দিনাজপুরে সাঁওতালদের স্বপ্নভঙ্গ

মিথুশিলাক মুরমু

একজন আইন প্রণেতার বিরুদ্ধে অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া সাঁওতালদের জমি দখল করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। তবে হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও আদিবাসীরা ক্ষীণ কণ্ঠেই জানান দিয়েছেন, রক্ষকই ভক্ষক।

বিনোদনকেন্দ্র ‘স্বপ্নপুরী’র অবস্থান দিনাজপুর জেলা থেকে প্রায় ৫২ কিলোমিটার দক্ষিণে আফতাবগঞ্জ উপজেলাধীন। উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরদিকে ৯ নং কুশদহ ইউনিয়ন পরিষদের অধীন খালিপপুর মৌজার মধ্যে অবস্থিত। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে একান্ত ব্যক্তিতগত উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন এই পার্কটি। ১৫০ একর জমির ওপর নির্মিত নান্দনিক সৌন্দর্যের এক স্বপ্নিল জগত স্বপ্নপুরী। ইতোমধ্যেই সমগ্র উত্তরবঙ্গের নি¤œমধ্যবিত্ত মানুষের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে শীতের আগমন থেকে শেষান্ত পর্যন্ত সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁওসহ জেলাসমূহ থেকে বাস, মাইক্রোবাস ভাড়া করে মানুষ ছুটে আসে স্বপ্নপুরীতে।

নির্মল পরিবেশে প্রিয়জনদের সঙ্গে নিজেদেরকে একাত্ম করার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে চলেছে স্বপ্নপুরী। দূরদূরান্ত থেকে আসা সাধারণ মানুষের হৃদয়কে উদীপ্ত করতে গড়ে তোলা হয়েছে চিড়িয়াখানা, বৈচিত্র্যময় ফুলের বাগান, কৃত্রিম হ্রদ, বর্ণিল মাছের সমাহার, রাইডসসহ জাদুর গ্যালারী। এ ছাড়া রয়েছে রেস্টহাউস, পিকনিক স্পট। এর উদ্যোক্তারা স্বপ্নের পরিধিকে প্রসারিত করতেই হয়তো দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন অপেক্ষাকৃত দুর্বল আদিবাসী সাঁওতাল-মাহালীদের ভূমির দিকে। আদিবাসীদের পৈত্রিক সম্পত্তির দলিল-দস্তাবেজকে ক্ষমতার দাপটে কিংবা অর্থের জোরে ওলট-পালট করে দিয়েছেন। ভূমিপুত্র আদিবাসীদেরকে উচ্ছেদ করে স্বপ্নের স্বপ্নপূরীর ষোলকলা পূর্ণ করতে বিনোদন কেন্দ্র বর্ধিতকরণে কী সামান্যতম বিবেক তাদের কাজ করে না!

আদিবাসীরা বুকে বল ও সাহস নিয়ে হাজির হয়েছিলেন দিনাজপুর প্রেসক্লাবে। ক্ষমতাসীন একজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করা সত্যিই দুরূহ কাজ, আর সেই কাজটিই করেছে স্বপ্নপুরী পাশর্^বর্তী জমির মালিকেরা। সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর অনেকেই মিডিয়ার সামনে নিজেদের বেদনার কাহিনী তুলে ধরেছেন। লিখিত বক্তব্যে উঠে এসেছেÑদিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় স্বপ্নপুরী নামের বিনোদনকেন্দ্রে সাঁওতাল ও মাহালী সম্প্রদায়ের তিনটি কবরস্থানের দখলের খবর। আর এখন সাঁওতালদের হুমকি, ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দাখিল করলেও প্রশাসন নির্বিকার; দায়িত্বরতদের যেন চোখ-কান-মুখ কিছুই নেই। বরং উল্টো নির্যাতনের কৌশল বদলায়, বেগবান হয়; আদিবাসীরা তটস্ত হয়ে পড়ে।

বিগত ৬ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে গণেশ হেমব্রম অভিযোগ করেছেন, তার ২০ দশমিক ৫৬ একর জমি দখলা করা হয়েছে। এরমধ্যে ৩৩ শতক কবরস্থান, ২৮ শতকে কালীমন্দির ও পূজাপাঠের স্থান এবং ২ একর জমিতে পুকুর তৈরি করে দখল করা হয়েছে। খুকুমনি হেমব্রমের ২ দশমিক ৩২ একর জমি ও তাঁর বাড়িঘর দখল করা হয়েছে। খালিপপুর মৌজায় লুইস হাঁসদার ১ দশমিক ৬১ একর জমি দখল করে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া রবিন মার্ডীর ২১ দশমিক ৮ একর জমি দখল করা হয়েছে, যার অধিকাংশ জমি স্বপ্নপুরীর সীমানার মধ্যে রয়েছে। এসব জমি নিয়ে আদালতে একাধিক মামলাও চলমান।

চোখের জলে ভয়ার্ত কণ্ঠে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উকিল হেমব্রম রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে জানাচ্ছিলেন, তাঁর ৩৩ শতাংশ জমির মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন। বাকি সব বেদখল হয়ে গেছে। গ্রামের কেউ-ই ভয়ে কথা বলতে পারেন না। এ ছাড়া স্বপ্নপুরী বিনোদনকেন্দ্রের ময়লা সাঁওতালদের কবরস্থানে ফেলা হয়। একমাসের বেশি সময় ধরে তিনি নিজ বাড়িতে যেতে পারছেন না। উকিল হেমব্রম জোর দিয়েই বলেছেন, ‘যেসব জমি দখল করা হয়েছে, তার প্রমাণ তাঁদের কাছে আছে।’ অভিযোগের প্রতুত্তরে উক্ত সংসদ সদস্য সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘তিনি নিজে কোনো বাড়ি করেননি এবং চাচার বাড়িতে থাকেন বলে জানান।’ তিনি আরো জানান, ‘প্রায়ই তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হয়। কিন্তু এসব নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট মামলাও নেই।’

আদিবাসী সাঁওতালদের দিনাজপুরের রাজপথে মানববন্ধন, জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন সত্যিই একটু হলেও আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। একমাত্র জমির কাগজপত্রের নির্ভুলতাই প্রমাণ করে সত্যিকারের ভূমির মালিকানা। অতীতে দেখা গেছে, আদিবাসীদের আক্রমন, উচ্ছেদ, জবরদখলের শিকার হলে সচেতন নাগরিক সমাজ বেরিয়ে আসতেন, এখন আমাদের বিবেক অসাড় হয়ে গেছে। আদিবাসীরা সংখ্যালঘুর চেয়েও সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। আদিবাসীদের জমি জায়গা টার্গেট করেই দখল করা হচ্ছে প্রতিনিয়তই। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে নিরীহ আদিবাসীদের সহায় সম্পত্তি গ্রহণ করা নৈতিকতার পরিপন্থী।

[লেখক : কলামিস্ট]

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৬ আশ্বিন ১৪২৯ ২৪ সফর ১৪৪৪

দিনাজপুরে সাঁওতালদের স্বপ্নভঙ্গ

মিথুশিলাক মুরমু

একজন আইন প্রণেতার বিরুদ্ধে অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া সাঁওতালদের জমি দখল করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। তবে হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও আদিবাসীরা ক্ষীণ কণ্ঠেই জানান দিয়েছেন, রক্ষকই ভক্ষক।

বিনোদনকেন্দ্র ‘স্বপ্নপুরী’র অবস্থান দিনাজপুর জেলা থেকে প্রায় ৫২ কিলোমিটার দক্ষিণে আফতাবগঞ্জ উপজেলাধীন। উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরদিকে ৯ নং কুশদহ ইউনিয়ন পরিষদের অধীন খালিপপুর মৌজার মধ্যে অবস্থিত। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে একান্ত ব্যক্তিতগত উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন এই পার্কটি। ১৫০ একর জমির ওপর নির্মিত নান্দনিক সৌন্দর্যের এক স্বপ্নিল জগত স্বপ্নপুরী। ইতোমধ্যেই সমগ্র উত্তরবঙ্গের নি¤œমধ্যবিত্ত মানুষের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে শীতের আগমন থেকে শেষান্ত পর্যন্ত সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁওসহ জেলাসমূহ থেকে বাস, মাইক্রোবাস ভাড়া করে মানুষ ছুটে আসে স্বপ্নপুরীতে।

নির্মল পরিবেশে প্রিয়জনদের সঙ্গে নিজেদেরকে একাত্ম করার মাধ্যম হিসেবে কাজ করে চলেছে স্বপ্নপুরী। দূরদূরান্ত থেকে আসা সাধারণ মানুষের হৃদয়কে উদীপ্ত করতে গড়ে তোলা হয়েছে চিড়িয়াখানা, বৈচিত্র্যময় ফুলের বাগান, কৃত্রিম হ্রদ, বর্ণিল মাছের সমাহার, রাইডসসহ জাদুর গ্যালারী। এ ছাড়া রয়েছে রেস্টহাউস, পিকনিক স্পট। এর উদ্যোক্তারা স্বপ্নের পরিধিকে প্রসারিত করতেই হয়তো দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন অপেক্ষাকৃত দুর্বল আদিবাসী সাঁওতাল-মাহালীদের ভূমির দিকে। আদিবাসীদের পৈত্রিক সম্পত্তির দলিল-দস্তাবেজকে ক্ষমতার দাপটে কিংবা অর্থের জোরে ওলট-পালট করে দিয়েছেন। ভূমিপুত্র আদিবাসীদেরকে উচ্ছেদ করে স্বপ্নের স্বপ্নপূরীর ষোলকলা পূর্ণ করতে বিনোদন কেন্দ্র বর্ধিতকরণে কী সামান্যতম বিবেক তাদের কাজ করে না!

আদিবাসীরা বুকে বল ও সাহস নিয়ে হাজির হয়েছিলেন দিনাজপুর প্রেসক্লাবে। ক্ষমতাসীন একজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করা সত্যিই দুরূহ কাজ, আর সেই কাজটিই করেছে স্বপ্নপুরী পাশর্^বর্তী জমির মালিকেরা। সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর অনেকেই মিডিয়ার সামনে নিজেদের বেদনার কাহিনী তুলে ধরেছেন। লিখিত বক্তব্যে উঠে এসেছেÑদিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় স্বপ্নপুরী নামের বিনোদনকেন্দ্রে সাঁওতাল ও মাহালী সম্প্রদায়ের তিনটি কবরস্থানের দখলের খবর। আর এখন সাঁওতালদের হুমকি, ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দাখিল করলেও প্রশাসন নির্বিকার; দায়িত্বরতদের যেন চোখ-কান-মুখ কিছুই নেই। বরং উল্টো নির্যাতনের কৌশল বদলায়, বেগবান হয়; আদিবাসীরা তটস্ত হয়ে পড়ে।

বিগত ৬ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে গণেশ হেমব্রম অভিযোগ করেছেন, তার ২০ দশমিক ৫৬ একর জমি দখলা করা হয়েছে। এরমধ্যে ৩৩ শতক কবরস্থান, ২৮ শতকে কালীমন্দির ও পূজাপাঠের স্থান এবং ২ একর জমিতে পুকুর তৈরি করে দখল করা হয়েছে। খুকুমনি হেমব্রমের ২ দশমিক ৩২ একর জমি ও তাঁর বাড়িঘর দখল করা হয়েছে। খালিপপুর মৌজায় লুইস হাঁসদার ১ দশমিক ৬১ একর জমি দখল করে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া রবিন মার্ডীর ২১ দশমিক ৮ একর জমি দখল করা হয়েছে, যার অধিকাংশ জমি স্বপ্নপুরীর সীমানার মধ্যে রয়েছে। এসব জমি নিয়ে আদালতে একাধিক মামলাও চলমান।

চোখের জলে ভয়ার্ত কণ্ঠে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উকিল হেমব্রম রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে জানাচ্ছিলেন, তাঁর ৩৩ শতাংশ জমির মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন। বাকি সব বেদখল হয়ে গেছে। গ্রামের কেউ-ই ভয়ে কথা বলতে পারেন না। এ ছাড়া স্বপ্নপুরী বিনোদনকেন্দ্রের ময়লা সাঁওতালদের কবরস্থানে ফেলা হয়। একমাসের বেশি সময় ধরে তিনি নিজ বাড়িতে যেতে পারছেন না। উকিল হেমব্রম জোর দিয়েই বলেছেন, ‘যেসব জমি দখল করা হয়েছে, তার প্রমাণ তাঁদের কাছে আছে।’ অভিযোগের প্রতুত্তরে উক্ত সংসদ সদস্য সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘তিনি নিজে কোনো বাড়ি করেননি এবং চাচার বাড়িতে থাকেন বলে জানান।’ তিনি আরো জানান, ‘প্রায়ই তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হয়। কিন্তু এসব নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট মামলাও নেই।’

আদিবাসী সাঁওতালদের দিনাজপুরের রাজপথে মানববন্ধন, জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন সত্যিই একটু হলেও আমাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। একমাত্র জমির কাগজপত্রের নির্ভুলতাই প্রমাণ করে সত্যিকারের ভূমির মালিকানা। অতীতে দেখা গেছে, আদিবাসীদের আক্রমন, উচ্ছেদ, জবরদখলের শিকার হলে সচেতন নাগরিক সমাজ বেরিয়ে আসতেন, এখন আমাদের বিবেক অসাড় হয়ে গেছে। আদিবাসীরা সংখ্যালঘুর চেয়েও সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। আদিবাসীদের জমি জায়গা টার্গেট করেই দখল করা হচ্ছে প্রতিনিয়তই। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে নিরীহ আদিবাসীদের সহায় সম্পত্তি গ্রহণ করা নৈতিকতার পরিপন্থী।

[লেখক : কলামিস্ট]