জাতীয় পার্টিতে ভাঙনের সুর

জাতীয় পার্টির আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা না থাকা নিয়ে বিরোধ চরমে উঠেছে। সেখানে নেতৃত্ব নিয়েও বিরোধ দেখা দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় মশিউর রহমান রাঙ্গাকে দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে দলটির বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। মূলত রওশন এরশাদকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে বিরোধী দলের নেতা করার বিষয় নিয়েই এ রিরোধ।

গত বুধাবার জাতীয় পার্টির সভাপতিমন্ডলীসহ সব পদ থেকে অব্যাহতি দেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের। এ নিয়ে গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘রওশন এরশাদকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা করার বিষয়ে যে চিঠি দেয়া হয়েছে, তার প্রক্রিয়া ‘সঠিক ছিল না’। এটা আমি একটা টেলিভিশনকে বলেছিলাম, এজন্য আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে মনে করছি।’

চিঠি দেয়ার প্রক্রিয়া সঠিক না থাকলে সেটি নিয়ে এতদিন পরে কেন কথা বলছেন, সেই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে রাঙ্গা বলেন, ‘রওশন এরশাদকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে বিরোধী দলীয় নেতা করার চিঠি দেয়ার পর তিনি (রওশন) আমাকে বলছেন, তুমি তো আমার সব সর্বনাশ করছ। তুমি তো সব চিঠিতে সই করেছ।

‘তখন আমি উনাকে বলেছি, এটার সঙ্গে আমি নেই। প্রক্রিয়া যে সঠিক ছিল না, এটা আমি কোন গণমাধ্যমে বলে দেব। এরপর আমি এ নিয়ে কথা বলেছি।’ রওশনকে বাদ দিতে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠকের পর স্পিকারকে পাঠানো চিঠিতে ‘হুমকির মুখে’ সই করেছিলেন বলে দাবি রাঙ্গার।

‘তখন স্বাক্ষর না করলে আমাকে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ থেকে সরিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল’ বলেন রাঙ্গা।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু দাবি করেন, ‘গত কয়েকদিন আগেও সে বিরোধী দলের নেতা নিয়ে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছে। অথচ আমরা মিটিং করে ২৬ জন এমপির মধ্যে ২৪ জন মিলে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিরোধী দলীয় নেতা পরিবর্তনের জন। এজন্য চিঠিও দিয়েছি। তিনিই স্বাক্ষরিত চিঠি দিয়েছেন। এখন তিনি উল্টাপাল্টা কথা বলেন।’ মহাসচিব সংবাদকে বলেন, ‘এখন আজকে যদি জিএম কাদের এটা বলেন (দল থেকে অব্যাহতি) ঠিক আছে, এই....। ওনার এসব কনফিউজিং কথাবার্তার মাধ্যমে বিভ্রান্তি হয়। সেজন্য চেয়ারম্যান তার পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।’

রাঙ্গা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দল যদি ‘গণতান্ত্রিকভাবে’ না চলে তো সেই দলে তিনিও থাকতে চান না। তিনি বলেছেন, ‘আমি আমার অব্যাহতির আদেশে আনহ্যাপি নই। তবে আমি আমার বহিষ্কার (অব্যাহতি) আদেশ প্রত্যাহার চাই। চেয়ারম্যানের সঙ্গে যুদ্ধ করে দলে থাকা যায় না।’

দলের মধ্যে কোন সমস্যা হয়েছে কি না জানতে চাইলে মহাসচিব চুন্নু বলেন, ‘হঠাৎ করে নয়, গত এক বছর যাবৎ পার্লামেন্টের ভেতরে এবং বাইরে তার কিছু কিছু বক্তব্য তার কথাবর্তা এগুলো দলের নীতির বাইরে। তাকে আগেও সতর্ক করা হয়েছে, তখন তিনি বলেছেন ‘এগুলো আর বলবেন না’।

অব্যাহতি পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাঙ্গা যে হুমকি দিয়েছিলেন সংবাদ সম্মেলনে সেই সুর পাল্টে তিনি বলেছেন, ‘অব্যাহতির আদেশ পাওয়ার পর আমি একটু রাগান্বিত ছিলাম, এটা অস্বীকার করব না। আমি চেয়ারম্যানকে যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম, সেটা তুলে নিয়েছি। রংপুরেও আর কোন ঝামেলা হবে না। সেটা গতকাল রাতেই বলে দিয়েছি।’

তবে সংবাদ সম্মেলন তিনি নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতেই আয়োজন করেছেন জানিয়ে রাঙ্গা বলেন, ‘অন্যায় করেননি’। তবে জাতীয় পার্টি যদি গণতান্ত্রিকভাবে না চলে আমি দলে থাকব না, এ দল করব না এবং অন্য কোন দলও করব না বলে সাফ জানিয়ে দেন। গঠনতন্ত্রের যে ধারার ক্ষমতাবলে দলীয় প্রধান তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন সেই ধারা ‘অগণতান্ত্রিক’ বলেও মন্তব্য করেন রাঙ্গা। দলের কাউন্সিলে ওই ধারা বাদ দেয়ার কথা উঠেছিল জানিয়ে তিনি দাবি করেন, ‘কিছু লোকের কারণে’ সেটা করা হয়নি।

রাঙ্গা বলেন, ‘আমি আজ এখানে পার্টির কোন লোক নিয়ে আসিনি। পরিবহন সেক্টরের কিছু লোক এসেছে। আগামীতে শুধু দুটি রাজনৈতিক দল থাকবে। কোন দুটি থাকবে, সেটা আমি বলব না। তবে সেখানে আমরা (জাতীয় পার্টি) থাকব না।’ জিএম কাদেরকে কিছু লোক ‘ভুল বুঝিয়ে’ তার অব্যাহতির আদেশ দিতে ‘বাধ্য করেছে’ মন্তব্য করে রাঙ্গা বলেন, ‘চেয়ারম্যানের সঙ্গে কিছু লোক আঠার মতো লেগে থাকে সারাক্ষণ। তারা উনাকে অনেক ভুল পরামর্শ দেন।’

রাঙ্গা বলেন, ‘জাতীয় পার্টি গণতান্ত্রিক দল না। তবে এটা স্বৈরতান্ত্রিক দল, এটা আমি বলব না।’

মহাসচিব চুন্নু বলেন, ‘আমাদের দলে কোন সমস্যা নেই। একজন সংগঠনবিরোধী কাজ করছিল তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সে আবার আজকে অব্যাহতি প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করছে।’

বেশ কিছুদিন ধরে জিএম কাদের সরকারবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। জাতীয় পার্টির মধ্যে আগামী নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন ধরনের মেরুকরণ হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের বাইরে কেউ কেউ জিএম কাদেরকে প্রভাবিত করছে বলে তার দলের মধ্যেই আলোচনা আছে। ওই মহলটি জোর চেষ্টা চালাচ্ছে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী বলয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বাইরে প্রভাবশালী কেউ কেউ জিএম কাদেরকে প্রভাবিত করছেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসার।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব দাবি করেন, বিএনপির বিষয়ে যদি কোন কথা আসে তবে আমি দলের মহাসচিব আমি এটা জানি না। বিএনপির সঙ্গে কোন আলোচনার হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে চুন্নু বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না। তাদের সময় এরশাদ সাহেব জেলে ছিল তার জন্ডিস ছিল মেডিকেল বোর্ডে বলল পিজি হাসপাতালে এনে চিকিৎসা করানোর জন্য, ওই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পারমিশন দিল না আমরা কি এসব ভুলে গেছি নাকি।’

দলের সভাপতিমন্ডলীসহ সব পদ থেকে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে অব্যাহতি দিয়েছে জাতীয় পার্টি। সেই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের দলের গঠনতন্ত্রের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদবী থেকে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে অব্যাহতি প্রদান করেছেন। ইতোমধ্যে এই আদেশ কার্যকর করা হয়েছে।’ বহিষ্কারের প্রতিক্রিয়ায় রাঙ্গা বলেন, ‘উনি (কাদের) দুষ্টু লোকের পরামর্শে করেছেন। আমরা কারও দয়ায় জাতীয় পার্টি করি না। তৃণমূল থেকে জাতীয় পার্টি করেছি। উনার সঙ্গে রংপুরে দেখা হবে।’

পরিবহন মালিক সমিতির নেতা রাঙ্গা বর্তমানে রংপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য। তিনি ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ জীবিত থাকাকালে ২০১৮ সালে রাঙ্গাকে দলের মহাসচিব করেছিলেন। এরপর ২০১৯ সালে তাকে সংসদে বিরোধী দলের প্রধান হুইপ করা হয়।

রংপুর থেকে লিয়াকত আলী বাদল জানিয়েছেন, জাতীয় পার্টি থেকে দলের সাবেক মহাসচিব ও বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাকে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার ঘটনা নিয়ে গত বুধবার গভীর রাত পর্যন্ত দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও রাঙ্গা সমর্থকদের ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া, সংঘর্ষ এবং পাল্টাপাল্টি দুই নেতার কুশপুত্তলিকা দাহ করার ঘটনা নিয়ে গতকাল পর্যন্ত উত্তেজনা বিরাজ করে।

