পদ্মপাতায় বর্ষণ

এলিজা খাতুন

পদ্মপাতার গলা শুকিয়ে আসছে। জল নেই একফোঁটা। জলের বোতলটা ব্যাগে নিতে ভুলে গেছে পাতা, দূরের পথে কোথাও গেলে ওর বাবা আরমান আলী সাথে থাকে। পাতা নাম হলেও বাবা তার আগে পদ্ম যোগ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়েছে পদ্মপাতার। ভোরে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হতে পেরে ওর স্বস্তি। এতক্ষণে জল পিপাসা চেড়ে উঠতেই বাবাকে জানায় পাতা। ট্রাভেল ব্যাগের হাতল ধরিয়ে দিয়ে পাতাকে প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসিয়ে ওর বাবা গেছে টিকিট আর জলের বোতল আনতে। ট্রেন ছাড়বার দেরি নেই তেমন। চারপাশে সোরগোল, অথচ পদ্মপাতার মনে কয়েক মুহূর্ত নীরবতা বিরাজ করে।

অল্পক্ষণেই আরমান আলী ফিরে আসে। পদ্মপাতা উদ্বিগ্নভাবে তাকায় বাবার দিকে। ট্রেনের বাঁশি বেজে গেছে। পাতার হাতে জলের বোতল, খবরের কাগজ, তালপাতার হাতপাখা ধরিয়ে ব্যাগ তুলে ট্রেনের দরজার দিকে এগোয় আরমান আলী। পেছনে দ্রুতবেগে হেঁটে যায় পদ্মপাতা। যাত্রীর ভিড় ঠেলে এক বগি থেকে আরেক বগিতে যাবার কসরত কম কিছু নয়। জায়গা নেই পা ফেলার। কোনভাবে নিজেদের সিটে এসে বসতে পারে। মেঘলা আকাশ, বৃষ্টির খোঁজ নেই, প্রচন্ড গরম। ভালো করে শাটার সরিয়ে জানালায় মাথা ঠেকায় পাতা। অপর দিকের সিটে অর্থাৎ মুখোমুখি জানালার পাশে ঋজু হয়ে বসে আছে এক যুবক, তারও দৃষ্টি সম্মুখে; অর্থাৎ মনে হতেই পারে দৃষ্টিটা পদ্মপাতার দিকে।

আরমান আলী ঝুঁকে নিজের পায়ের কাছে ব্যাগ চেপে বসতে গিয়ে পকেটের কলম সড়কে বেরিয়ে সম্মুখে জানালার পাশে বসা যুবকের দিকে ছিটকে পড়ে। যুবকটি নিচ থেকে কলম তুলে আরমান আলীর দিকে এগিয়ে ধরে। আরমান আলী খুশি হয়ে গ্রহণ করে। সুদর্শন যুবকের বিনয়ী অভিব্যক্তি যে কারো চোখে পড়ার মতো। বাবার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়েছে বলে মনে হয়নি পাতার। বাবা জিজ্ঞাসা করেই বসে কী নাম বাবাজি? কোথায় যাবে?

