সুন্দরবনের সুরক্ষায় সমন্বিত ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে

দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল নিয়ে দেশ ও বিদেশের পর্যটকদের বিপুল আগ্রহ রয়েছে। যোগাযোগসহ অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রমেই বাড়ছে সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনের আগ্রহ। প্রতি বছরের মতো এ বছরও শুরু হয়েছে সুন্দরবন ভ্রমণের মৌসুম। আমাদের একটি বিষয়ে সচেতন হতে হবে, তা হলো সুন্দরবনের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করা। মনে রাখতে হবে, সুন্দরবনের পর্যটন সম্ভাবনা নির্ভর করবে এখানকার বনজ ও প্রাণিসম্পদের ওপর। বনজ ও প্রাণিসম্পদ যত সমৃদ্ধ হবে, দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন নিয়ে আগ্রহ ততটাই বাড়বে।

প্রতি বছর বন্য প্রাণী ও জলজ প্রাণীর প্রজনন নির্বিঘœ করার লক্ষ্য নিয়ে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এটি অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে পর্যটনের কারণে সুন্দরবনের পরিবেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। দেখা যায়, অনেক পর্যটক খাদ্যদ্রব্য, বোতল, প্লাস্টিক বর্জ্য ও অন্যান্য পরিত্যক্তসামগ্রী বনের মধ্যে ফেলে দেয়। এগুলো বনের পরিবেশ নষ্ট করে। প্রয়োজনে ট্যুর অপারেটর ও নৌযান পরিচালনাকারীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

প্রতি বছর সুন্দরবনের আয়তন কমে আসায় বনভূমির প্রতিবেশব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কমে আসছে গাছ, লতাগুল্ম, প্রাণী। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সুন্দরবন দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। বৃহত্তর খুলনা জেলার গেজেটিয়ার লেখার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭০ সালে। ১৯৭৮ সালে ছাপা ওই গেজেটিয়ারে বলা হয়েছিল, নির্বিচার বনসম্পদ লুট ও প্রাণী হত্যা বন্ধ না হলে সুন্দরবন বিবর্ণ, বৃক্ষলতাহীন, প্রাণহীন হয়ে পড়বে। পাঁচ দশক পর পরিস্থিতি ততটা মারাত্মক না হলেও সুন্দরবনের প্রাণপ্রাচুর্য কমছে।

গবেষকরা বলছেন, সুন্দরবনের কিছু গাছ, প্রাণী ও পাখি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। সম্প্রতি লঘুচাপের প্রভাবে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তলিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবন। এ অবস্থায় সুন্দরবনের বাঘ, হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্য প্রাণীর জীবন সংকটে পড়েছে। এর মধ্যে পানির তোড়ে মারা পড়ছে অনেক প্রাণী।

এদিকে নোয়াখালীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় নিঝুম দ্বীপের হরিণগুলো প্রাণভয়ে লোকালয়ে এসে পড়েছে। এ ছাড়া নিম্নচাপের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর এখন উত্তাল। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বাগেরহাটের সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে শুক্রবার ৩ ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছিল পানি। করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রসহ বনের বিভিন্ন এলাকায় জোয়ারে পানি উঠে যায়। ভাটার সময় কিছু অংশের পানি নেমে গেলেও বনের নিচু এলাকায় পানি জমে ছিল।

২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের ২৫২ বর্গকিলোমিটার এলাকা হারিয়ে গেছে। এর অর্থ, প্রতি বছর আড়াই বর্গকিলোমিটারের মতো বন হারিয়ে যাচ্ছে। এ পরিমাণ জমির আয়তন আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফার ৩৫০টি ফুটবল মাঠের সমান। গত কয়েক দশকে জেলেরা ছোট ছোট খালে বিষ ঢেলে মাছ ধরেন বলে গণমাধ্যমকর্মীরা সংবাদ প্রকাশ করছেন। এতে মাছের সঙ্গে অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা যায়। এ জন্য সুন্দরবন বাঁচাতে সমন্বিত ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে।

সুন্দরবন আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। এর সৌন্দর্য রক্ষা করা, এর প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। সেভাবেই সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনের পরিকল্পনা করতে হবে।

[লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড]

সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৩ আশ্বিন ১৪২৯ ২১ সফর ১৪৪৪

সুন্দরবনের সুরক্ষায় সমন্বিত ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে

দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল নিয়ে দেশ ও বিদেশের পর্যটকদের বিপুল আগ্রহ রয়েছে। যোগাযোগসহ অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রমেই বাড়ছে সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনের আগ্রহ। প্রতি বছরের মতো এ বছরও শুরু হয়েছে সুন্দরবন ভ্রমণের মৌসুম। আমাদের একটি বিষয়ে সচেতন হতে হবে, তা হলো সুন্দরবনের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করা। মনে রাখতে হবে, সুন্দরবনের পর্যটন সম্ভাবনা নির্ভর করবে এখানকার বনজ ও প্রাণিসম্পদের ওপর। বনজ ও প্রাণিসম্পদ যত সমৃদ্ধ হবে, দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন নিয়ে আগ্রহ ততটাই বাড়বে।

প্রতি বছর বন্য প্রাণী ও জলজ প্রাণীর প্রজনন নির্বিঘœ করার লক্ষ্য নিয়ে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এটি অব্যাহত রাখতে হবে। একই সঙ্গে পর্যটনের কারণে সুন্দরবনের পরিবেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। দেখা যায়, অনেক পর্যটক খাদ্যদ্রব্য, বোতল, প্লাস্টিক বর্জ্য ও অন্যান্য পরিত্যক্তসামগ্রী বনের মধ্যে ফেলে দেয়। এগুলো বনের পরিবেশ নষ্ট করে। প্রয়োজনে ট্যুর অপারেটর ও নৌযান পরিচালনাকারীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

প্রতি বছর সুন্দরবনের আয়তন কমে আসায় বনভূমির প্রতিবেশব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কমে আসছে গাছ, লতাগুল্ম, প্রাণী। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে সুন্দরবন দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। বৃহত্তর খুলনা জেলার গেজেটিয়ার লেখার কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭০ সালে। ১৯৭৮ সালে ছাপা ওই গেজেটিয়ারে বলা হয়েছিল, নির্বিচার বনসম্পদ লুট ও প্রাণী হত্যা বন্ধ না হলে সুন্দরবন বিবর্ণ, বৃক্ষলতাহীন, প্রাণহীন হয়ে পড়বে। পাঁচ দশক পর পরিস্থিতি ততটা মারাত্মক না হলেও সুন্দরবনের প্রাণপ্রাচুর্য কমছে।

গবেষকরা বলছেন, সুন্দরবনের কিছু গাছ, প্রাণী ও পাখি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। সম্প্রতি লঘুচাপের প্রভাবে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তলিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবন। এ অবস্থায় সুন্দরবনের বাঘ, হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্য প্রাণীর জীবন সংকটে পড়েছে। এর মধ্যে পানির তোড়ে মারা পড়ছে অনেক প্রাণী।

এদিকে নোয়াখালীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় নিঝুম দ্বীপের হরিণগুলো প্রাণভয়ে লোকালয়ে এসে পড়েছে। এ ছাড়া নিম্নচাপের প্রভাবে বঙ্গোপসাগর এখন উত্তাল। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বাগেরহাটের সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে শুক্রবার ৩ ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছিল পানি। করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রসহ বনের বিভিন্ন এলাকায় জোয়ারে পানি উঠে যায়। ভাটার সময় কিছু অংশের পানি নেমে গেলেও বনের নিচু এলাকায় পানি জমে ছিল।

২০২০ সালে বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, গত ১০০ বছরে সুন্দরবনের ২৫২ বর্গকিলোমিটার এলাকা হারিয়ে গেছে। এর অর্থ, প্রতি বছর আড়াই বর্গকিলোমিটারের মতো বন হারিয়ে যাচ্ছে। এ পরিমাণ জমির আয়তন আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ফিফার ৩৫০টি ফুটবল মাঠের সমান। গত কয়েক দশকে জেলেরা ছোট ছোট খালে বিষ ঢেলে মাছ ধরেন বলে গণমাধ্যমকর্মীরা সংবাদ প্রকাশ করছেন। এতে মাছের সঙ্গে অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা যায়। এ জন্য সুন্দরবন বাঁচাতে সমন্বিত ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে।

সুন্দরবন আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। এর সৌন্দর্য রক্ষা করা, এর প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। সেভাবেই সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনের পরিকল্পনা করতে হবে।

[লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড]