ড্রাগনে স্বপ্ন বুনছেন মোশারফ

টাঙ্গাইলের মধুপুর লাল মাটির গড় অঞ্চল হিসেবে সমধিক পরিচিত। কৃষি ফসল চাষাবাদের জন্য এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া বিশেষ উপযোগী। গড় এলাকার মাটি উঁচু থাকার কারণে বন্যার পানি কৃষি ফসলের জমিতে উঠে না। এ জন্য কৃষকরা নিচু বিল বাইদের জমিতে ধান, পাট, গম ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি উঁচু জমিতে আনারস, কলা, পেঁপে, আদা, কচু, হলুদসহ নানা ফসল চাষ করে থাকেন। গড় এলাকার প্রধান অর্থকরি ফসল আনারস, কলা। সম্প্রতি চাষি ও কৃষকেরা ফসলের বৈচিত্র্য আনতে শুরু করেছে। এখন তারা ড্রাগন চাষেও ঝুঁকছেন। কফি, কাজু বাদাম, মাল্টার চাষও শুরু করেছেন।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, মধুপুরে লাল মাটিতে ২৭.৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগন চাষ হয়েছে। ২শ’ ৭৫ জন কৃষক এ বছর ড্রাগন চাষ করেছে। ১৬৫ থেকে ১৭০ মেট্টিক টন ফলনের সম্ভবনা রয়েছে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে। এ বছরের উৎপাদিত ড্রাগন ফলের বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। মোশারফ হোসেনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি ড্রাগন চাষ শুরু করেন ২০১৪ সালে। তিনি তখন প্রবাসে থাকেন। মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে সাভার এলাকার একটি প্রতিবেদন দেখে উদ্ভুদ্ধ হয়। সে বছরই দেশে এসে নিজের বাড়ির পালানে বাবার জমিতে ড্রাগন চাষের চিন্তা করে। পরে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে। তার পরামর্শে ধনবাড়ি হর্টিকালচার থেকে চারা সংগ্রহ করে। প্রথমে তার ৬০ শতাংশ জমিতে ৭’শ গাছ লাগান। ১’শ ৫০টি সিমেন্টের খুঁটিতে তুলে দেন। প্রথমে ১৪ মাস পরে ফল আসে। পরিপূর্ণভাবে দুই বছর ফলন পান। সে বার তার খরচ পরে লাভের মুখ দেখতে পান। পরের বছর বাগানে ভালো ভাবে পরিচর্যা করে ২ লক্ষ টাকা মত লাভ পান। পরের বছর আরো ৫ বিঘা জমিতে বাড়ান ড্রাগন চাষ। প্রতিদিন তার বাগানে ৩ থেকে ৪ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। সকাল থেকে সারাদিন শ্রমিকদের সাথে থেকে বাগানের যতœ নেন মোশারফ। মহিষমারা এলাকায় তার এ বাগানে ফুল ও ফল আসা শুরু করেছে। ইতিমধ্যে তিনি ড্রাগন বিক্রি শুরু করেছেন। ¯’ানীয় ভাবে ও ঢাকার পাইকারী বাজারে ড্রাগন বিক্রি করেন। আকার ও গুণগত মানভেদে ১৫০টাকা থেকে ৩৫০টাকা পর্যন্ত কেজি দামে ড্রাগন বিক্রি করে থাকেন। সরজমিনে মধুপুর শহর থেকে ১২ কি.মি. দূরে মহিষমারা ইউনিয়নের নেদুরবাজার এলাকায় তার বাগানে গিয়ে দেখা যায়, লাইন বদ্ব সারি সারি খুটিতে সাইকেল রিকসার পুরানো ট্রায়ার খুটির মাথায় প্যাঁচানো। খুটি থেকে লতার মত জড়িয়ে বেড়ে উঠেছে ড্রাগন গাছ। ফুল ও ড্রাগন ধরতে শুরু করেছে। কোনো কোনো গাছে ড্রাগন পাকতে শুরু করেছে। এ বাগানের চার পাশে কাটা তারের বেড়া। ফুলগুলো কোনটা সাদা। কোনটা গোলাপী রংয়ের। বেশির ভাগ ফল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। বাগানের মালিক জানালেন ড্রাগন সুস্বাদু থাকার কারণে পাখির উপদ্রব বেশি। পাখি যাতে ফল খেতে না পারে ও নষ্ট না হয় সেজন্যই তিনি পলিথিন দিয়ে ফলগুলো প্রতিদিন মুড়িয়ে দেন। বাগানে সবুজ ঘাসে যেন দৃষ্টিনন্দন। সারিবদ্ব লাইনের ফাঁকে ফাঁকে দিয়েছেন থাই পেয়ারা। গাছের গোড়ায় ব্যবহার করছে জৈব সার। মোশারফ জানান, পোকা মাকড় ও কীটপঙ্গ দমনের জন্য মাসে ২ বার বালাইনাশক ব্যবহার করেন। প্রায় ৮-৯ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেছেন স্বপ্নের ড্রাগন বাগান। এখন আর প্রবাসে যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে জেরে ফেলেছেন। দেশের মাটিতে কৃষি কাজ করে স্বাবলম্বীর পথে তিনি। তার দাবি মধুপুরের লাল মাটিতে ড্রাগন চাষ প্রথম তিনিই শুরু করেন।

মোশারফ আরো জানান, মধুপুরের মাটিতে যে কোনো ফসল জন্মে। তিনি ড্রাগন চাষ করতে ব্যাংক থেকে ঋণও নিয়েছেন। তার আশা ঋণ পরিশোধ করে লাভ গুণবেন। কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা না দিলে তার স্বপ্নের বাগানে তার মনের আশা পূরণ হবে। প্রতিদিন সকালে বাগানে ঘুরতে তার ভালো লাগে। ড্রাগনের ফুল ফলের উপর সকালের কচি রোদ পড়ে যখন চিক চিক করে সে দৃশ্য দেখে সারাদিনের শ্রমের কথা ভুলে যান। তার আশা এ বছর ড্রাগন বিক্রি করে কয়েক লক্ষ টাকা লাভ গুণবেন এমনটাই স্বপ্নের জাল বুনছেন তিনি ।

মধুপুরে উপজেলায় কৃষি অফিসার আল মামুন রাসেল জানান, মধুপুরের মাটি ও আবহাওয়া ড্রাগন চাষে উপযোগী। এ ফসল মধুপুর এলাকায় নতুন হলেও আবহাওয়া ও মাটি অনুকুলে থাকার কারণে কৃষকরা সহজেই ড্রাগন চাষ করছে। এলাকার মাটি উঁচু থাকার কারণে বন্যার পানি উঠে না বিধায় ড্রাগন চাষে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। তিনি জানান এ বছর ২৭.০৫ হেক্টর জমিতে ২৭৫ জন কৃষক ড্রাগন চাষ করছে। এর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৬৫-১৭০ মেট্রিকটন নির্ধারণ করা হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা।

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৬ আশ্বিন ১৪২৯ ২৪ সফর ১৪৪৪

ড্রাগনে স্বপ্ন বুনছেন মোশারফ

প্রতিনিধি, মধুপুর (টাঙ্গাইল)

image

টাঙ্গাইলের মধুপুর লাল মাটির গড় অঞ্চল হিসেবে সমধিক পরিচিত। কৃষি ফসল চাষাবাদের জন্য এ অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া বিশেষ উপযোগী। গড় এলাকার মাটি উঁচু থাকার কারণে বন্যার পানি কৃষি ফসলের জমিতে উঠে না। এ জন্য কৃষকরা নিচু বিল বাইদের জমিতে ধান, পাট, গম ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি উঁচু জমিতে আনারস, কলা, পেঁপে, আদা, কচু, হলুদসহ নানা ফসল চাষ করে থাকেন। গড় এলাকার প্রধান অর্থকরি ফসল আনারস, কলা। সম্প্রতি চাষি ও কৃষকেরা ফসলের বৈচিত্র্য আনতে শুরু করেছে। এখন তারা ড্রাগন চাষেও ঝুঁকছেন। কফি, কাজু বাদাম, মাল্টার চাষও শুরু করেছেন।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, মধুপুরে লাল মাটিতে ২৭.৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগন চাষ হয়েছে। ২শ’ ৭৫ জন কৃষক এ বছর ড্রাগন চাষ করেছে। ১৬৫ থেকে ১৭০ মেট্টিক টন ফলনের সম্ভবনা রয়েছে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে। এ বছরের উৎপাদিত ড্রাগন ফলের বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। মোশারফ হোসেনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি ড্রাগন চাষ শুরু করেন ২০১৪ সালে। তিনি তখন প্রবাসে থাকেন। মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে সাভার এলাকার একটি প্রতিবেদন দেখে উদ্ভুদ্ধ হয়। সে বছরই দেশে এসে নিজের বাড়ির পালানে বাবার জমিতে ড্রাগন চাষের চিন্তা করে। পরে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে। তার পরামর্শে ধনবাড়ি হর্টিকালচার থেকে চারা সংগ্রহ করে। প্রথমে তার ৬০ শতাংশ জমিতে ৭’শ গাছ লাগান। ১’শ ৫০টি সিমেন্টের খুঁটিতে তুলে দেন। প্রথমে ১৪ মাস পরে ফল আসে। পরিপূর্ণভাবে দুই বছর ফলন পান। সে বার তার খরচ পরে লাভের মুখ দেখতে পান। পরের বছর বাগানে ভালো ভাবে পরিচর্যা করে ২ লক্ষ টাকা মত লাভ পান। পরের বছর আরো ৫ বিঘা জমিতে বাড়ান ড্রাগন চাষ। প্রতিদিন তার বাগানে ৩ থেকে ৪ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। সকাল থেকে সারাদিন শ্রমিকদের সাথে থেকে বাগানের যতœ নেন মোশারফ। মহিষমারা এলাকায় তার এ বাগানে ফুল ও ফল আসা শুরু করেছে। ইতিমধ্যে তিনি ড্রাগন বিক্রি শুরু করেছেন। ¯’ানীয় ভাবে ও ঢাকার পাইকারী বাজারে ড্রাগন বিক্রি করেন। আকার ও গুণগত মানভেদে ১৫০টাকা থেকে ৩৫০টাকা পর্যন্ত কেজি দামে ড্রাগন বিক্রি করে থাকেন। সরজমিনে মধুপুর শহর থেকে ১২ কি.মি. দূরে মহিষমারা ইউনিয়নের নেদুরবাজার এলাকায় তার বাগানে গিয়ে দেখা যায়, লাইন বদ্ব সারি সারি খুটিতে সাইকেল রিকসার পুরানো ট্রায়ার খুটির মাথায় প্যাঁচানো। খুটি থেকে লতার মত জড়িয়ে বেড়ে উঠেছে ড্রাগন গাছ। ফুল ও ড্রাগন ধরতে শুরু করেছে। কোনো কোনো গাছে ড্রাগন পাকতে শুরু করেছে। এ বাগানের চার পাশে কাটা তারের বেড়া। ফুলগুলো কোনটা সাদা। কোনটা গোলাপী রংয়ের। বেশির ভাগ ফল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। বাগানের মালিক জানালেন ড্রাগন সুস্বাদু থাকার কারণে পাখির উপদ্রব বেশি। পাখি যাতে ফল খেতে না পারে ও নষ্ট না হয় সেজন্যই তিনি পলিথিন দিয়ে ফলগুলো প্রতিদিন মুড়িয়ে দেন। বাগানে সবুজ ঘাসে যেন দৃষ্টিনন্দন। সারিবদ্ব লাইনের ফাঁকে ফাঁকে দিয়েছেন থাই পেয়ারা। গাছের গোড়ায় ব্যবহার করছে জৈব সার। মোশারফ জানান, পোকা মাকড় ও কীটপঙ্গ দমনের জন্য মাসে ২ বার বালাইনাশক ব্যবহার করেন। প্রায় ৮-৯ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেছেন স্বপ্নের ড্রাগন বাগান। এখন আর প্রবাসে যাওয়ার চিন্তা মাথা থেকে জেরে ফেলেছেন। দেশের মাটিতে কৃষি কাজ করে স্বাবলম্বীর পথে তিনি। তার দাবি মধুপুরের লাল মাটিতে ড্রাগন চাষ প্রথম তিনিই শুরু করেন।

মোশারফ আরো জানান, মধুপুরের মাটিতে যে কোনো ফসল জন্মে। তিনি ড্রাগন চাষ করতে ব্যাংক থেকে ঋণও নিয়েছেন। তার আশা ঋণ পরিশোধ করে লাভ গুণবেন। কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা না দিলে তার স্বপ্নের বাগানে তার মনের আশা পূরণ হবে। প্রতিদিন সকালে বাগানে ঘুরতে তার ভালো লাগে। ড্রাগনের ফুল ফলের উপর সকালের কচি রোদ পড়ে যখন চিক চিক করে সে দৃশ্য দেখে সারাদিনের শ্রমের কথা ভুলে যান। তার আশা এ বছর ড্রাগন বিক্রি করে কয়েক লক্ষ টাকা লাভ গুণবেন এমনটাই স্বপ্নের জাল বুনছেন তিনি ।

মধুপুরে উপজেলায় কৃষি অফিসার আল মামুন রাসেল জানান, মধুপুরের মাটি ও আবহাওয়া ড্রাগন চাষে উপযোগী। এ ফসল মধুপুর এলাকায় নতুন হলেও আবহাওয়া ও মাটি অনুকুলে থাকার কারণে কৃষকরা সহজেই ড্রাগন চাষ করছে। এলাকার মাটি উঁচু থাকার কারণে বন্যার পানি উঠে না বিধায় ড্রাগন চাষে কৃষকরা লাভবান হচ্ছে। তিনি জানান এ বছর ২৭.০৫ হেক্টর জমিতে ২৭৫ জন কৃষক ড্রাগন চাষ করছে। এর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৬৫-১৭০ মেট্রিকটন নির্ধারণ করা হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা।