জি কে শামীমসহ ৮ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

ক্যাসিনোকান্ডে আলোচনায় আসা ঠিকাদার জি কে শামীম ও তার সাত দেহরক্ষীকে একটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছে আদালত। গতকাল দুপুরে ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শেখ ছামিদুলের আদালত এ রায় ঘোষণা করে। যাবজ্জীবন কারাদন্ড পাওয়া অন্য আসামিরা হলো জি কে শামীমের সহযোগী সাত দেহরক্ষী মো. জাহিদুল ইসালাম, মো. শহিদুল ইসলাম, মো. কামাল হোসেন, মো. সামসাদ হোসেন, মো. আমিনুল ইসলাম, মো. দেলোয়ার হোসেন ও মো. মুরাদ হোসেন।

এই মামলাকে ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বলে দাবি করেছেন জি কে শামীম। রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে তাকে পুলিশ পাহারায় কারাগারে নেয়ার পথে সাংবাদিকরা ছবি তুলছিলেন। এ সময় তিনি বলেন, এ মামলা অবশ্যই ষড়যন্ত্র। একটি স্বার্থান্বেষী মহলের গভীর চক্রান্ত। এ সময় দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে আর কোন কথা বলতে নিষেধ করেন। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় তাদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর তাদের আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে তাদের আদালতের কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর অস্ত্র মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে র‌্যাব। ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি একই আদালত আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে অভিযোগ গঠন করেন। ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে রাজধানীর নিকেতনে শামীমের বাসা ও অফিসে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে আটটি আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল পরিমাণ গুলি, ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর এবং নগদ প্রায় ১ কোটি ৮১ লাখ টাকা, বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা এবং মদ জব্দ করে। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনে তিনটি মামলা করা হয়। মামলার এজাহারে শামীমকে চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, অবৈধ মাদক ও জুয়া ব্যবসায়ী বলে উল্লেখ করা হয়। একই বছরের ২৭ অক্টোবর আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১ এর উপপরিদর্শক শেখর চন্দ্র মল্লিক অস্ত্র মামলায় তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। এই তিনটি মামলার মধ্যে গতকাল অস্ত্র মামলার ঘোষণা করে আদালত।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামি আমিনুল ইসলাম জামালপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে ডকুমেন্ট দেখালেও তা যাচাইয়ে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে ওই অস্ত্রের নকল কাগজপত্র নিয়ে ২০১৭ সালে প্রথমে এসএম বিল্ডার্স কোম্পানিতে যোগদান করেন।

পরে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি তিনি জি কে শামীমের দেহরক্ষী হিসেবে যোগদান করে কাজ করেন। তিনি মূলত অবৈধ অস্ত্রটি ৭০ হাজার টাকায় ক্রয় করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করেন। এছাড়া অন্য আসামিরা নিরাপত্তার অজুহাতে অস্ত্রের লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলেও তারা শর্ত ভঙ্গ করে অস্ত্র প্রকাশ্যে বহন, প্রদর্শন ও ব্যবহার করে লোকজনের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ও জুয়ার ব্যবসা করে স্বনামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদকে গ্রেপ্তারের পর জি কে শামীমের নাম উঠে আসে। তিনি অস্ত্রধারী দেহরক্ষী বেষ্টিত হয়ে সবসময় চলাফেরা করতেন। ছোটখাটো মানুষ হলেও শামীমের ক্ষমতার দাপট ছিল আকাশসমান। রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় জি কে শামীম প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত। গণপূর্ত ভবনের বেশিরভাগ ঠিকাদারি কাজই জি কে শামীম নিয়ন্ত্রণ করেন। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলেও গণপূর্তে শামীম ছিলেন ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি।

যুবদল থেকে যুবলীগ

এক সময়ের যুবদল নেতা ক্ষমতার পরিবর্তনে হয়ে যান যুবলীগ নেতা। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিও তিনি। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সন্মানদী ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়া গ্রামের মৃত মো. আফসার উদ্দিন মাস্টারের ছেলে শামীম। আফসার উদ্দিন মাস্টার ছিলেন হরিহরদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিন ছেলের মধ্যে জি কে শামীম মেজো। তিনি একসময় বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ক্যাডার ছিলেন। বিএনপির আমলে জি কে শামীমের ভয়ে মতিঝিল, পল্টন, শান্তিনগরের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়িয়েছেন। সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি ছিল তার পেশা। ওই সময় মির্জা আব্বাসের ডানহাত হিসেবে গণপূর্ত ভবনের সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও তিনি বহাল তবিয়তে ওই ভবন নিয়ন্ত্রণ করতেন আন্ডার ওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে। জীবনের ভয়ে অনেক আওয়ামী লীগের ঠিকাদার ওই ভবন ছেড়ে পালান। বাংলাদেশের সব ঠিকাদারকে গণপূর্তে কাজ করতে হলে তাকে বলে কাজ করতে হতো। বাংলাদেশের প্রথম সারির (১-২০) সব ঠিকাদার তার বাইরে ভয়ে কথা বলার সাহস পান না। এক অর্থে বলা যায়, গণপূর্ত ভবনের মালিকই তিনি।

কেন্দ্রীয় যুবলীগের নেতা হয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সারাদেশের কনস্ট্রাকশনের যত বড় বড় কাজ হয় সব কাজ তার নির্বাচিত ঠিকাদরি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ করতে পারতেন না। যদি কেউ জি কে শামীমকে না জানিয়ে দরপত্র ক্রয় করতেন তবে তার পরিণাম হতো ভয়ঙ্কর। ওই প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রধারী তার ক্যাডার বাহিনী শুধু হামলাই করত না, প্রয়োজনে তাদের মেরেও ফেলত। ৭ জন অস্ত্রধারী দেহরক্ষীর প্রটেকশনে চলতেন জি কে শামীম। সবার হাতেই শটগান। গায়ে বিশেষ সিকিউরিটি পোশাক। তাদের একেকজনের উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট। যাকে মাঝখানে রেখে তারা পাহারা দিতেন তিনি উচ্চতায় পাঁচ ফুটের কিছু বেশি।

জিকে শামীমের উত্থান

সন্মানদী ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানান, প্রাইমারি স্কুল ও হাইস্কুল পাস করার পর তাকে গ্রামে দেখা যায়নি। ঢাকার বাসাবো আর সবুজবাগ এলাকায় বড় হয়েছেন। গত জাতীয় নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনের জন্য প্রচারণাও চালিয়েছিলেন শামীম। বাসাবো ও এজিবি কলোনির কয়েকজন বাসিন্দা জানান, গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পর এজিবি কলোনি, হাসপাতাল জোন এবং মধ্য বাসাবোতেই পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন শামীম। ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের মাধ্যমেই তার রাজনীতি শুরু। পরবর্তী সময় মির্জা আব্বাসের ভাই মির্জা কালু ও মির্জা খোকনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় এবং তাদের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে গণপূর্ত ভবনের ঠিকাদারি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন।

ঢাকা মহানগর যুবদলের সহ-সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন। বিএনপি আমলে গণপূর্ত ভবন ছিল তার দখলে। একসময় মির্জা আব্বাস আর খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের ছবিসহ সবুজবাগ-বাসাবো এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শোভা পেত জি কে শামীমের ব্যানার-পোস্টার। এখন শোভা পায় যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ছবিসহ পোস্টার-ব্যানার। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিংবা যুবলীগের পার্টি অফিস, বিয়ে বাড়ি কিংবা বন্ধুর বাড়ি, যেখানেই তিনি যেতেন, সঙ্গে থাকত অস্ত্রধারী প্রটোকল বাহিনী। ভারী অস্ত্র নিয়ে ৭ জন নিরাপত্তারক্ষী আগে-পিছে পাহারা দিয়ে তাকে নিয়ে যেতেন।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন জি কে শামীম। বাসাবো এলাকায় পাঁচটি বাড়ি এবং একাধিক প্লট রয়েছে শামীমের। বাসাবোর কদমতলায় ১৭ নম্বরের পাঁচতলা বাড়িটি জি কে শামীমের। বাড়িটির ম্যানেজার হিসেবে দেখাশোনা করেন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. ইসমাইল হোসেন সর্দার। শামীম কয়েক বছর বাসাবোর ওই বাড়িতে বসবাস করলেও গ্রেপ্তারের আগে থাকতেন বনানীর ওল্ড ডিওএইচএসে নিজের ফ্ল্যাটে। নিজের কার্যালয় বানিয়ে বসতেন নিকেতন এলাকায় একটি ভবনে।

বাসাবোতে আরও রয়েছে তিনটি ভবন। ডেমরা ও দক্ষিণগাঁও ছাড়াও সোনারগাঁ উপজেলা, বান্দরবান ও গাজীপুরে কয়েকশ’ বিঘা জমি কিনেছেন তিনি। তবে যুবলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর জানায়, জি কে শামীম যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোন পদে নেই। অনুমোদিত কমিটির কোথাও জি কে শামীমের নাম নেই। কেউ যদি মুখে মুখে নিজেকে যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা বলে থাকেন সেটা তো হবে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতা বলেন, তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে আছেন। মূল কমিটি অনুমোদনের পর বেশ কয়েকজনকে সহ-সম্পাদক থেকে শুরু অনেক পদই দেয়া হয়েছে। আর আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক এস এম মেজবাহ হোসেন বুরুজ ২০১৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর মারা যাওয়ার পর শূন্য পদটি দেয়া হয়য় জি কে শামীমকে। শামীম ওই পদ ব্যবহার করে সাংগঠনিক কর্মকান্ড চালাতেন।

সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ১০ আশ্বিন ১৪২৯ ২৮ সফর ১৪৪৪

জি কে শামীমসহ ৮ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড

আদালত বার্তা পরিবেশক

image

ক্যাসিনোকান্ডে আলোচনায় আসা ঠিকাদার জি কে শামীম ও তার সাত দেহরক্ষীকে একটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছে আদালত। গতকাল দুপুরে ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শেখ ছামিদুলের আদালত এ রায় ঘোষণা করে। যাবজ্জীবন কারাদন্ড পাওয়া অন্য আসামিরা হলো জি কে শামীমের সহযোগী সাত দেহরক্ষী মো. জাহিদুল ইসালাম, মো. শহিদুল ইসলাম, মো. কামাল হোসেন, মো. সামসাদ হোসেন, মো. আমিনুল ইসলাম, মো. দেলোয়ার হোসেন ও মো. মুরাদ হোসেন।

এই মামলাকে ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বলে দাবি করেছেন জি কে শামীম। রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে তাকে পুলিশ পাহারায় কারাগারে নেয়ার পথে সাংবাদিকরা ছবি তুলছিলেন। এ সময় তিনি বলেন, এ মামলা অবশ্যই ষড়যন্ত্র। একটি স্বার্থান্বেষী মহলের গভীর চক্রান্ত। এ সময় দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে আর কোন কথা বলতে নিষেধ করেন। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় তাদের কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর তাদের আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে তাদের আদালতের কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর অস্ত্র মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে র‌্যাব। ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি একই আদালত আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে অভিযোগ গঠন করেন। ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে রাজধানীর নিকেতনে শামীমের বাসা ও অফিসে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে আটটি আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল পরিমাণ গুলি, ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর এবং নগদ প্রায় ১ কোটি ৮১ লাখ টাকা, বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা এবং মদ জব্দ করে। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনে তিনটি মামলা করা হয়। মামলার এজাহারে শামীমকে চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, অবৈধ মাদক ও জুয়া ব্যবসায়ী বলে উল্লেখ করা হয়। একই বছরের ২৭ অক্টোবর আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১ এর উপপরিদর্শক শেখর চন্দ্র মল্লিক অস্ত্র মামলায় তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। এই তিনটি মামলার মধ্যে গতকাল অস্ত্র মামলার ঘোষণা করে আদালত।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামি আমিনুল ইসলাম জামালপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে ডকুমেন্ট দেখালেও তা যাচাইয়ে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে ওই অস্ত্রের নকল কাগজপত্র নিয়ে ২০১৭ সালে প্রথমে এসএম বিল্ডার্স কোম্পানিতে যোগদান করেন।

পরে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি তিনি জি কে শামীমের দেহরক্ষী হিসেবে যোগদান করে কাজ করেন। তিনি মূলত অবৈধ অস্ত্রটি ৭০ হাজার টাকায় ক্রয় করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কাগজপত্র তৈরি করেন। এছাড়া অন্য আসামিরা নিরাপত্তার অজুহাতে অস্ত্রের লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলেও তারা শর্ত ভঙ্গ করে অস্ত্র প্রকাশ্যে বহন, প্রদর্শন ও ব্যবহার করে লোকজনের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ও জুয়ার ব্যবসা করে স্বনামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদকে গ্রেপ্তারের পর জি কে শামীমের নাম উঠে আসে। তিনি অস্ত্রধারী দেহরক্ষী বেষ্টিত হয়ে সবসময় চলাফেরা করতেন। ছোটখাটো মানুষ হলেও শামীমের ক্ষমতার দাপট ছিল আকাশসমান। রাজধানীর সবুজবাগ, বাসাবো, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় জি কে শামীম প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত। গণপূর্ত ভবনের বেশিরভাগ ঠিকাদারি কাজই জি কে শামীম নিয়ন্ত্রণ করেন। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলেও গণপূর্তে শামীম ছিলেন ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি।

যুবদল থেকে যুবলীগ

এক সময়ের যুবদল নেতা ক্ষমতার পরিবর্তনে হয়ে যান যুবলীগ নেতা। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতিও তিনি। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সন্মানদী ইউনিয়নের দক্ষিণপাড়া গ্রামের মৃত মো. আফসার উদ্দিন মাস্টারের ছেলে শামীম। আফসার উদ্দিন মাস্টার ছিলেন হরিহরদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিন ছেলের মধ্যে জি কে শামীম মেজো। তিনি একসময় বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ক্যাডার ছিলেন। বিএনপির আমলে জি কে শামীমের ভয়ে মতিঝিল, পল্টন, শান্তিনগরের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়িয়েছেন। সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজি ছিল তার পেশা। ওই সময় মির্জা আব্বাসের ডানহাত হিসেবে গণপূর্ত ভবনের সব টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও তিনি বহাল তবিয়তে ওই ভবন নিয়ন্ত্রণ করতেন আন্ডার ওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে। জীবনের ভয়ে অনেক আওয়ামী লীগের ঠিকাদার ওই ভবন ছেড়ে পালান। বাংলাদেশের সব ঠিকাদারকে গণপূর্তে কাজ করতে হলে তাকে বলে কাজ করতে হতো। বাংলাদেশের প্রথম সারির (১-২০) সব ঠিকাদার তার বাইরে ভয়ে কথা বলার সাহস পান না। এক অর্থে বলা যায়, গণপূর্ত ভবনের মালিকই তিনি।

কেন্দ্রীয় যুবলীগের নেতা হয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সারাদেশের কনস্ট্রাকশনের যত বড় বড় কাজ হয় সব কাজ তার নির্বাচিত ঠিকাদরি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউ করতে পারতেন না। যদি কেউ জি কে শামীমকে না জানিয়ে দরপত্র ক্রয় করতেন তবে তার পরিণাম হতো ভয়ঙ্কর। ওই প্রতিষ্ঠানে অস্ত্রধারী তার ক্যাডার বাহিনী শুধু হামলাই করত না, প্রয়োজনে তাদের মেরেও ফেলত। ৭ জন অস্ত্রধারী দেহরক্ষীর প্রটেকশনে চলতেন জি কে শামীম। সবার হাতেই শটগান। গায়ে বিশেষ সিকিউরিটি পোশাক। তাদের একেকজনের উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট। যাকে মাঝখানে রেখে তারা পাহারা দিতেন তিনি উচ্চতায় পাঁচ ফুটের কিছু বেশি।

জিকে শামীমের উত্থান

সন্মানদী ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানান, প্রাইমারি স্কুল ও হাইস্কুল পাস করার পর তাকে গ্রামে দেখা যায়নি। ঢাকার বাসাবো আর সবুজবাগ এলাকায় বড় হয়েছেন। গত জাতীয় নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনের জন্য প্রচারণাও চালিয়েছিলেন শামীম। বাসাবো ও এজিবি কলোনির কয়েকজন বাসিন্দা জানান, গ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পর এজিবি কলোনি, হাসপাতাল জোন এবং মধ্য বাসাবোতেই পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন শামীম। ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের মাধ্যমেই তার রাজনীতি শুরু। পরবর্তী সময় মির্জা আব্বাসের ভাই মির্জা কালু ও মির্জা খোকনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় এবং তাদের সহযোগিতায় ধীরে ধীরে গণপূর্ত ভবনের ঠিকাদারি ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন।

ঢাকা মহানগর যুবদলের সহ-সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন। বিএনপি আমলে গণপূর্ত ভবন ছিল তার দখলে। একসময় মির্জা আব্বাস আর খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের ছবিসহ সবুজবাগ-বাসাবো এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শোভা পেত জি কে শামীমের ব্যানার-পোস্টার। এখন শোভা পায় যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ছবিসহ পোস্টার-ব্যানার। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিংবা যুবলীগের পার্টি অফিস, বিয়ে বাড়ি কিংবা বন্ধুর বাড়ি, যেখানেই তিনি যেতেন, সঙ্গে থাকত অস্ত্রধারী প্রটোকল বাহিনী। ভারী অস্ত্র নিয়ে ৭ জন নিরাপত্তারক্ষী আগে-পিছে পাহারা দিয়ে তাকে নিয়ে যেতেন।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন জি কে শামীম। বাসাবো এলাকায় পাঁচটি বাড়ি এবং একাধিক প্লট রয়েছে শামীমের। বাসাবোর কদমতলায় ১৭ নম্বরের পাঁচতলা বাড়িটি জি কে শামীমের। বাড়িটির ম্যানেজার হিসেবে দেখাশোনা করেন স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. ইসমাইল হোসেন সর্দার। শামীম কয়েক বছর বাসাবোর ওই বাড়িতে বসবাস করলেও গ্রেপ্তারের আগে থাকতেন বনানীর ওল্ড ডিওএইচএসে নিজের ফ্ল্যাটে। নিজের কার্যালয় বানিয়ে বসতেন নিকেতন এলাকায় একটি ভবনে।

বাসাবোতে আরও রয়েছে তিনটি ভবন। ডেমরা ও দক্ষিণগাঁও ছাড়াও সোনারগাঁ উপজেলা, বান্দরবান ও গাজীপুরে কয়েকশ’ বিঘা জমি কিনেছেন তিনি। তবে যুবলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর জানায়, জি কে শামীম যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোন পদে নেই। অনুমোদিত কমিটির কোথাও জি কে শামীমের নাম নেই। কেউ যদি মুখে মুখে নিজেকে যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা বলে থাকেন সেটা তো হবে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতা বলেন, তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পদে আছেন। মূল কমিটি অনুমোদনের পর বেশ কয়েকজনকে সহ-সম্পাদক থেকে শুরু অনেক পদই দেয়া হয়েছে। আর আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক এস এম মেজবাহ হোসেন বুরুজ ২০১৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর মারা যাওয়ার পর শূন্য পদটি দেয়া হয়য় জি কে শামীমকে। শামীম ওই পদ ব্যবহার করে সাংগঠনিক কর্মকান্ড চালাতেন।