পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

কতদিন হয়ে গেল

কতবার কাঁচা ধান কার্তিকের সূর্যে গেল পেকে;

পউষের চাঁদ পড়ে ঝরে গেল।

খড় শুধু পৃথিবীর মুখখানা ঢেকে

রয়ে গেল;

[‘যাত্রা’- জীবনানন্দ দাশ]

অনেকদিন হয়ে গেল। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ চলে গেছেন পরপারে। কতো কার্তিক এলো গেলো! কতো কাঁচা ধান কার্তিকের সোনার রোদে হেমন্তে পেকে ডেকে আনল নবান্নকে। তবু আজও বেঁচে আছে শিশিরের শব্দ কিংবা রোদের গন্ধ। বেঁচে আছে হিজলের গাছ, বট আর অশ্বত্থের ডাল। বেঁচে আছে চিল, সোনালি ডানার চিল। কিংবা বেঁচে আছে হরিতকী ফল অথবা বেতফলের চোখ। বেঁচে আছে আজো হিঙুলের মেঘ, হাল ভাঙ্গা নাবিক আর কিশোরীর ঘুঙুরের প্রাণ। বাবুইয়ের বাসায় আজও জীবন্ত আছে পাখির নীড়ের মতো ডাগর চোখ। বয়ে চলে ধানসিঁড়ি, সুদর্শন উড়ে চলে আজও সন্ধ্যার আকাশে। তবু জীবনানন্দ শুকনো খড়ের মতো রয়ে যায় পৃথিবীর ধূলিজালে খড়ের প্রাণ হয়ে, ফসলের শেষ স্মৃতি হয়ে। ঘাতক ট্রামের তলায় হয়তো কবির লোকান্তর ঘটেছে। কিন্তু কবির ফসল, কবিতার প্রাণ, আজও এই বাংলার বাতাসে ভেসে বেড়ায় বট-পাকুড়ের শিকড়ে। আজও শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ আকাশে জানান দেয় জীবনানন্দের অতৃপ্তির বেদনার কথা। স্বপ্নের লাশগুলো হয়তোবা লাশকাটা ঘরে শুয়ে আছে প্রত্যয়নের আশে। গোধূলি সন্ধির নৃত্য নিয়ে নূতন কোনো সন্ধ্যা হয়তো ঘনায়ে আসে নক্ষত্রের আলো শুষে নিয়ে। তবুও জীবনানন্দ বিদেহে বিচরণ করেন গ্রাম বাংলায়। তবুও বেঁচে থাকে চিল্কা হরদে কবির চিলতে সকাল, এক ফালি স্বপ্নের জগৎ জাগানিয়া ফেরিওয়ালা হয়ে, মুগ্ধ দখিন বাতায়নে।

অনিত্য পৃথিবীর বুকে মানুষও পরিযায়ী। পাখি যেমন সুদূর সাইবেরিয়ার শীত ছেড়ে অনিকেত হয়ে একটুকু উষ্ণতার আশায় পাড়ি জমায় দেশ-দেশান্তরে, তেমনি অনন্ত লোকোত্তর জীবন ছেড়ে মানুষও নেমে আসে নামরূপ নিয়ে পঞ্চস্কন্ধে চড়ে এই মর্ত্যধামে। পরিযায়ী মানুষ তাই বলতে পারে অবলীলায়-

‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে

সিংহল সমুদ্র হতে মালয় সাগরে, নিশীথের অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে...’

মানুষের এই পরিযায়ী জীবন কবিকে করেছে আলোড়িত। কবি তাই তার জীবনের চারিদিকে দেখেন উত্তাল ফেনার সফেদ সমুদ্রের তরঙ্গরাশি।

‘কবিতা কিছু বলে না, বেজে ওঠে।’ রবীন্দ্রনাথের এই অমর বাণী জীবনানন্দের কবিতার প্রতি পরতে পরতে নূপুর ধ্বনি তুলে অনুরণিত হয়েছে কল্লোলে, কল-কাকলি হয়ে। জীবনানন্দের কবিতা তাই বাদ্যময়, বাক্যময় নয়। জীবনানন্দীয় কবিতা সুর তোলে হৃদয়তন্ত্রীতে, কেবল কানেই ধ্বনিময় নয়। ঝরা পালকের কাব্যগ্রন্থে বেজে উঠে কবির মাদল বাদ্যের মাত্রাবৃত্ত।

‘আমি কবি, সেই কবি,

আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি।

আনমনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল মেঘের পানে।

মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামনা জাগিছে প্রাণে

বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন্ কাজরার গানে।

দাদুরী কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!’

