স্বপ্নছোঁয়া জয় ও এগিয়ে যাওয়ার পথনকশা

শেখর ভট্টাচার্য

রবীন্দ্রনাথ তার সময়ে নারী অধিকার বিষয়ে সমাজের অনুশাসন, প্রতিভা বিকাশে সীমিত সুযোগ অবলোকন করে বিধাতার উদ্দেশ্যে অভিমান করে কবিতা লিখেছিলেন। বিধাতার কাছে ভালোবাসা মিশ্রিত প্রশ্ন ছিল তার, ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা?’ রবিঠাকুরের সময়ের সঙ্গে যদি বহমান সময়ের তুলনা করি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশের কী খুব পরিবর্তন হয়েছে? চারিদিকে এখনো কাঁটা বিছানো আছে। যে দিকে নারীর পদ স্পর্শ সে দিকেই রক্তাক্ত হওয়ার মতো অবস্থা।

সাফ ফুটবলের বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দলকে ২৩টি গোল দিয়েছে আর একটি মাত্র গোল হজম করেছে। প্রতিটি গোল আমি মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। তাদের লড়াইয়ের সংবাদ খুব ভালো জানা ছিল। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর, দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, সাতক্ষীরার গভীর গ্রাম থেকে উঠে আসা মেয়েরা যখন প্রতি খেলায় গোল করছিলেন, তখন আকাশে কান পেতে শুনতে পাচ্ছিলাম রবীন্দ্রনাথের সেই অমর সংগীত, “বাঁধ ভেঙে দাও বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ/ বন্দী প্রাণ মন হোক উধাও/শুকনো গাঙে আসুক/জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক/ভাঙনের জয়গান গাও। ...” কুশলতার সঙ্গে প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন আমাদের মেয়েরা। কঠোর পরিশ্রম নিরলস সাধনার মাধ্যমে তারা তাদের সামনে শক্ত করে দেয়া অনুশাসনের বাঁধকে কিছুটা হলেও ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছেন।

দীর্ঘদিনের সাধনার পর ধরা দিয়েছে সাফল্য। এ কারণে মানুষের ভেতর উচ্ছ্বাস, উল্লাসও হয়েছে বাঁধভাঙা। হার্ডল রেস বা বাঁধা ডিঙানো দৌড় প্রতিযোগিতায় সফলতা আসলে তার আনন্দ হয় বাঁধভাঙা। হার্ডল বা বাঁধা যে শুধু খেলোয়াড়দের সামাজিক এবং পারিবারিক জীবনে ছিল তা কিন্তু নয়, বাঁধা ছিল জাতীয় জীবনেও। বাংলাদেশের মেয়েদের দক্ষিণ এশিয়া জয়ের মাহাত্ম্য পুরো বুঝতে হলে আমাদের শুরুর দিকের বৈরী দিনগুলোর কথা মনে রাখাটা জরুরি। এখানেই সাবিনাদের সাফল্য শুধুই একটা খেলার অর্জন ছাপিয়ে অনেক বড় মাত্রা পেয়ে যায়। এ রকম বাধার কথা আমার শুনতে পাই সাবেক খেলোয়াড় ও ফুটবল সংগঠক কামরুন নাহার ডানার বয়ানে। দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সংবাদ শুনে তিনি কথাগুলো বলছিলেন, “২০০৩-০৮ সাল পর্যন্ত নারী ফুটবল নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা কখনোই ভুলব না। শুরুতে মৌলবাদীদের নানা হুমকিতে স্পনসররাও আসতে চাইত না। আমি তখন বাফুফের মহিলা কমিটিতে ছিলাম। বাফুফের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক হেলাল ভাইয়ের সঙ্গে দেশের একটা নামী করপোরেট প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম স্পনসরশিপের ব্যাপারে। কিন্তু মেয়েদের ফুটবলের পাশে দাঁড়ালে মৌলবাদীদের রোষানলে পড়ার শঙ্কার কথা বলে সেই প্রতিষ্ঠান আমাদের না বলে দিয়েছিল। কষ্ট পেয়েছিলাম অনেক। বাফুফেও তখন ভয় পেয়ে যায়।

সেই ভয়কে জয় করে ২০০৪ সালে ঢাকায় বাফুফের উদ্যোগে মেয়েদের প্রথম টুর্নামেন্ট হয়েছে। ২০০৬ সালে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে মেয়েদের টুর্নামেন্ট করি। আমি তখন মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদিকা। বাফুফে এবং মহিলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে কাজ করে দেখেছি মেয়েদের ফুটবল শুরুর সময়ের নানা প্রতিকূলতা। মৌলবাদীদের মিছিল-মিটিং আর নানা হুমকিকেও আমরা ভয় পাইনি। মেয়েদের দল আজ দক্ষিণ এশিয়ার সেরা, এটা ভাবতেই ভালো লাগছে।’

এ রকম নানাদিক থেকে আসা হার্ডলস বা বাঁধা আমাদের নারী ফুটবলারদের অদম্য করে ফেলেছিল। তারা দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য সব নিবেদন দিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এই মেয়েদের মধ্যে সাফল্যের এক অসাধারণ ক্ষুধাও জেগে উঠেছিল। সেই ক্ষুধাই বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতাগুলোতে তাদের করে তুলেছিল অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু এমন শূন্য থেকে শুরু করলে যা হয়, জাতীয় দলের হয়ে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে সাফল্যের পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল না। অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলতে খেলতেই তাদের নেমে পড়তে হয়েছে জাতীয় দলের হয়ে। এই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ তাই সর্বার্থেই নতুন এক যুগের সূচনা।

এই টুর্নামেন্টটা তো আসলে ভারত আর নেপালের ছিল এত দিন। এর আগের ৫টি টুর্নামেন্টের ৪টিরই ফাইনাল খেলেছে এই দুই দল, বাংলাদেশ খেলতে পেরেছে মাত্র একবার। দ্বিতীয়বার ফাইনালে উঠে বাংলাদেশ শুধু শিরোপাই জেতেনি, জেতার পথে হিমালয়ের দেশে নতুন নতুন শৃঙ্গেও পা রেখেছে। এর আগে ১০ ম্যাচেও যে ভারতকে হারানো যায়নি, আগের পাঁচবারেরই চ্যাম্পিয়ন সেই ভারতকে উড়িয়ে দিয়েছে ৩-০ গোলে। ফাইনালের প্রতিপক্ষ নেপালও তো ছিল একই রকম অজেয়। এর আগে ৮ ম্যাচে সোনার হরিণ হয়ে থাকা সেই জয় ধরা দিল ফাইনালে। কারণটা বুঝতে সানজিদা আক্তারের ফেসবুক স্ট্যাটাসটাই মনে হয় যথেষ্ট, যেখানে একটা জায়গায় তিনি বলছেন, ‘স্বাগতিক হিসেবে ফাইনাল খেলা কিংবা স্বাগতিক দলের বিপক্ষে ফাইনাল খেলা সব সময় রোমাঞ্চকর।’ ফাইনালে স্বাগতিক দলকে যেখানে সবাই এড়াতে চায়, সেই দলের বিপক্ষে অতীত কোন সাফল্য না থাকলে তো আরও বেশি, সেখানে সানজিদা নাকি উল্টো রোমাঞ্চিত। কতটা আত্মবিশ্বাস থাকলে এমন ভাবা যায়! সবাইকে তা জানিয়েও দেয়া যায়! শেষ পর্যন্ত তারা বুক চিতিয়ে লড়াই করে জিতিয়েছেন দলকে, জিতিয়েছেন বাংলাদেশকে। তাদের সাফল্যে, অর্জন বভুক্ষ বাংলাদেশও হয়েছে রোমাঞ্চিত।

এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় এই নারী খেলোয়াড়রাই আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের শ্রেষ্ঠ সাফল্যে অর্জনের দূত। আমাদের স্বপ্নকে সফল করার সারথি। এই খেলোয়াড়রাই ভবিষ্যতে আমাদের ফুটবলকে এগিয়ে নেয়ার দিকনির্দেশক। অর্থনৈতিকভাবে সংকটগ্রস্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে অধঃপতিত এই দেশে মেয়েরাই বাংলাদেশের স্বপ্ন হয়ে মাঠে নেমেছে। দুই চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে অন্য দেশের মেয়েদের সঙ্গে লড়াই করেছে। জয় ছিনিয়ে এনেছে। প্রমাণ করেছে অন্য দেশের মেয়েদের থেকে আমাদের দেশ পিছিয়ে নেই। শক্তি তো মাঠেই প্রমাণ হয়েছে। সেই শক্তি পরীক্ষায় আমাদের মেয়েরা বিজয়ী। সেই সঙ্গে বিজয়ী হয়েছে দেশ, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।

এই জয় বাংলাদেশের বহমান সময়ের বাস্তবতায় সহজ কোন বিষয় নয়। এই জয়ের আছে বহুমুখী তাৎপর্য। দক্ষিণ এশিয়ায় নারী ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন বা বিজয় তিলক ছিনিয়ে নিয়ে আসা নিছক কোন খেলোয়াড়ি বিজয় নয়। খেলাধুলার চাইতেও এ বিজয়ের সামাজিক-সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রাম থেকে জাতীয় দলে খেলছে আটজন নারী খেলোয়াড়। তাদের প্রায় সবাই কলসিন্দুর স্কুলের ছাত্রী। তারা প্রমাণ করেছে-উদ্যম ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকেও জাতীয় পর্যায়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা যায়। বিদেশের মাটিতে দেশের পতাকা গর্ব ভরে ওড়ানো যায়।

নারী ফুটবল দলের জয় থেকে অর্জিত বিশ্বাস ও সাহসকে কাজে লাগাতে হবে। জাতীয়ভাবে অর্জিত যে কোন সফলতা সামাজিক বাঁধা দূর করতে পারে সহজেই। সমাজের প্রান্ত থেকে উঠে আসা আমাদের নারী ফুটবলাররা জাতিকে প্রগতির পথে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এই আগল ভাঙ্গার আনন্দে ঢাকার রাজপথ লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়েছিল। মানুষের মিছিলে কারা ছিলেন না? সব শ্রেণী, পেশার মানুষেরা জড় হয়েছিলেন প্রাণভরা ভালোবাসা নিয়ে। সাম্প্রতিককালে এ রকম স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের ছবি আমরা দেখিনি। নারী ফুটবলাররা ছাদ খোলা বাস দিয়ে বিমান বন্দর থেকে বাফুফে ভবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন সঙ্গে লাখ জনতা, খেলোয়াড়দের ওপর ঝরছে পুষ্প বৃষ্টি আর মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছে তাদের হৃদয়।

এ রকম বাংলাদেশ আমরা দেখিনি বহু দিন। এই যে জাতীয় জীবনে জেগে ওঠা সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা, ভালোবাসা, এগুলো হলো বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়। আমাদের সামনে যত বাঁধাই আসুক-না কেন কঠোর শ্রম, সাধনা ও ভালোবাসা দিয়ে তা অতিক্রম করা সম্ভব। আমাদের নারী ফুটবল দল শুধু চ্যাম্পিয়নই হয়নি; বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর চোখ রাঙানিকেও উপেক্ষা করেছে। তাদের কারণেই আমরা এক ভিন্ন বাংলাদেশকে দেখতে পেলাম। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চোয়াল ভাঙা প্রতিজ্ঞায় যখন বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষ লড়ছেন শত্রু সেনাদের সঙ্গে, তখন বাংলাদেশের রূপ মাধুর্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিন্ন রকম বাংলাদেশকে দেখে বিস্মিত হয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ তার হৃদয়ানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন, তার মতো করে আজ বলতে ইচ্ছে করছে “এ রকম বাংলাদেশ কখনো দেখোনি তুমি/মুহূর্তে সবুজ ঘাস পুড়ে যায়/ত্রাসের আগুন লেগে লাল হয়ে জ্বলে উঠে চাঁদ/নরম নদীর চর হা করা কবর হয়ে/গ্রাস করে পরম শত্রুকে/মিত্রকে জয়ের চিহ্ন, পদতলে প্রেম/ললাটে ধুলোর টিপ এঁকে দেয় মায়ের মতন।”

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]

সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ১০ আশ্বিন ১৪২৯ ২৮ সফর ১৪৪৪

স্বপ্নছোঁয়া জয় ও এগিয়ে যাওয়ার পথনকশা

শেখর ভট্টাচার্য

image

দীর্ঘদিনের সাধনার পর ধরা দিয়েছে সাফল্য

রবীন্দ্রনাথ তার সময়ে নারী অধিকার বিষয়ে সমাজের অনুশাসন, প্রতিভা বিকাশে সীমিত সুযোগ অবলোকন করে বিধাতার উদ্দেশ্যে অভিমান করে কবিতা লিখেছিলেন। বিধাতার কাছে ভালোবাসা মিশ্রিত প্রশ্ন ছিল তার, ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা?’ রবিঠাকুরের সময়ের সঙ্গে যদি বহমান সময়ের তুলনা করি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশের কী খুব পরিবর্তন হয়েছে? চারিদিকে এখনো কাঁটা বিছানো আছে। যে দিকে নারীর পদ স্পর্শ সে দিকেই রক্তাক্ত হওয়ার মতো অবস্থা।

সাফ ফুটবলের বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দলকে ২৩টি গোল দিয়েছে আর একটি মাত্র গোল হজম করেছে। প্রতিটি গোল আমি মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। তাদের লড়াইয়ের সংবাদ খুব ভালো জানা ছিল। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর, দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা, সাতক্ষীরার গভীর গ্রাম থেকে উঠে আসা মেয়েরা যখন প্রতি খেলায় গোল করছিলেন, তখন আকাশে কান পেতে শুনতে পাচ্ছিলাম রবীন্দ্রনাথের সেই অমর সংগীত, “বাঁধ ভেঙে দাও বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ/ বন্দী প্রাণ মন হোক উধাও/শুকনো গাঙে আসুক/জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক/ভাঙনের জয়গান গাও। ...” কুশলতার সঙ্গে প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন আমাদের মেয়েরা। কঠোর পরিশ্রম নিরলস সাধনার মাধ্যমে তারা তাদের সামনে শক্ত করে দেয়া অনুশাসনের বাঁধকে কিছুটা হলেও ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছেন।

দীর্ঘদিনের সাধনার পর ধরা দিয়েছে সাফল্য। এ কারণে মানুষের ভেতর উচ্ছ্বাস, উল্লাসও হয়েছে বাঁধভাঙা। হার্ডল রেস বা বাঁধা ডিঙানো দৌড় প্রতিযোগিতায় সফলতা আসলে তার আনন্দ হয় বাঁধভাঙা। হার্ডল বা বাঁধা যে শুধু খেলোয়াড়দের সামাজিক এবং পারিবারিক জীবনে ছিল তা কিন্তু নয়, বাঁধা ছিল জাতীয় জীবনেও। বাংলাদেশের মেয়েদের দক্ষিণ এশিয়া জয়ের মাহাত্ম্য পুরো বুঝতে হলে আমাদের শুরুর দিকের বৈরী দিনগুলোর কথা মনে রাখাটা জরুরি। এখানেই সাবিনাদের সাফল্য শুধুই একটা খেলার অর্জন ছাপিয়ে অনেক বড় মাত্রা পেয়ে যায়। এ রকম বাধার কথা আমার শুনতে পাই সাবেক খেলোয়াড় ও ফুটবল সংগঠক কামরুন নাহার ডানার বয়ানে। দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সংবাদ শুনে তিনি কথাগুলো বলছিলেন, “২০০৩-০৮ সাল পর্যন্ত নারী ফুটবল নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা কখনোই ভুলব না। শুরুতে মৌলবাদীদের নানা হুমকিতে স্পনসররাও আসতে চাইত না। আমি তখন বাফুফের মহিলা কমিটিতে ছিলাম। বাফুফের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক হেলাল ভাইয়ের সঙ্গে দেশের একটা নামী করপোরেট প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম স্পনসরশিপের ব্যাপারে। কিন্তু মেয়েদের ফুটবলের পাশে দাঁড়ালে মৌলবাদীদের রোষানলে পড়ার শঙ্কার কথা বলে সেই প্রতিষ্ঠান আমাদের না বলে দিয়েছিল। কষ্ট পেয়েছিলাম অনেক। বাফুফেও তখন ভয় পেয়ে যায়।

সেই ভয়কে জয় করে ২০০৪ সালে ঢাকায় বাফুফের উদ্যোগে মেয়েদের প্রথম টুর্নামেন্ট হয়েছে। ২০০৬ সালে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে মেয়েদের টুর্নামেন্ট করি। আমি তখন মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদিকা। বাফুফে এবং মহিলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে কাজ করে দেখেছি মেয়েদের ফুটবল শুরুর সময়ের নানা প্রতিকূলতা। মৌলবাদীদের মিছিল-মিটিং আর নানা হুমকিকেও আমরা ভয় পাইনি। মেয়েদের দল আজ দক্ষিণ এশিয়ার সেরা, এটা ভাবতেই ভালো লাগছে।’

এ রকম নানাদিক থেকে আসা হার্ডলস বা বাঁধা আমাদের নারী ফুটবলারদের অদম্য করে ফেলেছিল। তারা দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য সব নিবেদন দিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এই মেয়েদের মধ্যে সাফল্যের এক অসাধারণ ক্ষুধাও জেগে উঠেছিল। সেই ক্ষুধাই বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতাগুলোতে তাদের করে তুলেছিল অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু এমন শূন্য থেকে শুরু করলে যা হয়, জাতীয় দলের হয়ে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে সাফল্যের পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল না। অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলতে খেলতেই তাদের নেমে পড়তে হয়েছে জাতীয় দলের হয়ে। এই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ তাই সর্বার্থেই নতুন এক যুগের সূচনা।

এই টুর্নামেন্টটা তো আসলে ভারত আর নেপালের ছিল এত দিন। এর আগের ৫টি টুর্নামেন্টের ৪টিরই ফাইনাল খেলেছে এই দুই দল, বাংলাদেশ খেলতে পেরেছে মাত্র একবার। দ্বিতীয়বার ফাইনালে উঠে বাংলাদেশ শুধু শিরোপাই জেতেনি, জেতার পথে হিমালয়ের দেশে নতুন নতুন শৃঙ্গেও পা রেখেছে। এর আগে ১০ ম্যাচেও যে ভারতকে হারানো যায়নি, আগের পাঁচবারেরই চ্যাম্পিয়ন সেই ভারতকে উড়িয়ে দিয়েছে ৩-০ গোলে। ফাইনালের প্রতিপক্ষ নেপালও তো ছিল একই রকম অজেয়। এর আগে ৮ ম্যাচে সোনার হরিণ হয়ে থাকা সেই জয় ধরা দিল ফাইনালে। কারণটা বুঝতে সানজিদা আক্তারের ফেসবুক স্ট্যাটাসটাই মনে হয় যথেষ্ট, যেখানে একটা জায়গায় তিনি বলছেন, ‘স্বাগতিক হিসেবে ফাইনাল খেলা কিংবা স্বাগতিক দলের বিপক্ষে ফাইনাল খেলা সব সময় রোমাঞ্চকর।’ ফাইনালে স্বাগতিক দলকে যেখানে সবাই এড়াতে চায়, সেই দলের বিপক্ষে অতীত কোন সাফল্য না থাকলে তো আরও বেশি, সেখানে সানজিদা নাকি উল্টো রোমাঞ্চিত। কতটা আত্মবিশ্বাস থাকলে এমন ভাবা যায়! সবাইকে তা জানিয়েও দেয়া যায়! শেষ পর্যন্ত তারা বুক চিতিয়ে লড়াই করে জিতিয়েছেন দলকে, জিতিয়েছেন বাংলাদেশকে। তাদের সাফল্যে, অর্জন বভুক্ষ বাংলাদেশও হয়েছে রোমাঞ্চিত।

এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় এই নারী খেলোয়াড়রাই আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের শ্রেষ্ঠ সাফল্যে অর্জনের দূত। আমাদের স্বপ্নকে সফল করার সারথি। এই খেলোয়াড়রাই ভবিষ্যতে আমাদের ফুটবলকে এগিয়ে নেয়ার দিকনির্দেশক। অর্থনৈতিকভাবে সংকটগ্রস্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে অধঃপতিত এই দেশে মেয়েরাই বাংলাদেশের স্বপ্ন হয়ে মাঠে নেমেছে। দুই চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে অন্য দেশের মেয়েদের সঙ্গে লড়াই করেছে। জয় ছিনিয়ে এনেছে। প্রমাণ করেছে অন্য দেশের মেয়েদের থেকে আমাদের দেশ পিছিয়ে নেই। শক্তি তো মাঠেই প্রমাণ হয়েছে। সেই শক্তি পরীক্ষায় আমাদের মেয়েরা বিজয়ী। সেই সঙ্গে বিজয়ী হয়েছে দেশ, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।

এই জয় বাংলাদেশের বহমান সময়ের বাস্তবতায় সহজ কোন বিষয় নয়। এই জয়ের আছে বহুমুখী তাৎপর্য। দক্ষিণ এশিয়ায় নারী ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন বা বিজয় তিলক ছিনিয়ে নিয়ে আসা নিছক কোন খেলোয়াড়ি বিজয় নয়। খেলাধুলার চাইতেও এ বিজয়ের সামাজিক-সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অনেক বেশি। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রাম থেকে জাতীয় দলে খেলছে আটজন নারী খেলোয়াড়। তাদের প্রায় সবাই কলসিন্দুর স্কুলের ছাত্রী। তারা প্রমাণ করেছে-উদ্যম ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকেও জাতীয় পর্যায়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা যায়। বিদেশের মাটিতে দেশের পতাকা গর্ব ভরে ওড়ানো যায়।

নারী ফুটবল দলের জয় থেকে অর্জিত বিশ্বাস ও সাহসকে কাজে লাগাতে হবে। জাতীয়ভাবে অর্জিত যে কোন সফলতা সামাজিক বাঁধা দূর করতে পারে সহজেই। সমাজের প্রান্ত থেকে উঠে আসা আমাদের নারী ফুটবলাররা জাতিকে প্রগতির পথে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এই আগল ভাঙ্গার আনন্দে ঢাকার রাজপথ লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়েছিল। মানুষের মিছিলে কারা ছিলেন না? সব শ্রেণী, পেশার মানুষেরা জড় হয়েছিলেন প্রাণভরা ভালোবাসা নিয়ে। সাম্প্রতিককালে এ রকম স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের ছবি আমরা দেখিনি। নারী ফুটবলাররা ছাদ খোলা বাস দিয়ে বিমান বন্দর থেকে বাফুফে ভবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন সঙ্গে লাখ জনতা, খেলোয়াড়দের ওপর ঝরছে পুষ্প বৃষ্টি আর মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছে তাদের হৃদয়।

এ রকম বাংলাদেশ আমরা দেখিনি বহু দিন। এই যে জাতীয় জীবনে জেগে ওঠা সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা, ভালোবাসা, এগুলো হলো বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়। আমাদের সামনে যত বাঁধাই আসুক-না কেন কঠোর শ্রম, সাধনা ও ভালোবাসা দিয়ে তা অতিক্রম করা সম্ভব। আমাদের নারী ফুটবল দল শুধু চ্যাম্পিয়নই হয়নি; বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর চোখ রাঙানিকেও উপেক্ষা করেছে। তাদের কারণেই আমরা এক ভিন্ন বাংলাদেশকে দেখতে পেলাম। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চোয়াল ভাঙা প্রতিজ্ঞায় যখন বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষ লড়ছেন শত্রু সেনাদের সঙ্গে, তখন বাংলাদেশের রূপ মাধুর্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিন্ন রকম বাংলাদেশকে দেখে বিস্মিত হয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ তার হৃদয়ানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন, তার মতো করে আজ বলতে ইচ্ছে করছে “এ রকম বাংলাদেশ কখনো দেখোনি তুমি/মুহূর্তে সবুজ ঘাস পুড়ে যায়/ত্রাসের আগুন লেগে লাল হয়ে জ্বলে উঠে চাঁদ/নরম নদীর চর হা করা কবর হয়ে/গ্রাস করে পরম শত্রুকে/মিত্রকে জয়ের চিহ্ন, পদতলে প্রেম/ললাটে ধুলোর টিপ এঁকে দেয় মায়ের মতন।”

[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]