মৈনাক পাহাড়ের কান্না

সনোজ কুণ্ড

আকাশে দাপিয়ে বেড়ানো মেঘ চাঁদের সীমানায় ধেয়ে আসে। প্রকৃতিতে নেমে আসে অন্ধকার। বাতাসের একটানা আগ্রাসী নিশ্বাসে জোনাকিরাও নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। নিঃসঙ্গ ডাহুকের বিরামহীন আর্তনাদ জানিয়ে দেয় রাতের গভীরতা। বাড়ির দক্ষিণ পাশের বাঁশঝাড়ের তাণ্ডবনৃত্য বুঝিয়ে দেয় ঝড়ের পূর্বাভাস।

প্রকৃতিতে বয়ে চলা ঝড়ের আঁচ না পেলেও নিয়তির ঝড়ে ঈশান লণ্ডভণ্ড। একটা দুঃসহ স্বপ্নের মুখোমুখি হয়ে সে এখন দিকভ্রান্ত। স্বপ্নের ভেতরই তার মস্তিষ্ক ঘুরপাক খায়। খুব চেনা কণ্ঠের কোনো এক নারী তাকে বলেছে- ‘ঈশান তুমি একজন খুনি!’ বুকের ভেতর শুরু হয় অস্থির ধড়ফড়ানি। ঈশান যেন খুনের আসামী হয়ে কাঠগড়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গোল রশিটা পেণ্ডুলামের মতো তার চোখের সামনে দুলছে। সে এক অসহ্য মুহূর্ত। ঈশান কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না।

পাশেই মারিয়া ঘুমে অচেতন। ডিম লাইটের সবুজ আলোটা তার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মারিয়ার ঢেউ খেলানো চুলের ভাঁজে ভাঁজে সবুজ আলোটা দোল খাচ্ছে। কী নিষ্পাপ মুখ! দীঘল চুল। ঠিক যেন তিতাস নদী। থৈ থৈ জল বুকে নিয়েও কতটা শান্ত। মারিয়াকে সে জাগাতে চায় না। সে জেগে উঠলেই কোনো না কোনো লোমহর্ষক ঘটনার জন্ম দেবে। বিছানায় বসেই মারিয়া হাত বাড়িয়ে ফ্যানের রেগুলেটর নিয়ন্ত্রণ করে। কখনো দরজার সিটকানি লাগায়। টেবিলে রাখা পানি এনে খায়। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কাছে আনে। মারিয়ার হাত তখন পাঁচ থেকে দশ ফিট পর্যন্ত লম্বা হয়ে যায়। আঙ্গুলগুলো অনেকটা কঞ্চির মতো দেখায়। ঈশান কতবার ঘুমের ভান করে মারিয়ার অলৌকিক সব কাণ্ড দেখেছে তার হিসেব নেই। ঈশানের শরীর তখন ভয়ে গুটিসুটি হয়ে থাকে। ভয়াল মুহূর্তটি তাকে যেন জ্যান্ত কবর দিয়ে রাখে। মারিয়ার দিকে সে তাকানোর সাহস পায় না। বালিশে মাথা গুঁজে ঘুমের ভান করে থাকে। নিজের স্ত্রীকে মনে হয় যেন ভিন্ন গ্রহের প্রাণি।

সাত-পাঁচ না ভেবে মারিয়াকে সে জাগিয়ে তোলে। ঈশানের অস্থিরতা দেখে মারিয়া এতটুকু বিচলিত হয় না। ঈশান তার স্বপ্নের কথা বলতে বলতে ইশারায় পানি খেতে চায়। মারিয়া টেবিলে রাখা পানিভর্তি হুইস্কির বোতল এনে দেয়। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার- ঈশান উঁচু করে যখন পানির বোতল গলায় ঢালতে থাকে তখন সে পানি রক্ত হয়ে যায়। রক্তের স্বাদ পেয়ে ঈশানের শুরু হয় রক্তবমি।

‘কী হয়েছে তোমার? পানি ফেলে দিলে কেন?’ মারিয়া বলে।

‘হুইস্কির বোতলে পানি ছিল না, এটাত রক্ত।’ ঈশান উদ্বিগ্ন হয়ে বলে।

মারিয়া খলবলিয়ে হাসে। ঠিক যেন জলপতনের শব্দ। ঐ হাসি যেন ঘরের ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে বাতাসের শরীরে একাকার হয়। সে হাসি মিলিয়ে যাবার আগে আরও একবার ঈশানের বুকে ধ্বনিত হয়। মারিয়ার হাসিতে রহস্যের ছটা। ঈশানের অসহ্য লাগে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারে না। তবে ঈশান যখন মারিয়ার চোখে একান্তভাবে চোখ রাখে তখন সে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। মারিয়া যেন যুগযুগ ধরে আত্মার গভীরে বাস করা নিজস্ব কেউ।

‘আমাকে আজও চিনতে পারলে না ঈশান?’ মারিয়ার কৌতূহলি প্রশ্ন।

‘তুমি মারিয়া। আমার স্ত্রী। না চেনার কী আছে!’ ঈশানের কণ্ঠে আড়ষ্ঠতা।

‘তুমি আমাকে খুন করলে কেন ঈশান? আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি?’

মারিয়ার চোখ ভিজে ওঠে। কিঞ্চিত হাসি ঈশানের ঠোঁটে। ভাবে, জলজ্যান্ত একটা মানুষ সামনে বসে আছে, আর তাকে নাকি খুন করেছি আমি। মাথার গোলমাল ছাড়া আর কিছুই নয়। ঈশানের নীরবতা ভাঙে মারিয়া।

‘আচ্ছা ঈশান, তোমার কি মনে পড়ে মহেশখালির উঁচু মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় আমরা শিবমূর্তি দেখতে গিয়েছিলাম। গোধূলি বেলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তুমি আমাকে হাত টেনে থামিয়ে বলেছিলে, ‘দাঁড়াও মারিয়া, তুমি কি কোনো কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ?’ তোমার কথা শুনে আমিও তীব্র বাতাসে কান পেতে সত্যিই একটা কান্নার শব্দ শুনতে পাই। তুমি বলেছিলে, এটা মৈনাক পাহাড়ের কান্না হতে পারে। পাহারেরও তো দুঃখ থাকতে পারে, কী বলো! সেই মুহূর্তেই তুমি আমাকে ধাক্কা মেরেছিলে! আমি তোমাকে জাঁপটে ধরে সে যাত্রায় প্রাণে রক্ষা পাই। উল্টো তুমি নিজেই হুড়মুড় করে সিঁড়ির পাশে পড়ে তীব্র ব্যথায় কঁকিকে উঠেছিলে। চেয়ে দেখ সেই ক্ষতচিহ্নটা এখনো আছে। এমন কতবার তুমি আমাকে মারতে চেয়েছিলে। কিন্তু পারনি!’

মারিয়া হাসতে হাসতে এক পর্যায়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

‘তুমি আসলে কে মারিয়া?’ ঈশান বলে।

‘আমি মারিয়া! তোমার স্ত্রী! তুমি কী করে চিনবে বলো, তুমি তো নিজের ভেতর নেই। নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছ। তুমি তো ঈশান নও। তুমি রিশাদ। রিশাদ ইসলাম।’

মারিয়ার গলায় দৃঢ়তা। ঈশান হো হো করে শব্দ করে হাসে।

‘তুমি আর দুর্গাপুর যাবে না ঈশান?’

‘দুর্গাপুর!’

‘হ্যাঁ, ভারতের বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর। তোমার ঠিকানা। যেখানে কেটেছে তোমার শৈশব-কৈশোর। সেখানে তোমার মা-বাবা এবং একমাত্র ছোটবোন রুবিয়া থাকে। তোমার বাবা কয়লার খনিতে কাজ করে। নিজের একটি ট্রাকও আছে। দিনের কাজ শেষে রাতে ট্রাক ভরে কয়লা পৌঁছে দেয় রানীগঞ্জ, অন্ডাল, আসানসোল। তোমার মা বাড়িতে দর্জির কাজ করে। তোমার কি মনে আছে ঈশান, তুমি শৈশবে একবার বাবার সাথে কয়লার খনিতে ঘুরতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলে? সেদিন ছিল প্রচণ্ড বর্ষা। হঠাৎ করে কয়লার খনিতে পানি জমে যায়। তুমি একটি উঁচু জায়গায় উঠে বসেছিলে। একদিন পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তোমাকে উদ্ধার করে।

ছোট বোন রুবিয়ার কথা মনে পড়ে তোমার? কী ফুটফুটে মেয়েটি। সারাক্ষণ বাড়িটা হৈ-হুল্লা করে মাতিয়ে রাখত। লাল জামা পরে থাকতে পছন্দ করত। মুখে থাকত লাঠি লজেন্স। একদিন লজেন্স চুষতে চুষতে তোমার মুখে ঠেলে দেয়। তুমি তার কচি গালে কী চড়টাই না মেরেছিলে! অভিমানী বোনটি তার চুল থেকে লাল ফিতা খুলে তোমার দুহাত বেঁধে থানায় নিয়ে যাবার হুমকি দিয়েছিল।’

মারিয়া বিরামহীন কথাগুলো বলতে থাকে। আরও কত পুরানো স্মৃতি! যা ঈশানের জীবনকেন্দ্রিক। ঈশান আরও শব্দ করে হাসে-

‘শার্লক হোমস্-এর বই পড়তে পড়তে তোমার মাথাটা একদম গেছে মারিয়া।’

‘ভুল বললে, শার্লক হোমস-এর কোনো বই আমার ঘরে নেই ঈশান।’

খর¯্রােতা নদীতে হালবিহিন নৌকা যেমন দিকভ্রান্ত হয়ে ভেসে বেড়ায়, ঈশানের মনের অবস্থা কিছুটা তেমন। রাগী গলায় বলে-

‘তোমাকে বিয়ে করাটাই আমার ভুল ছিল। কপালটাই মন্দ আমার। জগতে এত মেয়ে থাকতে তোমার ঠিকানা কেন খুঁজে পেলাম।’

‘জগতের যে নারীকেই তুমি বিয়ে করো না কেন, তোমার ঘরে মারিয়াই আসত। এটা যে বিধির বিধান। আমাকে যে তোমার জীবনে আসতেই হতো ঈশান।’ মারিয়া কথাগুলো বলে দৃঢ় চিত্তে।

ইদানীং ঈশানের মনে হচ্ছে সে নিজের ভেতর মরে আছে। আর এ জন্য দায়ী মারিয়া। জীবনটা সে অসহ্য করে তুলেছে। পাঁচ বছর সংসার করেও মারিয়াকে সে আবিষ্কার করতে পারল না। ঈশান মাঝে মাঝে ভাবে মারিয়ার একটা সন্তান হলে জীবনে পরিবর্তন আসতে পারে, কিন্তু সেখানেও বাধা। সন্তান নিতে চাইলে মারিয়া বলে তার পেটে নাকি ঈশানের সন্তান আসবে না। এসব চিন্তার কী অর্থ থাকতে পারে ঈশান ভেবে পায় না।

সাইমনের কথা খুব মনে পড়ে ঈশানের। তার সাথে ঈশান ব্যবসা করত। খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ব্যবসা বলতে স্বর্ণপাচারকারী চক্রের হয়ে কাজ করত। সাইমন মাঝে মাঝেই বলত, তুই বাঁচতে চাইলে মারিয়াকে খুন করে দে। ও মানুষ নয়, অন্য কারো আত্মা অথবা অন্য কিছু।

আজকাল ঘুমুতে গেলেই ঈশানের বুক ধুঁক ধুঁক করে। একটা অজানা ভয় তাকে ঘিরে ধরে। ঈশান রাতে কিছুটা ভয় আর দ্বিধা জড়ানো গলায় মারিয়াকে বলে, ‘আজ আমি জানতে চাই কে তুমি? কী চাও আমার কাছে?’

মারিয়ার অট্টহাসি ঘরের ভেতর বাজে।

‘আমি তোমার মারিয়া। যাকে এক অমাবস্যা রাতে মাথায় হুইস্কির বোতল দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছ। আমার রক্তাক্ত শরীর টেনেহিঁচড়ে ঐ বকুল গাছের তলায় পুঁতে রেখেছ।’

ঈশান বাকরুদ্ধ। এক দৃষ্টিতে ঐ হুইস্কির বোতলের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুহূর্তেই হুইস্কির বোতলের পানি আবার রক্ত হয়ে যায়।

‘এসব আজগুবি কথা শুনতে আমার একদম ভাল লাগে না মারিয়া। তুমি তো আমার সামনেই আছ। আমি তোমাকে খুন করলাম কোথায়?’ ঈশান বলে।

বিবেকের সাথে আর কোনো আপোষ নয়। ঈশান চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতেই সে মারিয়াকে খুন করবে। অফিসে বসে সে খুনের পরিকল্পনা করে। কাজে একদম মন নেই। সাদা পৃষ্ঠায় অহেতুক দাগাদাগি কাটে। টেবিলে রাখা অফিসের কাগজপত্র পেপার ওয়েটের শাসনে চাপা পড়ে আছে। সিগারেটের শেষ অংশগুলো ছাইভর্তি এ্যাস্ট্রেটে জড়াজড়ি করে ডাস্টবিনে যাবার অপেক্ষা করছে। কিন্তু মারিয়াকে কোথায় এবং কীভাবে খুন করা যায় সেই প্লানটা একদম মাথায় আসে না ঈশানের। তবে শেষপর্যন্ত খুনের পরিকল্পনা সহজ করে দেয় মারিয়া নিজেই।

আজ সেই ভয়ঙ্কর অমাবস্যা রাত। চারদিকে পাথরকালো অন্ধকার। ঈশানের অস্থিরতা দেখে মারিয়ার সন্দেহ হয়। সে ঘুমের ভান করে চোখ বন্ধ করে থাকে। ঈশান বিছানা থেকে উঠে হুইস্কির বোতলটা হাতে নেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে মারিয়া উঠে বসে। কিছু বুঝতে না দিয়ে বলে-

‘তুমি কি পানি খাবে ঈশান?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে মারিয়া নিজেই পানিভর্তি হুইস্কির বোতলটা এগিয়ে দেয়। বোতলটি উঁচু করে ঈশান পানি খেতে থাকে। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ঈশান অন্যমনস্কভাবে আজও একঢোক রক্ত পান করে।

‘চলো না ঈশান, একটু বকুলতলায় যাই। খুব ইচ্ছে করছে।’ মারিয়া কোমল সুরে বলে।

কথাটা শুনে ঈশান মনে মনে খুশিই হয়। ভাবে, মারিয়া নিজেই নিজের খুন হওয়ার পথে নিয়ে গেল। মানুষের ভেতরটা যখন জানোয়ার বাস করে তখন তার চেহারাতেও সেই রূপটা ভেসে ওঠে। ঈশানের মুখটা বিকৃত হয়ে আছে। চোখে-মুখে হিং¯্রতা। ভেতরে ভেতরে সে মারিয়াকে খুন করার নেশায় উন্মাদ হয়ে ওঠে। মারিয়া বকুল গাছের একটি ছিটকে ডাল টেনে গান ধরে-

‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেবো না ভুলিতে!’

মারিয়ার মনে আজ নতুন আনন্দের উদয় হয়। আজকের রাতটি যেন তার জীবন থেকে মুক্তির রাত। মারিয়া গভীর আবেগে ঈশানের লোমশ বুকে আলগা করে মাথা রাখে। অস্থিরভাবে ঈশানকে আদর করে। যৌন উত্তেজনায় মারিয়া মাতালের মতো দুলছে। আরেক দফা ঈশানকে বকুল গাছে ঠেস দিয়ে পাগলের মতো আদর করে। আদরে আদরে ঈশানের যৌবন জাগাতে চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। শেষপর্যন্ত বকুলগাছটাকে বুকে জড়িয়ে অশান্ত কান্নায় ভেঙে পড়ে।

ঈশান সুযোগ বুঝে হুইস্কির বোতল দিয়ে মারিয়ার মাথায় প্রচণ্ড শক্তি খাটিয়ে আঘাত করে। একাধিকবার। মারিয়া একবারই আর্তনাদ করার সুযোগ পেয়েছিল- উঃ! তার নিস্তেজ দেহটা ধপাস করে বকুল গাছের তলে পড়ে থাকে। ঈশান টর্চ মেরে দেখে মারিয়ার মাথা ফেটে থ্যাঁতলা হয়ে আছে। রক্তমাখা লাশটা বকুল তলায় পুঁতে রাখতে ঈশান ঘরে কোদাল আনতে যায়। ঘরে ঢুকে সে চিৎকার করে জ্ঞান হারাবার অবস্থা। মাথা চক্কর দেয়। তার দেহটা যেন অবশ হয়ে আসে। চোখের সামনে যা দেখল তাতে সে নিজেই যেন নিজের ভেতর মরে গেল। মারিয়া বিছানায় শুয়ে আছে। তার মাথা থেকে রক্তের ফোয়ারা তির তির করে বিছানায় গড়িয়ে পড়ছে। এতো স্বপ্ন নয়, বাস্তব। এ কী করে সম্ভব! ঈশান মারিয়ার কাছে গিয়ে বসে। মারিয়ার শরীর থেকে লাল রক্তের আঁচ টের পায়। সমস্ত শরীর ঘর্মাক্ত। শরীর থেকে মরা মানুষের গন্ধ ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ মারিয়া জলজ্যান্ত একটা মানুষ ঈশানের পাশেই শুয়ে আছে। তবে আসলেই সে জীবিত না মৃত এমন প্রশ্ন বহুবার মারিয়াকে করে কোনো উত্তর পায়নি।

‘দ্বিতীয় জন্মেও তুমি আমাকে বাঁচতে দিলে না ঈশান। আর নয়! আমি আজ এই দেহ ছেড়ে সত্যিই চলে যাচ্ছি। তোমার সাথে আর আমার থাকা হবে না।’

মারিয়া কথাগুলো বলল চাপা কান্নার স্বরে। তার কণ্ঠ থেকে আর কোনো কথা বের হলো না। ঈশান ভেবেই নিয়েছে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালেই মারিয়ার কাছে সে ক্ষমা চাইবে। সকল ভুল আর অবহেলা করার ক্ষমা।

শেষ রাতে ঈশানের চোখ ভেঙে ঘুম আসে। বড় শান্তির ঘুম। এমন নিশ্চিন্তে সে কবে ঘুমিয়েছিল মনে করতে পারে না। অবাক বিষয় হলো- আজ সে কোনো স্বপ্ন দেখেনি। বহুদিন পর এমনটা হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে পাশে মারিয়া নেই। নেই মানে সারা বাড়িতেও নেই। বিছানাতে এক চুলও রক্তের দাগ নেই। এমনকি তার ব্যবহৃত কোনো জিনিসপত্র ঘরে নেই। মারিয়াকে বিভিন্ন জাগায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সন্ধান পাওয়া গেল না। দীর্ঘ এক বছরেও না।

কোনো এক অমবস্যা রাতে ঈশানও খুন হলো। নিজের ঘরেই। রক্তাক্ত নিথর দেহটা পড়ে থাকল ঘরের মাঝখানে। মৃত হয়েও ঈশানের আত্মার কণ্ঠস্বর ঘরে ভেসে বেড়ায়। ঈশান নিজেই বলতে থাকে- ‘আমি জানতে চাই কে আমার খুনি! কে? যতক্ষণ আমার খুনিকে একঝলক দেখতে না পাব, ততক্ষণ আমার মৃত চোখের পাতা স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে না। আমার চোখের পাতা বন্ধ করার শক্তি কারো নেই এজন্য যে, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী আমার মৃত্যু হয়নি। আমি খুন হয়েছি। খুন হওয়া মানুষের আত্মা সহজে দেহ ছেড়ে চলে যায় না। তার নিজস্ব একটা শক্তি থাকে। সে শক্তি আমার আছে।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই এজন্য যে, তিনি আমার শেষ ইচ্ছে পূরণ করেছেন! আমি আমার খুনিকে দেখতে পেয়েছি।’

ঈশান যে মুহূর্তে তার প্রিয় খুনিকে দেখতে পায় ঠিক সেই মুহূর্তেই ঈশানের চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়। অদ্ভুত বিষয় হলো খুনিটা মুখোশ পরা সত্ত্বেও ঈশান তাকে চিনতে ভুল করেনি। কারণ ঐ নরঘাতক ঈশানের খুনিটা যে ঈশান নিজেই।

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৬ আশ্বিন ১৪২৯ ২৪ সফর ১৪৪৪

মৈনাক পাহাড়ের কান্না

সনোজ কুণ্ড

image

আকাশে দাপিয়ে বেড়ানো মেঘ চাঁদের সীমানায় ধেয়ে আসে। প্রকৃতিতে নেমে আসে অন্ধকার। বাতাসের একটানা আগ্রাসী নিশ্বাসে জোনাকিরাও নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। নিঃসঙ্গ ডাহুকের বিরামহীন আর্তনাদ জানিয়ে দেয় রাতের গভীরতা। বাড়ির দক্ষিণ পাশের বাঁশঝাড়ের তাণ্ডবনৃত্য বুঝিয়ে দেয় ঝড়ের পূর্বাভাস।

প্রকৃতিতে বয়ে চলা ঝড়ের আঁচ না পেলেও নিয়তির ঝড়ে ঈশান লণ্ডভণ্ড। একটা দুঃসহ স্বপ্নের মুখোমুখি হয়ে সে এখন দিকভ্রান্ত। স্বপ্নের ভেতরই তার মস্তিষ্ক ঘুরপাক খায়। খুব চেনা কণ্ঠের কোনো এক নারী তাকে বলেছে- ‘ঈশান তুমি একজন খুনি!’ বুকের ভেতর শুরু হয় অস্থির ধড়ফড়ানি। ঈশান যেন খুনের আসামী হয়ে কাঠগড়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গোল রশিটা পেণ্ডুলামের মতো তার চোখের সামনে দুলছে। সে এক অসহ্য মুহূর্ত। ঈশান কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না।

পাশেই মারিয়া ঘুমে অচেতন। ডিম লাইটের সবুজ আলোটা তার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মারিয়ার ঢেউ খেলানো চুলের ভাঁজে ভাঁজে সবুজ আলোটা দোল খাচ্ছে। কী নিষ্পাপ মুখ! দীঘল চুল। ঠিক যেন তিতাস নদী। থৈ থৈ জল বুকে নিয়েও কতটা শান্ত। মারিয়াকে সে জাগাতে চায় না। সে জেগে উঠলেই কোনো না কোনো লোমহর্ষক ঘটনার জন্ম দেবে। বিছানায় বসেই মারিয়া হাত বাড়িয়ে ফ্যানের রেগুলেটর নিয়ন্ত্রণ করে। কখনো দরজার সিটকানি লাগায়। টেবিলে রাখা পানি এনে খায়। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কাছে আনে। মারিয়ার হাত তখন পাঁচ থেকে দশ ফিট পর্যন্ত লম্বা হয়ে যায়। আঙ্গুলগুলো অনেকটা কঞ্চির মতো দেখায়। ঈশান কতবার ঘুমের ভান করে মারিয়ার অলৌকিক সব কাণ্ড দেখেছে তার হিসেব নেই। ঈশানের শরীর তখন ভয়ে গুটিসুটি হয়ে থাকে। ভয়াল মুহূর্তটি তাকে যেন জ্যান্ত কবর দিয়ে রাখে। মারিয়ার দিকে সে তাকানোর সাহস পায় না। বালিশে মাথা গুঁজে ঘুমের ভান করে থাকে। নিজের স্ত্রীকে মনে হয় যেন ভিন্ন গ্রহের প্রাণি।

সাত-পাঁচ না ভেবে মারিয়াকে সে জাগিয়ে তোলে। ঈশানের অস্থিরতা দেখে মারিয়া এতটুকু বিচলিত হয় না। ঈশান তার স্বপ্নের কথা বলতে বলতে ইশারায় পানি খেতে চায়। মারিয়া টেবিলে রাখা পানিভর্তি হুইস্কির বোতল এনে দেয়। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার- ঈশান উঁচু করে যখন পানির বোতল গলায় ঢালতে থাকে তখন সে পানি রক্ত হয়ে যায়। রক্তের স্বাদ পেয়ে ঈশানের শুরু হয় রক্তবমি।

‘কী হয়েছে তোমার? পানি ফেলে দিলে কেন?’ মারিয়া বলে।

‘হুইস্কির বোতলে পানি ছিল না, এটাত রক্ত।’ ঈশান উদ্বিগ্ন হয়ে বলে।

মারিয়া খলবলিয়ে হাসে। ঠিক যেন জলপতনের শব্দ। ঐ হাসি যেন ঘরের ভেন্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে বাতাসের শরীরে একাকার হয়। সে হাসি মিলিয়ে যাবার আগে আরও একবার ঈশানের বুকে ধ্বনিত হয়। মারিয়ার হাসিতে রহস্যের ছটা। ঈশানের অসহ্য লাগে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারে না। তবে ঈশান যখন মারিয়ার চোখে একান্তভাবে চোখ রাখে তখন সে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। মারিয়া যেন যুগযুগ ধরে আত্মার গভীরে বাস করা নিজস্ব কেউ।

‘আমাকে আজও চিনতে পারলে না ঈশান?’ মারিয়ার কৌতূহলি প্রশ্ন।

‘তুমি মারিয়া। আমার স্ত্রী। না চেনার কী আছে!’ ঈশানের কণ্ঠে আড়ষ্ঠতা।

‘তুমি আমাকে খুন করলে কেন ঈশান? আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি?’

মারিয়ার চোখ ভিজে ওঠে। কিঞ্চিত হাসি ঈশানের ঠোঁটে। ভাবে, জলজ্যান্ত একটা মানুষ সামনে বসে আছে, আর তাকে নাকি খুন করেছি আমি। মাথার গোলমাল ছাড়া আর কিছুই নয়। ঈশানের নীরবতা ভাঙে মারিয়া।

‘আচ্ছা ঈশান, তোমার কি মনে পড়ে মহেশখালির উঁচু মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় আমরা শিবমূর্তি দেখতে গিয়েছিলাম। গোধূলি বেলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তুমি আমাকে হাত টেনে থামিয়ে বলেছিলে, ‘দাঁড়াও মারিয়া, তুমি কি কোনো কান্নার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ?’ তোমার কথা শুনে আমিও তীব্র বাতাসে কান পেতে সত্যিই একটা কান্নার শব্দ শুনতে পাই। তুমি বলেছিলে, এটা মৈনাক পাহাড়ের কান্না হতে পারে। পাহারেরও তো দুঃখ থাকতে পারে, কী বলো! সেই মুহূর্তেই তুমি আমাকে ধাক্কা মেরেছিলে! আমি তোমাকে জাঁপটে ধরে সে যাত্রায় প্রাণে রক্ষা পাই। উল্টো তুমি নিজেই হুড়মুড় করে সিঁড়ির পাশে পড়ে তীব্র ব্যথায় কঁকিকে উঠেছিলে। চেয়ে দেখ সেই ক্ষতচিহ্নটা এখনো আছে। এমন কতবার তুমি আমাকে মারতে চেয়েছিলে। কিন্তু পারনি!’

মারিয়া হাসতে হাসতে এক পর্যায়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

‘তুমি আসলে কে মারিয়া?’ ঈশান বলে।

‘আমি মারিয়া! তোমার স্ত্রী! তুমি কী করে চিনবে বলো, তুমি তো নিজের ভেতর নেই। নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছ। তুমি তো ঈশান নও। তুমি রিশাদ। রিশাদ ইসলাম।’

মারিয়ার গলায় দৃঢ়তা। ঈশান হো হো করে শব্দ করে হাসে।

‘তুমি আর দুর্গাপুর যাবে না ঈশান?’

‘দুর্গাপুর!’

‘হ্যাঁ, ভারতের বর্ধমান জেলার দুর্গাপুর। তোমার ঠিকানা। যেখানে কেটেছে তোমার শৈশব-কৈশোর। সেখানে তোমার মা-বাবা এবং একমাত্র ছোটবোন রুবিয়া থাকে। তোমার বাবা কয়লার খনিতে কাজ করে। নিজের একটি ট্রাকও আছে। দিনের কাজ শেষে রাতে ট্রাক ভরে কয়লা পৌঁছে দেয় রানীগঞ্জ, অন্ডাল, আসানসোল। তোমার মা বাড়িতে দর্জির কাজ করে। তোমার কি মনে আছে ঈশান, তুমি শৈশবে একবার বাবার সাথে কয়লার খনিতে ঘুরতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলে? সেদিন ছিল প্রচণ্ড বর্ষা। হঠাৎ করে কয়লার খনিতে পানি জমে যায়। তুমি একটি উঁচু জায়গায় উঠে বসেছিলে। একদিন পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তোমাকে উদ্ধার করে।

ছোট বোন রুবিয়ার কথা মনে পড়ে তোমার? কী ফুটফুটে মেয়েটি। সারাক্ষণ বাড়িটা হৈ-হুল্লা করে মাতিয়ে রাখত। লাল জামা পরে থাকতে পছন্দ করত। মুখে থাকত লাঠি লজেন্স। একদিন লজেন্স চুষতে চুষতে তোমার মুখে ঠেলে দেয়। তুমি তার কচি গালে কী চড়টাই না মেরেছিলে! অভিমানী বোনটি তার চুল থেকে লাল ফিতা খুলে তোমার দুহাত বেঁধে থানায় নিয়ে যাবার হুমকি দিয়েছিল।’

মারিয়া বিরামহীন কথাগুলো বলতে থাকে। আরও কত পুরানো স্মৃতি! যা ঈশানের জীবনকেন্দ্রিক। ঈশান আরও শব্দ করে হাসে-

‘শার্লক হোমস্-এর বই পড়তে পড়তে তোমার মাথাটা একদম গেছে মারিয়া।’

‘ভুল বললে, শার্লক হোমস-এর কোনো বই আমার ঘরে নেই ঈশান।’

খর¯্রােতা নদীতে হালবিহিন নৌকা যেমন দিকভ্রান্ত হয়ে ভেসে বেড়ায়, ঈশানের মনের অবস্থা কিছুটা তেমন। রাগী গলায় বলে-

‘তোমাকে বিয়ে করাটাই আমার ভুল ছিল। কপালটাই মন্দ আমার। জগতে এত মেয়ে থাকতে তোমার ঠিকানা কেন খুঁজে পেলাম।’

‘জগতের যে নারীকেই তুমি বিয়ে করো না কেন, তোমার ঘরে মারিয়াই আসত। এটা যে বিধির বিধান। আমাকে যে তোমার জীবনে আসতেই হতো ঈশান।’ মারিয়া কথাগুলো বলে দৃঢ় চিত্তে।

ইদানীং ঈশানের মনে হচ্ছে সে নিজের ভেতর মরে আছে। আর এ জন্য দায়ী মারিয়া। জীবনটা সে অসহ্য করে তুলেছে। পাঁচ বছর সংসার করেও মারিয়াকে সে আবিষ্কার করতে পারল না। ঈশান মাঝে মাঝে ভাবে মারিয়ার একটা সন্তান হলে জীবনে পরিবর্তন আসতে পারে, কিন্তু সেখানেও বাধা। সন্তান নিতে চাইলে মারিয়া বলে তার পেটে নাকি ঈশানের সন্তান আসবে না। এসব চিন্তার কী অর্থ থাকতে পারে ঈশান ভেবে পায় না।

সাইমনের কথা খুব মনে পড়ে ঈশানের। তার সাথে ঈশান ব্যবসা করত। খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ব্যবসা বলতে স্বর্ণপাচারকারী চক্রের হয়ে কাজ করত। সাইমন মাঝে মাঝেই বলত, তুই বাঁচতে চাইলে মারিয়াকে খুন করে দে। ও মানুষ নয়, অন্য কারো আত্মা অথবা অন্য কিছু।

আজকাল ঘুমুতে গেলেই ঈশানের বুক ধুঁক ধুঁক করে। একটা অজানা ভয় তাকে ঘিরে ধরে। ঈশান রাতে কিছুটা ভয় আর দ্বিধা জড়ানো গলায় মারিয়াকে বলে, ‘আজ আমি জানতে চাই কে তুমি? কী চাও আমার কাছে?’

মারিয়ার অট্টহাসি ঘরের ভেতর বাজে।

‘আমি তোমার মারিয়া। যাকে এক অমাবস্যা রাতে মাথায় হুইস্কির বোতল দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছ। আমার রক্তাক্ত শরীর টেনেহিঁচড়ে ঐ বকুল গাছের তলায় পুঁতে রেখেছ।’

ঈশান বাকরুদ্ধ। এক দৃষ্টিতে ঐ হুইস্কির বোতলের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুহূর্তেই হুইস্কির বোতলের পানি আবার রক্ত হয়ে যায়।

‘এসব আজগুবি কথা শুনতে আমার একদম ভাল লাগে না মারিয়া। তুমি তো আমার সামনেই আছ। আমি তোমাকে খুন করলাম কোথায়?’ ঈশান বলে।

বিবেকের সাথে আর কোনো আপোষ নয়। ঈশান চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতেই সে মারিয়াকে খুন করবে। অফিসে বসে সে খুনের পরিকল্পনা করে। কাজে একদম মন নেই। সাদা পৃষ্ঠায় অহেতুক দাগাদাগি কাটে। টেবিলে রাখা অফিসের কাগজপত্র পেপার ওয়েটের শাসনে চাপা পড়ে আছে। সিগারেটের শেষ অংশগুলো ছাইভর্তি এ্যাস্ট্রেটে জড়াজড়ি করে ডাস্টবিনে যাবার অপেক্ষা করছে। কিন্তু মারিয়াকে কোথায় এবং কীভাবে খুন করা যায় সেই প্লানটা একদম মাথায় আসে না ঈশানের। তবে শেষপর্যন্ত খুনের পরিকল্পনা সহজ করে দেয় মারিয়া নিজেই।

আজ সেই ভয়ঙ্কর অমাবস্যা রাত। চারদিকে পাথরকালো অন্ধকার। ঈশানের অস্থিরতা দেখে মারিয়ার সন্দেহ হয়। সে ঘুমের ভান করে চোখ বন্ধ করে থাকে। ঈশান বিছানা থেকে উঠে হুইস্কির বোতলটা হাতে নেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে মারিয়া উঠে বসে। কিছু বুঝতে না দিয়ে বলে-

‘তুমি কি পানি খাবে ঈশান?’ উত্তরের অপেক্ষা না করে মারিয়া নিজেই পানিভর্তি হুইস্কির বোতলটা এগিয়ে দেয়। বোতলটি উঁচু করে ঈশান পানি খেতে থাকে। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ঈশান অন্যমনস্কভাবে আজও একঢোক রক্ত পান করে।

‘চলো না ঈশান, একটু বকুলতলায় যাই। খুব ইচ্ছে করছে।’ মারিয়া কোমল সুরে বলে।

কথাটা শুনে ঈশান মনে মনে খুশিই হয়। ভাবে, মারিয়া নিজেই নিজের খুন হওয়ার পথে নিয়ে গেল। মানুষের ভেতরটা যখন জানোয়ার বাস করে তখন তার চেহারাতেও সেই রূপটা ভেসে ওঠে। ঈশানের মুখটা বিকৃত হয়ে আছে। চোখে-মুখে হিং¯্রতা। ভেতরে ভেতরে সে মারিয়াকে খুন করার নেশায় উন্মাদ হয়ে ওঠে। মারিয়া বকুল গাছের একটি ছিটকে ডাল টেনে গান ধরে-

‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেবো না ভুলিতে!’

মারিয়ার মনে আজ নতুন আনন্দের উদয় হয়। আজকের রাতটি যেন তার জীবন থেকে মুক্তির রাত। মারিয়া গভীর আবেগে ঈশানের লোমশ বুকে আলগা করে মাথা রাখে। অস্থিরভাবে ঈশানকে আদর করে। যৌন উত্তেজনায় মারিয়া মাতালের মতো দুলছে। আরেক দফা ঈশানকে বকুল গাছে ঠেস দিয়ে পাগলের মতো আদর করে। আদরে আদরে ঈশানের যৌবন জাগাতে চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। শেষপর্যন্ত বকুলগাছটাকে বুকে জড়িয়ে অশান্ত কান্নায় ভেঙে পড়ে।

ঈশান সুযোগ বুঝে হুইস্কির বোতল দিয়ে মারিয়ার মাথায় প্রচণ্ড শক্তি খাটিয়ে আঘাত করে। একাধিকবার। মারিয়া একবারই আর্তনাদ করার সুযোগ পেয়েছিল- উঃ! তার নিস্তেজ দেহটা ধপাস করে বকুল গাছের তলে পড়ে থাকে। ঈশান টর্চ মেরে দেখে মারিয়ার মাথা ফেটে থ্যাঁতলা হয়ে আছে। রক্তমাখা লাশটা বকুল তলায় পুঁতে রাখতে ঈশান ঘরে কোদাল আনতে যায়। ঘরে ঢুকে সে চিৎকার করে জ্ঞান হারাবার অবস্থা। মাথা চক্কর দেয়। তার দেহটা যেন অবশ হয়ে আসে। চোখের সামনে যা দেখল তাতে সে নিজেই যেন নিজের ভেতর মরে গেল। মারিয়া বিছানায় শুয়ে আছে। তার মাথা থেকে রক্তের ফোয়ারা তির তির করে বিছানায় গড়িয়ে পড়ছে। এতো স্বপ্ন নয়, বাস্তব। এ কী করে সম্ভব! ঈশান মারিয়ার কাছে গিয়ে বসে। মারিয়ার শরীর থেকে লাল রক্তের আঁচ টের পায়। সমস্ত শরীর ঘর্মাক্ত। শরীর থেকে মরা মানুষের গন্ধ ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ মারিয়া জলজ্যান্ত একটা মানুষ ঈশানের পাশেই শুয়ে আছে। তবে আসলেই সে জীবিত না মৃত এমন প্রশ্ন বহুবার মারিয়াকে করে কোনো উত্তর পায়নি।

‘দ্বিতীয় জন্মেও তুমি আমাকে বাঁচতে দিলে না ঈশান। আর নয়! আমি আজ এই দেহ ছেড়ে সত্যিই চলে যাচ্ছি। তোমার সাথে আর আমার থাকা হবে না।’

মারিয়া কথাগুলো বলল চাপা কান্নার স্বরে। তার কণ্ঠ থেকে আর কোনো কথা বের হলো না। ঈশান ভেবেই নিয়েছে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালেই মারিয়ার কাছে সে ক্ষমা চাইবে। সকল ভুল আর অবহেলা করার ক্ষমা।

শেষ রাতে ঈশানের চোখ ভেঙে ঘুম আসে। বড় শান্তির ঘুম। এমন নিশ্চিন্তে সে কবে ঘুমিয়েছিল মনে করতে পারে না। অবাক বিষয় হলো- আজ সে কোনো স্বপ্ন দেখেনি। বহুদিন পর এমনটা হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে পাশে মারিয়া নেই। নেই মানে সারা বাড়িতেও নেই। বিছানাতে এক চুলও রক্তের দাগ নেই। এমনকি তার ব্যবহৃত কোনো জিনিসপত্র ঘরে নেই। মারিয়াকে বিভিন্ন জাগায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সন্ধান পাওয়া গেল না। দীর্ঘ এক বছরেও না।

কোনো এক অমবস্যা রাতে ঈশানও খুন হলো। নিজের ঘরেই। রক্তাক্ত নিথর দেহটা পড়ে থাকল ঘরের মাঝখানে। মৃত হয়েও ঈশানের আত্মার কণ্ঠস্বর ঘরে ভেসে বেড়ায়। ঈশান নিজেই বলতে থাকে- ‘আমি জানতে চাই কে আমার খুনি! কে? যতক্ষণ আমার খুনিকে একঝলক দেখতে না পাব, ততক্ষণ আমার মৃত চোখের পাতা স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে না। আমার চোখের পাতা বন্ধ করার শক্তি কারো নেই এজন্য যে, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী আমার মৃত্যু হয়নি। আমি খুন হয়েছি। খুন হওয়া মানুষের আত্মা সহজে দেহ ছেড়ে চলে যায় না। তার নিজস্ব একটা শক্তি থাকে। সে শক্তি আমার আছে।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই এজন্য যে, তিনি আমার শেষ ইচ্ছে পূরণ করেছেন! আমি আমার খুনিকে দেখতে পেয়েছি।’

ঈশান যে মুহূর্তে তার প্রিয় খুনিকে দেখতে পায় ঠিক সেই মুহূর্তেই ঈশানের চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়। অদ্ভুত বিষয় হলো খুনিটা মুখোশ পরা সত্ত্বেও ঈশান তাকে চিনতে ভুল করেনি। কারণ ঐ নরঘাতক ঈশানের খুনিটা যে ঈশান নিজেই।