গৌতম রায়
মুসলিম জনজীবন সম্পর্কে অত্যন্ত স্বল্প এবং সংকীর্ণ ধারণা থাকবার ফলে, সারস্বত সমাজের ভিতরে বাঙালি মুসলমানের জনজীবনে জাতপাতের ক্লিন্নতার বিষয়টি ঘিরে সেভাবে কোনো সমাজ অনুধ্যানের চিত্র দেখতেই পাওয়া যায় না। পবিত্র ইসলামে যেভাবে জাতপাত বিষয়ে বলা হয়েছে, সেটি যে পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক বিবর্তনের ভেতর দিয়ে সঠিকভাবে অনুসরিত হয়নি, সে সম্পর্কে গুণীজনেরা সহমত পোষণ করেন। বাঙালি সমাজে অভিজাত মুসলমান সম্প্রদায়, অর্থাৎ যাঁদের আশরাফ মুসলমান বলা হয়, তাঁদের সঙ্গে অনভিজাত, একেবারে সমাজের নিম্নবর্গীয়, কর্মজীবী মুসলমান, যাঁদেরকে আতরাফ বলা হয়, তাঁদের দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্বের ভেতর থেকে যে সামাজিক বিন্যাস উঠে আসে, তা নিয়ে প্রায় আলাপ-আলোচনা দেখতেই পাওয়া যায় না।
হাতেগোনা দুই চারজন কথাসাহিত্যিক তাঁদের সৃষ্টির ভেতরে বা বিভিন্ন আলোচনায় খুব সংক্ষিপ্ত আকারে এই আশরাফ-আতরাফের দ্বন্দ্বটিকে কখনো কখনো তুলে ধরেছেন। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মতো কালজয়ী কথাসাহিত্যিক তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতায় রাঢ়বঙ্গের সামাজিক বিন্যাসে এই আশরাফ-আতরাফের দ্বন্দ্বটিকে কোনো কোনো উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। উদাহরণ হিসেবে তাঁর জীবনকালের প্রায় শেষপর্বের অনবদ্য সৃষ্টি ‘স্বর্ণচাঁপার উপাখ্যানে’র কথা বলা যেতে পারে।
রাঢ় বাংলার আশরাফ মুসলমান যাদের রাঢ়ের আঞ্চলিক টানে ‘মিঞা মুসলমান’ বলা হয়, তাদের যে ‘আয়মাদারি’ অর্থাৎ আভিজাত্য, সে সম্পর্কে সিরাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল অনবদ্য। সেই বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা সিরাজ বহু সময় নানা সামাজিক বিবর্তন বোঝাতে গিয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরলেও তাকে ঘিরে পরিপূর্ণ উপন্যাস বা সমাজ বীক্ষণমূলক লেখা লেখবার সময় তিনি পাননি। হয়তো আরও দীর্ঘকাল জীবিত থাকলে এ সম্পর্কে তিনি তাঁর সুললিত কলমের মাধ্যমে বাঙালি সমাজকে এক অনবদ্য সৃষ্টি উপহার দিতেন।
মুসলমান সমাজ সম্পর্কে যাঁরা কিছুটা খোঁজখবর রাখতে আগ্রহী, তাঁরা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মতো মানুষদের লেখা পড়ে রাঢ়বঙ্গের আশরাফ-আরতরাফের দ্বন্দ্ব নিয়ে খানিকটা অবহিত হলেও পূর্ববঙ্গে, বিশেষ করে ভাটির দেশে, এই আশরাফের দ্বন্দ্ব কী পর্যায়ে ছিল এবং কীভাবে সেই দ্বন্দ্বের শিকার হচ্ছে নারী, তাদের সম্মুখ ধারণা খুব একটা করে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এই ধ্যানধারণা করে উঠতে না পারার প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো, এপার বাংলায় সমাজবিজ্ঞানের আলাপ আলোচনার ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে এক আশ্চর্যজনক নীরবতা এবং অবহেলা।
অপরপক্ষে দেশভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সমাজ সংস্কৃতি সম্পর্কে অনুপুঙ্খ আলাপ-আলোচনা এপার বাংলায় বেশ কমই হয়। বাংলাদেশে তাদের সমাজ চিত্রণের আণুবীক্ষণিক স্তরে যে সমস্ত কথাসাহিত্য রচিত হয়, তা সে অবিভক্ত বাংলার সময়কালেই হোক, পূর্ব পাকিস্তানের সময়কালই হোক বা আজকের বাংলাদেশেই হোক, তা ঘিরে এপার বাংলার সুধী সমাজের আশ্চর্যজনক নীরবতা আমরা লক্ষ্য করেছি।
এই যে আশরাফ-আতরাফের দ্বন্দ্ব, অর্থাৎ একেবারে মার্কসীয় অর্থনীতির ভাবধারায় যাকে শ্রেণিদ্বন্দ্বের একটা রূপ হিসেবে অভিহিত করতে পারা যায়, সেই বিষয়টি মুসলমান সমাজের নিরিখে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ কেবলমাত্র এপার বাংলার রাঢ়বঙ্গের কথা উল্লেখ করলেও, ভাটির দেশে তার যে ব্যাপ্তি, সেই ব্যাপ্তিবিষয়ক এক আশ্চর্যজনক সমাজবীক্ষণ আমরা পাই বাংলার দ্বিতীয় জাগরণ, অর্থাৎ মুসলিম সাহিত্য সমাজ, ‘শিখা’ গোষ্ঠীর অন্যতম কর্ণধার কাজী মোতাহার হোসেনের একটি ছোট গল্প ‘সমাজচিত্রে’র ভেতর দিয়ে।
কথাসাহিত্যচর্চা কাজী মোতাহার হোসেন খুব বেশি করেননি। তাঁর কবিতা নামক একটি সংকলন আছে। যেখানে বেশ কয়েকটি কবিতা রয়েছে। এই কবিতাগুলির মধ্যে ‘আসা যাওয়া’ নামক কবিতাটি ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে অগ্রহায়ণ মাসে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাছাড়াও ম্যাক্সিম গোর্কির স্মরণিকাতে ‘ঝড়ো বাজের গান’ নামক তাঁর একটি কবিতা আছে। এই কবিতাটি বাঙালি সমাজের ম্যাক্সিম গোর্কি চর্চার ক্ষেত্রে একটি কালজয়ী পদক্ষেপ।
এছাড়াও আরো কিছু কবিতা তাঁর রয়েছে। যেমন, রুবাইয়াৎই মীযান। অনেকেরই জানা নেই কাজী মোতাহার হোসেন বেশ কিছু হিন্দি কবিতাও অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর অনূদিত হিন্দি কবিতার ছোট ছোট চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর হিন্দি কবিতার অনূদিত বই ‘নিবেদন’। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আরেকটি অনুবাদ কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল। ‘বিরহহী’ নামক হিন্দি কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ’৬৮ সালের জুলাই মাসে। তাঁর শেষ অনূদিত হিন্দি কবিতা গ্রন্থটির নাম হলো ‘বিরহিনী’। এটা ১৯৬৯ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হয়েছিল।
কাজী মোতাহার হোসেন পূর্ববঙ্গে আশরাফ-আতরাফের দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে নারীর যন্ত্রণাকে এক অনবদ্য ভঙ্গিমায় ‘সমাজচিত্র’ গল্পটির মধ্যে দিয়ে সারস্বত সমাজের কাছে তুলে ধরেছিলেন। এই সমাজচিত্র নামক গল্পটি মোয়াজ্জিন পত্রিকার কার্তিক-অগ্রহায়ণ সংখ্যায়, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। গোটা জীবনে তাঁর আর একটি গল্পের সন্ধান পাওয়া যায়- যেটি মোয়াজ্জিন পত্রিকাটি ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গল্পটির নাম ছিল ‘নবীন সংঘ’। সেটি কাজী মোতাহার হোসেনের ‘সঞ্চয়ন’ নামক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
নারীর যন্ত্রণাকে এক অব্যক্ত ভঙ্গিমায় এই ‘সমাজচিত্র’ নামক গল্পের ভেতর দিয়ে তুলে আনার ক্ষেত্রে কাজী মোতাহার হোসেনের মানসিকতার মরমী দিকটা আমরা খুঁজে পাই। বঙ্গজননী সুফিয়া কামালের উদ্দেশ্যে লেখা তাঁর ছোট্ট একটি কবিতার ভেতর দিয়ে। এই কবিতাটি কাজী মোতাহার হোসেনের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। তাঁর জীবনাবসানের অনেক কাল পরে, ১৯৯২ সালের মে মাসে বাংলাদেশে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে যখন তাঁর রচনাবলী তৃতীয় খণ্ডটি প্রকাশিত হয়, সেই সংকলনটি প্রস্তুত করার সময় কাজী মোতাহার হোসেনের কাগজপত্র দেখতে দেখতে গ্রন্থটির সম্পাদক বিশ্ববিশ্রুত লোকসংস্কৃতিবিদ অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী বঙ্গজননী সুফিয়া কামালের উদ্দেশ্যে লেখা এই ছোট কবিতাটি খুঁজে পান। কবিতাটি এইরকম-
“সুফিয়া- মা আমার কামাল কিয়া আপ্ নি জামাল সে
আল্লাহ্র মহিমাতে সাহিত্য-সভায় কিম্বা গানের মজলিসে,
সকলেই- ‘সুফিয়া এসেছে নাকি? উঁকিঝুঁকি দেখে
দরাইয়াফত কি মতলব-সে
সুফিয়ার আবির্ভাবে তার বাণী-ঝংকারে, শ্রোতারা মেতে ওঠে উল্লাসে।”
এই ছোট্ট কবিতাটির নামকরণ কাজী মোতাহার হোসেন ঐ চিরকুটে লিখে রেখেছিলেন। নামকরণটি ছিল ‘সুফিয়ার সমাগমে’।
বাংলার দ্বিতীয় জাগরণের এই অনবদ্য ব্যক্তিত্ব কাজী মোতাহার হোসেন, যিনি সংস্কৃতি জগতে মুসলমানের অবদানকে বর্তমান সময়ে সারস্বত সমাজের কাছে তুলে ধরে, একদিকে যেমন মৌলবাদী সমাজের মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন, অপরদিকে মুক্তবুদ্ধির, মুক্তি-চেতনার মানুষদের কাছে আবদ্ধ হয়েছিলেন পরম আত্মীয় হিশেবে। কাজী মোতাহার হোসেনের, ‘সঙ্গীতে মুসলমানের অবদান’, মুসলমান সমাজের মৌলবাদী অংশের অনেকেই সহ্য করতে পারেনি। হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা মুসলমান সমাজের ঐতিহ্য অনুসন্ধানে কাজী মোতাহার হোসেনের এই ঐতিহাসিক ভূমিকাকে ঠিক ভালো চোখে দেখেনি।
সেই মানুষটিই গত শতকের বিশের দশকে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে তাঁর সহযোদ্ধা কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, কামালউদ্দিন খান প্রমুখ যে কর্মকাণ্ড করেছিলেন, সেই কর্মকাণ্ডের প্রতি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ ছিল। সেই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নজরুল ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিলেন। কাজী মোতাহার হোসেনের সুফিয়া কামাল সম্বন্ধে এই সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে বুঝতে পারা যায় যে, নারীর স্বাধিকারের প্রশ্নে কাজী মোতাহার হোসেন সমসাময়িকতাকে কতখানি অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। আর এই সমসাময়িকতাকে অতিক্রম করার প্রশ্নে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের প্রতি তাঁর দৃষ্টি নিক্ষেপ যে কত গভীর আর আন্তরিক ছিল, সেটি বোঝবার জন্য আমাদের অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে ‘সমাজচিত্র’ বলে তার এই গল্পটি পড়া দরকার।
গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন নারী। কী সেই নারীর নাম, সময়ের কাল¯্রােতে, সমাজ তা ভুলে যেতে বসেছে। বাঙালি সমাজের সে যুগের বা এযুগের, যে কোনো যুগেরই প্রচলিত প্রথা, যাই বলা হোক না কেন, নারীকে সম্মোধিত করা হয় অমুকের মা, তমুকের বোন ইত্যাদি বলে। এই গল্পের শুরুতেই কাজী মোতাহার হোসেন লিখছেন- ‘আর পাঁচী বলে তার কোনোদিন কোনো মেয়ে ছিল কিনা, সে সম্বন্ধেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’
এই শব্দবন্ধের ভেতর দিয়েই বিশ শতকের সূচনা পর্বে আশরাফ আতরাফের দ্বন্দ্ব, অর্থাৎ অভিজাত আর অনভিজাতের দ্বন্দ্বে একজন নারীর সামাজিক অবস্থান গ্রামীণ পটভূমিকায় কতটা সমস্যা সংকুল হয়ে ওঠে, তা যেভাবে কাজী সাহেব তুলে এনেছেন, সেটি এই একুশ শতকের প্রায় মধ্যভাগে ও আমাদের সমসাময়িকতার নিরিখে বিস্মিত হয়ে উঠতে হয়। কখনো কখনো মনে হয়, রাটক্লিফের সীমানা ভুলে গিয়ে এতো দুই বাংলার যে কোনো প্রান্তেরই এক প্রান্তিক নারীর কাহিনী। পাঁচির মা কি কেবলমাত্র বাঙালি নারীর কাহিনী? ভারতের যে কোন প্রান্তে আমরা কি পাঁচির মাকে খুঁজে পাই না? বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুখিনী নারীদের যে সমস্ত জীবন কাহিনী কৃষান চন্দর থেকে শুরু করে মহাশ্বেতা দেবীরা কথাসাহিত্যে তুলে এনেছেন, তাঁদের থেকে পাঁচির মা কি আলাদা? আবার অমৃতা প্রিতমের লেখার ভেতর দিয়েও যে নারীর কথা আমরা জানতে পারি, কিংবা গত শতকের আটের দশকে রাজস্থানের দেওরালা গ্রামের রূপ কানোয়ার নামক সেই দুখিনী নারী, তাঁদের সাথে কি পাঁচির মাকে আলাদা করা যায়? তারা কি প্রত্যেকেই এক একজন পাঁচির মা নয়?
এই গল্পটির কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলা তথা বাঙালির প্রেক্ষাপটের ভেতর দিয়ে নারীর যে চিরন্তন যন্ত্রণা, তাকে কাজী মোতাহার হোসেন তুলে ধরেছিলেন। প্রায় একশো বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও প্রান্তিক নারীর সেই প্রান্তিকতার অবস্থান থেকে কোনো উনিশ-বিশ ঘটেছে, এমনটা আমরা দেখতে পাই না। দেখতে পেলে আজও মহাশ্বেতা দেবী উত্তর বাংলা সাহিত্যে জয়া মিত্রের মতো মানুষেরা প্রান্তিক নারীদের নিয়ে এভাবে সোচ্চার হতেন না।
শ্রেণীবৈষম্যের পলে সমাজে নারীর উদ্বৃত্ত শ্রমের প্রশ্নে যে অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করে, সেই প্রসঙ্গটি বাংলার দ্বিতীয় নবজাগরণের ঋত্ত্বিকেরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তাঁদের বিভিন্ন লেখার মধ্যে তুলে ধরেছিলেন। কাজী আবদুল ওদুদের লেখা ‘নদীবক্ষে’ উপন্যাস, যেটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, সেখানেও আমরা দেখতে পাই, সামাজিক সংকটের একটা বিশেষ দিক।
কাজী মোতাহার হোসেন যেভাবে তাঁর এই ‘সমাজচিত্র’ নামক ছোট্ট গল্পটির মধ্যে ‘পাঁচীর মা’ এই মুখ্য চরিত্রটির ভেতর দিয়ে একজন নারীর গোটা জীবন ধরে সমাজের বুকে নিজেকে উজাড় করে দেওয়া সত্ত্বেও তাঁর বিন্দুমাত্র আধিকারকে সমাজ স্বীকৃতি দিচ্ছে না, এই বিষয়টিকে তুলে এনেছেন, তা সমসাময়িককালের কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রেই হোক, সামাজিক রীতি-নীতির ক্ষেত্রেই হোক,এক বৈপ্লবিক অভিপ্রায়।
আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়ে এই যে, এপার বাংলায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যত লেখা হয়েছে, সেখানে কিন্তু কখনোই বাঙালি মুসলমানের সৃষ্ট কথাসাহিত্যের এইসব ঐতিহাসিক দিকগুলির কথা আলোচনা তো দূরে থাকুক, উল্লেখ পর্যন্ত হয়নি। ফলে বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে এপার বাংলার বাঙালি হিন্দুদের মধ্যেও একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। আর সেই ভুল ধারণাকে অবলম্বন করেই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি নিজেদের রাজনৈতিক অভিপ্রায় হাসিল করবার লক্ষ্যে, বাঙালি হিন্দু সমাজকে অতি সহজেই মুসলমান সমাজ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবার সুযোগ পেয়ে গেছে।
পাঁচির মা চরিত্রটি নির্মাণ করবার ক্ষেত্রে গ্রাম বাংলার সমাজ চিত্রে সে যুগে একটা বড় অংশের নারী সমাজের চারিত্রিক লক্ষণের একটা বৈশিষ্ট্য বেশ কিছু আঞ্চলিক শব্দবন্ধের ভেতর দিয়ে কাজী মোতাহার হোসেন তুলে এনেছেন। এইসব শব্দবন্ধ গুলি হলো ‘গেজেট’, ‘পাড়া কুঁদুলে’, ‘দুর্মুখী’, ‘চোগলখোর’ ইত্যাদি। এই ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বাঙালি পাঠক বিশ শতকের মধ্যভাগে গজেন্দ্রকুমার মিত্রের লেখা ‘কলকাতার কাছেই’ উপন্যাসের শ্যামা ঠাকুরন চরিত্রের মধ্যে অনবদ্যভাবে দেখেছেন। তারও আগে দেখেছেন আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম ‘প্রতিশ্রুতি’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সত্যবতীর শাশুড়ি চরিত্রটির ভেতর দিয়ে।
গজেন্দ্রকুমার মিত্র বা আশাপূর্ণা দেবীর যে চরিত্রগুলিকে উল্লেখ করা হলো সেই চরিত্রগুলি কিন্তু একটা মধ্যবিত্ত আর্থিক সচ্ছলতার মোটামুটি পরিবেশ থেকে উঠে আসা চরিত্র। উনিশ-বিশ শতকের সামাজিক অদল বদলের ক্রান্তিলগ্নে এই চরিত্রগুলি পুরুষতান্ত্রিকতার এক অদ্ভুত টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে নিজেদের জীবনকে অতিবাহিত করেছিলেন।
এমন চরিত্র আমরা শৈলবালা ঘোষজায়ার ‘শেখ আন্দু’তেও দেখছি। সেই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রের ভিতরে আমরা আশাপূর্ণার কালজয়ী সত্যবতী ট্রিলজির সত্যবতীর আদল খুঁজে পাই। কিন্তু এটাও একটা দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, সত্যবতী চরিত্রটি ঘিরে বাংলা সাহিত্যে যত আলাপ আলোচনা, শেখ আন্দুর মুখ্য চরিত্র, যেটি কেবল সেই কালেই নয়, এইকালেও অত্যন্ত বৈপ্লবিক চরিত্র, তাকে ঘিরে আমরা বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের সেভাবে সরব হতে দেখি না।
এই প্রেক্ষিতেই আবার উঠে আসে কাজী মোতাহার হোসেনের এই পাঁচির মা চরিত্রটির কথা। আশাপূর্ণা দেবীর সৃষ্টিতে মধ্যবিত্ত নারীর সংকট বারবার আলোচিত হয়েছে। কিন্তু গ্রামীণ পটভূমিকায় পুরুষশাসিত সমাজের দ্বারা কেবলমাত্র ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়া নিম্নবর্গীয় মুসলমান নারীর কান্না যেভাবে কাজী মোতাহার হোসেন তুলে এনেছেন, সেটি কেবলমাত্র বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষিতেই নয়, বাংলার সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
