সুব্রত সরকারের সাক্ষাৎকার

‘লেখার সময় কবি স্বাভাবিক পৃথিবীর কেউ নন’

রাহেল রাজিব

সত্তরের দশক উত্তাল দশক- এ সময়ে আপনাদের বেড়ে ওঠা এবং লেখালেখির শুরু... এ সময়কে বাংলা সাহিত্যের উর্বর যুগ বলা হয়। আপনার ব্যক্তি জীবন ও লেখক জীবন কীভাবে এ সময় দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে- সে সম্পর্কে বলুন।

সুব্রত সরকার : দশকের শুরুটাই হয়েছিলো জবাকুসুমসঙ্কাশং মুখে নিয়ে। সারা পৃথিবীকে স্তম্ভিত করা দুটি ঘটনা ঘটিয়েছিল তখনকার মেধাবী তরুণেরা। একদিকে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলন। যা কাঁপিয়ে দিয়েছিলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নষ্ট শসা, পচা চালকুমড়োর সব আয়োজনকে। যদিও তা এক ব্যর্থতার করুণ ইতিহাস আজ। কিন্তু ফর্সা পাখির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের আখের গুছিয়ে নেওয়া বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থার মুখে লাথি মেরে ছাত্র-যুবারা গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নির্দেশ অমান্য করে শুধু ভাষা, কেবলমাত্র মাতৃভাষার জন্যে জন্ম নিয়েছিলো এক নবীন রাষ্ট্রের। কোটি কোটি মানুষের আত্মত্যাগের সামনে দাঁড়িয়ে সমগ্র পৃথিবী। আমি তখন সদ্য কৈশোরে পৌঁছেছি। তাই সারাজীবন ধরে আমাকে লিখে যেতে হয়েছে প্রাণের নিচে আটকে থাকা সেই পেরেকের কথা। পাইপগানের গুলির দাগ যা চুনকাম দিয়ে মুছে ফেলে দিলেও আজও সেখান থেকে রক্ত ঝরে পড়ে। তখন এ কথা লিখবার বয়স হয়নি তাই পরে লিখেছি। “রক্তপরাগ/ না, কপালের ফুটো দিয়ে সোজা গুলি ঢুকে গেছে ব্রেনে,/ সেখানে গর্তের উপরে দু’টি কাক উড়ে উড়ে আসেঃ / কা কা কমরেড!” না ঐ সময়ে আমার কৈশোর না থাকলে কাকের ডাকের ভিতর দিয়ে কমরেডকে আহ্বান করবার আওয়াজ অন্তরে এসে কিছুতেই প্রবেশ করতো না।

রা. রা. : প্রথম কাব্যÑ প্রথম শিল্পসন্তান। প্রথম কাব্য প্রকাশের প্রস্তুতি কালটাই একটা মস্ত লড়াই। সেটার গল্প বলুন আমাদের।

সু. স. : আমার প্রথম কবিতার বইয়ের নাম ‘দেবদারু কলোনি’। যা বেরিয়েছিল ১৯৭৯ সালে, বন্ধুদের চাঁদার টাকায়। প্রচ্ছদ করেছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত শিল্পী তথা বাটা কোম্পানির চিফ আর্টিস পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি নিজের টাকায় প্রচ্ছদটি ছেপে দেন আমার পয়সা নেই বলে। এই অর্থে সত্তরের দশকের কনিষ্ঠতম কবিদের একজন আমি। অগ্রজ সত্তর দশকের অনেকেই আজও তাই দাদা বলেই ডাকি। আমি একটা উদ্বাস্তু কলোনিতে থাকতাম। সেখানে বেশিরভাগ মানুষেরা প্রায় অনাহারে জীবন কাটাতেন। কলোনির গা-ঘেঁষে চলে গেছে যশোর রোড। যা নিয়ে আমি ১০ বছর বয়সে লিখেছি প্রথম কবিতা। আসলে জওহরলাল নেহরুর বাবার নামে আমাদের কলোনির নাম রাখা হয়েছিলো মতিলাল কলোনি। যাতে আবার না উচ্ছেদ হতে হয়। কিন্তু আমাদের বাড়ির পিছনে ছিলো এক দেবদারু গাছ। অনেকগুলি দিদিদের উৎপাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আমি সেই দেবদারু গাছের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলাম। তাকে দেবু-দা বলে ডাকতাম। তাই আমার কলোনিও আমার কাছে একজন মানুষ হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছিল। তখন কলকাতায় মার্কোস অনূদিত হন নি। ফলে আমার প্রথম বইতেই আমি অকারণে বেশ মাইলেজ পেয়ে যাই, যা আজ আমার মনে ঘোরানো সিঁড়ির মতো এক হাসি নিয়ে আসে। যশোর রোডের উলটো দিকে ইংরেজ সাহেবদের ফেলে যাওয়া কোয়ার্টার। সেখানে যারা থাকে তাদের সঙ্গে আমাদের কলোনির বাসিন্দাদের জীবনের আকাশ-পাতাল তফাৎ। আমার মায়ের বাবা ডাক্তার। আমার বাবা সরকারি আমলা তাই আমাদের জীবন অনেক স্বচ্ছল ছিল। কিন্তু আমার মন এই বৈপরীত্যকে কিছুতেই মানতে চাইতো না। লেখায় দেবদারু কলোনিকে মানুষ হিসেব করে তাই লিখেছি। খুবই কাঁচা লেখা তবু মনে করি এটাই আমার সর্বশ্রেষ্ঠ লেখা।

রা. রা. : বাংলা কবিতার বিবর্তনে নিজেকে কীভাবে নির্মাণ করেছেন বারবার?

সু. স. : খুব অল্প বয়স থেকে আমার বিভিন্ন বিষয়ে জানবার ইচ্ছে প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতা দিয়েছে। বাবার অডিট ফার্মের কাজের সূত্রে প্রচুর ভ্রমণ করা শুরু হয়েছিল কলেজ পাস করবার পর থেকে। আমি কমার্সের ছাত্র। কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞান থেকে ভূগোলের বই যেখানে যা পাই তাই পড়ি। সমসাময়িক কবিদের লেখা কম পড়তাম। তাদের সঙ্গ এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করতাম সচেতন ভাবে। যাতে তাদের প্রভাব আমার লেখায় কোনোভাবে না প্রবেশ করে। একটা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে চেয়েছি কতটুকু পেরেছি তা পাঠকেরা বলবে আজ না হলে আগামীকাল। আর যদি না পেরে থাকি তাহলে আমার লেখা মুছে যাবে। তাতে আমার কিছু দুঃখ নেই। আমি তো কবি হবার জন্যে জন্মগ্রহণ করি নি। ছোটোবেলা থেকে বই ভালোবাসতে গিয়ে কেমন অদ্ভুতভাবে নিজেই লিখতে শুরু করেছিলাম তা নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিলো না। সাহিত্যকে আমার চিরকালই বহতা স্রোতের মতো মনে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের লেখকেরা এই স্রোতধারা কে পুষ্ট করে যাবেÑ এই হলো প্রাকৃতিক নিয়ম। আমি আমার মতো করে ক’পৃষ্ঠার কিছু বাংলার প্রাণি রেখে গেলাম।

রা. রা. : প্রতিটা সময়েই ওভাররেটেড লেখক থাকেনÑ পদ পদবি চেয়ার অর্থ ক্ষমতা বেষ্টিত লেখকরা সমকালে জয়ধ্বনি ও হাততালি পানÑ প্রকৃত লেখকের সংগ্রামটি অনেকটা একক ও নিরন্তর। অপ্রাপ্তির খাতার ভারটা বেশি হয়Ñ কিন্তু কালের গহ্বরে জনপ্রিয় ও পদ-পদবিধারী ক্ষমতাধর লেখকবৃন্দ হারিয়ে যানÑ প্রকৃত লেখক টিকে থাকেন। এ বিষয়ে বিশদ বলুন।

সু. স. : আমার একটা কবিতার বইয়ের নাম ‘একাকী মানুষের সৌন্দর্য’। আশা করি এতেই বোঝা যাবে আমার মনের গঠনটি কেমন। আসলে খুব অল্প বয়সে বাবার ফার্মের দৌলতে পদ, প্রভাব, ক্ষমতা এসব নিজের চোখে দেখেছি। তাই সে সবের প্রতি মোহ মন থেকে মুছে গেছে তখনই। আমার কিছুমাত্র আপসোস নেই প্রাতিষ্ঠানিক আনুকূল্য না পাবার জন্যে। বরং এ সবের জন্য যারা হাঁকপাঁক করে তাদের প্রতি করুণা বোধ করি। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই এদের পাশ থেকে অন্যদিকে।

রা. রা. : কবির একটা নেশা থাকতে হয়Ñ টিপসি না হলে নাকি কবির শব্দভা-ে আঘাত লাগে নাÑ কেন? শিল্পের প্রতি এই নেশা সম্পর্কে বলুন।

সু. স. : কবির নেশা হবে বই পড়া, ভ্রমণ। গভীরভাবে যে কোনো বিষয় বা বস্তুকে পর্যবেক্ষণ। আর কিছু নেশার দরকার আছে বলে মনে করি না। বরং যে সব নেশা করলে শরীরের ক্ষতি হয় তা না করতেই বলবো। অনেকে নানা ধরনের শারীরিক সম্পর্কও লেখা বা শিল্পকলার সঙ্গে প্রয়োজনীয় মনে করেন। আমি তা বিশ্বাস করি না। এতে বহু সময় অপচয় হয় বলে আমার ধারণা।

রা. রা. : মাইকেল রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ হয়ে বাংলা কবিতার বাঁক নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?

