যানজট : অর্থনীতির নীরব ঘাতক

মিহির কুমার রায়

ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৪.২ শতাংশ; যা এশিয়া মহাদেশে সর্বোচ্চ। ১৯৭৪ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২০ লাখ আর ২০২১ সালনাগাদ এই মহানগরের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি। চীনের বৃহত্তম সাংহাই শহরে সে দেশের জনসংখ্যার মাত্র ১.৮ শতাংশ বাস করে। প্রতিবেশী ভারতের প্রধান শহরে জনসংখ্যার ২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৪ শতাংশ, পাকিস্তানে ৮.৯ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে ৮.১ শতাংশ বাস করে। অথচ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১১.২ শতাংশই বাস করে ঢাকায়Ñ যা এই অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ।

মাত্র ১৬০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকা এত বিপুল লোকসংখ্যার চাপ সইতে পারছে না। ব্যবসা, বাণিজ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার সন্ধানে ক্রমাগতভাবে জনসংখ্যার আগমন এ শহরের জন্যসেবা তথা অবকাঠামো খাতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জর জন্ম দিয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো যানজট। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সড়কের প্রসার না হওয়ায় যানবাহনের বিশাল বহর জানজটের সৃষ্টি করছে। তাছাড়াও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা বাড়িঘর, হাটবাজার, অপর্যাপ্ত ও অনুন্নত সড়ক ব্যবস্থা,অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি পার্কিং ওভার ব্রিজসহ আন্ডারপাসের অপ্রতুলতা যানজটের প্রধান কারন।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের এক সেমিনারে বলা হয়, যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতি বছর আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে আনুমানিক ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ২৫-৪২ হাজার কোটি টাকা। বলার অপেক্ষা রাখে না, সীমিত সড়ক ও যানবাহনের আধিক্যই মাত্রাতিরিক্ত যানজটের অন্যতম কারণ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, যানজটের কারণে রাজধানীতে গাড়ির গতি এবং মানুষের হাঁটার গতি প্রায় সমান। সড়ক খাতে বিনিয়োগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং যানজট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এ ক্ষতির অন্তত ৬০ শতাংশ বা ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।

ঢাকা শহরে যানবাহন চলচলের জন্য বর্তমানে রাস্তা রয়েছে ২২৫০ কিলোমিটার। যার মধ্যে এক লেনের রাস্তা ৩৮৬ কিলোমিটার, দুই লেনর রাস্তা ১৪০৮ কিলোমিটার, চার লেনের রাস্তা ৪৩৪ কিলোমিটার। এসব রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন যন্ত্রচালিত যানবাহনর চলচল করে ৫ লাখ ২৭ হাজার।

যানজট ঠেকাতে শহরের চারটি ট্রাফিক ডিভিশনের ৩ হাজারের বেশি ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। দুই সহস্রাধিক ট্রাফিক কর্মকতার সঙ্গে অধিক সংখ্যক আনসার সদস্য-কমিউনিটি পুলিশ নিরলস কাজ করার পরও যানজটের তেমন কোন সুফল আসেনি। রাজধানীর তেরটি পয়েন্টে ফোর লেন পদ্ধতি চালু ও ট্রাফিক পুলিশের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির পদক্ষেপও তেমন কোন সহায়ক ভূমিকা পালন করেনি। তারপরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত ও ব্যাংকের সময়সূচি পরিবর্তন করেও যানজট নিরসনের চেষ্টা করা হয়েছে। শহরকে সাতটি অঞ্চলে ভাগ করে মার্কেটসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করেও কোন সুফল আসেনি। শহরের বাকি অংশে লাঠি ও ট্রাফিক পুলিশের বাঁশি দ্বারা যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কাজ চলছে।

