বাণিজ্য ঘাটতি কমবে কীভাবে

রেজাউল করিম খোকন

প্রথমবার এক অর্থবছরে রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর সুসংবাদ বিপুল আমদানির তথ্যে ম্লান হয়ে গেছে। কেননা বাড়তে থাকা বাণিজ্য ঘাটতি গত মে মাস শেষে প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে শুরু করেছে। রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় যেটুকু বেশি, তার পার্থক্যই বাণিজ্য ঘাটতি। আর চলতি হিসাবের মাধ্যমে দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝানো হয়।

আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

অবশ্য করোনাকালীন সময়ে যে হারে ঘাটতি বাড়বে বলে আশঙ্কা ছিল তেমন ঘটেনি। করোনার শুরুতে রপ্তানি যেমন কমে গিয়েছিল, অন্যদিকে আমদানিও ব্যাপক হারে কমে গিয়েছিল। তাতে কমে এসেছিল বাণিজ্য ঘাটতি। সম্প্রতি আবার বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে শুরু করেছে। মে পর্যন্ত ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে রপ্তানির চেয়ে আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায় এবং রেমিট্যান্সে নেতিবাচক ধারা বজায় থাকায় বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩০ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ঘাটতি বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ (১০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার)। আগের অর্থবছরের আলোচিত সময়ে যা ছিল ২০ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। এর প্রভাবে দেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতিও ১৭ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার পার করেছে, যেটিও দেশের ইতিহাসের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। এক মাস আগেও এপ্রিল শেষে যা ছিল ১৫ দশামিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। আর গত বছরের মে থেকে এক বছরের ব্যবধানে চলতি হিসাবের এ ঘাটতি ৬ গুণের বেশি বেড়েছে।

২০২০-২১ অর্থবছরের মে মাসে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এমন এক সময়ে রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসেবে ভারসাম্যের এ তথ্য প্রকাশিত হল যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ।

আমদানি ব্যয়ের চাপ মেটাতে গিয়ে ডলারের দাম বাড়ছে, ক্রমাগত মান হারাচ্ছে টাকা। বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে মূলত আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া। সে তুলনায় রপ্তানি বাড়েনি যদিও আগের চেয়ে বেড়েছে এবার। কিন্তু বৈশ্বিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার বিনিময় হার বেড়ে গেছে। এ কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়েছে টাকার অঙ্কেও।

আমদানি ব্যয় কমিয়ে এনে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে নেয়া একাধিক পদক্ষেপ যেমন, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে বিদেশ ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহ করতে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত মার্জিন আরোপ করা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায়নি।

ঘাটতি কমিয়ে আনতে ডিমান্ড কাট (চাহিদা কমিয়ে আনা) করতে হবে প্রথমেই। সরকার ইতোমধ্যে কিছু নীতি গ্রহণ করেছে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে, যেমন নতুন গাড়ি ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এ রকম কিছু সিদ্ধান্তের ফলে ৪০ হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় হতে পারে। বেসরকারি পর্যায়ে বেশকিছু পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, শুল্ক বাড়িয়ে চাহিদা যদি কমিয়ে আনা যায়, তাহলে আমদানি কমে যাবে কিছুটা তাতে বাণিজ্য ঘাটতিও কমে যাবে। তবে মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জন্য আবশ্যকীয় যেমন চাল-গমসহ খাদ্যপণ্যের যথেষ্ট সরবরাহ রাখতে সরকার চার লাখ টন চাল আমদানির বিশেষ সুযোগ দিয়েছে। অথচ ২০ লাখ টন সরবরাহ লাগবে। তাহলে দাম সমন্বয় হবে। এ রকম আরও কিছু পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বেশি জরুরি। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি একটু সমন্বয় হলেও তো ক্ষতি নেই। সরকার ইতোমধ্যে সেই দিকেই হাঁটছে। বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্ধ করে দিয়েছে।

চলতি হিসাবে এত ঘাটতিতে বাংলাদেশ এর আগে কখনই পড়েনি। গত ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ঘাটতিতে পরে এক সময়ে উদ্বৃত্ত থাকা চলতি হিসাবের ভারসাম্য। ওই অর্থবছর শেষে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার।

এই হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোন ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

বাণিজ্য ও চলতি হিসাবের ঘাটতির প্রভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার আর সস্তা হচ্ছে টাকা। বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরেও লেনদেন ভারসাম্যে বড় উদ্বৃত্ত দিয়ে অর্থবছর শুরু করেছিল কিন্তু শেষের দিকে তা ঋণাত্মকে চলে যায়। যে অংকের রপ্তানি আয় আসছে তার চেয়ে বেশি আমদানিতে খরচ করতে হচ্ছে। ফলে চলতি অর্থবছরের শুরুতেই বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। একইসঙ্গে চলতি হিসাব ও সামগ্রিক লেনদেনেও ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বাণিজ্য ভারসাম্য হচ্ছে কোন দেশের অর্থনীতির একটি নির্দিষ্ট সময়ের মোট রপ্তানি ও মোট আমদানির আর্থিক মূল্যের পার্থক্য। একে নেট রপ্তানিও বলা হয়ে থাকে অনেক সময়। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি দেশের আমদানি ও রপ্তানির মধ্যকার সম্পর্ক।

ইতিবাচক ভারসাম্যকে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বলে যখন আমদানির থেকে রপ্তানি বেশি হয়; ইতিবাচক ভারসাম্যকে বলা হয়। বাণিজ্য ঘাটতি যা রপ্তানির থেকে আমদানি বেশি হলে হয়। বাণিজ্য ভারসাম্যকে অনেক সময় পণ্য ও সেবার ভারসাম্য- এ দুই ভাগে ভাগ করা হয়।

ভারত থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি ব্যাপক হারে বেড়েছে। গত অর্থবছরে তাদের কাছ থেকে যেসব দেশ পণ্য আমদানি করেছে, তার মধ্যে চতুর্থ বৃহত্তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। দুই বছর আগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নবম। ভারত থেকে আমদানিই শুধু নয়, সে দেশে বাংলাদেশের রপ্তানিও বেড়েছে বড় অঙ্কে। তবে আমদানির সঙ্গে রপ্তানির তফাত অনেক বেশি। করোনার সংক্রমণ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে তুলনামূলক কম দূরত্বের বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্য উচ্চহারে বেড়েছে।

বাংলাদেশকে রপ্তানি বাড়ানোয় মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।

ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব। এর জন্য রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত মান পরিপালনের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তবে ভারতের বাজারে অনেক সময় অযৌক্তিকভাবে অশুল্ক বাধা আরোপ করা হয়।

অশুল্ক বাধা দূর করার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং রপ্তানিকারকদের নেগোসিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বর্তমানে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক

পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনা করেছে। বাংলাদেশ যথাযথ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এ চুক্তি করলে ভারতে রপ্তানি বাড়বে। একই সঙ্গে এ দেশে ভারতের বিনিয়োগ বাড়বে। ভারতের বিনিয়োগকারীদের উৎপাদিত পণ্য তাদের দেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি হবে। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে।

২০২০-২১ অর্থবছরে চীনে রপ্তানি করা হয়েছে ৬৮ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য। একই সময় চীন থেকে আমদানি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ চীনের বাজারে বাংলাদেশ ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত ও কোটামুুক্ত সুবিধা পায়। কিন্তু পণ্য বহুমুখীকরণ ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতার অভাবে রপ্তানি বাণিজ্যের এ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এই সুবিধা কাজে লাগাতে হলে চীনের বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্ব দিতে হবে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে পণ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগের মাধ্যমে রপ্তানি বাড়ানো গেলে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে। বাংলাদেশ থেকে ছোট ছোট কিছু পণ্য গেলেও বেশির ভাগ রপ্তানি পোশাক খাতের ওপর নির্ভর। অন্যদিকে চীন বিশ্বের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। তাই রপ্তানি বাড়াতে পোশাকের বাইরে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, প্লাস্টিক, চামড়াজাত পণ্যে জোর দেওয়া হচ্ছে। পণ্য বৈচিত্র্য নিয়ে বাংলাদেশ কাজ করছে। এ ছাড়া দেশটিতে যাতায়াত ও ভিসা জটিলতা।

বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি বাজারগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, জাপান, চীন, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, সুইডেন, রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত।

বাংলাদেশের অর্থনীতি রপ্তানিনির্ভর। এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেলে দেশের সার্বিক কর্মসংস্থানসহ সেবা খাতেও এর প্রভাব পড়বে। ফলে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে করণীয় নির্ধারণসহ পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুন বাজার অনুসন্ধান ও পণ্য বৈচিত্র্যকরণের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে বর্তমান রপ্তানি পণ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ছে প্রায় সময়েই। অনেক বাধাবিপত্তির কারণে মাঝেমধ্যে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য হোঁচট খাচ্ছে। তেমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর বাণিজ্যিক লেনদেন বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

বর্তমানে যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য চালু রয়েছে তার বাইরে আরও নতুন দেশে বাজার খোঁজার চেষ্টা জোরালো করতে হবে। রপ্তানি বাণিজ্যের বিকাশ ঘটাতে হলে আমাদের উৎপাদিত পণ্যের মান উন্নত করতে হবে।

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্রান্ডের পন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ায় এর বাজার বিস্তৃতির উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সময়োপযোগী, কার্যকর, বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৩ আশ্বিন ১৪২৯ ২১ সফর ১৪৪৪

বাণিজ্য ঘাটতি কমবে কীভাবে

রেজাউল করিম খোকন

প্রথমবার এক অর্থবছরে রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর সুসংবাদ বিপুল আমদানির তথ্যে ম্লান হয়ে গেছে। কেননা বাড়তে থাকা বাণিজ্য ঘাটতি গত মে মাস শেষে প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে শুরু করেছে। রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় যেটুকু বেশি, তার পার্থক্যই বাণিজ্য ঘাটতি। আর চলতি হিসাবের মাধ্যমে দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝানো হয়।

আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

অবশ্য করোনাকালীন সময়ে যে হারে ঘাটতি বাড়বে বলে আশঙ্কা ছিল তেমন ঘটেনি। করোনার শুরুতে রপ্তানি যেমন কমে গিয়েছিল, অন্যদিকে আমদানিও ব্যাপক হারে কমে গিয়েছিল। তাতে কমে এসেছিল বাণিজ্য ঘাটতি। সম্প্রতি আবার বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে শুরু করেছে। মে পর্যন্ত ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে রপ্তানির চেয়ে আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ায় এবং রেমিট্যান্সে নেতিবাচক ধারা বজায় থাকায় বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে ৩০ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ঘাটতি বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ (১০ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার)। আগের অর্থবছরের আলোচিত সময়ে যা ছিল ২০ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। এর প্রভাবে দেশের বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঘাটতিও ১৭ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার পার করেছে, যেটিও দেশের ইতিহাসের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। এক মাস আগেও এপ্রিল শেষে যা ছিল ১৫ দশামিক ৪২ বিলিয়ন ডলার। আর গত বছরের মে থেকে এক বছরের ব্যবধানে চলতি হিসাবের এ ঘাটতি ৬ গুণের বেশি বেড়েছে।

২০২০-২১ অর্থবছরের মে মাসে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। এমন এক সময়ে রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি ও চলতি হিসেবে ভারসাম্যের এ তথ্য প্রকাশিত হল যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ।

আমদানি ব্যয়ের চাপ মেটাতে গিয়ে ডলারের দাম বাড়ছে, ক্রমাগত মান হারাচ্ছে টাকা। বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে মূলত আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া। সে তুলনায় রপ্তানি বাড়েনি যদিও আগের চেয়ে বেড়েছে এবার। কিন্তু বৈশ্বিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি ও টাকার বিনিময় হার বেড়ে গেছে। এ কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে গিয়েছে টাকার অঙ্কেও।

আমদানি ব্যয় কমিয়ে এনে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে নেয়া একাধিক পদক্ষেপ যেমন, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে বিদেশ ভ্রমণে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহ করতে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত মার্জিন আরোপ করা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের তেমন কোনো প্রভাব দেখা যায়নি।

ঘাটতি কমিয়ে আনতে ডিমান্ড কাট (চাহিদা কমিয়ে আনা) করতে হবে প্রথমেই। সরকার ইতোমধ্যে কিছু নীতি গ্রহণ করেছে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে, যেমন নতুন গাড়ি ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এ রকম কিছু সিদ্ধান্তের ফলে ৪০ হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় হতে পারে। বেসরকারি পর্যায়ে বেশকিছু পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, শুল্ক বাড়িয়ে চাহিদা যদি কমিয়ে আনা যায়, তাহলে আমদানি কমে যাবে কিছুটা তাতে বাণিজ্য ঘাটতিও কমে যাবে। তবে মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জন্য আবশ্যকীয় যেমন চাল-গমসহ খাদ্যপণ্যের যথেষ্ট সরবরাহ রাখতে সরকার চার লাখ টন চাল আমদানির বিশেষ সুযোগ দিয়েছে। অথচ ২০ লাখ টন সরবরাহ লাগবে। তাহলে দাম সমন্বয় হবে। এ রকম আরও কিছু পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বেশি জরুরি। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি একটু সমন্বয় হলেও তো ক্ষতি নেই। সরকার ইতোমধ্যে সেই দিকেই হাঁটছে। বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্ধ করে দিয়েছে।

চলতি হিসাবে এত ঘাটতিতে বাংলাদেশ এর আগে কখনই পড়েনি। গত ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ঘাটতিতে পরে এক সময়ে উদ্বৃত্ত থাকা চলতি হিসাবের ভারসাম্য। ওই অর্থবছর শেষে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার।

এই হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো, নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোন ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

বাণিজ্য ও চলতি হিসাবের ঘাটতির প্রভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে ডলারের বাজার আর সস্তা হচ্ছে টাকা। বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরেও লেনদেন ভারসাম্যে বড় উদ্বৃত্ত দিয়ে অর্থবছর শুরু করেছিল কিন্তু শেষের দিকে তা ঋণাত্মকে চলে যায়। যে অংকের রপ্তানি আয় আসছে তার চেয়ে বেশি আমদানিতে খরচ করতে হচ্ছে। ফলে চলতি অর্থবছরের শুরুতেই বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। একইসঙ্গে চলতি হিসাব ও সামগ্রিক লেনদেনেও ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বাণিজ্য ভারসাম্য হচ্ছে কোন দেশের অর্থনীতির একটি নির্দিষ্ট সময়ের মোট রপ্তানি ও মোট আমদানির আর্থিক মূল্যের পার্থক্য। একে নেট রপ্তানিও বলা হয়ে থাকে অনেক সময়। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি দেশের আমদানি ও রপ্তানির মধ্যকার সম্পর্ক।

ইতিবাচক ভারসাম্যকে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বলে যখন আমদানির থেকে রপ্তানি বেশি হয়; ইতিবাচক ভারসাম্যকে বলা হয়। বাণিজ্য ঘাটতি যা রপ্তানির থেকে আমদানি বেশি হলে হয়। বাণিজ্য ভারসাম্যকে অনেক সময় পণ্য ও সেবার ভারসাম্য- এ দুই ভাগে ভাগ করা হয়।

ভারত থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি ব্যাপক হারে বেড়েছে। গত অর্থবছরে তাদের কাছ থেকে যেসব দেশ পণ্য আমদানি করেছে, তার মধ্যে চতুর্থ বৃহত্তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। দুই বছর আগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নবম। ভারত থেকে আমদানিই শুধু নয়, সে দেশে বাংলাদেশের রপ্তানিও বেড়েছে বড় অঙ্কে। তবে আমদানির সঙ্গে রপ্তানির তফাত অনেক বেশি। করোনার সংক্রমণ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সরবরাহ চেইন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে তুলনামূলক কম দূরত্বের বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্য উচ্চহারে বেড়েছে।

বাংলাদেশকে রপ্তানি বাড়ানোয় মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।

ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব। এর জন্য রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত মান পরিপালনের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তবে ভারতের বাজারে অনেক সময় অযৌক্তিকভাবে অশুল্ক বাধা আরোপ করা হয়।

অশুল্ক বাধা দূর করার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং রপ্তানিকারকদের নেগোসিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বর্তমানে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক

পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনা করেছে। বাংলাদেশ যথাযথ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এ চুক্তি করলে ভারতে রপ্তানি বাড়বে। একই সঙ্গে এ দেশে ভারতের বিনিয়োগ বাড়বে। ভারতের বিনিয়োগকারীদের উৎপাদিত পণ্য তাদের দেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি হবে। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে।

২০২০-২১ অর্থবছরে চীনে রপ্তানি করা হয়েছে ৬৮ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য। একই সময় চীন থেকে আমদানি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ চীনের বাজারে বাংলাদেশ ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত ও কোটামুুক্ত সুবিধা পায়। কিন্তু পণ্য বহুমুখীকরণ ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতার অভাবে রপ্তানি বাণিজ্যের এ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এই সুবিধা কাজে লাগাতে হলে চীনের বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্ব দিতে হবে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে পণ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগের মাধ্যমে রপ্তানি বাড়ানো গেলে বাণিজ্য ঘাটতি কমবে। বাংলাদেশ থেকে ছোট ছোট কিছু পণ্য গেলেও বেশির ভাগ রপ্তানি পোশাক খাতের ওপর নির্ভর। অন্যদিকে চীন বিশ্বের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। তাই রপ্তানি বাড়াতে পোশাকের বাইরে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম, প্লাস্টিক, চামড়াজাত পণ্যে জোর দেওয়া হচ্ছে। পণ্য বৈচিত্র্য নিয়ে বাংলাদেশ কাজ করছে। এ ছাড়া দেশটিতে যাতায়াত ও ভিসা জটিলতা।

বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি বাজারগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, জাপান, চীন, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, সুইডেন, রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত।

বাংলাদেশের অর্থনীতি রপ্তানিনির্ভর। এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেলে দেশের সার্বিক কর্মসংস্থানসহ সেবা খাতেও এর প্রভাব পড়বে। ফলে রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে করণীয় নির্ধারণসহ পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুন বাজার অনুসন্ধান ও পণ্য বৈচিত্র্যকরণের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে বর্তমান রপ্তানি পণ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ছে প্রায় সময়েই। অনেক বাধাবিপত্তির কারণে মাঝেমধ্যে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য হোঁচট খাচ্ছে। তেমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর বাণিজ্যিক লেনদেন বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

বর্তমানে যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য চালু রয়েছে তার বাইরে আরও নতুন দেশে বাজার খোঁজার চেষ্টা জোরালো করতে হবে। রপ্তানি বাণিজ্যের বিকাশ ঘটাতে হলে আমাদের উৎপাদিত পণ্যের মান উন্নত করতে হবে।

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ব্রান্ডের পন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ায় এর বাজার বিস্তৃতির উজ্জ্বল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং নতুন বাজার সৃষ্টির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সময়োপযোগী, কার্যকর, বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]