দুর্নীতি কি অন্যায়

এম এ কবীর

প্রতিবেশীর সন্তান ধার করে এনে সেই সন্তানকে নিজের দাবি করে শিক্ষা কর্মকর্তাকে দেখিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা। কুড়িগ্রামের নাগেশ^রী উপজেলার হাসনাবাদ ইউনিয়নের মুনিয়ারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা আলেয়া সালমা চলতি বছরের ১৪ মার্চ থেকে মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করছেন। গর্ভধারণ না করেও এ ছুটি নিতে তিনি ছলচাতুরীর আশ্রয় নেন। তবে কয়েক মাস যেতে না যেতেই জনসম্মুখে উঠে আসে আসল ঘটনা।

প্রধান শিক্ষক খাদিজা সুলতানা, উপজেলা শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী ও হিসাবরক্ষক (বড়বাবু) আজিজার রহমান ও সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা আবু নোমান মো. নওশাদ আলীর যোগসাজশে এ ধরনের অনৈতিক ছুটিতে আছেন ওই শিক্ষিকা। আলেয়া সালমা বদলি সূত্রে ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মুনিয়ারহাট বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ২০১৯ সালে বিয়ে করেন বগুড়ার গাবতলী উপজেলা কাগইল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শফি আহমেদ স্বপনকে। বিয়ের পর থেকে বগুড়ায় চলে যান আলেয়া সালমা। এরপর করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে স্কুল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও তিনি স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এ সময় তিনি চিকিৎসাসহ নানা অজুহাতে ছুটি নেন। সর্বশেষ গর্ভধারণ না করেও মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করেন আলেয়া সালমা। চলতি বছরের ১৪ মার্চ সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য দিন দেখিয়ে ১৩ মার্চ থেকে ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির আবেদন করেন আলেয়া সালমা। কিন্তু গর্ভকালীন সালমার শারীরিক কোনো পরিবর্তন বিদ্যালয়ের সহকর্মীদের নজরে পড়েনি। এ কারণে তিনি ১৩ মার্চ কোলে শিশুসন্তান নিয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসে হাজির হন। জমা দেন ছুটির আবেদন।

বাংলাদেশে সব আমলে ক্ষমতাসীনদের সবচেয়ে অপ্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হচ্ছে ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’। জার্মানভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতি এবং সুশাসন নিয়ে কাজ করে। সংস্থাটির দুর্নীতির ধারণা সূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স) বাংলাদেশে এক রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে অনেক আগে থেকেই। এই সূচকের মাধ্যমে সারা বিশে^র সব দেশের মধ্যে একটা তুলনামূলক চিত্র দেখা যায়। ফলে বাংলাদেশ তার আশপাশের এবং অন্যান্য তুলনীয় দেশগুলোর তুলনায় দুর্নীতির ক্ষেত্রে কেমন আছে, সেটা শুধু রাজনৈতিক দল কেন, সচেতন নাগরিকদের কাছেও খুবই কৌতূহল জাগায়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সর্বশেষ সরকারটির সময়ে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ পরপর পাঁচবার পৃথিবীতে অন্য সব দেশগুলোর তুলনায় সবার শেষে ছিল।

এটাকে তৎকালীন বিরোধী দল ‘দুর্নীতিতে বিশ^চ্যাম্পিয়ন’ বলে ব্যবহার করে। অবশ্য সেই পাঁচবারের প্রথমবারের ফল বিএনপির সময়ে প্রকাশিত হলেও যে বছরের ভিত্তিতে সে ফলাফল হয়েছিল, সে বছরের প্রায় পুরোটা ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ এবং শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিএনপির সময় যখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করত, তখন বিএনপির লোকজন সেটা একেবারেই পছন্দ করত না। বরং সমালোচনা করত সংস্থাটির। তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের কাছে এই সংস্থাটি ছিল ‘অসাধারণ স্বচ্ছ’ এবং সুন্দর একটি প্রতিষ্ঠান।

