ক্যালিফোর্নিয়ায় বাংলা সাহিত্য সমাবেশ এবং নব জাগরণের সূচনা

মিলটন রহমান

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো ‘চতুর্থ বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সমাবেশ’। লন্ডন থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে যোগ দিয়েছিলাম দুই দিনের আয়োজনে। প্যাসিফিক ওশেনের লেগুনা সৈকতের অদূরে অরেঞ্জ কাউন্ট্রির লেক ফরেস্ট সিভিক সেন্টারে আয়োজিত সমাবেশ ছিলো আমার প্রত্যাশার চেয়ে আরো বেশি বিষয় বৈচিত্র্যে ঠাসা। অনুষ্ঠান দুই দিনের হলেও মূলত আগে-পরের দুইদিনও ছিলো আয়োজনের মাত্রাযোগের উপজীব্য। চলুন চোখ রাখা যাক মূল আয়োজনে। দুই দিনের টানা অনুষ্ঠানের প্রথম দিন ছিলো ৩ সেপ্টেম্বর। কবি আবৃত্তিকার শীলা মোস্তফার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের সূচনা হলো সমাবেশের স্মারক সঙ্কলন ‘হৃদবাংলা’র মোড়ক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে। ৫৭৭ পৃষ্ঠার বাহুল্য বর্জিত সংকলনটির প্রধান সম্পাদক কথাসাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং সম্পাদক আরেক কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক আশফাক স্বপন। সংকলটির গল্প, কবিতা এবং প্রবন্ধ নির্বাচন অত্যন্ত সুচিন্তিত। ছোট করে প্রত্যেক কবি-লেখকের পরিচয় দিয়েই পৃষ্ঠাজুড়ে রচনাক্রমের যাত্রা। ঋদ্ধ এ সংকলের উদ্বোধনের পরেই দুই ঘণ্টাব্যাপি চললো স্বরচিত গল্পপাঠ ও আলোচনা। ভেবেছিলাম এতো দীর্ঘ সময় কে গল্প শুনবে! কিন্তু না ধারণা ভুল হলো। সুজয় দত্তের সঞ্চালনায় টানা আটটি গল্প পাঠ হলো, আলোচনা হলো। দর্শক সরিতে আমরা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করলাম প্রত্যেকটি গল্প। তারপর শাহীন ইসলামের সঞ্চালনায় এক ঘণ্টায় দশটি স্বরচিত কবিতা পাঠ হলো। আলোচনা করলেন কবি শামীম আজাদ। তাতে অন্তর্জালে যোগ দিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। কবিতাও প্রাণসঞ্চারি হয়ে উঠলো অনুষ্ঠানে। এরপর আরো এক ঘণ্টা চললো বই পরিচিতি। রশ্নি ভৌমিকের সঞ্চালনায় নতুন গ্রন্থের পরিচিতিও ছিলো অত্যন্ত মেদহীন। কিছুক্ষণ বিরতি শেষে অমিতাভ রক্ষিতের সঞ্চলনায় টানা দুইঘণ্টা চললো স্বরচিত প্রবন্ধ পাঠ। অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে আমার কেবলই মনে শংকা জাগছিলো কখন জানি অনুষ্ঠান ঝুলে যায়। টানা এমন অনুষ্ঠান আয়োজনের চরম ঝুঁকিই বুঝি আয়োজক সংগঠন উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য পরিষদ নিয়েছে। না, এক একটি পর্ব শেষ হয় আর আমার ভুল ভাঙ্গে। যথারীতি প্রবন্ধ পাঠের অনুষ্ঠানও ছিলো পাঠ ও আলোচনায় তুঙ্গে। তারপর টানা নব্বই মিনিট বসে থাকার পালা। দেখানো হবে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আমিরুল আরহাম নির্মিত তথ্যচিত্র ‘শামসুর রাহমান’। হলভর্তি দর্শক। দেখতে শুরু করলাম। প্রদর্শনী শেষে মনে হলো কবিকে নিয়ে আমিরুল আরহাম আরেকটি মহাকাব্য রচনা করে ফেললেন ফ্রেমের রেখায়। প্রথম দিন শেষে ছিলো সমাবেশের স্থানীয় আয়োজক শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন ‘ক্রান্তি’র পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কবিতা আবৃত্তি, গান, নৃত্যসহ বিভিন্ন পরিবেশনায় ছিলো অত্যন্ত পরিমিতি বোধ এবং বিষয় নির্বাচনে প্রাঞ্জল। প্রথম অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিলো সকাল দশটায় আর শেষ হলো রাত ন’টায়। টানা এগারো ঘণ্টার অনুষ্ঠানে দর্শক উপস্থিত থাকবেন তা নিয়ে আমার শংকা ছিলো শতভাগ। আমি নিশ্চিত ছিলাম আয়োজকরা বড় ধরনের বিপাকে পড়বেন। কিন্তু তা হলো না। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষে বিস্ময়ের সাথে বুঝতে চেষ্টা করলাম, এমন আয়োজনও কি সম্ভব! সাহিত্য সমাবেশের সমন্বয়কারী কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক দীপেন ভট্টাচার্য এবং নিরন্তর কর্মব্যস্ত আশফাক স্বপনের চোখেমুখে এ নিয়ে কোন শংকা বা দ্বিধা দেখলাম না। কথাসাহিত্যি পূরবী বসু আর জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত তো নিরবিচ্ছিন্ন প্রাণ সঞ্চার করেই যাচ্ছেন। শুনেছি লেখকরা নাকি ভালো সংগঠক হতে পারেন না। এ আয়োজন দেখে আমার সে ভুলও ভাঙলো।

প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষে দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান সূচির ওপর চোখ রাখলাম। দ্বিতীয় দিন বিষয় বৈচিত্র্যে আরো ঠাসা। আমি কোনো মতেই দর্শকদের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছিলাম না। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান নিয়ে আমার চিন্তার অন্ত রইলো না। কারণ আজ আমারও প্রবন্ধ পাঠের পালা রয়েছে। দর্শক যদি না থাকে কাকে শুনাবো এতো দীর্ঘ রচনা! দ্বিতীয় দিনের শুরুই হলো স্বরচিত গল্পপাঠের মাধ্যমে। কথাসাহিত্যিক মৌসুমি কাদিরের সঞ্চলনায় একে একে পাঠ হলো পাঁচটি গল্প। গল্পগুলো সুখপাঠ হওয়ায় আলোচনাও হলো সরস। তারপর শুরু হলো ‘বিশ্বে বাংলা, বাংলায় বিশ্ব’ শিরোনামে আলোচনা। কথাসাহিত্যিক ফারহানা আজিম শিউলীর সঞ্চালনায় তাতে আলোচনায় অংশ নিলেন আহমেদ মাযহার, আবদুন নূর, গোলাম মুরশীদ, পূরবী বসু, আমিরুল আরহাম, শবনম নাদিয়া এবং মোহাম্মদ ইরফান। এই পর্বটিতে বাংলা শিল্প-সাহিত্য, সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় সংস্কৃতি সব একাকার হয়ে ধরা দিলো। মুগ্ধ হয়ে আমরা শুনলাম। তারপর কথাসাহিত্যিক দীপেন ভট্টাচার্যর সঞ্চালনায় শুরু হলো ‘বিশ্বজুড়ে রবীন্দ্রনাথ’ বিষয়ক আলোচনা। এতে অংশ নিলেন মুনিরা নকী, শক্তি দাশ এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মূলধারার কবি ও আলোচক নাইজেল হিউজ। এ আলোচনাটি আমার কাছে আরো বেশি আবেদন নিয়ে হাজির হলো। বহির্বিশ্বে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বহু কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে। আমরা ইংল্যান্ডে এমন অনেক কাজের সাথে যুক্ত এবং পরিচিত। মার্কিন মুলুকে তারই দেখা পেলাম নাইজেল হিউজের আলোচনায়।

