লিটন চক্রবর্তী মিঠুন
মানবকেন্দ্রিকতাবাদ (Anthropocentrism)
আলরিশ বেকের (টষৎরপয ইবপশ) মতে, ‘আমরা অনাকাক্সিক্ষত বা অনভিপ্রেত পরিণামের দুনিয়ায় বাস করছি।’ আমরা এমন সময়ের বাসিন্দা, যখন ছোটখাটো বিষয়ও অদ্ভুতভাবে রাজনৈতিকায়িত। এর একটি কারণ হচ্ছে আমাদের প্রত্যেকটি কাজের একটা পরিণামফল আছে, অনেক ক্ষেত্রেই যা অনিয়ন্ত্রণযোগ্য। ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত সংকট এ কর্মফল-নির্ভর ধারণাকে আরও পোক্ত করছে। এমন কথাও আজকাল বলা হচ্ছে, যে, পশ্চিমা সমাজ ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রের অখ-তা (রহঃবমৎরঃু) বিনাশে স্বেচ্ছায় তৎপর (জড়নবৎঃ ঔ. ইৎঁষষব)। তবে কি বাইবেল মানবজাতিকে সমস্ত পৃথিবীর ওপর আধিপত্য দিয়ে ভুল করেছে? লিন হোয়াইট জুনিয়র সাহেবের এ সওয়াল ১৯৬৭ সাল থেকে আমাদেরকে ভাবাচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি পশ্চিমা ভাবনার একটি অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রাকৃতিক জগৎ (হধঃঁৎধষ ড়িৎষফ) ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে গভীর ও ধ্বংসপরায়ণ মনোবৃত্তি। রবার্ট জে. ব্রাল বিষয়টাকে নিয়ে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন:
প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের প্রশ্নগুলো সেরেফ কারিগরি (ঃবপযহরপধষ) প্রশ্ন নয়; বরং সেগুলো ভাল ও নৈতিক জীবনের সংজ্ঞা নিয়ে যেমন, তেমনি আমাদের অস্তিত্বের সারবস্তু ও অর্থ নিয়েও। কাজেই এগুলো একাডেমিক বা কারিগরি ব্যাপার নয়, যে বিশেষজ্ঞদের উচ্চমার্গীয় আলাপচারিতায় সুরাহা করা যাবে। বরং এগুলো আমাদের মানব সম্প্রদায়ের সংজ্ঞা কী ও কীভাবে তার অস্তিত্বধারণ করা উচিতÑ এ জাতীয় মৌলিক প্রশ্ন। (উদ্ধৃত, ক্লার্ক, পৃ. ১)
বোঝাই যাচ্ছে, মানুষের ব্যক্তিসত্তা, মালিকানাবোধ ও নৈতিকতার বিষয়গুলো ইকোক্রিটিসিজমের আওতাধীন। কিন্তু, এই বিষয়গুলো নিয়ে পরিবেশবাদী মহল বিভিন্ন শিবিরে বিভক্ত। এর মধ্যে সংস্কারপন্থী পরিবেশবাদ (ৎবভড়ৎস বহারৎড়হসবহঃধষরংস) সবচেয়ে পরিচিত ও প্রভাবশালী। এটা মূলধারার চিন্তাটাকে সমর্থন করে, যে, প্রাকৃতিক জগৎ হচ্ছে প্রধানত মানুষের ব্যবহারযোগ্য সম্পদ (ৎবংড়ঁৎপব), তা হোক অর্থনৈতিকভাবে বা সাংস্কৃতিকভাবে। তবে এ ঘরানার পরিবেশবাদ অতি-ব্যবহার বা শোষণের হাত থেকে প্রাকৃতিক জগৎকে রক্ষণ ও সংরক্ষণ করতেও সচেষ্ট। বুনিয়াদিভাবে, সংস্কারপন্থী পরিবেশবাদীরা পুঁজিবাদী শিল্পায়িত সমাজের দেওয়া টার্ম বা পরিভাষার ভেতরে থেকে পদক্ষেপ করার পক্ষে ওকালতি করে। টেকসই উন্নয়ন (ংঁংঃধরহধনষব ফবাবষড়ঢ়সবহঃ), কার্বন-অফসেট, ঝমকালো ম্যাগাজিনে সংরক্ষণপন্থী দাতব্য কাজ (পড়হংবৎাধঃরড়হ পযধৎরঃরবং), ইত্যাদি হচ্ছে সে পরিভাষার কিছু নমুনা। পরিবেশবাদী রাজনীতি এমন একটি ব্যাপার যা মূলত মানুষের স্বার্থ ও জীবনমান, এবং নান্দনিকভাবে আকর্ষণীয় ভূদৃশ্য (ষধহফংপধঢ়ব) ও তার সাথে জড়িত অবসর বিনোদন প্রয়াসের (ষবরংঁৎব ঢ়ঁৎংঁরঃং) হেফাজত করার ব্যাপার। এটা দীর্ঘমেয়াদী মানবীয় আক্কেলবুদ্ধি, দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞার বিষয়। দেখা যায়, সংস্কারপন্থী পরিবেশবাদ এক ধরনের ভোক্তা ধার্মিকতাকে (পড়হংঁসবৎ ঢ়রবঃু) উৎসাহিত করে। যেমন, যদি ভোক্তারা একটু কম ধ্বংসাত্মক ধরনের গাড়ি কেনে, তাহলে তা পৃথিবী রক্ষার মতো একটি সওয়াব বা পুণ্যকাজ হিসেবে গণ্য হয়। মানে হচ্ছে, ভোক্তা পণ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটু সচেতন হবেন যেন তাঁদের সে পণ্যটির উৎপাদন প্রক্রিয়া ও ব্যবহার পরিবেশের জন্য তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর। (আদতেই তাতে কাজ হবে?)