প্রায় দেড় দশক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তাদের কাছে এখন আর ভালো কোন প্রতিষ্ঠান নয়। যখনই কোন মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে টিআইবি কোনো জরিপ বা গবেষণা করে দুর্নীতি এবং সুশাসনহীনতা নিয়ে কথা বলে তখনই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে ‘অস্বচ্ছ’, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ইত্যাদি শব্দ যুক্ত করে বক্তব্য দেন। সংসদে কী হয় না হয়, কতটা সময় সংসদের মূল কাজ অর্থাৎ আইন প্রণয়নে ব্যয় হয়, সেসব নিয়ে টিআইবি ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ নামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতেও সংসদে তীব্র সমালোচনার শিকার হয় সংস্থাটি। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘টিআইবি এখন কথায় কথায় বিবৃতি দেয়। সম্প্রতি রেলের টিকিট ও টিটিই নিয়ে মধ্যরাতে একটা ঘটনা ঘটে। এটার কোন খোঁজখবর না নিয়েই সকাল বেলা টিআইবি বিবৃতি দিয়ে দিল। এখন রিজভী আহমেদ আর টিআইবির মধ্যে আমি কোন পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছি না। কোন কিছু ঘটার আগেই যেমন রিজভী আহমেদ বিবৃতি লিখে রাখেন, তেমনি টিআইবিও কোন কিছু হওয়ার আগেই বিবৃতি লিখে রাখে।’

এই সংস্থার নানা রকম রিপোর্ট জনগণের জন্য অসাধারণ কার্যকরী হয়েছে। দেশের দুর্নীতি আর সুশাসনহীনতা সম্পর্কে মানুষ জানে, কিন্তু টিআইবির নানা সেক্টর নিয়ে গবেষণা মানুষকে এর পরিমাণ এবং ব্যাপ্তি নিয়ে ভালো ধারণা দেয়। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে মেরে দেয়া, অবকাঠামোসহ অন্যান্য প্রকল্প থেকে টাকা চুরি করা থেকে শুরু করে দেশের সব দুর্নীতির মাশুল শেষ পর্যন্ত দিতে হয় সাধারণ মানুষকেই। এসব সেক্টরে লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। কিন্তু এসব দুর্নীতির তুলনায় অনেক কম অঙ্কের দুর্নীতি নিয়ে দেশের মানুষের অনেক বড় মাথাব্যথা। টিআইবি দুর্নীতির একটি খানা জরিপ করে। এখানে এক বছরে সেবা খাতে সারা দেশের কতগুলো খানা বা পরিবার (হাউসহোল্ড), কী পরিমাণ এবং কেমন ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়েছে, সেই স্ট্যাডি করা হয়।

যেহেতু এসব দুর্নীতির ক্ষেত্রে মানুষ সরাসরি হয়রানির শিকার হয় এবং ঘুষ দেয়ার ক্ষেত্রে নিজের পকেট থেকে টাকা দিতে হয়, তাই এই দুর্নীতি এবং ঘুষের প্রতি মানুষের ক্ষোভ বেশি। দেশের অনেক মানুষ দুর্নীতি বলতে নিজে সরাসরি মুখোমুখি হয়েছে, এমন দুর্নীতিই বোঝে। সম্প্রতি ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’ শীর্ষক রিপোর্ট প্রকাশ করে টিআইবি যাতে ২০২০-এর ডিসেম্বর থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের জরিপ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে মোট ১৭ ধরনের সেবা খাতের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়। দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে ঘুষ, জোরপূর্বক অর্থ আদায়, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি, সময়ক্ষেপণসহ বিভিন্ন হয়রানি। জরিপের এক বছরে ঘুষ দেয়া টাকার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।

অর্থাৎ দেশে মাথাপিছু ঘুষ দেয়ার পরিমাণ ৬৭১ টাকা। বর্তমান জরিপে দুর্নীতির ব্যাপ্তি বেড়েছে। এর আগে ২০১৭ সালে সেবা খাতের দুর্নীতি নিয়ে খানা জরিপ করে টিআইবি। সার্বিকভাবে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দুর্নীতির শিকার খানা বেড়েছে। ২০১৭ সালে যা ছিল সাড়ে ৬৬ শতাংশ, ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৭ সালে প্রতিটি খানাকে গড়ে ঘুষ দিতে হয় ৫ হাজার ৯৩০ টাকা। ২০২১ সালে তা দাঁড়ায় ৬ হাজার ৬৩৬ টাকায়। জরিপের কিছু বিষয় লক্ষণীয়, দুর্নীতির শিকার হলেও অভিযোগ করেননি ৭৯ দশমিক ২২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ অভিযোগ করেননি হয়রানির ভয়ে। সব খানেই দুর্নীতি-তাই অভিযোগ করার প্রয়োজনবোধ করেননি ৪৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। সাড়ে ১৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। তবে ৭২ শতাংশ অভিযোগের ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অভিযোগের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

দুর্নীতির শিকার হওয়া মানুষদের অর্ধেকই দুর্নীতির ব্যাপারে অভিযোগ করার প্রয়োজন মনে করেন না; কারণ, তারা মনে করেন দুর্নীতি সব জায়গায়ই ছড়িয়ে আছে। একটা বীভৎসতার মধ্যে বসবাস করার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে মানুষ ধীরে ধীরে প্রাথমিকভাবে সেটার প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়তে শুরু করে। তার পরের ধাপে মানুষ সেটাকে মেনে নিতে শুরু করে। ফলে একটার পর একটা নতুন প্রজন্মের কাছে দুর্নীতি যে অন্যায় এই বোধ ক্রমাগত বিলীন হয়ে যেতে থাকে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৩ আশ্বিন ১৪২৯ ১৯ সফর ১৪৪৪

দুর্নীতি কি অন্যায়

এম এ কবীর

প্রতিবেশীর সন্তান ধার করে এনে সেই সন্তানকে নিজের দাবি করে শিক্ষা কর্মকর্তাকে দেখিয়ে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা। কুড়িগ্রামের নাগেশ^রী উপজেলার হাসনাবাদ ইউনিয়নের মুনিয়ারহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা আলেয়া সালমা চলতি বছরের ১৪ মার্চ থেকে মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করছেন। গর্ভধারণ না করেও এ ছুটি নিতে তিনি ছলচাতুরীর আশ্রয় নেন। তবে কয়েক মাস যেতে না যেতেই জনসম্মুখে উঠে আসে আসল ঘটনা।

প্রধান শিক্ষক খাদিজা সুলতানা, উপজেলা শিক্ষা অফিসের উচ্চমান সহকারী ও হিসাবরক্ষক (বড়বাবু) আজিজার রহমান ও সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা আবু নোমান মো. নওশাদ আলীর যোগসাজশে এ ধরনের অনৈতিক ছুটিতে আছেন ওই শিক্ষিকা। আলেয়া সালমা বদলি সূত্রে ২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মুনিয়ারহাট বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ২০১৯ সালে বিয়ে করেন বগুড়ার গাবতলী উপজেলা কাগইল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শফি আহমেদ স্বপনকে। বিয়ের পর থেকে বগুড়ায় চলে যান আলেয়া সালমা। এরপর করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে স্কুল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও তিনি স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এ সময় তিনি চিকিৎসাসহ নানা অজুহাতে ছুটি নেন। সর্বশেষ গর্ভধারণ না করেও মাতৃত্বকালীন ছুটি ভোগ করেন আলেয়া সালমা। চলতি বছরের ১৪ মার্চ সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য দিন দেখিয়ে ১৩ মার্চ থেকে ৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির আবেদন করেন আলেয়া সালমা। কিন্তু গর্ভকালীন সালমার শারীরিক কোনো পরিবর্তন বিদ্যালয়ের সহকর্মীদের নজরে পড়েনি। এ কারণে তিনি ১৩ মার্চ কোলে শিশুসন্তান নিয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসে হাজির হন। জমা দেন ছুটির আবেদন।

বাংলাদেশে সব আমলে ক্ষমতাসীনদের সবচেয়ে অপ্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হচ্ছে ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’। জার্মানভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতি এবং সুশাসন নিয়ে কাজ করে। সংস্থাটির দুর্নীতির ধারণা সূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স) বাংলাদেশে এক রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে অনেক আগে থেকেই। এই সূচকের মাধ্যমে সারা বিশে^র সব দেশের মধ্যে একটা তুলনামূলক চিত্র দেখা যায়। ফলে বাংলাদেশ তার আশপাশের এবং অন্যান্য তুলনীয় দেশগুলোর তুলনায় দুর্নীতির ক্ষেত্রে কেমন আছে, সেটা শুধু রাজনৈতিক দল কেন, সচেতন নাগরিকদের কাছেও খুবই কৌতূহল জাগায়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সর্বশেষ সরকারটির সময়ে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ পরপর পাঁচবার পৃথিবীতে অন্য সব দেশগুলোর তুলনায় সবার শেষে ছিল।

এটাকে তৎকালীন বিরোধী দল ‘দুর্নীতিতে বিশ^চ্যাম্পিয়ন’ বলে ব্যবহার করে। অবশ্য সেই পাঁচবারের প্রথমবারের ফল বিএনপির সময়ে প্রকাশিত হলেও যে বছরের ভিত্তিতে সে ফলাফল হয়েছিল, সে বছরের প্রায় পুরোটা ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ এবং শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিএনপির সময় যখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করত, তখন বিএনপির লোকজন সেটা একেবারেই পছন্দ করত না। বরং সমালোচনা করত সংস্থাটির। তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের কাছে এই সংস্থাটি ছিল ‘অসাধারণ স্বচ্ছ’ এবং সুন্দর একটি প্রতিষ্ঠান।

প্রায় দেড় দশক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তাদের কাছে এখন আর ভালো কোন প্রতিষ্ঠান নয়। যখনই কোন মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে টিআইবি কোনো জরিপ বা গবেষণা করে দুর্নীতি এবং সুশাসনহীনতা নিয়ে কথা বলে তখনই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে ‘অস্বচ্ছ’, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ইত্যাদি শব্দ যুক্ত করে বক্তব্য দেন। সংসদে কী হয় না হয়, কতটা সময় সংসদের মূল কাজ অর্থাৎ আইন প্রণয়নে ব্যয় হয়, সেসব নিয়ে টিআইবি ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ নামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতেও সংসদে তীব্র সমালোচনার শিকার হয় সংস্থাটি। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘টিআইবি এখন কথায় কথায় বিবৃতি দেয়। সম্প্রতি রেলের টিকিট ও টিটিই নিয়ে মধ্যরাতে একটা ঘটনা ঘটে। এটার কোন খোঁজখবর না নিয়েই সকাল বেলা টিআইবি বিবৃতি দিয়ে দিল। এখন রিজভী আহমেদ আর টিআইবির মধ্যে আমি কোন পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছি না। কোন কিছু ঘটার আগেই যেমন রিজভী আহমেদ বিবৃতি লিখে রাখেন, তেমনি টিআইবিও কোন কিছু হওয়ার আগেই বিবৃতি লিখে রাখে।’

