প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়

গাজী আরিফ মান্নান

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষার মাধ্যমে একটি জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে। এই শিখরে পৌঁছানোর প্রথম ধাপই হলো প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা। গুনগত ও মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাই পরবর্তী শিক্ষার মূল ভিত্তি। প্রাথমিক শিক্ষায় একজন শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের সঠিক নির্দেশনা বা পরিচর্যার মাধ্যমে তাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করে। একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের আনন্দের সঙ্গে বিভিন্ন কলাকৌশল ব্যবহার করে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সহযোগিতা করে। সময়ের আবর্তে শিক্ষকই শিক্ষার্থীর তথা একটি জাতির পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

একজন শিক্ষকের প্রথম কাজই হচ্ছে শ্রেণীতে ভালোভাবে পাঠদানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা। সে অনুযায়ী শিক্ষক তার মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন গবেষণা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং তা শ্রেনী পাঠদানে প্রয়োগ করেন। একজন শিক্ষক শুধু বইয়ের শিক্ষা নয়, এর বাইরেও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিকতা শিক্ষা দিয়ে থাকেন। বর্তমান সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একঝাঁক মেধাবী তরুন, তারা পাল্টে দিতে পারে প্রাথমিক শিক্ষাকে এবং শিক্ষার্থীদের।

শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে কাজের ধারাবাহিকতা থাকলেও প্রাথমিক পর্যায়ে সেই সুযোগ থাকে না, প্রাথমিক স্থরে একজন শিক্ষককে শ্রেণী কার্যক্রমের বাইরে বিভিন্ন দাপ্তরিক বা বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকা-ে জড়িত থাকতে হয় সারা বছরই। ফলে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের পাঠদানে পরিপূর্ণ মনযোগ এবং গবেষণা করে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করার সুযোগ খুবই কম। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের পাঠদানের পাশাপাশি আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়। ফলে একজন শিক্ষক শ্রেণীতে ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে পাঠদান কিংবা শ্রেণীতে পরিপূর্ণ সময় ব্যয় করে ফলপ্রসূ পাঠদান করতে পারেন না। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় বঞ্চিত হয় পাঠের মূল বিষয়বস্তু থেকে, পরিণামে অনেক শিক্ষার্থী বার্ষিক বা সমাপনী পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল অর্জন করতে পারে না।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাঠের বাইরে যে সব কাজগুলো করতে হয়, তা নিম্নে তুলে ধরা হলোÑশিক্ষার্থী ভর্তি রেজিস্টার, বই বিতরণ রেজিস্টার, প্রাক প্রাথমিক স্টক রেজিস্টার, প্রাক প্রাথমিক রেজল্যুশন রেজিস্টার, ঝরে পড়া শিক্ষার্থী রেজিস্টার। আরও রয়েছেÑঅভর্তিকৃত শিশুর তথ্য রেজিস্টার, এসএমসি রেজল্যুশন রেজিস্টার, শিক্ষক অভিভাবক সমিতি রেজিস্টার এমন অনেক কাজই করতে হয়। আবার অনেক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নাইট গার্ড না থাকার ফলে পতাকা উত্তোলন থেকে শুরু করে দরজা-জানালাও একজন শিক্ষককেই বন্ধ করতে বা খুলতে হয়।

এসব কার্যক্রম কাজের ধারাবাহিকতার আলোকে প্রতি বছরই করতে হয় একজন প্রাথমিকের বিদ্যালয়ের শিক্ষককে। এজন্য একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে একাডেমিক পাঠদানের বাইরে কি রকম কাজের চাপে থাকতে হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার শিক্ষক স্বল্পতার কারণে অনেক সময় কোন রকম বিরতি ছাড়াই সকাল থেকে ছুটি পর্যন্ত প্রায় ৭-৮টা বিষয়ের পাঠদান চালিয়ে যেতে হয়। এ ছাড়া অবকাঠামো সমস্যা থেকে শুরু করে কক্ষ স্বল্পতা এবং শিক্ষা অফিস থেকে প্রদত্ত নানামুখী কাজের চাপ।

এসব কারণে বর্তমানে মেধাবী শিক্ষকেরা সুযোগ বুঝে অন্য চাকরিতে চলে যায় এবং কিছু সংখ্যক এই চাকরিতে থাকলেও নানারকম অনিয়মের কারণে বা কাজের চাপের কারণে নিজেকে ঠিকভাবে মেলে ধরতে পারেন না বা মেলে ধরতে চায় না। প্রাথমিক শিক্ষায় বিভিন্ন ধরনের কাজ করার ফলে একজন শিক্ষক পাঠদানে উন্নয়ন সাধন কিংবা শিক্ষার্থীদের ফলপ্রসূ পাঠ উপহার দিতে পারেন না। এ ছাড়া প্রাথমিকের শ্রেণী কার্যক্রম দীর্ঘ সময় ধরে পরিচালিত হয়, যা শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। এতে দেখা যায়, অভিভাবকেরাও চিন্তিত হয়ে পড়েন এসব অবুঝ শিশু শিক্ষার্থীদের নিয়ে এবং তাদের খাবার-দাবার ও নিরাপত্তা নিয়ে।

সুতারাং প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতির জন্য প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা এবং একটি মানসম্মত শিক্ষা পদ্ধতি। এর সঙ্গে প্রয়োজন বাস্তবসম্মত সময়সূচিসহ আরও নানাবিদ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত যাতে প্রাথমিক শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। প্রাথমিক শিক্ষায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হলে শিক্ষকদের ওপর কাজের চাপ, হয়রানি এবং কর্মঘণ্টা কমিয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব করতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললে প্রাথমিক শিক্ষায় আশাব্যঞ্জক সাফল্য মিলতে পারে।

[লেখক : শিক্ষক, ফেনী]

মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৪ আশ্বিন ১৪২৯ ২২ সফর ১৪৪৪

প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাসঙ্গিক বিষয়

গাজী আরিফ মান্নান

শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষার মাধ্যমে একটি জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে। এই শিখরে পৌঁছানোর প্রথম ধাপই হলো প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা। গুনগত ও মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাই পরবর্তী শিক্ষার মূল ভিত্তি। প্রাথমিক শিক্ষায় একজন শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের সঠিক নির্দেশনা বা পরিচর্যার মাধ্যমে তাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়তা করে। একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের আনন্দের সঙ্গে বিভিন্ন কলাকৌশল ব্যবহার করে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সহযোগিতা করে। সময়ের আবর্তে শিক্ষকই শিক্ষার্থীর তথা একটি জাতির পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।

একজন শিক্ষকের প্রথম কাজই হচ্ছে শ্রেণীতে ভালোভাবে পাঠদানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা। সে অনুযায়ী শিক্ষক তার মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন গবেষণা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং তা শ্রেনী পাঠদানে প্রয়োগ করেন। একজন শিক্ষক শুধু বইয়ের শিক্ষা নয়, এর বাইরেও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিকতা শিক্ষা দিয়ে থাকেন। বর্তমান সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একঝাঁক মেধাবী তরুন, তারা পাল্টে দিতে পারে প্রাথমিক শিক্ষাকে এবং শিক্ষার্থীদের।

শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে কাজের ধারাবাহিকতা থাকলেও প্রাথমিক পর্যায়ে সেই সুযোগ থাকে না, প্রাথমিক স্থরে একজন শিক্ষককে শ্রেণী কার্যক্রমের বাইরে বিভিন্ন দাপ্তরিক বা বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকা-ে জড়িত থাকতে হয় সারা বছরই। ফলে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের পাঠদানে পরিপূর্ণ মনযোগ এবং গবেষণা করে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করার সুযোগ খুবই কম। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের পাঠদানের পাশাপাশি আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হয়। ফলে একজন শিক্ষক শ্রেণীতে ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে পাঠদান কিংবা শ্রেণীতে পরিপূর্ণ সময় ব্যয় করে ফলপ্রসূ পাঠদান করতে পারেন না। এসব কারণে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় বঞ্চিত হয় পাঠের মূল বিষয়বস্তু থেকে, পরিণামে অনেক শিক্ষার্থী বার্ষিক বা সমাপনী পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল অর্জন করতে পারে না।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাঠের বাইরে যে সব কাজগুলো করতে হয়, তা নিম্নে তুলে ধরা হলোÑশিক্ষার্থী ভর্তি রেজিস্টার, বই বিতরণ রেজিস্টার, প্রাক প্রাথমিক স্টক রেজিস্টার, প্রাক প্রাথমিক রেজল্যুশন রেজিস্টার, ঝরে পড়া শিক্ষার্থী রেজিস্টার। আরও রয়েছেÑঅভর্তিকৃত শিশুর তথ্য রেজিস্টার, এসএমসি রেজল্যুশন রেজিস্টার, শিক্ষক অভিভাবক সমিতি রেজিস্টার এমন অনেক কাজই করতে হয়। আবার অনেক বিদ্যালয়ে দপ্তরি কাম নাইট গার্ড না থাকার ফলে পতাকা উত্তোলন থেকে শুরু করে দরজা-জানালাও একজন শিক্ষককেই বন্ধ করতে বা খুলতে হয়।

এসব কার্যক্রম কাজের ধারাবাহিকতার আলোকে প্রতি বছরই করতে হয় একজন প্রাথমিকের বিদ্যালয়ের শিক্ষককে। এজন্য একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে একাডেমিক পাঠদানের বাইরে কি রকম কাজের চাপে থাকতে হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার শিক্ষক স্বল্পতার কারণে অনেক সময় কোন রকম বিরতি ছাড়াই সকাল থেকে ছুটি পর্যন্ত প্রায় ৭-৮টা বিষয়ের পাঠদান চালিয়ে যেতে হয়। এ ছাড়া অবকাঠামো সমস্যা থেকে শুরু করে কক্ষ স্বল্পতা এবং শিক্ষা অফিস থেকে প্রদত্ত নানামুখী কাজের চাপ।

এসব কারণে বর্তমানে মেধাবী শিক্ষকেরা সুযোগ বুঝে অন্য চাকরিতে চলে যায় এবং কিছু সংখ্যক এই চাকরিতে থাকলেও নানারকম অনিয়মের কারণে বা কাজের চাপের কারণে নিজেকে ঠিকভাবে মেলে ধরতে পারেন না বা মেলে ধরতে চায় না। প্রাথমিক শিক্ষায় বিভিন্ন ধরনের কাজ করার ফলে একজন শিক্ষক পাঠদানে উন্নয়ন সাধন কিংবা শিক্ষার্থীদের ফলপ্রসূ পাঠ উপহার দিতে পারেন না। এ ছাড়া প্রাথমিকের শ্রেণী কার্যক্রম দীর্ঘ সময় ধরে পরিচালিত হয়, যা শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। এতে দেখা যায়, অভিভাবকেরাও চিন্তিত হয়ে পড়েন এসব অবুঝ শিশু শিক্ষার্থীদের নিয়ে এবং তাদের খাবার-দাবার ও নিরাপত্তা নিয়ে।

সুতারাং প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতির জন্য প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা এবং একটি মানসম্মত শিক্ষা পদ্ধতি। এর সঙ্গে প্রয়োজন বাস্তবসম্মত সময়সূচিসহ আরও নানাবিদ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত যাতে প্রাথমিক শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। প্রাথমিক শিক্ষায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হলে শিক্ষকদের ওপর কাজের চাপ, হয়রানি এবং কর্মঘণ্টা কমিয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব করতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললে প্রাথমিক শিক্ষায় আশাব্যঞ্জক সাফল্য মিলতে পারে।

[লেখক : শিক্ষক, ফেনী]