পাঁচ নারী ফুটবলারের জন্য গর্বিত পার্বত্যবাসী

রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ে বেড়ে ওঠা নারী সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক রুপনা চাকমা। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক হওয়ায় তিনি এখন বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। অতিদরিদ্র পরিবারের নারী হয়েও তার অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে তার সাফল্যতে তার মাসহ গ্রামের লোকজন গর্বিত।

এদিকে, গতকাল রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান দুই কৃতী ফুটবলার রুপনা চাকমা ও ঋতুপর্ণা চাকমাকে দেড় লাখ করে তিন লাখ টাকা উপহার দেন। এছাড়া রুপনা চাকমার বাড়ি নির্মাণ ও ঋতুপর্ণাকে রাস্তা নির্মাণের আশ^াস দিয়েছেন।

রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের দুর্গম ভুয়োআদামের জন্ম রুপনা চাকমার। জন্মের আগে তার বাবা মারা যান। তার মা অতিদরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে তাকে কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় করে তোলেন। তবে ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ছিল তার প্রচ- ঝোঁক। গ্রামের হাছাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির পর নানিয়ারচরে উপজেলা পর্যায়ে খেলতে গিয়ে তার ফুটবল শৈলীর নজরে আসে সবাই। পরে ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির পর তার অদম্য শক্তি ও পরিশ্রমে আন্তর্জাতিক অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফ গেমসে দলে দেখতে ডাক পান রুপনা চাকমা।

এদিকে নারী সাফ ফুটবলে চ্যাম্পয়িন ও টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক হয়ে দেশের জন্য গৌরব অর্জনে তার মা ও গ্রামের লোকজন এখন খুশিতে আত্মহারা। গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, দুর্গম ভুইয়োদামে রুপনার মা কালোসোনা চাকমা বসে রয়েছেন ভাঙা একটি কুঁড়েঘরে। পাশে রয়েছে তার ভাইয়ের বাড়ি। ভাই ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে রুপনা নেপালে গিয়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন তার কথা বলাবলি করছিলেন।

রুপনার আপন বড় ভাই জীবন চাকমা বলেন, রুপনা ছোটবেলা থেকে খেলা পছন্দ করত এবং খেলার জন্য বন্ধুদের সঙ্গে মিশত। বিকেলে কাজ থেকে ফিরে মায়ের কাছ থেকে শুনি বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। গ্রামের লোকেরা রুপনাকে নিয়ে প্রশংসা করছে।

ভুইয়োদাম গ্রামের বাসিন্দা আলো বিকাশ চাকমা বলেন, রুপনার জন্মও হয়নি তার বাবা মারা গেছেন। মা তাদের অনেক কষ্ট করে বড় করেছেন। সেই রুপনা আজ আমাদের গ্রামের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। আমার তার জন্য গর্ববোধ করছি।

রুপনা চাকমার মা কালা সোনা চাকমা বলেন, ছোটবেলা থেকে রুপনা চাকমার ফুটবলের প্রতি প্রচ- ঝোঁক ছিল। ছোটবেলায় একবার প্রচ- জ¦র উঠেছিল কিন্তু তারপরও মাঠে খেলতে গিয়েছিল রুপনা। তার যেহেতু খেলার প্রতি আগ্রহ ছিল তাই আমি কোন দিনই তাকে বাধা দেইনি। বাংলাদেশ-নেপালের খেলাটি মোবাইলে দেখেছি। আমার মেয়ে দেশের জন্য বিজয় ছিনিয়ে আনায় গর্ববোধ করছি এবং খুবই খুশি লাগছে।

তিনি আরও জানান, ২০১২ সালে সে নানিয়ারচরে ফুটবল খেলতে গিয়েছিল। সেখানে তার খেলা পছন্দ হয়ে বীরসেন চাকমা ও শান্তি মনি চাকমা তাকে ঘাগড়াতে নিয়ে যান। তাদের অবদান রয়েছে।

গ্রাম প্রধান সুদত্ত বিকাশ চাকমা বলেন, রুপনা চাকমা সম্পর্কে ভাগিনা হয়। সে ছোটবেলা থেকে খেলাধুলাপ্রেমী। গ্রামের মানুষ তাকে নিয়ে গর্ববোধ করছে। তবে তার পরিবার ও তাকে এ পর্যন্ত সাহায্য সহযোগিতা করতে কাউকে দেখিনি। সরকার চাইলে রুপনার জন্য কিছু করতে পারে।

মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা বলেন, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে রুপনাকে ঘাগড়াতে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে রাজি ছিল না। ২০১৪ সালে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তাকে ঘাগড়াতে নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে সে সেরা গোলরক্ষক হিসেবে কৃতিত্ব অর্জন করে। তার এ অর্জন শুধু তার নয়। এ অর্জন পুরো দেশবাসীর।

ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মহিলা প্যানেল চেয়ারম্যান বাসন্তী চাকমা বলেন, রুপনা আমাদের ইউনিয়নের মেয়ে। তার জন্য আমরা গর্ববোধ করছি। কেননা সে আমাদের গ্রামের মেয়ে হয়ে বাংলাদেশের জন্য শিরোপা এনে দিয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তাকে যদি সহায়তা করা হয় তবে অনেক ভালো হয়। কেননা তার বাবা নেই। ছোটবেলা থেকে সে তার বাবকে দেখেনি।

এদিকে গতকাল রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ঋতুপর্ণা চাকমা ও রুপনা চাকমার গ্রামের বাড়িতে যান। এ সময় দুই ফুটবলার ঋতুপর্ণা চাকমা ও রুপনা চাকমার পরিবারকে দেড় লাখ টাকা করে ৩ লাখ টাকা তুলে দেন। এছাড়া রুপনা চাকমা গ্রামে এলাকাবাসীর সুবিধার জন্য একটি ব্রিজ নির্মাণ ও রুপনা চাকমাকে একটি বাড়ি নির্মাণের আশ^াস দেন।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ঋতুপর্ণা চাকমা ও রুপনা চাকমা আমাদের রাঙামাটির সন্তান। তাদের এ অর্জন পুরো বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। তাদের এ কৃতিত্বের জন্য তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও করা হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সবকিছুই সহায়তা দেয়া হবে।

খাগড়াছড়ি, প্রতিনিধি জানান, গত সোমবার কাঠমা-ুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-নেপালের মধ্যে অনুষ্ঠিত সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবারের মতো শিরোপার জয় লাভ করে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। এ দলে খাগড়াছড়ি জেলা থেকে তিনজন খেলোয়াড় ও একজন কোচ ছিলেন। তারা হলেন খাগড়াছড়ির মনিকা চাকমা, আনাই মগিনি ও আনুচিং মগিনি এবং দলের সহকারী কোচ হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন তৃষ্ণা চাকমা। আনাই ও আনুচিং দুই যমজ বোন। দলের সহকারী কোচ তৃষ্ণা চাকমার বাড়িও এ জেলায়।

বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৫ আশ্বিন ১৪২৯ ২৩ সফর ১৪৪৪

পাঁচ নারী ফুটবলারের জন্য গর্বিত পার্বত্যবাসী

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, পার্বত্যাঞ্চল

image

রাঙামাটির দুর্গম পাহাড়ে বেড়ে ওঠা নারী সাফ চ্যাম্পিয়ন দলের শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক রুপনা চাকমা। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক হওয়ায় তিনি এখন বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। অতিদরিদ্র পরিবারের নারী হয়েও তার অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে তার সাফল্যতে তার মাসহ গ্রামের লোকজন গর্বিত।

এদিকে, গতকাল রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান দুই কৃতী ফুটবলার রুপনা চাকমা ও ঋতুপর্ণা চাকমাকে দেড় লাখ করে তিন লাখ টাকা উপহার দেন। এছাড়া রুপনা চাকমার বাড়ি নির্মাণ ও ঋতুপর্ণাকে রাস্তা নির্মাণের আশ^াস দিয়েছেন।

রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের দুর্গম ভুয়োআদামের জন্ম রুপনা চাকমার। জন্মের আগে তার বাবা মারা যান। তার মা অতিদরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে তাকে কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় করে তোলেন। তবে ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ছিল তার প্রচ- ঝোঁক। গ্রামের হাছাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির পর নানিয়ারচরে উপজেলা পর্যায়ে খেলতে গিয়ে তার ফুটবল শৈলীর নজরে আসে সবাই। পরে ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির পর তার অদম্য শক্তি ও পরিশ্রমে আন্তর্জাতিক অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফ গেমসে দলে দেখতে ডাক পান রুপনা চাকমা।

এদিকে নারী সাফ ফুটবলে চ্যাম্পয়িন ও টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক হয়ে দেশের জন্য গৌরব অর্জনে তার মা ও গ্রামের লোকজন এখন খুশিতে আত্মহারা। গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে, দুর্গম ভুইয়োদামে রুপনার মা কালোসোনা চাকমা বসে রয়েছেন ভাঙা একটি কুঁড়েঘরে। পাশে রয়েছে তার ভাইয়ের বাড়ি। ভাই ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে রুপনা নেপালে গিয়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন তার কথা বলাবলি করছিলেন।

রুপনার আপন বড় ভাই জীবন চাকমা বলেন, রুপনা ছোটবেলা থেকে খেলা পছন্দ করত এবং খেলার জন্য বন্ধুদের সঙ্গে মিশত। বিকেলে কাজ থেকে ফিরে মায়ের কাছ থেকে শুনি বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। গ্রামের লোকেরা রুপনাকে নিয়ে প্রশংসা করছে।

ভুইয়োদাম গ্রামের বাসিন্দা আলো বিকাশ চাকমা বলেন, রুপনার জন্মও হয়নি তার বাবা মারা গেছেন। মা তাদের অনেক কষ্ট করে বড় করেছেন। সেই রুপনা আজ আমাদের গ্রামের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। আমার তার জন্য গর্ববোধ করছি।

রুপনা চাকমার মা কালা সোনা চাকমা বলেন, ছোটবেলা থেকে রুপনা চাকমার ফুটবলের প্রতি প্রচ- ঝোঁক ছিল। ছোটবেলায় একবার প্রচ- জ¦র উঠেছিল কিন্তু তারপরও মাঠে খেলতে গিয়েছিল রুপনা। তার যেহেতু খেলার প্রতি আগ্রহ ছিল তাই আমি কোন দিনই তাকে বাধা দেইনি। বাংলাদেশ-নেপালের খেলাটি মোবাইলে দেখেছি। আমার মেয়ে দেশের জন্য বিজয় ছিনিয়ে আনায় গর্ববোধ করছি এবং খুবই খুশি লাগছে।

তিনি আরও জানান, ২০১২ সালে সে নানিয়ারচরে ফুটবল খেলতে গিয়েছিল। সেখানে তার খেলা পছন্দ হয়ে বীরসেন চাকমা ও শান্তি মনি চাকমা তাকে ঘাগড়াতে নিয়ে যান। তাদের অবদান রয়েছে।

গ্রাম প্রধান সুদত্ত বিকাশ চাকমা বলেন, রুপনা চাকমা সম্পর্কে ভাগিনা হয়। সে ছোটবেলা থেকে খেলাধুলাপ্রেমী। গ্রামের মানুষ তাকে নিয়ে গর্ববোধ করছে। তবে তার পরিবার ও তাকে এ পর্যন্ত সাহায্য সহযোগিতা করতে কাউকে দেখিনি। সরকার চাইলে রুপনার জন্য কিছু করতে পারে।

মগাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা বলেন, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে রুপনাকে ঘাগড়াতে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে রাজি ছিল না। ২০১৪ সালে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তাকে ঘাগড়াতে নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে সে সেরা গোলরক্ষক হিসেবে কৃতিত্ব অর্জন করে। তার এ অর্জন শুধু তার নয়। এ অর্জন পুরো দেশবাসীর।

ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মহিলা প্যানেল চেয়ারম্যান বাসন্তী চাকমা বলেন, রুপনা আমাদের ইউনিয়নের মেয়ে। তার জন্য আমরা গর্ববোধ করছি। কেননা সে আমাদের গ্রামের মেয়ে হয়ে বাংলাদেশের জন্য শিরোপা এনে দিয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তাকে যদি সহায়তা করা হয় তবে অনেক ভালো হয়। কেননা তার বাবা নেই। ছোটবেলা থেকে সে তার বাবকে দেখেনি।

এদিকে গতকাল রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ঋতুপর্ণা চাকমা ও রুপনা চাকমার গ্রামের বাড়িতে যান। এ সময় দুই ফুটবলার ঋতুপর্ণা চাকমা ও রুপনা চাকমার পরিবারকে দেড় লাখ টাকা করে ৩ লাখ টাকা তুলে দেন। এছাড়া রুপনা চাকমা গ্রামে এলাকাবাসীর সুবিধার জন্য একটি ব্রিজ নির্মাণ ও রুপনা চাকমাকে একটি বাড়ি নির্মাণের আশ^াস দেন।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ঋতুপর্ণা চাকমা ও রুপনা চাকমা আমাদের রাঙামাটির সন্তান। তাদের এ অর্জন পুরো বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত। তাদের এ কৃতিত্বের জন্য তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও করা হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সবকিছুই সহায়তা দেয়া হবে।

খাগড়াছড়ি, প্রতিনিধি জানান, গত সোমবার কাঠমা-ুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-নেপালের মধ্যে অনুষ্ঠিত সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথমবারের মতো শিরোপার জয় লাভ করে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। এ দলে খাগড়াছড়ি জেলা থেকে তিনজন খেলোয়াড় ও একজন কোচ ছিলেন। তারা হলেন খাগড়াছড়ির মনিকা চাকমা, আনাই মগিনি ও আনুচিং মগিনি এবং দলের সহকারী কোচ হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন তৃষ্ণা চাকমা। আনাই ও আনুচিং দুই যমজ বোন। দলের সহকারী কোচ তৃষ্ণা চাকমার বাড়িও এ জেলায়।