এই সংস্থার নানা রকম রিপোর্ট জনগণের জন্য অসাধারণ কার্যকরী হয়েছে। দেশের দুর্নীতি আর সুশাসনহীনতা সম্পর্কে মানুষ জানে, কিন্তু টিআইবির নানা সেক্টর নিয়ে গবেষণা মানুষকে এর পরিমাণ এবং ব্যাপ্তি নিয়ে ভালো ধারণা দেয়। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে মেরে দেয়া, অবকাঠামোসহ অন্যান্য প্রকল্প থেকে টাকা চুরি করা থেকে শুরু করে দেশের সব দুর্নীতির মাশুল শেষ পর্যন্ত দিতে হয় সাধারণ মানুষকেই। এসব সেক্টরে লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। কিন্তু এসব দুর্নীতির তুলনায় অনেক কম অঙ্কের দুর্নীতি নিয়ে দেশের মানুষের অনেক বড় মাথাব্যথা। টিআইবি দুর্নীতির একটি খানা জরিপ করে। এখানে এক বছরে সেবা খাতে সারা দেশের কতগুলো খানা বা পরিবার (হাউসহোল্ড), কী পরিমাণ এবং কেমন ধরনের দুর্নীতির শিকার হয়েছে, সেই স্ট্যাডি করা হয়।

যেহেতু এসব দুর্নীতির ক্ষেত্রে মানুষ সরাসরি হয়রানির শিকার হয় এবং ঘুষ দেয়ার ক্ষেত্রে নিজের পকেট থেকে টাকা দিতে হয়, তাই এই দুর্নীতি এবং ঘুষের প্রতি মানুষের ক্ষোভ বেশি। দেশের অনেক মানুষ দুর্নীতি বলতে নিজে সরাসরি মুখোমুখি হয়েছে, এমন দুর্নীতিই বোঝে। সম্প্রতি ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’ শীর্ষক রিপোর্ট প্রকাশ করে টিআইবি যাতে ২০২০-এর ডিসেম্বর থেকে গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের জরিপ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে মোট ১৭ ধরনের সেবা খাতের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়। দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে ঘুষ, জোরপূর্বক অর্থ আদায়, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি, সময়ক্ষেপণসহ বিভিন্ন হয়রানি। জরিপের এক বছরে ঘুষ দেয়া টাকার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।

অর্থাৎ দেশে মাথাপিছু ঘুষ দেয়ার পরিমাণ ৬৭১ টাকা। বর্তমান জরিপে দুর্নীতির ব্যাপ্তি বেড়েছে। এর আগে ২০১৭ সালে সেবা খাতের দুর্নীতি নিয়ে খানা জরিপ করে টিআইবি। সার্বিকভাবে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দুর্নীতির শিকার খানা বেড়েছে। ২০১৭ সালে যা ছিল সাড়ে ৬৬ শতাংশ, ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৭ সালে প্রতিটি খানাকে গড়ে ঘুষ দিতে হয় ৫ হাজার ৯৩০ টাকা। ২০২১ সালে তা দাঁড়ায় ৬ হাজার ৬৩৬ টাকায়। জরিপের কিছু বিষয় লক্ষণীয়, দুর্নীতির শিকার হলেও অভিযোগ করেননি ৭৯ দশমিক ২২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ অভিযোগ করেননি হয়রানির ভয়ে। সব খানেই দুর্নীতি-তাই অভিযোগ করার প্রয়োজনবোধ করেননি ৪৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। সাড়ে ১৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। তবে ৭২ শতাংশ অভিযোগের ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অভিযোগের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

দুর্নীতির শিকার হওয়া মানুষদের অর্ধেকই দুর্নীতির ব্যাপারে অভিযোগ করার প্রয়োজন মনে করেন না; কারণ, তারা মনে করেন দুর্নীতি সব জায়গায়ই ছড়িয়ে আছে। একটা বীভৎসতার মধ্যে বসবাস করার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে মানুষ ধীরে ধীরে প্রাথমিকভাবে সেটার প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়তে শুরু করে। তার পরের ধাপে মানুষ সেটাকে মেনে নিতে শুরু করে। ফলে একটার পর একটা নতুন প্রজন্মের কাছে দুর্নীতি যে অন্যায় এই বোধ ক্রমাগত বিলীন হয়ে যেতে থাকে।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]