জ্যাঁ লুক গদারের স্ব-অধিকৃত সিনেমাজগত

গৌতম গুহ রায়

১৯৬০ সাল, এই বছরটিতে ফরাসি চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে একটা খড়ির সাদা দাগ দিয়ে দ্বিখ-িতকরনের চিহ্ন টানা হয়। চলচ্চিত্র আলোচকেরা বলেনÑ এ বছর জ্যাঁ লুক গদারের ‘ব্রেথলেস’ (অ্যা বোত দে সোফাল)-এর আগে বিশ্বের চলচিত্রের ইতিহাস এক রকম ছিলো, আর পরে আরেক রকম হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, চলচিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণময় চরিত্রটি বিদায় নিলেন। ৯১ বছর বয়সে এই মৃত্যু তাঁর স্বেচ্ছা আহূত, সম্ভবত শেষ জীবনের গ্লানিকে আর বইতে চাইছিলেন না। নৈতিকভাবে দিশাহীন ও আত্মিকভাবে নিঃস্ব হতে থাকা এই বিশ্বে গদারের মতো আকাশচুম্বি প্রতিভার একজন দার্শনিক-শিল্পীর শেষ বিদায় যখন ঘটে, তখন আমরা শুধু নিস্ব হই না, এই শূন্যতা আমাদের এক অতল খাদের দিকে গড়িয়ে দেয়। গদার তাঁর সিনেমাকে কোন স্বতন্ত্রীকরণের দিকে নিয়ে যায় এভাবে না বলে বলা যায় যে ফিল্মের জগতকে গদার পৌঁছে দেন তার স্ব-অধিকৃত রাজ্যে। ফরাসি চলচিত্রকার গদারের ফিল্ম আমি প্রথম যখন দেখি তখন পৃথিবীর রাজনৈতিক মানচিত্র ক্রমশ পালটে যাচ্ছে, ষাট সত্তরের দশকে যখন অন্য ধারার ফিল্ম, থিয়েটার নির্মাণের ঝড় উঠেছিলো তা কিছুটা স্তিমিত। এই ক্রমশ শীতল হয়ে আসা সময়েই তিনি এলেন, স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, ‘আই অ্যাম ট্রাইং টু চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড, ইয়েস।’

১৯৮৩তে জলপাইগুড়ি সিনে সোসাইটির উদ্যোগে সেবার ফেলিনি ও গদারের ফিল্ম দেখানো হচ্ছিলো, সেবারই আমার প্রথম গদার দেখা, ‘ব্রেথলেস’। আমার কেন জানি না এর শতবর্ষ আগের বিশ্ব সাহিত্যের প্রাঙ্গণে তোলপাড় করে দেওয়া এক রুশ সাহিত্যিকের কথা মনে এলো, দস্তয়েভস্কি। মাঝে শতবর্ষের ব্যবধান রেখে দুজনেই অপরাধ ঘরাণার সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে এক নতুন বয়ানের সঙ্গে পরিচয় করান, যেমন ছিলো ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’ বা ‘ব্রাদার কারমাজভ’-এর দস্তয়েভস্কি, তেমনি গদারের ‘ব্রিদলেস’ বা ‘দ্যু অ ত্রোয়া সোসেস কি যে স দেল’। ‘ব্রেথলেস’-এর স্ক্রিপ্ট রচনা করেছিলেন দুজনে মিলে, ফ্রাঁসোয়া ক্রুফো ও স্বয়ং গদার। ‘ব্রেথলেস’-এর কাহিনীতে দেখা যায় যে, হলিউডের সুপার হিট নায়ক হাফ্রে বোগার্টের অনুরক্ত তরুণ ও চৌকস মস্তান মাইকেল প্রচ- গতির উত্তেজনায় প্রতিটি দিন কাটায়। মার্সেলে সে একটি গাড়ি চুরি করার পর তাকে পুলিশে ধাওয়া করে। একটি গ্রাম্য ফাঁকা জায়গার সে বুদ্ধি করে সেই পুলিশটিকে নিয়ে আসে এবং তাকে সেই নির্জনতার সুযোগে খুন করে। তরুণী সাংবাদিক প্যাট্রিসিয়া তার প্রেমিকা। কপর্দকহীন মাইকেল পুলিশের তাড়ায় প্যাট্রেসিয়ার ফ্ল্যাটে আশ্রয় নেয়। নিয়ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করে কিছু টাকা যোগাড় করা এই প্যাট্রিসিয়াকে নানা সময় তার চুরি প্রভৃতির কাজে লাগিয়েছিলো মাইকেল। ইতালিতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করে সে এবং প্যাট্রিসিয়ার কাছে সেই কারণে টাকা ধার চায়। কিন্তু প্যাট্রিসিয়া তখন জানায় যে, সে মাইকেলের সন্তানকে ধারণ করে মা হতে যাচ্ছে। এই সময়েই সে জানতে পারে যে মাইকেল পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে এসেছে। প্যাট্রিসিয়া মাইকেলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে পুলিশকে খবর দেয়। কিন্তু নিজের পেটের হবু সন্তানের কথা ভেবে তার মনঃপীড়া হয়, সে মাইকেলকে পালাতে বলে। কিন্তু এবার আর মাইকেল পালাতে চায় না। সে আত্মসমর্পণ করে জেল খাটার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পুলিশ চলে এলে আবার মন পালটায় ও পালাতে চায়, কিন্তু এই সময় পুলিশের গুলিতে মারা যায় মাইকেল। এই ‘ব্রেথলেস’-এর এক বছর আগেই ফ্রাঁসোয়া ক্রুফোর ‘৪০০ ব্লো’ মুক্তি পায়, সেখানেও অপরাধ মনস্তত্ত্বের কথা উঠে আসে, ফিল্মটির কেন্দ্রে থাকা একটি কিশোর এন্তোনিওকে নিয়ে। কিন্তু গদার একদম অন্য ধরনের ট্রিটমেন্ট নিয়ে উদয় হন।

আর একটি বিষয়েও আমার দস্তয়েভস্কি ও গদারকে কাছাকাছি রাখতে ইচ্ছে হয়, দুজনেই পরিহার করেছেন নাগরিক সুখের গল্প, তাঁদের সাহিত্যে বা সিনেমায় ল্যান্ডস্কেপ বা প্রাকৃতিক সুষমা অনুপস্থিত, রয়েছে মানুষের মনস্তত্ব। কখনো কখনো যদিও দস্তয়েভস্কি থেকে গদার রুক্ষ,

বন্য, যৌন আবেদনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দস্তয়েভস্কির মতো গদারও ভীষণভাবে নাগরিক। গ্রাম্য জীবন প্রায় নেই, আর নগর জীবন মানে অনেকটা জুড়েই প্যারিস, যেমন দস্তয়েভস্কির পিটার্সবুর্গ। প্যারিসের আলো-আঁধারী গলি-ঘিঞ্জি, রাস্তার পতিতা, প্রাচুর্য ও দৈন্যের সহাবস্থান গদারের ফিল্মে যেমন এসেছে; তেমনি দস্তয়েভস্কির সাহিত্যেও এসেছে পিটার্সবুর্গের আধো অন্ধকারের রাস্তা, পতিতা, বৈষম্যের সামাজিক উল্লাস ও বিষাদ। দুজনেরই প্রেমের আখ্যান একে অন্যের থেকে ভিন্ন। এঁদের সাহিত্যে বা সিনেমায় প্রেম যেন সর্বগ্রাসী আত্মক্ষয়ে আশ্রয় হয়ে আসে। প্রেম হোক বা সামাজিক যাবতীয় সম্পর্কেরই ভিত্তিতে থাকে সামাজিক রাজনীতি। ক্রুফো ও গদার একই সময়ে সিনেমা বানিয়েছেন, একই সঙ্গে স্ক্রিপ্ট লিখেছেন, কিন্তু দুজনের মধ্যে অনেক রয়েছে পার্থক্য। খুব অল্প বয়সেই ক্রুফো মস্তিষ্কের ক্যান্সারে মারা যান, গদার ৯১ বছর বেঁচে থেকে ‘স্বেচ্ছামরণ’-এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ক্রুফো গল্প বলতে ভালোবাসতেন, মানবিক প্রেম ও প্রেমহীনতা নিয়ে, নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে করা তার সিনেমাগুলোতেও আসলে ভালোবাসারই আখ্যান রচিত হয়েছে। গদার সেখানে কোনও গল্প বলেন না, মানুষের দৈনন্দিন যাপনের টুকরো টুকরো বিবরণ তুলে আনেন, তিনি কোনো ঘটনা বা না-ঘটনার সরলরৈখিক গতিতে আস্থাশীল ছিলেন না। দর্শকের মগজকে আক্রমণ করার কাজটা তিনি করতে চাইতেন, তার প্রতিটি কাজ সেই বিস্ফোরক বহন করে। দর্শককে স্বস্তি দেওয়া তাঁর লক্ষ্য নয়, তিনি চাইতেন দর্শকের ভেতর একটা তোলপাড় বা ভাংচুর শুরু হোক। রাজনীতি থেকে যৌনতা, যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন তিনি চমকে দিয়েছেন, স্তব্ধ দর্শক ভাবতে বাধ্য হয়েছেন, এমন ভাবেও ফিল্মি ভাষা কথা বলে? চরম অন্তঃসারশূন্যতাকে কতখানি বাক্সময় করে তোলা যায় তা গদারের সিনেমা আমাদের শিখিয়েছে। গদারের সিনেমা গড়পড়তা সিনেমা দর্শকের ভালোলাগার কথা নয়, কিন্তু দেখতে হয়। মগজ লক্ষ্য করে তাঁর হানা শক্তিশেল এমন অস্থির করে দেবে যে, ফিল্মটি তখন বারেবারে দেখতে হবে, শিখবার জন্য।

গদারের প্রসঙ্গে বলা হয় যে, তিনি সিনেমার মাধ্যমে প্রবন্ধ লেখেন। ডেভিড স্টোরিটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গদার ‘মোশন পিকচার’ প্রসঙ্গে বলেন যে, ‘মোশন পিকচার, দেখতে, বলতে আর অধ্যয়ন করতেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। ওগুলো হলো জীবনকে নানা দিক থেকে দেখার বৈজ্ঞানিক হাতিয়ার...। সিনেমার মাত্র ৫ বা ৬ শতাংশ হওয়া উচিত দর্শনীয়। বাদবাকি পুরোটাই হওয়া উচিৎ তথ্যগত অধ্যায়ন, বৃহৎ অর্থে গবেষণা এবং প্রবন্ধ। আমি অর্ধেক ঔপন্যাসিক এবং অর্ধেক প্রাবন্ধিক’। আর একটি কথাও তাঁর প্রসঙ্গে বলা হয় সেটি ‘দুর্বোধ্যতা’। গদার সেই চলচিত্রকার যে সিনেমার আম-দর্শকদের সিনেমা দেখার ভঙ্গি পাল্টানোর কথা বলেন, বলেন, ‘উই হ্যাভ টু ফাইট দি অডিয়েন্স’, নিষ্ক্রিয়ভাবে সিনেমা দেখার বিরুদ্ধে এই ‘লড়াই’ তাঁর। সেই অভ্যাসকে আক্রমণ করতে চান তিনি, বিশ্বাসের সঙ্গে বলেন ‘মুভি গোয়ার্স’ ‘শুড বি ট্রিটেড উইথ ফার মোর রেস্পেক্ট দ্যান টিপিক্যাল হলিউড প্রোডাক্টস আ্যলাও’। সিনেমায় গল্প বলা বা টেকনিক্যাল চাতুর্য দিয়ে দর্শককে মোহিত করার উল্টোদিকে হেঁটে যাওয়া ফিল্ম দার্শনিকদের অন্যতম ছিলেন জাঁ লুক গদার। তাঁর ফিল্মে যাবতীয় কিছুই আসতে পারে, এনেছেন তিনি, অথচ গল্প বলার পথে গেলেও তিনি জনপ্রিয় হতে পারতেনÑ ‘ব্রেথলেস’ তার প্রমাণ। গল্প নিয়ে সিনেমা করার কতটা ক্ষমা তাঁর ছিলো সেটা এই ফিল্ম থেকে বুঝতে পারা যায়। গল্প বলা থেকে সরে গিয়ে যা খুশি তাই ফিলে আনার স্বপক্ষে ১৯৬৭তে লেখেন, ‘ওয়ান শুড পুট এভ্রি থিং ইনটু এ ফিল্ম’। তাঁর আলোকচিত্র শিল্পী ক্যুতর বলেছেন যে, তিনি একই সঙ্গে সমস্ত কিছু চান তার চলচ্চিত্রেÑ দর্শন, ধর্ম, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাষ্কর্য, স্থাপত্য, টেকনলজি, পপার্ট, খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদ, চিঠিপত্রাদি প্রভৃতি। তাঁর চলচিত্র তাই রীতি বিরুদ্ধ চলচিত্র। সিনেমার সূচনা থেকেই তাঁর পরিবর্তন সূচিত হয়। আঙ্গিকগত মুন্সিয়ানায় তিনি প্রথমেই ‘পরিচলক’ অভিধাটি পালটে দেন। লেখা হয়Ñ ‘ঈরহবসধ : ঔবধহ খঁপ এড়ফধৎফ’। এই গোটা বিষয়টা এক প্রখর চেতনাঋদ্ধ মেজাজকেই শুধু প্রতিফলিত করে না, এর প্রয়োগকলাকেও পালটে দেয়। ফরাসি টেলিভিশন যখন তাঁর ‘লা গাই স্যাভোয়া’ প্রচার নিষিদ্ধ করে, যেটি বানানোই হয়েছিলো দূরদর্শনের জন্য; আরো প্রত্যক্ষ বয়ানে চলে আসেন গদার। এর ফলে ক্রমশ একের পর এক তাঁর সিনেমা নিষিদ্ধ হতে থাকে, যেগুলো বানানো হয়েছিলো টেলিভিশনের জন্য। বিবিসির জন্য বানানো ‘ব্রিটিশ সাউন্ড’, জার্মান টিভির জন্য বানানো ‘প্রাভদা’ ও ‘ভøাদিমির আ রোজা’, ইতালির টিভির জন্য বানানো ‘লোত অ্যাঁ ইতালিয়া’ প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু আপসহীন গদার এরপর ক্রমশ ফিল্মে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের সমীকরণ থেকে সরে আসেন। ‘স্ত্রী-পুত্র ও আমাদের সুখী গৃহকোণ’Ñ এই জায়গা থেকে সরে আসেন তিনি। তার ছবিতে পরিবার অন্য মাত্রা নেয়। এমনকি শিশুও অনুপস্থিত হতে থাকে ক্রমশ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সামাজিক মুক্তির দিশা পরিপন্থী। সেখানে ব্যক্তির ব্যক্তিগত সমস্যাকেই প্রধান করে দেখানো হয়, সামাজিক বাস্তবতাকে আড়াল করে রাখা হয়, বিনোদনের এই বাণিজ্যের বিপ্রতীপে থাকতেন গদার। নিজেকে তাই বুর্জোয়া শিল্পকলার ছায়া থেকে শ্রেণি সচেতন বাস্তবতার রোদে এনে দাঁড় করান শিল্পকে।

গদার রাজনৈতিক মতাদর্শে মার্ক্সবাদের দিকে ছিলেন, আরো স্পষ্ঠভাবে বলা যায় তিনি ছিলেন মাওপন্থী সমর্থক। বিশ্বাস করতেন সমাজব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তনের সংগ্রামে। তবে তাঁর দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কমিউনিস্ট পার্টির ধীরলয়ে সক্রিয়তার বিপক্ষে থেকে তিনি চাইতেন দ্রুত ও সক্রিয় পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে হিংসা আসতেই পারে বলে মনে করতেন। যাবতীয় বুর্জোয়া সিস্টেমের প্রতি তাঁর ছিলো অসীম ঘৃণা। সমাজের ভিতটাকেই পালটে দিতে তাই ফিল্মকেই করে তুলেছিলেন তাঁর আয়ুধ। চেতনার প্রারম্ভ থেকেই তিনি অস্থির ও প্রতিবাদী। তাঁর নিজের সম্পর্কে লিখেছেন যে, ‘আমি এক বুর্জোয়া পরিবারে বড় হয়েছি এবং তারপরে পালিয়ে গেছি। এলএসডি-মারিজুয়ানার কাছে না গিয়ে আমি ছবির জগতে এসেছি। তারপর আমি আবিষ্কার করলাম যে, ছবির এই জগত আরো বেশি রকম বুর্জোয়া পরিবার।”

গদারের ‘তার সম্পর্কে যে দু’একটা কথা আমি জানি’ (দুউ অ ত্রোয়া সোসেস কি যে স দেল) আলোচনার বিশেষ গুরুত্ব দারি করে, এখানে তিনি ষাট দশকের ফ্রান্সে ধনতন্ত্রের অবস্থার একটা সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দিলেন। এতে আমরা দেখি শিল্প সম্পর্কে তার স্পষ্ট উচ্চারণ ছিলো, “শিল্প কী? সত্যি কথা বলতে কি, মানুষ নিজেই শৈলী অতএব শিল্প হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া যেখানে আকার হয়ে ওঠে মানুষ।” এই সিনেমায় খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সময়। ষাটের দশক, ঐতিহ্য-জড়ানো পুরোনো প্যারিস ভাঙছে। এক নতুন নগর জন্ম নিচ্ছে, ভেঙে পড়ছে পুরোনো মূল্যবোধ ভাঙছে, নৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোও। সামাজিক বন্ধন ও রক্ষণশীলতা পালটে যাচ্ছে আর এক অন্য প্যারিস জন্ম নিচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে নগরে বসবাসকারী মানুষজনও ধীরে ধীরে ভাঙতে থাকে, এখানেই এটা প্যরিসের সীমা ছাড়িয়ে আমার শহরেরও গল্প হয়ে ওঠে। তৎকালীন প্যরিসের, ফ্রান্সের রাজনীতি হয়ে ওঠে আমাদের কলকাতা ঢাকার রাজনীতি। ফিল্ম শেষ হয় কিন্তু গদারীয় রেশ থেকে যায়, ‘মৃত বস্তুরা সবসমই জীবন্ত। জীবন্ত মানুষ কখনও কখনও ইতিমধ্যেই মৃত’।

নিজের জীবনের ইলিউশান ও সততায় বিশ্বাসী গদার তার সৃজনে ক্রমানুবর্তিতা ভেঙ্গে কেন্দ্রীয় চরিত্রকে হঠাৎ করেই দর্শকের মুখোমুখি ফেলে দেন, তাদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। এর সঙ্গে সঙ্গে এটাও লক্ষণীয়, বোধ হয় গদারের চলচ্চিত্রে ‘সার্ভাইভাল’ চরিত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল, তাদের বিলয় ঘটিয়ে দেন তিনি। দর্শকের সামনে থাকা প্রচলিত রীতিকে উপেক্ষা করে তাঁর চরিত্রগুলো হয় ক্ষণস্থিতি এবং তাদের প্রবেশ প্রস্থান ও আচরণ চলিত রীতিবিরুদ্ধ হয়। শেষের দিকের ফিল্মগুলোতে দেখা যায় চলতে চলতে তিনি সাউন্ড ট্রাক বন্ধ করে দিচ্ছেন, অসহায় চরিত্রগুলো তখনো স্ক্রিনে রয়ে গেছে। আবার কোনো ফিল্মে দেখা যায় মাঝে মাঝে কালো শূন্যতা। এই নানা দৃশ্য বা প্রতি-দৃশ্য আসলে তার চলচিত্রে ইউরোপের আত্মিক অনিশ্চয়তা বা অসহতার কথা বলে। তাঁর শিল্পের অভিমুখ থাকে সমাজব্যবস্থার স্বরূপের উদ্ঘাটনের দিকে। তার শহর মানুষ পরিত্যক্ত স্তব্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার চরিত্রগুলো ঘুরে বেরায় নাগরিক যাপনের জটিল পয়েন্টগুলোয়। গদারের সিনেমায় বেশিরভাগ ঘটনাস্থল হিসাবে তাই বেছে নেন জেটি, কাফে, অটোমোবাইলস স্টেশান, পরিত্যক্ত প্রাসাদ। এই প্লটের ভিত্তিভূমিতে তিনি নির্মাণ করতেন তাঁর স্বতন্ত্র সামাজিক রাজনৈতিক বয়ান। গদারের সিনেমায় বারেবারে ফিরে আসে বেশ্যাবৃত্তি, পতিতারা। এই প্রসঙ্গে পরিচালক তানভীর মোকাম্মেলের আলোচনা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যায়, “... বুর্জোয়া সমাজের একটা বড় পাপকে গদার বারে বারেই ওঁর চলচ্চিত্রে এনেছেন। তা হচ্ছেÑ পতিতাবৃত্তি। শুধু প্যারিসের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো পতিতাদের নয়, এ সমস্যা যেন সমগ্র পুঁজিবাদী সমাজেরই সমস্যা, যে সমাজের বুদ্ধিজীবী, লেখক- সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতাÑ সবাইই নগদ বিদায়ের বদলে মার্কিনী কোকাকোলা সভ্যতার পতিতাবৃত্তি করছে, ডলারের কাছে প্রতিনিয়ত বিক্রি করছে তাদের সংস্কৃতি, তাদের মনন ও বিবেকবোধ। এদের বিরুদ্ধে গদার সর্বদাই থাকতে চেয়েছেন নির্মম”। গদার নারীমুক্তির পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। নারীকে পুরুষ জাত্যাভিমানের জন্য নিছক একটি যৌন সামগ্রী হিসাবে দেখার পুঁজিবাদী দর্শনের বিপক্ষে নানাভাবে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৭৫-এ করা তাঁর ‘নিউমরো দু’সিনেমাটিতে বিভিন্ন দৃশ্যে নারীমুক্তির কথা জোরের সঙ্গে বলেছেন। গদার স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিবাদ নির্মিত যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার বিপক্ষে সরব ছিলেন। ১৯৬৩তে বানানো ‘লা ক্যারিবিনিয়ার্স’ তাঁর একটি শক্তিশালী যুদ্ধবিরোধী সিনেমা। এই সিনামায় এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্যে দেখা যায় অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্রের মেয়েটি মায়াকোভস্কির কবিতা পড়তে পড়তে মারা যাচ্ছেন।

১৯৬৬তে ‘দু অ ত্রোয়া সোসেস কি যে সদেল’ ছবিতে গদার ষাট দশকের ফ্রান্সে ধনতন্ত্রের অবস্থার একটা সূক্ষতম রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দিলেন এবং দেখালেন গল সরকার কীভাবে দেশে পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিস্তার ঘটাচ্ছে। এরপর ‘উইক এন্ড’ থেকে তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য আরো সরাসরি চলে আসে। ১৯৬৮-র গণআন্দোলনের পর গদারকে চরম বামপন্থী হিসাবে ধরে নিয়ে সরকার তাঁর ‘লা গাই স্যাভোয়া’ ছবিটি ফ্রান্সে টেলিভিশনে প্রচার নিষিদ্ধ করে। ইতিমধ্যে গদার বাণিজ্যিক চলচিত্র নির্মাণের সমস্ত পরম্পরাকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এরপর ফ্রান্স, জার্মানি বা ইতালির টেলিভিশনের জন্য অনেকগুলো ফিল্ম নির্মাণ করেন তিনি। এই সিনেমাগুলোতে দেখা গেলো যে, গদার ক্রমশ ব্যক্তি ধ্যানধারণা থেকে সড়ে আসছেন। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাজাত শিল্পকলায় দেখা যায় যে সৃষ্ঠ চরিত্রগুলো এমন পরিবেশে বিচরণ করে, যেখানে তার ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত সমস্যাবলীই সামাজিক বাস্তবতার চাইতে বেশি প্রাধান্য পায়। ব্যক্তি থেকে শ্রেণিতে উত্তরণের এই প্রয়াসের ফলে শিল্পকলা এক স্বতন্ত্র পথের মুখোমুখি হলো, যার সৃজনপুরুষ জাঁ লুক গদার। বিশ্বের যেখানে যেখানে নির্যাতিত মানুষের আর্তি বিশ্বের আকাশ-বাতাসে গুঞ্জরিত হয়েছে সেখানেই প্রতিবাদের স্বর নিয়ে হাজির গদার। প্যালেস্টাইনের গেরিলাদের পাশে থেকে বানিয়েছেন ‘টিল ভিক্ট্রি’, তাঁর ‘লা ক্যারিবিনিয়ার্স’ সিনেমায় সা¤্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে তীব্র আঘাত করেছেন। পথ অনুসন্ধানী গদার আমাদের এই অসুস্থ বিশ্বের সামনে এক উজ্জ্বল ঝা-া।

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৬ আশ্বিন ১৪২৯ ২৪ সফর ১৪৪৪

জ্যাঁ লুক গদারের স্ব-অধিকৃত সিনেমাজগত

গৌতম গুহ রায়

image

জ্যাঁ লুক গদার / জন্ম : ৩ ডিসেম্বর ১৯৩০; মৃত্যু : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

১৯৬০ সাল, এই বছরটিতে ফরাসি চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে একটা খড়ির সাদা দাগ দিয়ে দ্বিখ-িতকরনের চিহ্ন টানা হয়। চলচ্চিত্র আলোচকেরা বলেনÑ এ বছর জ্যাঁ লুক গদারের ‘ব্রেথলেস’ (অ্যা বোত দে সোফাল)-এর আগে বিশ্বের চলচিত্রের ইতিহাস এক রকম ছিলো, আর পরে আরেক রকম হয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, চলচিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে বর্ণময় চরিত্রটি বিদায় নিলেন। ৯১ বছর বয়সে এই মৃত্যু তাঁর স্বেচ্ছা আহূত, সম্ভবত শেষ জীবনের গ্লানিকে আর বইতে চাইছিলেন না। নৈতিকভাবে দিশাহীন ও আত্মিকভাবে নিঃস্ব হতে থাকা এই বিশ্বে গদারের মতো আকাশচুম্বি প্রতিভার একজন দার্শনিক-শিল্পীর শেষ বিদায় যখন ঘটে, তখন আমরা শুধু নিস্ব হই না, এই শূন্যতা আমাদের এক অতল খাদের দিকে গড়িয়ে দেয়। গদার তাঁর সিনেমাকে কোন স্বতন্ত্রীকরণের দিকে নিয়ে যায় এভাবে না বলে বলা যায় যে ফিল্মের জগতকে গদার পৌঁছে দেন তার স্ব-অধিকৃত রাজ্যে। ফরাসি চলচিত্রকার গদারের ফিল্ম আমি প্রথম যখন দেখি তখন পৃথিবীর রাজনৈতিক মানচিত্র ক্রমশ পালটে যাচ্ছে, ষাট সত্তরের দশকে যখন অন্য ধারার ফিল্ম, থিয়েটার নির্মাণের ঝড় উঠেছিলো তা কিছুটা স্তিমিত। এই ক্রমশ শীতল হয়ে আসা সময়েই তিনি এলেন, স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, ‘আই অ্যাম ট্রাইং টু চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড, ইয়েস।’

১৯৮৩তে জলপাইগুড়ি সিনে সোসাইটির উদ্যোগে সেবার ফেলিনি ও গদারের ফিল্ম দেখানো হচ্ছিলো, সেবারই আমার প্রথম গদার দেখা, ‘ব্রেথলেস’। আমার কেন জানি না এর শতবর্ষ আগের বিশ্ব সাহিত্যের প্রাঙ্গণে তোলপাড় করে দেওয়া এক রুশ সাহিত্যিকের কথা মনে এলো, দস্তয়েভস্কি। মাঝে শতবর্ষের ব্যবধান রেখে দুজনেই অপরাধ ঘরাণার সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে এক নতুন বয়ানের সঙ্গে পরিচয় করান, যেমন ছিলো ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’ বা ‘ব্রাদার কারমাজভ’-এর দস্তয়েভস্কি, তেমনি গদারের ‘ব্রিদলেস’ বা ‘দ্যু অ ত্রোয়া সোসেস কি যে স দেল’। ‘ব্রেথলেস’-এর স্ক্রিপ্ট রচনা করেছিলেন দুজনে মিলে, ফ্রাঁসোয়া ক্রুফো ও স্বয়ং গদার। ‘ব্রেথলেস’-এর কাহিনীতে দেখা যায় যে, হলিউডের সুপার হিট নায়ক হাফ্রে বোগার্টের অনুরক্ত তরুণ ও চৌকস মস্তান মাইকেল প্রচ- গতির উত্তেজনায় প্রতিটি দিন কাটায়। মার্সেলে সে একটি গাড়ি চুরি করার পর তাকে পুলিশে ধাওয়া করে। একটি গ্রাম্য ফাঁকা জায়গার সে বুদ্ধি করে সেই পুলিশটিকে নিয়ে আসে এবং তাকে সেই নির্জনতার সুযোগে খুন করে। তরুণী সাংবাদিক প্যাট্রিসিয়া তার প্রেমিকা। কপর্দকহীন মাইকেল পুলিশের তাড়ায় প্যাট্রেসিয়ার ফ্ল্যাটে আশ্রয় নেয়। নিয়ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করে কিছু টাকা যোগাড় করা এই প্যাট্রিসিয়াকে নানা সময় তার চুরি প্রভৃতির কাজে লাগিয়েছিলো মাইকেল। ইতালিতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করে সে এবং প্যাট্রিসিয়ার কাছে সেই কারণে টাকা ধার চায়। কিন্তু প্যাট্রিসিয়া তখন জানায় যে, সে মাইকেলের সন্তানকে ধারণ করে মা হতে যাচ্ছে। এই সময়েই সে জানতে পারে যে মাইকেল পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে এসেছে। প্যাট্রিসিয়া মাইকেলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে পুলিশকে খবর দেয়। কিন্তু নিজের পেটের হবু সন্তানের কথা ভেবে তার মনঃপীড়া হয়, সে মাইকেলকে পালাতে বলে। কিন্তু এবার আর মাইকেল পালাতে চায় না। সে আত্মসমর্পণ করে জেল খাটার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পুলিশ চলে এলে আবার মন পালটায় ও পালাতে চায়, কিন্তু এই সময় পুলিশের গুলিতে মারা যায় মাইকেল। এই ‘ব্রেথলেস’-এর এক বছর আগেই ফ্রাঁসোয়া ক্রুফোর ‘৪০০ ব্লো’ মুক্তি পায়, সেখানেও অপরাধ মনস্তত্ত্বের কথা উঠে আসে, ফিল্মটির কেন্দ্রে থাকা একটি কিশোর এন্তোনিওকে নিয়ে। কিন্তু গদার একদম অন্য ধরনের ট্রিটমেন্ট নিয়ে উদয় হন।

আর একটি বিষয়েও আমার দস্তয়েভস্কি ও গদারকে কাছাকাছি রাখতে ইচ্ছে হয়, দুজনেই পরিহার করেছেন নাগরিক সুখের গল্প, তাঁদের সাহিত্যে বা সিনেমায় ল্যান্ডস্কেপ বা প্রাকৃতিক সুষমা অনুপস্থিত, রয়েছে মানুষের মনস্তত্ব। কখনো কখনো যদিও দস্তয়েভস্কি থেকে গদার রুক্ষ,

বন্য, যৌন আবেদনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দস্তয়েভস্কির মতো গদারও ভীষণভাবে নাগরিক। গ্রাম্য জীবন প্রায় নেই, আর নগর জীবন মানে অনেকটা জুড়েই প্যারিস, যেমন দস্তয়েভস্কির পিটার্সবুর্গ। প্যারিসের আলো-আঁধারী গলি-ঘিঞ্জি, রাস্তার পতিতা, প্রাচুর্য ও দৈন্যের সহাবস্থান গদারের ফিল্মে যেমন এসেছে; তেমনি দস্তয়েভস্কির সাহিত্যেও এসেছে পিটার্সবুর্গের আধো অন্ধকারের রাস্তা, পতিতা, বৈষম্যের সামাজিক উল্লাস ও বিষাদ। দুজনেরই প্রেমের আখ্যান একে অন্যের থেকে ভিন্ন। এঁদের সাহিত্যে বা সিনেমায় প্রেম যেন সর্বগ্রাসী আত্মক্ষয়ে আশ্রয় হয়ে আসে। প্রেম হোক বা সামাজিক যাবতীয় সম্পর্কেরই ভিত্তিতে থাকে সামাজিক রাজনীতি। ক্রুফো ও গদার একই সময়ে সিনেমা বানিয়েছেন, একই সঙ্গে স্ক্রিপ্ট লিখেছেন, কিন্তু দুজনের মধ্যে অনেক রয়েছে পার্থক্য। খুব অল্প বয়সেই ক্রুফো মস্তিষ্কের ক্যান্সারে মারা যান, গদার ৯১ বছর বেঁচে থেকে ‘স্বেচ্ছামরণ’-এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ক্রুফো গল্প বলতে ভালোবাসতেন, মানবিক প্রেম ও প্রেমহীনতা নিয়ে, নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে করা তার সিনেমাগুলোতেও আসলে ভালোবাসারই আখ্যান রচিত হয়েছে। গদার সেখানে কোনও গল্প বলেন না, মানুষের দৈনন্দিন যাপনের টুকরো টুকরো বিবরণ তুলে আনেন, তিনি কোনো ঘটনা বা না-ঘটনার সরলরৈখিক গতিতে আস্থাশীল ছিলেন না। দর্শকের মগজকে আক্রমণ করার কাজটা তিনি করতে চাইতেন, তার প্রতিটি কাজ সেই বিস্ফোরক বহন করে। দর্শককে স্বস্তি দেওয়া তাঁর লক্ষ্য নয়, তিনি চাইতেন দর্শকের ভেতর একটা তোলপাড় বা ভাংচুর শুরু হোক। রাজনীতি থেকে যৌনতা, যেখানেই সুযোগ পেয়েছেন তিনি চমকে দিয়েছেন, স্তব্ধ দর্শক ভাবতে বাধ্য হয়েছেন, এমন ভাবেও ফিল্মি ভাষা কথা বলে? চরম অন্তঃসারশূন্যতাকে কতখানি বাক্সময় করে তোলা যায় তা গদারের সিনেমা আমাদের শিখিয়েছে। গদারের সিনেমা গড়পড়তা সিনেমা দর্শকের ভালোলাগার কথা নয়, কিন্তু দেখতে হয়। মগজ লক্ষ্য করে তাঁর হানা শক্তিশেল এমন অস্থির করে দেবে যে, ফিল্মটি তখন বারেবারে দেখতে হবে, শিখবার জন্য।

গদারের প্রসঙ্গে বলা হয় যে, তিনি সিনেমার মাধ্যমে প্রবন্ধ লেখেন। ডেভিড স্টোরিটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গদার ‘মোশন পিকচার’ প্রসঙ্গে বলেন যে, ‘মোশন পিকচার, দেখতে, বলতে আর অধ্যয়ন করতেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। ওগুলো হলো জীবনকে নানা দিক থেকে দেখার বৈজ্ঞানিক হাতিয়ার...। সিনেমার মাত্র ৫ বা ৬ শতাংশ হওয়া উচিত দর্শনীয়। বাদবাকি পুরোটাই হওয়া উচিৎ তথ্যগত অধ্যায়ন, বৃহৎ অর্থে গবেষণা এবং প্রবন্ধ। আমি অর্ধেক ঔপন্যাসিক এবং অর্ধেক প্রাবন্ধিক’। আর একটি কথাও তাঁর প্রসঙ্গে বলা হয় সেটি ‘দুর্বোধ্যতা’। গদার সেই চলচিত্রকার যে সিনেমার আম-দর্শকদের সিনেমা দেখার ভঙ্গি পাল্টানোর কথা বলেন, বলেন, ‘উই হ্যাভ টু ফাইট দি অডিয়েন্স’, নিষ্ক্রিয়ভাবে সিনেমা দেখার বিরুদ্ধে এই ‘লড়াই’ তাঁর। সেই অভ্যাসকে আক্রমণ করতে চান তিনি, বিশ্বাসের সঙ্গে বলেন ‘মুভি গোয়ার্স’ ‘শুড বি ট্রিটেড উইথ ফার মোর রেস্পেক্ট দ্যান টিপিক্যাল হলিউড প্রোডাক্টস আ্যলাও’। সিনেমায় গল্প বলা বা টেকনিক্যাল চাতুর্য দিয়ে দর্শককে মোহিত করার উল্টোদিকে হেঁটে যাওয়া ফিল্ম দার্শনিকদের অন্যতম ছিলেন জাঁ লুক গদার। তাঁর ফিল্মে যাবতীয় কিছুই আসতে পারে, এনেছেন তিনি, অথচ গল্প বলার পথে গেলেও তিনি জনপ্রিয় হতে পারতেনÑ ‘ব্রেথলেস’ তার প্রমাণ। গল্প নিয়ে সিনেমা করার কতটা ক্ষমা তাঁর ছিলো সেটা এই ফিল্ম থেকে বুঝতে পারা যায়। গল্প বলা থেকে সরে গিয়ে যা খুশি তাই ফিলে আনার স্বপক্ষে ১৯৬৭তে লেখেন, ‘ওয়ান শুড পুট এভ্রি থিং ইনটু এ ফিল্ম’। তাঁর আলোকচিত্র শিল্পী ক্যুতর বলেছেন যে, তিনি একই সঙ্গে সমস্ত কিছু চান তার চলচ্চিত্রেÑ দর্শন, ধর্ম, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাষ্কর্য, স্থাপত্য, টেকনলজি, পপার্ট, খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদ, চিঠিপত্রাদি প্রভৃতি। তাঁর চলচিত্র তাই রীতি বিরুদ্ধ চলচিত্র। সিনেমার সূচনা থেকেই তাঁর পরিবর্তন সূচিত হয়। আঙ্গিকগত মুন্সিয়ানায় তিনি প্রথমেই ‘পরিচলক’ অভিধাটি পালটে দেন। লেখা হয়Ñ ‘ঈরহবসধ : ঔবধহ খঁপ এড়ফধৎফ’। এই গোটা বিষয়টা এক প্রখর চেতনাঋদ্ধ মেজাজকেই শুধু প্রতিফলিত করে না, এর প্রয়োগকলাকেও পালটে দেয়। ফরাসি টেলিভিশন যখন তাঁর ‘লা গাই স্যাভোয়া’ প্রচার নিষিদ্ধ করে, যেটি বানানোই হয়েছিলো দূরদর্শনের জন্য; আরো প্রত্যক্ষ বয়ানে চলে আসেন গদার। এর ফলে ক্রমশ একের পর এক তাঁর সিনেমা নিষিদ্ধ হতে থাকে, যেগুলো বানানো হয়েছিলো টেলিভিশনের জন্য। বিবিসির জন্য বানানো ‘ব্রিটিশ সাউন্ড’, জার্মান টিভির জন্য বানানো ‘প্রাভদা’ ও ‘ভøাদিমির আ রোজা’, ইতালির টিভির জন্য বানানো ‘লোত অ্যাঁ ইতালিয়া’ প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু আপসহীন গদার এরপর ক্রমশ ফিল্মে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের সমীকরণ থেকে সরে আসেন। ‘স্ত্রী-পুত্র ও আমাদের সুখী গৃহকোণ’Ñ এই জায়গা থেকে সরে আসেন তিনি। তার ছবিতে পরিবার অন্য মাত্রা নেয়। এমনকি শিশুও অনুপস্থিত হতে থাকে ক্রমশ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সামাজিক মুক্তির দিশা পরিপন্থী। সেখানে ব্যক্তির ব্যক্তিগত সমস্যাকেই প্রধান করে দেখানো হয়, সামাজিক বাস্তবতাকে আড়াল করে রাখা হয়, বিনোদনের এই বাণিজ্যের বিপ্রতীপে থাকতেন গদার। নিজেকে তাই বুর্জোয়া শিল্পকলার ছায়া থেকে শ্রেণি সচেতন বাস্তবতার রোদে এনে দাঁড় করান শিল্পকে।

গদার রাজনৈতিক মতাদর্শে মার্ক্সবাদের দিকে ছিলেন, আরো স্পষ্ঠভাবে বলা যায় তিনি ছিলেন মাওপন্থী সমর্থক। বিশ্বাস করতেন সমাজব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তনের সংগ্রামে। তবে তাঁর দেশের প্রাতিষ্ঠানিক কমিউনিস্ট পার্টির ধীরলয়ে সক্রিয়তার বিপক্ষে থেকে তিনি চাইতেন দ্রুত ও সক্রিয় পরিবর্তন। এই পরিবর্তনে হিংসা আসতেই পারে বলে মনে করতেন। যাবতীয় বুর্জোয়া সিস্টেমের প্রতি তাঁর ছিলো অসীম ঘৃণা। সমাজের ভিতটাকেই পালটে দিতে তাই ফিল্মকেই করে তুলেছিলেন তাঁর আয়ুধ। চেতনার প্রারম্ভ থেকেই তিনি অস্থির ও প্রতিবাদী। তাঁর নিজের সম্পর্কে লিখেছেন যে, ‘আমি এক বুর্জোয়া পরিবারে বড় হয়েছি এবং তারপরে পালিয়ে গেছি। এলএসডি-মারিজুয়ানার কাছে না গিয়ে আমি ছবির জগতে এসেছি। তারপর আমি আবিষ্কার করলাম যে, ছবির এই জগত আরো বেশি রকম বুর্জোয়া পরিবার।”

গদারের ‘তার সম্পর্কে যে দু’একটা কথা আমি জানি’ (দুউ অ ত্রোয়া সোসেস কি যে স দেল) আলোচনার বিশেষ গুরুত্ব দারি করে, এখানে তিনি ষাট দশকের ফ্রান্সে ধনতন্ত্রের অবস্থার একটা সূক্ষ্ম রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দিলেন। এতে আমরা দেখি শিল্প সম্পর্কে তার স্পষ্ট উচ্চারণ ছিলো, “শিল্প কী? সত্যি কথা বলতে কি, মানুষ নিজেই শৈলী অতএব শিল্প হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া যেখানে আকার হয়ে ওঠে মানুষ।” এই সিনেমায় খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সময়। ষাটের দশক, ঐতিহ্য-জড়ানো পুরোনো প্যারিস ভাঙছে। এক নতুন নগর জন্ম নিচ্ছে, ভেঙে পড়ছে পুরোনো মূল্যবোধ ভাঙছে, নৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোও। সামাজিক বন্ধন ও রক্ষণশীলতা পালটে যাচ্ছে আর এক অন্য প্যারিস জন্ম নিচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে নগরে বসবাসকারী মানুষজনও ধীরে ধীরে ভাঙতে থাকে, এখানেই এটা প্যরিসের সীমা ছাড়িয়ে আমার শহরেরও গল্প হয়ে ওঠে। তৎকালীন প্যরিসের, ফ্রান্সের রাজনীতি হয়ে ওঠে আমাদের কলকাতা ঢাকার রাজনীতি। ফিল্ম শেষ হয় কিন্তু গদারীয় রেশ থেকে যায়, ‘মৃত বস্তুরা সবসমই জীবন্ত। জীবন্ত মানুষ কখনও কখনও ইতিমধ্যেই মৃত’।

নিজের জীবনের ইলিউশান ও সততায় বিশ্বাসী গদার তার সৃজনে ক্রমানুবর্তিতা ভেঙ্গে কেন্দ্রীয় চরিত্রকে হঠাৎ করেই দর্শকের মুখোমুখি ফেলে দেন, তাদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। এর সঙ্গে সঙ্গে এটাও লক্ষণীয়, বোধ হয় গদারের চলচ্চিত্রে ‘সার্ভাইভাল’ চরিত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল, তাদের বিলয় ঘটিয়ে দেন তিনি। দর্শকের সামনে থাকা প্রচলিত রীতিকে উপেক্ষা করে তাঁর চরিত্রগুলো হয় ক্ষণস্থিতি এবং তাদের প্রবেশ প্রস্থান ও আচরণ চলিত রীতিবিরুদ্ধ হয়। শেষের দিকের ফিল্মগুলোতে দেখা যায় চলতে চলতে তিনি সাউন্ড ট্রাক বন্ধ করে দিচ্ছেন, অসহায় চরিত্রগুলো তখনো স্ক্রিনে রয়ে গেছে। আবার কোনো ফিল্মে দেখা যায় মাঝে মাঝে কালো শূন্যতা। এই নানা দৃশ্য বা প্রতি-দৃশ্য আসলে তার চলচিত্রে ইউরোপের আত্মিক অনিশ্চয়তা বা অসহতার কথা বলে। তাঁর শিল্পের অভিমুখ থাকে সমাজব্যবস্থার স্বরূপের উদ্ঘাটনের দিকে। তার শহর মানুষ পরিত্যক্ত স্তব্ধতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তার চরিত্রগুলো ঘুরে বেরায় নাগরিক যাপনের জটিল পয়েন্টগুলোয়। গদারের সিনেমায় বেশিরভাগ ঘটনাস্থল হিসাবে তাই বেছে নেন জেটি, কাফে, অটোমোবাইলস স্টেশান, পরিত্যক্ত প্রাসাদ। এই প্লটের ভিত্তিভূমিতে তিনি নির্মাণ করতেন তাঁর স্বতন্ত্র সামাজিক রাজনৈতিক বয়ান। গদারের সিনেমায় বারেবারে ফিরে আসে বেশ্যাবৃত্তি, পতিতারা। এই প্রসঙ্গে পরিচালক তানভীর মোকাম্মেলের আলোচনা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যায়, “... বুর্জোয়া সমাজের একটা বড় পাপকে গদার বারে বারেই ওঁর চলচ্চিত্রে এনেছেন। তা হচ্ছেÑ পতিতাবৃত্তি। শুধু প্যারিসের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো পতিতাদের নয়, এ সমস্যা যেন সমগ্র পুঁজিবাদী সমাজেরই সমস্যা, যে সমাজের বুদ্ধিজীবী, লেখক- সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতাÑ সবাইই নগদ বিদায়ের বদলে মার্কিনী কোকাকোলা সভ্যতার পতিতাবৃত্তি করছে, ডলারের কাছে প্রতিনিয়ত বিক্রি করছে তাদের সংস্কৃতি, তাদের মনন ও বিবেকবোধ। এদের বিরুদ্ধে গদার সর্বদাই থাকতে চেয়েছেন নির্মম”। গদার নারীমুক্তির পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। নারীকে পুরুষ জাত্যাভিমানের জন্য নিছক একটি যৌন সামগ্রী হিসাবে দেখার পুঁজিবাদী দর্শনের বিপক্ষে নানাভাবে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৭৫-এ করা তাঁর ‘নিউমরো দু’সিনেমাটিতে বিভিন্ন দৃশ্যে নারীমুক্তির কথা জোরের সঙ্গে বলেছেন। গদার স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিবাদ নির্মিত যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার বিপক্ষে সরব ছিলেন। ১৯৬৩তে বানানো ‘লা ক্যারিবিনিয়ার্স’ তাঁর একটি শক্তিশালী যুদ্ধবিরোধী সিনেমা। এই সিনামায় এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্যে দেখা যায় অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্রের মেয়েটি মায়াকোভস্কির কবিতা পড়তে পড়তে মারা যাচ্ছেন।

১৯৬৬তে ‘দু অ ত্রোয়া সোসেস কি যে সদেল’ ছবিতে গদার ষাট দশকের ফ্রান্সে ধনতন্ত্রের অবস্থার একটা সূক্ষতম রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দিলেন এবং দেখালেন গল সরকার কীভাবে দেশে পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিস্তার ঘটাচ্ছে। এরপর ‘উইক এন্ড’ থেকে তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য আরো সরাসরি চলে আসে। ১৯৬৮-র গণআন্দোলনের পর গদারকে চরম বামপন্থী হিসাবে ধরে নিয়ে সরকার তাঁর ‘লা গাই স্যাভোয়া’ ছবিটি ফ্রান্সে টেলিভিশনে প্রচার নিষিদ্ধ করে। ইতিমধ্যে গদার বাণিজ্যিক চলচিত্র নির্মাণের সমস্ত পরম্পরাকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এরপর ফ্রান্স, জার্মানি বা ইতালির টেলিভিশনের জন্য অনেকগুলো ফিল্ম নির্মাণ করেন তিনি। এই সিনেমাগুলোতে দেখা গেলো যে, গদার ক্রমশ ব্যক্তি ধ্যানধারণা থেকে সড়ে আসছেন। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাজাত শিল্পকলায় দেখা যায় যে সৃষ্ঠ চরিত্রগুলো এমন পরিবেশে বিচরণ করে, যেখানে তার ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত সমস্যাবলীই সামাজিক বাস্তবতার চাইতে বেশি প্রাধান্য পায়। ব্যক্তি থেকে শ্রেণিতে উত্তরণের এই প্রয়াসের ফলে শিল্পকলা এক স্বতন্ত্র পথের মুখোমুখি হলো, যার সৃজনপুরুষ জাঁ লুক গদার। বিশ্বের যেখানে যেখানে নির্যাতিত মানুষের আর্তি বিশ্বের আকাশ-বাতাসে গুঞ্জরিত হয়েছে সেখানেই প্রতিবাদের স্বর নিয়ে হাজির গদার। প্যালেস্টাইনের গেরিলাদের পাশে থেকে বানিয়েছেন ‘টিল ভিক্ট্রি’, তাঁর ‘লা ক্যারিবিনিয়ার্স’ সিনেমায় সা¤্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে তীব্র আঘাত করেছেন। পথ অনুসন্ধানী গদার আমাদের এই অসুস্থ বিশ্বের সামনে এক উজ্জ্বল ঝা-া।