বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন ও আজকের শিক্ষা

আকমল হোসেন

১৭ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক শিক্ষা দিবস। ১৯৬২ সালের এই দিনে শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে যেয়ে পুলিশের গুলিতে জীবন দিতে হয়েছিলো ছাত্রদের। দিবসটি সরকারিভাবে পালিত না হলেও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। শিক্ষার অধিকার আদায়ে ওই দিন ঢাকার রাজপথে তৎকালীন পাকিস্থান সরকারের পুলিশ বাহিনীর বুলেটে জীবন দিতে হয়েছিল মোস্তফা ওয়াজিল্লাহ, বাবুল প্রমুখ ছাত্র নেতাদের। সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের শাসন আমলে শরীফ কমিশনের নেতৃত্বে একটি শিক্ষানীতি প্রদান করা হয়েছিল। শিক্ষানীতির বেশ কিছু বক্তব্য তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থায় বেমানানই ছিল না অপ্রাসঙ্গিকও ছিল। এগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষা সংকোচন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বছর শেষে, পরীক্ষা ব্যবস্থা, ৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রি পাসকোর্স চালু এবং ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবনা অন্যতম। এগুলো বাতিলের দাবিতে ৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল। সেই ধর্মঘট পালনকালেই পুলিশি হত্যাকা- সংঘঠিত হয়, পরে আইয়ুব খান শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিল করেছিল।

শিক্ষা কি? কেন এবং কীভাবে এটা প্রদান করা যায় সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভোগবাদী সমাজে মুনাফাভিত্তিক এবং পুঁজিবাদী সমাজে যেভাবে সব কিছুকে পণ্য ভাবা হয় এবং টাকা দিলে পণ্যের মতো সবই পাওয়া যায়Ñএমন প্রবণতা সৃষ্টির চেষ্টা চললেও এখনো অনেক দেশেই শিক্ষার সাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি আছে। সেই বিবেচনায় শিক্ষার দর্শন নির্ধারিত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য হওয়ার কথা নয়Ñএ জন্য ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়ন এর বিষয়েও উন্নতি হওয়া দরকার। ব্যক্তির দেহ ও মনের সব ক্ষমতা বিকশিত, বিবর্তিত মার্জিত করে, তাকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান নৈপুণ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে তোলার ব্যবস্থাদির নাম যদি শিক্ষা হয়, তাহলে মানবতাবাদী এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হলে শিক্ষার দর্শন, অর্থায়ন, ও ব্যবস্থাপনা এমন হবে, যেখানে সবার জন্য একই ধরনের অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা হওয়া দরকার।

পৃথিবীর যে সব দেশ শিক্ষা, সংস্কৃতি আর অর্থনীতিতে এগিয়েছে, তাদের শিক্ষার ইতিহাস এমনটাই। শিক্ষার দর্শন হিসেবে ভাববাদ, যুক্তি, দর্শন সর্বশেষে বিজ্ঞানই অন্যতম মাধ্যম। এই ধারাবাহিকতাকে উপেক্ষা করে শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করলে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যুগের চাহিদা মিটাতে সক্ষম হবে কি? ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে লর্ড মেকলেকে দিয়ে সেই শিক্ষানীতি দেয়া হয়েছিল, যা অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন ও হিসাব-নিকাশ করার মতো একটি জাতি সৃষ্টি ছাড়া সৃজনশীল ও সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী বা অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানোর মতো চেতনাবোধ ওই শিক্ষাব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়নি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আলোকে এবং সংবিধানের ১৭ এর খ ধারার আলোকে একই ধারার সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। জাতীয় বাজেটে জিজিপির প্রাথমিকভাবে ৫ শতাংশ এবং পর্যায়ক্রমে ইউনেস্কোকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু একবারে ৩৫১৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করেছিলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আমলে আরও ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়েছে, যদিও এখনো ৪ হাজারের মতো প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণের বাইরে রয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯০ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি অবস্থায় রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস সেই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থাকেও আবার সাম্প্রদায়িক করা হয়েছিল, আগে-পিছের স্তরে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার স্বীকৃতি না থাকলেও একবারে মাস্টার্স পর্যায়ের দাওরাকে সরকারের আইনি স্বীকৃতিকে শিক্ষাবিদদের ভাবিয়ে তুলেছে, শিক্ষায় ঘটেছে সাম্প্রদায়িকতা, এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে।