রূপসী বাংলার কবি তার মনের ক্যানভাস জুড়ে এঁকে রেখেছেন পল্লী বাংলার নিটোল ছবি। যতো দেশী পাখি, স্বদেশী গাছ, খাল-নদী, ফল-ফুল-সকলই তার কবিতার অনুপম অনুষঙ্গ। কবিতার মধ্য দিয়ে কবির অতুলনীয় দেশপ্রেম ফুটে উঠেছে মায়া-জাগানিয়া অনুভূতি নিয়ে। কবির কবিতা এতো বেশি চিত্ররূপময় যে, চোখ বন্ধ করলেই মানসপত্রে চিত্রিত হয় কবিতার পটভূমি। ‘পৃথিবীর পথে আমি’ কবিতায় কবি বলেছেন-

‘এইসব দেখিয়াছি, দেখিয়াছি নদীটিরে- মজিতেছে ঢালু, অন্ধকারে,

সাপমাসি উড়ে যায়, দাঁড় কাক অশ্বত্থের নীড়ের ভিতর

পাখনার শব্দ করে অবিরাম, কুয়াশায় একাকী মাঠের ঐ ধারে

কে যেন দাঁড়িয়ে আছে, আরো দূরে দু’একটা স্তব্ধ খেড়ো ঘর

পড়ে আছে; খাগড়ার বনে ব্যাঙ ডাকে

কেন- থামিতে কি পারে;’

জীবনানন্দের কবিতায় নায়িকার উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। কখনো নারী এখানে উপস্থিত ‘বনলতা সেন’ নামে, কখনো সুনয়না, সুরঞ্জনা বা আকাশলীনা নামে। কখনো নারী এসেছে শঙ্খমালা হয়ে। নারীতে কবির ঘোর রয়েছে রহস্য হয়ে। নারীর মধ্যে ইতিহাসকে খুঁজতে খুঁজতে কবি বলেন-

‘তবুও তোমায় জেনেছি, নারী, ইতিহাসের শেষে এসে মানব প্রতিভার

রূঢ়তা ও নির্জনতার অবসানের মতো

আলো আছে বলে তুমি মহাদেবের অপরিমেয় নীল-

কণ্ঠ মুছে নীলকণ্ঠ পাখির ব্যসনে তো পরিণত।’

কবিতায় কবির প্রেম যেনো ইতিহাসের নারীর আদল। প্রাচীন নগরী কিংবা লুপ্ত জনপদ- সকলই কবির কাছে সত্যলব্ধ আয়োজন। নারী তবু রয়ে যায় সময়ের পরিহাসে জিজ্ঞাস্য নিরন্তর।

রহস্যময়তায় ভরপুর নারী বনলতা সেনের মতো পাখির নীড়োপম চোখ নিয়ে কবির দিকে তাকিয়ে ছিলো বলেই কবি চুলের দিঘল কালোয় অন্ধকারের বিদিশায় ভোগেন। কিংবা সাদামাটা মায়াবতী মুখে শ্রাবস্তীর কারুকার্য দেখে উল্লসিত হন- সে কেবল ভালোবাসার দুর্জ্ঞেয় রসায়নের জন্যেই। ‘লোকেন বোসের জর্নাল’ কবিতায় কবি ফিরে যান তার অতীতের পতিত ভালোবাসায়। তাকে বলতে দেখা যায়-

‘সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি

এখনো কি ভালোবাসি?

সেটা অবসরে ভাববার কথা,

অবসর তবু নেই;

তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে,

এখন শেল্ফে চার্বাক, ফ্রয়েড, প্লেটো, পাভলভ ভাবে

সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না।’

তিমির হননের কবি বার বার রোম্যান্টিকতার পুলকে সিক্ত হয়েছেন তাঁর কবিতায়। কখনো নিসর্গে, কখনো নারীতে তার এই পুলক দর্শন। সুজাতাকে তিনি এখনও ভালোবাসেন কিনা তা অমীমাংসিত হলেও ‘আজকে রাতে’ তিনি নিঃসঙ্গ থাকতে চান না। তিনি তার প্রেয়সীকে কাছে পেলে কথার ঝাঁপি খুলে বসতেন,

‘আজকে রাতে তোমায় আমার কাছে পেলে কথা

বলা যেতো; চারিদিকে হিজল শিরিষ নক্ষত্র ঘাস হাওয়ার প্রান্তর।’

কবি জীবনানন্দ দাশ কেবল অনুভূতির চিত্র এঁকেছেন তা-ই নয়, তিনি ছন্দের কারসাজিও রপ্ত করেছেন কবিতার কঙ্কালে। ‘কবিতার আত্মা ও শরীর’ প্রবন্ধ কবির সেই ছন্দ চিন্তার অনন্য প্রকাশ। মুক্ত মাত্রাবৃত্ত নিয়ে তিনি বলেছেনÑ এই ছন্দ রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বব্যাপী নিপীড়নকে যথার্থ ফুটিয়ে তুলতে পারে। পরবর্তীতে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’, ‘ধূমকেতু’ কবিতাগুলো মুক্ত মাত্রাবৃত্তের শক্তিমান প্রকাশ।

গদ্যছন্দ ব্যবহার করা কবি কেবল আধুনিক কবিতার নির্মাণে নিমগ্ন ছিলেন তা নয়, তার হাতে জন্ম হয়েছে কয়েকটি সনেটের। সনেট রচনা তাঁর কবি জীবনের প্রথম দিককার প্রয়াস। জীবনানন্দীয় সনেট ক্ল্যাসিক্যাল সনেটকে এড়িয়ে আঠার কিংবা আটাশ মাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ‘সে’ কবিতায় তিনি বলছেন-

‘আলো যেন কমিতেছে বিস্ময় যেতেছে নিভে আরো

আকাশ কেমন নীল? আকাশ তেমন নীল নয়,

মেয়ে মানুষের চোখে নেই যেন তেমন বিস্ময়,

মাছরাঙা শিশুদের পাখি আজ; শিশুরাই কারো

রেশমি চুলের শিশু নয় আজ; ভাবিতে কি পারো’

মহাপৃথিবীর কবি জীবনানন্দ। ক্রমশ হতাশার সমুদ্রে ডুবে জীবনের প্রতি হারিয়েছেন অনুরাগ। জীবনের কাছে না পেতে পেতে, সংসারের কূটকৌশলে অভাবের টানাপোড়েনের কাছে পরাস্ত হয়ে নেতিবাচকভাবে জীবনকে দেখতে শুরু করেন ‘মহাপৃথিবীতে’। আট বছর আগের একদিন কবিতায় হতাশাভরে কবিকে বলতে দেখি-

‘চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে

এক গাছা দড়ি হাতে গিয়ে ছিলে তবু একা একা,

যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা,’

ব্যক্তি জীবনে অসফল কবি জীবনানন্দ দাশ। তার অসাফল্যের বীতরাগ প্রকটিত হয় তার কবিতায়। যাপিত জীবনের মুহূর্তগুলোতে তিনি আশার দীপালি খুঁজে পান না। বরং একে একে নিভে যায় তার আশার সকল নক্ষত্র। তিনি কখনও মুহূর্তের বেদনায় বলে ফেলেন-

‘কখনও মুহূর্তে আসে সূর্য আর শিশিরের জলে

বসে থাকবার মতো

অথবা কখনও দেখি দিন নিভে গেছে

হরিয়াল প্রান্তরের পারে চলে গেছে

ডানার ঝিলিকে তার সবচেয়ে শেষ রোদ্দুরের

জ্বালিয়ে সে সূর্যকে নিভিয়ে এবার নিভে গেল।’

হতাশার মাঝে মাঝে কখনো সাহিত্যিক প্রাপ্তিতে, আন্তরিক উচ্ছ্বাসে কবি হয়েছেন উদ্বেলিত। চেতনায় এবং সৃজন সৌন্দর্য বীক্ষণ করা কবি প্রাপ্তির হঠাৎ ঝিলিকে আশাবাদী হয়ে ওঠেন থেকে থেকে-

‘নতুন সৌন্দর্য এক দেখিয়াছি- সকল অতীত

ঝেড়ে ফেলে- নতুন বসন্ত এক এসেছে জীবনে;

শালিকেরা কাঁপিতেছে মাঠে মাঠে- সেইখানে শীত,

শীত শুধু তবুও আমার বুকে হৃদয়ের বনে

কখন অঘ্রান রাত শেষ হল পৌষ গেল চলে

যাহারে পাইনি রেখে বেবিলনে সে এসেছে বলে।’

উপমার কবি জীবনানন্দ। কবিতার চরণে চরণে তার উপমারা হয়েছে প্রাণবন্ত। অতি সাধারণ বিষয়কে উপমান করে তিনি উপমিতকে করেছেন অনন্য সাধারণ। প্রকৃতি ও জীবনের ছবি হতে রঙ বেছে নিয়ে তিনি উপমাকে করেছেন চিত্রের মতো জীবন্ত। তিনি আলোর মধ্যে আবেগের খোঁজ পান, লুপ্ত বেড়ালের মতো আলোকে নিভে যেতে দেখেন কিংবা সন্ধ্যার বিশুষ্ক আলোর মাঝে জাফরানী রঙের গন্ধ খুঁজে পান। মৃত্তিকার জ্যামিতিক ঢেউ কিংবা পাখিদের মতো সিঁড়ি ছাড়া উপরে উঠার কৌশলে কবি অভিভূত। তাই সরোজিনীকে খুঁজতে গিয়ে তিনি বলেন-

এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে, জানি না সে শুয়ে আছে কিনা।

অনেক হয়েছে শোয়া,- তারপর একদিন চলে গেছে কোন্ দূর মেঘে।

অন্ধকার, শেষ হলে যেই স্তর জেগে উঠে আলোর আবেগে

সরোজিনী চলে গেল অদূর, সিঁড়ি ছাড়া পাখিদের মতো পাখা বিনা?

যুদ্ধ নিয়ে কবির ছিলো উৎকণ্ঠা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা কবিকে করেছিল বিচলিত। গ্রাম-বাংলার নিভৃতে থাকা কবি আকাশে যুদ্ধ বিমানের শব্দে হয়ে উঠেন আতঙ্কিত। তাই একদিন তিনি সাহস করে বলে ফেলেন-

‘দামামা থামিয়ে ফেল- পেঁচার পাখার মতো

অন্ধকারে ডুবে যাক

রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ।’

কবি যুদ্ধে কার ক্ষতি হল, কার জয় হল তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস, যুদ্ধ মানেই অকল্যাণ। তাই কবি জেদ করে বলেন-

‘জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্ খানে-

কোথায় নতুন করে বেবিলন ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়,’

তবুও এতো অপ্রাপ্তি, যুদ্ধ-দামামা ছেড়ে, ব্যর্থ প্রেম ছেড়ে, সংসারের জীর্ণ কষাঘাত ছেড়ে কবি বারে বারে হতে চেয়েছেন আশাবাদী। আশার কিরণ তার মনের চেতনায় হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে বলেছেÑ

‘রৌদ্র ঝিলমিল

ঊষার আকাশ, মধ্য নিশীথের নীল

অপার ঐশ্বর্য বেশে দেখা তুমি দাও বারে বারে

নিঃসহায় নগরীর কারাগার প্রাচীর পারে।’

কবি জীবনানন্দ কেবল রূপসী বাংলার কবি নন, তিনি পৃথিবীর পথে হাঁটা অনন্য যাত্রিক। তিনি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর কথক। তিনি কবিতার সাথে প্রেম করেছেন সারাটা জীবন। সাতটি তারার তিমিরের বেদনা দীর্ণ করে তিনি নক্ষত্রের রাতে মেতেছেন শব্দহীন জ্যোৎস্নায়। ঘাতক ট্রামের আঘাতে জীবনের যবনিকা হলেও তিনি নির্জন স্বাক্ষর রেখে গেছেন ধূসর পা-ুলিপি জুড়ে- বলেছেন তার কবিতার পাঠকের প্রতি- বিনয়ের, প্রার্থনার সকল অঞ্জলি নিয়ে-

আমি ঝরে যাব, তবু জীবন অগাধ

তোমারে রাখিব ধরে সেই দিন পৃথিবীর ’পরে,

আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৬ আশ্বিন ১৪২৯ ২৪ সফর ১৪৪৪

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

image

কতদিন হয়ে গেল

কতবার কাঁচা ধান কার্তিকের সূর্যে গেল পেকে;

পউষের চাঁদ পড়ে ঝরে গেল।

খড় শুধু পৃথিবীর মুখখানা ঢেকে

রয়ে গেল;

[‘যাত্রা’- জীবনানন্দ দাশ]

অনেকদিন হয়ে গেল। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ চলে গেছেন পরপারে। কতো কার্তিক এলো গেলো! কতো কাঁচা ধান কার্তিকের সোনার রোদে হেমন্তে পেকে ডেকে আনল নবান্নকে। তবু আজও বেঁচে আছে শিশিরের শব্দ কিংবা রোদের গন্ধ। বেঁচে আছে হিজলের গাছ, বট আর অশ্বত্থের ডাল। বেঁচে আছে চিল, সোনালি ডানার চিল। কিংবা বেঁচে আছে হরিতকী ফল অথবা বেতফলের চোখ। বেঁচে আছে আজো হিঙুলের মেঘ, হাল ভাঙ্গা নাবিক আর কিশোরীর ঘুঙুরের প্রাণ। বাবুইয়ের বাসায় আজও জীবন্ত আছে পাখির নীড়ের মতো ডাগর চোখ। বয়ে চলে ধানসিঁড়ি, সুদর্শন উড়ে চলে আজও সন্ধ্যার আকাশে। তবু জীবনানন্দ শুকনো খড়ের মতো রয়ে যায় পৃথিবীর ধূলিজালে খড়ের প্রাণ হয়ে, ফসলের শেষ স্মৃতি হয়ে। ঘাতক ট্রামের তলায় হয়তো কবির লোকান্তর ঘটেছে। কিন্তু কবির ফসল, কবিতার প্রাণ, আজও এই বাংলার বাতাসে ভেসে বেড়ায় বট-পাকুড়ের শিকড়ে। আজও শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ আকাশে জানান দেয় জীবনানন্দের অতৃপ্তির বেদনার কথা। স্বপ্নের লাশগুলো হয়তোবা লাশকাটা ঘরে শুয়ে আছে প্রত্যয়নের আশে। গোধূলি সন্ধির নৃত্য নিয়ে নূতন কোনো সন্ধ্যা হয়তো ঘনায়ে আসে নক্ষত্রের আলো শুষে নিয়ে। তবুও জীবনানন্দ বিদেহে বিচরণ করেন গ্রাম বাংলায়। তবুও বেঁচে থাকে চিল্কা হরদে কবির চিলতে সকাল, এক ফালি স্বপ্নের জগৎ জাগানিয়া ফেরিওয়ালা হয়ে, মুগ্ধ দখিন বাতায়নে।

অনিত্য পৃথিবীর বুকে মানুষও পরিযায়ী। পাখি যেমন সুদূর সাইবেরিয়ার শীত ছেড়ে অনিকেত হয়ে একটুকু উষ্ণতার আশায় পাড়ি জমায় দেশ-দেশান্তরে, তেমনি অনন্ত লোকোত্তর জীবন ছেড়ে মানুষও নেমে আসে নামরূপ নিয়ে পঞ্চস্কন্ধে চড়ে এই মর্ত্যধামে। পরিযায়ী মানুষ তাই বলতে পারে অবলীলায়-

‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে

সিংহল সমুদ্র হতে মালয় সাগরে, নিশীথের অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে...’

মানুষের এই পরিযায়ী জীবন কবিকে করেছে আলোড়িত। কবি তাই তার জীবনের চারিদিকে দেখেন উত্তাল ফেনার সফেদ সমুদ্রের তরঙ্গরাশি।

‘কবিতা কিছু বলে না, বেজে ওঠে।’ রবীন্দ্রনাথের এই অমর বাণী জীবনানন্দের কবিতার প্রতি পরতে পরতে নূপুর ধ্বনি তুলে অনুরণিত হয়েছে কল্লোলে, কল-কাকলি হয়ে। জীবনানন্দের কবিতা তাই বাদ্যময়, বাক্যময় নয়। জীবনানন্দীয় কবিতা সুর তোলে হৃদয়তন্ত্রীতে, কেবল কানেই ধ্বনিময় নয়। ঝরা পালকের কাব্যগ্রন্থে বেজে উঠে কবির মাদল বাদ্যের মাত্রাবৃত্ত।

‘আমি কবি, সেই কবি,

আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি।

আনমনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল মেঘের পানে।

মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামনা জাগিছে প্রাণে

বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন্ কাজরার গানে।

দাদুরী কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!’

রূপসী বাংলার কবি তার মনের ক্যানভাস জুড়ে এঁকে রেখেছেন পল্লী বাংলার নিটোল ছবি। যতো দেশী পাখি, স্বদেশী গাছ, খাল-নদী, ফল-ফুল-সকলই তার কবিতার অনুপম অনুষঙ্গ। কবিতার মধ্য দিয়ে কবির অতুলনীয় দেশপ্রেম ফুটে উঠেছে মায়া-জাগানিয়া অনুভূতি নিয়ে। কবির কবিতা এতো বেশি চিত্ররূপময় যে, চোখ বন্ধ করলেই মানসপত্রে চিত্রিত হয় কবিতার পটভূমি। ‘পৃথিবীর পথে আমি’ কবিতায় কবি বলেছেন-

‘এইসব দেখিয়াছি, দেখিয়াছি নদীটিরে- মজিতেছে ঢালু, অন্ধকারে,

সাপমাসি উড়ে যায়, দাঁড় কাক অশ্বত্থের নীড়ের ভিতর

পাখনার শব্দ করে অবিরাম, কুয়াশায় একাকী মাঠের ঐ ধারে

কে যেন দাঁড়িয়ে আছে, আরো দূরে দু’একটা স্তব্ধ খেড়ো ঘর

পড়ে আছে; খাগড়ার বনে ব্যাঙ ডাকে

কেন- থামিতে কি পারে;’

জীবনানন্দের কবিতায় নায়িকার উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। কখনো নারী এখানে উপস্থিত ‘বনলতা সেন’ নামে, কখনো সুনয়না, সুরঞ্জনা বা আকাশলীনা নামে। কখনো নারী এসেছে শঙ্খমালা হয়ে। নারীতে কবির ঘোর রয়েছে রহস্য হয়ে। নারীর মধ্যে ইতিহাসকে খুঁজতে খুঁজতে কবি বলেন-

‘তবুও তোমায় জেনেছি, নারী, ইতিহাসের শেষে এসে মানব প্রতিভার

রূঢ়তা ও নির্জনতার অবসানের মতো

আলো আছে বলে তুমি মহাদেবের অপরিমেয় নীল-

কণ্ঠ মুছে নীলকণ্ঠ পাখির ব্যসনে তো পরিণত।’

কবিতায় কবির প্রেম যেনো ইতিহাসের নারীর আদল। প্রাচীন নগরী কিংবা লুপ্ত জনপদ- সকলই কবির কাছে সত্যলব্ধ আয়োজন। নারী তবু রয়ে যায় সময়ের পরিহাসে জিজ্ঞাস্য নিরন্তর।

রহস্যময়তায় ভরপুর নারী বনলতা সেনের মতো পাখির নীড়োপম চোখ নিয়ে কবির দিকে তাকিয়ে ছিলো বলেই কবি চুলের দিঘল কালোয় অন্ধকারের বিদিশায় ভোগেন। কিংবা সাদামাটা মায়াবতী মুখে শ্রাবস্তীর কারুকার্য দেখে উল্লসিত হন- সে কেবল ভালোবাসার দুর্জ্ঞেয় রসায়নের জন্যেই। ‘লোকেন বোসের জর্নাল’ কবিতায় কবি ফিরে যান তার অতীতের পতিত ভালোবাসায়। তাকে বলতে দেখা যায়-

‘সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি

এখনো কি ভালোবাসি?

সেটা অবসরে ভাববার কথা,

অবসর তবু নেই;

তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে,

এখন শেল্ফে চার্বাক, ফ্রয়েড, প্লেটো, পাভলভ ভাবে

সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না।’

তিমির হননের কবি বার বার রোম্যান্টিকতার পুলকে সিক্ত হয়েছেন তাঁর কবিতায়। কখনো নিসর্গে, কখনো নারীতে তার এই পুলক দর্শন। সুজাতাকে তিনি এখনও ভালোবাসেন কিনা তা অমীমাংসিত হলেও ‘আজকে রাতে’ তিনি নিঃসঙ্গ থাকতে চান না। তিনি তার প্রেয়সীকে কাছে পেলে কথার ঝাঁপি খুলে বসতেন,

‘আজকে রাতে তোমায় আমার কাছে পেলে কথা

বলা যেতো; চারিদিকে হিজল শিরিষ নক্ষত্র ঘাস হাওয়ার প্রান্তর।’

কবি জীবনানন্দ দাশ কেবল অনুভূতির চিত্র এঁকেছেন তা-ই নয়, তিনি ছন্দের কারসাজিও রপ্ত করেছেন কবিতার কঙ্কালে। ‘কবিতার আত্মা ও শরীর’ প্রবন্ধ কবির সেই ছন্দ চিন্তার অনন্য প্রকাশ। মুক্ত মাত্রাবৃত্ত নিয়ে তিনি বলেছেনÑ এই ছন্দ রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বব্যাপী নিপীড়নকে যথার্থ ফুটিয়ে তুলতে পারে। পরবর্তীতে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’, ‘ধূমকেতু’ কবিতাগুলো মুক্ত মাত্রাবৃত্তের শক্তিমান প্রকাশ।

গদ্যছন্দ ব্যবহার করা কবি কেবল আধুনিক কবিতার নির্মাণে নিমগ্ন ছিলেন তা নয়, তার হাতে জন্ম হয়েছে কয়েকটি সনেটের। সনেট রচনা তাঁর কবি জীবনের প্রথম দিককার প্রয়াস। জীবনানন্দীয় সনেট ক্ল্যাসিক্যাল সনেটকে এড়িয়ে আঠার কিংবা আটাশ মাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ‘সে’ কবিতায় তিনি বলছেন-

‘আলো যেন কমিতেছে বিস্ময় যেতেছে নিভে আরো

আকাশ কেমন নীল? আকাশ তেমন নীল নয়,

মেয়ে মানুষের চোখে নেই যেন তেমন বিস্ময়,

মাছরাঙা শিশুদের পাখি আজ; শিশুরাই কারো

রেশমি চুলের শিশু নয় আজ; ভাবিতে কি পারো’

মহাপৃথিবীর কবি জীবনানন্দ। ক্রমশ হতাশার সমুদ্রে ডুবে জীবনের প্রতি হারিয়েছেন অনুরাগ। জীবনের কাছে না পেতে পেতে, সংসারের কূটকৌশলে অভাবের টানাপোড়েনের কাছে পরাস্ত হয়ে নেতিবাচকভাবে জীবনকে দেখতে শুরু করেন ‘মহাপৃথিবীতে’। আট বছর আগের একদিন কবিতায় হতাশাভরে কবিকে বলতে দেখি-

‘চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে

এক গাছা দড়ি হাতে গিয়ে ছিলে তবু একা একা,

যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা,’

ব্যক্তি জীবনে অসফল কবি জীবনানন্দ দাশ। তার অসাফল্যের বীতরাগ প্রকটিত হয় তার কবিতায়। যাপিত জীবনের মুহূর্তগুলোতে তিনি আশার দীপালি খুঁজে পান না। বরং একে একে নিভে যায় তার আশার সকল নক্ষত্র। তিনি কখনও মুহূর্তের বেদনায় বলে ফেলেন-

‘কখনও মুহূর্তে আসে সূর্য আর শিশিরের জলে

বসে থাকবার মতো

অথবা কখনও দেখি দিন নিভে গেছে

হরিয়াল প্রান্তরের পারে চলে গেছে

ডানার ঝিলিকে তার সবচেয়ে শেষ রোদ্দুরের

জ্বালিয়ে সে সূর্যকে নিভিয়ে এবার নিভে গেল।’

হতাশার মাঝে মাঝে কখনো সাহিত্যিক প্রাপ্তিতে, আন্তরিক উচ্ছ্বাসে কবি হয়েছেন উদ্বেলিত। চেতনায় এবং সৃজন সৌন্দর্য বীক্ষণ করা কবি প্রাপ্তির হঠাৎ ঝিলিকে আশাবাদী হয়ে ওঠেন থেকে থেকে-

‘নতুন সৌন্দর্য এক দেখিয়াছি- সকল অতীত

ঝেড়ে ফেলে- নতুন বসন্ত এক এসেছে জীবনে;

শালিকেরা কাঁপিতেছে মাঠে মাঠে- সেইখানে শীত,

শীত শুধু তবুও আমার বুকে হৃদয়ের বনে

কখন অঘ্রান রাত শেষ হল পৌষ গেল চলে

যাহারে পাইনি রেখে বেবিলনে সে এসেছে বলে।’

উপমার কবি জীবনানন্দ। কবিতার চরণে চরণে তার উপমারা হয়েছে প্রাণবন্ত। অতি সাধারণ বিষয়কে উপমান করে তিনি উপমিতকে করেছেন অনন্য সাধারণ। প্রকৃতি ও জীবনের ছবি হতে রঙ বেছে নিয়ে তিনি উপমাকে করেছেন চিত্রের মতো জীবন্ত। তিনি আলোর মধ্যে আবেগের খোঁজ পান, লুপ্ত বেড়ালের মতো আলোকে নিভে যেতে দেখেন কিংবা সন্ধ্যার বিশুষ্ক আলোর মাঝে জাফরানী রঙের গন্ধ খুঁজে পান। মৃত্তিকার জ্যামিতিক ঢেউ কিংবা পাখিদের মতো সিঁড়ি ছাড়া উপরে উঠার কৌশলে কবি অভিভূত। তাই সরোজিনীকে খুঁজতে গিয়ে তিনি বলেন-

এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে, জানি না সে শুয়ে আছে কিনা।

অনেক হয়েছে শোয়া,- তারপর একদিন চলে গেছে কোন্ দূর মেঘে।

অন্ধকার, শেষ হলে যেই স্তর জেগে উঠে আলোর আবেগে

সরোজিনী চলে গেল অদূর, সিঁড়ি ছাড়া পাখিদের মতো পাখা বিনা?

যুদ্ধ নিয়ে কবির ছিলো উৎকণ্ঠা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা কবিকে করেছিল বিচলিত। গ্রাম-বাংলার নিভৃতে থাকা কবি আকাশে যুদ্ধ বিমানের শব্দে হয়ে উঠেন আতঙ্কিত। তাই একদিন তিনি সাহস করে বলে ফেলেন-

‘দামামা থামিয়ে ফেল- পেঁচার পাখার মতো

অন্ধকারে ডুবে যাক

রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ।’

কবি যুদ্ধে কার ক্ষতি হল, কার জয় হল তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চান না। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস, যুদ্ধ মানেই অকল্যাণ। তাই কবি জেদ করে বলেন-

‘জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্ খানে-

কোথায় নতুন করে বেবিলন ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়,’

তবুও এতো অপ্রাপ্তি, যুদ্ধ-দামামা ছেড়ে, ব্যর্থ প্রেম ছেড়ে, সংসারের জীর্ণ কষাঘাত ছেড়ে কবি বারে বারে হতে চেয়েছেন আশাবাদী। আশার কিরণ তার মনের চেতনায় হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে বলেছেÑ

‘রৌদ্র ঝিলমিল

ঊষার আকাশ, মধ্য নিশীথের নীল

অপার ঐশ্বর্য বেশে দেখা তুমি দাও বারে বারে

নিঃসহায় নগরীর কারাগার প্রাচীর পারে।’

কবি জীবনানন্দ কেবল রূপসী বাংলার কবি নন, তিনি পৃথিবীর পথে হাঁটা অনন্য যাত্রিক। তিনি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর কথক। তিনি কবিতার সাথে প্রেম করেছেন সারাটা জীবন। সাতটি তারার তিমিরের বেদনা দীর্ণ করে তিনি নক্ষত্রের রাতে মেতেছেন শব্দহীন জ্যোৎস্নায়। ঘাতক ট্রামের আঘাতে জীবনের যবনিকা হলেও তিনি নির্জন স্বাক্ষর রেখে গেছেন ধূসর পা-ুলিপি জুড়ে- বলেছেন তার কবিতার পাঠকের প্রতি- বিনয়ের, প্রার্থনার সকল অঞ্জলি নিয়ে-

আমি ঝরে যাব, তবু জীবন অগাধ

তোমারে রাখিব ধরে সেই দিন পৃথিবীর ’পরে,

আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে!