দুবাইয়ের ফুটপাতে ও সৈকতে লুকিয়ে দুই সপ্তাহ পার করেন কুষ্টিয়ার চার তরুণ

দুবাই যাওয়ার জন্য অনলাইনে পরিচয় হওয়া এক লোকের হাতে সাড়ে পাঁচ লাখ করে টাকা দেন কুষ্টিয়ার চার তরুণ। তাদের বিমানবন্দরে প্রবেশের পর পাসপোর্ট দেয়া হয়। দুবাইয়ে পৌঁছার পর একটি বাড়িতে নেয়া হয় ফাহিম রেজা, মহরম, মজনু ও হেলালকে। তাদের আটকে রেখে চালানো হতে থাকে নির্যাতন। চাকরি চাইলেই নির্যাতন বাড়ে। হাত খরচের টাকাও ছিনিয়ে নেয়া হয় তাদের কাছ থেকে। নেপাল ও পাকিস্তানের লোকজন এই নির্যাতন চালায়। একদিন এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে নেয়ার সময় পালায় এই চার তরুণ। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ কাটে ফুটপাত, পার্ক ও সমুদ্রের তীরে লুকিয়ে। পরে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে তাদের দেশে ফেরত আনেন পরিবারের সদস্যরা।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ভুক্তভোগী চার যুবকের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা যায়। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশে চার মানবপাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলো- মানবপাচার চক্রের অন্যতম হোতা তোফায়েল আহমেদ (২৮), মো. আক্তার হোসেন (৩৮), মো. আনিছুর রহমান (৩৬) ও মো. রাসেল (৩০)।

দুবাইয়ে পাচারের শিকার ফাহিম রেজা বলেন, ‘আমার বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে। অনলাইনে তোফায়েল নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি তিনি বিদেশে লোক পাঠান। এরপর আমিসহ আরও কয়েকজন তার সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাদের দুবাই পাঠানোর কথা বলে পাসপোর্ট নিয়ে নেন। তিনি বলেন, ‘আমি ছাড়াও মহরম, মজনু ও হেলাল পাসপোর্ট দেয়। তারা আমাদের কাছ থেকে কয়েক দফায় ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেয়। কারও কাছ থেকে ৫ লাখ ৬০ হাজারও নিয়েছে। কোনও মেডিক্যাল পরীক্ষা ছাড়াই মজনু ও মহরমকে ৫ আগস্ট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যায়। তখনও তাদের কাছে পাসপোর্ট দেয়নি। বিমানবন্দরে প্রবেশ করানোর পর পাসপোর্ট দেয়। এরপর তারা দু’জন দুবাই যায়। ৬ আগস্ট আমি ও হেলাল যাই। দুবাইতে জাহিদ নামে একজন আমাদের রিসিভ করে।

আটকে রেখে নির্যাতন

চার তরুণ জানায়, দুবাইয়ে নেয়ার পর একটি বাড়িতে তাদের চারজনকে (ফাহিম রেজা, মহরম, মজনু ও হেলাল) আটকে রেখে নির্যাতন চালায় জুয়েল ও জাহিদ। চাকরি চাইলেই তাদের নির্যাতন করা হয়। তাদের কাছ থেকে হাত খরচের টাকাও নিয়ে নেয় তারা। সেখানে নেপাল ও পাকিস্তানের লোকজনও এসব নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত। একদিন তাদের বন্দী হিসেবে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে নেয়া হচ্ছিল। এ সময় সুযোগ বুঝে তারা পালিয়ে যায়।

সমুদ্রের তীরে ও ফুটপাতে আত্মগোপন

মজনু, মহরম, হেলাল ও ফাহিম পালিয়ে দুবাইয়ের ফুটপাত, ক্যাফেটেরিয়া, পার্ক ও সমুদ্রের তীরে প্রায় দুই সপ্তাহ ছিলেন। এ সময় এক বাংলাদেশির সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। তার কাছে কাজ চাইলে তিনি জানান, ভ্রমণ ভিসায় তারা কোনও কাজ পাবেন না। এরপর বাড়ি থেকে টিকিটের টাকা এনে তারা দুবাই থেকে গত ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন।

ভুক্তভোগী মহরম বলেন, ‘আমরা প্রায় দুই সপ্তাহের বেশি খোলা আকাশের নিচে ছিলাম। মানুষের কাছে চেয়ে খেয়েছি। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে কোনও রকম প্রাণ বাঁচিয়েছি। বাংলাদেশে ফিরে তিন যুবক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন। এরপর গতকাল ভোরে র‌্যাব-৩ অভিযানে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এবং রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা মধ্যপ্রাচ্যে অবৈধভাবে মানবপাচারচক্রের সঙ্গে জড়িত বলে জানানো হয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পাসপোর্টও জব্দ করা হয়েছে। র‌্যাব-৩ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন জানান, তোফায়েল আহমেদ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার যুবকদের টার্গেট করে। এরপর তার সহযোগীদের মাধ্যমে দুবাই পাচার করে টাকা আত্মসাৎ করে।

ভুয়া কোম্পানিতে পাঠানো হয় শ্রমিকদের

ভুক্তভোগী চার তরুণ জানান, দুবাই পৌঁছানোর পর সেখানে বসবাসকারী জাহিদ তাদের স্বাগত জানিয়ে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। এরপর ভিকটিমদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও নগদ অর্থ ছিনিয়ে নেয়া হয়। তারপর তাদের একটি সাজানো কোম্পানিতে চাকরি দেয়া হয়। চার-পাঁচ দিন পর ওই কোম্পানি থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, আইনি জটিলতার কারণে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে কোম্পানিটি। এরপর জাহিদ পুনরায় ভিকটিমদের অজ্ঞাত স্থানে বন্দী করে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে অর্থ আদায় শুরু করে।

ভিকটিমদের দাবি, আটকে রাখার সময় তাদের কোনও খাবার দেয়া হয়নি। খাবার চাইলে জাহিদ বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়ে এসে খাবার কিনতে বলে। এ সময় তোফায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে ভিকটিমদের অপেক্ষা করতে বলে। সে জানায়, আইনি জটিলতা দূর হলেই আবার কোম্পানি চালু হবে। তখন তারা বেতন ও কাজের সুযোগ পাবেন। ভিকটিমরা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নিজেদের চেষ্টায় টিকিট জোগাড় করে দেশে আসার চেষ্টা করেন। পাসপোর্ট চাইলে জাহিদ তাদের কাছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দাবি করে।

পাচারের সঙ্গে জড়িতরা কারা

পুলিশ ও ভিকটিমরা জানান, তোফায়েল এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। তার বাবা প্রায় ২৪ বছর ধরে দুবাইয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায় হোটেলের ব্যবসা করছেন। ২০১৭ সালে তোফায়েল দুবাই গিয়ে তার বাবার হোটেল ব্যবসায় যুক্ত হয়। করোনা মহামারি শুরু হলে সে বাংলাদেশে ফিরে আসে। এ সময় তার কোন উপার্জন না থাকায় সে তার পরিচিত দুবাই প্রবাসী জাহিদের মাধ্যমে মানবপাচারে জড়িয়ে পড়ে।

তোফায়েল তার নিজ বাড়ি চৌদ্দগ্রামে (কুমিল্লা) একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালু করে। কিন্তু ওই এজেন্সির কোনও লাইসেন্স ছিল না। তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে দুবাইয়ে যাতায়াত করছেন। তাই নিজেদের প্রয়োজনে তাদের বিভিন্ন ট্রাভেল ও রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে পরিচয় ছিল। এছাড়াও দুবাইয়ের জাহিদ দীর্ঘদিন ধরে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। জাহিদের মাধ্যমে আনিছুর ও আক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয় তোফায়েলের। তাদের মাধ্যমেই রাসেলসহ অন্য দালালদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। জাহিদ দুবাই থেকে ভ্রমণ ভিসা তৈরিতে এই চক্রকে সহায়তা করে থাকে। তোফায়েলও নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করে। সর্বশেষ গত আগস্টে দুবাই গিয়ে সে সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে আসে।

আক্তার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে স্নাতক পাস করেছে। সে কিছু দিন বনানী এলাকায় একটি কাপড়ের দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করে। পরে স্বল্প শ্রমে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় সে মানবপাচারকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। আনিছুর ও আক্তার একই এলাকার হওয়ায় তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। প্রথমে তারা পৃথকভাবে মানবপাচারে জড়িত থাকলেও ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে তারা সিটি এক্সপ্রেস ট্রাভেল এজেন্সি নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে গুলশানে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সুসজ্জিত অফিস চালু করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় দালাল নিযুক্ত করে এবং বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে সখ্য গড়ে মানবপাচারের কাজে লিপ্ত হয়। ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মো. আক্তার হোসেন ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. আনিছুর রহমান।

আনিছুর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান পাস করে কিছু দিন রাজধানীর একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে। স্বল্প শ্রমে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় সে মানবপাচারকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু দেশে প্রবাসী বন্ধু রয়েছে তার। তাদের মাধ্যমে সে ভুয়া ডিমান্ড লেটার, ইনভাইটেশন ও ওয়ার্ক পারমিট সংগ্রহ করে বিভিন্ন দেশে মানবপাচার করে থাকে। এছাড়াও এসব প্রবাসী দালাল ভিকটিম ও অভিভাবকদের বিদেশ থেকে ফোন দিয়ে ভালো বেতনের নিশ্চয়তা দিয়ে প্রতারণায় সহায়তা করে থাকে।

রাসেল কুমিল্লার একটি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাস করেছে। দুই বছর ধরে মানবপাচারচক্রের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করে আসছে সে। আক্তার ও আনিছুর বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসেবে তাকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিটি এক্সপ্রেস ট্রাভেল এজেন্সির ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত করে। এছাড়াও দুবাই প্রবাসী জাহিদের সে গৃহশিক্ষক ছিল। জাহিদ ও রাসেলের নিজ বাড়ি কুমিল্লা এলাকায় হওয়ায় তাদের মধ্যে সখ্য রয়েছে।

মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ১১ আশ্বিন ১৪২৯ ২৯ সফর ১৪৪৪

অভিযানে ৪ মানবপাচারকারী গ্রেপ্তার

দুবাইয়ের ফুটপাতে ও সৈকতে লুকিয়ে দুই সপ্তাহ পার করেন কুষ্টিয়ার চার তরুণ

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

দুবাই যাওয়ার জন্য অনলাইনে পরিচয় হওয়া এক লোকের হাতে সাড়ে পাঁচ লাখ করে টাকা দেন কুষ্টিয়ার চার তরুণ। তাদের বিমানবন্দরে প্রবেশের পর পাসপোর্ট দেয়া হয়। দুবাইয়ে পৌঁছার পর একটি বাড়িতে নেয়া হয় ফাহিম রেজা, মহরম, মজনু ও হেলালকে। তাদের আটকে রেখে চালানো হতে থাকে নির্যাতন। চাকরি চাইলেই নির্যাতন বাড়ে। হাত খরচের টাকাও ছিনিয়ে নেয়া হয় তাদের কাছ থেকে। নেপাল ও পাকিস্তানের লোকজন এই নির্যাতন চালায়। একদিন এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে নেয়ার সময় পালায় এই চার তরুণ। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ কাটে ফুটপাত, পার্ক ও সমুদ্রের তীরে লুকিয়ে। পরে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে তাদের দেশে ফেরত আনেন পরিবারের সদস্যরা।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ভুক্তভোগী চার যুবকের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা যায়। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশে চার মানবপাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলো- মানবপাচার চক্রের অন্যতম হোতা তোফায়েল আহমেদ (২৮), মো. আক্তার হোসেন (৩৮), মো. আনিছুর রহমান (৩৬) ও মো. রাসেল (৩০)।

দুবাইয়ে পাচারের শিকার ফাহিম রেজা বলেন, ‘আমার বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে। অনলাইনে তোফায়েল নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়। তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি তিনি বিদেশে লোক পাঠান। এরপর আমিসহ আরও কয়েকজন তার সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাদের দুবাই পাঠানোর কথা বলে পাসপোর্ট নিয়ে নেন। তিনি বলেন, ‘আমি ছাড়াও মহরম, মজনু ও হেলাল পাসপোর্ট দেয়। তারা আমাদের কাছ থেকে কয়েক দফায় ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেয়। কারও কাছ থেকে ৫ লাখ ৬০ হাজারও নিয়েছে। কোনও মেডিক্যাল পরীক্ষা ছাড়াই মজনু ও মহরমকে ৫ আগস্ট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যায়। তখনও তাদের কাছে পাসপোর্ট দেয়নি। বিমানবন্দরে প্রবেশ করানোর পর পাসপোর্ট দেয়। এরপর তারা দু’জন দুবাই যায়। ৬ আগস্ট আমি ও হেলাল যাই। দুবাইতে জাহিদ নামে একজন আমাদের রিসিভ করে।

আটকে রেখে নির্যাতন

চার তরুণ জানায়, দুবাইয়ে নেয়ার পর একটি বাড়িতে তাদের চারজনকে (ফাহিম রেজা, মহরম, মজনু ও হেলাল) আটকে রেখে নির্যাতন চালায় জুয়েল ও জাহিদ। চাকরি চাইলেই তাদের নির্যাতন করা হয়। তাদের কাছ থেকে হাত খরচের টাকাও নিয়ে নেয় তারা। সেখানে নেপাল ও পাকিস্তানের লোকজনও এসব নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত। একদিন তাদের বন্দী হিসেবে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে নেয়া হচ্ছিল। এ সময় সুযোগ বুঝে তারা পালিয়ে যায়।

সমুদ্রের তীরে ও ফুটপাতে আত্মগোপন

মজনু, মহরম, হেলাল ও ফাহিম পালিয়ে দুবাইয়ের ফুটপাত, ক্যাফেটেরিয়া, পার্ক ও সমুদ্রের তীরে প্রায় দুই সপ্তাহ ছিলেন। এ সময় এক বাংলাদেশির সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। তার কাছে কাজ চাইলে তিনি জানান, ভ্রমণ ভিসায় তারা কোনও কাজ পাবেন না। এরপর বাড়ি থেকে টিকিটের টাকা এনে তারা দুবাই থেকে গত ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন।

ভুক্তভোগী মহরম বলেন, ‘আমরা প্রায় দুই সপ্তাহের বেশি খোলা আকাশের নিচে ছিলাম। মানুষের কাছে চেয়ে খেয়েছি। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে কোনও রকম প্রাণ বাঁচিয়েছি। বাংলাদেশে ফিরে তিন যুবক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন। এরপর গতকাল ভোরে র‌্যাব-৩ অভিযানে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এবং রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা মধ্যপ্রাচ্যে অবৈধভাবে মানবপাচারচক্রের সঙ্গে জড়িত বলে জানানো হয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পাসপোর্টও জব্দ করা হয়েছে। র‌্যাব-৩ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন জানান, তোফায়েল আহমেদ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার যুবকদের টার্গেট করে। এরপর তার সহযোগীদের মাধ্যমে দুবাই পাচার করে টাকা আত্মসাৎ করে।

ভুয়া কোম্পানিতে পাঠানো হয় শ্রমিকদের

ভুক্তভোগী চার তরুণ জানান, দুবাই পৌঁছানোর পর সেখানে বসবাসকারী জাহিদ তাদের স্বাগত জানিয়ে একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। এরপর ভিকটিমদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও নগদ অর্থ ছিনিয়ে নেয়া হয়। তারপর তাদের একটি সাজানো কোম্পানিতে চাকরি দেয়া হয়। চার-পাঁচ দিন পর ওই কোম্পানি থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, আইনি জটিলতার কারণে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে কোম্পানিটি। এরপর জাহিদ পুনরায় ভিকটিমদের অজ্ঞাত স্থানে বন্দী করে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে অর্থ আদায় শুরু করে।

ভিকটিমদের দাবি, আটকে রাখার সময় তাদের কোনও খাবার দেয়া হয়নি। খাবার চাইলে জাহিদ বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়ে এসে খাবার কিনতে বলে। এ সময় তোফায়েলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে ভিকটিমদের অপেক্ষা করতে বলে। সে জানায়, আইনি জটিলতা দূর হলেই আবার কোম্পানি চালু হবে। তখন তারা বেতন ও কাজের সুযোগ পাবেন। ভিকটিমরা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নিজেদের চেষ্টায় টিকিট জোগাড় করে দেশে আসার চেষ্টা করেন। পাসপোর্ট চাইলে জাহিদ তাদের কাছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দাবি করে।

পাচারের সঙ্গে জড়িতরা কারা

পুলিশ ও ভিকটিমরা জানান, তোফায়েল এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। তার বাবা প্রায় ২৪ বছর ধরে দুবাইয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ায় হোটেলের ব্যবসা করছেন। ২০১৭ সালে তোফায়েল দুবাই গিয়ে তার বাবার হোটেল ব্যবসায় যুক্ত হয়। করোনা মহামারি শুরু হলে সে বাংলাদেশে ফিরে আসে। এ সময় তার কোন উপার্জন না থাকায় সে তার পরিচিত দুবাই প্রবাসী জাহিদের মাধ্যমে মানবপাচারে জড়িয়ে পড়ে।

তোফায়েল তার নিজ বাড়ি চৌদ্দগ্রামে (কুমিল্লা) একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালু করে। কিন্তু ওই এজেন্সির কোনও লাইসেন্স ছিল না। তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে দুবাইয়ে যাতায়াত করছেন। তাই নিজেদের প্রয়োজনে তাদের বিভিন্ন ট্রাভেল ও রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে পরিচয় ছিল। এছাড়াও দুবাইয়ের জাহিদ দীর্ঘদিন ধরে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। জাহিদের মাধ্যমে আনিছুর ও আক্তারের সঙ্গে পরিচয় হয় তোফায়েলের। তাদের মাধ্যমেই রাসেলসহ অন্য দালালদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। জাহিদ দুবাই থেকে ভ্রমণ ভিসা তৈরিতে এই চক্রকে সহায়তা করে থাকে। তোফায়েলও নিয়মিত দুবাই আসা-যাওয়া করে। সর্বশেষ গত আগস্টে দুবাই গিয়ে সে সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে আসে।

আক্তার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে স্নাতক পাস করেছে। সে কিছু দিন বনানী এলাকায় একটি কাপড়ের দোকানে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করে। পরে স্বল্প শ্রমে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় সে মানবপাচারকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। আনিছুর ও আক্তার একই এলাকার হওয়ায় তাদের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠে। প্রথমে তারা পৃথকভাবে মানবপাচারে জড়িত থাকলেও ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে তারা সিটি এক্সপ্রেস ট্রাভেল এজেন্সি নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে গুলশানে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সুসজ্জিত অফিস চালু করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় দালাল নিযুক্ত করে এবং বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে সখ্য গড়ে মানবপাচারের কাজে লিপ্ত হয়। ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মো. আক্তার হোসেন ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. আনিছুর রহমান।

আনিছুর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান পাস করে কিছু দিন রাজধানীর একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে। স্বল্প শ্রমে অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় সে মানবপাচারকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়। মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু দেশে প্রবাসী বন্ধু রয়েছে তার। তাদের মাধ্যমে সে ভুয়া ডিমান্ড লেটার, ইনভাইটেশন ও ওয়ার্ক পারমিট সংগ্রহ করে বিভিন্ন দেশে মানবপাচার করে থাকে। এছাড়াও এসব প্রবাসী দালাল ভিকটিম ও অভিভাবকদের বিদেশ থেকে ফোন দিয়ে ভালো বেতনের নিশ্চয়তা দিয়ে প্রতারণায় সহায়তা করে থাকে।

রাসেল কুমিল্লার একটি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাস করেছে। দুই বছর ধরে মানবপাচারচক্রের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করে আসছে সে। আক্তার ও আনিছুর বিশ্বস্ততার পুরস্কার হিসেবে তাকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিটি এক্সপ্রেস ট্রাভেল এজেন্সির ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত করে। এছাড়াও দুবাই প্রবাসী জাহিদের সে গৃহশিক্ষক ছিল। জাহিদ ও রাসেলের নিজ বাড়ি কুমিল্লা এলাকায় হওয়ায় তাদের মধ্যে সখ্য রয়েছে।