অন্যদিকে, অধিকতর রেডিক্যাল মতানুসারে পরিবেশগত সমস্যা আরও গুরুতর বিষয় যা আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘষামাজা বা ফাইন-টিউনিঙের মাধ্যমে সামলানো সম্ভব না। তাঁরা আধুনিক সমাজের বস্তুবাদী (সধঃবৎরধষ) ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিসমূহের পুনর্ভাবনা দাবি করে। এ র্যাডিক্যাল মতবাদীদের একটা কাফেলা হচ্ছে গভীর বাস্তুতন্ত্রবাদী (ফববঢ় বপড়ষড়মরংঃং) যাঁরা পরিবেশবাদের পহেলা দুশমন হিসেবে দেখেন মানবকেন্দ্রিকতাবাদকে (ধহঃযৎড়ঢ়ড়পবহঃৎরংস)। মানবকেন্দ্রিকতার গভীরে আছে এ সর্বব্যাপী চিন্তা যে, বাদবাকি দুনিয়ার সমস্ত কিছুর মূল্য মানুষের সাথে তার সম্পর্কের নিরিখে নির্ধারিত হয়। গভীর বাস্তুতন্ত্রবাদীরা মানবকেন্দ্রিক (৯-এর পৃষ্ঠায় পড়–ন) (৭-এর পৃষ্ঠার পর)
চিন্তাধারাকে মোটেই বরদাশত করেন না। বরং তাঁরা মানুষের আত্ম-উপলব্ধির ভেতরে একটা মৌলিক পরিবর্তন দাবি করেন। তাঁদের কথা হচ্ছে কারোরই উচিত নয় নিজেকে পরমাণুগঠিত (ধঃড়সরংঃরপ) এমন একটা সত্তা ভাবা যার কাজ হচ্ছে ভোগ (পড়হংঁসঢ়ঃরড়হ) করা আর আত্মজাহির (ংবষভ-ধংংবৎঃরড়হ) করা। বরং এটা ভাবাই উচিত প্রত্যেকে বৃহত্তর প্রাণসত্তার অংশ। সঙ্গত কারণে সমস্ত মানব কর্মকা- চালিত হওয়া উচিত সমগ্র জীবম-লের (নরড়ংঢ়যবৎব) মঙ্গলচিন্তাকে মাথায় রেখে। এরকম জীবকেন্দ্রিকতাবাদ (নরড়পবহঃৎরংস) সমস্ত প্রাকৃতিক জীবসত্তার অন্তর্নিহিত মূল্যকে (রহঃৎরহংরপ াধষঁবং) জোরদারভাবে কবুল করে। পাশাপাশি, বর্তমানের মানবকেন্দ্রিক একচোখা আচরণ যেখানে তুচ্ছ মানবীয় চাহিদাকেও অপারপর প্রজাতি বা স্থানের অখ-তার (রহঃবমৎরঃু ড়ভ ঢ়ষধপব) ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়, তা থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস চালায় জীবকেন্দ্রিকতাবাদ।
আবার, পরিবেশ-নারীবাদী (বপড়ভবসরহরংঃ) ও সামাজিক বাস্তুবিদ্যার চিন্তকগণ পরিবেশচিন্তায় বিচিত্রমুখী ব্যাখাবিশ্লেষণ, আদর্শগত চেতনা ও কর্মশক্তি নিয়ে আসেন। এ বিষয়ে মারে বুকচিন (গঁৎৎধু ইড়ড়শপযরহ) সুন্দর একটি কথা বলেছেন: ‘প্রকৃতির ওপর আধিপত্যের বিষয়টাই এসেছে মানুষের ওপর মানুষের আধিপত্যের ধারণা থেকে’। টিমোথি ক্লার্ক মত দিয়েছেন যে, ‘বাস্তুতান্ত্রিক সমস্যাবলি মানব সমাজে বিরাজিত ক্ষমতাকাঠামো (যরবৎধৎপযু) ও আভিজাত্যের (বষরঃরংস) গঠনবিন্যাস থেকেই উৎপন্ন হয়, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে মুনাফার উৎস হিসেবে অপরাপর মানুষ ও প্রাকৃতিক জগৎকে ব্যবহার ও শোষণ করা’। সেজন্যই দেখা যায়, সমালোচকগণ বুনিয়াদি রাজনৈতিক সংস্কারের ওকালতি করেন ছোট-পরিসরের, প্রায় নৈরাজ্যবাদী সমাজব্যবস্থার লক্ষে, যেখানে ভেতর থেকে গড়ে ওঠা না-ইনসাফির প্রথা ও প্রতিষ্ঠান (রহনঁরষঃ রহংঃরঃঁঃরড়হং ড়ভ রহলঁংঃরপব) থাকবে না।
এ সমস্ত রেডিক্যাল পরিবেশবাদীর কাছে কার্বন-অফসেট স্কিম (কার্বন-শোষণ প্রকল্প), বা এমনধারার পদক্ষেপসমূহÑ যা বাজার-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির সাথে কিছুটা সামঞ্জস্য রেখে পরিবেশগত অবক্ষয়কে সামলানোর কাজে লাগানো যায় বলে প্রচার করা হচ্ছেÑ সেগুলোকে অপর্যাপ্ত ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হয়। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি প্রচলিত প্রতিষ্ঠান ও আইন-আদালতের বৈধতাকেই (ষবমরঃরসধপু) প্রশ্ন করে এবং এরকম বিশ্বাসকেও প্রতিষ্ঠা দেয়, যে, শিল্পায়িত বাজার অর্থনীতি এবং আধুনিক রাষ্ট্র বুনিয়াদি ও কাঠামোগতভাবে অন্তহীন পুঁজি অর্জন প্রক্রিয়ার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। এবং এর শেষ হবে ধ্বংসের মধ্য দিয়েÑ হয় রাজনৈতিক পালাবদলের মাধ্যমে এ সিস্টেম ভূলুণ্ঠিত হবে, নয়তো পরিবেশগত মহাবিপর্যয়ের (পধঃধংঃৎড়ঢ়যব) মধ্য দিয়ে এটার বিনাশ ঘটবে।
এখন আসা যাক, মানবকেন্দ্রিকতাবাদের সংজ্ঞায়ন প্রসঙ্গে। এটি বলতে আসলে সব রকমের অবস্থান, মতামত, মতাদর্শ, চিন্তা-ভাবনা, অনুভব ও ধারণাকেই বোঝায় যা মানুষকে কেন্দ্র বা আদর্শ মনে করে। কাজেই, মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক জগৎকে দেখতে গেলে দেখতে হবে মানুষের সাথে এর সম্পর্কের আলোকে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, প্রাকৃতিক জগৎকে অর্থনৈতিক সম্পদ বা রিসোর্স হিসেবে দেখলে, কিংবা নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক বা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করলে সেটা হবে মানবকেন্দ্রিক মূল্যায়ন। শুধু তাই নয়, ভূদৃশ্য বা প্রাকৃতিক দৃশ্যকেও যদি নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে দেখা হয়, তাও হতে পারে মানবকেন্দ্রিকতার উদাহরণ। এমনকি চ-ীদাসের “শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই” বাণীটিও মানবকেন্দ্রিক চিন্তার প্রকাশ বলেই গণ্য হবে। “মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব”Ñ বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শনের এ অবস্থানটাও আদপে মানবকেন্দ্রিক। প্রায়শই মানবকেন্দ্রিকতাবাদকে জীবকেন্দ্রিকতাবাদের বিপরীতে স্থাপন করা হয়। এ মতবাদটি সমস্ত প্রাণসত্তা বা সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে (বপড়ংুংঃবস) সমগুরুত্ব দেবার কোশেশ করে। কোনও নির্দিষ্ট প্রজাতিকে (অর্থাৎ, মানবজাতি) আর সমস্ত কিছুর ওপরে স্থান দেয়া বা সুবিধে দেয়ার বিরুদ্ধে জীবকেন্দ্রিক মতবাদের অবস্থান।
টিমোথি ক্লার্ক প্রমুখদের মতে, মানবকেন্দ্রিকতাবাদ অতিসাধারণীকরণ বা ঢালাওপনার শিকার। কেননা, জীবকেন্দ্রিকতাবাদও (নরড়পবহঃৎরংস) কিন্তু দিনশেষে মানুষই করে। সেভাবে দেখতে গেলে, জীবকেন্দ্রিকতাবাদ কিছুটা হলেও মানবকেন্দ্রিক। তবে, পরিবেশগত পর্যালোচনার জগতে মানবকেন্দ্রিকতা মোটা দাগে মানুষ ও তার স্বার্থসমূহকে মূলবান মনে করে এবং অ-মানব সত্তাসমূহের চাইতে অগ্রাধিকার দেয়। যেমন, মানুষের প্রয়োজনে নদী-নালা, জলা-জঙ্গল, প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড় করে, ভূ-গর্ভস্থ খনিজপদার্থ উত্তোলন করে পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে, অপরাপর জীবসত্তাকে জাহান্নামের চৌরাস্তা দেখিয়ে যে কর্মযজ্ঞ, তাই হচ্ছে চূড়ান্ত বিচারে মানবকেন্দ্রিকতা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ব্যাপক অর্থে মানবকেন্দ্রিক (এবং শোষণমূলক)। এর ভেতরে যেন এ লাইনটাই বেজে চলে: ‘সবাই খাচ্ছে লুটেপুটে, তুই কেন খাবি খুঁটে?’
কাজেই এ মানবকেন্দ্রিকতাবাদের চরম বাড়াবাড়ির প্রেক্ষাপটে পরিবেশবাদী আন্দোলন ও পর্যালোচনা দিনকে দিন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। ইকোক্রিটিজসিজম সাহিত্য সমালোচনার পরিসরে মানবকেন্দ্রিক ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে সোচ্চার। শেরিল গল্টফেল্টি যেমনটি বলেছেন, “যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ইকোক্রিটিকাল কাজগুলোর একটি সাধারণ প্রণোদনা হচ্ছে এ ত্যক্তকর চেতনা যে, আমরা পরিবেশগত সীমার (বহারৎড়হসবহঃধষ ষরসরঃং) যুগের বসবাস করছি। এটা এমন এক সময় যখন মানুষের কাজকারবার গ্রহের মৌলিক প্রাণধারণ ব্যবস্থাকে (নধংরপ ষরভব ংঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ ংুংঃবসং) ধ্বংস করে ফেলছে। আমরা এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি। হয় আমাদেরকে আমাদের খাসালৎ বা পথ (ধিুং) বদলাতে হবে, নয়তো মোকাবেলা করতে হবে বৈশ্বিক বিপর্যয়টাকে, যা কেয়ামত বা মহাপ্রলয়ের দিকে আমাদের সম্মুখযাত্রায় সমস্ত সুন্দরকে তছনছ করে ফেলবে এবং আমাদের গ্রহবাসী অগুনতি প্রজাতিকে চিরকালের মতো নিঃশেষ করে দেবে” (ঞযব ঊপড়পৎরঃরপরংস জবধফবৎ; ঢ়. ীী; আমার অনুবাদ)। তিনি আরও মনে করেন যে, ‘আমরা যদি সমাধানের অংশ না হই, তাহলে আমরাই সমস্যার অংশ’। কী নির্জলা সত্যভাষণ!
নিঃসন্দেহে, আমাদের সামনে গুরুদায়িত্ব বর্তেছে মানবকেন্দ্রিকতার আতিশয্য ও নেতিবাচক প্রভাবকে সামলে “প্রকৃতির সুবিধাপ্রাপ্ত প্রজাতি” হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা। সাহিত্যের পাঠক, সমঝদার, সমালোচক, শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষক হিসেবে আমাদের কর্তব্য তাই পরিবেশের পুনর্বহালের (restoration) সপক্ষে, এবং একটা বড় মাত্রায় আমাদের কর্মফল হিসেবে সৃষ্ট পারিবেশিক সংকটের সমাধান খোঁজায় তৎপর হওয়া। ইতিহাসবিদ ডোনাল্ড উর্স্টার (Donald Worster)আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন: “বাস্তুতন্ত্র কীভাবে কাজ করছে তার ভিত্তিতে নয়, বরং কীভাবে আমাদের নৈতিক ব্যবস্থার (ethical systems) কার্যক্রমের ভিত্তিতে আমরা আজকে একটা বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলা করছি। এ সংকট সামলাতে গেলে প্রকৃতির ওপর আমাদের প্রভাব (impact) যথাসম্ভব সঠিকভাবে বুঝতে হবে। তারচেয়েও যা বেশি করে বুঝতে হবে সে সমস্ত নৈতিক ব্যবস্থাকে। সে উপলব্ধিটাকে কাজে লাগিয়ে নৈতিক ব্যবস্থাগুলোর সংস্কার বা পরিমার্জনা করতে হবে। ইতিহাসবিদগণ সাহিত্য প-িত, নৃতত্ত্ববিদ এবং দার্শনিকবৃন্দের সাথে মিলে অবশ্য সে সংস্কারকর্ম করতে পারবেন না, কিন্তু তাঁরা সে উপলব্ধির জায়গায় সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবেন” (উদ্ধৃত; পুর্বোক্ত; পৃ. xxi)।
যেহেতু সাহিত্যসমালোচকগণ প্রধানত মানববিদ্যার লোক, বিজ্ঞানের অনুশীলক নন, তাঁদের কাজ হচ্ছে মানব সমাজ ও সংস্কৃতি কীভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশের সংকটের কারণ সে বিষয়ের বিচার-বিশ্লেষণ করা। তাঁদের দায়িত্ব পরিবেশ বিষয়ে আমাদের বোধের উদ্বোধন ঘটানো যাতে আমরা প্রাপ্ত তথ্য, তত্ত্ব, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকে পরিবেশ রক্ষার স্থানিক ও বৈশ্বিক আন্দোলনে শামিল হতে পারি। কারণ, জলবায়ু সংকটসহ যাবতীয় পরিবেশগত সমস্যার সমাধান রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। আর বিশ্বনেতাদের ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরির জন্য যে জনসচেতনতার উন্মেষ ও সাংস্কৃতিক পটপরিবর্তন ঘটানো দরকার, তাতে ভূমিকা রাখতে পারেন সাহিত্য ও সংস্কৃতির বোদ্ধাগণ। ঠিক এ প্রেক্ষাপটে ইকোক্রিটিকগণ প্রাসঙ্গিক, এবং প্রাসঙ্গিক আমাদের সংস্কৃতিজাত মানবকেন্দ্রিকতাবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রামী অবস্থানও। সুতরাং, ইকোক্রিটিকগণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সাথে গলা মিলিয়ে বলতেই পারেন:
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।। (ছাড়পত্র)
তথ্যসূত্র:
1: The Cambridge Introduction to Literature and the Environment by Timothy Clark (2011)
2. The Ecocriticism Reader, edited by Cheryll Glotfelty & Harold Fromm (1996)
3. Internet
বৃহস্পতিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২২ , ২০ আশ্বিন ১৪২৯ ০৮ সফর ১৪৪৪
লিটন চক্রবর্তী মিঠুন
মানবকেন্দ্রিকতাবাদ (Anthropocentrism)
আলরিশ বেকের (টষৎরপয ইবপশ) মতে, ‘আমরা অনাকাক্সিক্ষত বা অনভিপ্রেত পরিণামের দুনিয়ায় বাস করছি।’ আমরা এমন সময়ের বাসিন্দা, যখন ছোটখাটো বিষয়ও অদ্ভুতভাবে রাজনৈতিকায়িত। এর একটি কারণ হচ্ছে আমাদের প্রত্যেকটি কাজের একটা পরিণামফল আছে, অনেক ক্ষেত্রেই যা অনিয়ন্ত্রণযোগ্য। ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত সংকট এ কর্মফল-নির্ভর ধারণাকে আরও পোক্ত করছে। এমন কথাও আজকাল বলা হচ্ছে, যে, পশ্চিমা সমাজ ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রের অখ-তা (রহঃবমৎরঃু) বিনাশে স্বেচ্ছায় তৎপর (জড়নবৎঃ ঔ. ইৎঁষষব)। তবে কি বাইবেল মানবজাতিকে সমস্ত পৃথিবীর ওপর আধিপত্য দিয়ে ভুল করেছে? লিন হোয়াইট জুনিয়র সাহেবের এ সওয়াল ১৯৬৭ সাল থেকে আমাদেরকে ভাবাচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি পশ্চিমা ভাবনার একটি অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রাকৃতিক জগৎ (হধঃঁৎধষ ড়িৎষফ) ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে গভীর ও ধ্বংসপরায়ণ মনোবৃত্তি। রবার্ট জে. ব্রাল বিষয়টাকে নিয়ে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন:
প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের প্রশ্নগুলো সেরেফ কারিগরি (ঃবপযহরপধষ) প্রশ্ন নয়; বরং সেগুলো ভাল ও নৈতিক জীবনের সংজ্ঞা নিয়ে যেমন, তেমনি আমাদের অস্তিত্বের সারবস্তু ও অর্থ নিয়েও। কাজেই এগুলো একাডেমিক বা কারিগরি ব্যাপার নয়, যে বিশেষজ্ঞদের উচ্চমার্গীয় আলাপচারিতায় সুরাহা করা যাবে। বরং এগুলো আমাদের মানব সম্প্রদায়ের সংজ্ঞা কী ও কীভাবে তার অস্তিত্বধারণ করা উচিতÑ এ জাতীয় মৌলিক প্রশ্ন। (উদ্ধৃত, ক্লার্ক, পৃ. ১)
বোঝাই যাচ্ছে, মানুষের ব্যক্তিসত্তা, মালিকানাবোধ ও নৈতিকতার বিষয়গুলো ইকোক্রিটিসিজমের আওতাধীন। কিন্তু, এই বিষয়গুলো নিয়ে পরিবেশবাদী মহল বিভিন্ন শিবিরে বিভক্ত। এর মধ্যে সংস্কারপন্থী পরিবেশবাদ (ৎবভড়ৎস বহারৎড়হসবহঃধষরংস) সবচেয়ে পরিচিত ও প্রভাবশালী। এটা মূলধারার চিন্তাটাকে সমর্থন করে, যে, প্রাকৃতিক জগৎ হচ্ছে প্রধানত মানুষের ব্যবহারযোগ্য সম্পদ (ৎবংড়ঁৎপব), তা হোক অর্থনৈতিকভাবে বা সাংস্কৃতিকভাবে। তবে এ ঘরানার পরিবেশবাদ অতি-ব্যবহার বা শোষণের হাত থেকে প্রাকৃতিক জগৎকে রক্ষণ ও সংরক্ষণ করতেও সচেষ্ট। বুনিয়াদিভাবে, সংস্কারপন্থী পরিবেশবাদীরা পুঁজিবাদী শিল্পায়িত সমাজের দেওয়া টার্ম বা পরিভাষার ভেতরে থেকে পদক্ষেপ করার পক্ষে ওকালতি করে। টেকসই উন্নয়ন (ংঁংঃধরহধনষব ফবাবষড়ঢ়সবহঃ), কার্বন-অফসেট, ঝমকালো ম্যাগাজিনে সংরক্ষণপন্থী দাতব্য কাজ (পড়হংবৎাধঃরড়হ পযধৎরঃরবং), ইত্যাদি হচ্ছে সে পরিভাষার কিছু নমুনা। পরিবেশবাদী রাজনীতি এমন একটি ব্যাপার যা মূলত মানুষের স্বার্থ ও জীবনমান, এবং নান্দনিকভাবে আকর্ষণীয় ভূদৃশ্য (ষধহফংপধঢ়ব) ও তার সাথে জড়িত অবসর বিনোদন প্রয়াসের (ষবরংঁৎব ঢ়ঁৎংঁরঃং) হেফাজত করার ব্যাপার। এটা দীর্ঘমেয়াদী মানবীয় আক্কেলবুদ্ধি, দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞার বিষয়। দেখা যায়, সংস্কারপন্থী পরিবেশবাদ এক ধরনের ভোক্তা ধার্মিকতাকে (পড়হংঁসবৎ ঢ়রবঃু) উৎসাহিত করে। যেমন, যদি ভোক্তারা একটু কম ধ্বংসাত্মক ধরনের গাড়ি কেনে, তাহলে তা পৃথিবী রক্ষার মতো একটি সওয়াব বা পুণ্যকাজ হিসেবে গণ্য হয়। মানে হচ্ছে, ভোক্তা পণ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটু সচেতন হবেন যেন তাঁদের সে পণ্যটির উৎপাদন প্রক্রিয়া ও ব্যবহার পরিবেশের জন্য তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিকর। (আদতেই তাতে কাজ হবে?)