গতকাল এদিকে রাঙ্গার সমর্থকরা যেকোন সময় রংপুর জেলা জাতীয় পার্টি কার্যালয় দখল করতে পারে এমনি আশঙ্কায় জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি ও রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে নগরীর জিএল রায় রেডের পার্টি কার্যালয়ে অবস্থান করেন।

রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাঙ্গা সমর্থিত কোন নেতাকর্মীকে সেখানে দেখা যায়নি। তবে এ ব্যাপারে দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের সমর্থক রংপুর সিটি মেয়র ও মহানগর জাপা সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান, সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির, যুগ্ম সম্পাদক লোকমান হোসেন বলেছেন, এটা দলীয় কার্যালয় দখল রাখা নয়, আমরা প্রতিদিনই দলীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করি এটা তারই অংশ হিসেবে অফিসে আছি।

তবে দলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, গতকাল রাঙ্গার সমর্থক কয়েকজন নেতাকর্মী গোপনে নগরীর জীবনবীমা করপোরেশনের কার্যালয়ের সামনে দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে পালিয়ে যায়। এ খবর পাওয়ার পর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার নেতৃত্বে শত শত নেতাকর্মী তাদের ধাওয়া করেছে। এরপর চুপ করে নয়, প্রকাশ্যেই রংপুর প্রসক্লাবের সামনে রাঙ্গার কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে শত শত নেতাকর্মী।

তারা বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি রাঙ্গাকে দলের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বহিষ্কার করা হয়নি। তিনি ক্ষমা চাইলে আবারও দলে ফিরতে পারেন।’ কিন্তু অতিউৎসাহীরা দলের চেয়ারম্যানের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছে বলে জানান তারা।

এদিকে বুধবারের রাতের দুই গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনায় কোন পক্ষই থানায় কোন লিখিত অভিযোগ দেয়নি বলে জানিয়েছেন রংপুর মেট্রোপলিটন কোতয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) হোসেন আলী। অন্যদিকে ওসি মোস্তাফিজার রহমান জানিয়েছেন, নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০২ আশ্বিন ১৪২৯ ১৮ সফর ১৪৪৪

জাতীয় পার্টিতে ভাঙনের সুর

শাফিউল ইমরান

image

জাতীয় পার্টির আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা না থাকা নিয়ে বিরোধ চরমে উঠেছে। সেখানে নেতৃত্ব নিয়েও বিরোধ দেখা দিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় মশিউর রহমান রাঙ্গাকে দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে দলটির বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। মূলত রওশন এরশাদকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে বিরোধী দলের নেতা করার বিষয় নিয়েই এ রিরোধ।

গত বুধাবার জাতীয় পার্টির সভাপতিমন্ডলীসহ সব পদ থেকে অব্যাহতি দেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের। এ নিয়ে গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘রওশন এরশাদকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা করার বিষয়ে যে চিঠি দেয়া হয়েছে, তার প্রক্রিয়া ‘সঠিক ছিল না’। এটা আমি একটা টেলিভিশনকে বলেছিলাম, এজন্য আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে মনে করছি।’

চিঠি দেয়ার প্রক্রিয়া সঠিক না থাকলে সেটি নিয়ে এতদিন পরে কেন কথা বলছেন, সেই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে রাঙ্গা বলেন, ‘রওশন এরশাদকে সরিয়ে জিএম কাদেরকে বিরোধী দলীয় নেতা করার চিঠি দেয়ার পর তিনি (রওশন) আমাকে বলছেন, তুমি তো আমার সব সর্বনাশ করছ। তুমি তো সব চিঠিতে সই করেছ।

‘তখন আমি উনাকে বলেছি, এটার সঙ্গে আমি নেই। প্রক্রিয়া যে সঠিক ছিল না, এটা আমি কোন গণমাধ্যমে বলে দেব। এরপর আমি এ নিয়ে কথা বলেছি।’ রওশনকে বাদ দিতে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠকের পর স্পিকারকে পাঠানো চিঠিতে ‘হুমকির মুখে’ সই করেছিলেন বলে দাবি রাঙ্গার।

‘তখন স্বাক্ষর না করলে আমাকে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ থেকে সরিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছিল’ বলেন রাঙ্গা।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু দাবি করেন, ‘গত কয়েকদিন আগেও সে বিরোধী দলের নেতা নিয়ে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছে। অথচ আমরা মিটিং করে ২৬ জন এমপির মধ্যে ২৪ জন মিলে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিরোধী দলীয় নেতা পরিবর্তনের জন। এজন্য চিঠিও দিয়েছি। তিনিই স্বাক্ষরিত চিঠি দিয়েছেন। এখন তিনি উল্টাপাল্টা কথা বলেন।’ মহাসচিব সংবাদকে বলেন, ‘এখন আজকে যদি জিএম কাদের এটা বলেন (দল থেকে অব্যাহতি) ঠিক আছে, এই....। ওনার এসব কনফিউজিং কথাবার্তার মাধ্যমে বিভ্রান্তি হয়। সেজন্য চেয়ারম্যান তার পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।’

রাঙ্গা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দল যদি ‘গণতান্ত্রিকভাবে’ না চলে তো সেই দলে তিনিও থাকতে চান না। তিনি বলেছেন, ‘আমি আমার অব্যাহতির আদেশে আনহ্যাপি নই। তবে আমি আমার বহিষ্কার (অব্যাহতি) আদেশ প্রত্যাহার চাই। চেয়ারম্যানের সঙ্গে যুদ্ধ করে দলে থাকা যায় না।’

দলের মধ্যে কোন সমস্যা হয়েছে কি না জানতে চাইলে মহাসচিব চুন্নু বলেন, ‘হঠাৎ করে নয়, গত এক বছর যাবৎ পার্লামেন্টের ভেতরে এবং বাইরে তার কিছু কিছু বক্তব্য তার কথাবর্তা এগুলো দলের নীতির বাইরে। তাকে আগেও সতর্ক করা হয়েছে, তখন তিনি বলেছেন ‘এগুলো আর বলবেন না’।

অব্যাহতি পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাঙ্গা যে হুমকি দিয়েছিলেন সংবাদ সম্মেলনে সেই সুর পাল্টে তিনি বলেছেন, ‘অব্যাহতির আদেশ পাওয়ার পর আমি একটু রাগান্বিত ছিলাম, এটা অস্বীকার করব না। আমি চেয়ারম্যানকে যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম, সেটা তুলে নিয়েছি। রংপুরেও আর কোন ঝামেলা হবে না। সেটা গতকাল রাতেই বলে দিয়েছি।’

তবে সংবাদ সম্মেলন তিনি নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতেই আয়োজন করেছেন জানিয়ে রাঙ্গা বলেন, ‘অন্যায় করেননি’। তবে জাতীয় পার্টি যদি গণতান্ত্রিকভাবে না চলে আমি দলে থাকব না, এ দল করব না এবং অন্য কোন দলও করব না বলে সাফ জানিয়ে দেন। গঠনতন্ত্রের যে ধারার ক্ষমতাবলে দলীয় প্রধান তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন সেই ধারা ‘অগণতান্ত্রিক’ বলেও মন্তব্য করেন রাঙ্গা। দলের কাউন্সিলে ওই ধারা বাদ দেয়ার কথা উঠেছিল জানিয়ে তিনি দাবি করেন, ‘কিছু লোকের কারণে’ সেটা করা হয়নি।

রাঙ্গা বলেন, ‘আমি আজ এখানে পার্টির কোন লোক নিয়ে আসিনি। পরিবহন সেক্টরের কিছু লোক এসেছে। আগামীতে শুধু দুটি রাজনৈতিক দল থাকবে। কোন দুটি থাকবে, সেটা আমি বলব না। তবে সেখানে আমরা (জাতীয় পার্টি) থাকব না।’ জিএম কাদেরকে কিছু লোক ‘ভুল বুঝিয়ে’ তার অব্যাহতির আদেশ দিতে ‘বাধ্য করেছে’ মন্তব্য করে রাঙ্গা বলেন, ‘চেয়ারম্যানের সঙ্গে কিছু লোক আঠার মতো লেগে থাকে সারাক্ষণ। তারা উনাকে অনেক ভুল পরামর্শ দেন।’

রাঙ্গা বলেন, ‘জাতীয় পার্টি গণতান্ত্রিক দল না। তবে এটা স্বৈরতান্ত্রিক দল, এটা আমি বলব না।’

মহাসচিব চুন্নু বলেন, ‘আমাদের দলে কোন সমস্যা নেই। একজন সংগঠনবিরোধী কাজ করছিল তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সে আবার আজকে অব্যাহতি প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করছে।’

বেশ কিছুদিন ধরে জিএম কাদের সরকারবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। জাতীয় পার্টির মধ্যে আগামী নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন ধরনের মেরুকরণ হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের বাইরে কেউ কেউ জিএম কাদেরকে প্রভাবিত করছে বলে তার দলের মধ্যেই আলোচনা আছে। ওই মহলটি জোর চেষ্টা চালাচ্ছে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী বলয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের বাইরে প্রভাবশালী কেউ কেউ জিএম কাদেরকে প্রভাবিত করছেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসার।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব দাবি করেন, বিএনপির বিষয়ে যদি কোন কথা আসে তবে আমি দলের মহাসচিব আমি এটা জানি না। বিএনপির সঙ্গে কোন আলোচনার হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে চুন্নু বলেন, ‘প্রশ্নই আসে না। তাদের সময় এরশাদ সাহেব জেলে ছিল তার জন্ডিস ছিল মেডিকেল বোর্ডে বলল পিজি হাসপাতালে এনে চিকিৎসা করানোর জন্য, ওই সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পারমিশন দিল না আমরা কি এসব ভুলে গেছি নাকি।’

দলের সভাপতিমন্ডলীসহ সব পদ থেকে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে অব্যাহতি দিয়েছে জাতীয় পার্টি। সেই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের দলের গঠনতন্ত্রের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ সব পদবী থেকে মশিউর রহমান রাঙ্গাকে অব্যাহতি প্রদান করেছেন। ইতোমধ্যে এই আদেশ কার্যকর করা হয়েছে।’ বহিষ্কারের প্রতিক্রিয়ায় রাঙ্গা বলেন, ‘উনি (কাদের) দুষ্টু লোকের পরামর্শে করেছেন। আমরা কারও দয়ায় জাতীয় পার্টি করি না। তৃণমূল থেকে জাতীয় পার্টি করেছি। উনার সঙ্গে রংপুরে দেখা হবে।’

পরিবহন মালিক সমিতির নেতা রাঙ্গা বর্তমানে রংপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য। তিনি ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ জীবিত থাকাকালে ২০১৮ সালে রাঙ্গাকে দলের মহাসচিব করেছিলেন। এরপর ২০১৯ সালে তাকে সংসদে বিরোধী দলের প্রধান হুইপ করা হয়।

রংপুর থেকে লিয়াকত আলী বাদল জানিয়েছেন, জাতীয় পার্টি থেকে দলের সাবেক মহাসচিব ও বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাকে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়ার ঘটনা নিয়ে গত বুধবার গভীর রাত পর্যন্ত দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও রাঙ্গা সমর্থকদের ধাওয়া, পাল্টা-ধাওয়া, সংঘর্ষ এবং পাল্টাপাল্টি দুই নেতার কুশপুত্তলিকা দাহ করার ঘটনা নিয়ে গতকাল পর্যন্ত উত্তেজনা বিরাজ করে।

গতকাল এদিকে রাঙ্গার সমর্থকরা যেকোন সময় রংপুর জেলা জাতীয় পার্টি কার্যালয় দখল করতে পারে এমনি আশঙ্কায় জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মহানগর জাতীয় পার্টির সভাপতি ও রংপুর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে নগরীর জিএল রায় রেডের পার্টি কার্যালয়ে অবস্থান করেন।

রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাঙ্গা সমর্থিত কোন নেতাকর্মীকে সেখানে দেখা যায়নি। তবে এ ব্যাপারে দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের সমর্থক রংপুর সিটি মেয়র ও মহানগর জাপা সভাপতি মোস্তাফিজার রহমান, সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির, যুগ্ম সম্পাদক লোকমান হোসেন বলেছেন, এটা দলীয় কার্যালয় দখল রাখা নয়, আমরা প্রতিদিনই দলীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করি এটা তারই অংশ হিসেবে অফিসে আছি।

তবে দলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, গতকাল রাঙ্গার সমর্থক কয়েকজন নেতাকর্মী গোপনে নগরীর জীবনবীমা করপোরেশনের কার্যালয়ের সামনে দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে পালিয়ে যায়। এ খবর পাওয়ার পর সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার নেতৃত্বে শত শত নেতাকর্মী তাদের ধাওয়া করেছে। এরপর চুপ করে নয়, প্রকাশ্যেই রংপুর প্রসক্লাবের সামনে রাঙ্গার কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে শত শত নেতাকর্মী।

তারা বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি রাঙ্গাকে দলের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বহিষ্কার করা হয়নি। তিনি ক্ষমা চাইলে আবারও দলে ফিরতে পারেন।’ কিন্তু অতিউৎসাহীরা দলের চেয়ারম্যানের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছে বলে জানান তারা।

এদিকে বুধবারের রাতের দুই গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনায় কোন পক্ষই থানায় কোন লিখিত অভিযোগ দেয়নি বলে জানিয়েছেন রংপুর মেট্রোপলিটন কোতয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) হোসেন আলী। অন্যদিকে ওসি মোস্তাফিজার রহমান জানিয়েছেন, নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।