সু. স. : এই তিনজনের মতো করে আর কেউ আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতায় বাঁক বদল করতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি না। নজরুল বা সুকান্ত একটা অন্য ধারার সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক তা তত সফল হয় নি। তবে কি বাংলা কবিতা জীবনানন্দে এসে থেমে গেছে, তা নয়। অনেক কবিই নতুনভাবে লিখেছেন কিন্তু তার প্রভাব ওদের মতো সর্বত্রগামী হতে পারে নি। হয়তো ভবিষ্যতে কেউ পারবেন। তা কবে হবে এখন বলা অসম্ভব।

রা. রা. : দেশভাগ কাঁটাতার কবিতায় কীভাবে প্রভাব ফেলে?

সু. স. : দেশভাগ বা কাঁটাতার আমায় লেখায় খুব প্রভাব ফেলেছে। এই বিভাজন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, তা নিয়ে কিছু আর বলতে চাই না। বরং আমার অনুভূতির কথা বলি। ট্রেনে চেপে বসলে বিহার বা ওড়িষার সীমান্ত পেরুলেই প্রকৃতি বদলে যায়। ভারতের অন্য দূরবর্তী রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে তা আরও। বাংলাদেশে গেলে কিন্তু তা মনে হয় না। ভূগোলের সঙ্গে কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক আছে। তাই একজন তামিল বা রাজস্থানি কবির চেয়েও বাংলাদেশের একজন কবি আমার অনেক আপনজন। আর তা আমার স্বীকার করা বা না করার উপর নির্ভর করে না।

রা. রা. : আপনার কবিতায় নান্দনিক কারুকাজ দীর্ঘদিন দীক্ষিত ও নিমগ্ন পাঠকদের মোহমুগ্ধ করে চলেছেÑ কবি হিসেবে এ শিল্পসাফল্যকে কীভাবে দেখেন?

সু. স. : আমার কবিতা নান্দনিক না অন্য কিছু সে সব কখনোই ভাবিনি। খুব ছোটোবেলায় একটা দেবদারু গাছকে ভালোবাসার ভিতর দিয়ে শুরু হয়েছিলো আমার আত্মানুসন্ধান। যেন অনেকটা সাকার থেকে নিরাকারের দিকে অনন্ত যাত্রা। আজ অনুভব করি এই ঘূর্ণায়মান মহাজগতের আমি এক ক্ষুদ্র অংশ। ক্ষুদ্র কিন্তু আমাকে ছাড়া এই মহাজগৎ অসম্পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ ধার করে বলি- আমায় নইলে ত্রিভুবনেরশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে। না কবিতা কিছু স্বল্পপাল্লার দৌড় নয় আমার কাছে। তাই এর সাফল্য বা অসাফল্যের সঙ্গে আমার কখনো মোলাকাত হয়নি। বরং যারা জীবনে সাফল্যের পথে হেঁটে গেছে তাদের দিকে ঘোরানো সিঁড়ির মতো তাকিয়ে থেকেছি হাতে রৌপ্য ও পরিহাস নিয়ে।

রা. রা. : কবি কি শুধুই নির্মোহ হবে? কেন?

সু. স. : কবি যখন মানুষ হিসাবে জীবন-যাপন করেন তখন তিনি অবশ্যই নির্মোহ থাকতে পারেন না। কিন্তু কবিতা লেখার সময়টুকু তিনি অবশ্যই পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুগত চেতনার বাইরে চলে যান। তখন মোহ বা নির্মোহের সীমানা কিছু থাকে বলে আমার মনে হয় না। কেবল ঐ লিখবার সময়টুকু। যখন তার মনে লেখা এসে প্রবেশ করছে থেকে লেখা যখন আবার ফের অনির্দেশে চলে যাচ্ছে সেই সময়টুকু তিনি স্বভাবিক পৃথিবীর কেউ নন তখন।

রা. রা. : কবি সুব্রত সরকার ও ব্যক্তি সুব্রত সরকারের দ্বন্দ্বগুলো বলুন।

সু. স. : এ প্রশ্নের জবাব আগেই কিছুটা দিয়েছি। অবশ্যই দুজন আলাদা। লেখার সময় ও না লিখবার সময়। আবার কখনও কখনও তা আলাদা নয়। যেমন যখন লিখে ফেলবার পরে আবার পড়ি তখন আমি নিজেই নিজের লেখার সমালোচক। কখনো মনে পড়ে ঋত্বিক ঘটকের বলা কথাটিÑ “দেশটা ক্রমেই ইতরের দেশ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিজের দেশকে ইতর বলে চিহ্নিত করা অধর্ম, তাই এ বিষয়ে সাবধান হওয়া উচিৎ।” ইত্যাদি। আবার ব্যক্তিগত জীবন-যাপনেও কখনো কবিতা ঢুকে পড়ে তখন কাছের মানুষগুলোর কাছে আমি অচেনা, অস্বস্তিকর বা প্রবল নিহিত পাতালছোঁয়া এক অতল নৌকো। এভাবেই তো কাটিয়ে গেলাম এই মরপৃথিবীতে ৬৫ বছর। দাঁড়িপাল্লা সমান সমান। পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব একদম ঠিক আছে।

রা. রা. : সমালোচকবৃন্দ বলে থাকেন- সুব্রত সরকার “নন্দনতাত্ত্বিক কবি” এই বিশেষণকে কীভাবে দেখেন?

সু. স. : আলাদা করে নন্দনতত্ত্ব বলে কিছু আছে কি না তা নিয়ে আমার খুব সন্দেহ আছে। তবে হ্যাঁ, ছোটোবেলা থেকেই আমি ভেবে এসেছি এই যে জন্মেছি এ কি নিছকই আমার বাবা-মায়ের মিলনের ফল। আবার সময়ে আমার মৃত্যু হবে তা কি কেবল এক যন্ত্রের পরিসমাপ্তি? না এর ভিতরে মহাজাগতিক কিছু পরিকল্পনা ছিলো বা আছে। আবার বিভিন্ন লেখা পড়ে এও জেনেছি এই মহাজগৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে গড়ে উঠেছে এক নির্দিষ্ট পরিণামকে লক্ষ্য রেখে। অথচ মহাজাগতিক বিস্ময়ের আমার অস্তিত্ব কিছু বিষয়ই নয়। আমার সামান্য লেখালেখিতে তার কিছু আসা যাবার কথা নয়। কিন্তু সত্যি কি তাই? তাহলে তো মহান কবি-লেখকদের, শিল্পীদেরও নস্যাৎ করে দিতে হয়। কারণ তারাও তো আমারই মতো নগণ্য এই মহাবিশ্বের কাছে। তা মেনে নিই কী করে? আরও লক্ষ্য করে দেখেছি শিল্প-সাহিত্যজগত যেন কালপ্রবাহের ইশারায় প্রবাহিত। যেন সেখানেও কোথা থেকে নির্দেশ ভেসে আসে। এই ক্ষুদ্র সাক্ষাৎকারে তা সবিস্তারে বলবার সুযোগ নেই। আমি শুধু আমার কিছু প্রশ্নের না পাওয়া উত্তরের ইঙ্গিত রেখে গেলাম। লেখায় তার প্রতিফলন হয়েছে। সন্দেহ আর সন্দেহ শুধু সন্দেহে ভরা রইলো আমার প্রায় ৫০ বছরের লেখাগুলিতে। তা কেউ যদি কখনো পড়ে, কখনো সে লেখার দীর্ঘশ্বাস, অস্পষ্ট অবয়বের ছায়া কেনো পাঠকের কাছে পৌঁছায় আমার সমগ্র জীবন ধন্য হবে, সেদিন।

রা. রা. : এই সন্ধ্যায় দীর্ঘ সময় দিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করলেন। আপনাকে ধনবাদ জানাই কবি।

সু. স. : তোমরাও আমার কথা ধৈর্য ধরে শুনেছো এবং এ সাক্ষাৎকারের জন্যে আমার লেখা কবিতা ও গদ্য লম্বা সময় নিয়ে পাঠ করেছো- তোমাদের ও যাঁরা এ সাক্ষাকারটি পড়ছেন তাঁদের সবার কল্যাণ হোক।

দ্রষ্টব্য:

সুব্রত সরকারের প্রকাশিত কাব্য: দেবদারু কলোনী (১৯৭৯), গত জন্মের ঋতু (১৯৮৬), তোমাদের খুব ভালোবেসেছি (১৯৮৬), সহ্য করো,াংলাভাষা (১৯৯১), তোমাকে মিথ্যা বলেছি(১৯৯২), ঘন মেঘ বলে ঋ (১৯৯৯), বহুত আঁধিয়ার হো বাবু,হামে কুছ রোশনি চাহিয়ে (১৯৯৯), একাকী মানুষের সৌন্দর্য্য (২০০২), ফারেনহাইট ফোর ফিফটি ওয়ান ডিগ্রি (২০০৪), অন্তঃস্থ বিসর্গ (২০১০), না স্নেহকরস্পর্শ (২০১৩), কবিতা সমগ্র (১ম সংস্করণ-২০১২,২য় সংস্করণ ২০১৬), চাঁদ,নমস্কার করলো” (২০১৮)। “সংগীত কণিকামাত্র” (২০১৯)। গদ্যগ্রন্থ: পরিচ্ছন্নতা ও বিষাদের দেবী (২০০৮), রক্তমাংসের পা-ুলিপি ও শকুনের ডানার কলম (২০১৮)।

বৃহস্পতিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২২ , ২০ আশ্বিন ১৪২৯ ০৮ সফর ১৪৪৪

সুব্রত সরকারের সাক্ষাৎকার

‘লেখার সময় কবি স্বাভাবিক পৃথিবীর কেউ নন’

রাহেল রাজিব

image

সুব্রত সরকার

সত্তরের দশক উত্তাল দশক- এ সময়ে আপনাদের বেড়ে ওঠা এবং লেখালেখির শুরু... এ সময়কে বাংলা সাহিত্যের উর্বর যুগ বলা হয়। আপনার ব্যক্তি জীবন ও লেখক জীবন কীভাবে এ সময় দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে- সে সম্পর্কে বলুন।

সুব্রত সরকার : দশকের শুরুটাই হয়েছিলো জবাকুসুমসঙ্কাশং মুখে নিয়ে। সারা পৃথিবীকে স্তম্ভিত করা দুটি ঘটনা ঘটিয়েছিল তখনকার মেধাবী তরুণেরা। একদিকে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলন। যা কাঁপিয়ে দিয়েছিলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নষ্ট শসা, পচা চালকুমড়োর সব আয়োজনকে। যদিও তা এক ব্যর্থতার করুণ ইতিহাস আজ। কিন্তু ফর্সা পাখির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের আখের গুছিয়ে নেওয়া বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থার মুখে লাথি মেরে ছাত্র-যুবারা গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নির্দেশ অমান্য করে শুধু ভাষা, কেবলমাত্র মাতৃভাষার জন্যে জন্ম নিয়েছিলো এক নবীন রাষ্ট্রের। কোটি কোটি মানুষের আত্মত্যাগের সামনে দাঁড়িয়ে সমগ্র পৃথিবী। আমি তখন সদ্য কৈশোরে পৌঁছেছি। তাই সারাজীবন ধরে আমাকে লিখে যেতে হয়েছে প্রাণের নিচে আটকে থাকা সেই পেরেকের কথা। পাইপগানের গুলির দাগ যা চুনকাম দিয়ে মুছে ফেলে দিলেও আজও সেখান থেকে রক্ত ঝরে পড়ে। তখন এ কথা লিখবার বয়স হয়নি তাই পরে লিখেছি। “রক্তপরাগ/ না, কপালের ফুটো দিয়ে সোজা গুলি ঢুকে গেছে ব্রেনে,/ সেখানে গর্তের উপরে দু’টি কাক উড়ে উড়ে আসেঃ / কা কা কমরেড!” না ঐ সময়ে আমার কৈশোর না থাকলে কাকের ডাকের ভিতর দিয়ে কমরেডকে আহ্বান করবার আওয়াজ অন্তরে এসে কিছুতেই প্রবেশ করতো না।

রা. রা. : প্রথম কাব্যÑ প্রথম শিল্পসন্তান। প্রথম কাব্য প্রকাশের প্রস্তুতি কালটাই একটা মস্ত লড়াই। সেটার গল্প বলুন আমাদের।

সু. স. : আমার প্রথম কবিতার বইয়ের নাম ‘দেবদারু কলোনি’। যা বেরিয়েছিল ১৯৭৯ সালে, বন্ধুদের চাঁদার টাকায়। প্রচ্ছদ করেছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত শিল্পী তথা বাটা কোম্পানির চিফ আর্টিস পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি নিজের টাকায় প্রচ্ছদটি ছেপে দেন আমার পয়সা নেই বলে। এই অর্থে সত্তরের দশকের কনিষ্ঠতম কবিদের একজন আমি। অগ্রজ সত্তর দশকের অনেকেই আজও তাই দাদা বলেই ডাকি। আমি একটা উদ্বাস্তু কলোনিতে থাকতাম। সেখানে বেশিরভাগ মানুষেরা প্রায় অনাহারে জীবন কাটাতেন। কলোনির গা-ঘেঁষে চলে গেছে যশোর রোড। যা নিয়ে আমি ১০ বছর বয়সে লিখেছি প্রথম কবিতা। আসলে জওহরলাল নেহরুর বাবার নামে আমাদের কলোনির নাম রাখা হয়েছিলো মতিলাল কলোনি। যাতে আবার না উচ্ছেদ হতে হয়। কিন্তু আমাদের বাড়ির পিছনে ছিলো এক দেবদারু গাছ। অনেকগুলি দিদিদের উৎপাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আমি সেই দেবদারু গাছের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলাম। তাকে দেবু-দা বলে ডাকতাম। তাই আমার কলোনিও আমার কাছে একজন মানুষ হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছিল। তখন কলকাতায় মার্কোস অনূদিত হন নি। ফলে আমার প্রথম বইতেই আমি অকারণে বেশ মাইলেজ পেয়ে যাই, যা আজ আমার মনে ঘোরানো সিঁড়ির মতো এক হাসি নিয়ে আসে। যশোর রোডের উলটো দিকে ইংরেজ সাহেবদের ফেলে যাওয়া কোয়ার্টার। সেখানে যারা থাকে তাদের সঙ্গে আমাদের কলোনির বাসিন্দাদের জীবনের আকাশ-পাতাল তফাৎ। আমার মায়ের বাবা ডাক্তার। আমার বাবা সরকারি আমলা তাই আমাদের জীবন অনেক স্বচ্ছল ছিল। কিন্তু আমার মন এই বৈপরীত্যকে কিছুতেই মানতে চাইতো না। লেখায় দেবদারু কলোনিকে মানুষ হিসেব করে তাই লিখেছি। খুবই কাঁচা লেখা তবু মনে করি এটাই আমার সর্বশ্রেষ্ঠ লেখা।

রা. রা. : বাংলা কবিতার বিবর্তনে নিজেকে কীভাবে নির্মাণ করেছেন বারবার?

সু. স. : খুব অল্প বয়স থেকে আমার বিভিন্ন বিষয়ে জানবার ইচ্ছে প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতা দিয়েছে। বাবার অডিট ফার্মের কাজের সূত্রে প্রচুর ভ্রমণ করা শুরু হয়েছিল কলেজ পাস করবার পর থেকে। আমি কমার্সের ছাত্র। কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞান থেকে ভূগোলের বই যেখানে যা পাই তাই পড়ি। সমসাময়িক কবিদের লেখা কম পড়তাম। তাদের সঙ্গ এড়িয়ে চলবার চেষ্টা করতাম সচেতন ভাবে। যাতে তাদের প্রভাব আমার লেখায় কোনোভাবে না প্রবেশ করে। একটা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে চেয়েছি কতটুকু পেরেছি তা পাঠকেরা বলবে আজ না হলে আগামীকাল। আর যদি না পেরে থাকি তাহলে আমার লেখা মুছে যাবে। তাতে আমার কিছু দুঃখ নেই। আমি তো কবি হবার জন্যে জন্মগ্রহণ করি নি। ছোটোবেলা থেকে বই ভালোবাসতে গিয়ে কেমন অদ্ভুতভাবে নিজেই লিখতে শুরু করেছিলাম তা নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিলো না। সাহিত্যকে আমার চিরকালই বহতা স্রোতের মতো মনে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ের লেখকেরা এই স্রোতধারা কে পুষ্ট করে যাবেÑ এই হলো প্রাকৃতিক নিয়ম। আমি আমার মতো করে ক’পৃষ্ঠার কিছু বাংলার প্রাণি রেখে গেলাম।

রা. রা. : প্রতিটা সময়েই ওভাররেটেড লেখক থাকেনÑ পদ পদবি চেয়ার অর্থ ক্ষমতা বেষ্টিত লেখকরা সমকালে জয়ধ্বনি ও হাততালি পানÑ প্রকৃত লেখকের সংগ্রামটি অনেকটা একক ও নিরন্তর। অপ্রাপ্তির খাতার ভারটা বেশি হয়Ñ কিন্তু কালের গহ্বরে জনপ্রিয় ও পদ-পদবিধারী ক্ষমতাধর লেখকবৃন্দ হারিয়ে যানÑ প্রকৃত লেখক টিকে থাকেন। এ বিষয়ে বিশদ বলুন।

সু. স. : আমার একটা কবিতার বইয়ের নাম ‘একাকী মানুষের সৌন্দর্য’। আশা করি এতেই বোঝা যাবে আমার মনের গঠনটি কেমন। আসলে খুব অল্প বয়সে বাবার ফার্মের দৌলতে পদ, প্রভাব, ক্ষমতা এসব নিজের চোখে দেখেছি। তাই সে সবের প্রতি মোহ মন থেকে মুছে গেছে তখনই। আমার কিছুমাত্র আপসোস নেই প্রাতিষ্ঠানিক আনুকূল্য না পাবার জন্যে। বরং এ সবের জন্য যারা হাঁকপাঁক করে তাদের প্রতি করুণা বোধ করি। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই এদের পাশ থেকে অন্যদিকে।

রা. রা. : কবির একটা নেশা থাকতে হয়Ñ টিপসি না হলে নাকি কবির শব্দভা-ে আঘাত লাগে নাÑ কেন? শিল্পের প্রতি এই নেশা সম্পর্কে বলুন।

সু. স. : কবির নেশা হবে বই পড়া, ভ্রমণ। গভীরভাবে যে কোনো বিষয় বা বস্তুকে পর্যবেক্ষণ। আর কিছু নেশার দরকার আছে বলে মনে করি না। বরং যে সব নেশা করলে শরীরের ক্ষতি হয় তা না করতেই বলবো। অনেকে নানা ধরনের শারীরিক সম্পর্কও লেখা বা শিল্পকলার সঙ্গে প্রয়োজনীয় মনে করেন। আমি তা বিশ্বাস করি না। এতে বহু সময় অপচয় হয় বলে আমার ধারণা।

রা. রা. : মাইকেল রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দ হয়ে বাংলা কবিতার বাঁক নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?

সু. স. : এই তিনজনের মতো করে আর কেউ আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতায় বাঁক বদল করতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি না। নজরুল বা সুকান্ত একটা অন্য ধারার সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক তা তত সফল হয় নি। তবে কি বাংলা কবিতা জীবনানন্দে এসে থেমে গেছে, তা নয়। অনেক কবিই নতুনভাবে লিখেছেন কিন্তু তার প্রভাব ওদের মতো সর্বত্রগামী হতে পারে নি। হয়তো ভবিষ্যতে কেউ পারবেন। তা কবে হবে এখন বলা অসম্ভব।

রা. রা. : দেশভাগ কাঁটাতার কবিতায় কীভাবে প্রভাব ফেলে?

সু. স. : দেশভাগ বা কাঁটাতার আমায় লেখায় খুব প্রভাব ফেলেছে। এই বিভাজন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, তা নিয়ে কিছু আর বলতে চাই না। বরং আমার অনুভূতির কথা বলি। ট্রেনে চেপে বসলে বিহার বা ওড়িষার সীমান্ত পেরুলেই প্রকৃতি বদলে যায়। ভারতের অন্য দূরবর্তী রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে তা আরও। বাংলাদেশে গেলে কিন্তু তা মনে হয় না। ভূগোলের সঙ্গে কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ক আছে। তাই একজন তামিল বা রাজস্থানি কবির চেয়েও বাংলাদেশের একজন কবি আমার অনেক আপনজন। আর তা আমার স্বীকার করা বা না করার উপর নির্ভর করে না।

রা. রা. : আপনার কবিতায় নান্দনিক কারুকাজ দীর্ঘদিন দীক্ষিত ও নিমগ্ন পাঠকদের মোহমুগ্ধ করে চলেছেÑ কবি হিসেবে এ শিল্পসাফল্যকে কীভাবে দেখেন?

সু. স. : আমার কবিতা নান্দনিক না অন্য কিছু সে সব কখনোই ভাবিনি। খুব ছোটোবেলায় একটা দেবদারু গাছকে ভালোবাসার ভিতর দিয়ে শুরু হয়েছিলো আমার আত্মানুসন্ধান। যেন অনেকটা সাকার থেকে নিরাকারের দিকে অনন্ত যাত্রা। আজ অনুভব করি এই ঘূর্ণায়মান মহাজগতের আমি এক ক্ষুদ্র অংশ। ক্ষুদ্র কিন্তু আমাকে ছাড়া এই মহাজগৎ অসম্পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ ধার করে বলি- আমায় নইলে ত্রিভুবনেরশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে। না কবিতা কিছু স্বল্পপাল্লার দৌড় নয় আমার কাছে। তাই এর সাফল্য বা অসাফল্যের সঙ্গে আমার কখনো মোলাকাত হয়নি। বরং যারা জীবনে সাফল্যের পথে হেঁটে গেছে তাদের দিকে ঘোরানো সিঁড়ির মতো তাকিয়ে থেকেছি হাতে রৌপ্য ও পরিহাস নিয়ে।

রা. রা. : কবি কি শুধুই নির্মোহ হবে? কেন?

সু. স. : কবি যখন মানুষ হিসাবে জীবন-যাপন করেন তখন তিনি অবশ্যই নির্মোহ থাকতে পারেন না। কিন্তু কবিতা লেখার সময়টুকু তিনি অবশ্যই পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুগত চেতনার বাইরে চলে যান। তখন মোহ বা নির্মোহের সীমানা কিছু থাকে বলে আমার মনে হয় না। কেবল ঐ লিখবার সময়টুকু। যখন তার মনে লেখা এসে প্রবেশ করছে থেকে লেখা যখন আবার ফের অনির্দেশে চলে যাচ্ছে সেই সময়টুকু তিনি স্বভাবিক পৃথিবীর কেউ নন তখন।

রা. রা. : কবি সুব্রত সরকার ও ব্যক্তি সুব্রত সরকারের দ্বন্দ্বগুলো বলুন।

সু. স. : এ প্রশ্নের জবাব আগেই কিছুটা দিয়েছি। অবশ্যই দুজন আলাদা। লেখার সময় ও না লিখবার সময়। আবার কখনও কখনও তা আলাদা নয়। যেমন যখন লিখে ফেলবার পরে আবার পড়ি তখন আমি নিজেই নিজের লেখার সমালোচক। কখনো মনে পড়ে ঋত্বিক ঘটকের বলা কথাটিÑ “দেশটা ক্রমেই ইতরের দেশ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিজের দেশকে ইতর বলে চিহ্নিত করা অধর্ম, তাই এ বিষয়ে সাবধান হওয়া উচিৎ।” ইত্যাদি। আবার ব্যক্তিগত জীবন-যাপনেও কখনো কবিতা ঢুকে পড়ে তখন কাছের মানুষগুলোর কাছে আমি অচেনা, অস্বস্তিকর বা প্রবল নিহিত পাতালছোঁয়া এক অতল নৌকো। এভাবেই তো কাটিয়ে গেলাম এই মরপৃথিবীতে ৬৫ বছর। দাঁড়িপাল্লা সমান সমান। পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব একদম ঠিক আছে।

রা. রা. : সমালোচকবৃন্দ বলে থাকেন- সুব্রত সরকার “নন্দনতাত্ত্বিক কবি” এই বিশেষণকে কীভাবে দেখেন?

