লক্ষ্যাপাড়ের চিত্রকথা নন্দনের গণকরণ

কাজল কানন

নগুরে মানুষ এখন নিজের সঙ্গেও নেই। প্রকৃতির সঙ্গ ছেড়ে সামাজের কাছে আসতে চেয়েছিলো। সমাজের সঙ্গ ছেড়ে সে নিজের কাছে পৌঁছুতে চেয়েছিলো। মহাসভ্যতাকে দাবি করে বসে আছে ‘মানবসভ্যতা’ হিসেবে। শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার মধ্য দিয়ে এমন এক পৃথিবী মানুষ বানাইছেÑ যার ভেতর মাহাভোগ-উপভোগ-অণুভোগ প্রাণান্ত হয়ে উঠেছে। এখন খুব শক্ত করেই কওয়া যায়, তার এই যাত্রা আত্মবিনাশী দাপাদাপি ছাড়া কিছুই না। বিশেষ করে ‘ব্যক্তি’ বানানোর পশ্চিমি ছ্যাবলামো থেকে অন্তত আমাদের জনপদের মানুষ তার আত্মাকে খাঁড়া রাখতে পারলো কই? ছেদে-বিচ্ছেদে জর্জর আত্মায় ভাবসম্পদ এখন তরিকাহারা। তার নিশা আছে নিশানা নেই। এক চরম বিচ্ছিন্নতা গ্রাস করছে শরীরমন।

এই মানুষ কি সব মানুষ? নাকি কোনো কোনো মানুষ? আসলে তো কোনো কোনো মানুষ। কিন্তু এই কোনো কোনো মানুষই সব মানুষকে নাচানোর ঠিকাদারি করছে। ঠিকাদারের ভাবই সর্দিজ¦রের বড়ির মতো গেলানো হচ্ছে সবাইকে। এখানে কিছুটা বাঁচা গেছেÑ সব মানুষ নয়, কোনো কোনো মানুষ। লাতিন আমেরিকায় যেমনটা হয়েছে, এখানে এখনও তেমনটা নয়। সেখানে ভাষা-কীর্তি-সংস্কৃতি সবটাই খায়া ফালাইছে। তবে ওই খেকো রাক্ষস কিন্তু আমাদের মধ্যেও হান্দাইয়া পড়ছে। বাংলাদেশকাল অর্থাৎ গত পঞ্চাশ বছরের জাতিরুচি/জনরুচি পরখ করলেই এর সন্ধান পাওয়া যাবে।

আমাদের সাহিত্য আমাদের মতো না, আমাদের গান আমাদের মতো না, আমাদের চিত্র আঁকা আমাদের মতো না, আমাদের রাজা-রাজনীতি আমাদের মতো না, আমাদের মনটাও আমাদের মতো না। তাই আমাদের রুচি আমাদের মতো হয় ক্যামনে? এমন বাস্তবতায় কোনো কোনো জাগরুকপ্রাণের তরিকাধারী তারুণ্য এর থেকে মুক্তি চাইছে এবং একটি পাল্টা মোকদ্দমা জারি রাখতে ধস্তাধস্তি করছে।

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে দাগ আর্ট স্টেশন যে প্রদর্শনী বসাইয়াছিলো, ‘লক্ষ্যাপাড়ের চিত্রকথা’ শিরোনামেÑ এটি দর্শন কইরা আমার মনে এমন ভাবনাই হৈলো।

এটি নারায়ণগঞ্জে হৈলো তাই, নাচন পারতাছি, এমনটা না। এই প্রদর্শনী একটা পাল্টাচিন্তা হিসেবে আমারে চেতাইয়া দিতে পারতাছে এটি হচ্ছে কথা। চরমতর বিচ্ছিন্নতার কালে এমন যৌথ শিল্পভাষ্য একটি চিন্তামুখ বলেই ধারণা হইতেছে।

এখানে তরুণপ্রাণ শিল্পীরা এমন কিছু প্রতিকৃতি হাজির করেছেন, যাদেরকে তারা কখনোই দেখেননি। তাদের কোনো ছবিও নেই। কারণ তারা অনেক আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমিও তাদের কোনো প্রতিকৃতি আগে দেখিনি। কিন্তু এই ছবিগুলো যখন দেখলাম, মনে হৈলো আমি তাদেরই চাক্ষুষ করলাম। যার সবটা উপস্থাপন একটি বিকল্প বাহাদুরি দেখাইতে পারতেছে। বাদামি কাগজের মধ্যে অতি সাধারণ মায়াপ্রবণ আঙ্গিক ও মশলায় প্রতিকৃতিগুলো আঁকা। এর মধ্যে আধুনিক ঝাড়িঝুড়ি নাই। প্রাণায়নের হাতছানি।

এই শহর নামে যে যৌথ শিল্পভাষ্যটি উপস্থাপন করা হয়েছে, তার সামনে এসে খাড়াইলাম। একটা মানুষকে কত সাধারণভাবে তার জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত করা যায়, এটি তার নমুনা। শীতলক্ষ্যার পাড়ের এই শহরটি মূলত শ্রমযাতনার নির্মাণ। এখানে বিত্ত আছে, বিত্তের উপরে বসা আছে দোটানা এক যাদু। যে মারেও না, বাঁচায়ও না। মানুষকে কেবল তাওয়ার মতো তাতায় জীবনভর। সে পোড়ে আর তৈরি হয় মহাভোগ। এই শিল্পাভষ্যটির মধ্য দিয়ে শহরটির রোয়াওঠা শরীর আত্মস্থ হয়ে যায়। জানা হয়ে যায়, প্রকৃতি তামা হয়ে গিয়ে একটি যাতনা বানিয়েছে। যার আঁচল ধরে বসে আছে বিষণ নাগরিক। এই দলীয় কর্মটির মধ্যে দিয়ে নগর যে কখনো একক কিছু নয়, শিল্পীরা তার তর্জমাও দিলেন।

অতীতকে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শেকড়, ভিত্তি নানাভাবে গাওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত গায়েনের চিন্তার তোহম বুঝতে হলে সমকালের খোলায় তোলা লাগেই। কারণ মানুষটা, সময়টা, তার কেদরানিটা কিন্তু বর্তমান ঘষেই জ¦লতে থাকে। নারায়ণগঞ্জ বা লক্ষ্যাপাড় যেভাবেই কই, এখানে শ্রমিকের মোকদ্দমাই টানটান। শ্রমশোষণের একটা পেটুক পট্টি হিসেবেও একে দেখা যায়। শিল্পী অমল আকাশ প্রথাবদ্ধ ঐতিহ্যকে ভিত্তি হিসেবে দেখার হিম্মত দেখালেন। পট-পটুয়া তো ফেলে আসা সময়ের দারু হিসেবে খাড়াইয়া গেছে আজকের যুগে। এটি আমাদের খাসলতেও মানাইয়া গেছে। কিন্তু এর মধ্যে হেতু ফলাইয়া দিয়া এই শিল্পী আমাদের কিছুটা হুঁশ বানাইলেন।

২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জে যে শ্রমিক বিদ্রোহটা হয়েছিলো, এটি আমার জীবনে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। আমার সুযোগ হয়েছিলো শ্রমিকদের সঙ্গে সামান্য চেষ্টা নিয়ে অংশ নেওয়ার। এর চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমি ঠাওর করেছিলাম একটি নয়া নারায়ণগঞ্জ; যা আমার তিরিশ বছরের দেখা শহরটিতে আলাদা গম্বুজ হিসেবে এখনও খাড়া। সেই শ্রমিক জাগরণকে পটের জর্জরে এনে অতীত বর্তমানে কষে একটি পাটের গেরো দিলেন অমল আকাশ।

