স্ন্যাপশটে স্মৃতি আলেখ্য

আতাতুর্ক কামাল পাশা

ফিকশন, নন-ফিকশন, কবিতা মিলিয়ে মিলু শামসের এর আগে সাতটি বই প্রকাশ পেয়েছিল। এবারে হড়হ-ভরপঃরড়হ বা অকল্পনীয় (বাস্তব) বিষয়ের বস্তুনিষ্ঠ মুক্তগদ্যের আর একটি বই পড়ার সুযোগ এলো, স্ন্যাপশট : টুকরো কথার স্মৃতি। ৫৮টি মুক্তগদ্য আর দু’টি গল্প নিয়ে এসেছে ২০২২-এর বইমেলায়।

স্ন্যাপশটগুলো বিশেষ মুহূর্তের স্থিরচিত্রের মতো করে ছোট ছোট করে লেখা। তবে, হৃদয়ের অন্তস্থলে প্রবেশ করে। “ঢাকার বিখ্যাত মানুষদের বাড়িগুলোর আদিরূপ অক্ষুণ্ণ রাখার কঠোর আইন থাকলে অন্ধকারে স্মৃতি হাতড়ে খুঁজতে হতো না।” (পৃ-৬২)। ছোট্ট কয়েকগুচ্ছ শব্দের ওজন এতো গভীরে প্রথিত যে তা আমাদের বংশপরম্পরার অনেক ভেতরে ঢুকে যায়। লেখক “অন্ধকারে স্মৃতি হাতড়ে খুঁজতে” ব্যবহার করে আমাদের জাতিসত্তার গভীরতম শেকড় ধরে টান দিয়েছেন। এ অন্ধকার বলতে বাজার-অর্থনীতি বিশে^র সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আমাদের দেশ ক্রমেই অজানা এক অন্ধকারের দিকে ছুটছে বলে প্রতীয়মান। স্মৃতি মানে যদি ধরে নিই আমাদের অতীত, ইতিহাস, সংস্কৃতি, সভ্যতা, পিতৃপুুরুষের ভিটা- তাহলেও দোষের কিছু হয় না। হাতড়ে বলতে বুঝতে চাই- সন্ধান, অনুসন্ধান, স্বজাত্যবোধের ইতিহাস, ইত্যাদি হাতড়ানো। লেখক ঠিকই বলেছেন, লন্ডনে শেক্সপিয়ারের তিনশ’ বছর আগের বাসস্থানটি দেখতে গিয়ে তাঁর কাছে তেমন উল্লেখযোগ্য মনে না হলেও বিলেতিরা স্থানটিকে ধরে রেখেছে তাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের স্মারক হিসেবে, অথচ আমাদের দেশের একজন প্রজ্ঞাবান মহতী দেশপ্রেমী সুফিয়া কামালের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনটির আজ কোনো হদিস নেই, আমরা ইতিহাসহীন হতে চলেছি। সেখানে বহুতল ভবন।

দেশ-বিদেশের বেশ কিছু স্থান পরিভ্রমণ করে সেখান থেকে উঠিয়ে এনেছেন কিছু টুকরো ¯œ্যাপশট। করোনাকালে অবরুদ্ধ মহানগরের ছবি এঁকেছেন। দেশের অনেক বরেণ্য ব্যক্তির, সাহিত্যিকের ওপর স্মৃতিতর্পণ করেছেন যেখানে তাঁরা আরো মহত্তম হয়ে উঠেছেন। প্রায় প্রতিটি ¯ম্পযাপশটই এক থেকে দেড়-দু’পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ। তবে এর গহীনের ভেতরই পাঠককে টেনে নিয়ে গিয়েছেন তিনি তাঁর ভাষা, বর্ণনা, চিত্র তুলে ধরবার বুনটের দক্ষতায়। যেমনটি করতে দেখা যায় চার্লস টমলিনসন, সেভেতলানা আলেক্সিভিচ, এলফ্রিদে জেলেনিককে যারা পারিপাশির্^ক পরিবেশ নিঁখুতভাবে বর্ণনার ভেতর দিয়ে বিশে^র মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন।

