রেলওয়ের অব্যবস্থাপনা

ট্রেনের টিকিট পেতে ভোগান্তি, টিকিট পেয়েও আসন না পাওয়া, ট্রেনের ছাদে যাত্রী বহন, ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগের শেষ নেই। এ ছাড়া অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে একের পর এক দুর্ঘটনা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে। ঈদ, পুজা-পার্বণের লম্বা ছুটিতে রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার নানাদিক প্রকট রূপ ধারণ করে।

গত ৩০ জুলাই মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেন-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে ১১ জন তরুণ শিক্ষার্থী পর্যটকের মৃত্যু ঘটে এবং আহত হয় অনেকে। দুপুরে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মহানগর প্রভাতী ট্রেন মিরসরাইয়ের পর্যটক বহনকারী মাইক্রেবাসকে লেভেলক্রসিংয়ে ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার সময় গেটম্যান লেভেলক্রসিংয়ে উপস্থিত না থাকায় লেভেলক্রসিংটি ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর জয়পুরহাটের পুরানাপৈল লেভেলক্রসিংয়ে গেটকিপার লোহার বার ফেলার পরও দ্রুতগতিতে আসা বাস তা ভেঙে গেটের ভেতর ঢুকে ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে হয় ১২ জন নিহত এবং ৬ জন গুরুতর আহত হয়। একই বছর ১৫ জুলাই ঢাকা-ঈশ^রদী রেলসড়কের সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায় পঞ্চক্রোশী এলাকার বেতকাকান্দিতে অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত এবং অন্তত ৬ জন আহত হয়েছে। এক বেসরকারি সূত্রমতে জানা যায়, গত তিন বছরে এ ধরনের ট্রেন দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৪৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। আহত হয়েছে ৩ হাজার জন।

সড়কপথে যানবাহন ও রেললাইনে ট্রেন আলাদা দুটি পথ ধরে চলে। শুধু লেভেলক্রসিংয়েই এ দুই ধরনের যানবাহনের সাক্ষাৎ হয়। কাজেই রেললাইনের ট্রেন ও সড়কে চলা যানবাহনের মধ্যে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অথচ এসব লেভেলক্রসিংগুলো অরক্ষিত থাকার কারণেই বারবার ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে রয়েছে শত শত অবৈধ লেভেলক্রসিং। সারা দেশে বৈধ-অবৈধ মিলে প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি লেভেলক্রসিং রয়েছে অরক্ষিত। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেলক্রসিং রয়েছে। এরমধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ। এর মধ্যে ৯৬১টি লেভেলক্রসিং সম্পূর্ণ অরক্ষিত। এসব ক্রসিংয়ে নেই কোনো গেটম্যান। সেখানে কোন সুরক্ষা সরঞ্জামও নেই এসব অরক্ষিত, গেটম্যানবিহীন লেভেলক্রসিংয়ে ঘটে যতসব দুর্ঘটনা। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে রেললাইনে ১ হাজার ৪৭৯টি লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে ৫৫০টি অবৈধ। এ ছাড়া এসবের ৬৬১টিতে কোনো গেটম্যানই নেই। পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ৩৭৭টি ক্রসিংয়ের ৮১১টি অবৈধ আর ৩০০ বৈধ ক্রসিংয়ে কোন গেটম্যান নেই। রেল কর্তৃপক্ষের কোন ধরনের অনুমোদন ছাড়াই এলজিইডি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ অবৈধ লেভেলক্রসিং তৈরি করে।

অনেক জায়গায় বেআইনিভাবে রেললাইন অতিক্রম করে যে যার প্রয়োজনে রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাইকে রেললাইন পেরোতে হচ্ছে। অথচ রেলওয়ে ১৮১৯ অধ্যাদেশ অনুযায়ী অনুমতি ছাড়া কেউ রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটলেও ২ বছরের কারাদ-ের বিধান রয়েছে। লেভেলক্রসিংয়ের বেশির ভাগ গেটবারের অবস্থাও করুণ। জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা ভাঙা গেটবার নামানো হচ্ছে কোন উপায়ে। এমনকি লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেন এসে পৌঁছার আগাম সংকেত পাওয়ার ব্যবস্থাও নেই সব জায়গায়। লেভেলক্রসিংয়ের আশেপাশে গড়ে উঠেছে বস্তি, বাজারসহ নানা অবৈধ স্থাপনা।

রেলপথের ওপর অবৈধভাবে রাস্তা নির্মাণ করে থাকে সরকারের নানা সংস্থা। বিভিন্ন এলাকার অসচেতন জনগোষ্ঠী নিজেদের বাড়ির রাস্তা সোজা করতে রেললাইনের ওপর দিয়ে এখানে সেখানে অবৈধভাবে এপ্রোচ সড়ক তৈরি করে। রেললাইনের ওপরই প্রতিদিন পণ্য বেচাকেনা করতে জড়ো হন অসংখ্য মানুষ। পথচারী ও যানবাহনকে অরক্ষিত লেভেলক্রসিং দ্রুত পেরুতে গিয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে।

বিশে^র মানুষের কাছে যাতায়াতের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত রেলপথ। শুধু যাত্রী পরিবহনই নয়, মালামাল পরিবহনের জন্যও বিশ^ব্যাপী রেলপথকেই সর্বাগ্রে বেছে নেয়া হয়। ট্রেনে চেপে অধিকসংখ্যক যাত্রী দ্রুততম সময়ে নিরাপদে অতিক্রম করতে পারে। ট্রেনের ভাড়াও তুলনামূলকভাবে কম। দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিরাজমান নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থার কারণে রেলযোগাযোগের তেমন প্রসার লাভ করছে না।

যাত্রীসেবা মানের কোনও রকম উন্নয়ন না ঘটায় বাংলাদেশ রেলওয়ে অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েতে চলেছে। এক সময় আখাউড়া-সিলেট রেল সেকশনের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বড়ছড়া রেলব্রিজ ভেঙে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস নিচে পড়ে উল্টে ৪ জন যাত্রী নিহত এবং দুই শতাধিক যাত্রী আহত হওয়ার পর রেলওয়ের নানা অব্যবস্থাপনার চিত্র নজরে আসে। রেলসেতু ভেঙে ট্রেন নিচে পড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে রেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করা হয়। উক্ত রেলসেতুর আশেপাশের রেললাইন থেকে রেললাইনের ক্লিপ চুরি হয়ে যাওয়ায় ট্রেন লাইনচ্যুত হতে পারে বলে রেল কর্তৃপক্ষকে পূর্বেই অবহিত করা হলেও কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। জোড়াতালি দেয়া রেললাইন, ওঠে যাওয়া ব্যালাস্ট, অতি পুরান ভাঙা কাঠের সিøপার, লাটবল্টু বা ডগস্পাইকের বদলে কাঠের গোজ লাগিয়ে মেরামত করা নড়বড়ে ব্রিজের ওপর দিয়ে চলা ১৭টি কোচে সহস্রাধিক যাত্রী, যা কি না ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত। ১৯১৭ সালে ৫ এপ্রিল পাহাড়ি ঢলে শ্রীমঙ্গল-সাঁতগাঁওয়ে সেতু ডেবে যায়। ২০১৬ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রেলসেতুর গার্ডারের নিচের মাটি ধসে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া হাটহাজারীতে রেলসেতু ভেঙে তেলবাহী ট্যাঙ্কার নিচে পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও রয়েছে।

বাংলাদেশে ট্রেন দুর্ঘটনার ফলে যাত্রী হতাহত ছাড়াও পঙ্গুত্ববরণ করে অনেকে। এদের পরিবার-পরিজন নিঃস্ব হয়ে যায়। কিন্তু এসবের জন্য মামলা কখনো বা হলেও মামলার নিষ্পত্তি হয় না। হতাহতদের মেলে না ক্ষতিপূরণ। একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় রেললাইন, ট্রেনের বগি, যন্ত্রাংশ ছাড়াও যাত্রীদের মালামালের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুর্ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পর রেললাইন সচল করে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে তুলতে অনেক সময় লেগে যায়। এ দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার কারণে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দেশে রেললাইনের প্রয়োজনীয় উপকরণ চুরি হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়।

রেললাইনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারেরও অভাব রয়েছে। জরাজীর্ণ প্ল্যাটফর্ম, মান্ধাতা আমলের রেললাইন, ইঞ্জিন, বগি এবং অদক্ষ চালক দিয়ে চলছে বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা। অব্যাহত ট্রেন দুর্ঘটনা বন্ধ করতে লেভেলক্রসিংয়ের সংস্কার, রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা সব অবৈধ স্থাপনা, হাটবাজার অনতিবিলম্বে উচ্ছেদ করা জরুরি। বর্তমান রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামোগত উন্নয়নকল্পে রেললাইন, ইঞ্জিন, বগি, সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নিয়মিত সংরক্ষণ ও মেরামত করা অত্যাবশ্যক। রাজধানীতে প্রায় ৩০টির অধিক লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণগুলোতে অনতিবিলম্বে ওভারপাস বা আন্ডারপাস নির্মাণ করা আবশ্যক। রেলওয়েকে প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ লেভেলক্রসিংয়ে শুধু ‘সতর্কীকরণ’ সাইবোর্ড ঝুলিয়ে দায় এড়িয়ে গেলে চলবে না।

ট্রেন আসার সময় রেলগেটে সাইরেন বা সতর্কীকরণ হুইসেল বাজিয়ে গেটম্যানকে সজাগ করে তুলে আগত বাসকে সাবধান করতে হবে। লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যানের সার্বক্ষণিক উপস্থিতির পাশাপাশি রেলওয়ে ট্রাফিক পুলিশের কর্মতৎপরতা নিশ্চিত করা জরুরি। যাত্রীদের টিকিট প্রদানের ব্যাপারে অনিয়ম বন্ধ করাসহ যাত্রী ছাউনি ও প্ল্যাটফর্মের উন্নয়নও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেভেলক্রসিংয়ের সংস্কারসহ ট্রেন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দক্ষ চালক নিয়োগ, রেলবিভাগের সর্বস্তরে যোগ্য এবং প্রশিক্ষিত জনবলকাঠামো সুদৃঢ় করা আবশ্যক। অনতিবিলম্বে অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধ করে বৈধ লেভেলক্রসিংগুলোতে প্রশিক্ষিত গেটম্যান নিয়োগ করে লেভেলক্রসিংয়ে তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।

ট্রেনের টিকিট পেতে মারাত্মক হয়রানির শিকার সম্প্রতি এক ঢাকা ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান, নানা আন্দোলন কর্মসূচি রেলওয়ের অব্যাবস্থাপনাকে জাতির সামনে উন্মোচিত করেছে, যা সত্যি লজ্জাজনক। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে রেলওয়ের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি রেলওয়ের রক্ষণাবেক্ষণ ও অপারেশনে জবাবদিহি নিশ্চিতকরণসহ যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন করা গেলে ট্রেনে যাত্রা নিরাপদ হবে এবং রেলযোগাযোগের ভবিষ্যৎ প্রসারও সম্ভব হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]

মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৪ আশ্বিন ১৪২৯ ২২ সফর ১৪৪৪

রেলওয়ের অব্যবস্থাপনা

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

ট্রেনের টিকিট পেতে ভোগান্তি, টিকিট পেয়েও আসন না পাওয়া, ট্রেনের ছাদে যাত্রী বহন, ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগের শেষ নেই। এ ছাড়া অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে একের পর এক দুর্ঘটনা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে। ঈদ, পুজা-পার্বণের লম্বা ছুটিতে রেলওয়ের অব্যবস্থাপনার নানাদিক প্রকট রূপ ধারণ করে।

গত ৩০ জুলাই মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেন-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে ১১ জন তরুণ শিক্ষার্থী পর্যটকের মৃত্যু ঘটে এবং আহত হয় অনেকে। দুপুরে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মহানগর প্রভাতী ট্রেন মিরসরাইয়ের পর্যটক বহনকারী মাইক্রেবাসকে লেভেলক্রসিংয়ে ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার সময় গেটম্যান লেভেলক্রসিংয়ে উপস্থিত না থাকায় লেভেলক্রসিংটি ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর জয়পুরহাটের পুরানাপৈল লেভেলক্রসিংয়ে গেটকিপার লোহার বার ফেলার পরও দ্রুতগতিতে আসা বাস তা ভেঙে গেটের ভেতর ঢুকে ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষে হয় ১২ জন নিহত এবং ৬ জন গুরুতর আহত হয়। একই বছর ১৫ জুলাই ঢাকা-ঈশ^রদী রেলসড়কের সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায় পঞ্চক্রোশী এলাকার বেতকাকান্দিতে অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত এবং অন্তত ৬ জন আহত হয়েছে। এক বেসরকারি সূত্রমতে জানা যায়, গত তিন বছরে এ ধরনের ট্রেন দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৪৫০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। আহত হয়েছে ৩ হাজার জন।

সড়কপথে যানবাহন ও রেললাইনে ট্রেন আলাদা দুটি পথ ধরে চলে। শুধু লেভেলক্রসিংয়েই এ দুই ধরনের যানবাহনের সাক্ষাৎ হয়। কাজেই রেললাইনের ট্রেন ও সড়কে চলা যানবাহনের মধ্যে সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অথচ এসব লেভেলক্রসিংগুলো অরক্ষিত থাকার কারণেই বারবার ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে রয়েছে শত শত অবৈধ লেভেলক্রসিং। সারা দেশে বৈধ-অবৈধ মিলে প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি লেভেলক্রসিং রয়েছে অরক্ষিত। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের ২ হাজার ৯৫৯ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২ হাজার ৮৫৬টি লেভেলক্রসিং রয়েছে। এরমধ্যে ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ এবং ১ হাজার ৩৬১টি অবৈধ। এর মধ্যে ৯৬১টি লেভেলক্রসিং সম্পূর্ণ অরক্ষিত। এসব ক্রসিংয়ে নেই কোনো গেটম্যান। সেখানে কোন সুরক্ষা সরঞ্জামও নেই এসব অরক্ষিত, গেটম্যানবিহীন লেভেলক্রসিংয়ে ঘটে যতসব দুর্ঘটনা। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে রেললাইনে ১ হাজার ৪৭৯টি লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে ৫৫০টি অবৈধ। এ ছাড়া এসবের ৬৬১টিতে কোনো গেটম্যানই নেই। পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ৩৭৭টি ক্রসিংয়ের ৮১১টি অবৈধ আর ৩০০ বৈধ ক্রসিংয়ে কোন গেটম্যান নেই। রেল কর্তৃপক্ষের কোন ধরনের অনুমোদন ছাড়াই এলজিইডি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ অবৈধ লেভেলক্রসিং তৈরি করে।

অনেক জায়গায় বেআইনিভাবে রেললাইন অতিক্রম করে যে যার প্রয়োজনে রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাইকে রেললাইন পেরোতে হচ্ছে। অথচ রেলওয়ে ১৮১৯ অধ্যাদেশ অনুযায়ী অনুমতি ছাড়া কেউ রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটলেও ২ বছরের কারাদ-ের বিধান রয়েছে। লেভেলক্রসিংয়ের বেশির ভাগ গেটবারের অবস্থাও করুণ। জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখা ভাঙা গেটবার নামানো হচ্ছে কোন উপায়ে। এমনকি লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেন এসে পৌঁছার আগাম সংকেত পাওয়ার ব্যবস্থাও নেই সব জায়গায়। লেভেলক্রসিংয়ের আশেপাশে গড়ে উঠেছে বস্তি, বাজারসহ নানা অবৈধ স্থাপনা।

রেলপথের ওপর অবৈধভাবে রাস্তা নির্মাণ করে থাকে সরকারের নানা সংস্থা। বিভিন্ন এলাকার অসচেতন জনগোষ্ঠী নিজেদের বাড়ির রাস্তা সোজা করতে রেললাইনের ওপর দিয়ে এখানে সেখানে অবৈধভাবে এপ্রোচ সড়ক তৈরি করে। রেললাইনের ওপরই প্রতিদিন পণ্য বেচাকেনা করতে জড়ো হন অসংখ্য মানুষ। পথচারী ও যানবাহনকে অরক্ষিত লেভেলক্রসিং দ্রুত পেরুতে গিয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে।

বিশে^র মানুষের কাছে যাতায়াতের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত রেলপথ। শুধু যাত্রী পরিবহনই নয়, মালামাল পরিবহনের জন্যও বিশ^ব্যাপী রেলপথকেই সর্বাগ্রে বেছে নেয়া হয়। ট্রেনে চেপে অধিকসংখ্যক যাত্রী দ্রুততম সময়ে নিরাপদে অতিক্রম করতে পারে। ট্রেনের ভাড়াও তুলনামূলকভাবে কম। দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিরাজমান নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থার কারণে রেলযোগাযোগের তেমন প্রসার লাভ করছে না।

যাত্রীসেবা মানের কোনও রকম উন্নয়ন না ঘটায় বাংলাদেশ রেলওয়ে অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েতে চলেছে। এক সময় আখাউড়া-সিলেট রেল সেকশনের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার বড়ছড়া রেলব্রিজ ভেঙে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস নিচে পড়ে উল্টে ৪ জন যাত্রী নিহত এবং দুই শতাধিক যাত্রী আহত হওয়ার পর রেলওয়ের নানা অব্যবস্থাপনার চিত্র নজরে আসে। রেলসেতু ভেঙে ট্রেন নিচে পড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে রেল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করা হয়। উক্ত রেলসেতুর আশেপাশের রেললাইন থেকে রেললাইনের ক্লিপ চুরি হয়ে যাওয়ায় ট্রেন লাইনচ্যুত হতে পারে বলে রেল কর্তৃপক্ষকে পূর্বেই অবহিত করা হলেও কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। জোড়াতালি দেয়া রেললাইন, ওঠে যাওয়া ব্যালাস্ট, অতি পুরান ভাঙা কাঠের সিøপার, লাটবল্টু বা ডগস্পাইকের বদলে কাঠের গোজ লাগিয়ে মেরামত করা নড়বড়ে ব্রিজের ওপর দিয়ে চলা ১৭টি কোচে সহস্রাধিক যাত্রী, যা কি না ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত। ১৯১৭ সালে ৫ এপ্রিল পাহাড়ি ঢলে শ্রীমঙ্গল-সাঁতগাঁওয়ে সেতু ডেবে যায়। ২০১৬ সালে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রেলসেতুর গার্ডারের নিচের মাটি ধসে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া হাটহাজারীতে রেলসেতু ভেঙে তেলবাহী ট্যাঙ্কার নিচে পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও রয়েছে।

বাংলাদেশে ট্রেন দুর্ঘটনার ফলে যাত্রী হতাহত ছাড়াও পঙ্গুত্ববরণ করে অনেকে। এদের পরিবার-পরিজন নিঃস্ব হয়ে যায়। কিন্তু এসবের জন্য মামলা কখনো বা হলেও মামলার নিষ্পত্তি হয় না। হতাহতদের মেলে না ক্ষতিপূরণ। একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় রেললাইন, ট্রেনের বগি, যন্ত্রাংশ ছাড়াও যাত্রীদের মালামালের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দুর্ঘটনা সংগঠিত হওয়ার পর রেললাইন সচল করে ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে তুলতে অনেক সময় লেগে যায়। এ দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার কারণে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। দেশে রেললাইনের প্রয়োজনীয় উপকরণ চুরি হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়।

রেললাইনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারেরও অভাব রয়েছে। জরাজীর্ণ প্ল্যাটফর্ম, মান্ধাতা আমলের রেললাইন, ইঞ্জিন, বগি এবং অদক্ষ চালক দিয়ে চলছে বাংলাদেশের রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা। অব্যাহত ট্রেন দুর্ঘটনা বন্ধ করতে লেভেলক্রসিংয়ের সংস্কার, রেললাইনের পাশে গড়ে ওঠা সব অবৈধ স্থাপনা, হাটবাজার অনতিবিলম্বে উচ্ছেদ করা জরুরি। বর্তমান রেলযোগাযোগ ব্যবস্থার অবকাঠামোগত উন্নয়নকল্পে রেললাইন, ইঞ্জিন, বগি, সিগন্যাল ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নিয়মিত সংরক্ষণ ও মেরামত করা অত্যাবশ্যক। রাজধানীতে প্রায় ৩০টির অধিক লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণগুলোতে অনতিবিলম্বে ওভারপাস বা আন্ডারপাস নির্মাণ করা আবশ্যক। রেলওয়েকে প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ লেভেলক্রসিংয়ে শুধু ‘সতর্কীকরণ’ সাইবোর্ড ঝুলিয়ে দায় এড়িয়ে গেলে চলবে না।

ট্রেন আসার সময় রেলগেটে সাইরেন বা সতর্কীকরণ হুইসেল বাজিয়ে গেটম্যানকে সজাগ করে তুলে আগত বাসকে সাবধান করতে হবে। লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যানের সার্বক্ষণিক উপস্থিতির পাশাপাশি রেলওয়ে ট্রাফিক পুলিশের কর্মতৎপরতা নিশ্চিত করা জরুরি। যাত্রীদের টিকিট প্রদানের ব্যাপারে অনিয়ম বন্ধ করাসহ যাত্রী ছাউনি ও প্ল্যাটফর্মের উন্নয়নও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেভেলক্রসিংয়ের সংস্কারসহ ট্রেন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দক্ষ চালক নিয়োগ, রেলবিভাগের সর্বস্তরে যোগ্য এবং প্রশিক্ষিত জনবলকাঠামো সুদৃঢ় করা আবশ্যক। অনতিবিলম্বে অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধ করে বৈধ লেভেলক্রসিংগুলোতে প্রশিক্ষিত গেটম্যান নিয়োগ করে লেভেলক্রসিংয়ে তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে।

ট্রেনের টিকিট পেতে মারাত্মক হয়রানির শিকার সম্প্রতি এক ঢাকা ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থান, নানা আন্দোলন কর্মসূচি রেলওয়ের অব্যাবস্থাপনাকে জাতির সামনে উন্মোচিত করেছে, যা সত্যি লজ্জাজনক। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে রেলওয়ের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি রেলওয়ের রক্ষণাবেক্ষণ ও অপারেশনে জবাবদিহি নিশ্চিতকরণসহ যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন করা গেলে ট্রেনে যাত্রা নিরাপদ হবে এবং রেলযোগাযোগের ভবিষ্যৎ প্রসারও সম্ভব হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষক]