গ্রামীণ কর্মক্ষম তরুণরা ‘ঢালাওভাবে শহরে চলে যাচ্ছে’

বিআইডিএস-এর সেমিনারে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. স্বপন আদনান

বাংলাদেশের গ্রাম থেকে কর্মক্ষম তরুণরা ঢালাওভাবে শহরে চলে আসছে। এ কারণে গ্রামে বয়বৃদ্ধ, শিশু ও অকর্মশীল মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এর ফলে সৃষ্ট অভিঘাতে গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে কি প্রভাব বিস্তার করে তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড.স্বপন আদনান।

‘গ্রামে কৃষি, পোল্ট্রি খামার, মৎস্য উৎপাদন, দুগ্ধ ও পশুপালন এসব ক্ষেত্রে যে নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হয়েছে তারাও শহরে বাস করে,’ বলেন তিনি।

গতকাল রাজধানীর আগারগাঁয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান(বিআইডিএস) মিলনায়তনে আয়োজিত ‘কৃষি উত্তরণ নাকি গ্রামীণ রূপান্তর: বাংলাদেশে গ্রাম পরিবর্তনের কারণ ও প্রবণতা’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।

নতুন নতুন প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কল্যাণে যেমন- মোবাইল, ইন্টারনেট, ডিস, বিভিন্ন ধরনের শহুরে খাবার এসব কিছু গ্রামকে এই নতুন শতাব্দীকে বেশি প্রভাবিত করেছে। যার কারণে যুব সমাজের শহরে বসবাসের আকর্ষণ বেড়ে গেছে।

ড. স্বপণের গবেষণায় এটা উঠে এসেছে যে: গ্রামে শিল্পায়ন খুব কম হলেও শহরে শিল্পায়ন হচ্ছে। বিগত ৭৫ বছরে গ্রামীণ অর্থনীতি, রাজনীতির বিবর্তন দেখাতে গিয়ে তিনি ৪টি ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমত; সামাজিক, সংখ্যামিতিক, সাংস্কৃতিক, দ্বিতীয়ত; কৃষি ও অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তন, তৃতীয়ত; দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়গত পরিবর্তন, চতুর্থত; ভূমির জবরদখলের রাজনৈতিক অর্থনীতি।

নোয়াখালীর চরাঞ্চলে ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমি অধিকার আন্দোলন, বিল ডাকাতিয়ায় জলাবদ্ধতার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে গ্রামীণ মানুষের অভ্যন্তরীণ শক্তির স্ফুরণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে তিনি মনে করেন।

স্বপন আদনান বলেন, ‘১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ (১৩৪০ এর মন্বন্তর) নেমে আসে সেটার এক ব্যাপক প্রভাব এদেশের ধনী-গরিব সবার উপর ব্যাপকভাবে পড়ে। এরপরে ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাবার পরে ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির মাধ্যমে ব্যাপক আকারে হিন্দু জমিদার ও অবস্থাপন্ন হিন্দুরা ভারতে অভিবাসন করেন।অপরদিকে, পশ্চিম বাংলা, বিহার, আসাম ও ভারতের অন্য রাজ্য থেকে মুসলিমরা ব্যাপকভাবে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় চলে আসেন।’

‘এই ধরনের সামাজিক, সংখ্যামিতিক উত্থান-পতন গ্রামীণ সমাজ জীবনে ব্যাপক রদবদল ঘটায়। এইসব ঘটনাপ্রবাহের কারণে পরবর্তী কয়েক দশকে গ্রামীণ সামাজিক ভিত্তি কাঠামোর পরিবর্তন তার দিকনির্ধারণ করে দেয়।’তিনি দেখান; গ্রামীণ সমাজে সালিশি বিচারের যে পদ্ধতি ছিল তাই ছিল বিচার পাওয়ার মূল ভিত্তি।এই ভিত্তি আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকে। সেই সালিশি বিচার ব্যবস্থা আস্তে আস্তে শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যায়। (যেমন : থানার ওসি বা কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি সালিশ করতে থাকে)। এই পুরো পদ্ধতিটা ধীরগতিতে কিন্তু ক্রমাগতভাবে গ্রামীণ সমাজে বৈধতার সংকট তৈরি করছে। কারণ লোকজ যে বিচারিক প্রতিষ্ঠান গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে তার জায়গায় যে বিকল্প বিচার ব্যবস্থা সেটি অতিমাত্রায় দুর্নীতিগ্রস্ত, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে দুষ্ট এবং পক্ষপাত সুলভ।

কৃষি ক্ষেত্রে সবুজ বিল্পব, নতুন বীজ, সার ও সেচ ব্যবস্থার ফলে উৎপাদন বাড়ছে। সেই সঙ্গে কৃষি শ্রমিকের মজুরি বাড়ছে। তবে, বড় কোম্পানিগুলোকে জমি দেয়ার পাশাপাশি কৃষি ও পাহাড়ী অঞ্চলের ভূমির জবরদখল চলছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশে দুর্নীতিপরায়ণ ও নিষ্ক্রিয় নেতৃত্ব থাকার পরও দেশের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে সেটা অন্য কারণে হতে পারে। সেই বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।’

পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য ড. সাত্তার ম-ল বলেন, ‘গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষি যন্ত্রায়ণ বড় ভূমিকা রাখছে। কৃষি যন্ত্রায়ণের কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অকৃষীয় কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।’

বিআইডিএস এর প্রফেসারিয়াল ফেলো ড. এম আসাদউজ্জামান বলেন, ‘৯০-এর দশকে নন ফার্ম কাজের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের আয় সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত আয়ের প্রায় কাছাকাছি ছিল। সেক্ষেত্রে যারা নন ফার্ম আয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের জমির পরিমাণ কম ছিল। কিন্ত এখন দেখা যাচ্ছে যাদের হাতে জমি বেশি তাদেরই হাতে কৃষি যন্ত্রপাতির মালিকানা বেশি। এতে দেখা গেছে; গ্রামে ব্যাপক অর্থনৈতিক অসমতা বিরাজ করছে।’

বিআইডিএস এর মহাপরিচালক (ডিজি) বিনায়ক সেন মনে করেন, এক্ষেত্রে পুঁজির দুই ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ‘আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির ধারাটা ইউরোপীয় মডেলে হচ্ছে না বরং সেটা প্রাচীন সামন্তবাদী পদ্ধতিতে হচ্ছে। অপরদিকে, খুব কম জমিতে অনেক বেশি ফসল ফলাতে হচ্ছে। অর্থাৎ যন্ত্রায়ণের ব্যাপক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে,’ বলেন তিনি।

বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০১ আশ্বিন ১৪২৯ ১৭ সফর ১৪৪৪

গ্রামীণ কর্মক্ষম তরুণরা ‘ঢালাওভাবে শহরে চলে যাচ্ছে’

বিআইডিএস-এর সেমিনারে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. স্বপন আদনান

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

বাংলাদেশের গ্রাম থেকে কর্মক্ষম তরুণরা ঢালাওভাবে শহরে চলে আসছে। এ কারণে গ্রামে বয়বৃদ্ধ, শিশু ও অকর্মশীল মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এর ফলে সৃষ্ট অভিঘাতে গ্রামীণ অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে কি প্রভাব বিস্তার করে তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড.স্বপন আদনান।

‘গ্রামে কৃষি, পোল্ট্রি খামার, মৎস্য উৎপাদন, দুগ্ধ ও পশুপালন এসব ক্ষেত্রে যে নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হয়েছে তারাও শহরে বাস করে,’ বলেন তিনি।

গতকাল রাজধানীর আগারগাঁয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান(বিআইডিএস) মিলনায়তনে আয়োজিত ‘কৃষি উত্তরণ নাকি গ্রামীণ রূপান্তর: বাংলাদেশে গ্রাম পরিবর্তনের কারণ ও প্রবণতা’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।

নতুন নতুন প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কল্যাণে যেমন- মোবাইল, ইন্টারনেট, ডিস, বিভিন্ন ধরনের শহুরে খাবার এসব কিছু গ্রামকে এই নতুন শতাব্দীকে বেশি প্রভাবিত করেছে। যার কারণে যুব সমাজের শহরে বসবাসের আকর্ষণ বেড়ে গেছে।

ড. স্বপণের গবেষণায় এটা উঠে এসেছে যে: গ্রামে শিল্পায়ন খুব কম হলেও শহরে শিল্পায়ন হচ্ছে। বিগত ৭৫ বছরে গ্রামীণ অর্থনীতি, রাজনীতির বিবর্তন দেখাতে গিয়ে তিনি ৪টি ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমত; সামাজিক, সংখ্যামিতিক, সাংস্কৃতিক, দ্বিতীয়ত; কৃষি ও অর্থনীতির ব্যাপক পরিবর্তন, তৃতীয়ত; দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়গত পরিবর্তন, চতুর্থত; ভূমির জবরদখলের রাজনৈতিক অর্থনীতি।

