বিপজ্জনক বর্জ্য এবং এর ব্যবস্থাপনা

মৃত্তিকা দাশ দূর্বা

দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকা-ের মাধ্যমে তৈরি হয় নানাবিধ বর্জ্য পদার্থ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ, প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি বর্জ্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য পদার্থের মধ্যে এমন কিছু বর্জ্য রয়েছে, যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপÑএই ধরনের বর্জ্য পদার্থকে বিপজ্জনক বর্জ্য বলা হয়। রাসায়নিকভাবে সক্রিয়, দাহ্য, বিস্ফোরক, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, ক্ষয়কারী পদার্থসহ বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ বিপজ্জনক বর্জ্যরে অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ- রাসায়নিক স্যার, কীটনাশক, বিভিন্ন ওষুধ, নষ্ট ব্যাটারি, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, এ সবকিছুই জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিপজ্জনক বর্জ্যরে নানা রকম উৎস রয়েছে। যেমন- শিল্পে উৎপাদিত বিভিন্ন পেস্টিসাইড, কীটনাশক (অলড্রিন) আগাছা নাশক এবং রাসায়নিক বস্তু, ধাতব বস্তু (সিসা, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, পারদ ইত্যাদি) এসব থেকে বিপজ্জনক বর্জ্য তৈরি হয়। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গৃহস্থালি কাজ, হাসপাতালের অব্যবহৃত, নষ্ট হয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতি, রক্ত ধৌত জল এসব পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। এ ছাড়া রয়েছে কাগজ শিল্পের আবর্জনা, ওষুধ শিল্পের বর্জ্য, ইঞ্জিন দহন বর্জ্য, খাদ্য শিল্পের বর্জ্য, গ্লাস কারখানার বর্জ্য, প্লাস্টিক বর্জ্য, বৈদ্যুতিক বর্জ্য, কৃষি বর্জ্য, বিস্ফোরক কারখানা থেকে উৎপাদিত বর্জ্য, সামরিক বর্জ্য, চিকিৎসার অবশিষ্টাংশ ইত্যাদি।

বিপজ্জনক বর্জ্য থেকে নানারকম রোগ সৃষ্টি হয় একই সঙ্গে পরিবেশের জন্য ও ক্ষতিকর। হাসপাতালে ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জমে থাকা বিপজ্জনক বর্জ্য দূষিত গ্যাস সৃষ্টি করে পরিবেশ দূষিত করে। বৃষ্টির জলে ধুয়ে এসব বস্তু জলাশয়ে পড়ে এবং পানি দূষণ করে, যা থেকে জলজপ্রাণী ও গৃহপালিত প্রাণীর বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। কৃষিতে বহুল ব্যবহৃত কীটনাশক, রাসায়নিক স্যার বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে জলাশয়ে গিয়ে পরে পানিকে বিষাক্ত করে তোলে। বিভিন্ন ভারী মৌল যেমন আর্সেনিক পানি দূষণ ঘটায়, আর্সেনিক দূষিত পানি পান করলে আর্সেনিকোসিস রোগ সৃষ্টি হয়, সিসা মানব দেহে ডিসলেক্সিয়া, ক্যাডমিয়াম থেকে ইটাইইটাই, পারদ থেকে মিনামিটা রোগ হয়। এ ছাড়া রয়েছে আচরণগত অস্বাভাবিকতা, ক্যান্সার, জিনগত ত্রুটি, শারীরিক ত্রুটি, জন্ম ত্রুটিসহ বিভিন্ন জটিল রোগ। সমানভাবে পরিবেশের জন্যও এসব বস্তু ক্ষতিকর; নদীনালাসহ অন্যান্য জলাশয়ে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের রোগ সৃষ্টি করে, বিষাক্ত এলাকাগুলোতে কোন জীব জীবনধারণ করতে পারে না; প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে।

কিছুকিছু বিপজ্জনক বর্জ্য যে কোন সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। টিএনটি, বিভিন্ন জৈব পার-অক্সাইড উৎকৃষ্ট বিস্ফোরক যাদের সঠিক উপায়ে সংরক্ষণ করা না হলে যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। ক্ষতিকারক বস্তুসমূহ পরিবেশের দুইভাবে বিষাক্ততা ছড়াতে সক্ষম-ক্রোনিক; একিউট। যখন এসব বস্তু খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে এইগুলো বিষাক্ততা ছড়াতে সক্ষম, তখন একে একিউট প্রভাব বলে। অন্যদিকে কিছুকিছু পদার্থ দীর্ঘদিন পরিবেশে উন্মুক্ত থেকে ধীরে ধীরে পরিবেশে বিষাক্ততা তৈরি করে, একে ক্রোনিক বিষাক্ততা বলে। তেজষ্ক্রিয় পদার্থসমূহ একিউট, ক্রোনিক দুইভাবেই ক্ষতিসাধন করতে পারে। কারণ এসব পদার্থসমূহ পরিবেশে বহুদিন থেকে যায় এবং ক্ষতিকারক (আলফা, বিটা, গামা) রশ্মি ছড়ায়। রাসায়নিকভাবে অস্থিতিশীল মৌলসমূহ যেকোনো সময় পানি বা বায়ুর সঙ্গে বিক্রিয়া করে বিস্ফোরিত হতে পারে। ক্ষয়কারক পদার্থসমূহ (সোডিয়াম, পটাশিয়ামসহ বিভিন্ন ক্ষারীয় ধাতু) জীবন্ত টিস্যুর সংস্পর্শে এলে, টিস্যুসমূহকে ধ্বংস করে ফেলে। সর্বোপরি, বিপজ্জনক বর্জ্যসমূহ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে মিশে জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই এই সব বর্জ্যরে সুষ্ঠু ও সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি।

বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি রয়েছে। তবে উৎস থেকে বর্জ্য উৎপাদন হ্রাসকরণ (জবফঁপরহম) বা পুনরুৎপাদন (জবপুপষরহম) পদ্ধতিগুলো সবচেয়ে উপযোগী। রিসাইকেলিং পদ্ধতিতে পুরাতন বর্জ্যসমুহকে পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন করে ব্যবহার্য বস্তুতে রূপান্তর করা হয়। যেমন- প্লাস্টিক রিসাইকেল। রিসাইকেলিং, রিডিউসিং পদ্ধতিগুলো পরিবেশ দূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও সব ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিগুলো ফলপ্রসূ হয় না। এমন কিছু বর্জ্য থেকেই যায় যাদের সংরক্ষণ কিংবা অপসারণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় পরিশোধন করা জরুরি।

বর্জ্য বিশেষে রাসায়নিক, জৈবিক, ভৌতিক, তাপীয় নানাভাবেই পরিশোধন করা যায়। রাসায়নিক পদ্ধতিগুলোর মধ্যে আয়ন বিনিময় (রড়হ পযধহমব), অধঃক্ষেপণ (চৎবপরঢ়রঃধঃরড়হ), জারণ, বিজারণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাপীয় পদ্ধতিতে ইনসিনেরেশন বা ভস্মীকরণ প্রক্রিয়ায় উচ্চ তাপমাত্রায় বর্জ্যগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এই পদ্ধতিতে জৈব বর্জ্যকে পুরোপুরি বিষমুক্ত ও বিনষ্ট করে দেওয়া যায়। কঠিন, তরল, অর্ধ তরল বস্তুসমূহকে আলাদা আলাদা পোড়ানোর জন্য আলাদা ধরনের তাপীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। যেমন- ফ্লুইড বেডইনসিনেরেটর, ঘূর্ণনচুল্লী (জড়ঃধৎু শরষহ), লিকুইড ইঞ্জেকশন ইনসিনেরেটর অন্তর্ভুক্ত। তবে ইনসিনেরেশন পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বর্জ্য পোড়ানোর সময় বায়ুদূষণ হয়। তাই যথা সম্ভব কম বায়ু দূষণ হয় এমন সুপরিকল্পিত উপায়ে এর দ্বারা বর্জ্যগুলো পোড়ানো উচিত। পৃথিবীর বহু দেশেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ইনসিনেরেশন পদ্ধতিটি বেশ পরিচিত।

পেট্রোলিয়াম শিল্প থেকে উৎপাদিত বর্জ্যসমূহের জৈব পরিশোধন বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আরেকটি উপায়। এই উপায়ে ল্যান্ডফার্মিং (খধহফ ভধৎসরহম) পদ্ধতিটি বেশ কার্যকর। এই পদ্ধতিতে বর্জ্যগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে মাটির উপরিভাগে মেশানো হয় যাতে করে মাটির অণুজীবগুলো ক্ষতিকারক বস্তুগুলোকে মাটির সঙ্গে পচিয়ে ফেলতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড অণুজীবও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া অণুজীবের দ্বারা দূষিত স্থানের বিপজ্জনক বস্তুগুলো স্থিতিশীল করা হয়ে থাকে, যা বায়োরিমিডিয়েশন (ইরড়ৎবসবফরধঃরড়হ) পদ্ধতি নামে পরিচিত।