বর্ণনা আর বাচনভঙ্গি নিয়ে এবং বিষয় নির্বাচনে মিলু শামসকে অতুলনীয় কাজ করতে দেখা যায়। বঙ্কিম যেমন বাংলা ভাষার আভিজাত্য বজায় রাখতে দায়িত্ববান ছিলেন মিলু শামসেরও সে দায়িত্ব পালনের প্রচেষ্টা দেখি এই নন-ফিকশনগুলোতে। আমাদের থ্রি জি বা ফোর জিদের মাঝে এখন লেখ্য ও বাচনিক কথ্যে যেসব শব্দ ব্যবহার হয়, তার ভেতরে এসব শব্দ আগন্তুক বলে বিবেচিত হচ্ছে, অচিরেই এগুলো হয়ত হারিয়ে যাবে তাদের মধ্য থেকে। শব্দগুলো পরিচিত হলেও বর্তমান কথ্যে, (এমনকি) লেখনীতে খুব একটা চোখে পড়ে না। যেমন- খানিক গড়িয়ে নেয়া (ঘুমানো অর্থে), গটগট করে ভেতরে ঢুকে (দ্বিধাহীন দ্রুত প্রবেশ), হঠাৎ সংবিৎ ফেরার মতো (খেয়াল হওয়া), ভরভরন্ত সূর্যমুখী ক্ষেত (পরিপূর্ণ অর্থে), উপলক্ষ যাই হোক (আয়োজন অর্থে), নীরবতা জেঁকে বসে (দখল করে), থৈথৈ ক্রেতা (ক্রেতায় পরিপূর্ণ), বাতাসের গমকে (বাতাসের ধাক্কায়), এগুলে (আগালে), বিদ্যাপীঠ, তবলার সঙ্গতে (তবলার তালে), ঢুঁ মেরে (উঁকি দিয়ে দেখা অর্থে), এগোতেই (আগাতেই), মন চনমন করছে (বিমুগ্ধ করছে), অর্থব (অকাজের), ইত্যাদি। এ ধরনের বেশ কিছু শব্দ আমাদের নতুন প্রজন্ম খুব একটা ব্যবহার করেও না, এসবের অর্থও তাদের কাছে ঠিকমতো বোধগম্য হয়ে ওঠে না। বাংলা একাডেমির অভিধানে দু’একটি শব্দের অর্থ পাওয়া যাচ্ছে বটে, কিন্তু অধিকাংশ শব্দই বর্তমান প্রজন্ম ব্যবহার করে না। এ দিকটির উপস্থাপনই একজন সচেতন লেখকের দায়িত্ব যা প্রতিবছর বইমেলায় আসা তরুণদের বইতে ব্যবহারই দেখা যায় না। তবে তিনি অসংখ্য ইংরেজি শব্দেরও ব্যবহার করেছেন। বইটিতে দু’টো গল্প সংযোজিত যার একটিতে করোনাকালীন অজস্র মৃতের কবর খুঁড়তে লোকের অভাবে একজন হিন্দু শ্রমিককেও ডাকা হয়- যা ঢাকা পড়ে যায় পরবর্তীদিনের সংবাদের পাতায় যেখানে দেশের উপজেলা চেয়ারম্যান ও বড় বড় আমলা করোনায় মৃতদের সুষ্ঠুভাবে সৎকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সরকারের দায়িত্ব পালন করেন।

তাঁর এই বইটির অনেক ম্পযাপশট পরবর্তীতে বাংলাদেশের ইতিহাস বা ইতিহাসের অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হবে। রবীন্দ্রনাথ তার চারটি চরণবিশিষ্ট একটি কবিতা লেখেন-

স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল

ক্ষণকালের ছন্দ।

উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল

সেই তারই আনন্দ।

মূূলত ক্ষণপ্রভাকে নিয়ে লেখা এই কবিতাটি যেখানে খুব অল্প সময়ের জন্য এক বিজলীর চমক একবার সবাইকে চমকে দিয়েই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মিলু শামস এ বইয়ে ক্ষণপ্রভার মতো চমক দেন, তবে হারিয়ে যান না। তিনি সময়কে, কালকে, লোকজ সমাজকে ধরে রেখেছেন এ বইয়ে।

স্ন্যাপশট : টুকরো কথার স্মৃতি। মিলু শামস। প্রকাশক। কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা। প্রচ্ছদ: নূরুল ইসলাম পেয়ার। মূল্য: ২৫০ টাকা।

বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০১ আশ্বিন ১৪২৯ ১৭ সফর ১৪৪৪

স্ন্যাপশটে স্মৃতি আলেখ্য

আতাতুর্ক কামাল পাশা

image

ফিকশন, নন-ফিকশন, কবিতা মিলিয়ে মিলু শামসের এর আগে সাতটি বই প্রকাশ পেয়েছিল। এবারে হড়হ-ভরপঃরড়হ বা অকল্পনীয় (বাস্তব) বিষয়ের বস্তুনিষ্ঠ মুক্তগদ্যের আর একটি বই পড়ার সুযোগ এলো, স্ন্যাপশট : টুকরো কথার স্মৃতি। ৫৮টি মুক্তগদ্য আর দু’টি গল্প নিয়ে এসেছে ২০২২-এর বইমেলায়।

স্ন্যাপশটগুলো বিশেষ মুহূর্তের স্থিরচিত্রের মতো করে ছোট ছোট করে লেখা। তবে, হৃদয়ের অন্তস্থলে প্রবেশ করে। “ঢাকার বিখ্যাত মানুষদের বাড়িগুলোর আদিরূপ অক্ষুণ্ণ রাখার কঠোর আইন থাকলে অন্ধকারে স্মৃতি হাতড়ে খুঁজতে হতো না।” (পৃ-৬২)। ছোট্ট কয়েকগুচ্ছ শব্দের ওজন এতো গভীরে প্রথিত যে তা আমাদের বংশপরম্পরার অনেক ভেতরে ঢুকে যায়। লেখক “অন্ধকারে স্মৃতি হাতড়ে খুঁজতে” ব্যবহার করে আমাদের জাতিসত্তার গভীরতম শেকড় ধরে টান দিয়েছেন। এ অন্ধকার বলতে বাজার-অর্থনীতি বিশে^র সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আমাদের দেশ ক্রমেই অজানা এক অন্ধকারের দিকে ছুটছে বলে প্রতীয়মান। স্মৃতি মানে যদি ধরে নিই আমাদের অতীত, ইতিহাস, সংস্কৃতি, সভ্যতা, পিতৃপুুরুষের ভিটা- তাহলেও দোষের কিছু হয় না। হাতড়ে বলতে বুঝতে চাই- সন্ধান, অনুসন্ধান, স্বজাত্যবোধের ইতিহাস, ইত্যাদি হাতড়ানো। লেখক ঠিকই বলেছেন, লন্ডনে শেক্সপিয়ারের তিনশ’ বছর আগের বাসস্থানটি দেখতে গিয়ে তাঁর কাছে তেমন উল্লেখযোগ্য মনে না হলেও বিলেতিরা স্থানটিকে ধরে রেখেছে তাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের স্মারক হিসেবে, অথচ আমাদের দেশের একজন প্রজ্ঞাবান মহতী দেশপ্রেমী সুফিয়া কামালের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনটির আজ কোনো হদিস নেই, আমরা ইতিহাসহীন হতে চলেছি। সেখানে বহুতল ভবন।

দেশ-বিদেশের বেশ কিছু স্থান পরিভ্রমণ করে সেখান থেকে উঠিয়ে এনেছেন কিছু টুকরো ¯œ্যাপশট। করোনাকালে অবরুদ্ধ মহানগরের ছবি এঁকেছেন। দেশের অনেক বরেণ্য ব্যক্তির, সাহিত্যিকের ওপর স্মৃতিতর্পণ করেছেন যেখানে তাঁরা আরো মহত্তম হয়ে উঠেছেন। প্রায় প্রতিটি ¯ম্পযাপশটই এক থেকে দেড়-দু’পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ। তবে এর গহীনের ভেতরই পাঠককে টেনে নিয়ে গিয়েছেন তিনি তাঁর ভাষা, বর্ণনা, চিত্র তুলে ধরবার বুনটের দক্ষতায়। যেমনটি করতে দেখা যায় চার্লস টমলিনসন, সেভেতলানা আলেক্সিভিচ, এলফ্রিদে জেলেনিককে যারা পারিপাশির্^ক পরিবেশ নিঁখুতভাবে বর্ণনার ভেতর দিয়ে বিশে^র মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন।