তারপর আবার টানা স্বরচিত কবিতা পাঠ। শামীম রেজার সঞ্চালনায় পাঠ হলো একে একে দশটি কবিতা। অসামান্য সব কবিতার বিশ্লেষন করলেন কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, শৈবাল তালুকদার এবং মৌ মধুবন্তী। দ্বিতীয় দিনের বিরতির পালা এলো। আমি দর্শদের দিকে তাকিয়ে দেখি। সবাই মুগ্ধ হয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন।

বিরতি শেষে এলো আমাদের পালা। আমরা প্রবন্ধ পাঠ করবো। বিষয়: কবিতার কলকব্জা। কলকব্জার কথা শুনলেই কেমন খটখটে মনে হয়। নিরস এ বিষয়টি শুনতে কেউ বসে থাকবেন সে আশা এবার একেবারে ছেড়ে দেইনি। কারণ উপস্থিতদের ওপর আমার আস্থা অনেক বেড়ে গিয়েছিলো ততক্ষণে। আমাদের পর্ব শুরু হলো। বিরতি শেষে হলে ফিরেছেন মাত্র কয়েকজন। অনুষ্ঠান কিন্তু থেমে নেই। শুরু হয়ে গেলো যথা সময়ে। রাকীব হাসানের সঞ্চালনায় আমি পাঠ করলাম প্রবন্ধ, ‘কবিতার গঠন ও পাঠপরাপাঠের ক্যারিকেচার’। কবিতার ছন্দ বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করলেন কাজী রহমান। এছাড়া কবিতার গঠন ও কাল বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করলেন হায়দার খান এবং মল্লিকা ধর। আমার প্রবন্ধ পাঠ শেষে দেখলাম হলভর্তি দর্শক। অতএব অনুষ্ঠানের শুরুতে যে হতাশা ছিলো তা শেষ পর্যন্ত টেকেনি। আমরা এতোক্ষণ কবিতার কলকব্জা নিয়ে কথা বলছিলাম। দর্শক সারি থেকে কয়েকটি প্রশ্নও এলো, সেসব নিয়ে কথাও হলো। আমাদের পর্ব শেষ হতে না হতেই কথাসাহিত্যিক নাহার মনিকার সঞ্চালনায় শুরু হয়ে গেলো ‘গল্পলেখকের কলকব্জা’ বিষয়ক আলোচনা। মূল প্রবন্ধ পাঠ করলেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। আলোচনায় অংশ নিলেন গল্পকার কুলদা রায়, আনিসুজ জামান এবং সাগুফতা শারমীন তানিয়া। তারপর চলচ্চিত্র পরিচালক আনোয়ার শাহাদাত নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখলাম। অসামান্য নির্মাণ শৈলী দর্শকদের মুগ্ধ করেছে।

এই ছিলো উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত দুই দিন ব্যাপি ‘চতুর্থ বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সমাবেশ’। কেবল আলোচনা নির্ভর হয়ে টানা দুদিনের ম্যারাথন অনুষ্ঠান আয়োজনেও যে সফল হওয়া যায় তা দেখলাম। আয়োজকদের একনিষ্ঠতা, বিষয় নির্বাচনে মনোযোগী হওয়া এবং আয়োজনের বৈচিত্র্য আনয়নে দক্ষতার ছাপ ছিলো শতভাগ। এই আয়োজনটি ভবিষ্যতের জন্য মডেল হতে পারে। আয়োজকরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের সূচনা করেছেন এর মাধ্যমে। আর তা হলো, বহির্বিশ্বে বাংলা সাহিত্যের নবযুগের সুচনা। আমি আশাবাদী, এ আয়োজন অব্যাহত থাকলে তার দেখা আমরা শীঘ্রই পাবো।

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৬ আশ্বিন ১৪২৯ ২৪ সফর ১৪৪৪

ক্যালিফোর্নিয়ায় বাংলা সাহিত্য সমাবেশ এবং নব জাগরণের সূচনা

মিলটন রহমান

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হলো ‘চতুর্থ বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সমাবেশ’। লন্ডন থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় গিয়ে যোগ দিয়েছিলাম দুই দিনের আয়োজনে। প্যাসিফিক ওশেনের লেগুনা সৈকতের অদূরে অরেঞ্জ কাউন্ট্রির লেক ফরেস্ট সিভিক সেন্টারে আয়োজিত সমাবেশ ছিলো আমার প্রত্যাশার চেয়ে আরো বেশি বিষয় বৈচিত্র্যে ঠাসা। অনুষ্ঠান দুই দিনের হলেও মূলত আগে-পরের দুইদিনও ছিলো আয়োজনের মাত্রাযোগের উপজীব্য। চলুন চোখ রাখা যাক মূল আয়োজনে। দুই দিনের টানা অনুষ্ঠানের প্রথম দিন ছিলো ৩ সেপ্টেম্বর। কবি আবৃত্তিকার শীলা মোস্তফার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের সূচনা হলো সমাবেশের স্মারক সঙ্কলন ‘হৃদবাংলা’র মোড়ক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে। ৫৭৭ পৃষ্ঠার বাহুল্য বর্জিত সংকলনটির প্রধান সম্পাদক কথাসাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং সম্পাদক আরেক কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক আশফাক স্বপন। সংকলটির গল্প, কবিতা এবং প্রবন্ধ নির্বাচন অত্যন্ত সুচিন্তিত। ছোট করে প্রত্যেক কবি-লেখকের পরিচয় দিয়েই পৃষ্ঠাজুড়ে রচনাক্রমের যাত্রা। ঋদ্ধ এ সংকলের উদ্বোধনের পরেই দুই ঘণ্টাব্যাপি চললো স্বরচিত গল্পপাঠ ও আলোচনা। ভেবেছিলাম এতো দীর্ঘ সময় কে গল্প শুনবে! কিন্তু না ধারণা ভুল হলো। সুজয় দত্তের সঞ্চালনায় টানা আটটি গল্প পাঠ হলো, আলোচনা হলো। দর্শক সরিতে আমরা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করলাম প্রত্যেকটি গল্প। তারপর শাহীন ইসলামের সঞ্চালনায় এক ঘণ্টায় দশটি স্বরচিত কবিতা পাঠ হলো। আলোচনা করলেন কবি শামীম আজাদ। তাতে অন্তর্জালে যোগ দিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। কবিতাও প্রাণসঞ্চারি হয়ে উঠলো অনুষ্ঠানে। এরপর আরো এক ঘণ্টা চললো বই পরিচিতি। রশ্নি ভৌমিকের সঞ্চালনায় নতুন গ্রন্থের পরিচিতিও ছিলো অত্যন্ত মেদহীন। কিছুক্ষণ বিরতি শেষে অমিতাভ রক্ষিতের সঞ্চলনায় টানা দুইঘণ্টা চললো স্বরচিত প্রবন্ধ পাঠ। অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে আমার কেবলই মনে শংকা জাগছিলো কখন জানি অনুষ্ঠান ঝুলে যায়। টানা এমন অনুষ্ঠান আয়োজনের চরম ঝুঁকিই বুঝি আয়োজক সংগঠন উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য পরিষদ নিয়েছে। না, এক একটি পর্ব শেষ হয় আর আমার ভুল ভাঙ্গে। যথারীতি প্রবন্ধ পাঠের অনুষ্ঠানও ছিলো পাঠ ও আলোচনায় তুঙ্গে। তারপর টানা নব্বই মিনিট বসে থাকার পালা। দেখানো হবে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আমিরুল আরহাম নির্মিত তথ্যচিত্র ‘শামসুর রাহমান’। হলভর্তি দর্শক। দেখতে শুরু করলাম। প্রদর্শনী শেষে মনে হলো কবিকে নিয়ে আমিরুল আরহাম আরেকটি মহাকাব্য রচনা করে ফেললেন ফ্রেমের রেখায়। প্রথম দিন শেষে ছিলো সমাবেশের স্থানীয় আয়োজক শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন ‘ক্রান্তি’র পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কবিতা আবৃত্তি, গান, নৃত্যসহ বিভিন্ন পরিবেশনায় ছিলো অত্যন্ত পরিমিতি বোধ এবং বিষয় নির্বাচনে প্রাঞ্জল। প্রথম অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিলো সকাল দশটায় আর শেষ হলো রাত ন’টায়। টানা এগারো ঘণ্টার অনুষ্ঠানে দর্শক উপস্থিত থাকবেন তা নিয়ে আমার শংকা ছিলো শতভাগ। আমি নিশ্চিত ছিলাম আয়োজকরা বড় ধরনের বিপাকে পড়বেন। কিন্তু তা হলো না। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষে বিস্ময়ের সাথে বুঝতে চেষ্টা করলাম, এমন আয়োজনও কি সম্ভব! সাহিত্য সমাবেশের সমন্বয়কারী কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক দীপেন ভট্টাচার্য এবং নিরন্তর কর্মব্যস্ত আশফাক স্বপনের চোখেমুখে এ নিয়ে কোন শংকা বা দ্বিধা দেখলাম না। কথাসাহিত্যি পূরবী বসু আর জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত তো নিরবিচ্ছিন্ন প্রাণ সঞ্চার করেই যাচ্ছেন। শুনেছি লেখকরা নাকি ভালো সংগঠক হতে পারেন না। এ আয়োজন দেখে আমার সে ভুলও ভাঙলো।

প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষে দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান সূচির ওপর চোখ রাখলাম। দ্বিতীয় দিন বিষয় বৈচিত্র্যে আরো ঠাসা। আমি কোনো মতেই দর্শকদের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছিলাম না। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান নিয়ে আমার চিন্তার অন্ত রইলো না। কারণ আজ আমারও প্রবন্ধ পাঠের পালা রয়েছে। দর্শক যদি না থাকে কাকে শুনাবো এতো দীর্ঘ রচনা! দ্বিতীয় দিনের শুরুই হলো স্বরচিত গল্পপাঠের মাধ্যমে। কথাসাহিত্যিক মৌসুমি কাদিরের সঞ্চলনায় একে একে পাঠ হলো পাঁচটি গল্প। গল্পগুলো সুখপাঠ হওয়ায় আলোচনাও হলো সরস। তারপর শুরু হলো ‘বিশ্বে বাংলা, বাংলায় বিশ্ব’ শিরোনামে আলোচনা। কথাসাহিত্যিক ফারহানা আজিম শিউলীর সঞ্চালনায় তাতে আলোচনায় অংশ নিলেন আহমেদ মাযহার, আবদুন নূর, গোলাম মুরশীদ, পূরবী বসু, আমিরুল আরহাম, শবনম নাদিয়া এবং মোহাম্মদ ইরফান। এই পর্বটিতে বাংলা শিল্প-সাহিত্য, সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় সংস্কৃতি সব একাকার হয়ে ধরা দিলো। মুগ্ধ হয়ে আমরা শুনলাম। তারপর কথাসাহিত্যিক দীপেন ভট্টাচার্যর সঞ্চালনায় শুরু হলো ‘বিশ্বজুড়ে রবীন্দ্রনাথ’ বিষয়ক আলোচনা। এতে অংশ নিলেন মুনিরা নকী, শক্তি দাশ এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মূলধারার কবি ও আলোচক নাইজেল হিউজ। এ আলোচনাটি আমার কাছে আরো বেশি আবেদন নিয়ে হাজির হলো। বহির্বিশ্বে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বহু কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে। আমরা ইংল্যান্ডে এমন অনেক কাজের সাথে যুক্ত এবং পরিচিত। মার্কিন মুলুকে তারই দেখা পেলাম নাইজেল হিউজের আলোচনায়।

তারপর আবার টানা স্বরচিত কবিতা পাঠ। শামীম রেজার সঞ্চালনায় পাঠ হলো একে একে দশটি কবিতা। অসামান্য সব কবিতার বিশ্লেষন করলেন কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, শৈবাল তালুকদার এবং মৌ মধুবন্তী। দ্বিতীয় দিনের বিরতির পালা এলো। আমি দর্শদের দিকে তাকিয়ে দেখি। সবাই মুগ্ধ হয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করছেন।

বিরতি শেষে এলো আমাদের পালা। আমরা প্রবন্ধ পাঠ করবো। বিষয়: কবিতার কলকব্জা। কলকব্জার কথা শুনলেই কেমন খটখটে মনে হয়। নিরস এ বিষয়টি শুনতে কেউ বসে থাকবেন সে আশা এবার একেবারে ছেড়ে দেইনি। কারণ উপস্থিতদের ওপর আমার আস্থা অনেক বেড়ে গিয়েছিলো ততক্ষণে। আমাদের পর্ব শুরু হলো। বিরতি শেষে হলে ফিরেছেন মাত্র কয়েকজন। অনুষ্ঠান কিন্তু থেমে নেই। শুরু হয়ে গেলো যথা সময়ে। রাকীব হাসানের সঞ্চালনায় আমি পাঠ করলাম প্রবন্ধ, ‘কবিতার গঠন ও পাঠপরাপাঠের ক্যারিকেচার’। কবিতার ছন্দ বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করলেন কাজী রহমান। এছাড়া কবিতার গঠন ও কাল বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করলেন হায়দার খান এবং মল্লিকা ধর। আমার প্রবন্ধ পাঠ শেষে দেখলাম হলভর্তি দর্শক। অতএব অনুষ্ঠানের শুরুতে যে হতাশা ছিলো তা শেষ পর্যন্ত টেকেনি। আমরা এতোক্ষণ কবিতার কলকব্জা নিয়ে কথা বলছিলাম। দর্শক সারি থেকে কয়েকটি প্রশ্নও এলো, সেসব নিয়ে কথাও হলো। আমাদের পর্ব শেষ হতে না হতেই কথাসাহিত্যিক নাহার মনিকার সঞ্চালনায় শুরু হয়ে গেলো ‘গল্পলেখকের কলকব্জা’ বিষয়ক আলোচনা। মূল প্রবন্ধ পাঠ করলেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত। আলোচনায় অংশ নিলেন গল্পকার কুলদা রায়, আনিসুজ জামান এবং সাগুফতা শারমীন তানিয়া। তারপর চলচ্চিত্র পরিচালক আনোয়ার শাহাদাত নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখলাম। অসামান্য নির্মাণ শৈলী দর্শকদের মুগ্ধ করেছে।

এই ছিলো উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত দুই দিন ব্যাপি ‘চতুর্থ বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সমাবেশ’। কেবল আলোচনা নির্ভর হয়ে টানা দুদিনের ম্যারাথন অনুষ্ঠান আয়োজনেও যে সফল হওয়া যায় তা দেখলাম। আয়োজকদের একনিষ্ঠতা, বিষয় নির্বাচনে মনোযোগী হওয়া এবং আয়োজনের বৈচিত্র্য আনয়নে দক্ষতার ছাপ ছিলো শতভাগ। এই আয়োজনটি ভবিষ্যতের জন্য মডেল হতে পারে। আয়োজকরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের সূচনা করেছেন এর মাধ্যমে। আর তা হলো, বহির্বিশ্বে বাংলা সাহিত্যের নবযুগের সুচনা। আমি আশাবাদী, এ আয়োজন অব্যাহত থাকলে তার দেখা আমরা শীঘ্রই পাবো।