লিটন চক্রবর্তী মিঠুন
অঙ্গীকারের অনড়তা, চিন্তার পরিচ্ছন্নতা, বোধের শুভ্রতা, বিদ্যাচর্চার অনলসতা, ভাষার গতিময়তা, সংলাপের সরসতা এবং বিনয়ের ব্যাপকতা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের যে ক’জন গুণীজনকে বিশিষ্ট করেছে, আবদুস সেলিম নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্যতম।
প্রধানত অনুবাদক সেলিমের অনুবাদ চর্চার শুরু সেই ছোটবেলায় বাবা সামাদ সাহেবের প্রযতেœ। কিশোর সেলিমের মধ্যে ইংরেজি ভাষাপ্রীতি ও ভাষাগত দক্ষতার আভাস দেখে বাবা তাকে নিয়মিত বাংলা থেকে ইংরেজিতে ও ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদের কাজ দিতেন। এর জন্য নোটবইও দিয়েছিলেন একাধিক। একটিতে খসড়া করতেন সেলিম আর তার ওপর ফিডব্যাক দিতেন বাবা। পরে সংশোধনপূর্বক অনুবাদকর্মসমূহ আরেকটি খাতায় তুলতেন। কৈশোরের এ অনুবাদ অনুশীলন ভবিষ্যৎ অনুবাদক সেলিমের জন্য শক্তিশালী ভিত নির্মাণ করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে অনুবাদ ও প্রবন্ধচর্চায় আসেন ১৯৬৯ সালে বন্ধু কবি ও সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে “শিল্পকলা” নামক ম্যাগাজিন যৌথভাবে সম্পাদনা করতে গিয়ে। স্বল্পায়ু এ ম্যাগাজিনটির আটটি সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৬৯-১৯৭২ সময়পর্বে। মূলত এ ম্যাগাজিনটির বদৌলতে মননশীলতার অভিযাত্রা শুরু হয় আবদুস সেলিমের। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ এবং ১৯৭৮ সালে কলকাতা সফরে গিয়ে বহু গুণী মানুষের সান্নিধ্য লাভ করেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন বুদ্ধদেব বসু, প্রতিভা বসু, বিষ্ণু দে, শঙ্খ ঘোষ, অশোকানন্দ দাশ, জিষ্ণু দে প্রমুখ। ১৯৭৬ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের বৃত্তি পেয়ে পড়তে যান ইংল্যান্ডে। তখন থেকে পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্যর আরও নিবিড় যোগাযোগ ঘটে তাঁর। একদিকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থানীয় ঐতিহ্য-অনুরাগ আর অন্যদিকে কসমোপলিটান দৃষ্টিভঙ্গি- এ দুটি ধারার যুগলস্রোতে স্নাত হন তিনি।
বের্টল্ট ব্রেখটের গ্যালিলিও নাটকটি অনুবাদ করেন ১৯৭৫ সালে- যা মুদ্রণাকারে প্রকাশিত হয় ’৭৮-এ। ১৯৮৬ সালে নাটকটি মঞ্চায়িত হলে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন আলী যাকের। ব্যাপকভাবে দর্শকনন্দিত ও সমালোচক-প্রশংসিত হয় গ্যালিলিও। বহুবার মঞ্চায়িত এ নাটকের অভাবনীয় সাফল্য তাঁকে উজ্জীবিত করে নাটকের অনুবাদে। মজার বিষয় হচ্ছে, এ নাটকের বদৌলতে আলী যাকেরের নামের সাথে গ্যালিলিও জুড়ে যায়। সে থেকে আজ অবধি তিনি ত্রিশটির বেশি নাটক অনুবাদ করেছেন যার মধ্যে সাতাশটি গ্রন্থবদ্ধ। আরও বেশ কয়েকটি অগ্রন্থিত আছে। নাটক অনুবাদ করেছেন বললে আসলে কম বলা হয়। অনেকগুলো নাটককে তিনি আসলে এডাপ্ট করেছেন, বাঙলায়ন করেছেন, দেশীয়
প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছেন। আক্ষরিক অনুবাদের যান্ত্রিক চর্চার বাইরে গিয়ে সাংস্কৃতিক তরজমার তরিকায় আস্থা রেখেছেন। তাঁর বেশিরভাগ নাটকের শক্তিমত্তা ঠিক এখানে, যে, দর্শক বিদেশি-বিভাষী নাটক দেখার দূরত্ববোধ দ্বারা খুব একটা আক্রান্ত হন না। বরং নাটকের চরিত্র ও গল্পের সাথে এক ধরনের আত্মিকতা অনুভব করেন। অনুবাদ-প্রক্রিয়ায় মূলের সাহিত্যগুণ ধরে রেখে টেক্সটকে দেশজতায় অভিষিক্ত করার নিপুণতা এক্ষেত্রে সেলিমকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।
ভাষা-ব্যবহারে ও সংলাপ নির্মাণে সেলিম সহজাত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পাত্র-পাত্রীর সামাজিক অবস্থান ও শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে ভাষা প্রয়োগ করেছেন। যেহেতু তাঁর নাটকের দর্শক প্রধানত বাংলাদেশী, তিনি শিক্ষিত ঢাকাই মধ্যবিত্তের ইংরেজি ও আঞ্চলিক ভাষার উপাদানযুক্ত কথ্য বাংলা খুব সাবলীলভাবে ব্যবহার করেছেন। ফলে ভাষাগত কৃত্রিমতা ও সংলাপের আড়ষ্টতা সেলিমকৃত নাট্যানুবাদে বিরল ঘটনা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আটপৌরে বুলি বুলবুলির মতো গাইতে থাকে সেলিমের নাট্যভুবনে, যা স্বস্তির ও আনন্দের। কেননা, নাটক মাধ্যমটিই এমন যা দর্শকের সঙ্গে পাত্র-পাত্রীর সরাসরি মিথস্ক্রিয়া তৈরি করে যার যোগসূত্র সংলাপ ও তার ভাষা।
তিন খ-ে তাঁর অনূদিত ১৯টি নাটক রয়েছে। এছাড়া, নাট্যত্রয়ী সংকলনে তিনটে, ৫ মঞ্চানুবাদ সংকলনে যথারীতি ৫টি এবং অগ্রন্থিত আরও বেশ ক’টি অনূদিত নাটক রয়েছে। এর বাইরে এডওয়ার্ড অ্যালবির হু’জ আফরেইড আভ ভার্জিনিয়া উল্ফ্, এবং দারিও ফো ও ফ্রাংকা রামের Rise and Shine এবং A Woman Alone(একা এক নারী) অনুবাদ করেন সাফল্যের সাথে। অ্যালবির নাটকটি এখনো মঞ্চে আনা যায়নি অশ্লীলতার সম্ভাব্য দায় এড়াতে। তবে খুবই এবসার্ড ঘরানার নাটকটি খুবই প্রাসঙ্গিক; বিশেষ করে, সেলিমের তরজমায় এ নাটকের সংলাপগুলো কানে ঝঙ্কার ও মনে রেখাপাত করার মতো। একা এক নারী অবশ্য মঞ্চসফল, তনিমা হামিদের অনবদ্য অভিনয় তাতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। অন্যদিকে, জাপানি নাটক ১০০ Sacks of Rice (একশ বস্তা চাল) অনুবাদ করে বাংলাদেশের দর্শকের কাছে জাপানি নাটকের স্বাদ ও গন্ধ পৌঁছে দেন নাট্যসাধক সেলিম। ক্ষেত্রবিশেষে এ জনপ্রিয়তা বহুল প্রচারিত গ্যালিলিওকেও টেক্কা দেয়। নাট্যকার মামুনুর রশীদ তো ব্যক্তিগত আলাপে সেলিমকে জানান যে, এ নাটকটি গ্যালিলিওর চাইতে বেশি ভালো লেগেছে ওনার।
লুইস ক্যারলের AliceÕs Adventures in Wonderland-এর Broadway Theatre-কৃত নাট্যরূপের অনুবাদ করেন এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড নামে। বাংলাভাষী কোমলমতি শিশুদের মানসিক বিকাশ ও বিনোদনের শুভ অভিপ্রায়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে ভাষান্তরের কাজটি করেন যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। একটি মরাগাছ ও চারটি নারীর মৃত্যু নাটক হিসেবে অনন্য। এছাড়া, টেলিভিশানের জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটো ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি গল্পকে নাট্যরূপ দেন এবং হেনরিক ইবসেনের একটি নাটক অনুবাদ করেন সসাগরা কন্যা নামে। এছাড়া, টেলিভিশানের জন্য তিনটি মৌলিক নাটকের কাহিনি ও চিত্রনাট্য লেখেন যার অন্যতম ওফেলিয়া এখন।
আগেই বলা হয়েছে, বেশ কিছু অনূদিত নাটক তিনি বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্থাপন করেছেন স্থানীয়করণ প্রক্রিয়ায়। যেমন: দারিও ফো-র রাইজ এন্ড শাইন নাটকটিকে রূপায়িত করেছেন একজন বাংলাদেশি গার্মেন্ট কন্যার গল্পাকারে। ডেভিড হেয়ারের The Vertical Hour (প্রলম্বিত প্রহর) সেলিমের তরজমায় পেয়েছে বাংলাদেশি আদল ও চারিত্র্য। এ. আর. গার্নির খড়াব Love Letters (প্রেমপত্র) অভিযোজিত হয়ে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প হয়ে উঠেছে। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি অকুণ্ঠ নিবেদন সেলিমের অনুবাদক সত্তাকে বারবার শেকড়মুখী করেছে। কেবল দেশপ্রেমের আবেগ নয়, বরং নাটকের মতো প্রবল অডিয়েন্সমুখী শিল্পমাধ্যমকে আরও জনপ্রিয় করে তোলার জন্য দেশজকরণের বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়াস চালিয়েছেন।
বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রতিনিধিত্বশীল সাহিত্যকর্মকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করেন। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক আবু ইসহাকের নন্দিত উপন্যাস ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’কে তিনি ঝরঝরে ও গতিময় ইংরেজিতে তরজমা করেন একই নামে। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে নবসৃষ্ট পাকিস্তানে বাঙালির জীবন সংগ্রাম, গ্রাম বাংলার জীবনপ্রবাহ, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, সামন্তবাদ, নারীবিদ্বেষ, মোল্লাতন্ত্র, ইত্যাদি অনুষঙ্গে রচিত উপন্যাসটি অনুবাদ করাটা চ্যালেঞ্জিং অনেক দিক থেকেই। পূর্ববঙ্গীয় লোকজ ভাষা, প্রবাদ-প্রবচন, লোকগান ও পল্লী সংস্কৃতির বিবিধ উপাদানকে ইংরেজির মতো সম্পূর্ণ ভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভৌগোলিক বাস্তবতার ভাষায় ফুটিয়ে তোলার জন্য যে রকম নৈপুণ্য ও কল্পনাপ্রতিভা দরকার তার শতভাগ উজাড় করে দিয়েছেন সেলিম। ভাষার সাবলীলতা ও ছন্দোময়তা এ অনুবাদটিকে ভিন্ন ব্যঞ্জনা দান করেছে। একইভাবে, সুরমা জাহিদের ১৯৭১-এ সম্ভ্রম হারানো নারীদের করুণ কাহিনীর সেলিমকৃত ভাষান্তর Violated in ১৯৭১ আমাদের জাতীয় জীবনের দুঃসহ বাস্তবতাকে বিশ্বময় পৌঁছে দেয়ার তারিফযোগ্য উদ্যোগ। এরকম সংবেদনশীল বিষয়ের ওপর কাজ করা একাত্তরপর্ব প্রত্যক্ষ করা যে কোনও বিবেকবান বাঙালির জন্য মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জপূর্ণ। সেলিম সে পরীক্ষায় যেমন উৎরেছেন, তেমনি কল্লোলিত গদ্যে তরজমার কাজটিও সম্পাদন করেছেন লব্ধ অভিজ্ঞতা ও পরিণত শিল্পমানসের যৌথসূত্রে। উল্লেখ্য, দুটো কাজই বাংলা একাডেমির কমিশনভুক্ত।
কবিতা আবদুস সেলিমের অনুবাদযাত্রায় পৃথক তাৎপর্যে উদ্ভাসিত। বাংলা ও ইংরেজিতে তিনি দেশি-বিদেশি বহু কবির কবিতা অনুবাদ করেছেন- যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বিদেশিদের মধ্যে শার্ল বোদলেয়ার, টিএস এলিয়ট, ম্যাথু আরনল্ড, ইয়েটস, টেড হিউজ, বের্টল্ট ব্রেখট, পাবলো নেরুদা, জন বেটজেমোন, মায়া এঞ্জেলু রয়েছেন। তাঁর অনুবাদগ্রন্থ Selected Poems from Bangladesh: Poets of the Sixties বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বন্ধু মান্নান সৈয়দের সৌজন্যে ৬০-এর দশকের সব বড় কবির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও নৈকট্য তৈরি হয়। তাই তাঁদের বাছাইকৃত কিছু কবিতা অনুবাদ করে সংকলনটি বের করেন বিশ্বময় বাংলা কবিতাকে ছড়িয়ে দেবার মানসে। বলাই বাহুল্য, এতে দেশাত্মবোধক জোশ যতোটা ছিল, বাস্তববুদ্ধির ছাপ ততো ছিল না। বইটি সম্ভাবনা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মহলে পৌঁছতে পারেনি যথারীতি বৈদেশিক যোগাযোগের অভাব ও বাজারজাতকরণের ঐতিহ্যগত অদক্ষতার কারণে। এ গ্রন্থে আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী, আসাদ চৌধুরী, রুবী রহমান, শাহজাহান হাফিজ, মোহাম্মদ রফিক, সিকদার আমিনুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, সুরাইয়া খানম, মহাদেব সাহা, মুহম্মদ নূরুল হুদা, হুমায়ুন কবির, আবুল হাসান, শিহাব সরকার এবং আবিদ আজাদের একাধিক কবিতা সেলিমের তারুণ্য-প্রণোদিত অনুবাদে স্থান পায়। উল্লেখ্য, খুব শিগগিরই এ বইয়ের নব সংস্করণ পরিমার্জিত হয়ে বাজারে আসতে চলেছে। এর বাইরেও তিনি ফররুখ আহমদ প্রমুখ বাঙালি কবির কবিতা ভাষান্তর করেছেন। জার্মান কবি ও নাট্যকার বের্টল্ট ব্রেখটের কাব্যানুবাদ কবিতা: বের্টল্ট ব্রেখট যখন প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে তখন বেশ সাড়া পড়ে যায় ঢাকার সাহিত্যমহলে। জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আয়োজনে অনুষ্ঠিত একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় আমন্ত্রিত হন অনুবাদক সেলিম। প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী প্রজ্ঞা লাবণী বেশকিছু অনূদিত কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় সম্মান একজন অনুবাদকের জন্য। এছাড়াও, তিনি সহকর্মী এই নিবন্ধকারের সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদ করেন বিশিষ্ট ছড়াকার হরষিত বালার নির্বাচিত ছড়া সংকলন Less than Lyrics More than Rhymes শিরোনামে।
তিনি বাংলা থেকে ইংরেজিতে কবিতার পাশাপাশি নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প এবং নন-ফিকশান অনুবাদ করেছেন। তাঁর বিনোদিনী নাটক অনুবাদের পেছনে একটি কৌতূহল-উদ্দীপক গল্প আছে- যা এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। প্রখ্যাত মঞ্চাভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর আত্মজীবনী অবলম্বনে সাইমন জাকারিয়া সংকলিত এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু পরিচালিত একই নামের নাটক দেখে মুগ্ধ হন ক্লেয়ার পামেন্ট (Claire Pamment) নামের এক বিদেশি অধ্যাপিকা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন সেমিস্টারে একটি রিডিং কোর্সে নাটকটির ইংরেজি সংস্করণ অন্তর্ভুক্ত করাতে চান মর্মে অনুরোধ করলে বাচ্চু সাহেব অনুবাদক সেলিমের সাথে যোগাযোগ করেন। তার ফলাফল এ স্বল্পসময়ে করা এ অনুবাদকর্ম। যথারীতি এ কাজটিতেও রয়েছে সেলিমীয় ইংরেজির তড়িৎচমক। আবার, সাধনা আহমেদের নাটক মাতব্রিং অনুবাদ করেন ২০২০ সালে, যা ইংল্যান্ডের অভিনয় শিল্পীরা কোভিডকালীন অনলাইন সংযোগের মাধ্যমে পাঠাভিনয় করেন। এটি লন্ডনের অনুষ্ঠানে “বিশেষ উল্লেখ”-র মর্যাদা পায়। এর আগে শওকত আলী, মান্নান সৈয়দ ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বেশ কিছু গল্প ইংরেজিতে রূপ দিয়েছেন।
কোভিডকালীন ঘোর অনিশ্চয়তাপূর্ণ সময়েও থেমে থাকেনি আবদুস সেলিমের কলম। বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচা থেকে নির্যাস নিয়ে শতবর্ষী সম্মিলন নামে একটি নাটক যৌথভাবে রচনা করেন সহকর্মী জায়েদ-উল-এহসানের সাথে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন দেহপসারিনীর অভিজ্ঞতার বাস্তব কাহিনির আলোকে প্রমীলা নামে আরেকটি নাটক লেখেন যথারীতি জায়েদের সাথে যুগ্মভাবে। দ্বিতীয় নাটকটি কোভিডকালীন প্রেক্ষাপটে অনলাইন সংযোগের মাধ্যমে পাঠাভিনীত হয়। জায়েদ-উল-এহসান ও নুসরাত সাবরিনা মৌরীর পাঠাভিনয় সরাসরি সম্প্রচারিত দীপ্ত টিভিতে।
আবদুস সেলিম তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বহু পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন। দ্য ডেইলি স্টার, নিউ এজ, অবজারভার, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি, প্রথম আলো, সংবাদ, কালি ও কলম, উত্তরাধিকারসহ দেশ-বিদেশের বিচিত্র পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন। তিনি ডেইলি স্টারে “Dramangle” নামে নাটক নিয়ে নিয়মিত কলাম লিখতেন। লিখতেন পত্রিকার “Showbiz” পাতায়ও। নিউ এজে The Procenium Arch নামে নাট্যকলা বিষয়ক কলাম লিখতেন একসময়। মজার বিষয় হচ্ছে এ পত্রিকাতেই তিনি কুড়িটির মতো কবিতা লিখেছেন, যদিও কবি হিসেবে নিজেকে যারপরনাই ব্যর্থ মনে করেন। বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রথাগত বিশ্লেষণের বাইরে গিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে প্রবন্ধ লিখেছেন বেশ কিছু। তাছাড়াও, একজন একাডেমিক হিসেবে তিনি প্রচুর গবেষণামূলক লেখালেখি করেছেন। দেশে-বিদেশে পেপার পাঠ করেছেন। ইংরেজি ভাষা শিক্ষণ নিয়ে তাঁর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ রয়েছে। তাঁর অন্যতম কীর্তি ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমির ইংরেজি-বাংলা অভিধান-এ উচ্চারণ সারণি সংযোজন। টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও রয়েছে তাঁর সরব উপস্থিতি। নানান সাহিত্য আড্ডা ও সভাতেও তিনি তাঁর মজলিশি ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বলতায় দীপ্র।
সব পরিচয় ছাপিয়ে যে পরিচয়ে আবদুস সেলিম সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ, তৃপ্ত ও গর্বিত তা তাঁর শিক্ষকতা। সেই ১৯৬৮ সালে একটি ক্যাডেট কলেজে দু’মাস খ-কালীন পড়ানোর মাধ্যমে তাঁর একাডেমিক ক্যারিয়ারের সূচনা। পড়িয়েছেন এমসি কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, দেবেন্দ্র কলেজ, হরগঙ্গা কলেজসহ বহু সরকারি কলেজে। ব্রিটিশ কাউন্সিলে IELTS-এর শিক্ষক ছিলেন বিভিন্ন মেয়াদে। চার বছর পড়িয়েছেন লিবিয়াতেও। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত BELTA (Bangladesh English Language Teachers Association) ছিল তাঁর ব্রেইনচাইল্ড। তিনি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। একসময় UNESCO National Commission-এর সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করেছেন। দীর্ঘ দুই দশক দেশের স্বনামধন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছেন। খ-কালীন পাঠদান করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের IBA এবং IML-এ। বর্তমানে তিনি সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড লিটারেচার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত। পাশাপাশি Translation নামের ষান্মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। ব্যস্ত আছেন বিচিত্রমুখী লেখালখি ও অনুষ্ঠান নিয়ে।
একাধারে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, নাট্যবিদ, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক এ গুণী মানুষটি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙা জেলায়। পিতা আবদুস সামাদ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা আর মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকে দারুণ মেধাবী সেলিমের শিক্ষাজীবন কাটে দেশের বিভিন্ন স্কুলে। বাবার চাকরিসূত্রে বারবার বদলির কারণে তাঁকে বহুবার স্কুল পাল্টাতে হয়। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিচিত্র স্বভাবের মানুষ, বহুবর্ণিল আঞ্চলিক ভাষা ও বহুমাত্রিক সংস্কৃতির সংস্পর্শ তাঁকে শৈশব থেকেই ঋদ্ধ করেছিল। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার, এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের মতো স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠসমূহে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর মেধা ও চিন্তাবোধকে আরও পরিশীলিত করেছে যার প্রভাব পড়েছে তাঁর মননচর্চার অঙিনায়।
বেশকিছু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন আবদুস সেলিম। ২০১০ সালে পেয়েছেন মুনীর চৌধুরী পুরস্কার। অনুবাদে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৫ তে। লোকনাট্যদল স্বর্ণপদক লাভ করেন ২০১৯-এ। একশ বস্তা চাল নাটকটির জন্য জাপান সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন দু-দুটো পুরস্কার।
পরিশেষে বলতে হয়, আবদুস সেলিম শিল্পের বিচিত্র পথের নিরলস অভিযাত্রী। তাঁর সাধনা একাগ্র ও সমর্পিতচিত্ত। তাঁর শিল্পিত জীবনের সৌরভ প্রাত্যহিক জীবনের দশটা-পাঁচটা সম্পর্কের ভেতরেও প্রবাহিত। ভোজনরসিক ও ভ্রমণপ্রিয় তিনি আগাগোড়া। রসবোধ তাঁর প্রখর, মেজাজ বৈঠকী, ভাষা বুদ্ধিদীপ্ত। শাসন করেন যথাস্থানে, কিন্তু তাতেও সোহাগের নির্যাস থাকে লেপ্টে। সহজাত নেতৃত্বগুণ তাঁকে বিশিষ্ট করেছে।
বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০১ আশ্বিন ১৪২৯ ১৭ সফর ১৪৪৪
লিটন চক্রবর্তী মিঠুন
অঙ্গীকারের অনড়তা, চিন্তার পরিচ্ছন্নতা, বোধের শুভ্রতা, বিদ্যাচর্চার অনলসতা, ভাষার গতিময়তা, সংলাপের সরসতা এবং বিনয়ের ব্যাপকতা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের যে ক’জন গুণীজনকে বিশিষ্ট করেছে, আবদুস সেলিম নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্যতম।
প্রধানত অনুবাদক সেলিমের অনুবাদ চর্চার শুরু সেই ছোটবেলায় বাবা সামাদ সাহেবের প্রযতেœ। কিশোর সেলিমের মধ্যে ইংরেজি ভাষাপ্রীতি ও ভাষাগত দক্ষতার আভাস দেখে বাবা তাকে নিয়মিত বাংলা থেকে ইংরেজিতে ও ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদের কাজ দিতেন। এর জন্য নোটবইও দিয়েছিলেন একাধিক। একটিতে খসড়া করতেন সেলিম আর তার ওপর ফিডব্যাক দিতেন বাবা। পরে সংশোধনপূর্বক অনুবাদকর্মসমূহ আরেকটি খাতায় তুলতেন। কৈশোরের এ অনুবাদ অনুশীলন ভবিষ্যৎ অনুবাদক সেলিমের জন্য শক্তিশালী ভিত নির্মাণ করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে অনুবাদ ও প্রবন্ধচর্চায় আসেন ১৯৬৯ সালে বন্ধু কবি ও সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে “শিল্পকলা” নামক ম্যাগাজিন যৌথভাবে সম্পাদনা করতে গিয়ে। স্বল্পায়ু এ ম্যাগাজিনটির আটটি সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৬৯-১৯৭২ সময়পর্বে। মূলত এ ম্যাগাজিনটির বদৌলতে মননশীলতার অভিযাত্রা শুরু হয় আবদুস সেলিমের। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ এবং ১৯৭৮ সালে কলকাতা সফরে গিয়ে বহু গুণী মানুষের সান্নিধ্য লাভ করেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন বুদ্ধদেব বসু, প্রতিভা বসু, বিষ্ণু দে, শঙ্খ ঘোষ, অশোকানন্দ দাশ, জিষ্ণু দে প্রমুখ। ১৯৭৬ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের বৃত্তি পেয়ে পড়তে যান ইংল্যান্ডে। তখন থেকে পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্যর আরও নিবিড় যোগাযোগ ঘটে তাঁর। একদিকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থানীয় ঐতিহ্য-অনুরাগ আর অন্যদিকে কসমোপলিটান দৃষ্টিভঙ্গি- এ দুটি ধারার যুগলস্রোতে স্নাত হন তিনি।
বের্টল্ট ব্রেখটের গ্যালিলিও নাটকটি অনুবাদ করেন ১৯৭৫ সালে- যা মুদ্রণাকারে প্রকাশিত হয় ’৭৮-এ। ১৯৮৬ সালে নাটকটি মঞ্চায়িত হলে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন আলী যাকের। ব্যাপকভাবে দর্শকনন্দিত ও সমালোচক-প্রশংসিত হয় গ্যালিলিও। বহুবার মঞ্চায়িত এ নাটকের অভাবনীয় সাফল্য তাঁকে উজ্জীবিত করে নাটকের অনুবাদে। মজার বিষয় হচ্ছে, এ নাটকের বদৌলতে আলী যাকেরের নামের সাথে গ্যালিলিও জুড়ে যায়। সে থেকে আজ অবধি তিনি ত্রিশটির বেশি নাটক অনুবাদ করেছেন যার মধ্যে সাতাশটি গ্রন্থবদ্ধ। আরও বেশ কয়েকটি অগ্রন্থিত আছে। নাটক অনুবাদ করেছেন বললে আসলে কম বলা হয়। অনেকগুলো নাটককে তিনি আসলে এডাপ্ট করেছেন, বাঙলায়ন করেছেন, দেশীয়
প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেছেন। আক্ষরিক অনুবাদের যান্ত্রিক চর্চার বাইরে গিয়ে সাংস্কৃতিক তরজমার তরিকায় আস্থা রেখেছেন। তাঁর বেশিরভাগ নাটকের শক্তিমত্তা ঠিক এখানে, যে, দর্শক বিদেশি-বিভাষী নাটক দেখার দূরত্ববোধ দ্বারা খুব একটা আক্রান্ত হন না। বরং নাটকের চরিত্র ও গল্পের সাথে এক ধরনের আত্মিকতা অনুভব করেন। অনুবাদ-প্রক্রিয়ায় মূলের সাহিত্যগুণ ধরে রেখে টেক্সটকে দেশজতায় অভিষিক্ত করার নিপুণতা এক্ষেত্রে সেলিমকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।
ভাষা-ব্যবহারে ও সংলাপ নির্মাণে সেলিম সহজাত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পাত্র-পাত্রীর সামাজিক অবস্থান ও শিক্ষাগত যোগ্যতার নিরিখে ভাষা প্রয়োগ করেছেন। যেহেতু তাঁর নাটকের দর্শক প্রধানত বাংলাদেশী, তিনি শিক্ষিত ঢাকাই মধ্যবিত্তের ইংরেজি ও আঞ্চলিক ভাষার উপাদানযুক্ত কথ্য বাংলা খুব সাবলীলভাবে ব্যবহার করেছেন। ফলে ভাষাগত কৃত্রিমতা ও সংলাপের আড়ষ্টতা সেলিমকৃত নাট্যানুবাদে বিরল ঘটনা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আটপৌরে বুলি বুলবুলির মতো গাইতে থাকে সেলিমের নাট্যভুবনে, যা স্বস্তির ও আনন্দের। কেননা, নাটক মাধ্যমটিই এমন যা দর্শকের সঙ্গে পাত্র-পাত্রীর সরাসরি মিথস্ক্রিয়া তৈরি করে যার যোগসূত্র সংলাপ ও তার ভাষা।
তিন খ-ে তাঁর অনূদিত ১৯টি নাটক রয়েছে। এছাড়া, নাট্যত্রয়ী সংকলনে তিনটে, ৫ মঞ্চানুবাদ সংকলনে যথারীতি ৫টি এবং অগ্রন্থিত আরও বেশ ক’টি অনূদিত নাটক রয়েছে। এর বাইরে এডওয়ার্ড অ্যালবির হু’জ আফরেইড আভ ভার্জিনিয়া উল্ফ্, এবং দারিও ফো ও ফ্রাংকা রামের Rise and Shine এবং A Woman Alone(একা এক নারী) অনুবাদ করেন সাফল্যের সাথে। অ্যালবির নাটকটি এখনো মঞ্চে আনা যায়নি অশ্লীলতার সম্ভাব্য দায় এড়াতে। তবে খুবই এবসার্ড ঘরানার নাটকটি খুবই প্রাসঙ্গিক; বিশেষ করে, সেলিমের তরজমায় এ নাটকের সংলাপগুলো কানে ঝঙ্কার ও মনে রেখাপাত করার মতো। একা এক নারী অবশ্য মঞ্চসফল, তনিমা হামিদের অনবদ্য অভিনয় তাতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। অন্যদিকে, জাপানি নাটক ১০০ Sacks of Rice (একশ বস্তা চাল) অনুবাদ করে বাংলাদেশের দর্শকের কাছে জাপানি নাটকের স্বাদ ও গন্ধ পৌঁছে দেন নাট্যসাধক সেলিম। ক্ষেত্রবিশেষে এ জনপ্রিয়তা বহুল প্রচারিত গ্যালিলিওকেও টেক্কা দেয়। নাট্যকার মামুনুর রশীদ তো ব্যক্তিগত আলাপে সেলিমকে জানান যে, এ নাটকটি গ্যালিলিওর চাইতে বেশি ভালো লেগেছে ওনার।
লুইস ক্যারলের AliceÕs Adventures in Wonderland-এর Broadway Theatre-কৃত নাট্যরূপের অনুবাদ করেন এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড নামে। বাংলাভাষী কোমলমতি শিশুদের মানসিক বিকাশ ও বিনোদনের শুভ অভিপ্রায়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে ভাষান্তরের কাজটি করেন যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। একটি মরাগাছ ও চারটি নারীর মৃত্যু নাটক হিসেবে অনন্য। এছাড়া, টেলিভিশানের জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটো ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি গল্পকে নাট্যরূপ দেন এবং হেনরিক ইবসেনের একটি নাটক অনুবাদ করেন সসাগরা কন্যা নামে। এছাড়া, টেলিভিশানের জন্য তিনটি মৌলিক নাটকের কাহিনি ও চিত্রনাট্য লেখেন যার অন্যতম ওফেলিয়া এখন।
আগেই বলা হয়েছে, বেশ কিছু অনূদিত নাটক তিনি বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্থাপন করেছেন স্থানীয়করণ প্রক্রিয়ায়। যেমন: দারিও ফো-র রাইজ এন্ড শাইন নাটকটিকে রূপায়িত করেছেন একজন বাংলাদেশি গার্মেন্ট কন্যার গল্পাকারে। ডেভিড হেয়ারের The Vertical Hour (প্রলম্বিত প্রহর) সেলিমের তরজমায় পেয়েছে বাংলাদেশি আদল ও চারিত্র্য। এ. আর. গার্নির খড়াব Love Letters (প্রেমপত্র) অভিযোজিত হয়ে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প হয়ে উঠেছে। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি অকুণ্ঠ নিবেদন সেলিমের অনুবাদক সত্তাকে বারবার শেকড়মুখী করেছে। কেবল দেশপ্রেমের আবেগ নয়, বরং নাটকের মতো প্রবল অডিয়েন্সমুখী শিল্পমাধ্যমকে আরও জনপ্রিয় করে তোলার জন্য দেশজকরণের বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়াস চালিয়েছেন।
বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রতিনিধিত্বশীল সাহিত্যকর্মকে ইংরেজিতে ভাষান্তর করেন। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক আবু ইসহাকের নন্দিত উপন্যাস ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’কে তিনি ঝরঝরে ও গতিময় ইংরেজিতে তরজমা করেন একই নামে। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে নবসৃষ্ট পাকিস্তানে বাঙালির জীবন সংগ্রাম, গ্রাম বাংলার জীবনপ্রবাহ, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, সামন্তবাদ, নারীবিদ্বেষ, মোল্লাতন্ত্র, ইত্যাদি অনুষঙ্গে রচিত উপন্যাসটি অনুবাদ করাটা চ্যালেঞ্জিং অনেক দিক থেকেই। পূর্ববঙ্গীয় লোকজ ভাষা, প্রবাদ-প্রবচন, লোকগান ও পল্লী সংস্কৃতির বিবিধ উপাদানকে ইংরেজির মতো সম্পূর্ণ ভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ভৌগোলিক বাস্তবতার ভাষায় ফুটিয়ে তোলার জন্য যে রকম নৈপুণ্য ও কল্পনাপ্রতিভা দরকার তার শতভাগ উজাড় করে দিয়েছেন সেলিম। ভাষার সাবলীলতা ও ছন্দোময়তা এ অনুবাদটিকে ভিন্ন ব্যঞ্জনা দান করেছে। একইভাবে, সুরমা জাহিদের ১৯৭১-এ সম্ভ্রম হারানো নারীদের করুণ কাহিনীর সেলিমকৃত ভাষান্তর Violated in ১৯৭১ আমাদের জাতীয় জীবনের দুঃসহ বাস্তবতাকে বিশ্বময় পৌঁছে দেয়ার তারিফযোগ্য উদ্যোগ। এরকম সংবেদনশীল বিষয়ের ওপর কাজ করা একাত্তরপর্ব প্রত্যক্ষ করা যে কোনও বিবেকবান বাঙালির জন্য মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জপূর্ণ। সেলিম সে পরীক্ষায় যেমন উৎরেছেন, তেমনি কল্লোলিত গদ্যে তরজমার কাজটিও সম্পাদন করেছেন লব্ধ অভিজ্ঞতা ও পরিণত শিল্পমানসের যৌথসূত্রে। উল্লেখ্য, দুটো কাজই বাংলা একাডেমির কমিশনভুক্ত।
কবিতা আবদুস সেলিমের অনুবাদযাত্রায় পৃথক তাৎপর্যে উদ্ভাসিত। বাংলা ও ইংরেজিতে তিনি দেশি-বিদেশি বহু কবির কবিতা অনুবাদ করেছেন- যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বিদেশিদের মধ্যে শার্ল বোদলেয়ার, টিএস এলিয়ট, ম্যাথু আরনল্ড, ইয়েটস, টেড হিউজ, বের্টল্ট ব্রেখট, পাবলো নেরুদা, জন বেটজেমোন, মায়া এঞ্জেলু রয়েছেন। তাঁর অনুবাদগ্রন্থ Selected Poems from Bangladesh: Poets of the Sixties বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বন্ধু মান্নান সৈয়দের সৌজন্যে ৬০-এর দশকের সব বড় কবির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ও নৈকট্য তৈরি হয়। তাই তাঁদের বাছাইকৃত কিছু কবিতা অনুবাদ করে সংকলনটি বের করেন বিশ্বময় বাংলা কবিতাকে ছড়িয়ে দেবার মানসে। বলাই বাহুল্য, এতে দেশাত্মবোধক জোশ যতোটা ছিল, বাস্তববুদ্ধির ছাপ ততো ছিল না। বইটি সম্ভাবনা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মহলে পৌঁছতে পারেনি যথারীতি বৈদেশিক যোগাযোগের অভাব ও বাজারজাতকরণের ঐতিহ্যগত অদক্ষতার কারণে। এ গ্রন্থে আবদুল মান্নান সৈয়দ, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী, আসাদ চৌধুরী, রুবী রহমান, শাহজাহান হাফিজ, মোহাম্মদ রফিক, সিকদার আমিনুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, সুরাইয়া খানম, মহাদেব সাহা, মুহম্মদ নূরুল হুদা, হুমায়ুন কবির, আবুল হাসান, শিহাব সরকার এবং আবিদ আজাদের একাধিক কবিতা সেলিমের তারুণ্য-প্রণোদিত অনুবাদে স্থান পায়। উল্লেখ্য, খুব শিগগিরই এ বইয়ের নব সংস্করণ পরিমার্জিত হয়ে বাজারে আসতে চলেছে। এর বাইরেও তিনি ফররুখ আহমদ প্রমুখ বাঙালি কবির কবিতা ভাষান্তর করেছেন। জার্মান কবি ও নাট্যকার বের্টল্ট ব্রেখটের কাব্যানুবাদ কবিতা: বের্টল্ট ব্রেখট যখন প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে তখন বেশ সাড়া পড়ে যায় ঢাকার সাহিত্যমহলে। জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের আয়োজনে অনুষ্ঠিত একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় আমন্ত্রিত হন অনুবাদক সেলিম। প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী প্রজ্ঞা লাবণী বেশকিছু অনূদিত কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় সম্মান একজন অনুবাদকের জন্য। এছাড়াও, তিনি সহকর্মী এই নিবন্ধকারের সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদ করেন বিশিষ্ট ছড়াকার হরষিত বালার নির্বাচিত ছড়া সংকলন Less than Lyrics More than Rhymes শিরোনামে।
তিনি বাংলা থেকে ইংরেজিতে কবিতার পাশাপাশি নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প এবং নন-ফিকশান অনুবাদ করেছেন। তাঁর বিনোদিনী নাটক অনুবাদের পেছনে একটি কৌতূহল-উদ্দীপক গল্প আছে- যা এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। প্রখ্যাত মঞ্চাভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীর আত্মজীবনী অবলম্বনে সাইমন জাকারিয়া সংকলিত এবং নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু পরিচালিত একই নামের নাটক দেখে মুগ্ধ হন ক্লেয়ার পামেন্ট (Claire Pamment) নামের এক বিদেশি অধ্যাপিকা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন সেমিস্টারে একটি রিডিং কোর্সে নাটকটির ইংরেজি সংস্করণ অন্তর্ভুক্ত করাতে চান মর্মে অনুরোধ করলে বাচ্চু সাহেব অনুবাদক সেলিমের সাথে যোগাযোগ করেন। তার ফলাফল এ স্বল্পসময়ে করা এ অনুবাদকর্ম। যথারীতি এ কাজটিতেও রয়েছে সেলিমীয় ইংরেজির তড়িৎচমক। আবার, সাধনা আহমেদের নাটক মাতব্রিং অনুবাদ করেন ২০২০ সালে, যা ইংল্যান্ডের অভিনয় শিল্পীরা কোভিডকালীন অনলাইন সংযোগের মাধ্যমে পাঠাভিনয় করেন। এটি লন্ডনের অনুষ্ঠানে “বিশেষ উল্লেখ”-র মর্যাদা পায়। এর আগে শওকত আলী, মান্নান সৈয়দ ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বেশ কিছু গল্প ইংরেজিতে রূপ দিয়েছেন।
কোভিডকালীন ঘোর অনিশ্চয়তাপূর্ণ সময়েও থেমে থাকেনি আবদুস সেলিমের কলম। বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচা থেকে নির্যাস নিয়ে শতবর্ষী সম্মিলন নামে একটি নাটক যৌথভাবে রচনা করেন সহকর্মী জায়েদ-উল-এহসানের সাথে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন দেহপসারিনীর অভিজ্ঞতার বাস্তব কাহিনির আলোকে প্রমীলা নামে আরেকটি নাটক লেখেন যথারীতি জায়েদের সাথে যুগ্মভাবে। দ্বিতীয় নাটকটি কোভিডকালীন প্রেক্ষাপটে অনলাইন সংযোগের মাধ্যমে পাঠাভিনীত হয়। জায়েদ-উল-এহসান ও নুসরাত সাবরিনা মৌরীর পাঠাভিনয় সরাসরি সম্প্রচারিত দীপ্ত টিভিতে।
আবদুস সেলিম তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বহু পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন। দ্য ডেইলি স্টার, নিউ এজ, অবজারভার, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি, প্রথম আলো, সংবাদ, কালি ও কলম, উত্তরাধিকারসহ দেশ-বিদেশের বিচিত্র পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন। তিনি ডেইলি স্টারে “Dramangle” নামে নাটক নিয়ে নিয়মিত কলাম লিখতেন। লিখতেন পত্রিকার “Showbiz” পাতায়ও। নিউ এজে The Procenium Arch নামে নাট্যকলা বিষয়ক কলাম লিখতেন একসময়। মজার বিষয় হচ্ছে এ পত্রিকাতেই তিনি কুড়িটির মতো কবিতা লিখেছেন, যদিও কবি হিসেবে নিজেকে যারপরনাই ব্যর্থ মনে করেন। বঙ্গবন্ধু ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রথাগত বিশ্লেষণের বাইরে গিয়ে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে প্রবন্ধ লিখেছেন বেশ কিছু। তাছাড়াও, একজন একাডেমিক হিসেবে তিনি প্রচুর গবেষণামূলক লেখালেখি করেছেন। দেশে-বিদেশে পেপার পাঠ করেছেন। ইংরেজি ভাষা শিক্ষণ নিয়ে তাঁর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ রয়েছে। তাঁর অন্যতম কীর্তি ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমির ইংরেজি-বাংলা অভিধান-এ উচ্চারণ সারণি সংযোজন। টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও রয়েছে তাঁর সরব উপস্থিতি। নানান সাহিত্য আড্ডা ও সভাতেও তিনি তাঁর মজলিশি ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বলতায় দীপ্র।
সব পরিচয় ছাপিয়ে যে পরিচয়ে আবদুস সেলিম সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ, তৃপ্ত ও গর্বিত তা তাঁর শিক্ষকতা। সেই ১৯৬৮ সালে একটি ক্যাডেট কলেজে দু’মাস খ-কালীন পড়ানোর মাধ্যমে তাঁর একাডেমিক ক্যারিয়ারের সূচনা। পড়িয়েছেন এমসি কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, দেবেন্দ্র কলেজ, হরগঙ্গা কলেজসহ বহু সরকারি কলেজে। ব্রিটিশ কাউন্সিলে IELTS-এর শিক্ষক ছিলেন বিভিন্ন মেয়াদে। চার বছর পড়িয়েছেন লিবিয়াতেও। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত BELTA (Bangladesh English Language Teachers Association) ছিল তাঁর ব্রেইনচাইল্ড। তিনি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। একসময় UNESCO National Commission-এর সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করেছেন। দীর্ঘ দুই দশক দেশের স্বনামধন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছেন। খ-কালীন পাঠদান করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের IBA এবং IML-এ। বর্তমানে তিনি সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড লিটারেচার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত। পাশাপাশি Translation নামের ষান্মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। ব্যস্ত আছেন বিচিত্রমুখী লেখালখি ও অনুষ্ঠান নিয়ে।
একাধারে শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, নাট্যবিদ, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক এ গুণী মানুষটি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙা জেলায়। পিতা আবদুস সামাদ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা আর মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকে দারুণ মেধাবী সেলিমের শিক্ষাজীবন কাটে দেশের বিভিন্ন স্কুলে। বাবার চাকরিসূত্রে বারবার বদলির কারণে তাঁকে বহুবার স্কুল পাল্টাতে হয়। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিচিত্র স্বভাবের মানুষ, বহুবর্ণিল আঞ্চলিক ভাষা ও বহুমাত্রিক সংস্কৃতির সংস্পর্শ তাঁকে শৈশব থেকেই ঋদ্ধ করেছিল। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার, এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের মতো স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠসমূহে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর মেধা ও চিন্তাবোধকে আরও পরিশীলিত করেছে যার প্রভাব পড়েছে তাঁর মননচর্চার অঙিনায়।
বেশকিছু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন আবদুস সেলিম। ২০১০ সালে পেয়েছেন মুনীর চৌধুরী পুরস্কার। অনুবাদে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৫ তে। লোকনাট্যদল স্বর্ণপদক লাভ করেন ২০১৯-এ। একশ বস্তা চাল নাটকটির জন্য জাপান সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন দু-দুটো পুরস্কার।
পরিশেষে বলতে হয়, আবদুস সেলিম শিল্পের বিচিত্র পথের নিরলস অভিযাত্রী। তাঁর সাধনা একাগ্র ও সমর্পিতচিত্ত। তাঁর শিল্পিত জীবনের সৌরভ প্রাত্যহিক জীবনের দশটা-পাঁচটা সম্পর্কের ভেতরেও প্রবাহিত। ভোজনরসিক ও ভ্রমণপ্রিয় তিনি আগাগোড়া। রসবোধ তাঁর প্রখর, মেজাজ বৈঠকী, ভাষা বুদ্ধিদীপ্ত। শাসন করেন যথাস্থানে, কিন্তু তাতেও সোহাগের নির্যাস থাকে লেপ্টে। সহজাত নেতৃত্বগুণ তাঁকে বিশিষ্ট করেছে।