ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় যে দেশগুলো

রাজা তৃতীয় চার্লস এখন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তার মায়ের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সম্পর্কের এক নতুন অদ্যায়ের সূচনা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ সম্পর্ক ভবিষ্যতে কেমন থাকবে বা আদৌ থাকবে কিনা। কারণ, রাজতন্ত্রের সঙ্গে অনেক দেশের সম্পর্ক মোটেও সহজ-সরল নয়, বরং বেশ জটিল।

এসব দেশের অনেক লোকই ব্রিটেনের রাজতন্ত্রকে আর তাদের রাষ্ট্রের শীর্ষে দেখতে চাইছে না। এর মধ্যে গত বছর বারবাডোজ ব্রিটিশ রাজতন্ত্র এবং ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তারা রানী এলিজাবেথকে তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে পৃথিবীর নবতম প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

এ ছাড়াও অনেকদিন ধরেই প্রজাতন্ত্রে পরিণত হওয়ার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে আসছেন ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মত আরো কিছু দেশের অনেকে। তাদের দেশের জনগণের একটা ক্রমবর্ধমান অংশের মধ্যেই কাজ করছে এমন ভাবনা। এমনকি খোদ ব্রিটেনেও এমন লোকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে-যারা রাজতন্ত্রের বিলোপ চান, যুক্তরাজ্যকে একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত করতে চান।

রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু অস্ট্রেলিয়ায় রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র ঘোষণার বিতর্ককে আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল স্পষ্ট করেই বলেছেন, অস্ট্রেলিয়াকে প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার ওপর গণভোট হয়তো শিগগিরই হবে না - কিন্তু একদিন এটা হতেই হবে, এটা অবধারিত।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি অ্যালবানিজ বলেছেন, এখন রানীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সময়, কিন্তু কোন এক সময় এ গণভোট হবে। ধারণা করা হেেচ্ছ, ২০২৪ বা ২০২৫ সালে অ্যালবানিজ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হলে এ নিয়ে একটি গণভোট হতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ডেও এমন ভাবনাচিন্তা বাড়ছে। রানীর মৃত্যুর পর আবার জোরদার হয়েছে সেই আলোচনা। তবে সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, তিনি মনে করেন তার জীবদ্দশাতেই নিউজিল্যান্ড একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবে তবে তার দেশ এখনই এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে না।

বারবাডোজ যেভাবে প্রজাতন্ত্র হয়েছে : গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে এক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বারবাডোজ পৃথিবীর নবতম প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় এবং রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে সরিয়ে দেয়। অনুষ্ঠানে রাজকীয় পতাকাকে শেষবারের মতো সালাম দিয়ে তা নামিয়ে বারবাডোজের পতাকা উড়ানো হয়। সম্মানিত অতিথি হিসেবে তৎকালীন প্রিন্স অব ওয়েলস যুবরাজ চার্লসও এতে যোগ দিয়েছিলেন, আর শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন রানী।

প্রজাতন্ত্র হতে চায় জ্যামাইকাও : রানীর মৃত্যুর পর রাজা তৃতীয় চার্লস এখন ক্যারিবিয়ান দেশ জ্যামাইকারও রাজা এবং রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু জ্যামাইকাও এ বছরের শুরুতে সেদেশে প্রিন্স উইলিয়ামের সফরের সময় তার ভাষণে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে তারা ঔপনিবেশিক অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে চায়, এবং বারবাডোজের মতই একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হতে চায়।

মনে রাখা দরকার, প্রিন্স উইলিয়াম এখন প্রিন্স অব ওয়েলস অর্থাৎ তৃতীয় চার্লসের পর ব্রিটেনের পরবর্তী রাজা হবেন তিনিই। তাকেই জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী এ্যান্ড্রু হোলনেস বলেছেন, আমরা অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি।

সম্প্রতিক জরিপগুলোয় দেখা গেছে জ্যামাইকার ৫০ শতাংশ মানুষ এখন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং রানী এলিজাবেথের মৃত্যু হয়তো এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে। জ্যামাইকায় শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য কাজ করছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান দি অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী অধ্যাপক রোজালিয়া হ্যামিলটন বলছেন, এ নিয়ে কথাবার্তা আবার শুরু হয়েছে। আমরা যতই কথা বলবো, ততই আরো বেশি জ্যামাইকান জেগে উঠবে।

তারা ইতিহাস থেকে জানতে পারছে-যে ইতিহাস আমাদের স্কুলে পড়ানো হয়তো না, যা আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। রাজা চার্লস জ্যামাইকার কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। তবে তিনি বারবাডোজে গত বছর এক ভাষণের সময় দাসপ্রথার মর্মান্তিক নৃশংসতার কথা স্বীকার করেছেন।

যুক্তরাজ্যেও রাজতন্ত্রবিরোধীরা : যুক্তরাজ্যে সবশেষ জনমত জরিপে দেখা যায়, ৬১ শতাংশ লোকই এখনো রাজতন্ত্র বহাল রাখার সমর্থক, অন্যদিকে ২৪ শতাংশ চান একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান।

তবে ব্রিটেনের ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়স্কদের মধ্যে এ ব্যাপারে মত পরিবর্তন হচ্ছে বলে দেখা গেছে গত কয়েক বছরে। এই বয়সের নাগরিকদের ওপর চালানো এক জরিপে ২০১৯ সালে দেখা যায়, ৪৬ শতাংশ ব্রিটেনে একজন রাজা বা রানী থাকার পক্ষে, অন্যদিকে ৩১ শতাংশ চান নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান।

কিন্তু একই বয়সীদের ওপর ২০২১ সালে চালানো জরিপে দেখা যায়, রাজতন্ত্র সমর্থন করেন মাত্র ৩১ শতাংশ এবং ৪১ শতাংশ চান ভোট দিয়ে একজন রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত করতে।

image

রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের শবযান এক পলক দেখতে রাস্তার দুই পাশে ভিড় জমিয়েছেন হাজারো মানুষ-এএফপি

আরও খবর
ইউক্রেনের একটি বাঁধে রুশ হামলা, বন্যার আশঙ্কা
সমাপ্তির পথে করোনা মহামারী : ডব্লিউএইচও
ইরানের বিরুদ্ধে আবারও নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের

শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০২ আশ্বিন ১৪২৯ ১৮ সফর ১৪৪৪

ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় যে দেশগুলো

image

রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের শবযান এক পলক দেখতে রাস্তার দুই পাশে ভিড় জমিয়েছেন হাজারো মানুষ-এএফপি

রাজা তৃতীয় চার্লস এখন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তার মায়ের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সম্পর্কের এক নতুন অদ্যায়ের সূচনা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ সম্পর্ক ভবিষ্যতে কেমন থাকবে বা আদৌ থাকবে কিনা। কারণ, রাজতন্ত্রের সঙ্গে অনেক দেশের সম্পর্ক মোটেও সহজ-সরল নয়, বরং বেশ জটিল।

এসব দেশের অনেক লোকই ব্রিটেনের রাজতন্ত্রকে আর তাদের রাষ্ট্রের শীর্ষে দেখতে চাইছে না। এর মধ্যে গত বছর বারবাডোজ ব্রিটিশ রাজতন্ত্র এবং ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তারা রানী এলিজাবেথকে তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে পৃথিবীর নবতম প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

এ ছাড়াও অনেকদিন ধরেই প্রজাতন্ত্রে পরিণত হওয়ার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে আসছেন ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মত আরো কিছু দেশের অনেকে। তাদের দেশের জনগণের একটা ক্রমবর্ধমান অংশের মধ্যেই কাজ করছে এমন ভাবনা। এমনকি খোদ ব্রিটেনেও এমন লোকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে-যারা রাজতন্ত্রের বিলোপ চান, যুক্তরাজ্যকে একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত করতে চান।

রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু অস্ট্রেলিয়ায় রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র ঘোষণার বিতর্ককে আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল স্পষ্ট করেই বলেছেন, অস্ট্রেলিয়াকে প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার ওপর গণভোট হয়তো শিগগিরই হবে না - কিন্তু একদিন এটা হতেই হবে, এটা অবধারিত।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি অ্যালবানিজ বলেছেন, এখন রানীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সময়, কিন্তু কোন এক সময় এ গণভোট হবে। ধারণা করা হেেচ্ছ, ২০২৪ বা ২০২৫ সালে অ্যালবানিজ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হলে এ নিয়ে একটি গণভোট হতে পারে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ডেও এমন ভাবনাচিন্তা বাড়ছে। রানীর মৃত্যুর পর আবার জোরদার হয়েছে সেই আলোচনা। তবে সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, তিনি মনে করেন তার জীবদ্দশাতেই নিউজিল্যান্ড একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবে তবে তার দেশ এখনই এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে না।

বারবাডোজ যেভাবে প্রজাতন্ত্র হয়েছে : গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে এক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বারবাডোজ পৃথিবীর নবতম প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় এবং রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে সরিয়ে দেয়। অনুষ্ঠানে রাজকীয় পতাকাকে শেষবারের মতো সালাম দিয়ে তা নামিয়ে বারবাডোজের পতাকা উড়ানো হয়। সম্মানিত অতিথি হিসেবে তৎকালীন প্রিন্স অব ওয়েলস যুবরাজ চার্লসও এতে যোগ দিয়েছিলেন, আর শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিলেন রানী।

প্রজাতন্ত্র হতে চায় জ্যামাইকাও : রানীর মৃত্যুর পর রাজা তৃতীয় চার্লস এখন ক্যারিবিয়ান দেশ জ্যামাইকারও রাজা এবং রাষ্ট্রপ্রধান। কিন্তু জ্যামাইকাও এ বছরের শুরুতে সেদেশে প্রিন্স উইলিয়ামের সফরের সময় তার ভাষণে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে তারা ঔপনিবেশিক অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে চায়, এবং বারবাডোজের মতই একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হতে চায়।

মনে রাখা দরকার, প্রিন্স উইলিয়াম এখন প্রিন্স অব ওয়েলস অর্থাৎ তৃতীয় চার্লসের পর ব্রিটেনের পরবর্তী রাজা হবেন তিনিই। তাকেই জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী এ্যান্ড্রু হোলনেস বলেছেন, আমরা অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি।

সম্প্রতিক জরিপগুলোয় দেখা গেছে জ্যামাইকার ৫০ শতাংশ মানুষ এখন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং রানী এলিজাবেথের মৃত্যু হয়তো এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে। জ্যামাইকায় শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য কাজ করছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান দি অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী অধ্যাপক রোজালিয়া হ্যামিলটন বলছেন, এ নিয়ে কথাবার্তা আবার শুরু হয়েছে। আমরা যতই কথা বলবো, ততই আরো বেশি জ্যামাইকান জেগে উঠবে।

তারা ইতিহাস থেকে জানতে পারছে-যে ইতিহাস আমাদের স্কুলে পড়ানো হয়তো না, যা আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। রাজা চার্লস জ্যামাইকার কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। তবে তিনি বারবাডোজে গত বছর এক ভাষণের সময় দাসপ্রথার মর্মান্তিক নৃশংসতার কথা স্বীকার করেছেন।

যুক্তরাজ্যেও রাজতন্ত্রবিরোধীরা : যুক্তরাজ্যে সবশেষ জনমত জরিপে দেখা যায়, ৬১ শতাংশ লোকই এখনো রাজতন্ত্র বহাল রাখার সমর্থক, অন্যদিকে ২৪ শতাংশ চান একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান।

তবে ব্রিটেনের ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়স্কদের মধ্যে এ ব্যাপারে মত পরিবর্তন হচ্ছে বলে দেখা গেছে গত কয়েক বছরে। এই বয়সের নাগরিকদের ওপর চালানো এক জরিপে ২০১৯ সালে দেখা যায়, ৪৬ শতাংশ ব্রিটেনে একজন রাজা বা রানী থাকার পক্ষে, অন্যদিকে ৩১ শতাংশ চান নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান।

কিন্তু একই বয়সীদের ওপর ২০২১ সালে চালানো জরিপে দেখা যায়, রাজতন্ত্র সমর্থন করেন মাত্র ৩১ শতাংশ এবং ৪১ শতাংশ চান ভোট দিয়ে একজন রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত করতে।