জলজীবনের ধারাপাত

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

আষাঢ়ের এক পূর্ণিমার রাতে জোছনার প্লাবনে থইথই করা পদ্মার অথৈ খরজলধারা পাড়ি দিয়ে বাংলাবাজার ঘাটে যানবাহনহীন বিশ-পঁচিশ জন যাত্রী নিয়ে বিশাল ফেরিটি তুমুল ঝাঁকুনি দিয়ে পল্টুনে সংযুক্ত হলে ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বন্ধ হয়ে অবসাদগ্রস্ত মানুষের মতো নিস্তেজ নিশ্চল হলে চারপাশের নিরেট স্তব্ধতা মন্তর প্রবাহে বাংলাবাজার ফেরিঘাটটিকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে- তখন রাত দশটা। সমস্ত আকাশ আর পদ্মার চরাচর মনে হয় একটি ভয়াল শূন্যতায় ভেসে আছে। রাত আরও গভীর হলে ফেরির ছাদের ওপর ঋজু হয়ে সুখাসনে বসে সিগারেট জ্বালিয়ে ফেরিচালক আমির হোসেন উদ্দেশ্যহীন নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে মেঘহীন স্বচ্ছ আকাশে ভাসমান ডিমের কুসুমের মতো পূর্ণিমার চাঁদের দিকে। এমন নির্মেঘ আকাশ আর বৃষ্টিহীন নিষ্ফলা বর্ষাকাল আমির হোসেন জীবনে কখনো দেখেছে কিনা মনে করতে পারেন। বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা বেশি, পদ্মার উন্মুক্ত ঘাটে ফেরির ছাদে বসে থাকলেও ভ্যাপসা গরমে অস্থিরতা অনুভব করে, জামাটি খুলে পাশে রেখে আদুল গায়ে নির্বাক পূর্ববৎ অনড় বসে থাকে আমির হোসেন। ভারতের বন্যার পানি পদ্মায় ধেয়ে আসাতে উত্তাল ¯্রােত আর অগণিত প্রবল ঢেউয়ের বুকে ধবল জোছনার প্রতিফলনের ফলে আমির হোসেনের মনে হয় কালচে নদীর ওপরে যেন শুভ্র ডানার অসংখ্য জলপরি ডুবসাঁতার খেলছে। এখন পরিশ্রমে শরীর ক্লান্ত হয় না, বরং পরিশ্রম না করার কারণে সে বিষম আলস্যে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যখন-তখন তন্দ্রাচ্ছান্নও হয়। পরিশ্রমে মানুষ ক্লান্ত হয়, আবার পরিশ্রমহীনতায়ও শরীরকে অবসাদে পরাস্ত করে। আমির হোসেন সিগারেট জ¦ালিয়ে অবসাদ দূর করার প্রয়াসে নৈঃশব্দ্যে ডুবে থাকা রহস্যময় পদ্মার নিসর্গের সঙ্গে নিজেকেও বিলীন করে দিয়ে ধীরে ধীরে সিগারেট টানে। একসময় তার দৃষ্টি গিয়ে মিশে নদীর বুকে ধবল জোছনার প্লাবনের ওপর পদ্মা সেতুর অসংখ্য বৈদ্যুতিক বাতির সোনালি আলোর বিভায়। আমির হোসেনের মনে হয় পদ্মার বুকে চোখ ধাঁধানো মায়াবী একটি আলোর নহর এবং তখন সেই মায়াবী আলোর নহরের দিকে তার দৃষ্টিতে নিবদ্ধ হয়, সেখান থেকে অন্যত্র দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। মায়াবী আলোর নহর- নাকি মায়াবী কোনো পরি সোনালি জরির শাড়ি পরে পদ্মার জলের ওপরে শায়িত হয়েছে আর জলতরঙ্গের সঙ্গে মিশে পানসি নৌকার মতো নিজেও দোল খাচ্ছে। নাকি কোনো আলোর শাম্পান পদ্মার দুকূল অবধি বিস্তৃত হয়েছে? বিভ্রমে আক্রান্ত হয় আমির হোসেন; সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সেতুর নিচে প্রতিফলিত মায়াবী আলোর নহরের দিকে। যানবাহনহীন বিশাল ফেরিটি শূন্যতায় খাঁ খাঁ করার যন্ত্রণা আর পদ্মা সেতুর নিচে প্রতিফলিত আলোর নহর দেখার আনন্দের যুগপৎ মিথস্ক্রিয়া বুকের গভীরে ক্ষণকাল আলোড়িত হয়ে পরক্ষণেই লীন হয়। দীর্ঘশ^াস বের হয় বুক চিরে। দীর্ঘশ^াস বের হতেই পারে। এই ফেরিতে বিশটি বছর কীভাবে কেটে গেল আমির হোসেন হিসেব করে মিলাতে পারে না। মানুষের জীবনের সময় এভাবেই কি মহাকালে বিলীন হয়ে যায়! বিশটি বছর পদ্মার বুকে- কত স্মৃতি, কত কথা, কত হাসিকান্না, আনন্দ-বেদনার কথা মনে হতে থাকে তার! রাতের মতোই নিঃসঙ্গ আমির হোসেন নির্জন ছাদে বসে থাকতে দেখে তারই সহকর্মী হেদায়েত খান পাশে এসে বসে। হাজার হাজার মানুষের পদচারনায়, কোলাহল, শত শত যানবাহনের ঘরাৎ ঘরাৎ শব্দে মুখরিত ফেরিঘাট এমন নির্জন হবে, এমন নিস্তব্ধ হয়ে যাবে এক বছর আগেও ওরা ভাবতে পারেনি। নির্জনতা সত্যি ভয়ঙ্কর। হেদায়েত খানেরও মনে হয় তার জীবনের শিকড় উপড়ে গেছে, চারপাশে থাকা হাজার হাজার চেনা-অচেনা মানুষেরা ওদের নিঃসঙ্গ করে সরে গেছে, কেউ নেই- শুধু ভয়াল শূন্যতা। সেও দীর্ঘশ^াস ফেলে। আমির হোসেন দৃষ্টি এখনো পদ্মা সেতুর নিচে অপরূপ সৌন্দর্যের আলোর নহরের দিকে, দৃষ্টি না ফিরিয়েই জিজ্ঞেস করে জানতে চায় যে, হেদায়েত খানের মন খারাপ কিনা। হেদায়েত কোনো উত্তর না দিয়ে ছাদের পাটাতনে শুয়ে ডিমের কুসুমের মতো চাঁদটির দিকে তাকিয়ে থাকে এবং কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর সেও জানতে যায় যে, আমির হোসেন কী ভাবছে এবং তার মন খারাপ কিনা? আমির হোসেন অস্ফুট জবাবে জানায় যে, তার মন খারাপ নয়, সে ভাবছে এই পদ্মার বুকে বিশ বছর ফেরি চালানোর কথা এবং এই ফেরির জীবনে কত ঘটনাই না মনে পড়ছে যেসব কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমির হোসেনের কথা শুনে হেদায়েত খানের (যে দশ বছর আগে আমির হোসেনের সহকারী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে) করোটিতেও অসংখ্য স্মৃতিময় ইমেজ জিয়ল মাছের মতো নড়েচড়ে ওঠে। সে তীব্র দৃষ্টিতে আমির হোসেনের মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে আর কিছু বলে কিনা শোনার জন্য। তারপর তার দৃষ্টি চলে যায় পদ্মা সেতুর বাতিগুলোর দিকে। অসংখ্য বাতির আলোর বিকিরণে সেতুর নিচের অপ্রতিরোধ্য পদ্মার ঢেউয়ে প্রতিফলিত হয়ে এক রহস্যময় মায়াবী মন্দ্রজাল সৃষ্টি করেছে, অবারিত জলধারায় থইথই করা রুপালি জোছনা, ফেরিঘাটের ভয়াল নৈঃশব্দ্য, হঠাৎ হঠাৎ শুশুকের ভেসে ওঠা, কিনারে বাঁধা জেলেদের ছোটো ছোটো নৌকা সব মিলিয়ে হেদায়েত খানও ভাবালুতায় ডুবে যায়। তার মনের গভীরেও একই প্রশ্নের কানামাছি খেলা শুরু করে, কোথায় হারিয়ে গেল ফেরিঘাটের কোলাহল, চিৎকার চেঁচামেচি, কান্না, মারামারি, হাতাহাতি, আনন্দ হিল্লোল- কোথায় হারিয়ে গেল? নিজের প্রশ্নের জালে নিজেই আটকা পড়ে আর নিজেই উত্তর খোঁজে? মনে পড়ে বাপের কথা, আপথ পথ হইবো, আঘাট ঘাট হইবো। বাপজান বোঝাতে চাইতে দিন বদলে যাবে আর সেই দিন বদলের কত খেলাই দেখে যাচ্ছে হেদায়েত খান! আমির হোসেন হেদায়েত খানের উদ্দেশ্যে বলে যে, এই ফেরিতে কত মানুষের কান্না চাপা পড়ে আছে, আর চোখের পানি শুকিয়ে আছে সেসব কথা ওর মনে পড়ে কিনা? মানুষের স্মৃতি বিভ্রম না হলে এত অল্প সময়ের কথা কেন মনে থাকবে না, আমির হোসেনের মনে কেন সংশয় দেখা দিয়েছে এই কথা বোঝাতে হেদায়েত খান ঈষৎ মাথা নাড়ে বটে তবে জোছনার আলোয় মাথা নাড়ানোর দৃশ্যটি চোখে না পড়াতে কিংবা কোনো কথা না বলাতে নির্ভার দৃষ্টি মেলে পদ্মা সেতুর দিকে তাকিয়ে থেকেই আমির হোসেন বলে যে, তার খুব মনে পড়ে কয়েকটি ঘটনা। এই পদ্মাকে তখন মনে হয়েছিল রাক্ষুসি। হেদায়েত খান আমির হোসেনের দিকে ক্ষণকাল তাকিয়েও আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে সেতুর আলোর দিকে তাকিয়ে নিগূঢ় সৌন্দর্য-রহস্য অবলোকনে

সে বিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং আমির হোসেনের কোনো কথার উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে না জাগাতে কোনো সাড়া দেয়নি। পৃথিবী নিজ অক্ষপথে ঘোরে- রাত এগিয়ে যায় ভোরের আলোর সীমান্ত রেখার দিকে। আমির হোসেন আপন মনেই বিড়বিড় করে, তবে অস্ফুট উচ্চারণ হলেও শ্রুত হয় তার আক্ষেপের কথা- কত বছর হইল? তারপর সে বলে যে, তাও তো কম না... পাঁচ-ছয় বছর তো হবেই... এবং হেদায়েত খানকে জিজ্ঞেস করে যে, একটি প্রাইভেট কার এই ফেরি থেকে ছিটকে পড়ে এবং মুহূর্তেই রাক্ষুসী নদীর ¯্রােতে চালকসহ চারজনের একটি পরিবার কোথায় তলিয়ে গিয়েছিল সে কথা মনে পড়ে কিনা! তারপর সে আক্ষেপের দীর্ঘশ^াস বলে যে, আহা! কী কষ্টের মৃত্যু! আহা! সেই দৃশ্য কল্পনা করে আমির হোসেনের চোখে পানি এসে যায় এবং এরপরই যেন তার দেখা পদ্মার জলজীবনের ধারাপাত খুলে বসে। হেদায়েত খানও সেদিন সেই মুহূর্তেই এই ফেরিতেই ছিল, সে ঘটনা তারও বিস্মৃত হয়নি, তার চোখেও সেই কারের তলিয়ে যাওয়া ঘটনাটি ভেসে ওঠাতে আবেগকাতর হয়ে সে জানায় যে, বড়ো কষ্টের মৃত্যু, একটি পরিবারের নিঃশেষ হয়ে যাওয়া, আহা! তারপর হেদায়েত বলে যে, কয় দিন আগেও ছিল শত শত মানুষের হাঁকডাক, চিল্লাচিল্লি, কোলাহল, ফেরিওয়ালাদের ডাকাডাকি, ড্রাইভারদের চিৎকার, ভেঁপুর কানফাটা আওয়াজ, ঝালমুড়ির পটের ধপাস ধপাস শব্দ, মেছোয়াদের পদ্মার তাজা মাছের দর কষাকষি, নবজাতক থেকে নব্বই বছরের বৃদ্ধদের আনাগোনা, তরুণ-তরুণীদের সেলফি তোলার হিড়িক, শত শত ট্রাক দিনের পর দিন লাইনে আটকে থাকা আর ড্রাইভাদের করুণ আবদার, সবই এখন ইতিহাস। হয়তো বিশ বছর পর মানুষের কাছে মনে হবে রূপকথার গল্প। আর এখন সারা দিনেও বিশজন মানুষ আসে না এই পথে। এত যে মানুষের ভিড় আর হইহুল্লোড় ছিল তবু ভালো লাগত। এখন মনে হয় জলের মাছ ডাঙ্গায়। আমির হোসেনও হারানো অতীতের জন্য বিমর্ষ হয়ে পড়ে এবং হেদায়েতের মনে আছে কিনা জানতে চায় যে, একটি করুণ মৃত্যুর ঘটনা মনে আছে কিনা। তখন সে বর্ণনা করে যে, মা-বাবার একমাত্র কলেজ পড়–য়া ছেলেটা মোটরসাইকেল অ্যাকসিডেন্ট করে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ফেরিতে উঠেছিল। ফেরিটি তাড়াতাড়ি ছাড়ার জন্য মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ বাতাস ভারি করে তুলেছিল। কিন্তু হুকুমের দাসদের কী-ই-বা করার ছিল তখন? ফেরি পূর্ণ না হলে ফেরি ছাড়া যাবে না, তারপর হঠাৎ কোনো এক কর্মকর্তা ফোন করলেন তিনি না আসা পর্যন্ত যেন ফেরি না ছাড়া হয়। আর সেই মায়ের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠল। যারা সেই মায়ের কান্না শুনেছিল সবারই চোখ ভেসেছিল জলে। তার কত আহাজারি- আপনারা আমার বাপ লাগেন, আমার ছেলেটাকে বাঁচানোর জন্য ফেরিটা ছাড়েন। কিন্তু তবু ফেরি ছাড়া হয়নি কর্মকর্তাকে খুশি করার জন্য। অফিসার সাহেব এলেন এবং ফেরি ছাড়ার সময়ই সব শান্ত হয়ে গেল। মায়ের আর্তনাদ- আমার ছেলেটা আর নাই। তোমরা শুনো, আমার ছেলেটা আর নাই। আমির হোসেন আবেগাপ্লুত ও বাকরুদ্ধ হয়ে গেলে সেই ঘটনার পরের কথাগুলো আর বলতে পারে না, মাঝপথে থেমে যাওয়ার পর হেদায়েত খান হাল ধরে এবং বলে যে, তখন রক্তে ভেসে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সটি ফেরি থেকে নামিয়ে দেওয়া হলো আর সেই টগবগে তরুণের লাশ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ফিরে গেল। মায়ের করুণ কান্নার সুর এখনো বাতাসে বাজে এবং হেদায়েত খান মাঝে মাঝে শুনতে পায় বলে জানায়। তারপর শত শত মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখল একটি তরুণের শরীর থেকে তাজা রক্তের ধারা। আর শরীরটা ক্রমে-ক্রমে ফ্যাকাসে হয়ে গেল, চোখ দুটি অর্ধমিলিত সাদা, মুখটা সামান্য হাঁ করা। প্রবাসী বাবার ছেলেটির বুকের ওপর মা বারবার আছড়ে পড়ছিল আর বলছিল, আমার সব শেষ হয়ে গেল। নিজের বুকেই নিজে কীভাবে থাপড়াচ্ছিল আর তখন ফেরির শত শত মানুষের চোখ থেকে নিঃশব্দে অশ্রু ঝরেছিল। এই ঘটনাটি দুজন বর্ণনা করে শেষ করলে নবীনচন্দ্র এসে পাশে বসে নিঃশব্দে। নবীনচন্দ্রের একটি ভাতের হোটেল ছিল, এখন সেই হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে। আমির হোসেনের সঙ্গে বিনা স্বার্থেই, শুধু ভালো ব্যবহারের জন্য নবীনচন্দ্রের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল, সে মাঝে মাঝে নদীর তাজা ইলিশ মাছের ভাজা খাওয়াত জোর করে। পদ্মার দুইপারের ছোটো ছোটো ভাতঘর থেকে ইলিশভাজার গন্ধে মঁ মঁ করত। সব ভাতঘর উঠে গেছে। কে কোথায় আছে কে জানে? নবীনচন্দ্রের বাড়ি পাশেই, এজন্য দীর্ঘদিনের নদীকে ভালোবাসা, ঘাটের প্রতি মায়ার কারণেই মাঝে মাঝে এসে বসে থাকে। আর আমির হোসেনের ফেরিটি এই ঘাটে এলে বিনা কারণেই আমির হোসেনের পাশে এসে বসে। ভাতঘর নেই বলে তার কোনো আক্ষেপ নেই। পদ্মাসেতু হওয়াতে এখন নতুন ব্যবসা করার স্বপ্নে বিভোর এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের চলাফেরার সহজ হয়েছে বলে সে আনন্দিত। আমির হোসেন জিজ্ঞেস করে যে, সে নতুন কোনো কাজের সন্ধান করেছে কিনা। হেদায়েত খানেরও সঙ্গে নবীনচন্দ্রের ভাব কম নয়, গভীর বন্ধুত্ব বলা যায় এবং এজন্যই সে টিপ্পনি কেটে বলে যে, ওর কাজের অভাব নেই, এখন গোয়ালন্দের পাড়ার পাশে ভাতঘর দিবে। এ-কথা শোনার পর নবীনচন্দ্র হো হো করে হেসে বলে যে, সে তার জন্য চিন্তা করে না। তার অনেক কাজ আছে। কিন্তু হেদায়েত খানের চিন্তায় তার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। তখন আমির হোসেন ও হেদায়েত খান ঔৎসুক্য দৃষ্টিতে নবীনচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে নবীনচন্দ্র আসলে কী বলতে চায় এবং কেনই বা হেদায়েত খানের জন্য ঘুম হারাম হলো। তখন নবীনচন্দ্র বলে যে, ফেরির তেল করে বিক্রি করে কিছু উপরি কামাই-রোজগার হতো, এখন তাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তার ঘরে বউ থাকবে কিনা কে জানে? নবীনচন্দ্রের কথায় দুজনই হেসে ওঠে। আমির হোসেন আরেকটি সিগারেটা জ্বালিয়ে নবীনচন্দ্রের দিকে প্যাকেটা বাড়িয়ে দিলে নবীনচন্দ্র ও হেদায়েত খান দুজনই সিগারেট নিয়ে অগ্নিসংযোগ করে ধোঁয়া ছাড়ে। নবীনচন্দ্র তার আরেকটি উদ্বেগের কথা জানায় যে, ফেরির পকেটমারেরা এখন কী করবে। তার উদ্বেগের কথা জেনে আমির হোসেন ও হেদায়েত খান হাসিতে ফেটে পড়ে এবং আমির হোসেন অস্ফুট উচ্চারণে বলে যে, নবীনচন্দ্রের উদ্বেগের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পকেটমারদের সরকারের পুনর্বাসন করা উচিত। আবার তিনজনের কথোপকথন থেমে যায় এবং তিনজনেই নিঃশব্দে সিগারেট টানে। তারা চেয়ে থাকে পদ্মা সেতুর বাতিগুলোর দিকে। জলতরঙ্গের বুকে সেতুর বাতিগুলোর আলোককণার প্রভা যেন আরও জেল্লা ছড়ায়। দূরের কোথাও নিশাচর পাখির ডাক মাঝে মাঝে ভেসে আসে। পদ্মার পার ঘেঁষে বনের ধারে শিয়ালের দু-একটি হুক্কা-হুয়া ডাক এবং বাঘডাশার দু-একটি চিৎকার শ্রুত হয় এবং পরক্ষণেই আবার আবার অকাট্য নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে প্রান্তর। এখন আর আগের মতো ফেরি ছাড়ার কোনো তাগিদ নেই। তাগিদ থাকবে কী করে? যেখানে মানুষই নেই সেখানে কী নিয়ে ফেরি ছাড়বে? রাতজাগা প্রহরে আমির হোসেনের কণ্ঠ আরও ভারি হয়ে ওঠে এবং এক ঈদের আগে একটি লঞ্চ ডুবে দু-তিনশ’ যাত্রীর পদ্মায় সলিল সমাধি হয়েছিল সে দৃশ্যটি ওদের মনে আছে কিনা সে জানতে চায়। দুজনেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে এবং নবীনচন্দ্র বলে যে, এই দৃশ্য কি কোনো মানুষের পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। হেদায়তে খান তখন যুক্ত করে যে, তখন তাদের এই এই ফেরিটি মাঝ নদীতে ছিল এবং সেই ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখে ফেরির শত শত যাত্রী হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছিল এবং সেই কান্না যেন এখানো বাতাসে ভাসছে। আমির হোসেনের হাতের সিগারেটটি সজোরে নদীর বুকে নিক্ষেপ করে এবং কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে যে, যখন পদ্মায় বড় বড় ঢেউ ওঠে তখন সে মানুষের কান্না শুনতে পায়। এতগুলো মানুষের মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখার পর আমির হোসেন ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েছিল এবং অনেক দিন পর সে সুস্থ হয়েছিল। তখন আমির হোসেন জলতরঙ্গে মানুষের গোঙানি শুনতে পেত। হেদায়েত খান বলে যে, ঝড়ের কবলে পড়ে ওদের ফেরিটি দু-তিনবার দশ মাইল দূরে ভাটিতে চলে গিয়েছিল সেই ঘটনাটি কি কম কষ্টের ছিল? ভয়ার্ত মানুষগুলোর মুখ এখানো হেদায়েত খানের চোখে ভেসে ওঠে। রাতের শেষ প্রহরে পূর্ণিমার জোছনা দীপ্তনিষ্প্রভ আবছা হয়ে আসে, চারদিক কোলাহলমুক্ত শান্ত, ভোরের আভায় পূর্বাকাশ ক্রমে ফর্সা হতে থাকে এবং ওরা তিন জন শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে দূরে, তখন স্বপ্নের পদ্মা সেতুটি নদীর ওপরে ক্রমে-ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে এবং এক সময় ভোরের কোমল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বিপুল সম্ভানার দ্বারা উন্মুক্ত করে।

বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০১ আশ্বিন ১৪২৯ ১৭ সফর ১৪৪৪

