা পরিস্থিাতি আরো কঠিন করে দিয়েছে।

আগের যুগে পূর্ব পুরুষরা নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক হিসেবে মাটির তৈরি থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিল, ঘটি-বাটি, বদনা ইত্যাদি ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন সময় এই শিল্প নানা রূপ নানা রঙে সামনে বৈচিত্র নিয়ে হাজির হয়েছে। কিন্তু সেই মাটির তৈরী শিল্পই বর্তমানে হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মাটি দিয়ে কুমাররা তাদের হাতের নিপুণ স্পর্শে কারু কাজের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের জিনিস তৈরী করে। এক কালে মাটির তৈরী শিল্প আমাদের পরিবারের নিত্য দিনের ব্যবহার্য বস্তু ছিল। আস্তে আস্তে এখন এই শিল্পটি মৃত প্রায়! কুমাররা অসম্ভব শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মধ্যে লুকায়িত মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধানো সব কারু কাজ করে থাকেন।

নকশা করা হাঁড়িপাতিল, চাড়ি, কলস, বদনা, পুতুল, ফুলের টব, ফুলদানী, জীবজন্তু, পাখিসহ বাংলার চিরাচরিত সব নিদর্শণ উঠে আসে তাদের তৈরি এসব শিল্পে। প্রযুক্তির অগ্রতি আর বিজ্ঞানের জয়ের ফসল হিসেবে কমদামে অধিক টেকসই সিলভার, মেলামাইন, প্লাস্টিক তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর দাপটে মৃৎ শিল্পের তৈরি সামগ্রীর চাহিদা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। মৃৎ শিল্পের ইতিহাস শত বছরের। এক সময় কুমারদের হাতে তৈরি মাটির জিনিস পত্রের ব্যাপক চাহিদা ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে মাটি তৈরি হাড়ি-পাতিলের চাহিদা থাকলেও বিলুপ্তির পথে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎ শিল্প। মৃৎ শিল্পের জায়গা দখল করে নিয়েছে সিলভার, প্লাস্টিক ও মেলামাই সামগ্রী।

এই উপজেলার মধ্যে কুমার পরিবার রয়েছে প্রায় অর্ধশত তার মধ্যে পৌরসভায় রয়েছে প্রায় ৪৭ থেকে ৪৮টি পরিবার। এসব পরিবারে শতাধিক সদস্য এখনও মাটির তৈরি জিনিসপত্র নিজ হাতে তৈরী করে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায়। তবে প্লাস্টিকের তৈরি আধুনিক জিনিসপত্রের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কদর কমেছে মাটির তৈরি জিনিস পত্রের। তাই বেকার হয়ে পড়েছে মাটির কারিগর কুমাররা। এরই মধ্যে এই অঞ্চলের অনেকেই কুমার পেশা পরিবর্তন করে ফেলেছেন।

এখন তাদের কেউ পোশাক তৈরির কারখানায়, কেউ দর্জির, কেউ বা আবার পুরানো কাগজ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রির করার কাজ বেছে নিয়েছেন। কুমারদের সব বাড়িতে দিন রাত চলছে কুমারদের কাজ। কেউ মাটিতে পানি মিশিয়ে কাঁদা নরম করছে, কেউ মাটির তৈরি জিনিস রোদে শুকানোর কাজ করছে, কেউ মাটির হাড়িগুলো পোড়ানোর কাজ করছে। আবার অনেকের জিনিসপত্রে রং-তুলির কাজে ব্যস্ত।

ঘোড়াঘাট উপজেলার কুমাররা দিনাজপুর -৬ আসনের এমপি শিবলী সাদিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, যদি আমাদের মাটির কাজকে একটু প্রাধান্য দিয়ে মাটির তৈরি জিনিসের দাম বাড়িয়ে এ খাতে সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন তাহলে হয়তো বা মাটির শিল্পটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো।

স্থানীয়রা জানান, এক সময় মাটির তৈরি জিনিসপত্রের বহু মাত্রিক ব্যবহার ছিল। এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হতো। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মাটির পণ্য বোঝাই ‘ভার’ নিয়ে গ্রাম-গঞ্জে ও পাড়া মহল্লায় বিক্রি করতেন কুমাররা। ভারে থাকত পাতিল, গামলা, দুধের পাত্র, পিঠা তৈরির পণ্য সড়া, চাড়ি গরুর খাবার পাত্র চাড়ি, ধান-চাল রাখার ছোট-বড় পাত্র, কড়াই, মাটির ব্যাংক, শিশুদের জন্য রকমারি নক্সার পুতুল, খেলনা ও মাটির তৈরি পশু পাখিসহ নানান পণ্য। এ সব পন্য ধান বা খাদ্যশস্য ও টাকার বিনিময়ে বিক্রি করতেন। সন্ধ্যায় ধান বোঝাই ভার নিয়ে বাড়ি ফিরতেন তারা।

ওই ধান বিক্রি করে চলত তাদের সংসার খরচ। সেই দিন এখন সুদূর অতীত। তবু পেশা সংশ্লিষ্টদের আশা, হয়তো আবার কদর বাড়বে মাটির পণ্যের। তখন হয়তো পরিবারে ফিরবে সচ্ছলতা। এখন তাদের মানবেতর দিন কাটালেও সেই সুদিনের অপেক্ষায় আজও সকাল-সন্ধ্যা পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তারা।