এ মুহূর্তে যুবকটি সম্ভবত অন্যমনস্ক। বাইরে তাকিয়ে। পাশে বসা প্রায় সমবয়সি আরেকজন কথা বলেÑ “আঙ্কেল ওর নাম বর্ষণ, আর আমি রনক। আমরা নামবো রাজশাহী”। বাবা ও রনকের কথপোকথনে পাতার আরও জানা হয় বর্ষণ সম্পর্কে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছে, একটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলো দুজনেই। ইন্টারভিউ হয়নি। কয়েকমাস পূর্বে ছাঁটাই হওয়া অসংখ্য কর্মী একজোট হয়ে মূল গেট অবরোধ করে ছিলো। শূন্য পদগুলোতে নতুন লোক নিয়োগ হয়ে গেলে ছাঁটাইকৃত কর্মীদের হারানো চাকরি ফিরে পাবার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাবে- এমন আশংকা ব্যক্ত করেছিলো ওরা। ভেতরে অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রায় সবাই। তুমুল বিরোধিতার মুখে কর্তৃপক্ষ ইন্টারভিউ স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে এবং পরিস্থিতি সামাল দিতেই পরীক্ষা বন্ধ রাখার কথা জানিয়ে দিয়েছে গেটের বাইরে অপেক্ষমাণ চাকরিপ্রার্থীদের। আন্দলোনকারীরা ঘোষণা শুনে সাময়িক শান্ত হলেও বকেয়া বেতন-বোনাসের দাবি ওঠে ধীরে ধীরে। ছাঁটাইকৃতরাই শুধু নয়, একে একে তাদের সাথে যুক্ত হতে থাকে সুবিধাবঞ্চিত আরও কর্মী। এক পর্যায়ে আন্দলোনটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে যায়।

“আমার মনে হয়েছে ওদের বিরোধিতা, দাবি, প্রতিবাদ-আন্দোলনে সমর্থন না করার কোনো কারণ নেই”- বললো রনক।

অবশ্য ইন্টারভিউ-এর আরেকটা তারিখ দেবে। তবে উঁচু পোস্টে লোক নিয়োগ বাকি রয়েছে এমনটাও অবিশ্বাস্য। চাকরি সংক্রান্ত রনকের এসব আলাপ আরও ঘনিয়ে আসে। কথায় কথায় বাবার মুখ থেকে পাতার ভার্সিটি-ভর্তি সংক্রান্ত নানা কথাও জানা হয় বর্ষণ ও রনকের।

বর্ষণ যে মনোযোগী শ্রোতা, তার অভিব্যক্তিতে সেটা সুস্পষ্ট। পদ্মপাতা আশ্চর্য হয় সে কেবল শ্রোতা! এতক্ষণে একটা কথাও বলেনি বর্ষণ। রনক ও বর্ষণ দুজনের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। একজন শতভাগ শ্রোতা। অন্যজন শতভাগ বক্তা। পদ্মপাতা মনে মনে হাসে। বর্ষণের চোখ এড়ায়নি তা। কিছু মুখ আছে, যা হৃদয়ের অনুভূতি স্বচ্ছ আয়নার মতো বিম্বিত করতে এতটুকু কার্পণ্য করে না। পদ্মপাতার মুখ তেমনই।

ইতোমধ্যে পাতা মাথাটা আরেকটু বেশি করে হেলে দিয়েছে জানালার রডে। ভার্সিটি ক্যাম্পাস সম্পর্কে রনক অনেক গল্প বলছে পাতাকে উদ্দেশ্য করে। পাতা মাঝে মাঝে সৌজন্যসূচক মাথা নাড়ায়। অথচ পাতা ভেতরে ভেতরে বিষণœ অন্যমনষ্ক, সেটাও ধরা পড়ে বর্ষণের কাছে। পদ্মপাতা ও বর্ষণের পারস্পরিক দৃষ্টি বিনিময়ে যে মহার্ঘ ভাষা রচনা হয় তা সকলের কাছে আপাতত অনাবিষ্কৃত। বার বার পাতার মুখের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বর্ষণ কেন এমন মৌন ভাবনায় নিমগ্ন! এ ভাবনায় পেয়ে বসে পাতাকে।

আরমান আলী ও রনক মুখোমুখি দুজনে যে আলাপে মশগুলÑ তার আওয়াজ পদ্মপাতার কানে আসলেও তাদের উচ্চারিত শব্দগুলো পরস্পর একত্রিত হয়ে যে অর্থবহ বাক্য সৃষ্টি হচ্ছে তা যথার্থ অর্থসমেত গ্রহণে সফল নয় পদ্মপাতার শ্রবণেন্দ্রিয়। কেননা পদ্মপাতার শ্রবণ শক্তি ডাইভার্ট হয়ে গেছে চোখের ভাষা গ্রহণকার্যে। বর্ষণের চোখে যত কথা ভিড় করে আছে তার অক্ষর, শব্দ, বাক্য একঝাক পাখির মতো উড়ে এসে দখল করছে পদ্মপাতার হৃদ-অনুভূতির সব ডালপালা। ট্রেন চলছে নির্দিষ্ট ছন্দে, মৃদু বাতাসে চুল উড়ে পদ্মর কপোলের পেলবতা বাড়িয়ে তুলেছে, চোখ ঢেকে যাচ্ছে বার বার। পাতা ঠিক এখানে নেই। অন্য (৮-এর পৃষ্ঠায় পড়–ন) (১০-এর পৃষ্ঠার পর)

কোন ভাবনায়।

ট্রেন থেমেছে স্টেশনে। ঝক্কিটা সামলাতে পারেনি পাতা। অক শব্দ করে জানালায় মুখ বাড়ায়, জল ছাড়া কিছু ওঠে না। একটা এভোমিন খেয়ে নিলে সমস্যা হতো না; বললো রনক। পদ্মপাতা নিরুত্তর। ট্রেনের গতি কমতেই আরমান আলী নেমে যায় কমলা লেবু কিনতে, লেবুর ঘ্রাণে নাকি গা-গুলানো ভাব কেটে যায়। সেই সাথে রনকও নামার জন্য ওঠে, একটু হেঁটে আসবে বলে। বর্ষণ নামবে কিনা জিজ্ঞেস করে। বর্ষণ হাতের ইশারায় না সূচক জবার দেয়।

পাতার পাশে পাখাটা হাতে নিয়ে বর্ষণ ওর মাথায় বাতাস দিতে শুরু করে। বাবা না ফেরা পর্যন্ত বাতাস নামে পাতার মাথায়। এমন মোহন বাতাস কখনও পাওয়া হয়নি পাতার। বর্ষণ পাশে বাবার জায়গাটিতে বসে। ওদিক থেকে পুরুষ যাত্রীদের ভিড় ঠেলে আসা থেকে যেন বাঁচাচ্ছে পাতাকে। অবাক লাগে পাতার, বর্ষণের প্রতি কেমন একটা ভরসা জন্মেছে স্বল্পসময়ে।

বাইরে চারপাশটা ভীষণ গুমোট। প্রবল বৃষ্টির আভাস আছে পত্রিকায়। ট্রেন থেমে থাকায় গরমটা বেশি লাগছে। জানালায় আরেকটু ভর দিয়ে হেলে বাইরে তাকায় পাতা। শততালি দেওয়া জীর্ণ ময়লাযুক্ত কাপড় পরিহিত কয়েকটি বালক বালিকার দৌড়াদৌড়ি, খুনসুটি দেখে ছোট ছোট স্বরে হাসি পায় পদ্মপাতার। সম্মুখের সিটে নজর পড়তেই দ্যাখে বর্ষণ উপভোগ করছে দৃশ্যটি। বর্ষণ চোখ ফেরাতেই পাতার চোখে চোখ পড়ে। স্মিত হাসি বসে আছে বর্ষণের ঠোঁটের আইলে। বাইরে মেঘ ভেসে চলার সাথে সাথে বাতাসও বইতে শুরু করে।

ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। দমকা বাতাস ছোটার সাথে সাথে ট্রেন চলতে লাগে। রনক দৌড়ে উঠে আসে। আরমান আলী তখনও ফেরে না। পাতা অস্থির হয়ে ওঠে। পাতাকে ভয়ানক রকম চিন্তিত দেখে রনক বললোÑ “ চিন্তা করবেন না, নিশ্চয়ই অন্য বগিতে উঠে পড়বেন তিনি”। পাতাও তাই ভাবে।

প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে এসে ট্রেন ছুটছে দুরন্ত। প্লাটফরম, লোকালয়, দোকানপাট ছেড়ে সবুজ ঘন ঝোপঝাড়, সারিসারি গাছ আর মাঠের পর মাঠ সরে সরে যায় দুপাশে... মেঘ উঠেছে ইতোমধ্যে। জানালায় বাতাসের ঝাপটা শুরু হয়েছে। পাতার চুল উড়ে বর্ষণের মুখে এলামেলো স্পর্শ দেয়। বর্ষণের মনে বিস্ময় জাগায় ছিটে বৃষ্টির সাথে বাতসের প্রবাহ; এ এক অজানা পেলবতা, নতুন করে চেনা। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে নিসর্গে ডুবে ডুবে ট্রেন চলছে। বুনো ঝোপঝাড় জঙ্গল ছিঁড়ে প্রবল বাতাস এসে পাতার গাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে বর্ষণের দিকে বয়ে যাচ্ছে। ভ্রমণের ভাঁজে ভাঁজে যেন মাতাল বিস্ময় গেঁথে যাওয়া! বাতাসের মদিরায় দুটি হৃদয় মৌন অনুভবের মহিমায় কতক্ষণ কেটেছে টের পায়নি কেউ। এরই মধ্যে আরমান আলী কখন এসে গেছে তা ভাববার তাগাদা নেই কারো মনে।

ট্রেনের গতি ধীর হয়ে আসে। রাজশাহী স্টেশন। রনক ব্যাগ পিঠে নিয়ে কাঁধে ফিতে আটকিয়ে নামার জন্য রেডি হতে হতে আরমান আলীর দিকে হাত বাড়ায়Ñ আঙ্কেল আপনাদের সাথে পরিচয় হয়ে অনেক ভালো লাগলো। দোয়া করবেন। আরমান আলী বললোÑ হ্যাঁ বাবা দোয়া করি, তোমাদের যেন খুব শিঘ্রই চাকরি হয়। রনক উত্তর দেয়Ñ এড্রেস নিয়েছি যখন সুসংবাদ জানবেন নিশ্চয়ই! আর বর্ষণের চাকরির সংবাদ আগেই পাবেন। প্রতিবন্ধি কোটার আওতায় না হলেও নরমালি চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা আমার চেয়ে ওরই বেশি। কেননা বাক প্রতিবন্ধি হলেও বর্ষণ আমার চেয়ে মেধাবী।

পদ্মপাতার আশ্চর্য ভরা দুই চোখ বর্ষণের চোখজোড়ায় স্থির-প্রশ্নবোধক! বর্ষণ বাক-প্রতিবন্ধি! বাকরুদ্ধ পাতার হৃদয়ে আসন্ন দূরত্বের পদচিহ্ন ফোঁড় তুলে যায়। বর্ষণের সমস্ত মুখজুড়ে এক অনাবিল মর্মভেদি মায়া বিরাজিত। বর্ষণ নিজের দুই হাত নেড়ে নেড়ে বিশেষ রকম ভঙ্গিমা-আকারে ইঙ্গিতে বিশেষ ভাষায় কথা বলে রনকের সাথে। একই কায়দায় রনকও উত্তর দেয়। বর্ষণ নেমে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে হতে পাখাটা ধরিয়ে দেয় পদ্মপাতার হাতে। ভাষাহীন বিষণ্ণতায় পাতার দৃষ্টি অগ্রসর হয় বর্ষণের চলে যাবার দিকে।

“পদ্ম ওঠ্, নামতে হবে”

বাবার কথায় পদ্মপাতা উঠে এগোয়। প্লাটফর্মে নেমে ডানে বামে সামনে পেছনে দূরে পাতা উদ্বিগ্নভাবে তাকায়; খোঁজে একটু আগেই সম্মুখে ছিলো যে ক্ষণকালের-অতিআপন মুখখানা।

হঠাৎ পাখায় তালপাতার ডাঁটায় গোঁজা চিরকুট দেখে চমকিত হয়। ছোট্ট ভাঁজ খুলে দেখতে যায়, ঠিক এমন মুহূর্তের ভীষণ বাতাস এসে উড়িয়ে নেয় পাতার আঙুলে আলতো করে ধরা চিরকুটটা। এলোপাতাড়ি উড়তে উড়তে রেললাইনের দূরে গিয়ে হারায়, বোধহয় কোনো পাথরের খাঁজে। হু হু বাতাস উদ্বেলিত করে বয়ে গেলো পাতার হৃৎপি- বরাবর। তীর্যকভাবে আসা তুমুল বৃষ্টি সমস্ত প্লাটফর্ম ভিজিয়ে দিচ্ছে। পদ্মপাতার সমস্ত মুখ বৃষ্টিভেজা, চোখজোড়া জলে ঝাপসা।

বৃহস্পতিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২২ , ২০ আশ্বিন ১৪২৯ ০৮ সফর ১৪৪৪

পদ্মপাতায় বর্ষণ

এলিজা খাতুন

image

পদ্মপাতার গলা শুকিয়ে আসছে। জল নেই একফোঁটা। জলের বোতলটা ব্যাগে নিতে ভুলে গেছে পাতা, দূরের পথে কোথাও গেলে ওর বাবা আরমান আলী সাথে থাকে। পাতা নাম হলেও বাবা তার আগে পদ্ম যোগ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হয়েছে পদ্মপাতার। ভোরে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হতে পেরে ওর স্বস্তি। এতক্ষণে জল পিপাসা চেড়ে উঠতেই বাবাকে জানায় পাতা। ট্রাভেল ব্যাগের হাতল ধরিয়ে দিয়ে পাতাকে প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসিয়ে ওর বাবা গেছে টিকিট আর জলের বোতল আনতে। ট্রেন ছাড়বার দেরি নেই তেমন। চারপাশে সোরগোল, অথচ পদ্মপাতার মনে কয়েক মুহূর্ত নীরবতা বিরাজ করে।

অল্পক্ষণেই আরমান আলী ফিরে আসে। পদ্মপাতা উদ্বিগ্নভাবে তাকায় বাবার দিকে। ট্রেনের বাঁশি বেজে গেছে। পাতার হাতে জলের বোতল, খবরের কাগজ, তালপাতার হাতপাখা ধরিয়ে ব্যাগ তুলে ট্রেনের দরজার দিকে এগোয় আরমান আলী। পেছনে দ্রুতবেগে হেঁটে যায় পদ্মপাতা। যাত্রীর ভিড় ঠেলে এক বগি থেকে আরেক বগিতে যাবার কসরত কম কিছু নয়। জায়গা নেই পা ফেলার। কোনভাবে নিজেদের সিটে এসে বসতে পারে। মেঘলা আকাশ, বৃষ্টির খোঁজ নেই, প্রচন্ড গরম। ভালো করে শাটার সরিয়ে জানালায় মাথা ঠেকায় পাতা। অপর দিকের সিটে অর্থাৎ মুখোমুখি জানালার পাশে ঋজু হয়ে বসে আছে এক যুবক, তারও দৃষ্টি সম্মুখে; অর্থাৎ মনে হতেই পারে দৃষ্টিটা পদ্মপাতার দিকে।

আরমান আলী ঝুঁকে নিজের পায়ের কাছে ব্যাগ চেপে বসতে গিয়ে পকেটের কলম সড়কে বেরিয়ে সম্মুখে জানালার পাশে বসা যুবকের দিকে ছিটকে পড়ে। যুবকটি নিচ থেকে কলম তুলে আরমান আলীর দিকে এগিয়ে ধরে। আরমান আলী খুশি হয়ে গ্রহণ করে। সুদর্শন যুবকের বিনয়ী অভিব্যক্তি যে কারো চোখে পড়ার মতো। বাবার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়েছে বলে মনে হয়নি পাতার। বাবা জিজ্ঞাসা করেই বসে কী নাম বাবাজি? কোথায় যাবে?

এ মুহূর্তে যুবকটি সম্ভবত অন্যমনস্ক। বাইরে তাকিয়ে। পাশে বসা প্রায় সমবয়সি আরেকজন কথা বলেÑ “আঙ্কেল ওর নাম বর্ষণ, আর আমি রনক। আমরা নামবো রাজশাহী”। বাবা ও রনকের কথপোকথনে পাতার আরও জানা হয় বর্ষণ সম্পর্কে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছে, একটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলো দুজনেই। ইন্টারভিউ হয়নি। কয়েকমাস পূর্বে ছাঁটাই হওয়া অসংখ্য কর্মী একজোট হয়ে মূল গেট অবরোধ করে ছিলো। শূন্য পদগুলোতে নতুন লোক নিয়োগ হয়ে গেলে ছাঁটাইকৃত কর্মীদের হারানো চাকরি ফিরে পাবার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাবে- এমন আশংকা ব্যক্ত করেছিলো ওরা। ভেতরে অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলো প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রায় সবাই। তুমুল বিরোধিতার মুখে কর্তৃপক্ষ ইন্টারভিউ স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে এবং পরিস্থিতি সামাল দিতেই পরীক্ষা বন্ধ রাখার কথা জানিয়ে দিয়েছে গেটের বাইরে অপেক্ষমাণ চাকরিপ্রার্থীদের। আন্দলোনকারীরা ঘোষণা শুনে সাময়িক শান্ত হলেও বকেয়া বেতন-বোনাসের দাবি ওঠে ধীরে ধীরে। ছাঁটাইকৃতরাই শুধু নয়, একে একে তাদের সাথে যুক্ত হতে থাকে সুবিধাবঞ্চিত আরও কর্মী। এক পর্যায়ে আন্দলোনটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে যায়।

“আমার মনে হয়েছে ওদের বিরোধিতা, দাবি, প্রতিবাদ-আন্দোলনে সমর্থন না করার কোনো কারণ নেই”- বললো রনক।

অবশ্য ইন্টারভিউ-এর আরেকটা তারিখ দেবে। তবে উঁচু পোস্টে লোক নিয়োগ বাকি রয়েছে এমনটাও অবিশ্বাস্য। চাকরি সংক্রান্ত রনকের এসব আলাপ আরও ঘনিয়ে আসে। কথায় কথায় বাবার মুখ থেকে পাতার ভার্সিটি-ভর্তি সংক্রান্ত নানা কথাও জানা হয় বর্ষণ ও রনকের।

বর্ষণ যে মনোযোগী শ্রোতা, তার অভিব্যক্তিতে সেটা সুস্পষ্ট। পদ্মপাতা আশ্চর্য হয় সে কেবল শ্রোতা! এতক্ষণে একটা কথাও বলেনি বর্ষণ। রনক ও বর্ষণ দুজনের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। একজন শতভাগ শ্রোতা। অন্যজন শতভাগ বক্তা। পদ্মপাতা মনে মনে হাসে। বর্ষণের চোখ এড়ায়নি তা। কিছু মুখ আছে, যা হৃদয়ের অনুভূতি স্বচ্ছ আয়নার মতো বিম্বিত করতে এতটুকু কার্পণ্য করে না। পদ্মপাতার মুখ তেমনই।

ইতোমধ্যে পাতা মাথাটা আরেকটু বেশি করে হেলে দিয়েছে জানালার রডে। ভার্সিটি ক্যাম্পাস সম্পর্কে রনক অনেক গল্প বলছে পাতাকে উদ্দেশ্য করে। পাতা মাঝে মাঝে সৌজন্যসূচক মাথা নাড়ায়। অথচ পাতা ভেতরে ভেতরে বিষণœ অন্যমনষ্ক, সেটাও ধরা পড়ে বর্ষণের কাছে। পদ্মপাতা ও বর্ষণের পারস্পরিক দৃষ্টি বিনিময়ে যে মহার্ঘ ভাষা রচনা হয় তা সকলের কাছে আপাতত অনাবিষ্কৃত। বার বার পাতার মুখের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বর্ষণ কেন এমন মৌন ভাবনায় নিমগ্ন! এ ভাবনায় পেয়ে বসে পাতাকে।

আরমান আলী ও রনক মুখোমুখি দুজনে যে আলাপে মশগুলÑ তার আওয়াজ পদ্মপাতার কানে আসলেও তাদের উচ্চারিত শব্দগুলো পরস্পর একত্রিত হয়ে যে অর্থবহ বাক্য সৃষ্টি হচ্ছে তা যথার্থ অর্থসমেত গ্রহণে সফল নয় পদ্মপাতার শ্রবণেন্দ্রিয়। কেননা পদ্মপাতার শ্রবণ শক্তি ডাইভার্ট হয়ে গেছে চোখের ভাষা গ্রহণকার্যে। বর্ষণের চোখে যত কথা ভিড় করে আছে তার অক্ষর, শব্দ, বাক্য একঝাক পাখির মতো উড়ে এসে দখল করছে পদ্মপাতার হৃদ-অনুভূতির সব ডালপালা। ট্রেন চলছে নির্দিষ্ট ছন্দে, মৃদু বাতাসে চুল উড়ে পদ্মর কপোলের পেলবতা বাড়িয়ে তুলেছে, চোখ ঢেকে যাচ্ছে বার বার। পাতা ঠিক এখানে নেই। অন্য (৮-এর পৃষ্ঠায় পড়–ন) (১০-এর পৃষ্ঠার পর)

কোন ভাবনায়।

ট্রেন থেমেছে স্টেশনে। ঝক্কিটা সামলাতে পারেনি পাতা। অক শব্দ করে জানালায় মুখ বাড়ায়, জল ছাড়া কিছু ওঠে না। একটা এভোমিন খেয়ে নিলে সমস্যা হতো না; বললো রনক। পদ্মপাতা নিরুত্তর। ট্রেনের গতি কমতেই আরমান আলী নেমে যায় কমলা লেবু কিনতে, লেবুর ঘ্রাণে নাকি গা-গুলানো ভাব কেটে যায়। সেই সাথে রনকও নামার জন্য ওঠে, একটু হেঁটে আসবে বলে। বর্ষণ নামবে কিনা জিজ্ঞেস করে। বর্ষণ হাতের ইশারায় না সূচক জবার দেয়।

পাতার পাশে পাখাটা হাতে নিয়ে বর্ষণ ওর মাথায় বাতাস দিতে শুরু করে। বাবা না ফেরা পর্যন্ত বাতাস নামে পাতার মাথায়। এমন মোহন বাতাস কখনও পাওয়া হয়নি পাতার। বর্ষণ পাশে বাবার জায়গাটিতে বসে। ওদিক থেকে পুরুষ যাত্রীদের ভিড় ঠেলে আসা থেকে যেন বাঁচাচ্ছে পাতাকে। অবাক লাগে পাতার, বর্ষণের প্রতি কেমন একটা ভরসা জন্মেছে স্বল্পসময়ে।

