মায়ানমার সীমান্তে গোলার শব্দ চলছে

আতঙ্কে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে ঘুমধুম সীমান্তের মানুষ

মায়ানমারের চলমান পরিস্থিতিতে চরম আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তে বসবাসকারী মানুষ। নিরাপত্তার কারণে অন্যত্র স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে তুমব্রু এলাকার কোনারপাড়ার ৩৫টি পরিবার। পরিবর্তন করা হয়েছে এসএসসি পরীক্ষার ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রও। সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। আর সীমান্তে চলাচলে আরোপ করা হয়েছে বিধিনিষেধ।

সীমান্ত এলাকার মানুষ জানিয়েছে, মায়ানমারের অভ্যন্তরে গতকাল সকালেও কয়েকটি গোলার বিকট শব্দ শোনা গেছে। শুক্রবার রাতে বাংলাদেশের কোনারপাড়ায় এসে পড়া অবিস্ফোরিত মর্টার শেল নষ্ট করা হয়েছে।

ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু কোনারপাড়ার বাসিন্দা নুর হাসিনা জানান, তার বাড়িতে শুক্রবার রাতে এসে পড়ে একটি মর্টার শেল। যা বিস্ফোরিত হয়নি। তবে তার বাড়ির কিছু দূরে আরও ১টি মর্টার শেল পড়ে বিস্ফোরিত হয়। যার শব্দে কেঁদে উঠে নুর হাসিনার ৪ মাসের কন্যা শিশু। এই আতঙ্কে তার পুরো পরিবার এখন আশ্রয় নিয়েছে তুমব্রু মাঝেরপাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে।

নুর হাসিনা আরও জানান, মায়ানমারে সংঘাত চলছে মাস ধরে। এতদিন গোলার শব্দ শোনা গেছে। অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এপারে এসে পড়েছে। তবে শুক্রবার রাতে ৩টি মর্টার শেল বিস্ফোরণে হতাহত হওয়ার পর থেকে এখানে চরম আতঙ্কিত পরিবেশ বিরাজ করছে।

ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার দিল মোহাম্মদ ভুট্টো জানিয়েছেন, শুক্রবার রাতের ঘটনার পর থেকে আতঙ্কের মাত্রা বেড়েছে। গতকাল সকালে শোনা গেছে গোলাগুলির শব্দ। এ পরিস্থিতিতে তুমব্রু কোনারপাড়ার ৩৫টি পরিবার অন্যত্র নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে। যারা উখিয়ার বালুখালী, পালংখালী, টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকায় আত্মীয়দের বাড়ি চলে গেছেন। সীমান্তের আরও অনেকেই নিরাপত্তার কারণে অন্যত্র যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ জানিয়েছেন, ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে এসএসসি বন্ধ করে উখিয়ার কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, শুক্রবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সীমান্তে মায়ানমারে অভ্যন্তরে গোলাগুলি, মর্টার শেল বিস্ফোরণের পর গতকাল সকালেও কয়েকটি গোলার বিকট শব্দ হয়েছে। আর শূন্যরেখায় মর্টার শেলের বিস্ফোরণে আহতরা এখনও উখিয়ার কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। আর সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনায় চলাচলে বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে।

শূন্যরেখায় বসবাসকারী রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা (হেড মাঝি) দিল মোহাম্মদ জানান, আগের চেয়ে শুক্রবারের ঘটনার পর রোহিঙ্গারা আরও বেশি আতঙ্কিত রয়েছে। কিন্তু তারা এখনও শূন্য রেখায় অবস্থান করছেন। বুঝতে পারছে না কি করবেন।

তিনি জানান, মায়ানমার বারবারই শূন্য রেখার রোহিঙ্গাদের ওখান থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করে আসছে। শুক্রবার মর্টার শেল ইচ্ছে করে নিক্ষেপ করেছে বলে তিনি মনে করছেন।

এদিকে মায়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল বিস্ফোরণে ১ রোহিঙ্গা যুবক নিহত ও কয়েকজন আহতের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মায়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল বাংলাদেশে এসে পড়েছে। এতে হতাহতের ঘটনায় বিজিবির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে প্রতিবাদ জানানো হবে। তিনি আরও জানান, মায়ানমারের পরিস্থিতি বিজিবি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। মায়ানমারের কোন নাগরিক যেন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারেন সে বিষয়েও সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে বিজিবি।

শুক্রবার সকালে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের বাইশফাঁড়ি সীমান্তের কাছে মাইন বিস্ফোরণে বাংলাদেশি যুবক অংথোয়াইং তঞ্চঙ্গার (২২) একটি পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বর্তমানে তিনি চিকিৎসাধীন রয়েছেন। রাতে মর্টার শেল এসে পড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এতে এক রোহিঙ্গা নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে এবং কয়েকজন আহত হয়।

বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু’র কোনারপাড়া সীমান্তে গোলাবর্ষণ এবং মর্টার শেল নিক্ষেপে হতাহতের ঘটনায় নো ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মাঝে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনার পর থেকে নো ম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রিত রোহিঙ্গারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিধিরা।

এছাড়া আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে স্থানীয়রাও নিজেদের বৃদ্ধা মা-বাবা ও শিশুদের অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় তুমব্রু’র বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান। তিনি নিজেও তার বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও বাড়ির শিশুদের নাইক্ষ্যংছড়ি সদরে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে জানান। সীমান্তের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানে শুক্রবার রাতেই ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উখিয়া কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করেছে এসএসসি-সমমানের পরীক্ষা কেন্দ্র।

স্থানান্তরকৃত নতুন কেন্দ্রে ৪৯৯ জন পরীক্ষার্থী শনিবার পরীক্ষা দিয়েছে। এমনটাই জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস। তিনি আরও বলেন- সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে সতর্ক ও নিরাপদে থাকার কথা বলা হয়েছে এবং প্রশাসন সবকিছু পর্যবেক্ষণে রাখছেন বলেও জানান তিনি। শুক্রবার রাতে ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী কোনাপাড়া এলাকায় নো ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কয়েকটি মর্টার শেল বিস্ফোরণ হয়। এতে এক যুবক নিহত ও আরও ৫ রোহিঙ্গা আহত হন।

আহতরা উখিয়া কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে। তুমব্রু ২নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য দিল মুহাম্মদ ভূট্টো জানান, শুক্রবার সারারাত গোলাবর্ষণ ও মর্টার শেল নিক্ষেপের পর শনিবার সকাল থেকেও বিরতিহীনভাবে চলছে গোলাবর্ষণ। গুলির বিকট শব্দে এপারের ভূমি পর্যন্ত কেঁপে উঠছে। আতঙ্কে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না সাধারণ মানুষ। স্থানীয় কৃষক নুরুল ইসলাম জানান, সীমান্তে মায়ানমার সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণ বন্ধ নেই। ফলে তাদের কৃষি কাজ বন্ধ রয়েছে। সীমান্তে মাইন আতঙ্কেও ভূগছেন চাষিরা। স্থানীয় বাসিন্দা হাসিনা আক্তার বলেন, মায়ানমার থেকে ছোঁড়া মর্টার শেল তাদের বাড়ির উঠোনে পড়েছে। এছাড়া সারারাত বিকট শব্দে গুলির আওয়াজে বাড়ির শিশু-বৃদ্ধরা ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এদিকে বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভেজ তিবরীজি বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র স্থানান্তর করে কক্সবাজার নেয়া হয়েছে। সীমান্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি আরও বলেন, এই প?রি?স্থি?তি?তে ঘুমধু?মের এসএস?সি পরীক্ষা কেন্দ্রটি স?রি?য়ে কক্সবাজা?রের উখিয়ার কুতুপালং পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ঘুমধুমের এ পরীক্ষা কেন্দ্রে ৪৯৯ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ব?লেও জানান তি?নি। জেলা প্রশাসক আরও বলেন, নো ম্যান্স ল্যান্ডে ৩টির মতো গোলা এসে পড়লে একটি বিস্ফোরিত হয়। যারা হতাহত হয়েছেন তারা সবাই রোহিঙ্গা। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে নতুন করে কেউ যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে এজন্য স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছে।

উল্লেখ্য যে, গেল ৯ সেপ্টেম্বর বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের বাংলাদেশ অভ্যন্তরে মায়ানমার থেকে ছোড়া একটি বুলেট এসে পড়ে। ৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় মায়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দুটি গোলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকায় পড়ে। তার আগে ২৮ আগস্ট বিকেল ৩টার দিকে মায়ানমার থেকে নিক্ষেপ করা একটি মর্টার শেল অবিস্ফোরিত অবস্থায় ঘুমধুমের তুমব্রু উত্তর মসজিদের কাছে পড়েছিল। তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে নো ম্যান্স ল্যান্ডে ৫ বছর ধরে আশ্রয় ক্যাম্প গড়ে তুলে বসবাস করছেন মায়ানমারের বাড়ি-ঘর হারা ৪ হাজার ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পিছনেই মায়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া ও রাখাইন রাজ্যের একাধিক পাহাড়।

রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৪ আশ্বিন ১৪২৯ ২০ সফর ১৪৪৪

মায়ানমার সীমান্তে গোলার শব্দ চলছে

আতঙ্কে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে ঘুমধুম সীমান্তের মানুষ

জেলা বার্তা পরিবেশক, কক্সবাজার

image

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের বিপরীতে মায়ানমারের সড়ক পথ

মায়ানমারের চলমান পরিস্থিতিতে চরম আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তে বসবাসকারী মানুষ। নিরাপত্তার কারণে অন্যত্র স্বজনদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে তুমব্রু এলাকার কোনারপাড়ার ৩৫টি পরিবার। পরিবর্তন করা হয়েছে এসএসসি পরীক্ষার ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রও। সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। আর সীমান্তে চলাচলে আরোপ করা হয়েছে বিধিনিষেধ।

সীমান্ত এলাকার মানুষ জানিয়েছে, মায়ানমারের অভ্যন্তরে গতকাল সকালেও কয়েকটি গোলার বিকট শব্দ শোনা গেছে। শুক্রবার রাতে বাংলাদেশের কোনারপাড়ায় এসে পড়া অবিস্ফোরিত মর্টার শেল নষ্ট করা হয়েছে।

ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু কোনারপাড়ার বাসিন্দা নুর হাসিনা জানান, তার বাড়িতে শুক্রবার রাতে এসে পড়ে একটি মর্টার শেল। যা বিস্ফোরিত হয়নি। তবে তার বাড়ির কিছু দূরে আরও ১টি মর্টার শেল পড়ে বিস্ফোরিত হয়। যার শব্দে কেঁদে উঠে নুর হাসিনার ৪ মাসের কন্যা শিশু। এই আতঙ্কে তার পুরো পরিবার এখন আশ্রয় নিয়েছে তুমব্রু মাঝেরপাড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে।

নুর হাসিনা আরও জানান, মায়ানমারে সংঘাত চলছে মাস ধরে। এতদিন গোলার শব্দ শোনা গেছে। অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এপারে এসে পড়েছে। তবে শুক্রবার রাতে ৩টি মর্টার শেল বিস্ফোরণে হতাহত হওয়ার পর থেকে এখানে চরম আতঙ্কিত পরিবেশ বিরাজ করছে।

ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার দিল মোহাম্মদ ভুট্টো জানিয়েছেন, শুক্রবার রাতের ঘটনার পর থেকে আতঙ্কের মাত্রা বেড়েছে। গতকাল সকালে শোনা গেছে গোলাগুলির শব্দ। এ পরিস্থিতিতে তুমব্রু কোনারপাড়ার ৩৫টি পরিবার অন্যত্র নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছে। যারা উখিয়ার বালুখালী, পালংখালী, টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকায় আত্মীয়দের বাড়ি চলে গেছেন। সীমান্তের আরও অনেকেই নিরাপত্তার কারণে অন্যত্র যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ জানিয়েছেন, ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে এসএসসি বন্ধ করে উখিয়ার কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, শুক্রবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সীমান্তে মায়ানমারে অভ্যন্তরে গোলাগুলি, মর্টার শেল বিস্ফোরণের পর গতকাল সকালেও কয়েকটি গোলার বিকট শব্দ হয়েছে। আর শূন্যরেখায় মর্টার শেলের বিস্ফোরণে আহতরা এখনও উখিয়ার কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। আর সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনায় চলাচলে বিধিনিষেধ দেয়া হয়েছে।

শূন্যরেখায় বসবাসকারী রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা (হেড মাঝি) দিল মোহাম্মদ জানান, আগের চেয়ে শুক্রবারের ঘটনার পর রোহিঙ্গারা আরও বেশি আতঙ্কিত রয়েছে। কিন্তু তারা এখনও শূন্য রেখায় অবস্থান করছেন। বুঝতে পারছে না কি করবেন।

তিনি জানান, মায়ানমার বারবারই শূন্য রেখার রোহিঙ্গাদের ওখান থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করে আসছে। শুক্রবার মর্টার শেল ইচ্ছে করে নিক্ষেপ করেছে বলে তিনি মনে করছেন।

এদিকে মায়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল বিস্ফোরণে ১ রোহিঙ্গা যুবক নিহত ও কয়েকজন আহতের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মায়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল বাংলাদেশে এসে পড়েছে। এতে হতাহতের ঘটনায় বিজিবির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে প্রতিবাদ জানানো হবে। তিনি আরও জানান, মায়ানমারের পরিস্থিতি বিজিবি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। মায়ানমারের কোন নাগরিক যেন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারেন সে বিষয়েও সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে বিজিবি।

শুক্রবার সকালে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের বাইশফাঁড়ি সীমান্তের কাছে মাইন বিস্ফোরণে বাংলাদেশি যুবক অংথোয়াইং তঞ্চঙ্গার (২২) একটি পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বর্তমানে তিনি চিকিৎসাধীন রয়েছেন। রাতে মর্টার শেল এসে পড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এতে এক রোহিঙ্গা নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে এবং কয়েকজন আহত হয়।

বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু’র কোনারপাড়া সীমান্তে গোলাবর্ষণ এবং মর্টার শেল নিক্ষেপে হতাহতের ঘটনায় নো ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের মাঝে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনার পর থেকে নো ম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রিত রোহিঙ্গারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিধিরা।

এছাড়া আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে স্থানীয়রাও নিজেদের বৃদ্ধা মা-বাবা ও শিশুদের অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় তুমব্রু’র বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান। তিনি নিজেও তার বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও বাড়ির শিশুদের নাইক্ষ্যংছড়ি সদরে আত্মীয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে জানান। সীমান্তের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানে শুক্রবার রাতেই ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উখিয়া কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করেছে এসএসসি-সমমানের পরীক্ষা কেন্দ্র।

স্থানান্তরকৃত নতুন কেন্দ্রে ৪৯৯ জন পরীক্ষার্থী শনিবার পরীক্ষা দিয়েছে। এমনটাই জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস। তিনি আরও বলেন- সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে সতর্ক ও নিরাপদে থাকার কথা বলা হয়েছে এবং প্রশাসন সবকিছু পর্যবেক্ষণে রাখছেন বলেও জানান তিনি। শুক্রবার রাতে ঘুমধুম ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী কোনাপাড়া এলাকায় নো ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কয়েকটি মর্টার শেল বিস্ফোরণ হয়। এতে এক যুবক নিহত ও আরও ৫ রোহিঙ্গা আহত হন।

আহতরা উখিয়া কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছে। তুমব্রু ২নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য দিল মুহাম্মদ ভূট্টো জানান, শুক্রবার সারারাত গোলাবর্ষণ ও মর্টার শেল নিক্ষেপের পর শনিবার সকাল থেকেও বিরতিহীনভাবে চলছে গোলাবর্ষণ। গুলির বিকট শব্দে এপারের ভূমি পর্যন্ত কেঁপে উঠছে। আতঙ্কে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না সাধারণ মানুষ। স্থানীয় কৃষক নুরুল ইসলাম জানান, সীমান্তে মায়ানমার সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণ বন্ধ নেই। ফলে তাদের কৃষি কাজ বন্ধ রয়েছে। সীমান্তে মাইন আতঙ্কেও ভূগছেন চাষিরা। স্থানীয় বাসিন্দা হাসিনা আক্তার বলেন, মায়ানমার থেকে ছোঁড়া মর্টার শেল তাদের বাড়ির উঠোনে পড়েছে। এছাড়া সারারাত বিকট শব্দে গুলির আওয়াজে বাড়ির শিশু-বৃদ্ধরা ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এদিকে বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভেজ তিবরীজি বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র স্থানান্তর করে কক্সবাজার নেয়া হয়েছে। সীমান্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি আরও বলেন, এই প?রি?স্থি?তি?তে ঘুমধু?মের এসএস?সি পরীক্ষা কেন্দ্রটি স?রি?য়ে কক্সবাজা?রের উখিয়ার কুতুপালং পরীক্ষা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ঘুমধুমের এ পরীক্ষা কেন্দ্রে ৪৯৯ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ব?লেও জানান তি?নি। জেলা প্রশাসক আরও বলেন, নো ম্যান্স ল্যান্ডে ৩টির মতো গোলা এসে পড়লে একটি বিস্ফোরিত হয়। যারা হতাহত হয়েছেন তারা সবাই রোহিঙ্গা। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে নতুন করে কেউ যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে এজন্য স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে আছে।

উল্লেখ্য যে, গেল ৯ সেপ্টেম্বর বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের বাংলাদেশ অভ্যন্তরে মায়ানমার থেকে ছোড়া একটি বুলেট এসে পড়ে। ৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় মায়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দুটি গোলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকায় পড়ে। তার আগে ২৮ আগস্ট বিকেল ৩টার দিকে মায়ানমার থেকে নিক্ষেপ করা একটি মর্টার শেল অবিস্ফোরিত অবস্থায় ঘুমধুমের তুমব্রু উত্তর মসজিদের কাছে পড়েছিল। তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে নো ম্যান্স ল্যান্ডে ৫ বছর ধরে আশ্রয় ক্যাম্প গড়ে তুলে বসবাস করছেন মায়ানমারের বাড়ি-ঘর হারা ৪ হাজার ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পিছনেই মায়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া ও রাখাইন রাজ্যের একাধিক পাহাড়।