বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন

ফোরকান উদ্দিন আহমেদ

সমগ্র পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে তীব্র ও গভীর অর্থনৈতিক মন্দা এ পর্যায়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে মহামন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী কার্যকর তিন মৌলিক দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে একদিকে যুদ্ধ তথা বিশ্বযুদ্ধ এবং বিপ্লব তথা বিশ্ব বিপ্লবের আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি করে চলেছে। অসমান বিকাশের নিয়মানুযায়ী পুঁজি ও শক্তি অনুপাতে বাজার ও প্রভাব বলয় পুনর্বণ্টনকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মুদ্রাযুদ্ধ, স্থানিক-আঞ্চলিক যুদ্ধ বিস্তৃততর হয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদ বৃদ্ধি করে চলেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যুদ্ধে সব থেকে উল্লেখযোগ্য শরিক হলো সন্ত্রাসী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ইসরাইল। এই রাষ্ট্রকেও তারা এক সুদূরপ্রসারী নীতির আওতাতেই সৃষ্টি করে ১৯৪৮ সালে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘অবরোধ’ নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে এ ধরনের আক্রমণের দৃষ্টান্তের অভাব নেই। সামরিক আক্রমণ ছাড়াও এ অবরোধ তারা কার্যকর করছে ইরান, সিরিয়া, ভেনিজুয়েলা, ইয়েমেন, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশে। এর অন্য উদাহরণেরও অভাব নেই, যা ল্যাটিন আমেরিকায় এখন প্রায় সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ নীতির মূল লক্ষ্য হলো, সামরিক ঘেরাও ছাড়া মূলত বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা। এ নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে তারা নির্দিষ্ট দেশে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করছে। তাদের বৈদেশিক উপার্জনে বাধা সৃষ্টি করছে এবং খাদ্য আমদানি ইত্যাদি বন্ধ করে এমন সংকট সৃষ্টি করছে, যাতে অভ্যন্তরীণভাবে এসব দেশের জনগণ সরকারবিরোধী হয়ে ওঠে। তাদের এই সরকার বিরোধিতাকে ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি দেশে তাদের এজেন্টদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিক দিয়ে এ মুহূর্তে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল, ভেনিজুয়েলা, ইরান, ইয়েমেন, উত্তর কোরিয়া। উত্তর কোরিয়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। তারা খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানার মতো শক্তি পর্যন্ত অর্জন করেছে।

ভেনিজুয়েলায় তেলের মজুদ সৌদি আরবের থেকে বেশি। কাজেই তেল রপ্তানি করেই তারা দেশের জনগণের সমৃদ্ধি এবং নিজেদের রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন আমেরিকা ভেনিজুয়েলায় অবরোধ চাপিয়ে রেখে তাদের তেল রপ্তানি অসম্ভব করে তুলেছে। যেসব দেশ ভেনিজুয়েলা থেকে তেল কিনত তারা আর তেল কিনতে পারছে না। এর ফলে সেদেশে এক ভয়ানক অর্থনৈতিক সংকট ও খাদ্য, ওষুধ ইত্যাদির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর ফলে জনগণের একটা বড় অংশ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ।

কিন্তু বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ সে নিষেধাজ্ঞা না মেনে ইরানের তেল কিনতে থাকায় আগের থেকে অবস্থা খারাপ হলেও ভেনিজুয়েলার মতো সংকট সেখানে তৈরি হয়নি। সৌদি আরব এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হিসেবে একটি বিপজ্জনক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তাকে দিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনের যুদ্ধ শুরু করেছে এবং তাদের সন্ত্রাসী বোমা হামলায় সেখানে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হচ্ছে। তা ছাড়া সেখানে চরম খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ অবস্থা তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী তৎপরতা কতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে, তার কোন হিসাব নেই। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে খারাপ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা ও তাকে সময়মতো ব্যবহার করা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নীতির এক বড় দিক।

মার্কিন সরকার যে বহু দেশে এ ধরনের গ্রুপের মাধ্যমে প্রক্সি ওয়ার বা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির এই যুগে কারও কাছেই অজানা নয়। যেমন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আলকায়দা ও তালেবান সৃষ্টিতে মার্কিন সরকারের ভূমিকার কথা সবাই জানে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ সোভিয়েত সেনাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ব্যবহারের জন্য দেশে দেশে প্রচারণার মহাপরিকল্পনা নিয়েছিল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তিনটি দেশকে নিয়ে স্কোয়াড গঠন করেছেন। এই স্কোয়াডের ভবিষ্যৎ সিয়াটো ও বাগদাদ চুক্তির মতো হবে। ন্যাটো এখনো টিকে আছে মার্কিন অর্থে। ট্রাম্প এই ন্যাটো ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। চীনা আক্রমণের ভয় দেখিয়ে বাইডেন ন্যাটো রাখতে চান। কিন্তু কত দিন রাখতে পারবেন সন্দেহ আছে। বর্তমানে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হাওয়া বইছে।

আমেরিকা এই হাওয়া কত দিন প্রতিরোধ করতে পারবে, তা সন্দেহজনক। হিসাব করলে দেখা যায়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আয়ু ৫০ বছরও হতে যাচ্ছে না। দেখা যাক তারপর কোন নতুন সাম্রাজ্য মাথা তুলে দাঁড়ায়। সেটা দেখার জন্য আরও কিছুকাল আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমেরিকার সামরিক জয়ের কোনো গৌরবগাথা নেই। সুতরাং তার পতনের ইতিহাস হবে আরও লজ্জাজনক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ধনতন্ত্রের নেতৃত্বও তার হাত থেকে চলে যাবে। কার হাতে যাবে? সেই চীনের হাতে কি? চীন কি দেশে দেশে তার অর্থনৈতিক সাহায্যদানকে আবার নতুন সাম্রাজ্য বিস্তারের ভিত্তি করে তুলবে? সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপে যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, সেই আধিপত্য রক্ষার জন্য হাঙ্গেরিতে ২৬ হাজার মানুষ হত্যা করেছিল। পূর্ব ইউরোপে সেই সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্য স্থায়ী হয়নি। চীনকে রাশিয়ার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হবে। চীন বহির্বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ চাপানোর আগেই তার অভ্যন্তরে নাগরিক অধিকারের জন্য বিপ্লব ঘটতে পারে। তাই আশা করা যায়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতনের পর পৃথিবীতে একটা স্বস্তির আবহাওয়া ফিরে আসতে পারে। সম্প্রতি আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চলে এসেছে, তাতে এই প্রশ্ন খুব যৌক্তিকভাবেই উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্র কি তার মিত্রদের বিপদের মুখে ফেলে রেখে তার স্বার্থরক্ষায় চলে যাবে?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির একনায়ক হিটলার এবং তার নাৎসি বাহিনীর পতন ঘটার পর পৃথিবীব্যাপী পারমাণবিক শক্তি সম্পন্ন রাষ্ট্রগুলো দুই দলে বিভক্ত হয়ে সূচনা করে এক সুদীর্ঘ স্নায়ুযুদ্ধের। মূলত বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নতুন পৃথিবীতে একক আধিপত্য বিস্তার করাই লক্ষ্য ছিল এ দুই পক্ষের- যার একটি ছিল ন্যাটো কোয়ালিশন নিয়ে আমেরিকা আর অন্যটি ছিল কমিউনিস্ট পৃথিবীকে নিয়ে রাশিয়ার। এক দিন যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল সারা বিশ্বের ওপর, ক্ষমতাধর সে ব্রিটিশ রাজ আজ বিশ্বে বিস্মৃিতর ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার অহংকার আর দাম্ভিকতার সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্র কাহারও কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গর্ব করার কোন স্থায়ী ইতিহাস নেই, গৌরবগাথা ও নেই। কাজেই তাদের অনিবার্য পতনের দিক এ পর্যন্ত বহুভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আজ দ্বারপ্রান্তে। যে কোন মুহূর্তে রণদামামা বেজে উঠতে পারে। পৃথিবী আজ সহিংস ও অমানবিক হয়ে উঠেছে। বৃহৎ শক্তির আগ্রাসন মোকাবিলার সংগ্রাম হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই যুদ্ধ নয়Ñপৃথিবী হোক শান্তিময়।

সম্প্রতি ফ্রান্সের প্যারিসে একটি সমঝোতা বৈঠকে জার্মানি ও ফ্রান্সের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ইউক্রেন ও রাশিয়া অস্ত্রবিরতিতে যাওয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করে। এই সংবাদ নিশ্চিতরূপে ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি শান্তির বার্তা বয়ে আনে। আমরা হিরোশিমা-নাগাসাকি হামলার ভয়াবহতা এখনো ভুলতে পারিনি। আর কোন ফ্যাটম্যান কিংবা লিটল বয় আমরা চাই না। পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করুক, সহিংসতা রুখে দিয়ে সহিষ্ণুতার চর্চা করা হোক, অস্ত্রের অবাধ বিস্তার রোধ করে সংহতির প্রতিযোগিতা হোক।

সর্বোপরি, সব বিবাদ, সংশয়, সংঘাতের ঊর্ধ্বে গিয়ে পৃথিবীটা মানুষের হোক।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]

মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৪ আশ্বিন ১৪২৯ ২২ সফর ১৪৪৪

বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন

ফোরকান উদ্দিন আহমেদ

সমগ্র পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে তীব্র ও গভীর অর্থনৈতিক মন্দা এ পর্যায়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে মহামন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী কার্যকর তিন মৌলিক দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে একদিকে যুদ্ধ তথা বিশ্বযুদ্ধ এবং বিপ্লব তথা বিশ্ব বিপ্লবের আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি করে চলেছে। অসমান বিকাশের নিয়মানুযায়ী পুঁজি ও শক্তি অনুপাতে বাজার ও প্রভাব বলয় পুনর্বণ্টনকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মুদ্রাযুদ্ধ, স্থানিক-আঞ্চলিক যুদ্ধ বিস্তৃততর হয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদ বৃদ্ধি করে চলেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যুদ্ধে সব থেকে উল্লেখযোগ্য শরিক হলো সন্ত্রাসী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ইসরাইল। এই রাষ্ট্রকেও তারা এক সুদূরপ্রসারী নীতির আওতাতেই সৃষ্টি করে ১৯৪৮ সালে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘অবরোধ’ নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে এ ধরনের আক্রমণের দৃষ্টান্তের অভাব নেই। সামরিক আক্রমণ ছাড়াও এ অবরোধ তারা কার্যকর করছে ইরান, সিরিয়া, ভেনিজুয়েলা, ইয়েমেন, উত্তর কোরিয়ার মতো দেশে। এর অন্য উদাহরণেরও অভাব নেই, যা ল্যাটিন আমেরিকায় এখন প্রায় সর্বত্র দেখা যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ নীতির মূল লক্ষ্য হলো, সামরিক ঘেরাও ছাড়া মূলত বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা। এ নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে তারা নির্দিষ্ট দেশে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করছে। তাদের বৈদেশিক উপার্জনে বাধা সৃষ্টি করছে এবং খাদ্য আমদানি ইত্যাদি বন্ধ করে এমন সংকট সৃষ্টি করছে, যাতে অভ্যন্তরীণভাবে এসব দেশের জনগণ সরকারবিরোধী হয়ে ওঠে। তাদের এই সরকার বিরোধিতাকে ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিটি দেশে তাদের এজেন্টদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিক দিয়ে এ মুহূর্তে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল, ভেনিজুয়েলা, ইরান, ইয়েমেন, উত্তর কোরিয়া। উত্তর কোরিয়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। তারা খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানার মতো শক্তি পর্যন্ত অর্জন করেছে।

ভেনিজুয়েলায় তেলের মজুদ সৌদি আরবের থেকে বেশি। কাজেই তেল রপ্তানি করেই তারা দেশের জনগণের সমৃদ্ধি এবং নিজেদের রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু দীর্ঘদিন আমেরিকা ভেনিজুয়েলায় অবরোধ চাপিয়ে রেখে তাদের তেল রপ্তানি অসম্ভব করে তুলেছে। যেসব দেশ ভেনিজুয়েলা থেকে তেল কিনত তারা আর তেল কিনতে পারছে না। এর ফলে সেদেশে এক ভয়ানক অর্থনৈতিক সংকট ও খাদ্য, ওষুধ ইত্যাদির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর ফলে জনগণের একটা বড় অংশ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ।

কিন্তু বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ সে নিষেধাজ্ঞা না মেনে ইরানের তেল কিনতে থাকায় আগের থেকে অবস্থা খারাপ হলেও ভেনিজুয়েলার মতো সংকট সেখানে তৈরি হয়নি। সৌদি আরব এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী হিসেবে একটি বিপজ্জনক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তাকে দিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনের যুদ্ধ শুরু করেছে এবং তাদের সন্ত্রাসী বোমা হামলায় সেখানে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হচ্ছে। তা ছাড়া সেখানে চরম খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ অবস্থা তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী তৎপরতা কতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে, তার কোন হিসাব নেই। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে খারাপ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা ও তাকে সময়মতো ব্যবহার করা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নীতির এক বড় দিক।

মার্কিন সরকার যে বহু দেশে এ ধরনের গ্রুপের মাধ্যমে প্রক্সি ওয়ার বা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির এই যুগে কারও কাছেই অজানা নয়। যেমন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য আলকায়দা ও তালেবান সৃষ্টিতে মার্কিন সরকারের ভূমিকার কথা সবাই জানে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ সোভিয়েত সেনাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ব্যবহারের জন্য দেশে দেশে প্রচারণার মহাপরিকল্পনা নিয়েছিল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তিনটি দেশকে নিয়ে স্কোয়াড গঠন করেছেন। এই স্কোয়াডের ভবিষ্যৎ সিয়াটো ও বাগদাদ চুক্তির মতো হবে। ন্যাটো এখনো টিকে আছে মার্কিন অর্থে। ট্রাম্প এই ন্যাটো ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। চীনা আক্রমণের ভয় দেখিয়ে বাইডেন ন্যাটো রাখতে চান। কিন্তু কত দিন রাখতে পারবেন সন্দেহ আছে। বর্তমানে দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হাওয়া বইছে।

আমেরিকা এই হাওয়া কত দিন প্রতিরোধ করতে পারবে, তা সন্দেহজনক। হিসাব করলে দেখা যায়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আয়ু ৫০ বছরও হতে যাচ্ছে না। দেখা যাক তারপর কোন নতুন সাম্রাজ্য মাথা তুলে দাঁড়ায়। সেটা দেখার জন্য আরও কিছুকাল আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমেরিকার সামরিক জয়ের কোনো গৌরবগাথা নেই। সুতরাং তার পতনের ইতিহাস হবে আরও লজ্জাজনক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ধনতন্ত্রের নেতৃত্বও তার হাত থেকে চলে যাবে। কার হাতে যাবে? সেই চীনের হাতে কি? চীন কি দেশে দেশে তার অর্থনৈতিক সাহায্যদানকে আবার নতুন সাম্রাজ্য বিস্তারের ভিত্তি করে তুলবে? সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপে যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল, সেই আধিপত্য রক্ষার জন্য হাঙ্গেরিতে ২৬ হাজার মানুষ হত্যা করেছিল। পূর্ব ইউরোপে সেই সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্য স্থায়ী হয়নি। চীনকে রাশিয়ার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে হবে। চীন বহির্বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ চাপানোর আগেই তার অভ্যন্তরে নাগরিক অধিকারের জন্য বিপ্লব ঘটতে পারে। তাই আশা করা যায়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতনের পর পৃথিবীতে একটা স্বস্তির আবহাওয়া ফিরে আসতে পারে। সম্প্রতি আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চলে এসেছে, তাতে এই প্রশ্ন খুব যৌক্তিকভাবেই উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্র কি তার মিত্রদের বিপদের মুখে ফেলে রেখে তার স্বার্থরক্ষায় চলে যাবে?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির একনায়ক হিটলার এবং তার নাৎসি বাহিনীর পতন ঘটার পর পৃথিবীব্যাপী পারমাণবিক শক্তি সম্পন্ন রাষ্ট্রগুলো দুই দলে বিভক্ত হয়ে সূচনা করে এক সুদীর্ঘ স্নায়ুযুদ্ধের। মূলত বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নতুন পৃথিবীতে একক আধিপত্য বিস্তার করাই লক্ষ্য ছিল এ দুই পক্ষের- যার একটি ছিল ন্যাটো কোয়ালিশন নিয়ে আমেরিকা আর অন্যটি ছিল কমিউনিস্ট পৃথিবীকে নিয়ে রাশিয়ার। এক দিন যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল সারা বিশ্বের ওপর, ক্ষমতাধর সে ব্রিটিশ রাজ আজ বিশ্বে বিস্মৃিতর ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার অহংকার আর দাম্ভিকতার সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্র কাহারও কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গর্ব করার কোন স্থায়ী ইতিহাস নেই, গৌরবগাথা ও নেই। কাজেই তাদের অনিবার্য পতনের দিক এ পর্যন্ত বহুভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আজ দ্বারপ্রান্তে। যে কোন মুহূর্তে রণদামামা বেজে উঠতে পারে। পৃথিবী আজ সহিংস ও অমানবিক হয়ে উঠেছে। বৃহৎ শক্তির আগ্রাসন মোকাবিলার সংগ্রাম হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই যুদ্ধ নয়Ñপৃথিবী হোক শান্তিময়।

সম্প্রতি ফ্রান্সের প্যারিসে একটি সমঝোতা বৈঠকে জার্মানি ও ফ্রান্সের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ইউক্রেন ও রাশিয়া অস্ত্রবিরতিতে যাওয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করে। এই সংবাদ নিশ্চিতরূপে ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি শান্তির বার্তা বয়ে আনে। আমরা হিরোশিমা-নাগাসাকি হামলার ভয়াবহতা এখনো ভুলতে পারিনি। আর কোন ফ্যাটম্যান কিংবা লিটল বয় আমরা চাই না। পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করুক, সহিংসতা রুখে দিয়ে সহিষ্ণুতার চর্চা করা হোক, অস্ত্রের অবাধ বিস্তার রোধ করে সংহতির প্রতিযোগিতা হোক।

সর্বোপরি, সব বিবাদ, সংশয়, সংঘাতের ঊর্ধ্বে গিয়ে পৃথিবীটা মানুষের হোক।

[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]