বাসাবাড়ি-কারখানা কোথাও নেই গ্যাস

তিন মাস ধরে দুর্ভোগে না’গঞ্জের গ্রাহকরা

গৃহকর্মীর কাজ করেন লিলি বেগম। দিনভর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর নিজের সাংসারিক কাজ সেরে রাতে বিছানায় যেতে এগারোটা বেজে যায় তার। চোখ মুদলেই চলে আসে ঘুম। তবে তৃপ্তির ঘুম হয় না। রাত তিনটায় হাজিরা দিতে হয় রান্নাঘরে। বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ সংকট থাকায় গত তিন মাস যাবত এই রুটিনেই চলছে তার জীবন।

সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের বাংলাবাজারের বাসিন্দা লিলি বেগম বলেন, ‘সারাদিন গ্যাস থাকে না। আগে কুপির মতো একটু জ্বলতো। তাতে টিপটিপ করে ভাতটা অন্তত ফুটতো। এখন তো তাও নাই। যেই বাড়িতে কাজে যাই সেইখানেও গ্যাস নাই। একজনের বাড়িতে এলপি গ্যাস আর আরেকজনের স্টোভ দিয়ে রান্না করি। তাগো ট্যাকা আছে তারা পারে, আমগোর জীবন কষ্টেই সাধন!’

এই সংকট কেবল লিলি বেগমের নয়। নারায়ণগঞ্জ জেলাজুড়ে এখন গ্যাসের সংকট। সবচেয়ে বেশি সংকট রয়েছে সদর ও বন্দর উপজেলায়। বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানায় কোথাও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস নেই। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকরা। গ্যাসের বিল পরিশোধ করার পরও কাক্সিক্ষত সরবরাহ না পেয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন তারা।

নারায়ণগঞ্জে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। তিতাসের আঞ্চলিক বিপণন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, নারায়ণগঞ্জ জেলার পাঁচ উপজেলায় ৬৬ হাজার বৈধ আবাসিক গ্রাহক রয়েছে। এছাড়া ৫৯১টি শিল্প-কারখানাও রয়েছে তিতাসের গ্যাস সংযোগের তালিকায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদর ও বন্দর উপজেলায় গ্যাসের সংকট তীব্র। এই দুই উপজেলাতেই রয়েছে তিন শতাধিক শিল্প-কারখানা। সদর উপজেলার সস্তাপুর, কাশীপুর, বাবুরাইল, ভোলাইল, গাবতলী, বিসিক, কায়েমপুর, শহরের টানবাজার, পাইকপাড়া, নন্দীপাড়া, দেওভোগ, বন্দরের আমিন ও রূপালী আবাসিক এলাকা, সোনাকান্দা, নবীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা ভুগছেন গ্যাস সংকটে। সাধারণত শীতকালে গ্যাসের চাহিদা বেশি থাকায় তখন গ্যাস সংকট তৈরি হয়। তবে শীতকাল আসার আগেই গ্যাসের সংকট তৈরি হওয়ায় উদ্বিগ্ন গ্রাহকরা।

গ্যাস সংকটে ভোগান্তিতে পড়া অন্তত ১৫ পরিবারের সঙ্গে কথা হয়। তাদের ভাষ্যমতে, গ্যাসের সংকট আগেও ছিল। তবে গত জুন মাস থেকে এই সংকট তীব্র হয়েছে। দিনের বেলা পাইপলাইনে গ্যাসের দেখা মেলে না, আসে গভীর রাতে। আবার ভোর হওয়ার আগেই চলে যায়। বাধ্য হয়ে অনেকে রান্নার কাজে ব্যবহার করছেন মাটির চুলা। তবে অনেক বহুতল ভবনের মালিকদের মাটির চুলায় আপত্তি থাকায় ব্যবহার করতে হচ্ছে এলপিজি সিলিন্ডার। কেউ আবার বৈদ্যুতিক চুলাও ব্যবহার করছেন। এতে বেড়ে যাচ্ছে সাংসারিক খরচ।

চুলায় গ্যাস না থাকায় দুই মাস যাবত মাটির চুলায় রান্না করেন দেওভোগের পূর্বনগর এলাকার বাসিন্দা নাজমা বেগম। অভ্যাস না থাকায় রান্নায় বেগ পেতে হয় বলে জানান। তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন সিলিন্ডার দিয়া রান্না করছি। তাতে খরচে পোষায় না। কাঠ কিনে তা পুড়িয়ে রান্না করি। গ্যাস থাকুক বা না থাকুক বিল তো ঠিকই দিতে হয়।’