জলজীবনের ধারাপাত

মোজাম্মেল হক নিয়োগী

image

আষাঢ়ের এক পূর্ণিমার রাতে জোছনার প্লাবনে থইথই করা পদ্মার অথৈ খরজলধারা পাড়ি দিয়ে বাংলাবাজার ঘাটে যানবাহনহীন বিশ-পঁচিশ জন যাত্রী নিয়ে বিশাল ফেরিটি তুমুল ঝাঁকুনি দিয়ে পল্টুনে সংযুক্ত হলে ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বন্ধ হয়ে অবসাদগ্রস্ত মানুষের মতো নিস্তেজ নিশ্চল হলে চারপাশের নিরেট স্তব্ধতা মন্তর প্রবাহে বাংলাবাজার ফেরিঘাটটিকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে- তখন রাত দশটা। সমস্ত আকাশ আর পদ্মার চরাচর মনে হয় একটি ভয়াল শূন্যতায় ভেসে আছে। রাত আরও গভীর হলে ফেরির ছাদের ওপর ঋজু হয়ে সুখাসনে বসে সিগারেট জ্বালিয়ে ফেরিচালক আমির হোসেন উদ্দেশ্যহীন নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে মেঘহীন স্বচ্ছ আকাশে ভাসমান ডিমের কুসুমের মতো পূর্ণিমার চাঁদের দিকে। এমন নির্মেঘ আকাশ আর বৃষ্টিহীন নিষ্ফলা বর্ষাকাল আমির হোসেন জীবনে কখনো দেখেছে কিনা মনে করতে পারেন। বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা বেশি, পদ্মার উন্মুক্ত ঘাটে ফেরির ছাদে বসে থাকলেও ভ্যাপসা গরমে অস্থিরতা অনুভব করে, জামাটি খুলে পাশে রেখে আদুল গায়ে নির্বাক পূর্ববৎ অনড় বসে থাকে আমির হোসেন। ভারতের বন্যার পানি পদ্মায় ধেয়ে আসাতে উত্তাল ¯্রােত আর অগণিত প্রবল ঢেউয়ের বুকে ধবল জোছনার প্রতিফলনের ফলে আমির হোসেনের মনে হয় কালচে নদীর ওপরে যেন শুভ্র ডানার অসংখ্য জলপরি ডুবসাঁতার খেলছে। এখন পরিশ্রমে শরীর ক্লান্ত হয় না, বরং পরিশ্রম না করার কারণে সে বিষম আলস্যে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যখন-তখন তন্দ্রাচ্ছান্নও হয়। পরিশ্রমে মানুষ ক্লান্ত হয়, আবার পরিশ্রমহীনতায়ও শরীরকে অবসাদে পরাস্ত করে। আমির হোসেন সিগারেট জ¦ালিয়ে অবসাদ দূর করার প্রয়াসে নৈঃশব্দ্যে ডুবে থাকা রহস্যময় পদ্মার নিসর্গের সঙ্গে নিজেকেও বিলীন করে দিয়ে ধীরে ধীরে সিগারেট টানে। একসময় তার দৃষ্টি গিয়ে মিশে নদীর বুকে ধবল জোছনার প্লাবনের ওপর পদ্মা সেতুর অসংখ্য বৈদ্যুতিক বাতির সোনালি আলোর বিভায়। আমির হোসেনের মনে হয় পদ্মার বুকে চোখ ধাঁধানো মায়াবী একটি আলোর নহর এবং তখন সেই মায়াবী আলোর নহরের দিকে তার দৃষ্টিতে নিবদ্ধ হয়, সেখান থেকে অন্যত্র দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। মায়াবী আলোর নহর- নাকি মায়াবী কোনো পরি সোনালি জরির শাড়ি পরে পদ্মার জলের ওপরে শায়িত হয়েছে আর জলতরঙ্গের সঙ্গে মিশে পানসি নৌকার মতো নিজেও দোল খাচ্ছে। নাকি কোনো আলোর শাম্পান পদ্মার দুকূল অবধি বিস্তৃত হয়েছে? বিভ্রমে আক্রান্ত হয় আমির হোসেন; সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সেতুর নিচে প্রতিফলিত মায়াবী আলোর নহরের দিকে। যানবাহনহীন বিশাল ফেরিটি শূন্যতায় খাঁ খাঁ করার যন্ত্রণা আর পদ্মা সেতুর নিচে প্রতিফলিত আলোর নহর দেখার আনন্দের যুগপৎ মিথস্ক্রিয়া বুকের গভীরে ক্ষণকাল আলোড়িত হয়ে পরক্ষণেই লীন হয়। দীর্ঘশ^াস বের হয় বুক চিরে। দীর্ঘশ^াস বের হতেই পারে। এই ফেরিতে বিশটি বছর কীভাবে কেটে গেল আমির হোসেন হিসেব করে মিলাতে পারে না। মানুষের জীবনের সময় এভাবেই কি মহাকালে বিলীন হয়ে যায়! বিশটি বছর পদ্মার বুকে- কত স্মৃতি, কত কথা, কত হাসিকান্না, আনন্দ-বেদনার কথা মনে হতে থাকে তার! রাতের মতোই নিঃসঙ্গ আমির হোসেন নির্জন ছাদে বসে থাকতে দেখে তারই সহকর্মী হেদায়েত খান পাশে এসে বসে। হাজার হাজার মানুষের পদচারনায়, কোলাহল, শত শত যানবাহনের ঘরাৎ ঘরাৎ শব্দে মুখরিত ফেরিঘাট এমন নির্জন হবে, এমন নিস্তব্ধ হয়ে যাবে এক বছর আগেও ওরা ভাবতে পারেনি। নির্জনতা সত্যি ভয়ঙ্কর। হেদায়েত খানেরও মনে হয় তার জীবনের শিকড় উপড়ে গেছে, চারপাশে থাকা হাজার হাজার চেনা-অচেনা মানুষেরা ওদের নিঃসঙ্গ করে সরে গেছে, কেউ নেই- শুধু ভয়াল শূন্যতা। সেও দীর্ঘশ^াস ফেলে। আমির