ব্রিটিশের তৈরি করা অর্থনৈতিক সংকটকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে, ব্রিটিশের সঙ্গে একযোগে দুর্ভিক্ষের এক করাল পটভূমিকা তৈরি করার পর গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ, কি প্রান্তিক অবস্থার ভিতর পৌঁছে যাচ্ছে, তার চরিত্র চিত্রনের মধ্যে এই গল্পটির একটি ভিন্ন সামাজিক তাৎপর্য লুকিয়ে আছে। সামাজিক তাৎপর্যের জায়গায় এই গল্পটির আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত চিত্রণের পর্যায়টিকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতি’ উপন্যাসের যে দুর্ভিক্ষের বর্ণনার প্রেক্ষিত রয়েছে, নীল চাষীদের উপর অত্যাচারের কথা রয়েছে, তার সঙ্গে তুলনা করতে পারা যায়।
আবার তার পরবর্তী প্রজন্মের লেখক সমরেশ বসু যখন ‘ভানুমতী’ উপন্যাস রচনা করছেন সেই উপন্যাসেও যেভাবে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম কালে ব্রিটিশের তৈরি অর্থনৈতিক সংকট, নীল চাষ, কীভাবে বাংলার সামাজিক প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণ হয়ে উঠল, তার মর্মস্পর্শী বিবরণ আছে। ব্রিটিশের তথাকথিত সামাজিক সাংস্কৃতিক পটভূমিকা হুগলি, ২৪ পরগণাকে ঘিরে ভৌগোলিক অঞ্চলগুলির পর্যায়ের ধরে সমরেশের লেখাতে সেগুলি উঠে এসেছে।
সেই পর্যায়ক্রমের সঙ্গেও তুলনা করতে পারা যায় ‘সমাজচিত্র’ গল্পটিকে। দুর্ভিক্ষের কড়াল গ্রাস থেকে আতরাফ পাঁচর মা শুধু দু’মুঠো খাবারের তাগিদে আশরাফ একজন মানুষের সঙ্গে বিয়ের খেলায় মেতে উঠতে বাধ্য হয়। পাঁচীর মার স্বামীর সেই বিয়ে বিয়ে খেলার নেশা ছুটে গেলে, তাকে আবার আতরাফ জীবনে জোর করে যখন ঠেলে দেওয়া হয়। তখন সে তার প্রথম জীবনের আতরাফ অবস্থানে আর থাকে না। সে তখন হয়ে যায় ‘দাস শ্রমিক’ একদা যে আশরাফ ব্যক্তি জৈবিক কারণে তাঁকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিল, তার ঘরের বন্ডেড লেবারে পরিণত হয় পাঁচীর মা।
আর সেই মানুষটি, অর্থাৎ পাঁচীর মা যখন সামান্য নিজের অধিকার, যে অধিকারের মধ্যে কোনো স্ত্রীর অধিকারের দাবি নেই, কেবলমাত্র নারীর অধিকার আছে, সেটিকে তুলে ধরবার তাগিদে, গাঁয়ের নতুন বর আসায়, গাঁয়ের মেয়েকে সন্তানের স্নেহ উজার করে দিতে চায়, তখনই তাঁর স্বামী, যে কিনা এখন তাকে কেবলমাত্র মালিকের সামগ্রী হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত, সে একটি মৃত্যুর পর, মৃতের প্রতি বাড়ির বাঁদীর সহানুভূতি দেখে বলে- ‘বড় যে দরদ ফুটে বেরুচ্ছে। তা যাও না কেন? ওদের বাড়িতেও থাকগে, হালাল রুজি খেয়ে বেশ মোটা তাজা হবে’ ফলে।
পাঁচির মার অধিকার নেই একজন নারী হিসেবে একটি মৃত মানুষের পরিবার-পরিজনদের পাশে দাঁড়ানোর। কারণ, সামাজিক রাজনীতির বেড়াজালে সেই মৃত মানুষটিকে ধর্মের আবরণ দিয়ে এক ঘরে করে দেওয়া হয়েছে সামাজিক রাজনীতির কৌশলে মৃতের জানাজা পড়ানো হচ্ছে না। এমন সামাজিক অচলায়তনকে সংবেদশীলতার আদলে দেখা একজন বাদীকে কি সমাজ সহ্য করতে পারে? তাইতো নসীর মিঞা বাঘের মতো গর্জে উঠে পাঁচির মাকে লাঠির গুঁতো দিয়ে মেরে বলে, ‘বেরো আমার বাড়ি থেকে। বাঁদী হয়ে এত বড় আশ্পর্দা। গ্রামসুদ্ধ লোকে মানা করল, আমি মানা করলাম, তা ওনার গ্রাহ্য হলো না। উনি গেলেন তাদের খয়েরখাহী করতে। আহা বড় দয়ার শরীর রে। এখন বেরোও দেখি আমার বাড়ি থেকে।”
তারপরের দিনই স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করলেন পাঁচির মা, তবে লাশ হয়ে।
এই অনবদ্য সামাজিক আখ্যান যদি আজ সমস্ত ধরনের সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, এপার বাংলার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা একবার পড়েন, হয়তো প্রতিবেশীকে না জানবার সঙ্কীর্ণতা থেকে একটু হলেও নিজেদের উত্তরিত করতে পারবেন।
বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০১ আশ্বিন ১৪২৯ ১৭ সফর ১৪৪৪
গৌতম রায়
মুসলিম জনজীবন সম্পর্কে অত্যন্ত স্বল্প এবং সংকীর্ণ ধারণা থাকবার ফলে, সারস্বত সমাজের ভিতরে বাঙালি মুসলমানের জনজীবনে জাতপাতের ক্লিন্নতার বিষয়টি ঘিরে সেভাবে কোনো সমাজ অনুধ্যানের চিত্র দেখতেই পাওয়া যায় না। পবিত্র ইসলামে যেভাবে জাতপাত বিষয়ে বলা হয়েছে, সেটি যে পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক বিবর্তনের ভেতর দিয়ে সঠিকভাবে অনুসরিত হয়নি, সে সম্পর্কে গুণীজনেরা সহমত পোষণ করেন। বাঙালি সমাজে অভিজাত মুসলমান সম্প্রদায়, অর্থাৎ যাঁদের আশরাফ মুসলমান বলা হয়, তাঁদের সঙ্গে অনভিজাত, একেবারে সমাজের নিম্নবর্গীয়, কর্মজীবী মুসলমান, যাঁদেরকে আতরাফ বলা হয়, তাঁদের দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্বের ভেতর থেকে যে সামাজিক বিন্যাস উঠে আসে, তা নিয়ে প্রায় আলাপ-আলোচনা দেখতেই পাওয়া যায় না।
হাতেগোনা দুই চারজন কথাসাহিত্যিক তাঁদের সৃষ্টির ভেতরে বা বিভিন্ন আলোচনায় খুব সংক্ষিপ্ত আকারে এই আশরাফ-আতরাফের দ্বন্দ্বটিকে কখনো কখনো তুলে ধরেছেন। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মতো কালজয়ী কথাসাহিত্যিক তাঁর ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতায় রাঢ়বঙ্গের সামাজিক বিন্যাসে এই আশরাফ-আতরাফের দ্বন্দ্বটিকে কোনো কোনো উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। উদাহরণ হিসেবে তাঁর জীবনকালের প্রায় শেষপর্বের অনবদ্য সৃষ্টি ‘স্বর্ণচাঁপার উপাখ্যানে’র কথা বলা যেতে পারে।
রাঢ় বাংলার আশরাফ মুসলমান যাদের রাঢ়ের আঞ্চলিক টানে ‘মিঞা মুসলমান’ বলা হয়, তাদের যে ‘আয়মাদারি’ অর্থাৎ আভিজাত্য, সে সম্পর্কে সিরাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল অনবদ্য। সেই বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা সিরাজ বহু সময় নানা সামাজিক বিবর্তন বোঝাতে গিয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরলেও তাকে ঘিরে পরিপূর্ণ উপন্যাস বা সমাজ বীক্ষণমূলক লেখা লেখবার সময় তিনি পাননি। হয়তো আরও দীর্ঘকাল জীবিত থাকলে এ সম্পর্কে তিনি তাঁর সুললিত কলমের মাধ্যমে বাঙালি সমাজকে এক অনবদ্য সৃষ্টি উপহার দিতেন।
মুসলমান সমাজ সম্পর্কে যাঁরা কিছুটা খোঁজখবর রাখতে আগ্রহী, তাঁরা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মতো মানুষদের লেখা পড়ে রাঢ়বঙ্গের আশরাফ-আরতরাফের দ্বন্দ্ব নিয়ে খানিকটা অবহিত হলেও পূর্ববঙ্গে, বিশেষ করে ভাটির দেশে, এই আশরাফের দ্বন্দ্ব কী পর্যায়ে ছিল এবং কীভাবে সেই দ্বন্দ্বের শিকার হচ্ছে নারী, তাদের সম্মুখ ধারণা খুব একটা করে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এই ধ্যানধারণা করে উঠতে না পারার প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো, এপার বাংলায় সমাজবিজ্ঞানের আলাপ আলোচনার ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজ সম্পর্কে এক আশ্চর্যজনক নীরবতা এবং অবহেলা।
অপরপক্ষে দেশভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সমাজ সংস্কৃতি সম্পর্কে অনুপুঙ্খ আলাপ-আলোচনা এপার বাংলায় বেশ কমই হয়। বাংলাদেশে তাদের সমাজ চিত্রণের আণুবীক্ষণিক স্তরে যে সমস্ত কথাসাহিত্য রচিত হয়, তা সে অবিভক্ত বাংলার সময়কালেই হোক, পূর্ব পাকিস্তানের সময়কালই হোক বা আজকের বাংলাদেশেই হোক, তা ঘিরে এপার বাংলার সুধী সমাজের আশ্চর্যজনক নীরবতা আমরা লক্ষ্য করেছি।
এই যে আশরাফ-আতরাফের দ্বন্দ্ব, অর্থাৎ একেবারে মার্কসীয় অর্থনীতির ভাবধারায় যাকে শ্রেণিদ্বন্দ্বের একটা রূপ হিসেবে অভিহিত করতে পারা যায়, সেই বিষয়টি মুসলমান সমাজের নিরিখে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ কেবলমাত্র এপার বাংলার রাঢ়বঙ্গের কথা উল্লেখ করলেও, ভাটির দেশে তার যে ব্যাপ্তি, সেই ব্যাপ্তিবিষয়ক এক আশ্চর্যজনক সমাজবীক্ষণ আমরা পাই বাংলার দ্বিতীয় জাগরণ, অর্থাৎ মুসলিম সাহিত্য সমাজ, ‘শিখা’ গোষ্ঠীর অন্যতম কর্ণধার কাজী মোতাহার হোসেনের একটি ছোট গল্প ‘সমাজচিত্রে’র ভেতর দিয়ে।
কথাসাহিত্যচর্চা কাজী মোতাহার হোসেন খুব বেশি করেননি। তাঁর কবিতা নামক একটি সংকলন আছে। যেখানে বেশ কয়েকটি কবিতা রয়েছে। এই কবিতাগুলির মধ্যে ‘আসা যাওয়া’ নামক কবিতাটি ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে অগ্রহায়ণ মাসে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাছাড়াও ম্যাক্সিম গোর্কির স্মরণিকাতে ‘ঝড়ো বাজের গান’ নামক তাঁর একটি কবিতা আছে। এই কবিতাটি বাঙালি সমাজের ম্যাক্সিম গোর্কি চর্চার ক্ষেত্রে একটি কালজয়ী পদক্ষেপ।
এছাড়াও আরো কিছু কবিতা তাঁর রয়েছে। যেমন, রুবাইয়াৎই মীযান। অনেকেরই জানা নেই কাজী মোতাহার হোসেন বেশ কিছু হিন্দি কবিতাও অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর অনূদিত হিন্দি কবিতার ছোট ছোট চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর হিন্দি কবিতার অনূদিত বই ‘নিবেদন’। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আরেকটি অনুবাদ কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল। ‘বিরহহী’ নামক হিন্দি কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ’৬৮ সালের জুলাই মাসে। তাঁর শেষ অনূদিত হিন্দি কবিতা গ্রন্থটির নাম হলো ‘বিরহিনী’। এটা ১৯৬৯ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হয়েছিল।
কাজী মোতাহার হোসেন পূর্ববঙ্গে আশরাফ-আতরাফের দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে নারীর যন্ত্রণাকে এক অনবদ্য ভঙ্গিমায় ‘সমাজচিত্র’ গল্পটির মধ্যে দিয়ে সারস্বত সমাজের কাছে তুলে ধরেছিলেন। এই সমাজচিত্র নামক গল্পটি মোয়াজ্জিন পত্রিকার কার্তিক-অগ্রহায়ণ সংখ্যায়, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। গোটা জীবনে তাঁর আর একটি গল্পের সন্ধান পাওয়া যায়- যেটি মোয়াজ্জিন পত্রিকাটি ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গল্পটির নাম ছিল ‘নবীন সংঘ’। সেটি কাজী মোতাহার হোসেনের ‘সঞ্চয়ন’ নামক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
নারীর যন্ত্রণাকে এক অব্যক্ত ভঙ্গিমায় এই ‘সমাজচিত্র’ নামক গল্পের ভেতর দিয়ে তুলে আনার ক্ষেত্রে কাজী মোতাহার হোসেনের মানসিকতার মরমী দিকটা আমরা খুঁজে পাই। বঙ্গজননী সুফিয়া কামালের উদ্দেশ্যে লেখা তাঁর ছোট্ট একটি কবিতার ভেতর দিয়ে। এই কবিতাটি কাজী মোতাহার হোসেনের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। তাঁর জীবনাবসানের অনেক কাল পরে, ১৯৯২ সালের মে মাসে বাংলাদেশে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে যখন তাঁর রচনাবলী তৃতীয় খণ্ডটি প্রকাশিত হয়, সেই সংকলনটি প্রস্তুত করার সময় কাজী মোতাহার হোসেনের কাগজপত্র দেখতে দেখতে গ্রন্থটির সম্পাদক বিশ্ববিশ্রুত লোকসংস্কৃতিবিদ অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী বঙ্গজননী সুফিয়া কামালের উদ্দেশ্যে লেখা এই ছোট কবিতাটি খুঁজে পান। কবিতাটি এইরকম-
“সুফিয়া- মা আমার কামাল কিয়া আপ্ নি জামাল সে
আল্লাহ্র মহিমাতে সাহিত্য-সভায় কিম্বা গানের মজলিসে,
সকলেই- ‘সুফিয়া এসেছে নাকি? উঁকিঝুঁকি দেখে
দরাইয়াফত কি মতলব-সে
সুফিয়ার আবির্ভাবে তার বাণী-ঝংকারে, শ্রোতারা মেতে ওঠে উল্লাসে।”
এই ছোট্ট কবিতাটির নামকরণ কাজী মোতাহার হোসেন ঐ চিরকুটে লিখে রেখেছিলেন। নামকরণটি ছিল ‘সুফিয়ার সমাগমে’।
বাংলার দ্বিতীয় জাগরণের এই অনবদ্য ব্যক্তিত্ব কাজী মোতাহার হোসেন, যিনি সংস্কৃতি জগতে মুসলমানের অবদানকে বর্তমান সময়ে সারস্বত সমাজের কাছে তুলে ধরে, একদিকে যেমন মৌলবাদী সমাজের মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন, অপরদিকে মুক্তবুদ্ধির, মুক্তি-চেতনার মানুষদের কাছে আবদ্ধ হয়েছিলেন পরম আত্মীয় হিশেবে। কাজী মোতাহার হোসেনের, ‘সঙ্গীতে মুসলমানের অবদান’, মুসলমান সমাজের মৌলবাদী অংশের অনেকেই সহ্য করতে পারেনি। হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা মুসলমান সমাজের ঐতিহ্য অনুসন্ধানে কাজী মোতাহার হোসেনের এই ঐতিহাসিক ভূমিকাকে ঠিক ভালো চোখে দেখেনি।
সেই মানুষটিই গত শতকের বিশের দশকে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে তাঁর সহযোদ্ধা কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, কামালউদ্দিন খান প্রমুখ যে কর্মকাণ্ড করেছিলেন, সেই কর্মকাণ্ডের প্রতি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ ছিল। সেই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নজরুল ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিলেন। কাজী মোতাহার হোসেনের সুফিয়া কামাল সম্বন্ধে এই সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে বুঝতে পারা যায় যে, নারীর স্বাধিকারের প্রশ্নে কাজী মোতাহার হোসেন সমসাময়িকতাকে কতখানি অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। আর এই সমসাময়িকতাকে অতিক্রম করার প্রশ্নে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের প্রতি তাঁর দৃষ্টি নিক্ষেপ যে কত গভীর আর আন্তরিক ছিল, সেটি বোঝবার জন্য আমাদের অত্যন্ত সহৃদয়তার সঙ্গে ‘সমাজচিত্র’ বলে তার এই গল্পটি পড়া দরকার।
গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন নারী। কী সেই নারীর নাম, সময়ের কাল¯্রােতে, সমাজ তা ভুলে যেতে বসেছে। বাঙালি সমাজের সে যুগের বা এযুগের, যে কোনো যুগেরই প্রচলিত প্রথা, যাই বলা হোক না কেন, নারীকে সম্মোধিত করা হয় অমুকের মা, তমুকের বোন ইত্যাদি বলে। এই গল্পের শুরুতেই কাজী মোতাহার হোসেন লিখছেন- ‘আর পাঁচী বলে তার কোনোদিন কোনো মেয়ে ছিল কিনা, সে সম্বন্ধেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।’
এই শব্দবন্ধের ভেতর দিয়েই বিশ শতকের সূচনা পর্বে আশরাফ আতরাফের দ্বন্দ্ব, অর্থাৎ অভিজাত আর অনভিজাতের দ্বন্দ্বে একজন নারীর সামাজিক অবস্থান গ্রামীণ পটভূমিকায় কতটা সমস্যা সংকুল হয়ে ওঠে, তা যেভাবে কাজী সাহেব তুলে এনেছেন, সেটি এই একুশ শতকের প্রায় মধ্যভাগে ও আমাদের সমসাময়িকতার নিরিখে বিস্মিত হয়ে উঠতে হয়। কখনো কখনো মনে হয়, রাটক্লিফের সীমানা ভুলে গিয়ে এতো দুই বাংলার যে কোনো প্রান্তেরই এক প্রান্তিক নারীর কাহিনী। পাঁচির মা কি কেবলমাত্র বাঙালি নারীর কাহিনী? ভারতের যে কোন প্রান্তে আমরা কি পাঁচির মাকে খুঁজে পাই না? বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুখিনী নারীদের যে সমস্ত জীবন কাহিনী কৃষান চন্দর থেকে শুরু করে মহাশ্বেতা দেবীরা কথাসাহিত্যে তুলে এনেছেন, তাঁদের থেকে পাঁচির মা কি আলাদা? আবার অমৃতা প্রিতমের লেখার ভেতর দিয়েও যে নারীর কথা আমরা জানতে পারি, কিংবা গত শতকের আটের দশকে রাজস্থানের দেওরালা গ্রামের রূপ কানোয়ার নামক সেই দুখিনী নারী, তাঁদের সাথে কি পাঁচির মাকে আলাদা করা যায়? তারা কি প্রত্যেকেই এক একজন পাঁচির মা নয়?
এই গল্পটির কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলা তথা বাঙালির প্রেক্ষাপটের ভেতর দিয়ে নারীর যে চিরন্তন যন্ত্রণা, তাকে কাজী মোতাহার হোসেন তুলে ধরেছিলেন। প্রায় একশো বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও প্রান্তিক নারীর সেই প্রান্তিকতার অবস্থান থেকে কোনো উনিশ-বিশ ঘটেছে, এমনটা আমরা দেখতে পাই না। দেখতে পেলে আজও মহাশ্বেতা দেবী উত্তর বাংলা সাহিত্যে জয়া মিত্রের মতো মানুষেরা প্রান্তিক নারীদের নিয়ে এভাবে সোচ্চার হতেন না।
শ্রেণীবৈষম্যের পলে সমাজে নারীর উদ্বৃত্ত শ্রমের প্রশ্নে যে অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করে, সেই প্রসঙ্গটি বাংলার দ্বিতীয় নবজাগরণের ঋত্ত্বিকেরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তাঁদের বিভিন্ন লেখার মধ্যে তুলে ধরেছিলেন। কাজী আবদুল ওদুদের লেখা ‘নদীবক্ষে’ উপন্যাস, যেটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, সেখানেও আমরা দেখতে পাই, সামাজিক সংকটের একটা বিশেষ দিক।
কাজী মোতাহার হোসেন যেভাবে তাঁর এই ‘সমাজচিত্র’ নামক ছোট্ট গল্পটির মধ্যে ‘পাঁচীর মা’ এই মুখ্য চরিত্রটির ভেতর দিয়ে একজন নারীর গোটা জীবন ধরে সমাজের বুকে নিজেকে উজাড় করে দেওয়া সত্ত্বেও তাঁর বিন্দুমাত্র আধিকারকে সমাজ স্বীকৃতি দিচ্ছে না, এই বিষয়টিকে তুলে এনেছেন, তা সমসাময়িককালের কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রেই হোক, সামাজিক রীতি-নীতির ক্ষেত্রেই হোক,এক বৈপ্লবিক অভিপ্রায়।
আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয়ে এই যে, এপার বাংলায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যত লেখা হয়েছে, সেখানে কিন্তু কখনোই বাঙালি মুসলমানের সৃষ্ট কথাসাহিত্যের এইসব ঐতিহাসিক দিকগুলির কথা আলোচনা তো দূরে থাকুক, উল্লেখ পর্যন্ত হয়নি। ফলে বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে এপার বাংলার বাঙালি হিন্দুদের মধ্যেও একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। আর সেই ভুল ধারণাকে অবলম্বন করেই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি নিজেদের রাজনৈতিক অভিপ্রায় হাসিল করবার লক্ষ্যে, বাঙালি হিন্দু সমাজকে অতি সহজেই মুসলমান সমাজ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করবার সুযোগ পেয়ে গেছে।
পাঁচির মা চরিত্রটি নির্মাণ করবার ক্ষেত্রে গ্রাম বাংলার সমাজ চিত্রে সে যুগে একটা বড় অংশের নারী সমাজের চারিত্রিক লক্ষণের একটা বৈশিষ্ট্য বেশ কিছু আঞ্চলিক শব্দবন্ধের ভেতর দিয়ে কাজী মোতাহার হোসেন তুলে এনেছেন। এইসব শব্দবন্ধ গুলি হলো ‘গেজেট’, ‘পাড়া কুঁদুলে’, ‘দুর্মুখী’, ‘চোগলখোর’ ইত্যাদি। এই ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বাঙালি পাঠক বিশ শতকের মধ্যভাগে গজেন্দ্রকুমার মিত্রের লেখা ‘কলকাতার কাছেই’ উপন্যাসের শ্যামা ঠাকুরন চরিত্রের মধ্যে অনবদ্যভাবে দেখেছেন। তারও আগে দেখেছেন আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম ‘প্রতিশ্রুতি’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সত্যবতীর শাশুড়ি চরিত্রটির ভেতর দিয়ে।
গজেন্দ্রকুমার মিত্র বা আশাপূর্ণা দেবীর যে চরিত্রগুলিকে উল্লেখ করা হলো সেই চরিত্রগুলি কিন্তু একটা মধ্যবিত্ত আর্থিক সচ্ছলতার মোটামুটি পরিবেশ থেকে উঠে আসা চরিত্র। উনিশ-বিশ শতকের সামাজিক অদল বদলের ক্রান্তিলগ্নে এই চরিত্রগুলি পুরুষতান্ত্রিকতার এক অদ্ভুত টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে নিজেদের জীবনকে অতিবাহিত করেছিলেন।
এমন চরিত্র আমরা শৈলবালা ঘোষজায়ার ‘শেখ আন্দু’তেও দেখছি। সেই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রের ভিতরে আমরা আশাপূর্ণার কালজয়ী সত্যবতী ট্রিলজির সত্যবতীর আদল খুঁজে পাই। কিন্তু এটাও একটা দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, সত্যবতী চরিত্রটি ঘিরে বাংলা সাহিত্যে যত আলাপ আলোচনা, শেখ আন্দুর মুখ্য চরিত্র, যেটি কেবল সেই কালেই নয়, এইকালেও অত্যন্ত বৈপ্লবিক চরিত্র, তাকে ঘিরে আমরা বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের সেভাবে সরব হতে দেখি না।
এই প্রেক্ষিতেই আবার উঠে আসে কাজী মোতাহার হোসেনের এই পাঁচির মা চরিত্রটির কথা। আশাপূর্ণা দেবীর সৃষ্টিতে মধ্যবিত্ত নারীর সংকট বারবার আলোচিত হয়েছে। কিন্তু গ্রামীণ পটভূমিকায় পুরুষশাসিত সমাজের দ্বারা কেবলমাত্র ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়া নিম্নবর্গীয় মুসলমান নারীর কান্না যেভাবে কাজী মোতাহার হোসেন তুলে এনেছেন, সেটি কেবলমাত্র বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষিতেই নয়, বাংলার সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
ব্রিটিশের তৈরি করা অর্থনৈতিক সংকটকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে, ব্রিটিশের সঙ্গে একযোগে দুর্ভিক্ষের এক করাল পটভূমিকা তৈরি করার পর গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ, কি প্রান্তিক অবস্থার ভিতর পৌঁছে যাচ্ছে, তার চরিত্র চিত্রনের মধ্যে এই গল্পটির একটি ভিন্ন সামাজিক তাৎপর্য লুকিয়ে আছে। সামাজিক তাৎপর্যের জায়গায় এই গল্পটির আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত চিত্রণের পর্যায়টিকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতি’ উপন্যাসের যে দুর্ভিক্ষের বর্ণনার প্রেক্ষিত রয়েছে, নীল চাষীদের উপর অত্যাচারের কথা রয়েছে, তার সঙ্গে তুলনা করতে পারা যায়।
আবার তার পরবর্তী প্রজন্মের লেখক সমরেশ বসু যখন ‘ভানুমতী’ উপন্যাস রচনা করছেন সেই উপন্যাসেও যেভাবে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম কালে ব্রিটিশের তৈরি অর্থনৈতিক সংকট, নীল চাষ, কীভাবে বাংলার সামাজিক প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণ হয়ে উঠল, তার মর্মস্পর্শী বিবরণ আছে। ব্রিটিশের তথাকথিত সামাজিক সাংস্কৃতিক পটভূমিকা হুগলি, ২৪ পরগণাকে ঘিরে ভৌগোলিক অঞ্চলগুলির পর্যায়ের ধরে সমরেশের লেখাতে সেগুলি উঠে এসেছে।
সেই পর্যায়ক্রমের সঙ্গেও তুলনা করতে পারা যায় ‘সমাজচিত্র’ গল্পটিকে। দুর্ভিক্ষের কড়াল গ্রাস থেকে আতরাফ পাঁচর মা শুধু দু’মুঠো খাবারের তাগিদে আশরাফ একজন মানুষের সঙ্গে বিয়ের খেলায় মেতে উঠতে বাধ্য হয়। পাঁচীর মার স্বামীর সেই বিয়ে বিয়ে খেলার নেশা ছুটে গেলে, তাকে আবার আতরাফ জীবনে জোর করে যখন ঠেলে দেওয়া হয়। তখন সে তার প্রথম জীবনের আতরাফ অবস্থানে আর থাকে না। সে তখন হয়ে যায় ‘দাস শ্রমিক’ একদা যে আশরাফ ব্যক্তি জৈবিক কারণে তাঁকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিল, তার ঘরের বন্ডেড লেবারে পরিণত হয় পাঁচীর মা।
আর সেই মানুষটি, অর্থাৎ পাঁচীর মা যখন সামান্য নিজের অধিকার, যে অধিকারের মধ্যে কোনো স্ত্রীর অধিকারের দাবি নেই, কেবলমাত্র নারীর অধিকার আছে, সেটিকে তুলে ধরবার তাগিদে, গাঁয়ের নতুন বর আসায়, গাঁয়ের মেয়েকে সন্তানের স্নেহ উজার করে দিতে চায়, তখনই তাঁর স্বামী, যে কিনা এখন তাকে কেবলমাত্র মালিকের সামগ্রী হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত, সে একটি মৃত্যুর পর, মৃতের প্রতি বাড়ির বাঁদীর সহানুভূতি দেখে বলে- ‘বড় যে দরদ ফুটে বেরুচ্ছে। তা যাও না কেন? ওদের বাড়িতেও থাকগে, হালাল রুজি খেয়ে বেশ মোটা তাজা হবে’ ফলে।
পাঁচির মার অধিকার নেই একজন নারী হিসেবে একটি মৃত মানুষের পরিবার-পরিজনদের পাশে দাঁড়ানোর। কারণ, সামাজিক রাজনীতির বেড়াজালে সেই মৃত মানুষটিকে ধর্মের আবরণ দিয়ে এক ঘরে করে দেওয়া হয়েছে সামাজিক রাজনীতির কৌশলে মৃতের জানাজা পড়ানো হচ্ছে না। এমন সামাজিক অচলায়তনকে সংবেদশীলতার আদলে দেখা একজন বাদীকে কি সমাজ সহ্য করতে পারে? তাইতো নসীর মিঞা বাঘের মতো গর্জে উঠে পাঁচির মাকে লাঠির গুঁতো দিয়ে মেরে বলে, ‘বেরো আমার বাড়ি থেকে। বাঁদী হয়ে এত বড় আশ্পর্দা। গ্রামসুদ্ধ লোকে মানা করল, আমি মানা করলাম, তা ওনার গ্রাহ্য হলো না। উনি গেলেন তাদের খয়েরখাহী করতে। আহা বড় দয়ার শরীর রে। এখন বেরোও দেখি আমার বাড়ি থেকে।”
তারপরের দিনই স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করলেন পাঁচির মা, তবে লাশ হয়ে।
এই অনবদ্য সামাজিক আখ্যান যদি আজ সমস্ত ধরনের সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, এপার বাংলার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা একবার পড়েন, হয়তো প্রতিবেশীকে না জানবার সঙ্কীর্ণতা থেকে একটু হলেও নিজেদের উত্তরিত করতে পারবেন।