বর্ণনা আর বাচনভঙ্গি নিয়ে এবং বিষয় নির্বাচনে মিলু শামসকে অতুলনীয় কাজ করতে দেখা যায়। বঙ্কিম যেমন বাংলা ভাষার আভিজাত্য বজায় রাখতে দায়িত্ববান ছিলেন মিলু শামসেরও সে দায়িত্ব পালনের প্রচেষ্টা দেখি এই নন-ফিকশনগুলোতে। আমাদের থ্রি জি বা ফোর জিদের মাঝে এখন লেখ্য ও বাচনিক কথ্যে যেসব শব্দ ব্যবহার হয়, তার ভেতরে এসব শব্দ আগন্তুক বলে বিবেচিত হচ্ছে, অচিরেই এগুলো হয়ত হারিয়ে যাবে তাদের মধ্য থেকে। শব্দগুলো পরিচিত হলেও বর্তমান কথ্যে, (এমনকি) লেখনীতে খুব একটা চোখে পড়ে না। যেমন- খানিক গড়িয়ে নেয়া (ঘুমানো অর্থে), গটগট করে ভেতরে ঢুকে (দ্বিধাহীন দ্রুত প্রবেশ), হঠাৎ সংবিৎ ফেরার মতো (খেয়াল হওয়া), ভরভরন্ত সূর্যমুখী ক্ষেত (পরিপূর্ণ অর্থে), উপলক্ষ যাই হোক (আয়োজন অর্থে), নীরবতা জেঁকে বসে (দখল করে), থৈথৈ ক্রেতা (ক্রেতায় পরিপূর্ণ), বাতাসের গমকে (বাতাসের ধাক্কায়), এগুলে (আগালে), বিদ্যাপীঠ, তবলার সঙ্গতে (তবলার তালে), ঢুঁ মেরে (উঁকি দিয়ে দেখা অর্থে), এগোতেই (আগাতেই), মন চনমন করছে (বিমুগ্ধ করছে), অর্থব (অকাজের), ইত্যাদি। এ ধরনের বেশ কিছু শব্দ আমাদের নতুন প্রজন্ম খুব একটা ব্যবহার করেও না, এসবের অর্থও তাদের কাছে ঠিকমতো বোধগম্য হয়ে ওঠে না। বাংলা একাডেমির অভিধানে দু’একটি শব্দের অর্থ পাওয়া যাচ্ছে বটে, কিন্তু অধিকাংশ শব্দই বর্তমান প্রজন্ম ব্যবহার করে না। এ দিকটির উপস্থাপনই একজন সচেতন লেখকের দায়িত্ব যা প্রতিবছর বইমেলায় আসা তরুণদের বইতে ব্যবহারই দেখা যায় না। তবে তিনি অসংখ্য ইংরেজি শব্দেরও ব্যবহার করেছেন। বইটিতে দু’টো গল্প সংযোজিত যার একটিতে করোনাকালীন অজস্র মৃতের কবর খুঁড়তে লোকের অভাবে একজন হিন্দু শ্রমিককেও ডাকা হয়- যা ঢাকা পড়ে যায় পরবর্তীদিনের সংবাদের পাতায় যেখানে দেশের উপজেলা চেয়ারম্যান ও বড় বড় আমলা করোনায় মৃতদের সুষ্ঠুভাবে সৎকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সরকারের দায়িত্ব পালন করেন।

তাঁর এই বইটির অনেক ম্পযাপশট পরবর্তীতে বাংলাদেশের ইতিহাস বা ইতিহাসের অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হবে। রবীন্দ্রনাথ তার চারটি চরণবিশিষ্ট একটি কবিতা লেখেন-

স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল

ক্ষণকালের ছন্দ।

উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে গেল

সেই তারই আনন্দ।

মূূলত ক্ষণপ্রভাকে নিয়ে লেখা এই কবিতাটি যেখানে খুব অল্প সময়ের জন্য এক বিজলীর চমক একবার সবাইকে চমকে দিয়েই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মিলু শামস এ বইয়ে ক্ষণপ্রভার মতো চমক দেন, তবে হারিয়ে যান না। তিনি সময়কে, কালকে, লোকজ সমাজকে ধরে রেখেছেন এ বইয়ে।

স্ন্যাপশট : টুকরো কথার স্মৃতি। মিলু শামস। প্রকাশক। কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা। প্রচ্ছদ: নূরুল ইসলাম পেয়ার। মূল্য: ২৫০ টাকা।