অন্যদিকে, অধিকতর রেডিক্যাল মতানুসারে পরিবেশগত সমস্যা আরও গুরুতর বিষয় যা আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘষামাজা বা ফাইন-টিউনিঙের মাধ্যমে সামলানো সম্ভব না। তাঁরা আধুনিক সমাজের বস্তুবাদী (সধঃবৎরধষ) ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিসমূহের পুনর্ভাবনা দাবি করে। এ র্যাডিক্যাল মতবাদীদের একটা কাফেলা হচ্ছে গভীর বাস্তুতন্ত্রবাদী (ফববঢ় বপড়ষড়মরংঃং) যাঁরা পরিবেশবাদের পহেলা দুশমন হিসেবে দেখেন মানবকেন্দ্রিকতাবাদকে (ধহঃযৎড়ঢ়ড়পবহঃৎরংস)। মানবকেন্দ্রিকতার গভীরে আছে এ সর্বব্যাপী চিন্তা যে, বাদবাকি দুনিয়ার সমস্ত কিছুর মূল্য মানুষের সাথে তার সম্পর্কের নিরিখে নির্ধারিত হয়। গভীর বাস্তুতন্ত্রবাদীরা মানবকেন্দ্রিক (৯-এর পৃষ্ঠায় পড়–ন) (৭-এর পৃষ্ঠার পর)
চিন্তাধারাকে মোটেই বরদাশত করেন না। বরং তাঁরা মানুষের আত্ম-উপলব্ধির ভেতরে একটা মৌলিক পরিবর্তন দাবি করেন। তাঁদের কথা হচ্ছে কারোরই উচিত নয় নিজেকে পরমাণুগঠিত (ধঃড়সরংঃরপ) এমন একটা সত্তা ভাবা যার কাজ হচ্ছে ভোগ (পড়হংঁসঢ়ঃরড়হ) করা আর আত্মজাহির (ংবষভ-ধংংবৎঃরড়হ) করা। বরং এটা ভাবাই উচিত প্রত্যেকে বৃহত্তর প্রাণসত্তার অংশ। সঙ্গত কারণে সমস্ত মানব কর্মকা- চালিত হওয়া উচিত সমগ্র জীবম-লের (নরড়ংঢ়যবৎব) মঙ্গলচিন্তাকে মাথায় রেখে। এরকম জীবকেন্দ্রিকতাবাদ (নরড়পবহঃৎরংস) সমস্ত প্রাকৃতিক জীবসত্তার অন্তর্নিহিত মূল্যকে (রহঃৎরহংরপ াধষঁবং) জোরদারভাবে কবুল করে। পাশাপাশি, বর্তমানের মানবকেন্দ্রিক একচোখা আচরণ যেখানে তুচ্ছ মানবীয় চাহিদাকেও অপারপর প্রজাতি বা স্থানের অখ-তার (রহঃবমৎরঃু ড়ভ ঢ়ষধপব) ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়, তা থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস চালায় জীবকেন্দ্রিকতাবাদ।
আবার, পরিবেশ-নারীবাদী (বপড়ভবসরহরংঃ) ও সামাজিক বাস্তুবিদ্যার চিন্তকগণ পরিবেশচিন্তায় বিচিত্রমুখী ব্যাখাবিশ্লেষণ, আদর্শগত চেতনা ও কর্মশক্তি নিয়ে আসেন। এ বিষয়ে মারে বুকচিন (গঁৎৎধু ইড়ড়শপযরহ) সুন্দর একটি কথা বলেছেন: ‘প্রকৃতির ওপর আধিপত্যের বিষয়টাই এসেছে মানুষের ওপর মানুষের আধিপত্যের ধারণা থেকে’। টিমোথি ক্লার্ক মত দিয়েছেন যে, ‘বাস্তুতান্ত্রিক সমস্যাবলি মানব সমাজে বিরাজিত ক্ষমতাকাঠামো (যরবৎধৎপযু) ও আভিজাত্যের (বষরঃরংস) গঠনবিন্যাস থেকেই উৎপন্ন হয়, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে মুনাফার উৎস হিসেবে অপরাপর মানুষ ও প্রাকৃতিক জগৎকে ব্যবহার ও শোষণ করা’। সেজন্যই দেখা যায়, সমালোচকগণ বুনিয়াদি রাজনৈতিক সংস্কারের ওকালতি করেন ছোট-পরিসরের, প্রায় নৈরাজ্যবাদী সমাজব্যবস্থার লক্ষে, যেখানে ভেতর থেকে গড়ে ওঠা না-ইনসাফির প্রথা ও প্রতিষ্ঠান (রহনঁরষঃ রহংঃরঃঁঃরড়হং ড়ভ রহলঁংঃরপব) থাকবে না।