হোসেন দৃষ্টি এখনো পদ্মা সেতুর নিচে অপরূপ সৌন্দর্যের আলোর নহরের দিকে, দৃষ্টি না ফিরিয়েই জিজ্ঞেস করে জানতে চায় যে, হেদায়েত খানের মন খারাপ কিনা। হেদায়েত কোনো উত্তর না দিয়ে ছাদের পাটাতনে শুয়ে ডিমের কুসুমের মতো চাঁদটির দিকে তাকিয়ে থাকে এবং কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর সেও জানতে যায় যে, আমির হোসেন কী ভাবছে এবং তার মন খারাপ কিনা? আমির হোসেন অস্ফুট জবাবে জানায় যে, তার মন খারাপ নয়, সে ভাবছে এই পদ্মার বুকে বিশ বছর ফেরি চালানোর কথা এবং এই ফেরির জীবনে কত ঘটনাই না মনে পড়ছে যেসব কথা বলে শেষ করা যাবে না। আমির হোসেনের কথা শুনে হেদায়েত খানের (যে দশ বছর আগে আমির হোসেনের সহকারী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে) করোটিতেও অসংখ্য স্মৃতিময় ইমেজ জিয়ল মাছের মতো নড়েচড়ে ওঠে। সে তীব্র দৃষ্টিতে আমির হোসেনের মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে আর কিছু বলে কিনা শোনার জন্য। তারপর তার দৃষ্টি চলে যায় পদ্মা সেতুর বাতিগুলোর দিকে। অসংখ্য বাতির আলোর বিকিরণে সেতুর নিচের অপ্রতিরোধ্য পদ্মার ঢেউয়ে প্রতিফলিত হয়ে এক রহস্যময় মায়াবী মন্দ্রজাল সৃষ্টি করেছে, অবারিত জলধারায় থইথই করা রুপালি জোছনা, ফেরিঘাটের ভয়াল নৈঃশব্দ্য, হঠাৎ হঠাৎ শুশুকের ভেসে ওঠা, কিনারে বাঁধা জেলেদের ছোটো ছোটো নৌকা সব মিলিয়ে হেদায়েত খানও ভাবালুতায় ডুবে যায়। তার মনের গভীরেও একই প্রশ্নের কানামাছি খেলা শুরু করে, কোথায় হারিয়ে গেল ফেরিঘাটের কোলাহল, চিৎকার চেঁচামেচি, কান্না, মারামারি, হাতাহাতি, আনন্দ হিল্লোল- কোথায় হারিয়ে গেল? নিজের প্রশ্নের জালে নিজেই আটকা পড়ে আর নিজেই উত্তর খোঁজে? মনে পড়ে বাপের কথা, আপথ পথ হইবো, আঘাট ঘাট হইবো। বাপজান বোঝাতে চাইতে দিন বদলে যাবে আর সেই দিন বদলের কত খেলাই দেখে যাচ্ছে হেদায়েত খান! আমির হোসেন হেদায়েত খানের উদ্দেশ্যে বলে যে, এই ফেরিতে কত মানুষের কান্না চাপা পড়ে আছে, আর চোখের পানি শুকিয়ে আছে সেসব কথা ওর মনে পড়ে কিনা? মানুষের স্মৃতি বিভ্রম না হলে এত অল্প সময়ের কথা কেন মনে থাকবে না, আমির হোসেনের মনে কেন সংশয় দেখা দিয়েছে এই কথা বোঝাতে হেদায়েত খান ঈষৎ মাথা নাড়ে বটে তবে জোছনার আলোয় মাথা নাড়ানোর দৃশ্যটি চোখে না পড়াতে কিংবা কোনো কথা না বলাতে নির্ভার দৃষ্টি মেলে পদ্মা সেতুর দিকে তাকিয়ে থেকেই আমির হোসেন বলে যে, তার খুব মনে পড়ে কয়েকটি ঘটনা। এই পদ্মাকে তখন মনে হয়েছিল রাক্ষুসি। হেদায়েত খান আমির হোসেনের দিকে ক্ষণকাল তাকিয়েও আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে সেতুর আলোর দিকে তাকিয়ে নিগূঢ় সৌন্দর্য-রহস্য অবলোকনে

সে বিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং আমির হোসেনের কোনো কথার উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে না জাগাতে কোনো সাড়া দেয়নি। পৃথিবী নিজ অক্ষপথে ঘোরে- রাত এগিয়ে যায় ভোরের আলোর সীমান্ত রেখার দিকে। আমির হোসেন আপন মনেই বিড়বিড় করে, তবে অস্ফুট উচ্চারণ হলেও শ্রুত হয় তার আক্ষেপের কথা- কত বছর হইল? তারপর সে বলে যে, তাও তো কম না... পাঁচ-ছয় বছর তো হবেই... এবং হেদায়েত খানকে জিজ্ঞেস করে যে, একটি প্রাইভেট কার এই ফেরি থেকে ছিটকে পড়ে এবং মুহূর্তেই রাক্ষুসী নদীর ¯্রােতে চালকসহ চারজনের একটি পরিবার কোথায় তলিয়ে গিয়েছিল সে কথা মনে পড়ে কিনা! তারপর সে আক্ষেপের দীর্ঘশ^াস বলে যে, আহা! কী কষ্টের মৃত্যু! আহা! সেই দৃশ্য কল্পনা করে আমির হোসেনের চোখে পানি এসে যায় এবং এরপরই যেন তার দেখা পদ্মার জলজীবনের ধারাপাত খুলে বসে। হেদায়েত খানও সেদিন সেই মুহূর্তেই এই ফেরিতেই ছিল, সে ঘটনা তারও বিস্মৃত হয়নি, তার চোখেও সেই কারের তলিয়ে যাওয়া ঘটনাটি ভেসে ওঠাতে আবেগকাতর হয়ে সে জানায় যে, বড়ো কষ্টের মৃত্যু, একটি পরিবারের নিঃশেষ হয়ে যাওয়া, আহা! তারপর হেদায়েত বলে যে, কয় দিন আগেও ছিল শত শত মানুষের