এখানে পটচিত্র একেবারেই হালের নামতা। বর্তমান সময় ও লোকমুখি আঙ্গিকে পটের রব রূপগঞ্জের হাসেম ফুডের শ্রমিকদাহকে নয়াভাষ্য জারি করেছে। এই শ্রমিকদাহ কিছু দিন পরপরই বাংলাদেশে হচ্ছে। মানুষ আগুনে বলকাইয়া ঝলসাইয়া শ্রমিক হয়, নাকি শ্রমিক পুইড়া মানুষ হয় এমন প্রশ্ন এতদিনে বিসিএসে নিশ্চয়ই ঢুকিয়া পড়িতেছে। জ্ঞান হিসেবেও হয়তো এটি সূচিবদ্ধ হইতে থাকবে। কারণ প্রতিনিয়ত যেভাবে পুরান ঢাকা, নতুন ঢাকা, কারখানা গুদামে শ্রমিক পোড়ানো হয়; সেটিতো এখন আমাদের জ্ঞানগত সম্পদ হিসেবেই দেখতে হচ্ছে। কারণ চারপাশে যা কিছু আছে তাই নিয়েইতো আমাদের পরিবেশ, এভাবেই শিখেছি পাঠ্য-অপাঠ্য জ্ঞানে। অমল আকাশের সেই পোড়াহাহিনীই দেখলাম নিজের পোড়াচোখে।

এতে আমার মতো সাধারণ বোকাসোকা চোখ একটু জ্বালাপোড়া হৈলো। কারণ চিত্রকলার সঙ্গে গণবিচিচ্ছন্নতার যে মোটা রেখাটি আমি দেখতে দেখতে ভীত হয়ে উঠেছিলাম, তার থেকে কিছুটা বিরাম পাইলাম। শিল্পীর চিন্তা মানে ‘উঁচুজাতের ফেউ’- এই জায়গা থেকে নিজেকে সরানোর সুযোগ পাইলাম।

পশ্চিমা সবকিছুই বর্জনীয় নয়। মানুষের ভাবনার কোনো পুব-পশ্চিম লাগে না। কথা হচ্ছে, যখন ভাবের ওপর ভাবের গ্রাস অনিবার্য হয়, তখন তাকে পাল্টা হ্যাডম দেখানো লাগে। না হলে ভাববৈচিত্র্য বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের চিত্রকলার একটি বড় জায়গায় এমন প্রবণতা মিছা না। কুয়ার ব্যাঙ আর সমুদ্রের ব্যাঙের মধ্যে হরেক ভেদ থাকতে পারে, বিভেদ নেই। কুয়ার ব্যাঙ আর সমুদ্রের ব্যাঙের মধ্যে অমিল থাকতে পারে, গুনেমানে উভয়ই সমান। তাই কেউ কুয়ায় থাকতে চাইলে তার ওপর সমুদ্র আরোপের খেইলই হচ্ছে আগ্রাসন।

মূলত শীতলক্ষ্যার আত্মকাহিনীই নারায়ণগঞ্জের পূর্বাপর। এই নদী কেবলই সয়েছে সময়ের একের পর এক তামাদি। এর সঙ্গে একটা সম্পর্ক করা যায়নি। নদীটা চিরকালই একা। এর দায় কেউ নেয়নি। এই একাকে দেখা কিন্তু গুরুতর কর্তব্য। যুগে যুগে কেউ না কেউ তো একাকে দেখেন। তার খোঁজ নেন। তেমন একটি চিন্তাভাষ্য ব্যক্ত হইছে শিল্পী বদরুল আলম ইমনের মাথা থেকে। একটি নদীর আত্মকাহিনী তাই হয়ে উঠেছে এটি। যার ভাববৈচিত্র্য অন্তর্গতভাবে আপ্লুত করে।

বস্ত্র বিছানোর মধ্য দিয়ে শিল্পী সুমনা ও নাছির যে, ভাবগর্জন বর্ণনা করেছেন, এটি আমাদের শরীর আর আত্মার মধ্যে একটা সম্পর্ক বানাইয়া দেয়। বিশেষ করে এই নারায়ণগঞ্জ নগরীর উঁচু-নিচু দালানের প্রতিটি ইটের মধ্যে পোশাকশ্রমিক, সুতাশ্রমিক, তাঁতশ্রমিকের বুনন রয়েছে- তার সঙ্গে একটি আত্মীয়তা ঘটেছে শিল্পীদের কাজের আঙ্গিকে। এই আত্মীয়তার সবচেয়ে বড় নমুনা হচ্ছে শিল্পের গণকরণ। অতি সাধারণ, আশ-পাশের বিষয়, অনুষঙ্গ, ভাব, বাঞ্ছা, ভূগোল এখানে সক্রিয় ডানা তুলছে। দুর্বোধ্য ভাবপ্রকারে আক্রান্ত হওয়া মূলছিঁড়া মধ্যবিত্ত শিল্পবচন এখানে উত্তীর্ণ শিল্পভাষ্য হিসেবে হাজির রয়েছে। যা একটি কার্যকর জবাব এবং প্লাবনের পাল্টামুখ হতে পারে।

লক্ষ্যাপাড়ের চিত্রকথা শিরোনামে হাজির করা শিল্পী রঞ্জিত কর্মকার ও খন্দকার নাছির আহাম্মদের ভাস্কর্যসহ পুরো বিন্যাসটি নিয়েই একটি ধারণা মালুম হয়- যা ঔপনিবেশিক বালা-মুসিব্বত থেকে রেহাই দিতে পারে চিন্তা এবং হিয়াকে। এই জনপদের মানুষকে তার দৈনন্দিন নন্দন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তার বিনোদনপরিসর কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এটি নিগূঢ় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কূটচাল থেকেই হয়েছে। ক্ষমতার মতায়ন ঘটানোই এর লক্ষ্য। যে শিল্পী এবং শিল্পীগোষ্ঠী এটি করেছে তাদের শনাক্ত হওয়াও শুরু হয়েছে। দাগ আর্ট স্টেশন আঁখি মেলে আরও কিছু করুক না শিল্পের গণকরণে।

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৬ আশ্বিন ১৪২৯ ২৪ সফর ১৪৪৪

লক্ষ্যাপাড়ের চিত্রকথা নন্দনের গণকরণ

কাজল কানন

image

নগুরে মানুষ এখন নিজের সঙ্গেও নেই। প্রকৃতির সঙ্গ ছেড়ে সামাজের কাছে আসতে চেয়েছিলো। সমাজের সঙ্গ ছেড়ে সে নিজের কাছে পৌঁছুতে চেয়েছিলো। মহাসভ্যতাকে দাবি করে বসে আছে ‘মানবসভ্যতা’ হিসেবে। শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার মধ্য দিয়ে এমন এক পৃথিবী মানুষ বানাইছেÑ যার ভেতর মাহাভোগ-উপভোগ-অণুভোগ প্রাণান্ত হয়ে উঠেছে। এখন খুব শক্ত করেই কওয়া যায়, তার এই যাত্রা আত্মবিনাশী দাপাদাপি ছাড়া কিছুই না। বিশেষ করে ‘ব্যক্তি’ বানানোর পশ্চিমি ছ্যাবলামো থেকে অন্তত আমাদের জনপদের মানুষ তার আত্মাকে খাঁড়া রাখতে পারলো কই? ছেদে-বিচ্ছেদে জর্জর আত্মায় ভাবসম্পদ এখন তরিকাহারা। তার নিশা আছে নিশানা নেই। এক চরম বিচ্ছিন্নতা গ্রাস করছে শরীরমন।

এই মানুষ কি সব মানুষ? নাকি কোনো কোনো মানুষ? আসলে তো কোনো কোনো মানুষ। কিন্তু এই কোনো কোনো মানুষই সব মানুষকে নাচানোর ঠিকাদারি করছে। ঠিকাদারের ভাবই সর্দিজ¦রের বড়ির মতো গেলানো হচ্ছে সবাইকে। এখানে কিছুটা বাঁচা গেছেÑ সব মানুষ নয়, কোনো কোনো মানুষ। লাতিন আমেরিকায় যেমনটা হয়েছে, এখানে এখনও তেমনটা নয়। সেখানে ভাষা-কীর্তি-সংস্কৃতি সবটাই খায়া ফালাইছে। তবে ওই খেকো রাক্ষস কিন্তু আমাদের মধ্যেও হান্দাইয়া পড়ছে। বাংলাদেশকাল অর্থাৎ গত পঞ্চাশ বছরের জাতিরুচি/জনরুচি পরখ করলেই এর সন্ধান পাওয়া যাবে।

আমাদের সাহিত্য আমাদের মতো না, আমাদের গান আমাদের মতো না, আমাদের চিত্র আঁকা আমাদের মতো না, আমাদের রাজা-রাজনীতি আমাদের মতো না, আমাদের মনটাও আমাদের মতো না। তাই আমাদের রুচি আমাদের মতো হয় ক্যামনে? এমন বাস্তবতায় কোনো কোনো জাগরুকপ্রাণের তরিকাধারী তারুণ্য এর থেকে মুক্তি চাইছে এবং একটি পাল্টা মোকদ্দমা জারি রাখতে ধস্তাধস্তি করছে।

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে দাগ আর্ট স্টেশন যে প্রদর্শনী বসাইয়াছিলো, ‘লক্ষ্যাপাড়ের চিত্রকথা’ শিরোনামেÑ এটি দর্শন কইরা আমার মনে এমন ভাবনাই হৈলো।

এটি নারায়ণগঞ্জে হৈলো তাই, নাচন পারতাছি, এমনটা না। এই প্রদর্শনী একটা পাল্টাচিন্তা হিসেবে আমারে চেতাইয়া দিতে পারতাছে এটি হচ্ছে কথা। চরমতর বিচ্ছিন্নতার কালে এমন যৌথ শিল্পভাষ্য একটি চিন্তামুখ বলেই ধারণা হইতেছে।

এখানে তরুণপ্রাণ শিল্পীরা এমন কিছু প্রতিকৃতি হাজির করেছেন, যাদেরকে তারা কখনোই দেখেননি। তাদের কোনো ছবিও নেই। কারণ তারা অনেক আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমিও তাদের কোনো প্রতিকৃতি আগে দেখিনি। কিন্তু এই ছবিগুলো যখন দেখলাম, মনে হৈলো আমি তাদেরই চাক্ষুষ করলাম। যার সবটা উপস্থাপন একটি বিকল্প বাহাদুরি দেখাইতে পারতেছে। বাদামি কাগজের মধ্যে অতি সাধারণ মায়াপ্রবণ আঙ্গিক ও মশলায় প্রতিকৃতিগুলো আঁকা। এর মধ্যে আধুনিক ঝাড়িঝুড়ি নাই। প্রাণায়নের হাতছানি।

এই শহর নামে যে যৌথ শিল্পভাষ্যটি উপস্থাপন করা হয়েছে, তার সামনে এসে খাড়াইলাম। একটা মানুষকে কত সাধারণভাবে তার জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত করা যায়, এটি তার নমুনা। শীতলক্ষ্যার পাড়ের এই শহরটি মূলত শ্রমযাতনার নির্মাণ। এখানে বিত্ত আছে, বিত্তের উপরে বসা আছে দোটানা এক যাদু। যে মারেও না, বাঁচায়ও না। মানুষকে কেবল তাওয়ার মতো তাতায় জীবনভর। সে পোড়ে আর তৈরি হয় মহাভোগ। এই শিল্পাভষ্যটির মধ্য দিয়ে শহরটির রোয়াওঠা শরীর আত্মস্থ হয়ে যায়। জানা হয়ে যায়, প্রকৃতি তামা হয়ে গিয়ে একটি যাতনা বানিয়েছে। যার আঁচল ধরে বসে আছে বিষণ নাগরিক। এই দলীয় কর্মটির মধ্যে দিয়ে নগর যে কখনো একক কিছু নয়, শিল্পীরা তার তর্জমাও দিলেন।

অতীতকে ইতিহাস, ঐতিহ্য, শেকড়, ভিত্তি নানাভাবে গাওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত গায়েনের চিন্তার তোহম বুঝতে হলে সমকালের খোলায় তোলা লাগেই। কারণ মানুষটা, সময়টা, তার কেদরানিটা কিন্তু বর্তমান ঘষেই জ¦লতে থাকে। নারায়ণগঞ্জ বা লক্ষ্যাপাড় যেভাবেই কই, এখানে শ্রমিকের মোকদ্দমাই টানটান। শ্রমশোষণের একটা পেটুক পট্টি হিসেবেও একে দেখা যায়। শিল্পী অমল আকাশ প্রথাবদ্ধ ঐতিহ্যকে ভিত্তি হিসেবে দেখার হিম্মত দেখালেন। পট-পটুয়া তো ফেলে আসা সময়ের দারু হিসেবে খাড়াইয়া গেছে আজকের যুগে। এটি আমাদের খাসলতেও মানাইয়া গেছে। কিন্তু এর মধ্যে হেতু ফলাইয়া দিয়া এই শিল্পী আমাদের কিছুটা হুঁশ বানাইলেন।

২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জে যে শ্রমিক বিদ্রোহটা হয়েছিলো, এটি আমার জীবনে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। আমার সুযোগ হয়েছিলো শ্রমিকদের সঙ্গে সামান্য চেষ্টা নিয়ে অংশ নেওয়ার। এর চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমি ঠাওর করেছিলাম একটি নয়া নারায়ণগঞ্জ; যা আমার তিরিশ বছরের দেখা শহরটিতে আলাদা গম্বুজ হিসেবে এখনও খাড়া। সেই শ্রমিক জাগরণকে পটের জর্জরে এনে অতীত বর্তমানে কষে একটি পাটের গেরো দিলেন অমল আকাশ।

এখানে পটচিত্র একেবারেই হালের নামতা। বর্তমান সময় ও লোকমুখি আঙ্গিকে পটের রব রূপগঞ্জের হাসেম ফুডের শ্রমিকদাহকে নয়াভাষ্য জারি করেছে। এই শ্রমিকদাহ কিছু দিন পরপরই বাংলাদেশে হচ্ছে। মানুষ আগুনে বলকাইয়া ঝলসাইয়া শ্রমিক হয়, নাকি শ্রমিক পুইড়া মানুষ হয় এমন প্রশ্ন এতদিনে বিসিএসে নিশ্চয়ই ঢুকিয়া পড়িতেছে। জ্ঞান হিসেবেও হয়তো এটি সূচিবদ্ধ হইতে থাকবে। কারণ প্রতিনিয়ত যেভাবে পুরান ঢাকা, নতুন ঢাকা, কারখানা গুদামে শ্রমিক পোড়ানো হয়; সেটিতো এখন আমাদের জ্ঞানগত সম্পদ হিসেবেই দেখতে হচ্ছে। কারণ চারপাশে যা কিছু আছে তাই নিয়েইতো আমাদের পরিবেশ, এভাবেই শিখেছি পাঠ্য-অপাঠ্য জ্ঞানে। অমল আকাশের সেই পোড়াহাহিনীই দেখলাম নিজের পোড়াচোখে।

এতে আমার মতো সাধারণ বোকাসোকা চোখ একটু জ্বালাপোড়া হৈলো। কারণ চিত্রকলার সঙ্গে গণবিচিচ্ছন্নতার যে মোটা রেখাটি আমি দেখতে দেখতে ভীত হয়ে উঠেছিলাম, তার থেকে কিছুটা বিরাম পাইলাম। শিল্পীর চিন্তা মানে ‘উঁচুজাতের ফেউ’- এই জায়গা থেকে নিজেকে সরানোর সুযোগ পাইলাম।

পশ্চিমা সবকিছুই বর্জনীয় নয়। মানুষের ভাবনার কোনো পুব-পশ্চিম লাগে না। কথা হচ্ছে, যখন ভাবের ওপর ভাবের গ্রাস অনিবার্য হয়, তখন তাকে পাল্টা হ্যাডম দেখানো লাগে। না হলে ভাববৈচিত্র্য বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের চিত্রকলার একটি বড় জায়গায় এমন প্রবণতা মিছা না। কুয়ার ব্যাঙ আর সমুদ্রের ব্যাঙের মধ্যে হরেক ভেদ থাকতে পারে, বিভেদ নেই। কুয়ার ব্যাঙ আর সমুদ্রের ব্যাঙের মধ্যে অমিল থাকতে পারে, গুনেমানে উভয়ই সমান। তাই কেউ কুয়ায় থাকতে চাইলে তার ওপর সমুদ্র আরোপের খেইলই হচ্ছে আগ্রাসন।

মূলত শীতলক্ষ্যার আত্মকাহিনীই নারায়ণগঞ্জের পূর্বাপর। এই নদী কেবলই সয়েছে সময়ের একের পর এক তামাদি। এর সঙ্গে একটা সম্পর্ক করা যায়নি। নদীটা চিরকালই একা। এর দায় কেউ নেয়নি। এই একাকে দেখা কিন্তু গুরুতর কর্তব্য। যুগে যুগে কেউ না কেউ তো একাকে দেখেন। তার খোঁজ নেন। তেমন একটি চিন্তাভাষ্য ব্যক্ত হইছে শিল্পী বদরুল আলম ইমনের মাথা থেকে। একটি নদীর আত্মকাহিনী তাই হয়ে উঠেছে এটি। যার ভাববৈচিত্র্য অন্তর্গতভাবে আপ্লুত করে।

বস্ত্র বিছানোর মধ্য দিয়ে শিল্পী সুমনা ও নাছির যে, ভাবগর্জন বর্ণনা করেছেন, এটি আমাদের শরীর আর আত্মার মধ্যে একটা সম্পর্ক বানাইয়া দেয়। বিশেষ করে এই নারায়ণগঞ্জ নগরীর উঁচু-নিচু দালানের প্রতিটি ইটের মধ্যে পোশাকশ্রমিক, সুতাশ্রমিক, তাঁতশ্রমিকের বুনন রয়েছে- তার সঙ্গে একটি আত্মীয়তা ঘটেছে শিল্পীদের কাজের আঙ্গিকে। এই আত্মীয়তার সবচেয়ে বড় নমুনা হচ্ছে শিল্পের গণকরণ। অতি সাধারণ, আশ-পাশের বিষয়, অনুষঙ্গ, ভাব, বাঞ্ছা, ভূগোল এখানে সক্রিয় ডানা তুলছে। দুর্বোধ্য ভাবপ্রকারে আক্রান্ত হওয়া মূলছিঁড়া মধ্যবিত্ত শিল্পবচন এখানে উত্তীর্ণ শিল্পভাষ্য হিসেবে হাজির রয়েছে। যা একটি কার্যকর জবাব এবং প্লাবনের পাল্টামুখ হতে পারে।

লক্ষ্যাপাড়ের চিত্রকথা শিরোনামে হাজির করা শিল্পী রঞ্জিত কর্মকার ও খন্দকার নাছির আহাম্মদের ভাস্কর্যসহ পুরো বিন্যাসটি নিয়েই একটি ধারণা মালুম হয়- যা ঔপনিবেশিক বালা-মুসিব্বত থেকে রেহাই দিতে পারে চিন্তা এবং হিয়াকে। এই জনপদের মানুষকে তার দৈনন্দিন নন্দন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তার বিনোদনপরিসর কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এটি নিগূঢ় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কূটচাল থেকেই হয়েছে। ক্ষমতার মতায়ন ঘটানোই এর লক্ষ্য। যে শিল্পী এবং শিল্পীগোষ্ঠী এটি করেছে তাদের শনাক্ত হওয়াও শুরু হয়েছে। দাগ আর্ট স্টেশন আঁখি মেলে আরও কিছু করুক না শিল্পের গণকরণে।