গ্যাস না পেয়ে তিতাসের আঞ্চলিক কার্যালয়ে মৌখিক অভিযোগ জানিয়েছেন ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম। গত সোমবার কার্যালয়ের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। গ্যাস না থাকায় ‘মুসিবতে’ পড়েছেন জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, গাবতলী এলাকায় চারতলা ভবন রয়েছে তার। বৈধভাবে গ্যাস সংযোগও আছে। তবে কয়েকমাস যাবত গ্যাসের সরবরাহ নেই। নিজেরা এতে সমস্যায় তো পড়েছেনই তার ওপর ভাড়াটিয়ারাও এতে ক্ষুব্ধ। ভাড়াটিয়ারা আগামী মাস থেকে গ্যাস বিল দেবেন না বলে জানিয়েছেন। তারা এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করবেন।

শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন কোম্পানিতে গ্যাস দিয়ে আমাদের এই সংকট তৈরি করেছে। কিছু বললেই খালি যুদ্ধের অজুহাত দেয়। গ্যাস তো দেশের বাইরে থেকে কেনা লাগে না। এইটা তো আমাদের দেশেরই। মাঝে মাঝে ইচ্ছা তো করে গ্যাসের লাইনই কাইটা দেই। কিন্তু একবার কাটলে ৫০ লাখ টাকা দিয়াও তো পড়ে সংযোগ নিতে পারমু না।’

এদিকে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় গ্রাহক পর্যায়ে এই সংকট তৈরি হয়েছে বলে দাবি তিতাস গ্যাস কোম্পানির আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মামুনুর রশীদের। তিনি বলেন, ‘সিস্টেম থেকে গ্যাস সাপ্লাই কম আসতেছে। গত আগস্ট মাসের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন ২ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস সাপ্লাই এসেছে এই জেলায়। কিন্তু চাহিদা ৩ মিলিয়ন কিউবিক মিটারেরও ওপরে। তার ওপর বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে গ্যাসে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পাওয়ার প্লান্টে গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। যার ফলে গ্রাহক পর্যায়ে পর্যাপ্ত গ্যাস দিতে পারছি না।’

গ্যাসের সংকট নিয়ে আলোচনা চলছে জানিয়ে তিতাসের এই কর্মকর্তা বলেন, শীঘ্রই এই সমস্যার সমাধান হবে।

তিনি আরও বলেন, গ্যাসের সংকট নিরসনে কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে পেট্রোবাংলা। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জ্বালানি গ্যাসের এ সংকট থাকবে না। তবে আগামী কয়েক মাস অর্থাৎ শীতকাল পর্যন্ত গ্যাসের এ সংকট থাকবে বলে জানান তিনি।

গ্যাসের সংকটে শিল্প-প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ব্যাহত

গ্যাসের সংকটে সদর উপজেলার বিসিক শিল্পনগরী, আদমজী ইপিজেডসহ বন্দর, সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার উপজেলার কয়েকশ’ শিল্প-প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতাদের সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পেরে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এইভাবে চলতে থাকলে রপ্তানি আয় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে মনে করছেন নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নেতারা।

বিকেএমইএ সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, জুন মাস থেকে গ্যাসের সংকট শুরু হয়েছে। শিল্প-কারখানায় গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই থাকার কথা। কারখানার মেশিন চালানোর জন্য অন্তত ৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকা লাগে। কারখানাগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ দেড় পিএসআই। গ্যাসের চাপ কম থাকায় তার নিজের মালিকানাধীন ফতুল্লা ডাইং অ্যান্ড ক্যালেন্ডারিং মিলস নামে কারখানাটিতে ৬০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে বলে জানান।

তিনি বলেন, ‘বিদেশি ক্রেতাদের ঠিকমতো শিপমেন্ট দিতে পারছি না। এতে তারা আমাদের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। আবার ব্যাংকের টাকাও সময়মতো পরিশোধ করতে পারছি না।’

গ্যাস সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গত সোমবার জ্বালানিবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সঙ্গে সভা হয়েছে বলে জানান বিকেএমইএর এই সহ-সভাপতি। তিনি বলেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে গ্যাস সংকটের একটা সমাধানের আশ্বাস দেয়া হয়েছে সভায়।

গ্যাস সংকটে ফুঁসছেন গ্রাহকরা

নিয়মিত বিল পরিশোধ করার পরও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না পেয়ে ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা। গত সোমবার দুপুরে তারা নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় অবস্থিত তিতাস গ্যাস কোম্পানির আঞ্চলিক কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেছেন। পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ বাড়িয়ে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের দাবিতে তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

বিক্ষোভ চলাকালীন গ্রাহকরা বলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোন গ্যাস থাকে না। গভীর রাতে আসে আবার ভোরের আগেই চলে যায়। কারো বাড়িতেই গ্যাস নেই। গ্যাস না থাকার কষ্ট কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। বাসায় গৃহিনীরা কষ্ট করে রান্নাবান্না করছে। কিন্তু অমরা গ্যাস না পেয়ে মাসের পর মাস বিল পরিশোধ করে আসছি। এভাবে চলতে পারে না।

বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর সিন্ডিকেটের কারণে গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে দাবি করে তারা আরও বলেন, ‘মানুষ গ্যাস পায় না কারণ এই গ্যাস বসুন্ধরা, ফ্রেশের মতো বড় কয়েকটি কোম্পানির পেটে। কারণ গ্যাস না থাকলে আমরা সিলিন্ডার কিনব, এলপিজি কিনব; এই হলো তাদের মতলব।’

বক্তারা তিতাস গ্যাস কোম্পানির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও তোলেন। দ্রুততার সঙ্গে জেলার সব অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের দাবি তোলেন। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না পেলে এই আন্দোলন চলমান থাকবে এবং তা বৃহৎ আকার ধারণ করবে বলে জানান বক্তারা। প্রয়োজনে অবস্থান ধর্মঘটেরও হুঁশিয়ারি দেন তারা।

এর আগে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবিতে গত রোববার তিতাসের আঞ্চলিক মহা ব্যবস্থাপকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। বন্দরে গ্যাসের দাবিতে উপজেলা পরিষদে মানববন্ধনও করেছেন স্থানীয়রা। অন্যান্য উপজেলাগুলোতেও গ্যাস না পেয়ে ক্ষুব্ধ গ্রাহক।

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ৩০ ভাদ্র ১৪২৯ ১৭ সফর ১৪৪৪

বাসাবাড়ি-কারখানা কোথাও নেই গ্যাস

তিন মাস ধরে দুর্ভোগে না’গঞ্জের গ্রাহকরা

সৌরভ হোসেন সিয়াম, নারায়ণগঞ্জ

image

না’গঞ্জ : গ্যাস সংকটে ভোগান্তির চিত্র, মাটির চুলায় রান্নার কাজ চলছে -সংবাদ

গৃহকর্মীর কাজ করেন লিলি বেগম। দিনভর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর নিজের সাংসারিক কাজ সেরে রাতে বিছানায় যেতে এগারোটা বেজে যায় তার। চোখ মুদলেই চলে আসে ঘুম। তবে তৃপ্তির ঘুম হয় না। রাত তিনটায় হাজিরা দিতে হয় রান্নাঘরে। বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ সংকট থাকায় গত তিন মাস যাবত এই রুটিনেই চলছে তার জীবন।

সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের বাংলাবাজারের বাসিন্দা লিলি বেগম বলেন, ‘সারাদিন গ্যাস থাকে না। আগে কুপির মতো একটু জ্বলতো। তাতে টিপটিপ করে ভাতটা অন্তত ফুটতো। এখন তো তাও নাই। যেই বাড়িতে কাজে যাই সেইখানেও গ্যাস নাই। একজনের বাড়িতে এলপি গ্যাস আর আরেকজনের স্টোভ দিয়ে রান্না করি। তাগো ট্যাকা আছে তারা পারে, আমগোর জীবন কষ্টেই সাধন!’

এই সংকট কেবল লিলি বেগমের নয়। নারায়ণগঞ্জ জেলাজুড়ে এখন গ্যাসের সংকট। সবচেয়ে বেশি সংকট রয়েছে সদর ও বন্দর উপজেলায়। বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানায় কোথাও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস নেই। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকরা। গ্যাসের বিল পরিশোধ করার পরও কাক্সিক্ষত সরবরাহ না পেয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন তারা।

নারায়ণগঞ্জে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। তিতাসের আঞ্চলিক বিপণন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, নারায়ণগঞ্জ জেলার পাঁচ উপজেলায় ৬৬ হাজার বৈধ আবাসিক গ্রাহক রয়েছে। এছাড়া ৫৯১টি শিল্প-কারখানাও রয়েছে তিতাসের গ্যাস সংযোগের তালিকায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদর ও বন্দর উপজেলায় গ্যাসের সংকট তীব্র। এই দুই উপজেলাতেই রয়েছে তিন শতাধিক শিল্প-কারখানা। সদর উপজেলার সস্তাপুর, কাশীপুর, বাবুরাইল, ভোলাইল, গাবতলী, বিসিক, কায়েমপুর, শহরের টানবাজার, পাইকপাড়া, নন্দীপাড়া, দেওভোগ, বন্দরের আমিন ও রূপালী আবাসিক এলাকা, সোনাকান্দা, নবীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা ভুগছেন গ্যাস সংকটে। সাধারণত শীতকালে গ্যাসের চাহিদা বেশি থাকায় তখন গ্যাস সংকট তৈরি হয়। তবে শীতকাল আসার আগেই গ্যাসের সংকট তৈরি হওয়ায় উদ্বিগ্ন গ্রাহকরা।

গ্যাস সংকটে ভোগান্তিতে পড়া অন্তত ১৫ পরিবারের সঙ্গে কথা হয়। তাদের ভাষ্যমতে, গ্যাসের সংকট আগেও ছিল। তবে গত জুন মাস থেকে এই সংকট তীব্র হয়েছে। দিনের বেলা পাইপলাইনে গ্যাসের দেখা মেলে না, আসে গভীর রাতে। আবার ভোর হওয়ার আগেই চলে যায়। বাধ্য হয়ে অনেকে রান্নার কাজে ব্যবহার করছেন মাটির চুলা। তবে অনেক বহুতল ভবনের মালিকদের মাটির চুলায় আপত্তি থাকায় ব্যবহার করতে হচ্ছে এলপিজি সিলিন্ডার। কেউ আবার বৈদ্যুতিক চুলাও ব্যবহার করছেন। এতে বেড়ে যাচ্ছে সাংসারিক খরচ।

চুলায় গ্যাস না থাকায় দুই মাস যাবত মাটির চুলায় রান্না করেন দেওভোগের পূর্বনগর এলাকার বাসিন্দা নাজমা বেগম। অভ্যাস না থাকায় রান্নায় বেগ পেতে হয় বলে জানান। তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন সিলিন্ডার দিয়া রান্না করছি। তাতে খরচে পোষায় না। কাঠ কিনে তা পুড়িয়ে রান্না করি। গ্যাস থাকুক বা না থাকুক বিল তো ঠিকই দিতে হয়।’

গ্যাস না পেয়ে তিতাসের আঞ্চলিক কার্যালয়ে মৌখিক অভিযোগ জানিয়েছেন ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম। গত সোমবার কার্যালয়ের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। গ্যাস না থাকায় ‘মুসিবতে’ পড়েছেন জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, গাবতলী এলাকায় চারতলা ভবন রয়েছে তার। বৈধভাবে গ্যাস সংযোগও আছে। তবে কয়েকমাস যাবত গ্যাসের সরবরাহ নেই। নিজেরা এতে সমস্যায় তো পড়েছেনই তার ওপর ভাড়াটিয়ারাও এতে ক্ষুব্ধ। ভাড়াটিয়ারা আগামী মাস থেকে গ্যাস বিল দেবেন না বলে জানিয়েছেন। তারা এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করবেন।

শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন কোম্পানিতে গ্যাস দিয়ে আমাদের এই সংকট তৈরি করেছে। কিছু বললেই খালি যুদ্ধের অজুহাত দেয়। গ্যাস তো দেশের বাইরে থেকে কেনা লাগে না। এইটা তো আমাদের দেশেরই। মাঝে মাঝে ইচ্ছা তো করে গ্যাসের লাইনই কাইটা দেই। কিন্তু একবার কাটলে ৫০ লাখ টাকা দিয়াও তো পড়ে সংযোগ নিতে পারমু না।’

এদিকে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় গ্রাহক পর্যায়ে এই সংকট তৈরি হয়েছে বলে দাবি তিতাস গ্যাস কোম্পানির আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মামুনুর রশীদের। তিনি বলেন, ‘সিস্টেম থেকে গ্যাস সাপ্লাই কম আসতেছে। গত আগস্ট মাসের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন ২ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস সাপ্লাই এসেছে এই জেলায়। কিন্তু চাহিদা ৩ মিলিয়ন কিউবিক মিটারেরও ওপরে। তার ওপর বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে গ্যাসে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পাওয়ার প্লান্টে গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। যার ফলে গ্রাহক পর্যায়ে পর্যাপ্ত গ্যাস দিতে পারছি না।’

গ্যাসের সংকট নিয়ে আলোচনা চলছে জানিয়ে তিতাসের এই কর্মকর্তা বলেন, শীঘ্রই এই সমস্যার সমাধান হবে।

তিনি আরও বলেন, গ্যাসের সংকট নিরসনে কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে পেট্রোবাংলা। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জ্বালানি গ্যাসের এ সংকট থাকবে না। তবে আগামী কয়েক মাস অর্থাৎ শীতকাল পর্যন্ত গ্যাসের এ সংকট থাকবে বলে জানান তিনি।

গ্যাসের সংকটে শিল্প-প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ব্যাহত

গ্যাসের সংকটে সদর উপজেলার বিসিক শিল্পনগরী, আদমজী ইপিজেডসহ বন্দর, সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার উপজেলার কয়েকশ’ শিল্প-প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতাদের সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে না পেরে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এইভাবে চলতে থাকলে রপ্তানি আয় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে মনে করছেন নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নেতারা।

বিকেএমইএ সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, জুন মাস থেকে গ্যাসের সংকট শুরু হয়েছে। শিল্প-কারখানায় গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই থাকার কথা। কারখানার মেশিন চালানোর জন্য অন্তত ৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকা লাগে। কারখানাগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ দেড় পিএসআই। গ্যাসের চাপ কম থাকায় তার নিজের মালিকানাধীন ফতুল্লা ডাইং অ্যান্ড ক্যালেন্ডারিং মিলস নামে কারখানাটিতে ৬০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে বলে জানান।

তিনি বলেন, ‘বিদেশি ক্রেতাদের ঠিকমতো শিপমেন্ট দিতে পারছি না। এতে তারা আমাদের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। আবার ব্যাংকের টাকাও সময়মতো পরিশোধ করতে পারছি না।’

গ্যাস সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গত সোমবার জ্বালানিবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সঙ্গে সভা হয়েছে বলে জানান বিকেএমইএর এই সহ-সভাপতি। তিনি বলেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে গ্যাস সংকটের একটা সমাধানের আশ্বাস দেয়া হয়েছে সভায়।

গ্যাস সংকটে ফুঁসছেন গ্রাহকরা

নিয়মিত বিল পরিশোধ করার পরও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না পেয়ে ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা। গত সোমবার দুপুরে তারা নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় অবস্থিত তিতাস গ্যাস কোম্পানির আঞ্চলিক কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেছেন। পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ বাড়িয়ে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের দাবিতে তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।

বিক্ষোভ চলাকালীন গ্রাহকরা বলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোন গ্যাস থাকে না। গভীর রাতে আসে আবার ভোরের আগেই চলে যায়। কারো বাড়িতেই গ্যাস নেই। গ্যাস না থাকার কষ্ট কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। বাসায় গৃহিনীরা কষ্ট করে রান্নাবান্না করছে। কিন্তু অমরা গ্যাস না পেয়ে মাসের পর মাস বিল পরিশোধ করে আসছি। এভাবে চলতে পারে না।

বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর সিন্ডিকেটের কারণে গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে দাবি করে তারা আরও বলেন, ‘মানুষ গ্যাস পায় না কারণ এই গ্যাস বসুন্ধরা, ফ্রেশের মতো বড় কয়েকটি কোম্পানির পেটে। কারণ গ্যাস না থাকলে আমরা সিলিন্ডার কিনব, এলপিজি কিনব; এই হলো তাদের মতলব।’

বক্তারা তিতাস গ্যাস কোম্পানির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও তোলেন। দ্রুততার সঙ্গে জেলার সব অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের দাবি তোলেন। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না পেলে এই আন্দোলন চলমান থাকবে এবং তা বৃহৎ আকার ধারণ করবে বলে জানান বক্তারা। প্রয়োজনে অবস্থান ধর্মঘটেরও হুঁশিয়ারি দেন তারা।

এর আগে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবিতে গত রোববার তিতাসের আঞ্চলিক মহা ব্যবস্থাপকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। বন্দরে গ্যাসের দাবিতে উপজেলা পরিষদে মানববন্ধনও করেছেন স্থানীয়রা। অন্যান্য উপজেলাগুলোতেও গ্যাস না পেয়ে ক্ষুব্ধ গ্রাহক।