ধারাবাহিক রচনা : ৩

ইকোক্রিটিসিজম পরিবেশ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধন

লিটন চক্রবর্তী মিঠুন

(পূর্ব প্রকাশের পর)

দূষণ: পরিবেশবাদী আন্দোলনের ট্রিগারপয়েন্ট

“পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;

মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।”

-জীবনানন্দ দাশ

পৃথিবী সত্যিই ভয়াবহভাবে অসুস্থ। দূষিত আজ পৃথিবীর আলো, বাতাস, জল, মাটি। হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম খাত মারিয়ানা ট্রেঞ্চ: সর্বত্র আজ লাগামহীন দূষণের রাজত্ব। খাদ্যে বিষ, ওষুধে ভেজাল, প্রশ্বাসে রাসায়নিক পদার্থ, দৃষ্টিতে ধূসরতাÑ পৃথিবী এখন কঠিনভাবে বিপর্যন্ত মানুষের অন্তহীন লোভের কাছে। চলমান অতিমারিকে আলোচনার বাইরে রেখেও এ কথা বলা যায় যে, বিগত কয়েক শতাব্দীজুড়ে পৃথিবীর প্ল্যানেটারি সিস্টেম প্রচ- আঘাতের মুখোমুখি। বেপরোয়া পরিবেশ বিপর্যয় সে বাস্তবতার কেন্দ্রে। আর পরিবেশ সংকটের গভীরে বল্গাহীন দূষণের ব্যাপক বিস্তার। রাসায়নিক দূষণের সীমাহীন দৌরাত্ম্য নিয়ে সংবেদনশীল রাচেল কারসন যখন ১৯৬২ সালে লেখেন ঝরষবহঃ ঝঢ়ৎরহম (নীরব বসন্ত), তখন থেকেই বলা চলে শুরু হয় আধুনিক পরিবেশবাদের অভিযাত্রা। আর জ্ঞানকা- হিসেবে ইকোক্রিটিসিজমের শুরুয়াতে এ বইটি বাইবেলস্বরূপ। এ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় ‘অ ঋধনষব ভড়ৎ ঞড়সড়ৎৎড়’ি (আগামীর উপকথা)-য় তিনি একটি রূপকথাধর্মী বয়ানভঙ্গিতে শুরু করেন: ‘একদা আমেরিকার বুকে একটি শহর ছিল যেখানে প্রতিটি জীবন ছিল তার প্রতিবেশের সাথে সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ’। তারপর তিনি ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ পল্লীপ্রতিম শহরের কাব্যিক চিত্র আঁকেন যেখানে সমৃদ্ধ খেতখামার, সবুজ মাঠ, পাহাড়ে শেয়ালের ডাকাডাকি, নীরব হরিণ, লতাগুল্ম, বুনোফুল,অগুনতি পাখপাখালি, খাঁড়ির স্বচ্ছজলে মাছের খেলা এবং শহরে ঘুরতে আসা মানুষের অমলিন আনন্দের বর্ণনা আছে। সে চিত্রকল্পে একদিকে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাব্যিক সুষমা, তেমনি আছে মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে বিরাজমান ঐকতানের মহিমা। কিন্তু সে স্বর্গতুল্য পরিবেশ ও প্রতিবেশ একসময় মানুষের শয়তানিতে আক্রান্ত-সন্ত্রস্ত হয়।

তারপর একটা অশুভ ছায়া নেমে আসে এলাকাটির ওপর এবং সবকিছু পাল্টে যেতে থাকে। কোনও এক অলক্ষ্মীর আছর পুরো সমাজের ওপর পড়ে: রহস্যময় রোগবালাই মুরগির পালে জেঁকে বসে; গবাদিপশু-ভেড়ার পাল রোগব্যাধিতে মারা পড়তে থাকে। চারদিকে মৃত্যুর কালোছায়া।

এরপর পুরো অধ্যায় জুড়ে একটি সৌম্যশান্ত পরিবেশের ছিন্নবিচ্ছিন্ন হবার করুণ বর্ণনা আবেগঘন ভাষায় বিধৃত আছে। সবচেয়ে মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাখপাখালির অবলুপ্তি নিয়ে : একসময় যে সকালগুলো রবিন, ক্যাটবার্ড, ডাভ, জেই, রেন এবং আরও নানান পাখির কূজনে মুখরিত হতো, আজ সেখানে নেই কোনও আওয়াজ; কেবল নীরবতা ছেয়ে গেছে মাঠে, বনে ও জলাভূমিতে। শিরোনামের ‘নীরব বসন্ত’ একদিকে যেমন পাখির গান হারিয়ে যাবার বিষয়টিকে দ্যোতিত করে, অন্যদিকে সার্বিক পরিবেশ বিপর্যয়কেও উচ্চালোকিত করে।

গ্রেগ গারার্ডের ঊপড়পৎরঃরপরংস বইয়ের আলোকে বলা যায়, আধুনিক পরিবেশবাদ কেবল চূড়ান্তভাবে কাব্যিক নীতিগল্প (ঢ়ধৎধনষব) দিয়েই শুরু হয়নি, পল্লীসাহিত্য (ঢ়ধংঃড়ৎধষ) ও প্রলয়কথার (ধঢ়ড়পধষুঢ়ংব) মতো সাহিত্য ঘরানা বা জঁরের ওপরও নির্ভরশীল, যেগুলো প্রকৃতিতে মানুষের অবস্থানকে কল্পনা করার পূর্বপ্রচলিত পন্থা এবং বাইবেলের প্রথম ও শেষ বই, অর্থাৎ জেনেসিস ও রেভেলেশানের সময়কার (২০১৩ : ২)।