সংবিধানে একই ধারার সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যমের (তিনধারার) শিক্ষা বহাল রয়েছে। শিক্ষায় অর্থায়ন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাড়েনি, শিক্ষা প্রশাসনে দলীয়করণের ভূত বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডিতে দলীয়করণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি বাদে সবগুলোতে দলীয়করণের ভূত চেপে বসেছে, ফলে দলীয়ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলায় তুলনামূলক কম যোগ্যতার লোক অগ্রাধিকার পাচ্ছে, ফলে শিক্ষার গুণগতমানের ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিশ^বিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজের টাকার কমিশন বণ্টনে সমঝোতা করতে দেখা যাচ্ছে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রভাবশালীদের। সৃজনশীল আর এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে এ+ আর গোল্ডেনের সংখ্যা বাড়লেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারছে না।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আন্তর্জাতিক মানের দিক থেকে অনেক নিচে অবস্থান করছে। বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় গ্রুপ অব কোম্পানির মালিকরা শিক্ষাব্যবসা শুরু করে শিক্ষার বারোটা বাজিয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের মধ্যে টাকা ভাগবাটোয়ারার ঘটনা এখন আদালতে গড়িয়েছে। মৌলিক অধিকার শিক্ষা আজ সুপার মার্কেটের পণ্যের মতো যার টাকা আছে, সেই সেটা কিনতে পারবে। এটি জীবন দিয়ে স্বাধীন করা একটি দেশের জন্য খুবই দুঃখজনক, তবে এটাই এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে, শিক্ষার দর্শনে মুক্তিযদ্ধের চেতনা ও ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিধান যেমন উপেক্ষিত হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নের ক্ষেত্রেই কোন ইতিবাচক অগ্রগতি হয়নি বরং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটির ক্ষমতাশীল আমলে শিক্ষা কারিকুলামে সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পেয়েছে। আগে-পিছের শিক্ষার একাডেমিক ও কারিকুলামগত স্বীকৃতি না থাকলেও কওমি মাদ্রাসার শেষ পর্যায়ের শিক্ষাকে মাস্টার্সের মর্যাদা শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে হ-য-ব-র-ল সৃষ্টি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই শিক্ষাকে কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না।

বিজ্ঞান যুক্তি আধুনিক সমাজে শিক্ষার বিষয়বস্তু হওয়া উচিত মানবিকতা, সৃজনশীলতা, যৌক্তিকতা ও উৎপাদনশীলতা। ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন দমনে পুলিশ ব্যবহার হয়েছিল আর আজকের আন্দোলন দমনে পুলিশ এবং হেলমেট বাহিনী ব্যবহার হচ্ছে, দুই আমলের পার্থক্য আগে ছিল বাঙালিরা পরাধীন আর এখন হয়েছে স্বাধীন। চাকরির ক্ষেত্রে কোটা আর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো সামাজিক আন্দেলনকে দমন করতে সরকার যে হামলা গ্রেপ্তার আর রিমান্ডের পথ অনুসরণ করেছিল তা গণতান্ত্রিক সরকারের আচরণ বলে মনে হয়নি। অন্যদিকে বিশ্বদ্যিালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে যখন উন্নয়ন তহবিলের টাকা রুলিং পার্টির ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়, তখন ওই ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তল্পিবাহক হওয়া ছাড়া ছাত্রসমাজের অধিকার আদায়ে কোন ভূমিকা রাখতে পারে না, পারছে না। স্বাধীন দেশে সব সময় সব সরকারের আমলেই এমনটা দেখা গেছে আজও তার ব্যতিক্রম নয়। নতুন করে শুরু হয়েেেছ রুলিং পার্টির ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সিট বাণিজ্য ও প্রক্সির মাধ্যমে ভর্তি বাণিজ্য এবং চাকরি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস। এই সব ছাত্র নেতাদের শিক্ষাবর্ষ শেষ হয় না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল লোকজন দেখেও না দেখার ভান করে বসে থাকে। যারা এর প্রতিবাদ করছে, তাদের ওপর পুলিশ এবং সরকারের পালিত হেলমেট ও লাঠিয়াল বাহিনী হামলে পড়ে। আদু ভাই ওই সব ছাত্র নেতাদের রুখতে না পারলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মেধারভিত্তিতে আবাসন সুবিধা হওয়া সম্ভব নয়, শিক্ষাঙ্গনের এহেন নৈরাজ্য প্রতিরোধে ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের মতো আরেকটি আন্দোলনের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে।

[লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি]

শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৩ আশ্বিন ১৪২৯ ১৯ সফর ১৪৪৪

বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন ও আজকের শিক্ষা

আকমল হোসেন

১৭ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক শিক্ষা দিবস। ১৯৬২ সালের এই দিনে শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে যেয়ে পুলিশের গুলিতে জীবন দিতে হয়েছিলো ছাত্রদের। দিবসটি সরকারিভাবে পালিত না হলেও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। শিক্ষার অধিকার আদায়ে ওই দিন ঢাকার রাজপথে তৎকালীন পাকিস্থান সরকারের পুলিশ বাহিনীর বুলেটে জীবন দিতে হয়েছিল মোস্তফা ওয়াজিল্লাহ, বাবুল প্রমুখ ছাত্র নেতাদের। সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের শাসন আমলে শরীফ কমিশনের নেতৃত্বে একটি শিক্ষানীতি প্রদান করা হয়েছিল। শিক্ষানীতির বেশ কিছু বক্তব্য তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থায় বেমানানই ছিল না অপ্রাসঙ্গিকও ছিল। এগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষা সংকোচন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বছর শেষে, পরীক্ষা ব্যবস্থা, ৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রি পাসকোর্স চালু এবং ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবনা অন্যতম। এগুলো বাতিলের দাবিতে ৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছিল। সেই ধর্মঘট পালনকালেই পুলিশি হত্যাকা- সংঘঠিত হয়, পরে আইয়ুব খান শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতি বাতিল করেছিল।

শিক্ষা কি? কেন এবং কীভাবে এটা প্রদান করা যায় সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভোগবাদী সমাজে মুনাফাভিত্তিক এবং পুঁজিবাদী সমাজে যেভাবে সব কিছুকে পণ্য ভাবা হয় এবং টাকা দিলে পণ্যের মতো সবই পাওয়া যায়Ñএমন প্রবণতা সৃষ্টির চেষ্টা চললেও এখনো অনেক দেশেই শিক্ষার সাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি আছে। সেই বিবেচনায় শিক্ষার দর্শন নির্ধারিত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য হওয়ার কথা নয়Ñএ জন্য ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়ন এর বিষয়েও উন্নতি হওয়া দরকার। ব্যক্তির দেহ ও মনের সব ক্ষমতা বিকশিত, বিবর্তিত মার্জিত করে, তাকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান নৈপুণ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে তোলার ব্যবস্থাদির নাম যদি শিক্ষা হয়, তাহলে মানবতাবাদী এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হলে শিক্ষার দর্শন, অর্থায়ন, ও ব্যবস্থাপনা এমন হবে, যেখানে সবার জন্য একই ধরনের অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষা হওয়া দরকার।

পৃথিবীর যে সব দেশ শিক্ষা, সংস্কৃতি আর অর্থনীতিতে এগিয়েছে, তাদের শিক্ষার ইতিহাস এমনটাই। শিক্ষার দর্শন হিসেবে ভাববাদ, যুক্তি, দর্শন সর্বশেষে বিজ্ঞানই অন্যতম মাধ্যম। এই ধারাবাহিকতাকে উপেক্ষা করে শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করলে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যুগের চাহিদা মিটাতে সক্ষম হবে কি? ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে লর্ড মেকলেকে দিয়ে সেই শিক্ষানীতি দেয়া হয়েছিল, যা অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন ও হিসাব-নিকাশ করার মতো একটি জাতি সৃষ্টি ছাড়া সৃজনশীল ও সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী বা অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানোর মতো চেতনাবোধ ওই শিক্ষাব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়নি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আলোকে এবং সংবিধানের ১৭ এর খ ধারার আলোকে একই ধারার সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। জাতীয় বাজেটে জিজিপির প্রাথমিকভাবে ৫ শতাংশ এবং পর্যায়ক্রমে ইউনেস্কোকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু একবারে ৩৫১৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারিকরণ করেছিলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর আমলে আরও ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়েছে, যদিও এখনো ৪ হাজারের মতো প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণের বাইরে রয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯০ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি অবস্থায় রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস সেই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থাকেও আবার সাম্প্রদায়িক করা হয়েছিল, আগে-পিছের স্তরে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার স্বীকৃতি না থাকলেও একবারে মাস্টার্স পর্যায়ের দাওরাকে সরকারের আইনি স্বীকৃতিকে শিক্ষাবিদদের ভাবিয়ে তুলেছে, শিক্ষায় ঘটেছে সাম্প্রদায়িকতা, এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে।

সংবিধানে একই ধারার সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের কথা থাকলেও বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা ও ইংরেজি মাধ্যমের (তিনধারার) শিক্ষা বহাল রয়েছে। শিক্ষায় অর্থায়ন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাড়েনি, শিক্ষা প্রশাসনে দলীয়করণের ভূত বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডিতে দলীয়করণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪টি বাদে সবগুলোতে দলীয়করণের ভূত চেপে বসেছে, ফলে দলীয়ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলায় তুলনামূলক কম যোগ্যতার লোক অগ্রাধিকার পাচ্ছে, ফলে শিক্ষার গুণগতমানের ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিশ^বিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজের টাকার কমিশন বণ্টনে সমঝোতা করতে দেখা যাচ্ছে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রভাবশালীদের। সৃজনশীল আর এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে এ+ আর গোল্ডেনের সংখ্যা বাড়লেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারছে না।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আন্তর্জাতিক মানের দিক থেকে অনেক নিচে অবস্থান করছে। বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় গ্রুপ অব কোম্পানির মালিকরা শিক্ষাব্যবসা শুরু করে শিক্ষার বারোটা বাজিয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের মধ্যে টাকা ভাগবাটোয়ারার ঘটনা এখন আদালতে গড়িয়েছে। মৌলিক অধিকার শিক্ষা আজ সুপার মার্কেটের পণ্যের মতো যার টাকা আছে, সেই সেটা কিনতে পারবে। এটি জীবন দিয়ে স্বাধীন করা একটি দেশের জন্য খুবই দুঃখজনক, তবে এটাই এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে, শিক্ষার দর্শনে মুক্তিযদ্ধের চেতনা ও ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিধান যেমন উপেক্ষিত হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নের ক্ষেত্রেই কোন ইতিবাচক অগ্রগতি হয়নি বরং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটির ক্ষমতাশীল আমলে শিক্ষা কারিকুলামে সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পেয়েছে। আগে-পিছের শিক্ষার একাডেমিক ও কারিকুলামগত স্বীকৃতি না থাকলেও কওমি মাদ্রাসার শেষ পর্যায়ের শিক্ষাকে মাস্টার্সের মর্যাদা শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে হ-য-ব-র-ল সৃষ্টি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই শিক্ষাকে কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না।

বিজ্ঞান যুক্তি আধুনিক সমাজে শিক্ষার বিষয়বস্তু হওয়া উচিত মানবিকতা, সৃজনশীলতা, যৌক্তিকতা ও উৎপাদনশীলতা। ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন দমনে পুলিশ ব্যবহার হয়েছিল আর আজকের আন্দোলন দমনে পুলিশ এবং হেলমেট বাহিনী ব্যবহার হচ্ছে, দুই আমলের পার্থক্য আগে ছিল বাঙালিরা পরাধীন আর এখন হয়েছে স্বাধীন। চাকরির ক্ষেত্রে কোটা আর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো সামাজিক আন্দেলনকে দমন করতে সরকার যে হামলা গ্রেপ্তার আর রিমান্ডের পথ অনুসরণ করেছিল তা গণতান্ত্রিক সরকারের আচরণ বলে মনে হয়নি। অন্যদিকে বিশ্বদ্যিালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে যখন উন্নয়ন তহবিলের টাকা রুলিং পার্টির ছাত্র সংগঠনের নেতাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়, তখন ওই ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তল্পিবাহক হওয়া ছাড়া ছাত্রসমাজের অধিকার আদায়ে কোন ভূমিকা রাখতে পারে না, পারছে না। স্বাধীন দেশে সব সময় সব সরকারের আমলেই এমনটা দেখা গেছে আজও তার ব্যতিক্রম নয়। নতুন করে শুরু হয়েেেছ রুলিং পার্টির ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সিট বাণিজ্য ও প্রক্সির মাধ্যমে ভর্তি বাণিজ্য এবং চাকরি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস। এই সব ছাত্র নেতাদের শিক্ষাবর্ষ শেষ হয় না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল লোকজন দেখেও না দেখার ভান করে বসে থাকে। যারা এর প্রতিবাদ করছে, তাদের ওপর পুলিশ এবং সরকারের পালিত হেলমেট ও লাঠিয়াল বাহিনী হামলে পড়ে। আদু ভাই ওই সব ছাত্র নেতাদের রুখতে না পারলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মেধারভিত্তিতে আবাসন সুবিধা হওয়া সম্ভব নয়, শিক্ষাঙ্গনের এহেন নৈরাজ্য প্রতিরোধে ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের মতো আরেকটি আন্দোলনের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে।

[লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি]