৯৪তম জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

রবীন্দ্রনাথ, রাজনীতি ও বাম সাহিত্য আমাকে প্রভাবিত করেছে আহমদ রফিক

ওবায়েদ আকাশ : এই মুহূর্তে আপনি আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য, বর্ষিয়ান। একটি জীবন লেখালেখির সঙ্গে কাটিয়ে দিলেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় লিখেছেন। সব লেখকই নিজেকে কবি পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, এমনকি রবীন্দ্রনাথও...

আহমদ রফিক : হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ তো বলতেনই, কবিতা আমার প্রিয় সঙ্গিনী।

ও. আ. : এর বাইরে ভাষা আন্দোলন, রাজনীতি, রবীন্দ্রনাথ, অন্যান্য প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস আপনার লেখালেখির বিষয়...

আ. র. : হ্যাঁ, তবে কবিতা এখন লিখছি খুব কম। আমার লেখালেখির কাজগুলো যদি দেখি, তো প্রথমেই ভাষা আন্দোলন, দ্বিতীয়ত রবীন্দ্রনাথ, তারপর রাজনীতি, দেশের রাজনীতি, বিদেশের রাজনীতি, তারপরে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক লেখালেখি। এর মধ্যে দেশবিভাগ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে আমি মনে করি। এবং এটা আমার ছাত্রজীবন থেকে। তখন আমি অসাম্প্রদায়িক বাম রাজনীতি করেছি। সেই বিভাগপূর্ব কালে। সেই থেকে আজ নয় কাল নয় করতে করতে এই তো গত দু’তিন বছর আগে আমি দেশবিভাগ নিয়ে, দেশবিভাগের ট্রাজেডি, বহুমাত্রিকতা নিয়ে প্রায় সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার একটা বই লিখেছি। ট্রাজেডি এই অর্থে, বিদেশীরাও কিন্তু এটাকে বলে ‘সাউথ এশিয়ান ট্রাজেডি’, যেখানে তিন সম্প্রদায়ের কয়েক লক্ষ লোক মারা গেল- হিন্দু, মুসলমান, শিখ। এবং তখন কয়েক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হলো। এবং আমি বলব, ধারালো তলোয়ার পাঞ্জাব এবং বঙ্গদেশ ভাগ করা হলো।

ও. আ. : আপনি আসলে কাকে দায়ী করতে চান?

আ. র. : রাজনৈতিক দল, প্রধান রাজনৈতিক দল, কংগ্রেস এবং লীগ এর জন্য দায়ী ছিল। এবং সেই সঙ্গে ইংরেজ শাসক। বিশেষ করে শেষ দিকে এসে মাউন্টব্যাটেন সর্বনাশটা করলেন। একটি উদাহরণ দেই : যখন দেশ ভাগ হবে এমন সিদ্ধান্ত হলো, কংগ্রেস একটি নির্বাহী বৈঠক করলো এবং তখন বাম রাজনীতির দুএকজন যেমন রামমনোহর লোহিয়া এবং খান আবদুল গাফফার খান কড়া প্রতিবাদ করলেন। গাফফার খান বললেন, মহাত্মাজী এতদিন আমরা কংগ্রেসের রাজনীতি করলাম আর এখন সেই কংগ্রেস আমাদের নেকড়ের মুখে ছুড়ে ফেলে দিলো। নেকড়ের মুখে মানে পাকিস্তানের জিন্না সাহেবের মুখে। এবং পরবর্তীকালে ব্যাপারটা তাই হলো। কারণ সীমান্ত প্রদেশে যে অত্যাচারটা হয়েছে, তাতে খান আবদুল গাফফার খান তার বাকি জীবনটা হয় জেলে না হয় নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন। পাকিস্তানে এবং কাবুলে, আফগানিস্তানে। ওরা তো পশতু পাঠান। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস জিন্না সাহেবের পাকিস্তান দাবিটা মেনে নিলো। দায়টা এক্ষেত্রে যদি জিন্না সাহেবের ৬০% ধরি, বাকি ৪০% অবশ্যই কংগ্রেসের। আর পুরো ভূমিকাটা ব্রিটিশ শাসকদের।

ও. আ. : তখন তো আপনার বয়স ১৭/১৮ বছর। এত অল্প বয়সে আপনাকে এমন একটা ঘটনার সাক্ষী হতে হলো।

আ. র. : হ্যাঁ, তখন আমি ছাত্র, এবং তখন থেকেই আমি সাহিত্য, রাজনীতি, বাম-সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছি।

ও. আ. : বাম-সাহিত্যটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

আ. র. : ওই সময়েই ভারতীয় স্বাধীনতার বিষয়টা আমার কাছে খুব বড় বিবেচ্য বিষয় ছিল। ঠিক কাজী নজরুল ইসলামের মতো। আমার ঐ সময়ের রাজনীতির মেন্টরের কথা যদি কেউ জানতে চায়, তো আমি বলব, একজন কাজী নজরুল ইসলাম এবং আর একজন সুভাষচন্দ্র বসু।

ও. আ. : রাজনীতির মেন্টর বলছেন নাকি সাহিত্যের?

আ. র. : হ্যাঁ, রাজনীতির মেন্টর। নজরুল তো বিদ্রেহের সঙ্গে, ওই সময়ের বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। লেবার স্বরাজ পার্টি করলেন মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে। ধূমকেতু, নবযুগ পত্রিকা সম্পাদনা করলেন। উনিই তো প্রথম, ‘ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়’, এই ঘোষণা দিলেন। উনি ঘোষণা করলেন ১৯২২ সালে, কংগ্রেস করল কয়েক বছর পরে।

ও. আ. : এ-কারণে আপনি তাঁর সাহিত্যকে বাম-সাহিত্য বলছেন?

আ. র. : হ্যাঁ, এসব কারণে।

ও. আ. : তখন কি সোভিয়েত সাহিত্য আপনাকে আলোড়িত করেছে?

আ. র. : না না তখনো সোভিয়েত সাহিত্য পড়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু গোর্কির ‘মা’ পড়ে আলোড়িত হয়েছি। বন্ধুদের পড়তে দিয়েছি। ওটাও বাম সাহিত্য। তবে বিপ্লবী রাজনীতি প্রিয় বিষয় ছিল। যেমন তখনকার আমার একটা পুস্তিকার কথা বলি, ‘ভকৎ সিং ও তার সহকর্মীরা’। এটি প্রকাশ করেছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি। তাহলে বুঝতে পারো আমার রাজনৈতিক ধারাটা কোনদিকে ছিল। চিন্তা করো আমাদের এখানে এত এত লেখক থাকতে, এত এত ইতিহাসবেত্তা থাকতে যেটাকে বললাম সাউথ এশিয়ান ট্রাজেডি, এটা নিয়ে কেউ কিছু লিখল না। আমি আমার ঐ বইটাতে এ বিষয়টা নিয়ে লিখেছি। অনেক কষ্ট করে অনেক অনেক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। আমাদের এখানে এ ধারার আর কোনো বই নেই। এইভাবে যে সে সময়ের পশ্চাৎগতির সাহিত্য, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদে আজম জিন্দাবাদ মার্কা যে পাকিস্তান বন্দনার সাহিত্য, এটা ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত একই ধারায় বয়ে গেছে। ১৯৫২ সালে এসে ভাষা আন্দোলন একটা বাঁকফেরা পরিবর্তন ঘটালো, সেটা যেমন সাহিত্যক্ষেত্রে, তেমনি রাজনীতির ক্ষেত্রে। সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা পরিবর্তনটা অধিকমাত্রায় দেখি। তখন কুমিল্লায় একটা সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সম্মেলন হলো। আমি, গাজীউল হকসহ অনেকে মিলে ঐ সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলাম।

ও. আ. : এ বিষয়ে আমরা আর একটু পরে আসছি। আগে জেনে নেই, আপনি আসলে শুরুতে কী ধরনের লেখালেখি দিয়ে শুরু করেছিলেন। প্রবন্ধ, কবিতা, রাজনৈতিক লেখালেখি নাকি অন্য কোনো মাধ্যমে?

আ. র. : সব মিলেই। গল্প, কবিতা, সব কিছুই লিখতে শুরু করেছিলাম। আমার ১৯৫৮ সালে যে বইটা বের হলো, সেটা ১৯৫৬ সালে লেখা, বইটির নাম ছিল : ‘শিল্প সংস্কৃতি জীবন’, সেখানে নজরুলের উপর একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ ছিল, বঙ্কিমের উপর একটা প্রবন্ধ ছিল, সেটা অবশ্য সমালোচনামূলকই ছিল বেশি, মীর মশাররফের উপর প্রথম আমার লেখা একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ ছিল।

ও. আ. : জ্বি। আমরা আবার সেই কুমিল্লার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সম্মেলনের ঘটনায় ফিরে যাই।

আ. র. : তখন আমি, গাজীউল হক ছাড়াও সম্মেলনে গিয়েছিল আমার আরেক বন্ধু আনোয়ারুল হক খান। ও তখন ফজলুল হক হলের জিএস। ঢাকা থেকে মুড়ির টিনের মতো একটা বাসে শিল্পী আব্দুল আলীম, শেখ লুৎফর রহমান, সোহরাব

হোসেনসহ আরো অনেকে গিয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে হলো ভাষা আন্দোলন, সম্মেলন হলো অগাস্টে। সেখানে নজরুল সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, লোকসঙ্গীত, ইকবালের সেই বিখ্যাত ‘জাগো দুনিয়ার’ গানটি। এরকম আরো পরিবেশনা হলো সেদিন। ফনি বড়–য়া ও রমেশ শীলের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ কবিগান রাতভর আমরা ঈশ্বর পাঠশালার প্রাঙ্গণে বসে শুনলাম। সেই সম্মেলন ছিল জাতীয়তাবাদী বাঙালি চেতনার সম্মেলন। জাতীয়তাবাদী, প্রগতিবাদী, লোকসংস্কৃতি-চেতনার সেই সম্মেলন সম্ভব হলো ভাষা আন্দোলনের কারণে।

ও. আ. : আয়োজক কারা ছিল?

আ. র. : আয়োজক ছিল কুমিল্লারই শিল্প সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রগতিশীল কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন। ও আর একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, ওই সম্মেলনে তখনই কিন্তু বিজন ভট্টাচার্যের নাটক ‘নবান্ন’ ও ‘জবানবন্দি’ মঞ্চস্থ হলো। সেই কুমিল্লা সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের আমলে, যুক্তফ্রন্ট এত শক্তিশালী ছিল যে, মুসলিম লীগের মতো দল তার কাছে ধরাশায়ী হলো। সেই যুক্তফ্রন্টের আমলে ১৯৫৪ সালে কার্জন হলে তিন দিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলন হলো। এই সম্মেলনে সুভাষ মুখার্জি, কাজী আবদুল ওদুদ, মনোজ বসু থেকে শুরু করে কলকাতা থেকে ৩০/৪০ জন যোগ দিতে এসেছিলেন। আমার এখনো মনে আছে, লায়লা সামাদ বললেন, ঘোমটা ছেড়ে বেরিয়ে এসো নারী। আজ অহরহ এত নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন হচ্ছে। আমার এখনো মনে আছে, সেই সম্মেলন থেকে মেয়েরা কার্জন হল থেকে সেই আজিমপুর কলোনি পর্যন্ত রাত সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরে গেছে। কোনো আক্রমণ হয়নি। ঝামেলা হয়নি। ৫০-এর দশকের এজাতীয় পরিবেশ কিন্তু একটা বিরাট ঘটনা ছিল।

ও. আ. : সবাই যেটা আপনাকে জিগ্যেস করে, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে কীভাবে জড়িত হলেন?

আ. র. : আমি স্কুল থেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলাম। কলেজ জীবনে রাজনীতি করেছি। সেই ১৯৪৮ সালে মুন্সিগঞ্জে ভাষা আন্দোলন করেছি। তখন আমি মার্কসবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাই। বিশেষভাবে পাঠ নিয়েছি। ওয়েব দম্পতির ‘সোভিয়েত কম্যুনিজম’ বই পড়েছি। ওরা হাসব্যান্ড-ওয়াইফ, দু’জনেই কম্যুনিস্ট। সেই সময়ে কবিতার ওপরে ক্রিস্টোফার কডোয়েলের লেখা ‘ইল্যুশন এ্যান্ড রিয়েলিটি’ পড়েছি। অর্থাৎ সেই সময়ে সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতির জন্য যা যা দরকার সব পড়েছি। তখন আমি লোরকা পড়েছি, নেরুদা পড়েছি। তারপর ১৯৪৯ সালে ঢাকায় এলাম। এরপরে ঢাকায় যতগুলো গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে, এগুলোতে অংশ নেয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।

সেই সময়েই সংগঠিত হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। আমি সংগঠক হিসেবে সরাসরি আন্দোলনে যোগদান করি। আমার কাজ ছিল বিভিন্ন হলে ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, সারা দিন মিছিল-মিটিং করা। আন্দোলনে গুলি চালানোর ঘটনাটা সরাসরি আমার সামনেই ঘটে। বরকত রফিক জব্বার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সে সময়ের ছাত্ররা একাডেমিক পড়াশোনার চেয়ে রাজনীতি শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ক পড়াশোনা এবং সাংগঠনিক কার্যক্রমকে বেশি গুরুত্ব দিত। মওলানা ভাসানী একমাত্র ব্যক্তি যিনি স্বীকার করলেন, যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে ছাত্রদের এবং সাধারণ জনগণের অবদান সবচেয়ে বেশি। তখন আমাদের হোস্টেলের খাবারের খুব সুনাম ছিল। যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পরে আমরা আমাদের হোস্টেলে খাওয়ার জন্য তিন প্রধান নেতাকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী। তখন খাওয়াদাওয়া শেষে একমাত্র মওলানা ভাসানী এই স্বীকারোক্তি করেছিলেন। যখন কেন্দ্রের ষড়যন্ত্রে, ৯২ক ধারা জারি করে যখন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করা হলো, তখন আমার ফাইনাল পরীক্ষার এক মাস বাকি, তারিখটি আমার এখনো মনে আছে, ৩০ মে ১৯৫৪। সেদিন আমরা হস্টেল প্রাঙ্গণে ঘাসের ওপর বসে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর বক্তৃতা শুনলাম, আমার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল, দেড় বছর আত্মগোপনে কাটিয়ে ফিরে এসে বহু কষ্টে পড়াশোনা শেষ করলাম। পরবর্তী জীবনে আমার আর মেডিকেল লাইনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল না। ভাল কোনো চাকরিও করতে পারিনি। অথচ মেট্রিকে আমি বিভাগপূর্ব কালে কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছিলাম, ইন্টারমিডিয়েটেও আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছিলাম। আমি সর্বাত্মকভাবে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। তারপরে তো জীবন সংগ্রাম। আমি দেড় বছর বয়সে পিতৃহারা হয়েছি। আমার বড়ভাই সংসার চালাতেন। আমরা চার ভাইয়ের মধ্যে আমি সর্বকনিষ্ঠ। স্বাভাবিকভাবেই একটা চাপ এসে পড়ল। তার পর থেকে ৩/৪ বছর আমার খুব খারাপ সময় গেছে। হেন কাজ নেই যে আমি করিনি। গোয়েন্দা গল্প লেখা, নোটবই লেখা, মিল্লাত পত্রিকায় সাব এডিটরগিরি করা, ছাত্রছাত্রী পড়ানো, এসব বিচিত্র কাজ করেছি। ফার্মাকোলোজি বিষয়টা আমার খুব প্রিয় ছিল। ওটা ড্রাগের ব্যাপার। এলাবার্ট ডেভিডে চাকরি নিলাম। টেকনিক্যাল ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের চিফ হিসেবে। সেখানে ছিলাম সত্তর একাত্তর পর্যন্ত। ওখানে যুক্ত থাকার কারণে বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিস কর্পোরেশন)-এ জয়েন করলাম। এর মধ্যে একটি কথা আমি বলি, ১৯৬৪ সালে আমি দুটো কাজের সঙ্গে খুব আগ্রহের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ছাত্র জীবন থেকেই আমার শখ ছিল এসটি সাহিত্য পত্রিকা বের করা। আমার বন্ধু আলীম চৌধুরী ‘যাত্রিক’ নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা চালাতো। আমি ওটার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।

ও. আ. : আপনার সাহিত্য পত্রিকার নাম কি ‘নাগরিক’ ছিল?

আ. র. : হ্যাঁ, হ্যাঁ, নাগরিক। একেবারে সত্তর সাল পর্যন্ত চালিয়েছি। সেখানে তখনকার এমন কোনো তরুণ লেখক ছিল না, আজকে যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক, যে তারা লেখেনি। আমি দুজনের কথা খুব বিশেষভাবে বলি : একজন আবুল হাসান এবং একজন নির্মলেন্দু গুণ, ওদের দুজনের কবিতা আমি ‘নাগরিক’-এ ছেপেছিলাম। ওরা দুজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রথম গল্প এবং প্রথম কবিতা আমি ছাপি। হাসান আজিজুল হকের প্রথম গল্প আমি প্রথম ছাপি। ওর প্রথম দিককার ৩/৪টা গল্প আমি নাগরিক-এ ছাপি।

এই পত্রিকাটা কেউ কোনোদিন হাইলাইট করেনি। এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান এবং শওকত ওসমান। প্রত্যেক সংখ্যায় তারা লিখতেন।

আমি আর একটি কাজ করেছিলাম। তখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে বাঙালিদের কোনো স্থান ছিল না। তারা ছিল নিগৃহীত। তাই আমি আর আমার ছয় বন্ধু মিলে ‘ওরিয়ন ল্যাবরেটরিজ’ নামে একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি খুলেছিলাম। ‘নাগরিক’ আর ‘ওরিয়ন’ এই দুটো ছিল আমার অন্যতম সৃষ্টি।

ও. আ. : নাগরিক সম্পর্কে আর একটু জানতে চাই। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি পত্রিকা আপনি করেছেন। এখনকার আমরা যারা লিটল ম্যাগাজিনকে এন্টিএশটাবলিশমেন্টের চরিত্রে দাঁড় করাতে চাই। তখন নাগরিকের কনসেপ্টটা কি এরকম ছিল?

আ. র. : হ্যাঁ, তা তো বটেই। নাগরিককে আমি সংকীর্ণ বাম রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইনি। আমার কনসেপ্টটা ছিল, নাগরিক হবে আধুনিক এবং প্রগতিশীলদের পত্রিকা। সেখানে মুক্তমনা সাহিত্যিকরা সাতিহ্যচর্চা করবে। সেখানে বুক রিভিউ সেক্টরটা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। দেশী বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর রিভিউ ছাপাতাম। সেখানে আমি জাঁ পল সার্ত্রের একটি বইয়ের একটি দীর্ঘ বিভিউ করেছিলাম, ছদ্মনামে। আরো অসংখ্য বইয়ের রিভিউ ছাপা হতো। সে সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধে বারট্রার্ন্ড রাসেলের লেখা ‘ওয়ার ক্রাইমস ইন ভিয়েতনাম’ বইটির সমালোচনা ছেপেছিলাম। আমেরিকানদের সমালোচনা করে লেখা বইটি, সেটারও একটা রিভিউ ছাপা হয়েছিল।

ও. আ. : এই যে, কবিতা, পরিচয়, সমকাল বা আপনার ‘নাগরিক’ এসব পত্রিকা মূলত সাহিত্য ক্ষেত্রে কী ধরনের অবদান রাখে?

আ. র. : ঐ সময় আমার পত্রিকার লক্ষ্য ছিল, আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতাকে উৎসাহিত করা। এ ধরনের পত্রিকা সাহিত্যের বাঁক বদলে বিশেষ ভূমিকা রাখে, এসব পত্রিকার মাধ্যমে সাহিত্যের একটি যুগ সৃষ্টি হয়। যেমন তোমাকে আর একটা ঘটনা বলি : তখন জাক দুকরে নামে একজন ফরাসি ফ্রি ল্যান্স জার্নালিস্ট ঢাকায় এসেছিলেন। আমি তখন গোপিবাগ থাকি, ৪৬/১ রামকৃষ্ণ মিশন রোড, আমার এক বন্ধু তাকে নিয়ে এল। সে এসেছে মূলত সাউথ এশিয়া দেখতে। তো তার সঙ্গে কথা বলে দেখি, সে দুনিয়ার সব খবর রাখে। সিআইএ এখানে কী করছে, কে কী করছে, দুকরে সব জানে। আমি তাকে আধুনিক ফরাসি সাহিত্য নিয়ে ইংরেজিতে একটি প্রবন্ধ লিখতে অনুরোধ করলাম। তিনি চমৎকার একটি প্রবন্ধ লিখলেন, বশির আল হেলাল সেটা অনুবাদ করল। সেটা নাগরিকে ছাপালাম। বুঝতেই পারছ, নাগরিক কেমন ধারার পত্রিকা ছিল।

ও. আ. : শুরুতে আপনার কবিতা নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম।

আ. র. : হ্যাঁ, ’৬৬ সালে আমার প্রথম কবিতার বই বের হয় ‘নির্বাসিত নায়ক’। তারপর সত্তরে বাঙালিয়ানার টানে লেখা হয় বাউল মাটিতে মন। তারপর যুদ্ধ শুরু হলো। তখন লিখলাম রক্তের নিসর্গে স্বদেশ।

ও. আ. : একটা সময় আপনি মনে হয় খুব কবিতাপাগল ছিলেন। কবিতা নিয়ে খুব উন্মাতাল সময় কাটত। আপনার সেই কবিতামগ্ন দিনগুলি সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। এসময়ের কথা, বন্ধুদের কথা।

আ. র. : তখন হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন, সে তখন প্রায়ই আমার হোস্টেলে আসতো। বিশেষ বিশেষ ছোট্ট সময়পর্বে কবিতা নিয়ে উন্মাদনা। প্রথম কবিতা ‘সংকেত’ ছাপা হয় ১৯৫০-এ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রথম ম্যাগাজিনে। ‘যাত্রিক’ সাহিত্য পত্রিকাটিতে পর পর তিনচারটি কবিতা ছাপা হয় (১৯৫৩-৫৪)। এরপর তো রাজনীতির ডামাডোল পর্বে কবিতা অনেকদিনতক নির্বাসনে। আবার কয়েক দশক পর কবিতা লেখা- নতুন করে ভিন্ন ধারায় বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়।

ও. আ. : তখনকার আপনাদের যে সাহিত্য আন্দোলন ছিল সেটা মূলত কোন লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়েছিল? নতুন সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে আপনাদের আন্দোলনটা ঠিক কী রকম ছিল?

আ. র. : সাতচল্লিশ থেকে একান্ন পর্যন্ত যে পাকিস্তানবাদী সাহিত্য ধারার চালু হয়েছিল, তালিম হোসেন বা গোলাম মোস্তফারা যে ধারার প্রবর্তক ছিলেন, বায়ান্ন সালে এসে কিন্তু সেই ধারা একেবারে পাল্টে গেল। আধুনিকতা ও প্রগতিশীল সাহিত্যচর্চার ধারাটা শুরু হলো। আমাদের লক্ষ্য ছিল সেই ধারাটাকে বহন করে চলা। তার পরিপুষ্টি ঘটানো।

ও. আ. : সেসময় বিশ্বসাহিত্যের কারা আপনাদের সামনে আদর্শ হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন?

আ. র. : আমরা তখন বেশি গুরুত্ব দিয়েছি বাম ধারার লেখকদের। অডেন, লোরকা, নেরুদার মতো কবিদের। এলিয়ট মূল্য পাননি কারণ তিনি শেষ পর্যন্ত ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। বন্ধ্যাভূমি চাষ করে শেষ পর্যন্ত তিনি সাম্রাজ্যবাদী সেকথা বিষ্ণু দে’র কবিতাতেও উল্লিখিত। একসময় ব্রেখ্টের কয়েকটি কবিতার অনুবাদও করেছিলাম। বিশ শতকের ফরাসি কবিদের মধ্যে পল এলুয়ার ও লুই আরাগঁ আমার প্রিয় কবি। নেরুদা, লোরকার কথা আগে বলেছি।

ও. আ. : তিরিশের দশক সম্পর্কে আপনাদের ধারণা কেমন ছিল।

আ. র. : তিরিশ সম্পর্কে আমরা পজিটিভ ছিলাম একারণে যে, তারাও আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতাকে গ্রহণ করেছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের সেই কবিতা, আমি কামারের,... আমি মজুরের... নজরুলের পর এই ধারাটাকে আমরা গ্রহণ করেছিলাম। সমর সেনের কবিতা, সুভাষ, সুকান্ত, মঙ্গলাচরণের কবিতা... এগুলোকে আমরা গ্রহণ করেছিলাম। আমার ‘নির্বাসিত নায়কের’ মূল কথাই ছিল, উঠতি পুঁজিবাদকে আঘাত করা। এই নির্বাসন মানে গ্রামে ফিরে যাওয়া নয়। মানে ব্যাক টু ভিলেজ। মানে গ্রামের মানুষকে অর্থনৈতিক মর্যাদায় সামনে তুলে আনা। রবীন্দ্রনাথ তো বলেছিলেন, গ্রাম পড়ে আছে মধ্যযুগে, শহর আধুনিক যুগে, দুইয়ের মধ্যে কালাপানির ব্যবধান, এ ব্যবধান ঘুচাতে হবে। এ কারণে রবীন্দ্রনাথ সেই ১৯০৫ সালে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ক্ষুদ্র ঋণ ও সমবায় ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। যে ভাবনা থেকেই নোবেল পুরস্কার এলো বাংলাদেশে। এ দুটোই ছিল রবীন্দ্রনাথের গ্রাম উন্নয়নের মাইলস্টোন।

ও. আ. : রবীন্দ্রনাথের ভাষা এবং উপস্থাপনা কি সেই সময়ে আপনাদের মধ্যে কোনো বিরূপ প্রভাব বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল? কারণ আপনারা তো ভাষায় এবং চিন্তায় চেঞ্জ হয়ে গেলেন।

আ. র. : না তা করেনি, তবে চিন্তায় কিছুটা বিরোধিতা দেখা দিল যখন তিনি উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত অনেকটা ভক্তিবাদী ধারায় ফিরে গেলেন। সেই ধারাটা আমরা সমর্থন করতে পারিনি। কিন্তু ১৯১৪ সালে ‘সবুজপত্রে’ প্রমথ চৌধুরী যখন চলতি ভাষায় লেখা পদ্ধতি প্রকাশ করতে শুরু করলেন, তখন তার পিছনে রবীন্দ্রনাথেরই কিন্তু বেশি উৎসাহ ছিল। সেখানে তিনি নবীনের বন্দনা করলেন, সবুজের অভিযান লিখলেন : ‘আয়রে নবীন আয়রে আমার কাঁচা’ লিখলেন। ‘বলাকা’য় এসে সে পরিবর্তন আরো স্পষ্ট হলো। ‘বলাকা’র প্রথম কবিতাই তো ‘সবুজের অভিযান’। এই সবুজের অভিযানই তো সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যায় বেরুল। এখানে এসে রবীন্দ্রনাথ আরো আধুনিক হয়ে উঠলেন।

বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা

এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা।

স্বর্গ কি হবে না কেনা?