হাঁকডাক, চিল্লাচিল্লি, কোলাহল, ফেরিওয়ালাদের ডাকাডাকি, ড্রাইভারদের চিৎকার, ভেঁপুর কানফাটা আওয়াজ, ঝালমুড়ির পটের ধপাস ধপাস শব্দ, মেছোয়াদের পদ্মার তাজা মাছের দর কষাকষি, নবজাতক থেকে নব্বই বছরের বৃদ্ধদের আনাগোনা, তরুণ-তরুণীদের সেলফি তোলার হিড়িক, শত শত ট্রাক দিনের পর দিন লাইনে আটকে থাকা আর ড্রাইভাদের করুণ আবদার, সবই এখন ইতিহাস। হয়তো বিশ বছর পর মানুষের কাছে মনে হবে রূপকথার গল্প। আর এখন সারা দিনেও বিশজন মানুষ আসে না এই পথে। এত যে মানুষের ভিড় আর হইহুল্লোড় ছিল তবু ভালো লাগত। এখন মনে হয় জলের মাছ ডাঙ্গায়। আমির হোসেনও হারানো অতীতের জন্য বিমর্ষ হয়ে পড়ে এবং হেদায়েতের মনে আছে কিনা জানতে চায় যে, একটি করুণ মৃত্যুর ঘটনা মনে আছে কিনা। তখন সে বর্ণনা করে যে, মা-বাবার একমাত্র কলেজ পড়–য়া ছেলেটা মোটরসাইকেল অ্যাকসিডেন্ট করে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ফেরিতে উঠেছিল। ফেরিটি তাড়াতাড়ি ছাড়ার জন্য মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ বাতাস ভারি করে তুলেছিল। কিন্তু হুকুমের দাসদের কী-ই-বা করার ছিল তখন? ফেরি পূর্ণ না হলে ফেরি ছাড়া যাবে না, তারপর হঠাৎ কোনো এক কর্মকর্তা ফোন করলেন তিনি না আসা পর্যন্ত যেন ফেরি না ছাড়া হয়। আর সেই মায়ের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠল। যারা সেই মায়ের কান্না শুনেছিল সবারই চোখ ভেসেছিল জলে। তার কত আহাজারি- আপনারা আমার বাপ লাগেন, আমার ছেলেটাকে বাঁচানোর জন্য ফেরিটা ছাড়েন। কিন্তু তবু ফেরি ছাড়া হয়নি কর্মকর্তাকে খুশি করার জন্য। অফিসার সাহেব এলেন এবং ফেরি ছাড়ার সময়ই সব শান্ত হয়ে গেল। মায়ের আর্তনাদ- আমার ছেলেটা আর নাই। তোমরা শুনো, আমার ছেলেটা আর নাই। আমির হোসেন আবেগাপ্লুত ও বাকরুদ্ধ হয়ে গেলে সেই ঘটনার পরের কথাগুলো আর বলতে পারে না, মাঝপথে থেমে যাওয়ার পর হেদায়েত খান হাল ধরে এবং বলে যে, তখন রক্তে ভেসে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সটি ফেরি থেকে নামিয়ে দেওয়া হলো আর সেই টগবগে তরুণের লাশ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ফিরে গেল। মায়ের করুণ কান্নার সুর এখনো বাতাসে বাজে এবং হেদায়েত খান মাঝে মাঝে শুনতে পায় বলে জানায়। তারপর শত শত মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখল একটি তরুণের শরীর থেকে তাজা রক্তের ধারা। আর শরীরটা ক্রমে-ক্রমে ফ্যাকাসে হয়ে গেল, চোখ দুটি অর্ধমিলিত সাদা, মুখটা সামান্য হাঁ করা। প্রবাসী বাবার ছেলেটির বুকের ওপর মা বারবার আছড়ে পড়ছিল আর বলছিল, আমার সব শেষ হয়ে গেল। নিজের বুকেই নিজে কীভাবে থাপড়াচ্ছিল আর তখন ফেরির শত শত মানুষের চোখ থেকে নিঃশব্দে অশ্রু ঝরেছিল। এই ঘটনাটি দুজন বর্ণনা করে শেষ করলে নবীনচন্দ্র এসে পাশে বসে নিঃশব্দে। নবীনচন্দ্রের একটি ভাতের হোটেল ছিল, এখন সেই হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে। আমির হোসেনের সঙ্গে বিনা স্বার্থেই, শুধু ভালো ব্যবহারের জন্য নবীনচন্দ্রের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল, সে মাঝে মাঝে নদীর তাজা ইলিশ মাছের ভাজা খাওয়াত জোর করে। পদ্মার দুইপারের ছোটো ছোটো ভাতঘর থেকে ইলিশভাজার গন্ধে মঁ মঁ করত। সব ভাতঘর উঠে গেছে। কে কোথায় আছে কে জানে? নবীনচন্দ্রের বাড়ি পাশেই, এজন্য দীর্ঘদিনের নদীকে ভালোবাসা, ঘাটের প্রতি মায়ার কারণেই মাঝে মাঝে এসে বসে থাকে। আর আমির হোসেনের ফেরিটি এই ঘাটে এলে বিনা কারণেই আমির হোসেনের পাশে এসে বসে। ভাতঘর নেই বলে তার কোনো আক্ষেপ নেই। পদ্মাসেতু হওয়াতে এখন নতুন ব্যবসা করার স্বপ্নে বিভোর এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের চলাফেরার সহজ হয়েছে বলে সে আনন্দিত। আমির হোসেন জিজ্ঞেস করে যে, সে নতুন কোনো কাজের সন্ধান করেছে কিনা। হেদায়েত খানেরও সঙ্গে নবীনচন্দ্রের ভাব কম নয়, গভীর বন্ধুত্ব বলা যায় এবং এজন্যই সে টিপ্পনি কেটে বলে যে, ওর কাজের অভাব নেই, এখন গোয়ালন্দের পাড়ার পাশে ভাতঘর দিবে। এ-কথা শোনার পর নবীনচন্দ্র হো হো করে হেসে বলে যে, সে তার জন্য চিন্তা করে না। তার অনেক কাজ আছে। কিন্তু হেদায়েত খানের চিন্তায় তার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। তখন আমির হোসেন ও হেদায়েত খান ঔৎসুক্য দৃষ্টিতে নবীনচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে নবীনচন্দ্র আসলে কী বলতে চায় এবং কেনই বা হেদায়েত খানের জন্য ঘুম হারাম হলো। তখন নবীনচন্দ্র বলে যে, ফেরির তেল করে বিক্রি করে কিছু উপরি কামাই-রোজগার হতো, এখন তাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তার ঘরে বউ থাকবে কিনা কে জানে? নবীনচন্দ্রের কথায় দুজনই হেসে ওঠে। আমির হোসেন আরেকটি সিগারেটা জ্বালিয়ে নবীনচন্দ্রের দিকে প্যাকেটা বাড়িয়ে দিলে নবীনচন্দ্র ও হেদায়েত খান দুজনই সিগারেট নিয়ে অগ্নিসংযোগ করে ধোঁয়া ছাড়ে। নবীনচন্দ্র তার আরেকটি উদ্বেগের কথা জানায় যে, ফেরির পকেটমারেরা এখন কী করবে। তার উদ্বেগের কথা জেনে আমির হোসেন ও হেদায়েত খান হাসিতে ফেটে পড়ে এবং আমির হোসেন অস্ফুট উচ্চারণে বলে যে, নবীনচন্দ্রের উদ্বেগের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পকেটমারদের সরকারের পুনর্বাসন করা উচিত। আবার তিনজনের কথোপকথন থেমে যায় এবং তিনজনেই নিঃশব্দে সিগারেট টানে। তারা চেয়ে থাকে পদ্মা সেতুর বাতিগুলোর দিকে। জলতরঙ্গের বুকে সেতুর বাতিগুলোর আলোককণার প্রভা যেন আরও জেল্লা ছড়ায়। দূরের কোথাও নিশাচর পাখির ডাক মাঝে মাঝে ভেসে আসে। পদ্মার পার ঘেঁষে বনের ধারে শিয়ালের দু-একটি হুক্কা-হুয়া ডাক এবং বাঘডাশার দু-একটি চিৎকার শ্রুত হয় এবং পরক্ষণেই আবার আবার অকাট্য নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে প্রান্তর। এখন আর আগের মতো ফেরি ছাড়ার কোনো তাগিদ নেই। তাগিদ থাকবে কী করে? যেখানে মানুষই নেই সেখানে কী নিয়ে ফেরি ছাড়বে? রাতজাগা প্রহরে আমির হোসেনের কণ্ঠ আরও ভারি হয়ে ওঠে এবং এক ঈদের আগে একটি লঞ্চ ডুবে দু-তিনশ’ যাত্রীর পদ্মায় সলিল সমাধি হয়েছিল সে দৃশ্যটি ওদের মনে আছে কিনা সে জানতে চায়। দুজনেই সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে এবং নবীনচন্দ্র বলে যে, এই দৃশ্য কি কোনো মানুষের পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়। হেদায়তে খান তখন যুক্ত করে যে, তখন তাদের এই এই ফেরিটি মাঝ নদীতে ছিল এবং সেই ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখে ফেরির শত শত যাত্রী হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছিল এবং সেই কান্না যেন এখানো বাতাসে ভাসছে। আমির হোসেনের হাতের সিগারেটটি সজোরে নদীর বুকে নিক্ষেপ করে এবং কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলে যে, যখন পদ্মায় বড় বড় ঢেউ ওঠে তখন সে মানুষের কান্না শুনতে পায়। এতগুলো মানুষের মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুর ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখার পর আমির হোসেন ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েছিল এবং অনেক দিন পর সে সুস্থ হয়েছিল। তখন আমির হোসেন জলতরঙ্গে মানুষের গোঙানি শুনতে পেত। হেদায়েত খান বলে যে, ঝড়ের কবলে পড়ে ওদের ফেরিটি দু-তিনবার দশ মাইল দূরে ভাটিতে চলে গিয়েছিল সেই ঘটনাটি কি কম কষ্টের ছিল? ভয়ার্ত মানুষগুলোর মুখ এখানো হেদায়েত খানের চোখে ভেসে ওঠে। রাতের শেষ প্রহরে পূর্ণিমার জোছনা দীপ্তনিষ্প্রভ আবছা হয়ে আসে, চারদিক কোলাহলমুক্ত শান্ত, ভোরের আভায় পূর্বাকাশ ক্রমে ফর্সা হতে থাকে এবং ওরা তিন জন শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে দূরে, তখন স্বপ্নের পদ্মা সেতুটি নদীর ওপরে ক্রমে-ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে এবং এক সময় ভোরের কোমল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বিপুল সম্ভানার দ্বারা উন্মুক্ত করে।