সু. স. : আলাদা করে নন্দনতত্ত্ব বলে কিছু আছে কি না তা নিয়ে আমার খুব সন্দেহ আছে। তবে হ্যাঁ, ছোটোবেলা থেকেই আমি ভেবে এসেছি এই যে জন্মেছি এ কি নিছকই আমার বাবা-মায়ের মিলনের ফল। আবার সময়ে আমার মৃত্যু হবে তা কি কেবল এক যন্ত্রের পরিসমাপ্তি? না এর ভিতরে মহাজাগতিক কিছু পরিকল্পনা ছিলো বা আছে। আবার বিভিন্ন লেখা পড়ে এও জেনেছি এই মহাজগৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে গড়ে উঠেছে এক নির্দিষ্ট পরিণামকে লক্ষ্য রেখে। অথচ মহাজাগতিক বিস্ময়ের আমার অস্তিত্ব কিছু বিষয়ই নয়। আমার সামান্য লেখালেখিতে তার কিছু আসা যাবার কথা নয়। কিন্তু সত্যি কি তাই? তাহলে তো মহান কবি-লেখকদের, শিল্পীদেরও নস্যাৎ করে দিতে হয়। কারণ তারাও তো আমারই মতো নগণ্য এই মহাবিশ্বের কাছে। তা মেনে নিই কী করে? আরও লক্ষ্য করে দেখেছি শিল্প-সাহিত্যজগত যেন কালপ্রবাহের ইশারায় প্রবাহিত। যেন সেখানেও কোথা থেকে নির্দেশ ভেসে আসে। এই ক্ষুদ্র সাক্ষাৎকারে তা সবিস্তারে বলবার সুযোগ নেই। আমি শুধু আমার কিছু প্রশ্নের না পাওয়া উত্তরের ইঙ্গিত রেখে গেলাম। লেখায় তার প্রতিফলন হয়েছে। সন্দেহ আর সন্দেহ শুধু সন্দেহে ভরা রইলো আমার প্রায় ৫০ বছরের লেখাগুলিতে। তা কেউ যদি কখনো পড়ে, কখনো সে লেখার দীর্ঘশ্বাস, অস্পষ্ট অবয়বের ছায়া কেনো পাঠকের কাছে পৌঁছায় আমার সমগ্র জীবন ধন্য হবে, সেদিন।

রা. রা. : এই সন্ধ্যায় দীর্ঘ সময় দিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করলেন। আপনাকে ধনবাদ জানাই কবি।

সু. স. : তোমরাও আমার কথা ধৈর্য ধরে শুনেছো এবং এ সাক্ষাৎকারের জন্যে আমার লেখা কবিতা ও গদ্য লম্বা সময় নিয়ে পাঠ করেছো- তোমাদের ও যাঁরা এ সাক্ষাকারটি পড়ছেন তাঁদের সবার কল্যাণ হোক।

দ্রষ্টব্য:

সুব্রত সরকারের প্রকাশিত কাব্য: দেবদারু কলোনী (১৯৭৯), গত জন্মের ঋতু (১৯৮৬), তোমাদের খুব ভালোবেসেছি (১৯৮৬), সহ্য করো,াংলাভাষা (১৯৯১), তোমাকে মিথ্যা বলেছি(১৯৯২), ঘন মেঘ বলে ঋ (১৯৯৯), বহুত আঁধিয়ার হো বাবু,হামে কুছ রোশনি চাহিয়ে (১৯৯৯), একাকী মানুষের সৌন্দর্য্য (২০০২), ফারেনহাইট ফোর ফিফটি ওয়ান ডিগ্রি (২০০৪), অন্তঃস্থ বিসর্গ (২০১০), না স্নেহকরস্পর্শ (২০১৩), কবিতা সমগ্র (১ম সংস্করণ-২০১২,২য় সংস্করণ ২০১৬), চাঁদ,নমস্কার করলো” (২০১৮)। “সংগীত কণিকামাত্র” (২০১৯)। গদ্যগ্রন্থ: পরিচ্ছন্নতা ও বিষাদের দেবী (২০০৮), রক্তমাংসের পা-ুলিপি ও শকুনের ডানার কলম (২০১৮)।