মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য রিডিং কম্পিটিশন

সন্ধ্যা রানী সাহা

স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে শ্রেণীকক্ষে যে চিত্রটি লক্ষ্য করা যায় তাহলো ভর্তিকৃত সব শিশু প্রতিদিন উপস্থিত হয় না। কদাচিৎ কোনো বিদ্যালয়ে মাত্র একটি বা দুটি শ্রেণীতে সব শিশুদের উপস্থিত পাওয়া যায়। যে শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত তাদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তেমন তাগিদ চোখে পড়ে না।

অথচ শিক্ষার্থীদের শতভাগ হাজিরা নিশ্চিত করতে স্কুলের ক্যাচমেন্ট-এরিয়াভিত্তিক হোমভিজিট, মা-সমাবেশ, উঠান-বৈঠক, মোবাইল ফোনে খোঁজখবর নেয়া ইত্যাদি পদ্ধতি অবলম্বনের বিধান আছে।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের পঠন-দক্ষতার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সংশ্লিষ্টরা যে কথাগুলো প্রায়ই বলে থাকেন তা হলো, “শিশু বাড়িতে পড়তে পারে না, তাদের অভিভাবক নিরক্ষর, অসচেতন, বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রাপ্ত দম্পতির সন্তান, হতদরিদ্র বলে কৃষিকাজ করতে যায়, মেধা অনেক কম বা করোনার সময়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল ইত্যাদি।” কেউ বলতে চায় না যে, “এরা আমাদের শিশু, এরা আমাদেরই সন্তান এবং জাতীয় সম্পদ”। শিশুদের প্রতি ঋণাত্মক যে কোন ধরনের মনোভাব বদলানো জরুরি। কারণ, এদের ওপরই নির্ভর করছে দেশের আর্থসামাজিক সাফল্য।

সুতরাং দ্রুত সব শিশুর দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। এজন্য চাই শিশুর পঠন-দক্ষতা বৃদ্ধি। তাহলে তারা নিজেরা পড়ে এবং বুঝে সমাজের বহু জটিল বিষয় নিজেরাই সমাধান করে নিতে পারবে। আর এ থেকেই মাথায় আসে কীভাবে তাদের পঠন-দক্ষতা বাড়ানো যায়।

করোনা মহামারীর কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে টানা ১৮ মাস সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে সরাসরি পাঠদান প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। সে সময়ে টেলিভিশন, রেডিও এবং অনলাইনে ক্লাস চলমান ছিল। তা ছাড়া অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমেও শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা চালিয়ে নেবার প্রচেষ্টা হয়েছে। তথাপি এসব কার্যকমে সবাইকে যুক্ত করা প্রাথমিক পর্যায়ে সেভাবে সম্ভব হবে না ভেবে সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলায় আমার প্রস্তাব মোতাবেক উপজেলা পরিষদের (জুলাই ২০২০ এর রেজল্যুশন অনুযায়ী) সম¥তিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠদান করবেন। সে অনুযায়ী শিক্ষকরা পাঠদানে নিয়োজিত থেকে ফেসবুকে তা আপলোড করতেন।

অবশ্য সব শিক্ষককে এ কাজে সমানভাবে নিয়োজিত করা সম্ভব হয়নি। কারণ, অনেকে অন্যত্র অবস্থান করছিলেন। তারপরও কতটুকু অগ্রসর হওয়া গেছে, তার তো একটি যাচাই হওয়া প্রয়োজন। মূলত এসব চিন্তা করেই বিদ্যালয় পুরোপুরি খোলার পর আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয়ের সঙ্গে পরামর্শক্রমে মে, ২০২২ সালে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়–য়া যে সব শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের পাঁচ ভাগে ভাগ করলাম। যেমন : সাবলীলভাবে পড়তে পারে, বানান করে পড়তে পারে, শিক্ষকের আংশিক সহযোগিতা নিয়ে পড়তে পারে, শিক্ষকের সম্পূর্ণ সহায়তা নিয়ে পড়তে পারে এবং পড়তে পারে না। এর পর যারা সাবলীলভাবে পড়তে পারে তাদের সহায়তায় শিক্ষকরা যেন বাকি সবাইকে সাবলীলভাবে পড়তে পারা, শিখতে পারা, সে বিষয়ে উৎসাহিত করে দুই মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়। বলা হয় উক্ত দুই মাসে উপজেলার সব বিদ্যালয়ের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বাংলা ও ইংরেজি রিডিং সাবলীলভাবে পড়তে পারাটা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের রিডিং পড়া শেখানোর অর্থ হলো শল্য চিকিৎসক না হয়েও চক্ষুদান করতে পারা। আজকে আমরা যারা শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হতে পেরেছি তারা কারা? তারা নিশ্চয়ই আমরা যারা আগেভাগে রিডিং পড়া শিখিয়েছিলাম। আমরা হয়ত সচেতন অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে রিডিং পড়া শিখেছিলাম কিন্তু সরকার বর্তমানে আমাদের সেই সচেতন অভিভাবক হিসেবে শিশুদের জন্য বেতনভুক্ত করে নিয়োজিত করেছে। অত্রএব এই সব শিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি।

আমরা যদি শিশুদের রিডিং পড়া শিখিয়ে দেই তাহলে আমরা বিশ^াস না বুঝে চাকরি ক্ষেত্রে এ যাবৎ যদি কোনো গাফলাতি হয়ে থাকে, তাহলে সে গ্লানি থেকে আমাদের মুক্ত করবে। জুন ২০২২ থেকে জুলাই ২০২২ এই দুই মাস সবাই মিলে সচেষ্ট থেকে ১৭ আগস্ট ২০২২ উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত করা হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক রিডিং কম্পিটিশনের। কামারখন্দ উপজেলার চার ইউনিয়ন থেকে ১১ আগস্ট ২০২২ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারগণের নেতৃত্বে বাছাইকৃত বাংলায় ১০০ জন এবং ইংরেজিতে ১০০ জন এই মোট ২০০ শিক্ষার্থীকে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। উপজেলা শিক্ষা অফিস ব্যতিরকে অন্য ১৬টি দপ্তরের প্রধানরা এই প্রতিযোগিতার বিচারকের দায়িত্ব পালন করে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা এব উৎসাহিত করেন।

করোনার বন্ধের সময় কামারখন্দের শিক্ষকবৃন্দ যে কাজ করেছেন তার প্রমাণ এই রিডিং প্রতিযোগিতায় তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের চতুর্থ এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমানভাবে অংশগ্রহণ করা। এখন কামারখন্দের দুয়েকজন শিক্ষার্থী ছাড়া (বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন কিংবা অন্য কোন গুরুতর সমস্যাগ্রস্ত) তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির সব শিক্ষার্থী পড়তে পারে। এই কৃতিত্ব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যারা রিডিং কম্পিটিশনকে সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছেন। ইতিপূর্বে ২০১৯ সালে কামারখন্দে এই প্রতিযোগিতা প্রথম হয়েছিল।

২০২০ এবং ২০২১ সালে করোনা মহামারীর কারণে তা বন্ধ ছিল। শুনেছি উচ্চবিদ্যালয়সমূহে পরিদর্শক গেলে শিক্ষকবৃন্দ বলে থাকেন- “প্রাইমারি থেকে কিছু শিখে আসেনি তাই শিক্ষার্থীরা পারে না”। কথাটি সর্বাংশে সত্য নয়। কারণ, প্রাইভেট পড়ানোর সময় কিন্তু তারা পড়তে না পারার বিষয়টি অভিভাবকদের না জানিয়েই পড়িয়ে যান। আর আমরা বিএ, এমএ পাস করলেও কী সব কিছুর সঠিক করে পড়তে, লিখতে এবং বুঝতে পারি? জীবনব্যাপী মানুষকে পড়ালেখা করতে হয়।

কাজেই নিরুৎসাহিত না করে কিছু সময় ব্যয় করে শিক্ষার্থীকে পড়তে পারা শিখিয়ে দিতে ক্ষতি কী? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার আলস্য ও সৌন্দর্য প্রবন্ধে যথাযর্থই বলেছেন-“এই জড়তা, অবিশ^াস ও অহংকার চিরদিন থাকিবে না। দীপ

আপন নির্বাপিত শিখার স্তূতিমাত্র লইয়া শুধু অহনির্শি দুর্গন্ধ ধুম বিস্তার করিয়াই আপনাকে সার্থক জ্ঞান করিবে তাহা বিশ^াস হয় না। জ্বলন্ত প্রদীপের স্পর্শে সে আবার জ্বলিয়া উঠিবে এবং সে আলোক তাহার নিজেরাই আলোক হইবে”।

কাজেই এভাবে সবাই মিলে দেশের সর্বত্র রিডিং পড়া শেখানোকে উৎসাহিত করতে পারলে শিক্ষা শুধু শিক্ষিত লোকের সন্তানদের লাভের বিষয় হয়ে থাকবে না। তা নিরক্ষর বাবা-মায়ের সন্তানদেরও সমানভাবে লাভের যোগ্য বিষয়ে পরিণত হবে।

আমাদের এই রিডিং কম্পিটিশনকে কেন্দ্র করে শিক্ষকবৃন্দ তাদের একাগ্রতা, পরার্থপরতা, পক্ষপাতহীন আচরণ সর্বোপরী সম্মোহনী ক্ষমতার সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার করেছেন। আজকে শিক্ষকবৃন্দ যতœ সহকারে রিডিং পড়া শেখানোর জন্য শিক্ষার্থী নিজে পড়তে পারছে। কী পড়ছে, তা বুঝতে পারছে। এতে তারা আনন্দিত হচ্ছে।

বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। বিদ্যালয়কে নিজের জায়গা বলে মনে করছে। উপস্থিতিও বাড়ছে। বাংলা পড়তে পারার ফলে শিক্ষার্থীদের গাণিতিক দক্ষতা অর্জন করানোর কাজটিও সহজ হয়ে যাচ্ছে। তারা ইংরেজিতে কথোপকথন করতে শিখছে।

সব মিলে অতি অল্প সময়ের প্রস্তুতিতে আয়োজিত আমাদের এই রিডিং কম্পিটিশনটি যেন শিক্ষার্থীদের পর্যায়ক্রমে উপজেলা পর্যন্ত নিয়ে এসে অরুণ আলোর স্বর্ণ রেণু মাখিয়ে দিল। এখন তারা ছুটবে নক্ষত্রে পরিণত হওয়ার বাসনায়।

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার, কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]

সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৩ আশ্বিন ১৪২৯ ২১ সফর ১৪৪৪

মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার জন্য রিডিং কম্পিটিশন

সন্ধ্যা রানী সাহা

স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে শ্রেণীকক্ষে যে চিত্রটি লক্ষ্য করা যায় তাহলো ভর্তিকৃত সব শিশু প্রতিদিন উপস্থিত হয় না। কদাচিৎ কোনো বিদ্যালয়ে মাত্র একটি বা দুটি শ্রেণীতে সব শিশুদের উপস্থিত পাওয়া যায়। যে শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত তাদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তেমন তাগিদ চোখে পড়ে না।

অথচ শিক্ষার্থীদের শতভাগ হাজিরা নিশ্চিত করতে স্কুলের ক্যাচমেন্ট-এরিয়াভিত্তিক হোমভিজিট, মা-সমাবেশ, উঠান-বৈঠক, মোবাইল ফোনে খোঁজখবর নেয়া ইত্যাদি পদ্ধতি অবলম্বনের বিধান আছে।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের পঠন-দক্ষতার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে সংশ্লিষ্টরা যে কথাগুলো প্রায়ই বলে থাকেন তা হলো, “শিশু বাড়িতে পড়তে পারে না, তাদের অভিভাবক নিরক্ষর, অসচেতন, বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রাপ্ত দম্পতির সন্তান, হতদরিদ্র বলে কৃষিকাজ করতে যায়, মেধা অনেক কম বা করোনার সময়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিল ইত্যাদি।” কেউ বলতে চায় না যে, “এরা আমাদের শিশু, এরা আমাদেরই সন্তান এবং জাতীয় সম্পদ”। শিশুদের প্রতি ঋণাত্মক যে কোন ধরনের মনোভাব বদলানো জরুরি। কারণ, এদের ওপরই নির্ভর করছে দেশের আর্থসামাজিক সাফল্য।

সুতরাং দ্রুত সব শিশুর দিকে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। এজন্য চাই শিশুর পঠন-দক্ষতা বৃদ্ধি। তাহলে তারা নিজেরা পড়ে এবং বুঝে সমাজের বহু জটিল বিষয় নিজেরাই সমাধান করে নিতে পারবে। আর এ থেকেই মাথায় আসে কীভাবে তাদের পঠন-দক্ষতা বাড়ানো যায়।

করোনা মহামারীর কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে টানা ১৮ মাস সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে সরাসরি পাঠদান প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। সে সময়ে টেলিভিশন, রেডিও এবং অনলাইনে ক্লাস চলমান ছিল। তা ছাড়া অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমেও শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা চালিয়ে নেবার প্রচেষ্টা হয়েছে। তথাপি এসব কার্যকমে সবাইকে যুক্ত করা প্রাথমিক পর্যায়ে সেভাবে সম্ভব হবে না ভেবে সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলায় আমার প্রস্তাব মোতাবেক উপজেলা পরিষদের (জুলাই ২০২০ এর রেজল্যুশন অনুযায়ী) সম¥তিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠদান করবেন। সে অনুযায়ী শিক্ষকরা পাঠদানে নিয়োজিত থেকে ফেসবুকে তা আপলোড করতেন।

অবশ্য সব শিক্ষককে এ কাজে সমানভাবে নিয়োজিত করা সম্ভব হয়নি। কারণ, অনেকে অন্যত্র অবস্থান করছিলেন। তারপরও কতটুকু অগ্রসর হওয়া গেছে, তার তো একটি যাচাই হওয়া প্রয়োজন। মূলত এসব চিন্তা করেই বিদ্যালয় পুরোপুরি খোলার পর আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয়ের সঙ্গে পরামর্শক্রমে মে, ২০২২ সালে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়–য়া যে সব শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের পাঁচ ভাগে ভাগ করলাম। যেমন : সাবলীলভাবে পড়তে পারে, বানান করে পড়তে পারে, শিক্ষকের আংশিক সহযোগিতা নিয়ে পড়তে পারে, শিক্ষকের সম্পূর্ণ সহায়তা নিয়ে পড়তে পারে এবং পড়তে পারে না। এর পর যারা সাবলীলভাবে পড়তে পারে তাদের সহায়তায় শিক্ষকরা যেন বাকি সবাইকে সাবলীলভাবে পড়তে পারা, শিখতে পারা, সে বিষয়ে উৎসাহিত করে দুই মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়। বলা হয় উক্ত দুই মাসে উপজেলার সব বিদ্যালয়ের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বাংলা ও ইংরেজি রিডিং সাবলীলভাবে পড়তে পারাটা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষার্থীদের রিডিং পড়া শেখানোর অর্থ হলো শল্য চিকিৎসক না হয়েও চক্ষুদান করতে পারা। আজকে আমরা যারা শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হতে পেরেছি তারা কারা? তারা নিশ্চয়ই আমরা যারা আগেভাগে রিডিং পড়া শিখিয়েছিলাম। আমরা হয়ত সচেতন অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানে রিডিং পড়া শিখেছিলাম কিন্তু সরকার বর্তমানে আমাদের সেই সচেতন অভিভাবক হিসেবে শিশুদের জন্য বেতনভুক্ত করে নিয়োজিত করেছে। অত্রএব এই সব শিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি।

আমরা যদি শিশুদের রিডিং পড়া শিখিয়ে দেই তাহলে আমরা বিশ^াস না বুঝে চাকরি ক্ষেত্রে এ যাবৎ যদি কোনো গাফলাতি হয়ে থাকে, তাহলে সে গ্লানি থেকে আমাদের মুক্ত করবে। জুন ২০২২ থেকে জুলাই ২০২২ এই দুই মাস সবাই মিলে সচেষ্ট থেকে ১৭ আগস্ট ২০২২ উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত করা হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নিয়ে এক রিডিং কম্পিটিশনের। কামারখন্দ উপজেলার চার ইউনিয়ন থেকে ১১ আগস্ট ২০২২ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারগণের নেতৃত্বে বাছাইকৃত বাংলায় ১০০ জন এবং ইংরেজিতে ১০০ জন এই মোট ২০০ শিক্ষার্থীকে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। উপজেলা শিক্ষা অফিস ব্যতিরকে অন্য ১৬টি দপ্তরের প্রধানরা এই প্রতিযোগিতার বিচারকের দায়িত্ব পালন করে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা এব উৎসাহিত করেন।

করোনার বন্ধের সময় কামারখন্দের শিক্ষকবৃন্দ যে কাজ করেছেন তার প্রমাণ এই রিডিং প্রতিযোগিতায় তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের চতুর্থ এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমানভাবে অংশগ্রহণ করা। এখন কামারখন্দের দুয়েকজন শিক্ষার্থী ছাড়া (বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন কিংবা অন্য কোন গুরুতর সমস্যাগ্রস্ত) তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির সব শিক্ষার্থী পড়তে পারে। এই কৃতিত্ব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যারা রিডিং কম্পিটিশনকে সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছেন। ইতিপূর্বে ২০১৯ সালে কামারখন্দে এই প্রতিযোগিতা প্রথম হয়েছিল।

২০২০ এবং ২০২১ সালে করোনা মহামারীর কারণে তা বন্ধ ছিল। শুনেছি উচ্চবিদ্যালয়সমূহে পরিদর্শক গেলে শিক্ষকবৃন্দ বলে থাকেন- “প্রাইমারি থেকে কিছু শিখে আসেনি তাই শিক্ষার্থীরা পারে না”। কথাটি সর্বাংশে সত্য নয়। কারণ, প্রাইভেট পড়ানোর সময় কিন্তু তারা পড়তে না পারার বিষয়টি অভিভাবকদের না জানিয়েই পড়িয়ে যান। আর আমরা বিএ, এমএ পাস করলেও কী সব কিছুর সঠিক করে পড়তে, লিখতে এবং বুঝতে পারি? জীবনব্যাপী মানুষকে পড়ালেখা করতে হয়।

কাজেই নিরুৎসাহিত না করে কিছু সময় ব্যয় করে শিক্ষার্থীকে পড়তে পারা শিখিয়ে দিতে ক্ষতি কী? কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার আলস্য ও সৌন্দর্য প্রবন্ধে যথাযর্থই বলেছেন-“এই জড়তা, অবিশ^াস ও অহংকার চিরদিন থাকিবে না। দীপ

আপন নির্বাপিত শিখার স্তূতিমাত্র লইয়া শুধু অহনির্শি দুর্গন্ধ ধুম বিস্তার করিয়াই আপনাকে সার্থক জ্ঞান করিবে তাহা বিশ^াস হয় না। জ্বলন্ত প্রদীপের স্পর্শে সে আবার জ্বলিয়া উঠিবে এবং সে আলোক তাহার নিজেরাই আলোক হইবে”।

কাজেই এভাবে সবাই মিলে দেশের সর্বত্র রিডিং পড়া শেখানোকে উৎসাহিত করতে পারলে শিক্ষা শুধু শিক্ষিত লোকের সন্তানদের লাভের বিষয় হয়ে থাকবে না। তা নিরক্ষর বাবা-মায়ের সন্তানদেরও সমানভাবে লাভের যোগ্য বিষয়ে পরিণত হবে।

আমাদের এই রিডিং কম্পিটিশনকে কেন্দ্র করে শিক্ষকবৃন্দ তাদের একাগ্রতা, পরার্থপরতা, পক্ষপাতহীন আচরণ সর্বোপরী সম্মোহনী ক্ষমতার সর্বোত্তম সদ্ব্যবহার করেছেন। আজকে শিক্ষকবৃন্দ যতœ সহকারে রিডিং পড়া শেখানোর জন্য শিক্ষার্থী নিজে পড়তে পারছে। কী পড়ছে, তা বুঝতে পারছে। এতে তারা আনন্দিত হচ্ছে।

বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। বিদ্যালয়কে নিজের জায়গা বলে মনে করছে। উপস্থিতিও বাড়ছে। বাংলা পড়তে পারার ফলে শিক্ষার্থীদের গাণিতিক দক্ষতা অর্জন করানোর কাজটিও সহজ হয়ে যাচ্ছে। তারা ইংরেজিতে কথোপকথন করতে শিখছে।

সব মিলে অতি অল্প সময়ের প্রস্তুতিতে আয়োজিত আমাদের এই রিডিং কম্পিটিশনটি যেন শিক্ষার্থীদের পর্যায়ক্রমে উপজেলা পর্যন্ত নিয়ে এসে অরুণ আলোর স্বর্ণ রেণু মাখিয়ে দিল। এখন তারা ছুটবে নক্ষত্রে পরিণত হওয়ার বাসনায়।

[লেখক : উপজেলা শিক্ষা অফিসার, কামারখন্দ, সিরাজগঞ্জ]