বায়োরিমিডিয়েশন একটি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি, যার দ্বারা অণুজীবের মাধ্যমে দূষিত স্থানসমূহকে পুরোপরি বা আংশিকভাবে পুনরুৎদ্ধার করা সম্ভব। রাসায়নিক, জৈব, তাপীয় এই পদ্ধতিগুলোর বর্জ্যসমূহের আণবিক গঠন পরিবর্তন এর দ্বারা এদের ক্ষতিকারক প্রভাব হ্রাস করা হয়। অন্যদিকে, শারীরিক বা ভৌতিক ব্যবস্থায় বর্জ্যরে আকার পরিবর্তন, ঘনীভবন বা বর্জ্যরে পরিমাণ হ্রাস করা হয়। ভৌতপ্রক্রিয়ায় বাষ্পীভবন, অধঃক্ষেপণ, পরিশ্রাবণ, ফ্লোটেশন (ঋষড়ঃধঃরড়হ) এসব অন্তর্ভুক্ত।

এমনকিছু বিপজ্জনক বর্জ্য রয়েছে, যাদের ক্ষতিকর প্রভাব উপরিউক্ত কোন পদ্ধতিতেই অপসারণ করা যায় না। এসব বর্জ্যের ক্ষেত্রে ল্যান্ড ডিসপোজাল (খধহফ ফরংঢ়ড়ংধষ) -ই হলো চূড়ান্ত ব্যবস্থা। দুই ধরনের ডিসপোজাল পদ্ধতি রয়েছে। ১. ল্যান্ড ফিলিং বা ভরাটকরণ ২. সিকিউর ল্যান্ডফিলিং। ল্যান্ডফিলিং হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যাতে বিপজ্জনক বস্তুসমূহকে লোকালয় থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলা হয়। তবে এই পদ্ধতিতে পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি থাকে। অন্যদিকে, সিকিউর ল্যান্ড ফিলিং এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে বিপজ্জনক বর্জ্যগুলোকে সুপরিকল্পিত উপায়ে মাটির গভীরে কয়েকটি স্তরে জমাট করা হয়; এই ক্ষেত্রে বায়ু দূষণের ঝুঁকি হ্রাস পায়। তবে এই ক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হয় যেন মাটির গভীরে বর্জ্যের স্তর ও পানির স্তরের মধ্যকার পার্থক্য কমপক্ষে ৩ মিটার থাকে। অন্যথায়, বর্জ্য মাটির নিচের পানির স্তরে মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সরাসরি উন্মুক্ত না থাকায়, সিকিউর ল্যান্ড ফিলিং পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটি সত্যি যে, বহির্বিশ্বে বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হলেও বাংলাদেশে বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলশ্রুতিতে, এই ধরনের বর্জ্যরে উৎস, ক্ষতিকারক দিকগুলো সম্পর্কে সাধারণ জনগণের তেমন কোন ধারণাই তৈরি হয়নি। বেশির ভাগ মানুষ এখানে সেখানে ময়লা ফেলতে বেশি অভ্যস্ত, যার ফলে তৈরি হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ময়লা-আবর্জনার স্তূপ।

বিপজ্জনক বস্তুসমূহ এই আবর্জনার স্তূপের মাঝেই মিশে যাচ্ছে; সেই আবর্জনা পচেগলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করছে। তাই পরিবেশ সুরক্ষার্থে বিপজ্জনক বর্জ্যসমূহ সুপরিকল্পিত উপায়ে পৃথকীকরণ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত করে তোলার কোন বিকল্প নেই। সর্বোপরি, পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের সুনজর আশা করি, যেন সুপরিকল্পিত ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এসব বর্জ্য অপসারণ করে দূষণমুক্ত একটি পরিবেশ গড়ে তোলার দিকে অগ্রসর হতে পারি।

[লেখক: শিক্ষার্থী, পরিবেশবিজ্ঞান ও প্রকোশল বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৬ আশ্বিন ১৪২৯ ২৪ সফর ১৪৪৪

বিপজ্জনক বর্জ্য এবং এর ব্যবস্থাপনা

মৃত্তিকা দাশ দূর্বা

দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকা-ের মাধ্যমে তৈরি হয় নানাবিধ বর্জ্য পদার্থ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ, প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার, ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি বর্জ্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য পদার্থের মধ্যে এমন কিছু বর্জ্য রয়েছে, যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপÑএই ধরনের বর্জ্য পদার্থকে বিপজ্জনক বর্জ্য বলা হয়। রাসায়নিকভাবে সক্রিয়, দাহ্য, বিস্ফোরক, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, ক্ষয়কারী পদার্থসহ বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ বিপজ্জনক বর্জ্যরে অন্তর্ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ- রাসায়নিক স্যার, কীটনাশক, বিভিন্ন ওষুধ, নষ্ট ব্যাটারি, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, এ সবকিছুই জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিপজ্জনক বর্জ্যরে নানা রকম উৎস রয়েছে। যেমন- শিল্পে উৎপাদিত বিভিন্ন পেস্টিসাইড, কীটনাশক (অলড্রিন) আগাছা নাশক এবং রাসায়নিক বস্তু, ধাতব বস্তু (সিসা, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, পারদ ইত্যাদি) এসব থেকে বিপজ্জনক বর্জ্য তৈরি হয়। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গৃহস্থালি কাজ, হাসপাতালের অব্যবহৃত, নষ্ট হয়ে যাওয়া যন্ত্রপাতি, রক্ত ধৌত জল এসব পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। এ ছাড়া রয়েছে কাগজ শিল্পের আবর্জনা, ওষুধ শিল্পের বর্জ্য, ইঞ্জিন দহন বর্জ্য, খাদ্য শিল্পের বর্জ্য, গ্লাস কারখানার বর্জ্য, প্লাস্টিক বর্জ্য, বৈদ্যুতিক বর্জ্য, কৃষি বর্জ্য, বিস্ফোরক কারখানা থেকে উৎপাদিত বর্জ্য, সামরিক বর্জ্য, চিকিৎসার অবশিষ্টাংশ ইত্যাদি।

বিপজ্জনক বর্জ্য থেকে নানারকম রোগ সৃষ্টি হয় একই সঙ্গে পরিবেশের জন্য ও ক্ষতিকর। হাসপাতালে ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জমে থাকা বিপজ্জনক বর্জ্য দূষিত গ্যাস সৃষ্টি করে পরিবেশ দূষিত করে। বৃষ্টির জলে ধুয়ে এসব বস্তু জলাশয়ে পড়ে এবং পানি দূষণ করে, যা থেকে জলজপ্রাণী ও গৃহপালিত প্রাণীর বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। কৃষিতে বহুল ব্যবহৃত কীটনাশক, রাসায়নিক স্যার বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে জলাশয়ে গিয়ে পরে পানিকে বিষাক্ত করে তোলে। বিভিন্ন ভারী মৌল যেমন আর্সেনিক পানি দূষণ ঘটায়, আর্সেনিক দূষিত পানি পান করলে আর্সেনিকোসিস রোগ সৃষ্টি হয়, সিসা মানব দেহে ডিসলেক্সিয়া, ক্যাডমিয়াম থেকে ইটাইইটাই, পারদ থেকে মিনামিটা রোগ হয়। এ ছাড়া রয়েছে আচরণগত অস্বাভাবিকতা, ক্যান্সার, জিনগত ত্রুটি, শারীরিক ত্রুটি, জন্ম ত্রুটিসহ বিভিন্ন জটিল রোগ। সমানভাবে পরিবেশের জন্যও এসব বস্তু ক্ষতিকর; নদীনালাসহ অন্যান্য জলাশয়ে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের রোগ সৃষ্টি করে, বিষাক্ত এলাকাগুলোতে কোন জীব জীবনধারণ করতে পারে না; প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে।

কিছুকিছু বিপজ্জনক বর্জ্য যে কোন সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। টিএনটি, বিভিন্ন জৈব পার-অক্সাইড উৎকৃষ্ট বিস্ফোরক যাদের সঠিক উপায়ে সংরক্ষণ করা না হলে যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। ক্ষতিকারক বস্তুসমূহ পরিবেশের দুইভাবে বিষাক্ততা ছড়াতে সক্ষম-ক্রোনিক; একিউট। যখন এসব বস্তু খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে এইগুলো বিষাক্ততা ছড়াতে সক্ষম, তখন একে একিউট প্রভাব বলে। অন্যদিকে কিছুকিছু পদার্থ দীর্ঘদিন পরিবেশে উন্মুক্ত থেকে ধীরে ধীরে পরিবেশে বিষাক্ততা তৈরি করে, একে ক্রোনিক বিষাক্ততা বলে। তেজষ্ক্রিয় পদার্থসমূহ একিউট, ক্রোনিক দুইভাবেই ক্ষতিসাধন করতে পারে। কারণ এসব পদার্থসমূহ পরিবেশে বহুদিন থেকে যায় এবং ক্ষতিকারক (আলফা, বিটা, গামা) রশ্মি ছড়ায়। রাসায়নিকভাবে অস্থিতিশীল মৌলসমূহ যেকোনো সময় পানি বা বায়ুর সঙ্গে বিক্রিয়া করে বিস্ফোরিত হতে পারে। ক্ষয়কারক পদার্থসমূহ (সোডিয়াম, পটাশিয়ামসহ বিভিন্ন ক্ষারীয় ধাতু) জীবন্ত টিস্যুর সংস্পর্শে এলে, টিস্যুসমূহকে ধ্বংস করে ফেলে। সর্বোপরি, বিপজ্জনক বর্জ্যসমূহ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে মিশে জনস্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই এই সব বর্জ্যরে সুষ্ঠু ও সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি।

বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি রয়েছে। তবে উৎস থেকে বর্জ্য উৎপাদন হ্রাসকরণ (জবফঁপরহম) বা পুনরুৎপাদন (জবপুপষরহম) পদ্ধতিগুলো সবচেয়ে উপযোগী। রিসাইকেলিং পদ্ধতিতে পুরাতন বর্জ্যসমুহকে পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন করে ব্যবহার্য বস্তুতে রূপান্তর করা হয়। যেমন- প্লাস্টিক রিসাইকেল। রিসাইকেলিং, রিডিউসিং পদ্ধতিগুলো পরিবেশ দূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও সব ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিগুলো ফলপ্রসূ হয় না। এমন কিছু বর্জ্য থেকেই যায় যাদের সংরক্ষণ কিংবা অপসারণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় পরিশোধন করা জরুরি।

বর্জ্য বিশেষে রাসায়নিক, জৈবিক, ভৌতিক, তাপীয় নানাভাবেই পরিশোধন করা যায়। রাসায়নিক পদ্ধতিগুলোর মধ্যে আয়ন বিনিময় (রড়হ পযধহমব), অধঃক্ষেপণ (চৎবপরঢ়রঃধঃরড়হ), জারণ, বিজারণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাপীয় পদ্ধতিতে ইনসিনেরেশন বা ভস্মীকরণ প্রক্রিয়ায় উচ্চ তাপমাত্রায় বর্জ্যগুলোকে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এই পদ্ধতিতে জৈব বর্জ্যকে পুরোপুরি বিষমুক্ত ও বিনষ্ট করে দেওয়া যায়। কঠিন, তরল, অর্ধ তরল বস্তুসমূহকে আলাদা আলাদা পোড়ানোর জন্য আলাদা ধরনের তাপীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। যেমন- ফ্লুইড বেডইনসিনেরেটর, ঘূর্ণনচুল্লী (জড়ঃধৎু শরষহ), লিকুইড ইঞ্জেকশন ইনসিনেরেটর অন্তর্ভুক্ত। তবে ইনসিনেরেশন পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বর্জ্য পোড়ানোর সময় বায়ুদূষণ হয়। তাই যথা সম্ভব কম বায়ু দূষণ হয় এমন সুপরিকল্পিত উপায়ে এর দ্বারা বর্জ্যগুলো পোড়ানো উচিত। পৃথিবীর বহু দেশেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ইনসিনেরেশন পদ্ধতিটি বেশ পরিচিত।

পেট্রোলিয়াম শিল্প থেকে উৎপাদিত বর্জ্যসমূহের জৈব পরিশোধন বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আরেকটি উপায়। এই উপায়ে ল্যান্ডফার্মিং (খধহফ ভধৎসরহম) পদ্ধতিটি বেশ কার্যকর। এই পদ্ধতিতে বর্জ্যগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে মাটির উপরিভাগে মেশানো হয় যাতে করে মাটির অণুজীবগুলো ক্ষতিকারক বস্তুগুলোকে মাটির সঙ্গে পচিয়ে ফেলতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড অণুজীবও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া অণুজীবের দ্বারা দূষিত স্থানের বিপজ্জনক বস্তুগুলো স্থিতিশীল করা হয়ে থাকে, যা বায়োরিমিডিয়েশন (ইরড়ৎবসবফরধঃরড়হ) পদ্ধতি নামে পরিচিত।

বায়োরিমিডিয়েশন একটি পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি, যার দ্বারা অণুজীবের মাধ্যমে দূষিত স্থানসমূহকে পুরোপরি বা আংশিকভাবে পুনরুৎদ্ধার করা সম্ভব। রাসায়নিক, জৈব, তাপীয় এই পদ্ধতিগুলোর বর্জ্যসমূহের আণবিক গঠন পরিবর্তন এর দ্বারা এদের ক্ষতিকারক প্রভাব হ্রাস করা হয়। অন্যদিকে, শারীরিক বা ভৌতিক ব্যবস্থায় বর্জ্যরে আকার পরিবর্তন, ঘনীভবন বা বর্জ্যরে পরিমাণ হ্রাস করা হয়। ভৌতপ্রক্রিয়ায় বাষ্পীভবন, অধঃক্ষেপণ, পরিশ্রাবণ, ফ্লোটেশন (ঋষড়ঃধঃরড়হ) এসব অন্তর্ভুক্ত।

এমনকিছু বিপজ্জনক বর্জ্য রয়েছে, যাদের ক্ষতিকর প্রভাব উপরিউক্ত কোন পদ্ধতিতেই অপসারণ করা যায় না। এসব বর্জ্যের ক্ষেত্রে ল্যান্ড ডিসপোজাল (খধহফ ফরংঢ়ড়ংধষ) -ই হলো চূড়ান্ত ব্যবস্থা। দুই ধরনের ডিসপোজাল পদ্ধতি রয়েছে। ১. ল্যান্ড ফিলিং বা ভরাটকরণ ২. সিকিউর ল্যান্ডফিলিং। ল্যান্ডফিলিং হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যাতে বিপজ্জনক বস্তুসমূহকে লোকালয় থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলা হয়। তবে এই পদ্ধতিতে পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি থাকে। অন্যদিকে, সিকিউর ল্যান্ড ফিলিং এমন একটি প্রক্রিয়া যাতে বিপজ্জনক বর্জ্যগুলোকে সুপরিকল্পিত উপায়ে মাটির গভীরে কয়েকটি স্তরে জমাট করা হয়; এই ক্ষেত্রে বায়ু দূষণের ঝুঁকি হ্রাস পায়। তবে এই ক্ষেত্রে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হয় যেন মাটির গভীরে বর্জ্যের স্তর ও পানির স্তরের মধ্যকার পার্থক্য কমপক্ষে ৩ মিটার থাকে। অন্যথায়, বর্জ্য মাটির নিচের পানির স্তরে মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সরাসরি উন্মুক্ত না থাকায়, সিকিউর ল্যান্ড ফিলিং পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস করে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটি সত্যি যে, বহির্বিশ্বে বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হলেও বাংলাদেশে বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলশ্রুতিতে, এই ধরনের বর্জ্যরে উৎস, ক্ষতিকারক দিকগুলো সম্পর্কে সাধারণ জনগণের তেমন কোন ধারণাই তৈরি হয়নি। বেশির ভাগ মানুষ এখানে সেখানে ময়লা ফেলতে বেশি অভ্যস্ত, যার ফলে তৈরি হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ময়লা-আবর্জনার স্তূপ।

বিপজ্জনক বস্তুসমূহ এই আবর্জনার স্তূপের মাঝেই মিশে যাচ্ছে; সেই আবর্জনা পচেগলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করছে। তাই পরিবেশ সুরক্ষার্থে বিপজ্জনক বর্জ্যসমূহ সুপরিকল্পিত উপায়ে পৃথকীকরণ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত করে তোলার কোন বিকল্প নেই। সর্বোপরি, পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের সুনজর আশা করি, যেন সুপরিকল্পিত ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এসব বর্জ্য অপসারণ করে দূষণমুক্ত একটি পরিবেশ গড়ে তোলার দিকে অগ্রসর হতে পারি।

[লেখক: শিক্ষার্থী, পরিবেশবিজ্ঞান ও প্রকোশল বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়]