শহরের জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ ব্যক্তি গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে থাকে এবং বাকি সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসা ১০০ থেকে ২০০ সংস্থার বাস সার্ভিস তথা গণপরিবহন। বিশেষজ্ঞগনের মতে এক একটি কোম্পানিকে একেকটি রুটের বাস পরিচালনার দায়িত্ব দিলে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা তথা সেবার মান আরও বাড়বে। ঢাকা মহানগরীর গণপরিবহন লক্ষ্যে একটিমাত্র পরিবহন সংস্থা গঠন করা দরকার। দেশের যানবাহনের মাত্র ০.১ শতাংশ বাস বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসি) পরিচালনা কারে যাদের সংখ্যা এক হাজার আর ট্রাকের সংখ্যা একশত পঞ্চাশটি। কাজেই প্রাইভেট বাস সাভিস নিয়ন্ত্রণ এবং বেশি সংখ্যক পাবলিক বাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে না পারলে যানজট কমানো সম্ভব না।

এ যানজটের গতি-প্রকৃতি নিয়ে অনেক লেখা লেখি, টকশো, জনজীবনের দুর্ভোগ, ইত্যাদি প্রচারিত হলেও এর কোন সমাধান স্থায়ী যাচ্ছে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি গবেষণায় দেখা যায়Ñ ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমানো গেলে প্রতি বছর ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব হতো। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদেন বলছেÑ যানজটের ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় এবং বিগত দশ বছরের ঢাকায় প্রতিদিনে যান চলাচল গতিবেগ ২১ কিলোমিটার থেকে ৭ কিলোমিটার নেমে এসেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছেÑ বিশ্বের অন্যতম এই ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ১৯৯৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার হয়েছে ৫০ শতাংশ, রাস্তাঘাট বেড়েছে ৫ শতাংশ আর যান চলাচল বেড়েছে ১৩৪ শতাংশ।

সুষ্ঠুভাবে যান চলাচল করতে যে কোন শহরের মোট আয়তনের যেখানে ২০ শতাংশ রাস্তা থাকা প্রয়োজন সেখানে ঢাকা শহরে আছে মাত্র ৭-৮ শতাংশের কাছাকাছি। উন্নয়ন কার্যক্রম ও সড়ক অবকাঠামো অপর্যাপ্ততায় রাজধানীর যানজট ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতিতেও এর প্রভাব এখন ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনেও উঠে আসছে, অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণের কারণ হয়ে উঠছে অতিমাত্রায় যানজট। সর্বশেষ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) চলমান সম্মেলনে উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, শুধু রাজধানীর যানজটের কারণেই প্রতি বছর প্রত্যক্ষ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় আড়াই শতাংশে। পরোক্ষ লোকসান যুক্ত হলে এ ক্ষতি পৌঁছায় ৬ শতাংশের কাছাকাছিতে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ ঢাকার যানজটের কারণে দেশের জিডিপিতে প্রতি বছর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ দশমিক ৫ শতাংশে। পরোক্ষ ক্ষতি যোগ করে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশে। অর্থনীতির এ ক্ষতকে আরো গভীর করে তুলেছে রাজধানীর অপরিকল্পিত নগরায়ণ। শুধু এ কারণেই ক্ষতি হয় জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ।

যানজটের পেছনে ঢাকার দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগ অবকাঠামো দায়ী। ঢাকা শহরের রাস্তাগুলোয় যে পরিমাণ গাড়ি চলাচলের ক্ষমতা, বাস্তবে গাড়ি চলাচল করে তার ৩০-৪০ শতাংশ বেশি। ঢাকায় যত যানজট হয়, তার ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী পার্কিং ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা। পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন নতুন অবকাঠামো গড়ে উঠছে। কিন্তু সেগুলোর ব্যবস্থাপনা ভালো নয়। ব্যবস্থাপনা ভালো না হলে যতই অবকাঠামো গড়ে তোলা হোক না কেন তার পূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে না। ঢাকার পরিবহন ও পরিবহন সম্পর্কিত অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছে।

এসব সমস্যা নিরসনে নীতি-নির্ধারকদের উদ্দেশে অর্থনৈতিক কমিশন গঠনের মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া চালুর সুপারিশ করেছেন অনেক গবেষক। তাদের ভাষ্যমতে, নগর প্রশাসনের হাতে নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা দেয়া প্রয়োজন। এছাড়া বিকেন্দ্রীকরণ-সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে ঢাকার সঠিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা, পথচারীবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা, উন্নত গণপরিবহন প্রবর্তন, গণপরিবহনের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ, পার্কিং ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারীদেরও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

তাছাড়া ফুটপাত দখলম্ুক্ত করা ও অবৈধ স্থাপনা ভেঙে সড়কে যান চলাচলের পথ সুগম করতে হবে। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বন্ধ করতে হবে, পর্যাপ্ত সংখ্যক আন্ডারপাস ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করে তা জনগণকে ব্যবহারের উপযুক্ত করলে যানজট নিরসন সম্ভব হবে। মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পর্যায়ক্রমে এলিভেটেড টাওয়ার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হলে যে অর্থ ব্যয় হবে তা যানজটের ফলে নষ্ট হওয়া শ্রম বাঁচিয়ে দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে।

ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ডিটিসিএ রাজউক সিসিএস এলজিইডি ও বিআরটিসির মধ্যে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সড়ক পরিবহন খাতে দুর্নীতি ও নৈরাজ্য প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স অব্যাহত রাখতে পারলে ঢাকা মহানগরীর যানজট অনেকাংশে কমে আসবে। ঢাকার নগরায়ণ কেন্দ্র থেকে প্রথমে উত্তরে, তারপর পশ্চিমে সম্প্রসারণ হয়েছে। পূর্বদিকের বেশির ভাগ এলাকা এখনো গ্রামীণ। এসব এলাকার দ্রুত উন্নয়ন ও বিকাশের সুযোগ রয়েছে। যথাযথ পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পূর্ব ঢাকাকে প্রাণচঞ্চল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে রাজধানী যানজট, বন্যা ও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে।

[লেখক : গবেষক]

শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ০৭ আশ্বিন ১৪২৯ ২৫ সফর ১৪৪৪

যানজট : অর্থনীতির নীরব ঘাতক

মিহির কুমার রায়

image

যানজটে ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়

ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৪.২ শতাংশ; যা এশিয়া মহাদেশে সর্বোচ্চ। ১৯৭৪ সালে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২০ লাখ আর ২০২১ সালনাগাদ এই মহানগরের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি। চীনের বৃহত্তম সাংহাই শহরে সে দেশের জনসংখ্যার মাত্র ১.৮ শতাংশ বাস করে। প্রতিবেশী ভারতের প্রধান শহরে জনসংখ্যার ২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৪ শতাংশ, পাকিস্তানে ৮.৯ শতাংশ এবং ভিয়েতনামে ৮.১ শতাংশ বাস করে। অথচ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১১.২ শতাংশই বাস করে ঢাকায়Ñ যা এই অঞ্চলের মধ্যে সর্বোচ্চ।

মাত্র ১৬০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ঢাকা এত বিপুল লোকসংখ্যার চাপ সইতে পারছে না। ব্যবসা, বাণিজ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার সন্ধানে ক্রমাগতভাবে জনসংখ্যার আগমন এ শহরের জন্যসেবা তথা অবকাঠামো খাতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জর জন্ম দিয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো যানজট। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সড়কের প্রসার না হওয়ায় যানবাহনের বিশাল বহর জানজটের সৃষ্টি করছে। তাছাড়াও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা বাড়িঘর, হাটবাজার, অপর্যাপ্ত ও অনুন্নত সড়ক ব্যবস্থা,অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি পার্কিং ওভার ব্রিজসহ আন্ডারপাসের অপ্রতুলতা যানজটের প্রধান কারন।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের এক সেমিনারে বলা হয়, যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতি বছর আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে আনুমানিক ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ২৫-৪২ হাজার কোটি টাকা। বলার অপেক্ষা রাখে না, সীমিত সড়ক ও যানবাহনের আধিক্যই মাত্রাতিরিক্ত যানজটের অন্যতম কারণ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, যানজটের কারণে রাজধানীতে গাড়ির গতি এবং মানুষের হাঁটার গতি প্রায় সমান। সড়ক খাতে বিনিয়োগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং যানজট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এ ক্ষতির অন্তত ৬০ শতাংশ বা ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।

ঢাকা শহরে যানবাহন চলচলের জন্য বর্তমানে রাস্তা রয়েছে ২২৫০ কিলোমিটার। যার মধ্যে এক লেনের রাস্তা ৩৮৬ কিলোমিটার, দুই লেনর রাস্তা ১৪০৮ কিলোমিটার, চার লেনের রাস্তা ৪৩৪ কিলোমিটার। এসব রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন যন্ত্রচালিত যানবাহনর চলচল করে ৫ লাখ ২৭ হাজার।

যানজট ঠেকাতে শহরের চারটি ট্রাফিক ডিভিশনের ৩ হাজারের বেশি ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। দুই সহস্রাধিক ট্রাফিক কর্মকতার সঙ্গে অধিক সংখ্যক আনসার সদস্য-কমিউনিটি পুলিশ নিরলস কাজ করার পরও যানজটের তেমন কোন সুফল আসেনি। রাজধানীর তেরটি পয়েন্টে ফোর লেন পদ্ধতি চালু ও ট্রাফিক পুলিশের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির পদক্ষেপও তেমন কোন সহায়ক ভূমিকা পালন করেনি। তারপরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত ও ব্যাংকের সময়সূচি পরিবর্তন করেও যানজট নিরসনের চেষ্টা করা হয়েছে। শহরকে সাতটি অঞ্চলে ভাগ করে মার্কেটসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করেও কোন সুফল আসেনি। শহরের বাকি অংশে লাঠি ও ট্রাফিক পুলিশের বাঁশি দ্বারা যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কাজ চলছে।

শহরের জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ ব্যক্তি গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে থাকে এবং বাকি সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসা ১০০ থেকে ২০০ সংস্থার বাস সার্ভিস তথা গণপরিবহন। বিশেষজ্ঞগনের মতে এক একটি কোম্পানিকে একেকটি রুটের বাস পরিচালনার দায়িত্ব দিলে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা তথা সেবার মান আরও বাড়বে। ঢাকা মহানগরীর গণপরিবহন লক্ষ্যে একটিমাত্র পরিবহন সংস্থা গঠন করা দরকার। দেশের যানবাহনের মাত্র ০.১ শতাংশ বাস বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন (বিআরটিসি) পরিচালনা কারে যাদের সংখ্যা এক হাজার আর ট্রাকের সংখ্যা একশত পঞ্চাশটি। কাজেই প্রাইভেট বাস সাভিস নিয়ন্ত্রণ এবং বেশি সংখ্যক পাবলিক বাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে না পারলে যানজট কমানো সম্ভব না।

এ যানজটের গতি-প্রকৃতি নিয়ে অনেক লেখা লেখি, টকশো, জনজীবনের দুর্ভোগ, ইত্যাদি প্রচারিত হলেও এর কোন সমাধান স্থায়ী যাচ্ছে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি গবেষণায় দেখা যায়Ñ ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমানো গেলে প্রতি বছর ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় সম্ভব হতো। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদেন বলছেÑ যানজটের ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় এবং বিগত দশ বছরের ঢাকায় প্রতিদিনে যান চলাচল গতিবেগ ২১ কিলোমিটার থেকে ৭ কিলোমিটার নেমে এসেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছেÑ বিশ্বের অন্যতম এই ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ১৯৯৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার হয়েছে ৫০ শতাংশ, রাস্তাঘাট বেড়েছে ৫ শতাংশ আর যান চলাচল বেড়েছে ১৩৪ শতাংশ।

সুষ্ঠুভাবে যান চলাচল করতে যে কোন শহরের মোট আয়তনের যেখানে ২০ শতাংশ রাস্তা থাকা প্রয়োজন সেখানে ঢাকা শহরে আছে মাত্র ৭-৮ শতাংশের কাছাকাছি। উন্নয়ন কার্যক্রম ও সড়ক অবকাঠামো অপর্যাপ্ততায় রাজধানীর যানজট ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। দেশের সার্বিক অর্থনীতিতেও এর প্রভাব এখন ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনেও উঠে আসছে, অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণের কারণ হয়ে উঠছে অতিমাত্রায় যানজট। সর্বশেষ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) চলমান সম্মেলনে উপস্থাপিত এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, শুধু রাজধানীর যানজটের কারণেই প্রতি বছর প্রত্যক্ষ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় আড়াই শতাংশে। পরোক্ষ লোকসান যুক্ত হলে এ ক্ষতি পৌঁছায় ৬ শতাংশের কাছাকাছিতে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ ঢাকার যানজটের কারণে দেশের জিডিপিতে প্রতি বছর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২ দশমিক ৫ শতাংশে। পরোক্ষ ক্ষতি যোগ করে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশে। অর্থনীতির এ ক্ষতকে আরো গভীর করে তুলেছে রাজধানীর অপরিকল্পিত নগরায়ণ। শুধু এ কারণেই ক্ষতি হয় জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ।

যানজটের পেছনে ঢাকার দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগ অবকাঠামো দায়ী। ঢাকা শহরের রাস্তাগুলোয় যে পরিমাণ গাড়ি চলাচলের ক্ষমতা, বাস্তবে গাড়ি চলাচল করে তার ৩০-৪০ শতাংশ বেশি। ঢাকায় যত যানজট হয়, তার ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী পার্কিং ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা। পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন নতুন অবকাঠামো গড়ে উঠছে। কিন্তু সেগুলোর ব্যবস্থাপনা ভালো নয়। ব্যবস্থাপনা ভালো না হলে যতই অবকাঠামো গড়ে তোলা হোক না কেন তার পূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে না। ঢাকার পরিবহন ও পরিবহন সম্পর্কিত অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়ে গেছে।

এসব সমস্যা নিরসনে নীতি-নির্ধারকদের উদ্দেশে অর্থনৈতিক কমিশন গঠনের মাধ্যমে বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়া চালুর সুপারিশ করেছেন অনেক গবেষক। তাদের ভাষ্যমতে, নগর প্রশাসনের হাতে নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা দেয়া প্রয়োজন। এছাড়া বিকেন্দ্রীকরণ-সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে ঢাকার সঠিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা, পথচারীবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা, উন্নত গণপরিবহন প্রবর্তন, গণপরিবহনের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ, পার্কিং ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারীদেরও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

তাছাড়া ফুটপাত দখলম্ুক্ত করা ও অবৈধ স্থাপনা ভেঙে সড়কে যান চলাচলের পথ সুগম করতে হবে। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং বন্ধ করতে হবে, পর্যাপ্ত সংখ্যক আন্ডারপাস ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করে তা জনগণকে ব্যবহারের উপযুক্ত করলে যানজট নিরসন সম্ভব হবে। মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পর্যায়ক্রমে এলিভেটেড টাওয়ার পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হলে যে অর্থ ব্যয় হবে তা যানজটের ফলে নষ্ট হওয়া শ্রম বাঁচিয়ে দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে।

ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ডিটিসিএ রাজউক সিসিএস এলজিইডি ও বিআরটিসির মধ্যে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। সড়ক পরিবহন খাতে দুর্নীতি ও নৈরাজ্য প্রতিরোধের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স অব্যাহত রাখতে পারলে ঢাকা মহানগরীর যানজট অনেকাংশে কমে আসবে। ঢাকার নগরায়ণ কেন্দ্র থেকে প্রথমে উত্তরে, তারপর পশ্চিমে সম্প্রসারণ হয়েছে। পূর্বদিকের বেশির ভাগ এলাকা এখনো গ্রামীণ। এসব এলাকার দ্রুত উন্নয়ন ও বিকাশের সুযোগ রয়েছে। যথাযথ পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পূর্ব ঢাকাকে প্রাণচঞ্চল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে রাজধানী যানজট, বন্যা ও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে।

[লেখক : গবেষক]