এ সমস্ত রেডিক্যাল পরিবেশবাদীর কাছে কার্বন-অফসেট স্কিম (কার্বন-শোষণ প্রকল্প), বা এমনধারার পদক্ষেপসমূহÑ যা বাজার-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির সাথে কিছুটা সামঞ্জস্য রেখে পরিবেশগত অবক্ষয়কে সামলানোর কাজে লাগানো যায় বলে প্রচার করা হচ্ছেÑ সেগুলোকে অপর্যাপ্ত ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হয়। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি প্রচলিত প্রতিষ্ঠান ও আইন-আদালতের বৈধতাকেই (ষবমরঃরসধপু) প্রশ্ন করে এবং এরকম বিশ্বাসকেও প্রতিষ্ঠা দেয়, যে, শিল্পায়িত বাজার অর্থনীতি এবং আধুনিক রাষ্ট্র বুনিয়াদি ও কাঠামোগতভাবে অন্তহীন পুঁজি অর্জন প্রক্রিয়ার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। এবং এর শেষ হবে ধ্বংসের মধ্য দিয়েÑ হয় রাজনৈতিক পালাবদলের মাধ্যমে এ সিস্টেম ভূলুণ্ঠিত হবে, নয়তো পরিবেশগত মহাবিপর্যয়ের (পধঃধংঃৎড়ঢ়যব) মধ্য দিয়ে এটার বিনাশ ঘটবে।
এখন আসা যাক, মানবকেন্দ্রিকতাবাদের সংজ্ঞায়ন প্রসঙ্গে। এটি বলতে আসলে সব রকমের অবস্থান, মতামত, মতাদর্শ, চিন্তা-ভাবনা, অনুভব ও ধারণাকেই বোঝায় যা মানুষকে কেন্দ্র বা আদর্শ মনে করে। কাজেই, মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক জগৎকে দেখতে গেলে দেখতে হবে মানুষের সাথে এর সম্পর্কের আলোকে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, প্রাকৃতিক জগৎকে অর্থনৈতিক সম্পদ বা রিসোর্স হিসেবে দেখলে, কিংবা নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক বা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করলে সেটা হবে মানবকেন্দ্রিক মূল্যায়ন। শুধু তাই নয়, ভূদৃশ্য বা প্রাকৃতিক দৃশ্যকেও যদি নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে দেখা হয়, তাও হতে পারে মানবকেন্দ্রিকতার উদাহরণ। এমনকি চ-ীদাসের “শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই” বাণীটিও মানবকেন্দ্রিক চিন্তার প্রকাশ বলেই গণ্য হবে। “মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব”Ñ বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শনের এ অবস্থানটাও আদপে মানবকেন্দ্রিক। প্রায়শই মানবকেন্দ্রিকতাবাদকে জীবকেন্দ্রিকতাবাদের বিপরীতে স্থাপন করা হয়। এ মতবাদটি সমস্ত প্রাণসত্তা বা সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে (বপড়ংুংঃবস) সমগুরুত্ব দেবার কোশেশ করে। কোনও নির্দিষ্ট প্রজাতিকে (অর্থাৎ, মানবজাতি) আর সমস্ত কিছুর ওপরে স্থান দেয়া বা সুবিধে দেয়ার বিরুদ্ধে জীবকেন্দ্রিক মতবাদের অবস্থান।
টিমোথি ক্লার্ক প্রমুখদের মতে, মানবকেন্দ্রিকতাবাদ অতিসাধারণীকরণ বা ঢালাওপনার শিকার। কেননা, জীবকেন্দ্রিকতাবাদও (নরড়পবহঃৎরংস) কিন্তু দিনশেষে মানুষই করে। সেভাবে দেখতে গেলে, জীবকেন্দ্রিকতাবাদ কিছুটা হলেও মানবকেন্দ্রিক। তবে, পরিবেশগত পর্যালোচনার জগতে মানবকেন্দ্রিকতা মোটা দাগে মানুষ ও তার স্বার্থসমূহকে মূলবান মনে করে এবং অ-মানব সত্তাসমূহের চাইতে অগ্রাধিকার দেয়। যেমন, মানুষের প্রয়োজনে নদী-নালা, জলা-জঙ্গল, প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড় করে, ভূ-গর্ভস্থ খনিজপদার্থ উত্তোলন করে পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে, অপরাপর জীবসত্তাকে জাহান্নামের চৌরাস্তা দেখিয়ে যে কর্মযজ্ঞ, তাই হচ্ছে চূড়ান্ত বিচারে মানবকেন্দ্রিকতা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ব্যাপক অর্থে মানবকেন্দ্রিক (এবং শোষণমূলক)। এর ভেতরে যেন এ লাইনটাই বেজে চলে: ‘সবাই খাচ্ছে লুটেপুটে, তুই কেন খাবি খুঁটে?’
কাজেই এ মানবকেন্দ্রিকতাবাদের চরম বাড়াবাড়ির প্রেক্ষাপটে পরিবেশবাদী আন্দোলন ও পর্যালোচনা দিনকে দিন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। ইকোক্রিটিজসিজম সাহিত্য সমালোচনার পরিসরে মানবকেন্দ্রিক ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে সোচ্চার। শেরিল গল্টফেল্টি যেমনটি বলেছেন, “যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ইকোক্রিটিকাল কাজগুলোর একটি সাধারণ প্রণোদনা হচ্ছে এ ত্যক্তকর চেতনা যে, আমরা পরিবেশগত সীমার (বহারৎড়হসবহঃধষ ষরসরঃং) যুগের বসবাস করছি। এটা এমন এক সময় যখন মানুষের কাজকারবার গ্রহের মৌলিক প্রাণধারণ ব্যবস্থাকে (নধংরপ ষরভব ংঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ ংুংঃবসং) ধ্বংস করে ফেলছে। আমরা এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি। হয় আমাদেরকে আমাদের খাসালৎ বা পথ (ধিুং) বদলাতে হবে, নয়তো মোকাবেলা করতে হবে বৈশ্বিক বিপর্যয়টাকে, যা কেয়ামত বা মহাপ্রলয়ের দিকে আমাদের সম্মুখযাত্রায় সমস্ত সুন্দরকে তছনছ করে ফেলবে এবং আমাদের গ্রহবাসী অগুনতি প্রজাতিকে চিরকালের মতো নিঃশেষ করে দেবে” (ঞযব ঊপড়পৎরঃরপরংস জবধফবৎ; ঢ়. ীী; আমার অনুবাদ)। তিনি আরও মনে করেন যে, ‘আমরা যদি সমাধানের অংশ না হই, তাহলে আমরাই সমস্যার অংশ’। কী নির্জলা সত্যভাষণ!
নিঃসন্দেহে, আমাদের সামনে গুরুদায়িত্ব বর্তেছে মানবকেন্দ্রিকতার আতিশয্য ও নেতিবাচক প্রভাবকে সামলে “প্রকৃতির সুবিধাপ্রাপ্ত প্রজাতি” হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা। সাহিত্যের পাঠক, সমঝদার, সমালোচক, শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষক হিসেবে আমাদের কর্তব্য তাই পরিবেশের পুনর্বহালের (restoration) সপক্ষে, এবং একটা বড় মাত্রায় আমাদের কর্মফল হিসেবে সৃষ্ট পারিবেশিক সংকটের সমাধান খোঁজায় তৎপর হওয়া। ইতিহাসবিদ ডোনাল্ড উর্স্টার (Donald Worster)আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন: “বাস্তুতন্ত্র কীভাবে কাজ করছে তার ভিত্তিতে নয়, বরং কীভাবে আমাদের নৈতিক ব্যবস্থার (ethical systems) কার্যক্রমের ভিত্তিতে আমরা আজকে একটা বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলা করছি। এ সংকট সামলাতে গেলে প্রকৃতির ওপর আমাদের প্রভাব (impact) যথাসম্ভব সঠিকভাবে বুঝতে হবে। তারচেয়েও যা বেশি করে বুঝতে হবে সে সমস্ত নৈতিক ব্যবস্থাকে। সে উপলব্ধিটাকে কাজে লাগিয়ে নৈতিক ব্যবস্থাগুলোর সংস্কার বা পরিমার্জনা করতে হবে। ইতিহাসবিদগণ সাহিত্য প-িত, নৃতত্ত্ববিদ এবং দার্শনিকবৃন্দের সাথে মিলে অবশ্য সে সংস্কারকর্ম করতে পারবেন না, কিন্তু তাঁরা সে উপলব্ধির জায়গায় সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবেন” (উদ্ধৃত; পুর্বোক্ত; পৃ. xxi)।
যেহেতু সাহিত্যসমালোচকগণ প্রধানত মানববিদ্যার লোক, বিজ্ঞানের অনুশীলক নন, তাঁদের কাজ হচ্ছে মানব সমাজ ও সংস্কৃতি কীভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশের সংকটের কারণ সে বিষয়ের বিচার-বিশ্লেষণ করা। তাঁদের দায়িত্ব পরিবেশ বিষয়ে আমাদের বোধের উদ্বোধন ঘটানো যাতে আমরা প্রাপ্ত তথ্য, তত্ত্ব, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলোকে পরিবেশ রক্ষার স্থানিক ও বৈশ্বিক আন্দোলনে শামিল হতে পারি। কারণ, জলবায়ু সংকটসহ যাবতীয় পরিবেশগত সমস্যার সমাধান রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। আর বিশ্বনেতাদের ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরির জন্য যে জনসচেতনতার উন্মেষ ও সাংস্কৃতিক পটপরিবর্তন ঘটানো দরকার, তাতে ভূমিকা রাখতে পারেন সাহিত্য ও সংস্কৃতির বোদ্ধাগণ। ঠিক এ প্রেক্ষাপটে ইকোক্রিটিকগণ প্রাসঙ্গিক, এবং প্রাসঙ্গিক আমাদের সংস্কৃতিজাত মানবকেন্দ্রিকতাবাদের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রামী অবস্থানও। সুতরাং, ইকোক্রিটিকগণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সাথে গলা মিলিয়ে বলতেই পারেন:
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।। (ছাড়পত্র)
তথ্যসূত্র:
1: The Cambridge Introduction to Literature and the Environment by Timothy Clark (2011)
2. The Ecocriticism Reader, edited by Cheryll Glotfelty & Harold Fromm (1996)
3. Internet