নোয়াখালীর চরাঞ্চলে ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমি অধিকার আন্দোলন, বিল ডাকাতিয়ায় জলাবদ্ধতার বিরুদ্ধে আন্দোলনকে গ্রামীণ মানুষের অভ্যন্তরীণ শক্তির স্ফুরণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে তিনি মনে করেন।

স্বপন আদনান বলেন, ‘১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ (১৩৪০ এর মন্বন্তর) নেমে আসে সেটার এক ব্যাপক প্রভাব এদেশের ধনী-গরিব সবার উপর ব্যাপকভাবে পড়ে। এরপরে ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাবার পরে ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির মাধ্যমে ব্যাপক আকারে হিন্দু জমিদার ও অবস্থাপন্ন হিন্দুরা ভারতে অভিবাসন করেন।অপরদিকে, পশ্চিম বাংলা, বিহার, আসাম ও ভারতের অন্য রাজ্য থেকে মুসলিমরা ব্যাপকভাবে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় চলে আসেন।’

‘এই ধরনের সামাজিক, সংখ্যামিতিক উত্থান-পতন গ্রামীণ সমাজ জীবনে ব্যাপক রদবদল ঘটায়। এইসব ঘটনাপ্রবাহের কারণে পরবর্তী কয়েক দশকে গ্রামীণ সামাজিক ভিত্তি কাঠামোর পরিবর্তন তার দিকনির্ধারণ করে দেয়।’তিনি দেখান; গ্রামীণ সমাজে সালিশি বিচারের যে পদ্ধতি ছিল তাই ছিল বিচার পাওয়ার মূল ভিত্তি।এই ভিত্তি আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকে। সেই সালিশি বিচার ব্যবস্থা আস্তে আস্তে শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যায়। (যেমন : থানার ওসি বা কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি সালিশ করতে থাকে)। এই পুরো পদ্ধতিটা ধীরগতিতে কিন্তু ক্রমাগতভাবে গ্রামীণ সমাজে বৈধতার সংকট তৈরি করছে। কারণ লোকজ যে বিচারিক প্রতিষ্ঠান গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে তার জায়গায় যে বিকল্প বিচার ব্যবস্থা সেটি অতিমাত্রায় দুর্নীতিগ্রস্ত, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে দুষ্ট এবং পক্ষপাত সুলভ।

কৃষি ক্ষেত্রে সবুজ বিল্পব, নতুন বীজ, সার ও সেচ ব্যবস্থার ফলে উৎপাদন বাড়ছে। সেই সঙ্গে কৃষি শ্রমিকের মজুরি বাড়ছে। তবে, বড় কোম্পানিগুলোকে জমি দেয়ার পাশাপাশি কৃষি ও পাহাড়ী অঞ্চলের ভূমির জবরদখল চলছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশে দুর্নীতিপরায়ণ ও নিষ্ক্রিয় নেতৃত্ব থাকার পরও দেশের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে সেটা অন্য কারণে হতে পারে। সেই বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।’

পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য ড. সাত্তার ম-ল বলেন, ‘গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষি যন্ত্রায়ণ বড় ভূমিকা রাখছে। কৃষি যন্ত্রায়ণের কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অকৃষীয় কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।’

বিআইডিএস এর প্রফেসারিয়াল ফেলো ড. এম আসাদউজ্জামান বলেন, ‘৯০-এর দশকে নন ফার্ম কাজের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের আয় সরাসরি কৃষির সঙ্গে যুক্ত আয়ের প্রায় কাছাকাছি ছিল। সেক্ষেত্রে যারা নন ফার্ম আয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের জমির পরিমাণ কম ছিল। কিন্ত এখন দেখা যাচ্ছে যাদের হাতে জমি বেশি তাদেরই হাতে কৃষি যন্ত্রপাতির মালিকানা বেশি। এতে দেখা গেছে; গ্রামে ব্যাপক অর্থনৈতিক অসমতা বিরাজ করছে।’

বিআইডিএস এর মহাপরিচালক (ডিজি) বিনায়ক সেন মনে করেন, এক্ষেত্রে পুঁজির দুই ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ‘আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির ধারাটা ইউরোপীয় মডেলে হচ্ছে না বরং সেটা প্রাচীন সামন্তবাদী পদ্ধতিতে হচ্ছে। অপরদিকে, খুব কম জমিতে অনেক বেশি ফসল ফলাতে হচ্ছে। অর্থাৎ যন্ত্রায়ণের ব্যাপক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে,’ বলেন তিনি।