তাহলে প্রশ্ন জাগে : কী সেই অশুভ শক্তি যার বিষাক্ত নিশ্বাসে প্রকৃতি ও পরিবেশের এ সর্বনাশ? কারসনের মতে, আসল অপরাধী হচ্ছে ডিডিটি, অলড্রিন, ডায়েলড্রিনের মতো অর্গানিক কীটনাশকগুলো যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চালু করা হয় এবং কীটপতঙ্গ দমনে কার্যকর প্রমাণিত হয়। কারসন তাঁর বইতে বিচিত্রসব বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত একাট্টা করে এটা দেখাতে সক্ষম হন যে, কীটনিধনে এ সাফল্য বুনোজীবন (রিষফষরভব) ও মানব স্বাস্থ্যের প্রতি মারাত্মক হুমকি। তিনি একই সাথে কতিপয় কৃষিবিজ্ঞানীর ইউটোপীয় কল্পনাকে তাঁদেরই যুক্তিকে ঘায়েল করার প্রয়াস পান। মজার বিষয় হচ্ছে, তাঁর বৈজ্ঞানিক দাবিসমূহ ব্যাপকভাবে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। ফলে কীটনাশক দূষণ নিয়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধি পায়, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দৃঢ়তর হয় এবং কম তীব্র কৃষি রাসায়নিকের উদ্ভব ও উন্নয়ন হয়।

কাজেই রাচেল কারসনের বইটি যে পরিবেশবাদী আন্দোলনের সূচনা করে, তা একই সঙ্গে বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক। আশাবাদ এ আন্দোলনের মর্মমূলে। এ আন্দোলনের মানসসন্তান ইকোক্রিটিসিজম ডিসিপ্লিন হিসেবে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটায়। নারীবাদ ও মার্কসবাদের মতো এটিও রাজনৈতিক ধারার বিচার-বিশ্লেষণ। ইকোক্রিটিকগণ, গ্রেগ গারার্ড যেমনটি বলছেন, তাঁদের সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণকে প্রত্যক্ষভাবে একটি ‘সবুজ’ নৈতিক ও রাজনৈতিক এজেন্ডার সাথে বেঁধে দেন। ইকোক্রিটিসিজম ও সংশ্লিষ্ট আন্দোলন ও একটিভিজম পরিবেশগত ও সামাজিক বিষয়গুলোকে একসাথে জুড়ে দিয়েই বাস্তবতাকে বোঝার ও পাল্টানোর চেষ্টা করেন। কী দর্শন, কী রাজনীতি, কী অর্থনীতি, কী সমাজবিজ্ঞানÑ সবদিকে ইকোক্রিটিসিজম তার বিশ্লেষণী দৃষ্টি জারি রেখেছে। একটি অনড় আশাবাদ এ ঘরানার জ্ঞানকা-ের অন্তর্লীন শক্তি। কাজেই একজন ইকোক্রিটিক বা প্রতিবেশতাত্ত্বিক সমালোচক দুর্মর আশাবাদী। কবি সুকান্তের ভাষায় বলতে হয়,

জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ,

আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ,

মাটিতে লালিত ভীরু, শুধু আজ আকাশের ডাকে

মেলেছি সন্ধিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে।

চোখে দ্বিধা-সন্দেহ থাকলেও পরিবেশ-বিপর্যয়ে জেরবার পৃথিবীকে দূষণমুক্ত করে বাস্তুগত ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন একজন ইকোক্রিটিকের থাকাই বাঞ্ছনীয়। কেননা, ইকোক্রিটিসিজমের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গীকার প্রশ্নাতীত। এটি কেবল তত্ত্বের জন্য তত্ত্ব নয়। যেমনটা আমরা রাচেল কারসনের সাহিত্যগুণ সম্পন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য সংবলিত দূষণবিরোধী বই সাইলেন্ট স্প্রিংয়ের প্রায়োগিক মূল্যের উদাহরণ থেকে বুঝতে পারি। যেভাবে একটি বই একটি আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে, রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে আলোড়ন তুলেছে এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে, সেটাই আশার সঞ্চার করে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইকোক্রিটিসিজম বা প্রতিবেশ-সমালোচনাতত্ত্বের প্রায়োগিকতার অন্যতম দিক হচ্ছে দূষণসহ যাবতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিতর্ক বা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়া। যেসব কঠিন বাস্তবতা আমাদের সমগ্র গ্রহীয় সিস্টেমকে জর্জরিত করছে, তাকে আমাদের আলাপে-সংলাপে-প্রলাপে-বিলাপে আনতে না পারলে কোনও ধরনের একশান তথা পদক্ষেপ নেয়া সম্ভবপর নয়। কারণ, আমাদের গল্প বা বয়ানই আমাদের বাস্তবতাকে কাঠামো দেয়, রূপ দেয়। বলা চলে, আমরা আমাদের গল্পের সমান বড় কিংবা ছোট। কাজেই আমাদের গল্প পাল্টে গেলে আমরাও পাল্টে যাই। বিপন্ন ধরিত্রীর বাস্তবতার পেছনে আমাদের গল্প বা বয়ানের দোষকে অস্বীকার করার জো নেই। মুক্তির মন্ত্রও ঠিক সেখানেই। পরিবেশগত আন্দোলন তাই ন্যারেটিভ বা বয়ান/গল্পের আন্দোলনও বটে। আর বোধগম্য কারণে একজন ইকোক্রিটিক আমাদের গল্প তথা সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার গভীরে লুক্কায়িত সেসব প্যাটার্ন, বয়ানকৌশল, উপমা, চিহ্ন বা প্রতীক খুঁজে বের করবেনÑ যা পরিবেশের সাথে আমাদের সম্পর্ককে বুঝতে সাহায্য করবে।

রিচার্ড কেরিজ (জরপযধৎফ কবৎৎরফমব) ইকোক্রিটিক ও ইকোক্রিটিসিজমের কাজের রূপরেখা দিচ্ছেন এভাবে:

ইকোক্রিটিক চান পরিবেশগত ধারণা ও প্রতিনিধিত্বকে ট্র্যাক করতে তা সে যেখানেই পাওয়া যাক না কেন। তিনি চান আরও স্পষ্ট করে সে বিতর্ককে দেখতে যা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিম-লে ঘটে চলেছে, কিন্তু প্রায়শই অর্ধ-লুক্কায়িত অবস্থায়। সর্বোপরি, ইকোক্রিটিসিজম টেক্সট ও ধারণাসমূহকে পরিবেশগত সংকটের প্রতি-জবাব হিসেবে মূল্যায়ন করতে চায় তাদের সামঞ্জস্য ও কার্যকারিতার আলোকে।

অর্থাৎ, আমরা যদি কোনও বই পড়ি বা সিনেমা দেখি ইকোক্রিটিসিজমের লেন্স মারফত, তাহলে আমরা সেখানে একটা বিতর্ক বা ডিসকোর্স খুঁজবো। টেক্সটি পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয় ও সংকটকে ঠিক কীভাবে তুলে ধরেছে বা ধরেনি, কিংবা কীভাবে পরিবেশ-ধ্বংসের প্রণোদনা জোগাচ্ছে সে বিতর্ক খোঁজা ইকোক্রিটিকের মূল কাজ। ধরা যাক, আপনি বাংলাদেশি ঔপন্যাসিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শকুনের ডানা উপন্যাসটি পড়ছেন। আপনি তাহলে পরিবেশবাদী বিতর্কে এ টেক্সটের অবদান আছে কি না তার অনুসন্ধান করবেন। লেখকের শিরোনাম চয়ন, প্লটনির্মাণ, বয়ানকৌশল, গল্প, থিম, লিটারেরি ডিভাইস, চরিত্রায়ণÑ সমস্ত কিছু পরিবেশ বিষয়ক আলাপ-আলোচনায় কোনও প্রভাব ফেলছে কি না তা আপনার সমালোচনার রাডারে থাকবে। আপনি আরও খুঁজবেন এ টেক্সটের রাজনীতি এবং সে রাজনীতি পরিবেশবাদের পক্ষে না বিপক্ষে। পাশাপাশি, এ উপন্যাস পাঠকের মানসচেতনায় পরিবেশ সম্পর্কে কোনো বোধের অনুরণন ঘটাচ্ছে তাও দেখবার বিষয়। মানুষ ও প্রকৃতি-প্রতিবেশের মিথস্ক্রিয়া টেক্সটটি কীভাবে দেখছে বা দেখাতে চাইছে সেটাও ধর্তব্যের ব্যাপার। বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশের ভারসাম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাণিদের প্রতি মানুষের আচরণ, পুঁজিবাদী অর্থনীতি, উন্নয়ন প্রকল্প, বিশ্বায়ন এবং এরকম অন্যান্য অনুষঙ্গ যা চলমান পরিবেশ-বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে, তা উক্ত টেক্সটে এসেছে কি না, বা কী চেহারায় ও আদলে এসেছে- এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ইকোক্রিটিক ঢঁড়ে বেড়াবেন টেক্সটিকে তাঁর সমালোচকীয় অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে ফেলে। গল্প, কবিতা, সিনেমা, পোস্টার, রাজনৈতিক মেনিফেস্টো, বিজ্ঞাপন- কোনও কিছুই বাদ যাবে না ইকোক্রিটিসিজমের অনুসন্ধানী তৎপরতা থেকে।

এ প্রসঙ্গে গ্রেগ গারার্ড আমাদেরকে জানাচ্ছেন:

ইকোক্রিটিসিজমের শুরুর দিকের কাজগুলোতে রোমান্টিক কাব্য, বন্যতাবিষয়ক বয়ান ও নিসর্গলিখনের প্রতি নিবিড় আগ্রহ থাকলেও বিগত কয়েক বছরে অঝখঊ (অংংড়পরধঃরড়হ ভড়ৎ ঃযব ঝঃঁফু ড়ভ খরঃবৎধঃঁৎব ধহফ ঊহারৎড়হসবহঃ) অধিকতর সাধারণ সাংস্কৃতিক ইকোক্রিটিসিজমের দিকে ঝুঁকেছে, যেখানে রয়েছে জনপ্রিয় বিজ্ঞান সাহিত্য, ছায়াছবি, টেলিভিশন, কলা, স্থাপত্য এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক নিদর্শন বা প্রতœবস্তু যথা থিম পার্ক, চিড়িয়াখানা ও শপিং মল সম্পর্কে অধ্যয়ন বা পঠনপাঠন। যেহেতু ইকোক্রিটিক একটি সত্যিকারের পরিবর্তনমূলক ডিসকোর্স বা বয়ান প্রদান করতে চান, যাতে আমরা আমাদের বসবাসের পৃথিবীটাকে বিচার-বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করতে পারি, সে লক্ষে ব্যাপক বিস্তৃত পরিসরের সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া ও পণ্যের ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। কেননা, এসব সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া ও পণ্যের মধ্যে ও মাধ্যমে সংস্কৃতি ও প্রকৃতির মাঝে জটিল বোঝাপড়া বা লেনাদেনা সম্পন্ন হয়। (২০১৩: ৫)

এ থেকে বিষয়টি জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়, যে, ইকোক্রিটিসিজম আজকে দিগন্ত বিস্তার করেছে সাংস্কৃতিক পরিম-লের উদার জমিনে। মানব ও অ-মানবের সম্পর্কের আসলিয়াত বুঝতে গিয়ে এক সময় সে প্রশ্ন করে বসেছে খোদ “মানব” প্রত্যয়টির মানে নিয়ে। আর দশটি সমকালীন সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক তত্ত্বের মধ্যে ইকোক্রিটিসিজম নিজেকে আলাদা করেছে বাস্তুবিজ্ঞানের (ংপরবহপব ড়ভ বপড়ষড়মু) সাথে তার নিবিড় সম্পর্কের সৌজন্যে। সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সমালোচনার ধারা হিসেবে ইকোক্রিটিসিজম হয়তো বাস্তুবিজ্ঞানের ভেতরকার সমস্যা নিয়ে আলাপ করার হকদার নয়, কেননা সেটা বৈজ্ঞানিক সমস্যা। কিন্তু বাস্তুতান্ত্রিক সমস্যা যার সাথে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা অবশ্যই ইকোক্রিটিসিজমের বিষয়। যেমন, রাচেল কারসনের সাইলেন্ট স্প্রিং বা নীরব বসন্ত রাসায়নিক দূষণজনিত ইকোলজিকাল প্রবলেমকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোচনার বিষয়ে পরিণত করেছে। একইভাবে, বিভূতিভূষণের আরণ্যক উপন্যাসটি বাস্তুতন্ত্রবিনাশী পুঁজিবাদী সভ্যতা ও সংস্কৃতির লজিককে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে, আর ইকোক্রিটিক উপন্যাসের মতো সাংস্কৃতিক টেক্সটে খুঁজে পেয়েছেন সংস্কৃতি ও প্রকৃতি তথা মানব ও অ-মানবের মধ্যে সম্পর্কের একটি নেতিবাচক ও সাংঘর্ষিক রূপ।

ইকোক্রিটিসিজমের অন্যতম অভিপ্রায় রেটোরিক বা কথনশৈলী নির্মাণ। কারণ, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, গল্প বা বয়ান আমাদের আত্মসত্তা নির্মাণ করে। আর তাই এমন রেটোরিক তৈরি করা দরকার, যার ইমপ্যাক্ট আমরা ভালোভাবেই টের পাই। ইকোক্রিটিসিজম এ দায়িত্বটি কাঁধে তুলে নিয়েছে। কারসন যেমন প্রকৃতিকে কল্পনা করার বা দেখার প্রাচীন তরিকার সাথে “ফলআউট হিস্টিরিয়া” (মানে সব-শেষ-হয়ে-গেল-গেল বলে মূর্ছা যাবার অবস্থা) থেকে উদ্ভূত হুমকিকে দেখার সমকালীন ফিরকাকে এমনভাবে মিলিয়েছেন যেন দূষণ বিষয়টি সম্পর্কে নির্দিষ্ট নরম্যাটিভ বা স্বাভাবিক দাবি তোলা যায়। অর্থাৎ, দূষণ বিষয়ক ধারণাটিকেই তিনি সূক্ষ্মভাবে বদলে নিয়েছেন, যেন বিষয়টি জনমনে যুতসই প্রভাব ফেলতে পারে। বলা যায়, ইকোক্রিটিসিজম কথনশৈলী বা রেটোরিককে হাতিয়ার বানিয়ে তার পরিবেশবাদী মঞ্জিলে মাকসাদে পৌঁছুতে চায়। (চলবে)

তথ্য সহায়তা:

১. ঊপড়পৎরঃরপরংস নু এৎবম এধৎৎধৎফ (২০১৩)

২. ঝরষবহঃ ঝঢ়ৎরহম নু জধপযবষ ঈধৎংড়হ (১৯৬২)

৩. সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শকুনের ডানা (২০১৩)

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৬ আশ্বিন ১৪২৯ ২৪ সফর ১৪৪৪

ধারাবাহিক রচনা : ৩

ইকোক্রিটিসিজম পরিবেশ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধন

লিটন চক্রবর্তী মিঠুন

image

(পূর্ব প্রকাশের পর)

দূষণ: পরিবেশবাদী আন্দোলনের ট্রিগারপয়েন্ট

“পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;

মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।”

-জীবনানন্দ দাশ

পৃথিবী সত্যিই ভয়াবহভাবে অসুস্থ। দূষিত আজ পৃথিবীর আলো, বাতাস, জল, মাটি। হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম খাত মারিয়ানা ট্রেঞ্চ: সর্বত্র আজ লাগামহীন দূষণের রাজত্ব। খাদ্যে বিষ, ওষুধে ভেজাল, প্রশ্বাসে রাসায়নিক পদার্থ, দৃষ্টিতে ধূসরতাÑ পৃথিবী এখন কঠিনভাবে বিপর্যন্ত মানুষের অন্তহীন লোভের কাছে। চলমান অতিমারিকে আলোচনার বাইরে রেখেও এ কথা বলা যায় যে, বিগত কয়েক শতাব্দীজুড়ে পৃথিবীর প্ল্যানেটারি সিস্টেম প্রচ- আঘাতের মুখোমুখি। বেপরোয়া পরিবেশ বিপর্যয় সে বাস্তবতার কেন্দ্রে। আর পরিবেশ সংকটের গভীরে বল্গাহীন দূষণের ব্যাপক বিস্তার। রাসায়নিক দূষণের সীমাহীন দৌরাত্ম্য নিয়ে সংবেদনশীল রাচেল কারসন যখন ১৯৬২ সালে লেখেন ঝরষবহঃ ঝঢ়ৎরহম (নীরব বসন্ত), তখন থেকেই বলা চলে শুরু হয় আধুনিক পরিবেশবাদের অভিযাত্রা। আর জ্ঞানকা- হিসেবে ইকোক্রিটিসিজমের শুরুয়াতে এ বইটি বাইবেলস্বরূপ। এ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় ‘অ ঋধনষব ভড়ৎ ঞড়সড়ৎৎড়’ি (আগামীর উপকথা)-য় তিনি একটি রূপকথাধর্মী বয়ানভঙ্গিতে শুরু করেন: ‘একদা আমেরিকার বুকে একটি শহর ছিল যেখানে প্রতিটি জীবন ছিল তার প্রতিবেশের সাথে সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ’। তারপর তিনি ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ পল্লীপ্রতিম শহরের কাব্যিক চিত্র আঁকেন যেখানে সমৃদ্ধ খেতখামার, সবুজ মাঠ, পাহাড়ে শেয়ালের ডাকাডাকি, নীরব হরিণ, লতাগুল্ম, বুনোফুল,অগুনতি পাখপাখালি, খাঁড়ির স্বচ্ছজলে মাছের খেলা এবং শহরে ঘুরতে আসা মানুষের অমলিন আনন্দের বর্ণনা আছে। সে চিত্রকল্পে একদিকে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাব্যিক সুষমা, তেমনি আছে মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে বিরাজমান ঐকতানের মহিমা। কিন্তু সে স্বর্গতুল্য পরিবেশ ও প্রতিবেশ একসময় মানুষের শয়তানিতে আক্রান্ত-সন্ত্রস্ত হয়।

তারপর একটা অশুভ ছায়া নেমে আসে এলাকাটির ওপর এবং সবকিছু পাল্টে যেতে থাকে। কোনও এক অলক্ষ্মীর আছর পুরো সমাজের ওপর পড়ে: রহস্যময় রোগবালাই মুরগির পালে জেঁকে বসে; গবাদিপশু-ভেড়ার পাল রোগব্যাধিতে মারা পড়তে থাকে। চারদিকে মৃত্যুর কালোছায়া।

এরপর পুরো অধ্যায় জুড়ে একটি সৌম্যশান্ত পরিবেশের ছিন্নবিচ্ছিন্ন হবার করুণ বর্ণনা আবেগঘন ভাষায় বিধৃত আছে। সবচেয়ে মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাখপাখালির অবলুপ্তি নিয়ে : একসময় যে সকালগুলো রবিন, ক্যাটবার্ড, ডাভ, জেই, রেন এবং আরও নানান পাখির কূজনে মুখরিত হতো, আজ সেখানে নেই কোনও আওয়াজ; কেবল নীরবতা ছেয়ে গেছে মাঠে, বনে ও জলাভূমিতে। শিরোনামের ‘নীরব বসন্ত’ একদিকে যেমন পাখির গান হারিয়ে যাবার বিষয়টিকে দ্যোতিত করে, অন্যদিকে সার্বিক পরিবেশ বিপর্যয়কেও উচ্চালোকিত করে।

গ্রেগ গারার্ডের ঊপড়পৎরঃরপরংস বইয়ের আলোকে বলা যায়, আধুনিক পরিবেশবাদ কেবল চূড়ান্তভাবে কাব্যিক নীতিগল্প (ঢ়ধৎধনষব) দিয়েই শুরু হয়নি, পল্লীসাহিত্য (ঢ়ধংঃড়ৎধষ) ও প্রলয়কথার (ধঢ়ড়পধষুঢ়ংব) মতো সাহিত্য ঘরানা বা জঁরের ওপরও নির্ভরশীল, যেগুলো প্রকৃতিতে মানুষের অবস্থানকে কল্পনা করার পূর্বপ্রচলিত পন্থা এবং বাইবেলের প্রথম ও শেষ বই, অর্থাৎ জেনেসিস ও রেভেলেশানের সময়কার (২০১৩ : ২)।

তাহলে প্রশ্ন জাগে : কী সেই অশুভ শক্তি যার বিষাক্ত নিশ্বাসে প্রকৃতি ও পরিবেশের এ সর্বনাশ? কারসনের মতে, আসল অপরাধী হচ্ছে ডিডিটি, অলড্রিন, ডায়েলড্রিনের মতো অর্গানিক কীটনাশকগুলো যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চালু করা হয় এবং কীটপতঙ্গ দমনে কার্যকর প্রমাণিত হয়। কারসন তাঁর বইতে বিচিত্রসব বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত একাট্টা করে এটা দেখাতে সক্ষম হন যে, কীটনিধনে এ সাফল্য বুনোজীবন (রিষফষরভব) ও মানব স্বাস্থ্যের প্রতি মারাত্মক হুমকি। তিনি একই সাথে কতিপয় কৃষিবিজ্ঞানীর ইউটোপীয় কল্পনাকে তাঁদেরই যুক্তিকে ঘায়েল করার প্রয়াস পান। মজার বিষয় হচ্ছে, তাঁর বৈজ্ঞানিক দাবিসমূহ ব্যাপকভাবে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। ফলে কীটনাশক দূষণ নিয়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধি পায়, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দৃঢ়তর হয় এবং কম তীব্র কৃষি রাসায়নিকের উদ্ভব ও উন্নয়ন হয়।

কাজেই রাচেল কারসনের বইটি যে পরিবেশবাদী আন্দোলনের সূচনা করে, তা একই সঙ্গে বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক। আশাবাদ এ আন্দোলনের মর্মমূলে। এ আন্দোলনের মানসসন্তান ইকোক্রিটিসিজম ডিসিপ্লিন হিসেবে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটায়। নারীবাদ ও মার্কসবাদের মতো এটিও রাজনৈতিক ধারার বিচার-বিশ্লেষণ। ইকোক্রিটিকগণ, গ্রেগ গারার্ড যেমনটি বলছেন, তাঁদের সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণকে প্রত্যক্ষভাবে একটি ‘সবুজ’ নৈতিক ও রাজনৈতিক এজেন্ডার সাথে বেঁধে দেন। ইকোক্রিটিসিজম ও সংশ্লিষ্ট আন্দোলন ও একটিভিজম পরিবেশগত ও সামাজিক বিষয়গুলোকে একসাথে জুড়ে দিয়েই বাস্তবতাকে বোঝার ও পাল্টানোর চেষ্টা করেন। কী দর্শন, কী রাজনীতি, কী অর্থনীতি, কী সমাজবিজ্ঞানÑ সবদিকে ইকোক্রিটিসিজম তার বিশ্লেষণী দৃষ্টি জারি রেখেছে। একটি অনড় আশাবাদ এ ঘরানার জ্ঞানকা-ের অন্তর্লীন শক্তি। কাজেই একজন ইকোক্রিটিক বা প্রতিবেশতাত্ত্বিক সমালোচক দুর্মর আশাবাদী। কবি সুকান্তের ভাষায় বলতে হয়,

জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ,

আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ,

মাটিতে লালিত ভীরু, শুধু আজ আকাশের ডাকে

মেলেছি সন্ধিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে।

চোখে দ্বিধা-সন্দেহ থাকলেও পরিবেশ-বিপর্যয়ে জেরবার পৃথিবীকে দূষণমুক্ত করে বাস্তুগত ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন একজন ইকোক্রিটিকের থাকাই বাঞ্ছনীয়। কেননা, ইকোক্রিটিসিজমের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গীকার প্রশ্নাতীত। এটি কেবল তত্ত্বের জন্য তত্ত্ব নয়। যেমনটা আমরা রাচেল কারসনের সাহিত্যগুণ সম্পন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য সংবলিত দূষণবিরোধী বই সাইলেন্ট স্প্রিংয়ের প্রায়োগিক মূল্যের উদাহরণ থেকে বুঝতে পারি। যেভাবে একটি বই একটি আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে, রাষ্ট্রীয় নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে আলোড়ন তুলেছে এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে, সেটাই আশার সঞ্চার করে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইকোক্রিটিসিজম বা প্রতিবেশ-সমালোচনাতত্ত্বের প্রায়োগিকতার অন্যতম দিক হচ্ছে দূষণসহ যাবতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিতর্ক বা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়া। যেসব কঠিন বাস্তবতা আমাদের সমগ্র গ্রহীয় সিস্টেমকে জর্জরিত করছে, তাকে আমাদের আলাপে-সংলাপে-প্রলাপে-বিলাপে আনতে না পারলে কোনও ধরনের একশান তথা পদক্ষেপ নেয়া সম্ভবপর নয়। কারণ, আমাদের গল্প বা বয়ানই আমাদের বাস্তবতাকে কাঠামো দেয়, রূপ দেয়। বলা চলে, আমরা আমাদের গল্পের সমান বড় কিংবা ছোট। কাজেই আমাদের গল্প পাল্টে গেলে আমরাও পাল্টে যাই। বিপন্ন ধরিত্রীর বাস্তবতার পেছনে আমাদের গল্প বা বয়ানের দোষকে অস্বীকার করার জো নেই। মুক্তির মন্ত্রও ঠিক সেখানেই। পরিবেশগত আন্দোলন তাই ন্যারেটিভ বা বয়ান/গল্পের আন্দোলনও বটে। আর বোধগম্য কারণে একজন ইকোক্রিটিক আমাদের গল্প তথা সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার গভীরে লুক্কায়িত সেসব প্যাটার্ন, বয়ানকৌশল, উপমা, চিহ্ন বা প্রতীক খুঁজে বের করবেনÑ যা পরিবেশের সাথে আমাদের সম্পর্ককে বুঝতে সাহায্য করবে।

রিচার্ড কেরিজ (জরপযধৎফ কবৎৎরফমব) ইকোক্রিটিক ও ইকোক্রিটিসিজমের কাজের রূপরেখা দিচ্ছেন এভাবে:

ইকোক্রিটিক চান পরিবেশগত ধারণা ও প্রতিনিধিত্বকে ট্র্যাক করতে তা সে যেখানেই পাওয়া যাক না কেন। তিনি চান আরও স্পষ্ট করে সে বিতর্ককে দেখতে যা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিম-লে ঘটে চলেছে, কিন্তু প্রায়শই অর্ধ-লুক্কায়িত অবস্থায়। সর্বোপরি, ইকোক্রিটিসিজম টেক্সট ও ধারণাসমূহকে পরিবেশগত সংকটের প্রতি-জবাব হিসেবে মূল্যায়ন করতে চায় তাদের সামঞ্জস্য ও কার্যকারিতার আলোকে।

অর্থাৎ, আমরা যদি কোনও বই পড়ি বা সিনেমা দেখি ইকোক্রিটিসিজমের লেন্স মারফত, তাহলে আমরা সেখানে একটা বিতর্ক বা ডিসকোর্স খুঁজবো। টেক্সটি পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয় ও সংকটকে ঠিক কীভাবে তুলে ধরেছে বা ধরেনি, কিংবা কীভাবে পরিবেশ-ধ্বংসের প্রণোদনা জোগাচ্ছে সে বিতর্ক খোঁজা ইকোক্রিটিকের মূল কাজ। ধরা যাক, আপনি বাংলাদেশি ঔপন্যাসিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শকুনের ডানা উপন্যাসটি পড়ছেন। আপনি তাহলে পরিবেশবাদী বিতর্কে এ টেক্সটের অবদান আছে কি না তার অনুসন্ধান করবেন। লেখকের শিরোনাম চয়ন, প্লটনির্মাণ, বয়ানকৌশল, গল্প, থিম, লিটারেরি ডিভাইস, চরিত্রায়ণÑ সমস্ত কিছু পরিবেশ বিষয়ক আলাপ-আলোচনায় কোনও প্রভাব ফেলছে কি না তা আপনার সমালোচনার রাডারে থাকবে। আপনি আরও খুঁজবেন এ টেক্সটের রাজনীতি এবং সে রাজনীতি পরিবেশবাদের পক্ষে না বিপক্ষে। পাশাপাশি, এ উপন্যাস পাঠকের মানসচেতনায় পরিবেশ সম্পর্কে কোনো বোধের অনুরণন ঘটাচ্ছে তাও দেখবার বিষয়। মানুষ ও প্রকৃতি-প্রতিবেশের মিথস্ক্রিয়া টেক্সটটি কীভাবে দেখছে বা দেখাতে চাইছে সেটাও ধর্তব্যের ব্যাপার। বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশের ভারসাম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাণিদের প্রতি মানুষের আচরণ, পুঁজিবাদী অর্থনীতি, উন্নয়ন প্রকল্প, বিশ্বায়ন এবং এরকম অন্যান্য অনুষঙ্গ যা চলমান পরিবেশ-বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে, তা উক্ত টেক্সটে এসেছে কি না, বা কী চেহারায় ও আদলে এসেছে- এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ইকোক্রিটিক ঢঁড়ে বেড়াবেন টেক্সটিকে তাঁর সমালোচকীয় অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে ফেলে। গল্প, কবিতা, সিনেমা, পোস্টার, রাজনৈতিক মেনিফেস্টো, বিজ্ঞাপন- কোনও কিছুই বাদ যাবে না ইকোক্রিটিসিজমের অনুসন্ধানী তৎপরতা থেকে।

এ প্রসঙ্গে গ্রেগ গারার্ড আমাদেরকে জানাচ্ছেন:

ইকোক্রিটিসিজমের শুরুর দিকের কাজগুলোতে রোমান্টিক কাব্য, বন্যতাবিষয়ক বয়ান ও নিসর্গলিখনের প্রতি নিবিড় আগ্রহ থাকলেও বিগত কয়েক বছরে অঝখঊ (অংংড়পরধঃরড়হ ভড়ৎ ঃযব ঝঃঁফু ড়ভ খরঃবৎধঃঁৎব ধহফ ঊহারৎড়হসবহঃ) অধিকতর সাধারণ সাংস্কৃতিক ইকোক্রিটিসিজমের দিকে ঝুঁকেছে, যেখানে রয়েছে জনপ্রিয় বিজ্ঞান সাহিত্য, ছায়াছবি, টেলিভিশন, কলা, স্থাপত্য এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক নিদর্শন বা প্রতœবস্তু যথা থিম পার্ক, চিড়িয়াখানা ও শপিং মল সম্পর্কে অধ্যয়ন বা পঠনপাঠন। যেহেতু ইকোক্রিটিক একটি সত্যিকারের পরিবর্তনমূলক ডিসকোর্স বা বয়ান প্রদান করতে চান, যাতে আমরা আমাদের বসবাসের পৃথিবীটাকে বিচার-বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করতে পারি, সে লক্ষে ব্যাপক বিস্তৃত পরিসরের সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া ও পণ্যের ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। কেননা, এসব সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া ও পণ্যের মধ্যে ও মাধ্যমে সংস্কৃতি ও প্রকৃতির মাঝে জটিল বোঝাপড়া বা লেনাদেনা সম্পন্ন হয়। (২০১৩: ৫)

এ থেকে বিষয়টি জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়, যে, ইকোক্রিটিসিজম আজকে দিগন্ত বিস্তার করেছে সাংস্কৃতিক পরিম-লের উদার জমিনে। মানব ও অ-মানবের সম্পর্কের আসলিয়াত বুঝতে গিয়ে এক সময় সে প্রশ্ন করে বসেছে খোদ “মানব” প্রত্যয়টির মানে নিয়ে। আর দশটি সমকালীন সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক তত্ত্বের মধ্যে ইকোক্রিটিসিজম নিজেকে আলাদা করেছে বাস্তুবিজ্ঞানের (ংপরবহপব ড়ভ বপড়ষড়মু) সাথে তার নিবিড় সম্পর্কের সৌজন্যে। সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সমালোচনার ধারা হিসেবে ইকোক্রিটিসিজম হয়তো বাস্তুবিজ্ঞানের ভেতরকার সমস্যা নিয়ে আলাপ করার হকদার নয়, কেননা সেটা বৈজ্ঞানিক সমস্যা। কিন্তু বাস্তুতান্ত্রিক সমস্যা যার সাথে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা অবশ্যই ইকোক্রিটিসিজমের বিষয়। যেমন, রাচেল কারসনের সাইলেন্ট স্প্রিং বা নীরব বসন্ত রাসায়নিক দূষণজনিত ইকোলজিকাল প্রবলেমকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আলোচনার বিষয়ে পরিণত করেছে। একইভাবে, বিভূতিভূষণের আরণ্যক উপন্যাসটি বাস্তুতন্ত্রবিনাশী পুঁজিবাদী সভ্যতা ও সংস্কৃতির লজিককে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে, আর ইকোক্রিটিক উপন্যাসের মতো সাংস্কৃতিক টেক্সটে খুঁজে পেয়েছেন সংস্কৃতি ও প্রকৃতি তথা মানব ও অ-মানবের মধ্যে সম্পর্কের একটি নেতিবাচক ও সাংঘর্ষিক রূপ।

ইকোক্রিটিসিজমের অন্যতম অভিপ্রায় রেটোরিক বা কথনশৈলী নির্মাণ। কারণ, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, গল্প বা বয়ান আমাদের আত্মসত্তা নির্মাণ করে। আর তাই এমন রেটোরিক তৈরি করা দরকার, যার ইমপ্যাক্ট আমরা ভালোভাবেই টের পাই। ইকোক্রিটিসিজম এ দায়িত্বটি কাঁধে তুলে নিয়েছে। কারসন যেমন প্রকৃতিকে কল্পনা করার বা দেখার প্রাচীন তরিকার সাথে “ফলআউট হিস্টিরিয়া” (মানে সব-শেষ-হয়ে-গেল-গেল বলে মূর্ছা যাবার অবস্থা) থেকে উদ্ভূত হুমকিকে দেখার সমকালীন ফিরকাকে এমনভাবে মিলিয়েছেন যেন দূষণ বিষয়টি সম্পর্কে নির্দিষ্ট নরম্যাটিভ বা স্বাভাবিক দাবি তোলা যায়। অর্থাৎ, দূষণ বিষয়ক ধারণাটিকেই তিনি সূক্ষ্মভাবে বদলে নিয়েছেন, যেন বিষয়টি জনমনে যুতসই প্রভাব ফেলতে পারে। বলা যায়, ইকোক্রিটিসিজম কথনশৈলী বা রেটোরিককে হাতিয়ার বানিয়ে তার পরিবেশবাদী মঞ্জিলে মাকসাদে পৌঁছুতে চায়। (চলবে)

তথ্য সহায়তা:

১. ঊপড়পৎরঃরপরংস নু এৎবম এধৎৎধৎফ (২০১৩)

২. ঝরষবহঃ ঝঢ়ৎরহম নু জধপযবষ ঈধৎংড়হ (১৯৬২)

৩. সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শকুনের ডানা (২০১৩)