প্রান্তিক কৃষক ও ক্ষেতমজুরেরা কেমন আছে

সামসুল ইসলাম টুকু

প্রায় ২ কোটি ১১ লাখ বিভিন্ন শ্রেণীর কৃষক রয়েছে দেশে। কৃষি বিভাগ কৃষকদের ৫টি শ্রেণীতে বিভক্ত করে। এরা হচ্ছে ভূমিহীন, প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও ধনী কৃষক। এ বিশালসংখ্যক কৃষক শুধু তার নিজ প্রয়োজনেই ফসল উৎপাদন করেনা। করে দেশবাসীর জন্যও। এ ছাড়া কমপক্ষে ১ কোটি মানুষ যাদের ক্ষেতমজুর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যাদের ঘামে ভেজা শ্রমেই সেই খাদ্য উৎপাদিত হয়, তাদের কোন সম্পদ সম্পত্তি নেই, হাত-পা ছাড়া এবং অন্য কোন কাজ নেই জমিতে শ্রম দেয়া ছাড়া।

কৃষক আজ সারের জন্য হাহাকার করছেন। প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর আসছে সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের। আর এই অতিরিক্ত মূল্য আদায় করছেন নিবন্ধিত সার ডিলারেরা। প্রশাসনসহ সারের লাইসেন্স দাতা প্রতিষ্ঠান কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা এ জন্য মাঠে নামেছেন, ডিলারদের জরিমানাও করেছেন, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে প্রচ- খরা, প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাব কৃষকদের বেকায়দায় ফেলেছে। সারা দেশে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৮০ ভাগ পূরণ হবে কি না, সন্দেহ দেখা দিয়েছে। প্রতি বছরই এ ধরনের কোন না কোন সংকট দেখা যায়। যেমন খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, সেচের পানির সংকট, সারের উচ্চমূল্য ও সর্বোপরি ধানের ন্যায্য না পাওয়া। তারপরও তারা দেশবাসীর খাদ্য জোগান দেন। অথচ তারা নিজেরা বঞ্চিত থেকে যান। বছরের পর বছর ধরে ধান চাষ করে তারা পরিবারের সচ্ছলতা আনতে পারেন না। বিশেষত ১ কোটি ২২ লাখ ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকরা। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেকেই ধান আবাদ পরিত্যাগ করে আমের চাষ করে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

এক বিঘা জমতে ধান আবাদ করতে প্রথমে জমির আইল কাটা ও বাঁধার জন্য তিনজন মজুর, তারপরে হালচাষ করতে ৪ জন মজুর এবং ২ বার নিড়ানি দিতে ৫ জন মজুর দরকার। অর্থাৎ মোট ১২ জন মজুর এর দৈনিক ৪০০ টাকা হিসেবে ৪ হাজার ৮০০ টাকা। বিঘাপ্রতি সেচ ১ হাজার ৫০০ টাকা। তিন ধরনের সার ৮০ কেজি যার সরকারি মূল্য ১ হাজার ৩৬০ টাকা। কীটনাশক প্রায় ১ হাজার টাকা। সার ও কীটনাশক ছিটানোর জন্য ১ হাজার টাকা এবং কৃষকের নিজের শ্রম ধান বীজ মাড়াই বা জিন বাবদ সর্বনিম্ন ১ হাজার ৩৪০ টাকা ধরা হলে মোট খরচ হয় ১১ হাজার টাকা।

ধরে নিলাম এক বিঘাতে সর্বোচ্চ ২০ মণ ধান উৎপাদিত হলো। যার বর্তমান বাজারমূল্য মণপ্রতি ১ হাজার টাকা হিসেবে ২০ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিলে কৃষকের হাতে থাকে মাত্র ৯ মণ ধান বা ৯ হাজার টাকা এবং এক বছরে দুটি ফসল নিশ্চিত করতে পারলে পাবে ১৮ হাজার টাকা যদি তার ১ বিঘা জমি থাকে।

মাত্র ১৮ হাজার টাকায় কি একটা কৃষক পরিবার সারা বছর চলতে পারে? আদৌ না। তাছাড়া ১ কোটি ২২ লাখ ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকের ৯০ শতাংশের ১ বিঘা জমিই নেই। এর সঙ্গে আর ১ কোটি ক্ষেতমজুর (যারা সারা বছর কাজ পায় না, ৬ মাস পর্যন্ত বেকার থাকে) যুক্ত হয় তাহলে প্রায় ২ কোটি ২২ লাখ পরিবারের ৮/৯ কোটি মানষের (যা দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক) বেঁচে থাকা কত কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। ভূমিহীন প্রান্তিক ও ক্ষেতমজুরদের খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান নিশ্চিত নয়। আর এদের উন্নয়ন নিশ্চিত না করে এসডিজির লক্ষ্যমাত্র পুরন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিবেচনা করাও সম্ভব নয়।

[লেখক : সাংবাদিক ]

আরও খবর

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ৩০ ভাদ্র ১৪২৯ ১৭ সফর ১৪৪৪

প্রান্তিক কৃষক ও ক্ষেতমজুরেরা কেমন আছে

সামসুল ইসলাম টুকু

প্রায় ২ কোটি ১১ লাখ বিভিন্ন শ্রেণীর কৃষক রয়েছে দেশে। কৃষি বিভাগ কৃষকদের ৫টি শ্রেণীতে বিভক্ত করে। এরা হচ্ছে ভূমিহীন, প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও ধনী কৃষক। এ বিশালসংখ্যক কৃষক শুধু তার নিজ প্রয়োজনেই ফসল উৎপাদন করেনা। করে দেশবাসীর জন্যও। এ ছাড়া কমপক্ষে ১ কোটি মানুষ যাদের ক্ষেতমজুর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যাদের ঘামে ভেজা শ্রমেই সেই খাদ্য উৎপাদিত হয়, তাদের কোন সম্পদ সম্পত্তি নেই, হাত-পা ছাড়া এবং অন্য কোন কাজ নেই জমিতে শ্রম দেয়া ছাড়া।

কৃষক আজ সারের জন্য হাহাকার করছেন। প্রতিদিন পত্র-পত্রিকায় সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর আসছে সার ও কীটনাশকের অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের। আর এই অতিরিক্ত মূল্য আদায় করছেন নিবন্ধিত সার ডিলারেরা। প্রশাসনসহ সারের লাইসেন্স দাতা প্রতিষ্ঠান কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা এ জন্য মাঠে নামেছেন, ডিলারদের জরিমানাও করেছেন, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অন্যদিকে প্রচ- খরা, প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাব কৃষকদের বেকায়দায় ফেলেছে। সারা দেশে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৮০ ভাগ পূরণ হবে কি না, সন্দেহ দেখা দিয়েছে। প্রতি বছরই এ ধরনের কোন না কোন সংকট দেখা যায়। যেমন খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, সেচের পানির সংকট, সারের উচ্চমূল্য ও সর্বোপরি ধানের ন্যায্য না পাওয়া। তারপরও তারা দেশবাসীর খাদ্য জোগান দেন। অথচ তারা নিজেরা বঞ্চিত থেকে যান। বছরের পর বছর ধরে ধান চাষ করে তারা পরিবারের সচ্ছলতা আনতে পারেন না। বিশেষত ১ কোটি ২২ লাখ ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকরা। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেকেই ধান আবাদ পরিত্যাগ করে আমের চাষ করে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছেন।

এক বিঘা জমতে ধান আবাদ করতে প্রথমে জমির আইল কাটা ও বাঁধার জন্য তিনজন মজুর, তারপরে হালচাষ করতে ৪ জন মজুর এবং ২ বার নিড়ানি দিতে ৫ জন মজুর দরকার। অর্থাৎ মোট ১২ জন মজুর এর দৈনিক ৪০০ টাকা হিসেবে ৪ হাজার ৮০০ টাকা। বিঘাপ্রতি সেচ ১ হাজার ৫০০ টাকা। তিন ধরনের সার ৮০ কেজি যার সরকারি মূল্য ১ হাজার ৩৬০ টাকা। কীটনাশক প্রায় ১ হাজার টাকা। সার ও কীটনাশক ছিটানোর জন্য ১ হাজার টাকা এবং কৃষকের নিজের শ্রম ধান বীজ মাড়াই বা জিন বাবদ সর্বনিম্ন ১ হাজার ৩৪০ টাকা ধরা হলে মোট খরচ হয় ১১ হাজার টাকা।

ধরে নিলাম এক বিঘাতে সর্বোচ্চ ২০ মণ ধান উৎপাদিত হলো। যার বর্তমান বাজারমূল্য মণপ্রতি ১ হাজার টাকা হিসেবে ২০ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিলে কৃষকের হাতে থাকে মাত্র ৯ মণ ধান বা ৯ হাজার টাকা এবং এক বছরে দুটি ফসল নিশ্চিত করতে পারলে পাবে ১৮ হাজার টাকা যদি তার ১ বিঘা জমি থাকে।

মাত্র ১৮ হাজার টাকায় কি একটা কৃষক পরিবার সারা বছর চলতে পারে? আদৌ না। তাছাড়া ১ কোটি ২২ লাখ ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকের ৯০ শতাংশের ১ বিঘা জমিই নেই। এর সঙ্গে আর ১ কোটি ক্ষেতমজুর (যারা সারা বছর কাজ পায় না, ৬ মাস পর্যন্ত বেকার থাকে) যুক্ত হয় তাহলে প্রায় ২ কোটি ২২ লাখ পরিবারের ৮/৯ কোটি মানষের (যা দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক) বেঁচে থাকা কত কঠিন তা সহজেই অনুমেয়। ভূমিহীন প্রান্তিক ও ক্ষেতমজুরদের খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান নিশ্চিত নয়। আর এদের উন্নয়ন নিশ্চিত না করে এসডিজির লক্ষ্যমাত্র পুরন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বিবেচনা করাও সম্ভব নয়।

[লেখক : সাংবাদিক ]