বিশ্বের ভা-ারী শুধিবে না এত ঋণ?

রাত্রির তপস্যা সে কি আনবে না দিন?

নিদারুণ দুঃখরাতে

মৃত্যুঘাতে

মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্তসীমা

তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?

বলাকায় রবীন্দ্রনাথের এই যে ধারা, এই ধারার পরিবর্তন কিন্তু ভাষার দিক দিয়েও পরিবর্তন। এখানে তিনি চলতি ভাষার ব্যবহার করেছেন। কিন্তু আমি রবীন্দ্রনাথের শেষ দশক বা ত্রিশের দশকের কবিতাকে সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করি। ত্রিশের দশকে তাঁর রাশিয়া সফর, তাঁর ‘রথের রশি’, ‘তাসের দেশ’ এই সব নাটকের মধ্য দিয়ে যে প্রগতিযাত্রা, এটা কিন্তু ত্রিশের দশকেই ঘটল। তাঁর কবিতায় ব্যাপক পরিবর্তন আসলো। শিলাইদহে এসে বাউল সাধনা, গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যে রে’ গানের প্রেমে পড়ে গেলেন।

ও. আ. : আপনি কোন জায়গাটা থেকে রবীন্দ্রচর্চা শুরু করলেন? কীভাবে?

আ. র. : ১৯৪৮ সালে যখন ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি হার্ড লাইন নিল : ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হায়, লাখো ইনসান ভুখা হায়’ এই স্লোগানটা সঠিক ছিল কিন্তু সময়োপযোগী ছিল না। স্লোগানটা সময় উপযোগী ছিল না এই কারণে যে, দেশ কেবল পরাধীনতামুক্ত হয়েছে। আমরা যদিও বলি যে, দেশ পুরোপুরি স্বাধীন নয়। তখন কম্যুনিস্টরা এবং অন্যরাও বলেছে যে, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, ক্ষমতার হস্তান্তর। ব্রিটিশরা সমঝোতা ও সংলাপের মাধ্যমে লীগ এবং কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা দিয়ে তাদের কমনওয়েলথের গোয়ালে ঢুকিয়ে চলে গেল। আমি এইখানে বলবো যে, এত বিপ্লব হলো, বিপ্লবীরা ফাঁসির মঞ্চে জীবন দিল, দ্বীপান্তরে জীবন দিল তবু কিন্তু তারা স্বাধীনতা আনতে পারলো না। স্বাধীনতা এলো সমঝোতা এবং সংলাপের মাধ্যমে। কিন্তু এটা তো হয় না। তবু স্বাধীনতা নিয়ে তখন হিন্দু মুসলমান সবার মধ্যে উন্মাদনা। এই সময় যদি বলি যে, এটা স্বাধীনতা নয়, মানুষ শুনবে? এই জন্যই বললাম যে, স্লোগানটা সময় উপযোগী ছিল না। সেই সময় কম্যুনিস্টরা খুব বিপর্যয়ের মুখে পড়লেন। সেই ধারাবাহিকতায় তারা রবীন্দ্রথানকে বর্জন করলেন, রামমোহন, বিদ্যাসাগরকেও বর্জন করলেনই, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বললেন যে, রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট মাত্রায় প্রগতিশীল নন। সেই ধারা বহন করলেন আমাদের এখানে আখলাকুর রহমান, মুনীর চৌধুরীরা। কলকাতার আদলে এখানে গঠিত প্রগতি লেখক সংঘ একই পথে। অজিত গুহ মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছিলেন বলে তাকে বহিষ্কার পর্যন্ত করলো। তা অবশ্য বেশি দিন টেকেনি। বছর দুয়েক টিকেছিল। পরে অবশ্য অনেকে পাপ মোচন করেছেন, মুনীর চৌধুরী পাপ মোচন করে পরে বললেন, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমাদের চলেই না। তো সেই সময় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন বিতর্ক আমাকে তাকে নিয়ে লেখালেখি করতে উদ্বুদ্ধ করে। পরে যখন পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হলো, জন্মশতবার্ষিকী পালনে বাধা দেওয়া হলো, তখন থেকে পুরো মাত্রায় আমি রবীন্দ্র গবেষণা ও তাঁকে নিয়ে লেখালেখি শুরু করি।

ও. আ. : মাইকেল মধুসূদন সম্পর্কে আপনার বক্তব্য শুনতে চাই।

আ. র. : মাইকেলকে আমি আধুনিক কবি মনে করি। পরিবর্তন ঘটালেন তিনি আঙ্গিকে এবং বিষয়ে। তিনি রাবণকে বীরের মর্যাদায় দাঁড় করিয়ে একটি বিপ্লবী কাজ করলেন। তিনি রাজনৈতিক এবং সাহিত্যিক উভয় দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি।

ও. আ. : আপনি সাহিত্যের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে দেখেছেন, সাহিত্যের একটা শাশ্বত স্বর থাকে, তবু সাহিত্য বিভিন্ন দশকে বদলায়। এখনকার সাহিত্যও বদলেছে। তো আপনি বর্তমান সময়ের সাহিত্য সম্পর্কে কী বলবেন?

আ. র. : হ্যাঁ, আমি বিভিন্ন সময়ের বাঁকবদলগুলো দেখেছি। চল্লিশের দশক ছিল একটা দামাল দশক, বাম সাহিত্য রাজনীতির উত্থানের দশক। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত দেখছি। এখনকার সাহিত্য অনেকবেশি বিচ্ছিন্ন এবং মেইনস্ট্রিম থেকে আলাদা মনে হয়। ইংরেজি সাহিত্যেও এখন মেইনস্ট্রিম বলে কিছু নেই। সবাই বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। সামাজিক রাজনৈতিক সাহিত্যিক দায়কে তারা নিজের মতো করে মেনে নিয়েছে। সেখান থেকেই তারা আলাদা একটি ধারা তৈরি করছে।

ও. আ. : পোস্টমডার্ন চিন্তাবিদরা সব কিছুর ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের শক্তিমত্তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

আ. র. : হ্যাঁ, এটার যেমন ইতিবাচক দিক আছে, তেমনি নেতিবাচক দিক আছে। যেমন ফরাসি দেশেও একদল শিল্পী আছেন, যারা মেইন স্ট্রিম থেকে বের হয়ে তাদের নিজেদের মতো করে ছবি এঁকেছেন, এবং তার দায় তারা স্বীকার করে নিয়েছেন।

ও. আ. : ভিন্ন দেশের উন্নত সাহিত্যের তুলনায় আমাদের সাহিত্যের মান এখন কোন পর্যায়ে বলে মনে করেন?

আ. র. : এখন সারা পৃথিবীতে যে সাহিত্য রচিত হচ্ছে, সেখানে ইংরেজি সাহিত্যের অবস্থান তেমন আশাব্যাঞ্জক নয়। আমরা আসলে ইউরোপীয় ভাবধারায় এখনো সাহিত্য করে যাচ্ছি। ইউরোপের সাহিত্যই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের আইডল। আমার অবজার্বেশন থেকে বলতে পারি এখন পৃথিবীতে ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য ও কিছুটা আফ্রিকান সাহিত্য মানুষের সবচেয়ে বেশি কাছে যেতে পারছে এবং গুণগত মানে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। যেমন আজকে মার্কেজের কথাই ধরো, সে আজ কেন এত আলোচিত? কারণ সে তার সাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করেছে তার হাতের কাছ থেকে। নিজের মাটি নিজের দেশ থেকে। এখন সাহিত্যকে উপরে তুলে নিয়ে যেতে হলে তাকে স্থানীয়করণ করতে হবে। নিজের দেশের প্রকৃতি, নিজের দেশের মানুষের সুখ-দুঃখ-জীবনাচারকে প্রাধান্য দিতে হবে। এ কথা শুধু বাংলা সাহিত্যের বেলায় নয়। পৃথিবীর যে কোনো দেশের সাহিত্যের জন্যই এ কথা অবশ্য পালনীয়।

ও. আ. : দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং কবি-লেখক-শিল্পীদের সামাজিক দায় সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?

আ. র. : বিশ শতকের শেষের দিক পর্যন্ত যে প্রতিবাদমুখর বিশ্ব, তখনকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে রোলা বার্বুস, আইনস্টাইন, বার্ট্রান্ড রাসেল, বার্নার্ড শ এবং রবীন্দ্রনাথও যে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন, সেই ঘোষণাপত্রের প্রথম কথাটা?ই ছিল : বর্তমান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেই সন্ধিক্ষণে নীরবতার অর্থ পাপ। আমি এই কথাটাই আবারো উচ্চারণ করবো যে, আমাদের ও বিশ্বের বর্তমান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ সকল মহলের নীরব থাকাটাই পাপ। কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের শুধু লেখার টেবিলে থাকলে চলবে না। তাদের বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। ঘরে বাইরে একত্রে সোচ্চার হতে হবে। সমাজের দায় তাদের বহন করতে হবে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ৭ মে, ২০১৭

বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০১ আশ্বিন ১৪২৯ ১৭ সফর ১৪৪৪

৯৪তম জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

রবীন্দ্রনাথ, রাজনীতি ও বাম সাহিত্য আমাকে প্রভাবিত করেছে আহমদ রফিক

image

আহমদ রফিক / জন্ম : ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯

ওবায়েদ আকাশ : এই মুহূর্তে আপনি আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য, বর্ষিয়ান। একটি জীবন লেখালেখির সঙ্গে কাটিয়ে দিলেন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় লিখেছেন। সব লেখকই নিজেকে কবি পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, এমনকি রবীন্দ্রনাথও...

আহমদ রফিক : হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ তো বলতেনই, কবিতা আমার প্রিয় সঙ্গিনী।

ও. আ. : এর বাইরে ভাষা আন্দোলন, রাজনীতি, রবীন্দ্রনাথ, অন্যান্য প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস আপনার লেখালেখির বিষয়...

আ. র. : হ্যাঁ, তবে কবিতা এখন লিখছি খুব কম। আমার লেখালেখির কাজগুলো যদি দেখি, তো প্রথমেই ভাষা আন্দোলন, দ্বিতীয়ত রবীন্দ্রনাথ, তারপর রাজনীতি, দেশের রাজনীতি, বিদেশের রাজনীতি, তারপরে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক লেখালেখি। এর মধ্যে দেশবিভাগ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে আমি মনে করি। এবং এটা আমার ছাত্রজীবন থেকে। তখন আমি অসাম্প্রদায়িক বাম রাজনীতি করেছি। সেই বিভাগপূর্ব কালে। সেই থেকে আজ নয় কাল নয় করতে করতে এই তো গত দু’তিন বছর আগে আমি দেশবিভাগ নিয়ে, দেশবিভাগের ট্রাজেডি, বহুমাত্রিকতা নিয়ে প্রায় সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার একটা বই লিখেছি। ট্রাজেডি এই অর্থে, বিদেশীরাও কিন্তু এটাকে বলে ‘সাউথ এশিয়ান ট্রাজেডি’, যেখানে তিন সম্প্রদায়ের কয়েক লক্ষ লোক মারা গেল- হিন্দু, মুসলমান, শিখ। এবং তখন কয়েক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হলো। এবং আমি বলব, ধারালো তলোয়ার পাঞ্জাব এবং বঙ্গদেশ ভাগ করা হলো।

ও. আ. : আপনি আসলে কাকে দায়ী করতে চান?

আ. র. : রাজনৈতিক দল, প্রধান রাজনৈতিক দল, কংগ্রেস এবং লীগ এর জন্য দায়ী ছিল। এবং সেই সঙ্গে ইংরেজ শাসক। বিশেষ করে শেষ দিকে এসে মাউন্টব্যাটেন সর্বনাশটা করলেন। একটি উদাহরণ দেই : যখন দেশ ভাগ হবে এমন সিদ্ধান্ত হলো, কংগ্রেস একটি নির্বাহী বৈঠক করলো এবং তখন বাম রাজনীতির দুএকজন যেমন রামমনোহর লোহিয়া এবং খান আবদুল গাফফার খান কড়া প্রতিবাদ করলেন। গাফফার খান বললেন, মহাত্মাজী এতদিন আমরা কংগ্রেসের রাজনীতি করলাম আর এখন সেই কংগ্রেস আমাদের নেকড়ের মুখে ছুড়ে ফেলে দিলো। নেকড়ের মুখে মানে পাকিস্তানের জিন্না সাহেবের মুখে। এবং পরবর্তীকালে ব্যাপারটা তাই হলো। কারণ সীমান্ত প্রদেশে যে অত্যাচারটা হয়েছে, তাতে খান আবদুল গাফফার খান তার বাকি জীবনটা হয় জেলে না হয় নির্বাসিত জীবন যাপন করেছেন। পাকিস্তানে এবং কাবুলে, আফগানিস্তানে। ওরা তো পশতু পাঠান। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস জিন্না সাহেবের পাকিস্তান দাবিটা মেনে নিলো। দায়টা এক্ষেত্রে যদি জিন্না সাহেবের ৬০% ধরি, বাকি ৪০% অবশ্যই কংগ্রেসের। আর পুরো ভূমিকাটা ব্রিটিশ শাসকদের।

ও. আ. : তখন তো আপনার বয়স ১৭/১৮ বছর। এত অল্প বয়সে আপনাকে এমন একটা ঘটনার সাক্ষী হতে হলো।

আ. র. : হ্যাঁ, তখন আমি ছাত্র, এবং তখন থেকেই আমি সাহিত্য, রাজনীতি, বাম-সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছি।

ও. আ. : বাম-সাহিত্যটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

আ. র. : ওই সময়েই ভারতীয় স্বাধীনতার বিষয়টা আমার কাছে খুব বড় বিবেচ্য বিষয় ছিল। ঠিক কাজী নজরুল ইসলামের মতো। আমার ঐ সময়ের রাজনীতির মেন্টরের কথা যদি কেউ জানতে চায়, তো আমি বলব, একজন কাজী নজরুল ইসলাম এবং আর একজন সুভাষচন্দ্র বসু।

ও. আ. : রাজনীতির মেন্টর বলছেন নাকি সাহিত্যের?

আ. র. : হ্যাঁ, রাজনীতির মেন্টর। নজরুল তো বিদ্রেহের সঙ্গে, ওই সময়ের বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। লেবার স্বরাজ পার্টি করলেন মোজাফ্ফর আহমদের সঙ্গে। ধূমকেতু, নবযুগ পত্রিকা সম্পাদনা করলেন। উনিই তো প্রথম, ‘ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়’, এই ঘোষণা দিলেন। উনি ঘোষণা করলেন ১৯২২ সালে, কংগ্রেস করল কয়েক বছর পরে।

ও. আ. : এ-কারণে আপনি তাঁর সাহিত্যকে বাম-সাহিত্য বলছেন?

আ. র. : হ্যাঁ, এসব কারণে।

ও. আ. : তখন কি সোভিয়েত সাহিত্য আপনাকে আলোড়িত করেছে?

আ. র. : না না তখনো সোভিয়েত সাহিত্য পড়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু গোর্কির ‘মা’ পড়ে আলোড়িত হয়েছি। বন্ধুদের পড়তে দিয়েছি। ওটাও বাম সাহিত্য। তবে বিপ্লবী রাজনীতি প্রিয় বিষয় ছিল। যেমন তখনকার আমার একটা পুস্তিকার কথা বলি, ‘ভকৎ সিং ও তার সহকর্মীরা’। এটি প্রকাশ করেছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি। তাহলে বুঝতে পারো আমার রাজনৈতিক ধারাটা কোনদিকে ছিল। চিন্তা করো আমাদের এখানে এত এত লেখক থাকতে, এত এত ইতিহাসবেত্তা থাকতে যেটাকে বললাম সাউথ এশিয়ান ট্রাজেডি, এটা নিয়ে কেউ কিছু লিখল না। আমি আমার ঐ বইটাতে এ বিষয়টা নিয়ে লিখেছি। অনেক কষ্ট করে অনেক অনেক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। আমাদের এখানে এ ধারার আর কোনো বই নেই। এইভাবে যে সে সময়ের পশ্চাৎগতির সাহিত্য, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদে আজম জিন্দাবাদ মার্কা যে পাকিস্তান বন্দনার সাহিত্য, এটা ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত একই ধারায় বয়ে গেছে। ১৯৫২ সালে এসে ভাষা আন্দোলন একটা বাঁকফেরা পরিবর্তন ঘটালো, সেটা যেমন সাহিত্যক্ষেত্রে, তেমনি রাজনীতির ক্ষেত্রে। সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা পরিবর্তনটা অধিকমাত্রায় দেখি। তখন কুমিল্লায় একটা সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সম্মেলন হলো। আমি, গাজীউল হকসহ অনেকে মিলে ঐ সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলাম।

ও. আ. : এ বিষয়ে আমরা আর একটু পরে আসছি। আগে জেনে নেই, আপনি আসলে শুরুতে কী ধরনের লেখালেখি দিয়ে শুরু করেছিলেন। প্রবন্ধ, কবিতা, রাজনৈতিক লেখালেখি নাকি অন্য কোনো মাধ্যমে?

আ. র. : সব মিলেই। গল্প, কবিতা, সব কিছুই লিখতে শুরু করেছিলাম। আমার ১৯৫৮ সালে যে বইটা বের হলো, সেটা ১৯৫৬ সালে লেখা, বইটির নাম ছিল : ‘শিল্প সংস্কৃতি জীবন’, সেখানে নজরুলের উপর একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ ছিল, বঙ্কিমের উপর একটা প্রবন্ধ ছিল, সেটা অবশ্য সমালোচনামূলকই ছিল বেশি, মীর মশাররফের উপর প্রথম আমার লেখা একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ ছিল।

ও. আ. : জ্বি। আমরা আবার সেই কুমিল্লার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সম্মেলনের ঘটনায় ফিরে যাই।

আ. র. : তখন আমি, গাজীউল হক ছাড়াও সম্মেলনে গিয়েছিল আমার আরেক বন্ধু আনোয়ারুল হক খান। ও তখন ফজলুল হক হলের জিএস। ঢাকা থেকে মুড়ির টিনের মতো একটা বাসে শিল্পী আব্দুল আলীম, শেখ লুৎফর রহমান, সোহরাব

হোসেনসহ আরো অনেকে গিয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে হলো ভাষা আন্দোলন, সম্মেলন হলো অগাস্টে। সেখানে নজরুল সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, লোকসঙ্গীত, ইকবালের সেই বিখ্যাত ‘জাগো দুনিয়ার’ গানটি। এরকম আরো পরিবেশনা হলো সেদিন। ফনি বড়–য়া ও রমেশ শীলের ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ কবিগান রাতভর আমরা ঈশ্বর পাঠশালার প্রাঙ্গণে বসে শুনলাম। সেই সম্মেলন ছিল জাতীয়তাবাদী বাঙালি চেতনার সম্মেলন। জাতীয়তাবাদী, প্রগতিবাদী, লোকসংস্কৃতি-চেতনার সেই সম্মেলন সম্ভব হলো ভাষা আন্দোলনের কারণে।

ও. আ. : আয়োজক কারা ছিল?

আ. র. : আয়োজক ছিল কুমিল্লারই শিল্প সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রগতিশীল কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন। ও আর একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, ওই সম্মেলনে তখনই কিন্তু বিজন ভট্টাচার্যের নাটক ‘নবান্ন’ ও ‘জবানবন্দি’ মঞ্চস্থ হলো। সেই কুমিল্লা সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের আমলে, যুক্তফ্রন্ট এত শক্তিশালী ছিল যে, মুসলিম লীগের মতো দল তার কাছে ধরাশায়ী হলো। সেই যুক্তফ্রন্টের আমলে ১৯৫৪ সালে কার্জন হলে তিন দিনব্যাপী সাহিত্য সম্মেলন হলো। এই সম্মেলনে সুভাষ মুখার্জি, কাজী আবদুল ওদুদ, মনোজ বসু থেকে শুরু করে কলকাতা থেকে ৩০/৪০ জন যোগ দিতে এসেছিলেন। আমার এখনো মনে আছে, লায়লা সামাদ বললেন, ঘোমটা ছেড়ে বেরিয়ে এসো নারী। আজ অহরহ এত নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন হচ্ছে। আমার এখনো মনে আছে, সেই সম্মেলন থেকে মেয়েরা কার্জন হল থেকে সেই আজিমপুর কলোনি পর্যন্ত রাত সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরে গেছে। কোনো আক্রমণ হয়নি। ঝামেলা হয়নি। ৫০-এর দশকের এজাতীয় পরিবেশ কিন্তু একটা বিরাট ঘটনা ছিল।

ও. আ. : সবাই যেটা আপনাকে জিগ্যেস করে, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে কীভাবে জড়িত হলেন?

আ. র. : আমি স্কুল থেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলাম। কলেজ জীবনে রাজনীতি করেছি। সেই ১৯৪৮ সালে মুন্সিগঞ্জে ভাষা আন্দোলন করেছি। তখন আমি মার্কসবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাই। বিশেষভাবে পাঠ নিয়েছি। ওয়েব দম্পতির ‘সোভিয়েত কম্যুনিজম’ বই পড়েছি। ওরা হাসব্যান্ড-ওয়াইফ, দু’জনেই কম্যুনিস্ট। সেই সময়ে কবিতার ওপরে ক্রিস্টোফার কডোয়েলের লেখা ‘ইল্যুশন এ্যান্ড রিয়েলিটি’ পড়েছি। অর্থাৎ সেই সময়ে সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতির জন্য যা যা দরকার সব পড়েছি। তখন আমি লোরকা পড়েছি, নেরুদা পড়েছি। তারপর ১৯৪৯ সালে ঢাকায় এলাম। এরপরে ঢাকায় যতগুলো গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয়েছে, এগুলোতে অংশ নেয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।

সেই সময়েই সংগঠিত হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। আমি সংগঠক হিসেবে সরাসরি আন্দোলনে যোগদান করি। আমার কাজ ছিল বিভিন্ন হলে ছাত্রদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, সারা দিন মিছিল-মিটিং করা। আন্দোলনে গুলি চালানোর ঘটনাটা সরাসরি আমার সামনেই ঘটে। বরকত রফিক জব্বার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সে সময়ের ছাত্ররা একাডেমিক পড়াশোনার চেয়ে রাজনীতি শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ক পড়াশোনা এবং সাংগঠনিক কার্যক্রমকে বেশি গুরুত্ব দিত। মওলানা ভাসানী একমাত্র ব্যক্তি যিনি স্বীকার করলেন, যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে ছাত্রদের এবং সাধারণ জনগণের অবদান সবচেয়ে বেশি। তখন আমাদের হোস্টেলের খাবারের খুব সুনাম ছিল। যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পরে আমরা আমাদের হোস্টেলে খাওয়ার জন্য তিন প্রধান নেতাকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী। তখন খাওয়াদাওয়া শেষে একমাত্র মওলানা ভাসানী এই স্বীকারোক্তি করেছিলেন। যখন কেন্দ্রের ষড়যন্ত্রে, ৯২ক ধারা জারি করে যখন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করা হলো, তখন আমার ফাইনাল পরীক্ষার এক মাস বাকি, তারিখটি আমার এখনো মনে আছে, ৩০ মে ১৯৫৪। সেদিন আমরা হস্টেল প্রাঙ্গণে ঘাসের ওপর বসে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর বক্তৃতা শুনলাম, আমার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল, দেড় বছর আত্মগোপনে কাটিয়ে ফিরে এসে বহু কষ্টে পড়াশোনা শেষ করলাম। পরবর্তী জীবনে আমার আর মেডিকেল লাইনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল না। ভাল কোনো চাকরিও করতে পারিনি। অথচ মেট্রিকে আমি বিভাগপূর্ব কালে কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছিলাম, ইন্টারমিডিয়েটেও আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছিলাম। আমি সর্বাত্মকভাবে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। তারপরে তো জীবন সংগ্রাম। আমি দেড় বছর বয়সে পিতৃহারা হয়েছি। আমার বড়ভাই সংসার চালাতেন। আমরা চার ভাইয়ের মধ্যে আমি সর্বকনিষ্ঠ। স্বাভাবিকভাবেই একটা চাপ এসে পড়ল। তার পর থেকে ৩/৪ বছর আমার খুব খারাপ সময় গেছে। হেন কাজ নেই যে আমি করিনি। গোয়েন্দা গল্প লেখা, নোটবই লেখা, মিল্লাত পত্রিকায় সাব এডিটরগিরি করা, ছাত্রছাত্রী পড়ানো, এসব বিচিত্র কাজ করেছি। ফার্মাকোলোজি বিষয়টা আমার খুব প্রিয় ছিল। ওটা ড্রাগের ব্যাপার। এলাবার্ট ডেভিডে চাকরি নিলাম। টেকনিক্যাল ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টের চিফ হিসেবে। সেখানে ছিলাম সত্তর একাত্তর পর্যন্ত। ওখানে যুক্ত থাকার কারণে বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিস কর্পোরেশন)-এ জয়েন করলাম। এর মধ্যে একটি কথা আমি বলি, ১৯৬৪ সালে আমি দুটো কাজের সঙ্গে খুব আগ্রহের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ছাত্র জীবন থেকেই আমার শখ ছিল এসটি সাহিত্য পত্রিকা বের করা। আমার বন্ধু আলীম চৌধুরী ‘যাত্রিক’ নামে একটি সাহিত্যপত্রিকা চালাতো। আমি ওটার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।

ও. আ. : আপনার সাহিত্য পত্রিকার নাম কি ‘নাগরিক’ ছিল?

আ. র. : হ্যাঁ, হ্যাঁ, নাগরিক। একেবারে সত্তর সাল পর্যন্ত চালিয়েছি। সেখানে তখনকার এমন কোনো তরুণ লেখক ছিল না, আজকে যারা প্রতিষ্ঠিত লেখক, যে তারা লেখেনি। আমি দুজনের কথা খুব বিশেষভাবে বলি : একজন আবুল হাসান এবং একজন নির্মলেন্দু গুণ, ওদের দুজনের কবিতা আমি ‘নাগরিক’-এ ছেপেছিলাম। ওরা দুজন খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রথম গল্প এবং প্রথম কবিতা আমি ছাপি। হাসান আজিজুল হকের প্রথম গল্প আমি প্রথম ছাপি। ওর প্রথম দিককার ৩/৪টা গল্প আমি নাগরিক-এ ছাপি।

এই পত্রিকাটা কেউ কোনোদিন হাইলাইট করেনি। এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান এবং শওকত ওসমান। প্রত্যেক সংখ্যায় তারা লিখতেন।

আমি আর একটি কাজ করেছিলাম। তখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে বাঙালিদের কোনো স্থান ছিল না। তারা ছিল নিগৃহীত। তাই আমি আর আমার ছয় বন্ধু মিলে ‘ওরিয়ন ল্যাবরেটরিজ’ নামে একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি খুলেছিলাম। ‘নাগরিক’ আর ‘ওরিয়ন’ এই দুটো ছিল আমার অন্যতম সৃষ্টি।

ও. আ. : নাগরিক সম্পর্কে আর একটু জানতে চাই। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি পত্রিকা আপনি করেছেন। এখনকার আমরা যারা লিটল ম্যাগাজিনকে এন্টিএশটাবলিশমেন্টের চরিত্রে দাঁড় করাতে চাই। তখন নাগরিকের কনসেপ্টটা কি এরকম ছিল?

আ. র. : হ্যাঁ, তা তো বটেই। নাগরিককে আমি সংকীর্ণ বাম রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইনি। আমার কনসেপ্টটা ছিল, নাগরিক হবে আধুনিক এবং প্রগতিশীলদের পত্রিকা। সেখানে মুক্তমনা সাহিত্যিকরা সাতিহ্যচর্চা করবে। সেখানে বুক রিভিউ সেক্টরটা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। দেশী বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর রিভিউ ছাপাতাম। সেখানে আমি জাঁ পল সার্ত্রের একটি বইয়ের একটি দীর্ঘ বিভিউ করেছিলাম, ছদ্মনামে। আরো অসংখ্য বইয়ের রিভিউ ছাপা হতো। সে সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধে বারট্রার্ন্ড রাসেলের লেখা ‘ওয়ার ক্রাইমস ইন ভিয়েতনাম’ বইটির সমালোচনা ছেপেছিলাম। আমেরিকানদের সমালোচনা করে লেখা বইটি, সেটারও একটা রিভিউ ছাপা হয়েছিল।

ও. আ. : এই যে, কবিতা, পরিচয়, সমকাল বা আপনার ‘নাগরিক’ এসব পত্রিকা মূলত সাহিত্য ক্ষেত্রে কী ধরনের অবদান রাখে?

আ. র. : ঐ সময় আমার পত্রিকার লক্ষ্য ছিল, আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতাকে উৎসাহিত করা। এ ধরনের পত্রিকা সাহিত্যের বাঁক বদলে বিশেষ ভূমিকা রাখে, এসব পত্রিকার মাধ্যমে সাহিত্যের একটি যুগ সৃষ্টি হয়। যেমন তোমাকে আর একটা ঘটনা বলি : তখন জাক দুকরে নামে একজন ফরাসি ফ্রি ল্যান্স জার্নালিস্ট ঢাকায় এসেছিলেন। আমি তখন গোপিবাগ থাকি, ৪৬/১ রামকৃষ্ণ মিশন রোড, আমার এক বন্ধু তাকে নিয়ে এল। সে এসেছে মূলত সাউথ এশিয়া দেখতে। তো তার সঙ্গে কথা বলে দেখি, সে দুনিয়ার সব খবর রাখে। সিআইএ এখানে কী করছে, কে কী করছে, দুকরে সব জানে। আমি তাকে আধুনিক ফরাসি সাহিত্য নিয়ে ইংরেজিতে একটি প্রবন্ধ লিখতে অনুরোধ করলাম। তিনি চমৎকার একটি প্রবন্ধ লিখলেন, বশির আল হেলাল সেটা অনুবাদ করল। সেটা নাগরিকে ছাপালাম। বুঝতেই পারছ, নাগরিক কেমন ধারার পত্রিকা ছিল।

ও. আ. : শুরুতে আপনার কবিতা নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম।

আ. র. : হ্যাঁ, ’৬৬ সালে আমার প্রথম কবিতার বই বের হয় ‘নির্বাসিত নায়ক’। তারপর সত্তরে বাঙালিয়ানার টানে লেখা হয় বাউল মাটিতে মন। তারপর যুদ্ধ শুরু হলো। তখন লিখলাম রক্তের নিসর্গে স্বদেশ।

ও. আ. : একটা সময় আপনি মনে হয় খুব কবিতাপাগল ছিলেন। কবিতা নিয়ে খুব উন্মাতাল সময় কাটত। আপনার সেই কবিতামগ্ন দিনগুলি সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। এসময়ের কথা, বন্ধুদের কথা।

আ. র. : তখন হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন, সে তখন প্রায়ই আমার হোস্টেলে আসতো। বিশেষ বিশেষ ছোট্ট সময়পর্বে কবিতা নিয়ে উন্মাদনা। প্রথম কবিতা ‘সংকেত’ ছাপা হয় ১৯৫০-এ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রথম ম্যাগাজিনে। ‘যাত্রিক’ সাহিত্য পত্রিকাটিতে পর পর তিনচারটি কবিতা ছাপা হয় (১৯৫৩-৫৪)। এরপর তো রাজনীতির ডামাডোল পর্বে কবিতা অনেকদিনতক নির্বাসনে। আবার কয়েক দশক পর কবিতা লেখা- নতুন করে ভিন্ন ধারায় বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়।

ও. আ. : তখনকার আপনাদের যে সাহিত্য আন্দোলন ছিল সেটা মূলত কোন লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়েছিল? নতুন সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে আপনাদের আন্দোলনটা ঠিক কী রকম ছিল?

আ. র. : সাতচল্লিশ থেকে একান্ন পর্যন্ত যে পাকিস্তানবাদী সাহিত্য ধারার চালু হয়েছিল, তালিম হোসেন বা গোলাম মোস্তফারা যে ধারার প্রবর্তক ছিলেন, বায়ান্ন সালে এসে কিন্তু সেই ধারা একেবারে পাল্টে গেল। আধুনিকতা ও প্রগতিশীল সাহিত্যচর্চার ধারাটা শুরু হলো। আমাদের লক্ষ্য ছিল সেই ধারাটাকে বহন করে চলা। তার পরিপুষ্টি ঘটানো।

ও. আ. : সেসময় বিশ্বসাহিত্যের কারা আপনাদের সামনে আদর্শ হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন?

আ. র. : আমরা তখন বেশি গুরুত্ব দিয়েছি বাম ধারার লেখকদের। অডেন, লোরকা, নেরুদার মতো কবিদের। এলিয়ট মূল্য পাননি কারণ তিনি শেষ পর্যন্ত ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। বন্ধ্যাভূমি চাষ করে শেষ পর্যন্ত তিনি সাম্রাজ্যবাদী সেকথা বিষ্ণু দে’র কবিতাতেও উল্লিখিত। একসময় ব্রেখ্টের কয়েকটি কবিতার অনুবাদও করেছিলাম। বিশ শতকের ফরাসি কবিদের মধ্যে পল এলুয়ার ও লুই আরাগঁ আমার প্রিয় কবি। নেরুদা, লোরকার কথা আগে বলেছি।

ও. আ. : তিরিশের দশক সম্পর্কে আপনাদের ধারণা কেমন ছিল।

আ. র. : তিরিশ সম্পর্কে আমরা পজিটিভ ছিলাম একারণে যে, তারাও আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতাকে গ্রহণ করেছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের সেই কবিতা, আমি কামারের,... আমি মজুরের... নজরুলের পর এই ধারাটাকে আমরা গ্রহণ করেছিলাম। সমর সেনের কবিতা, সুভাষ, সুকান্ত, মঙ্গলাচরণের কবিতা... এগুলোকে আমরা গ্রহণ করেছিলাম। আমার ‘নির্বাসিত নায়কের’ মূল কথাই ছিল, উঠতি পুঁজিবাদকে আঘাত করা। এই নির্বাসন মানে গ্রামে ফিরে যাওয়া নয়। মানে ব্যাক টু ভিলেজ। মানে গ্রামের মানুষকে অর্থনৈতিক মর্যাদায় সামনে তুলে আনা। রবীন্দ্রনাথ তো বলেছিলেন, গ্রাম পড়ে আছে মধ্যযুগে, শহর আধুনিক যুগে, দুইয়ের মধ্যে কালাপানির ব্যবধান, এ ব্যবধান ঘুচাতে হবে। এ কারণে রবীন্দ্রনাথ সেই ১৯০৫ সালে কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ক্ষুদ্র ঋণ ও সমবায় ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। যে ভাবনা থেকেই নোবেল পুরস্কার এলো বাংলাদেশে। এ দুটোই ছিল রবীন্দ্রনাথের গ্রাম উন্নয়নের মাইলস্টোন।

ও. আ. : রবীন্দ্রনাথের ভাষা এবং উপস্থাপনা কি সেই সময়ে আপনাদের মধ্যে কোনো বিরূপ প্রভাব বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল? কারণ আপনারা তো ভাষায় এবং চিন্তায় চেঞ্জ হয়ে গেলেন।

আ. র. : না তা করেনি, তবে চিন্তায় কিছুটা বিরোধিতা দেখা দিল যখন তিনি উনিশ শতকের শেষের দিক থেকে বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত অনেকটা ভক্তিবাদী ধারায় ফিরে গেলেন। সেই ধারাটা আমরা সমর্থন করতে পারিনি। কিন্তু ১৯১৪ সালে ‘সবুজপত্রে’ প্রমথ চৌধুরী যখন চলতি ভাষায় লেখা পদ্ধতি প্রকাশ করতে শুরু করলেন, তখন তার পিছনে রবীন্দ্রনাথেরই কিন্তু বেশি উৎসাহ ছিল। সেখানে তিনি নবীনের বন্দনা করলেন, সবুজের অভিযান লিখলেন : ‘আয়রে নবীন আয়রে আমার কাঁচা’ লিখলেন। ‘বলাকা’য় এসে সে পরিবর্তন আরো স্পষ্ট হলো। ‘বলাকা’র প্রথম কবিতাই তো ‘সবুজের অভিযান’। এই সবুজের অভিযানই তো সবুজপত্রের প্রথম সংখ্যায় বেরুল। এখানে এসে রবীন্দ্রনাথ আরো আধুনিক হয়ে উঠলেন।

বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা

এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা।

স্বর্গ কি হবে না কেনা?

বিশ্বের ভা-ারী শুধিবে না এত ঋণ?

রাত্রির তপস্যা সে কি আনবে না দিন?

নিদারুণ দুঃখরাতে

মৃত্যুঘাতে

মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্তসীমা

তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?

বলাকায় রবীন্দ্রনাথের এই যে ধারা, এই ধারার পরিবর্তন কিন্তু ভাষার দিক দিয়েও পরিবর্তন। এখানে তিনি চলতি ভাষার ব্যবহার করেছেন। কিন্তু আমি রবীন্দ্রনাথের শেষ দশক বা ত্রিশের দশকের কবিতাকে সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করি। ত্রিশের দশকে তাঁর রাশিয়া সফর, তাঁর ‘রথের রশি’, ‘তাসের দেশ’ এই সব নাটকের মধ্য দিয়ে যে প্রগতিযাত্রা, এটা কিন্তু ত্রিশের দশকেই ঘটল। তাঁর কবিতায় ব্যাপক পরিবর্তন আসলো। শিলাইদহে এসে বাউল সাধনা, গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যে রে’ গানের প্রেমে পড়ে গেলেন।

ও. আ. : আপনি কোন জায়গাটা থেকে রবীন্দ্রচর্চা শুরু করলেন? কীভাবে?

আ. র. : ১৯৪৮ সালে যখন ইন্ডিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি হার্ড লাইন নিল : ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হায়, লাখো ইনসান ভুখা হায়’ এই স্লোগানটা সঠিক ছিল কিন্তু সময়োপযোগী ছিল না। স্লোগানটা সময় উপযোগী ছিল না এই কারণে যে, দেশ কেবল পরাধীনতামুক্ত হয়েছে। আমরা যদিও বলি যে, দেশ পুরোপুরি স্বাধীন নয়। তখন কম্যুনিস্টরা এবং অন্যরাও বলেছে যে, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, ক্ষমতার হস্তান্তর। ব্রিটিশরা সমঝোতা ও সংলাপের মাধ্যমে লীগ এবং কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা দিয়ে তাদের কমনওয়েলথের গোয়ালে ঢুকিয়ে চলে গেল। আমি এইখানে বলবো যে, এত বিপ্লব হলো, বিপ্লবীরা ফাঁসির মঞ্চে জীবন দিল, দ্বীপান্তরে জীবন দিল তবু কিন্তু তারা স্বাধীনতা আনতে পারলো না। স্বাধীনতা এলো সমঝোতা এবং সংলাপের মাধ্যমে। কিন্তু এটা তো হয় না। তবু স্বাধীনতা নিয়ে তখন হিন্দু মুসলমান সবার মধ্যে উন্মাদনা। এই সময় যদি বলি যে, এটা স্বাধীনতা নয়, মানুষ শুনবে? এই জন্যই বললাম যে, স্লোগানটা সময় উপযোগী ছিল না। সেই সময় কম্যুনিস্টরা খুব বিপর্যয়ের মুখে পড়লেন। সেই ধারাবাহিকতায় তারা রবীন্দ্রথানকে বর্জন করলেন, রামমোহন, বিদ্যাসাগরকেও বর্জন করলেনই, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বললেন যে, রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট মাত্রায় প্রগতিশীল নন। সেই ধারা বহন করলেন আমাদের এখানে আখলাকুর রহমান, মুনীর চৌধুরীরা। কলকাতার আদলে এখানে গঠিত প্রগতি লেখক সংঘ একই পথে। অজিত গুহ মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছিলেন বলে তাকে বহিষ্কার পর্যন্ত করলো। তা অবশ্য বেশি দিন টেকেনি। বছর দুয়েক টিকেছিল। পরে অবশ্য অনেকে পাপ মোচন করেছেন, মুনীর চৌধুরী পাপ মোচন করে পরে বললেন, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমাদের চলেই না। তো সেই সময় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন বিতর্ক আমাকে তাকে নিয়ে লেখালেখি করতে উদ্বুদ্ধ করে। পরে যখন পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হলো, জন্মশতবার্ষিকী পালনে বাধা দেওয়া হলো, তখন থেকে পুরো মাত্রায় আমি রবীন্দ্র গবেষণা ও তাঁকে নিয়ে লেখালেখি শুরু করি।

ও. আ. : মাইকেল মধুসূদন সম্পর্কে আপনার বক্তব্য শুনতে চাই।

আ. র. : মাইকেলকে আমি আধুনিক কবি মনে করি। পরিবর্তন ঘটালেন তিনি আঙ্গিকে এবং বিষয়ে। তিনি রাবণকে বীরের মর্যাদায় দাঁড় করিয়ে একটি বিপ্লবী কাজ করলেন। তিনি রাজনৈতিক এবং সাহিত্যিক উভয় দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি।

ও. আ. : আপনি সাহিত্যের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে দেখেছেন, সাহিত্যের একটা শাশ্বত স্বর থাকে, তবু সাহিত্য বিভিন্ন দশকে বদলায়। এখনকার সাহিত্যও বদলেছে। তো আপনি বর্তমান সময়ের সাহিত্য সম্পর্কে কী বলবেন?

আ. র. : হ্যাঁ, আমি বিভিন্ন সময়ের বাঁকবদলগুলো দেখেছি। চল্লিশের দশক ছিল একটা দামাল দশক, বাম সাহিত্য রাজনীতির উত্থানের দশক। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত দেখছি। এখনকার সাহিত্য অনেকবেশি বিচ্ছিন্ন এবং মেইনস্ট্রিম থেকে আলাদা মনে হয়। ইংরেজি সাহিত্যেও এখন মেইনস্ট্রিম বলে কিছু নেই। সবাই বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। সামাজিক রাজনৈতিক সাহিত্যিক দায়কে তারা নিজের মতো করে মেনে নিয়েছে। সেখান থেকেই তারা আলাদা একটি ধারা তৈরি করছে।

ও. আ. : পোস্টমডার্ন চিন্তাবিদরা সব কিছুর ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের শক্তিমত্তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

আ. র. : হ্যাঁ, এটার যেমন ইতিবাচক দিক আছে, তেমনি নেতিবাচক দিক আছে। যেমন ফরাসি দেশেও একদল শিল্পী আছেন, যারা মেইন স্ট্রিম থেকে বের হয়ে তাদের নিজেদের মতো করে ছবি এঁকেছেন, এবং তার দায় তারা স্বীকার করে নিয়েছেন।

ও. আ. : ভিন্ন দেশের উন্নত সাহিত্যের তুলনায় আমাদের সাহিত্যের মান এখন কোন পর্যায়ে বলে মনে করেন?

আ. র. : এখন সারা পৃথিবীতে যে সাহিত্য রচিত হচ্ছে, সেখানে ইংরেজি সাহিত্যের অবস্থান তেমন আশাব্যাঞ্জক নয়। আমরা আসলে ইউরোপীয় ভাবধারায় এখনো সাহিত্য করে যাচ্ছি। ইউরোপের সাহিত্যই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের আইডল। আমার অবজার্বেশন থেকে বলতে পারি এখন পৃথিবীতে ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য ও কিছুটা আফ্রিকান সাহিত্য মানুষের সবচেয়ে বেশি কাছে যেতে পারছে এবং গুণগত মানে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। যেমন আজকে মার্কেজের কথাই ধরো, সে আজ কেন এত আলোচিত? কারণ সে তার সাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করেছে তার হাতের কাছ থেকে। নিজের মাটি নিজের দেশ থেকে। এখন সাহিত্যকে উপরে তুলে নিয়ে যেতে হলে তাকে স্থানীয়করণ করতে হবে। নিজের দেশের প্রকৃতি, নিজের দেশের মানুষের সুখ-দুঃখ-জীবনাচারকে প্রাধান্য দিতে হবে। এ কথা শুধু বাংলা সাহিত্যের বেলায় নয়। পৃথিবীর যে কোনো দেশের সাহিত্যের জন্যই এ কথা অবশ্য পালনীয়।

ও. আ. : দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং কবি-লেখক-শিল্পীদের সামাজিক দায় সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?

আ. র. : বিশ শতকের শেষের দিক পর্যন্ত যে প্রতিবাদমুখর বিশ্ব, তখনকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে রোলা বার্বুস, আইনস্টাইন, বার্ট্রান্ড রাসেল, বার্নার্ড শ এবং রবীন্দ্রনাথও যে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন, সেই ঘোষণাপত্রের প্রথম কথাটা?ই ছিল : বর্তমান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেই সন্ধিক্ষণে নীরবতার অর্থ পাপ। আমি এই কথাটাই আবারো উচ্চারণ করবো যে, আমাদের ও বিশ্বের বর্তমান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ সকল মহলের নীরব থাকাটাই পাপ। কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের শুধু লেখার টেবিলে থাকলে চলবে না। তাদের বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। ঘরে বাইরে একত্রে সোচ্চার হতে হবে। সমাজের দায় তাদের বহন করতে হবে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ৭ মে, ২০১৭