বাইরে চারপাশটা ভীষণ গুমোট। প্রবল বৃষ্টির আভাস আছে পত্রিকায়। ট্রেন থেমে থাকায় গরমটা বেশি লাগছে। জানালায় আরেকটু ভর দিয়ে হেলে বাইরে তাকায় পাতা। শততালি দেওয়া জীর্ণ ময়লাযুক্ত কাপড় পরিহিত কয়েকটি বালক বালিকার দৌড়াদৌড়ি, খুনসুটি দেখে ছোট ছোট স্বরে হাসি পায় পদ্মপাতার। সম্মুখের সিটে নজর পড়তেই দ্যাখে বর্ষণ উপভোগ করছে দৃশ্যটি। বর্ষণ চোখ ফেরাতেই পাতার চোখে চোখ পড়ে। স্মিত হাসি বসে আছে বর্ষণের ঠোঁটের আইলে। বাইরে মেঘ ভেসে চলার সাথে সাথে বাতাসও বইতে শুরু করে।

ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। দমকা বাতাস ছোটার সাথে সাথে ট্রেন চলতে লাগে। রনক দৌড়ে উঠে আসে। আরমান আলী তখনও ফেরে না। পাতা অস্থির হয়ে ওঠে। পাতাকে ভয়ানক রকম চিন্তিত দেখে রনক বললোÑ “ চিন্তা করবেন না, নিশ্চয়ই অন্য বগিতে উঠে পড়বেন তিনি”। পাতাও তাই ভাবে।

প্লাটফর্ম ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে এসে ট্রেন ছুটছে দুরন্ত। প্লাটফরম, লোকালয়, দোকানপাট ছেড়ে সবুজ ঘন ঝোপঝাড়, সারিসারি গাছ আর মাঠের পর মাঠ সরে সরে যায় দুপাশে... মেঘ উঠেছে ইতোমধ্যে। জানালায় বাতাসের ঝাপটা শুরু হয়েছে। পাতার চুল উড়ে বর্ষণের মুখে এলামেলো স্পর্শ দেয়। বর্ষণের মনে বিস্ময় জাগায় ছিটে বৃষ্টির সাথে বাতসের প্রবাহ; এ এক অজানা পেলবতা, নতুন করে চেনা। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে নিসর্গে ডুবে ডুবে ট্রেন চলছে। বুনো ঝোপঝাড় জঙ্গল ছিঁড়ে প্রবল বাতাস এসে পাতার গাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে বর্ষণের দিকে বয়ে যাচ্ছে। ভ্রমণের ভাঁজে ভাঁজে যেন মাতাল বিস্ময় গেঁথে যাওয়া! বাতাসের মদিরায় দুটি হৃদয় মৌন অনুভবের মহিমায় কতক্ষণ কেটেছে টের পায়নি কেউ। এরই মধ্যে আরমান আলী কখন এসে গেছে তা ভাববার তাগাদা নেই কারো মনে।

ট্রেনের গতি ধীর হয়ে আসে। রাজশাহী স্টেশন। রনক ব্যাগ পিঠে নিয়ে কাঁধে ফিতে আটকিয়ে নামার জন্য রেডি হতে হতে আরমান আলীর দিকে হাত বাড়ায়Ñ আঙ্কেল আপনাদের সাথে পরিচয় হয়ে অনেক ভালো লাগলো। দোয়া করবেন। আরমান আলী বললোÑ হ্যাঁ বাবা দোয়া করি, তোমাদের যেন খুব শিঘ্রই চাকরি হয়। রনক উত্তর দেয়Ñ এড্রেস নিয়েছি যখন সুসংবাদ জানবেন নিশ্চয়ই! আর বর্ষণের চাকরির সংবাদ আগেই পাবেন। প্রতিবন্ধি কোটার আওতায় না হলেও নরমালি চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা আমার চেয়ে ওরই বেশি। কেননা বাক প্রতিবন্ধি হলেও বর্ষণ আমার চেয়ে মেধাবী।

পদ্মপাতার আশ্চর্য ভরা দুই চোখ বর্ষণের চোখজোড়ায় স্থির-প্রশ্নবোধক! বর্ষণ বাক-প্রতিবন্ধি! বাকরুদ্ধ পাতার হৃদয়ে আসন্ন দূরত্বের পদচিহ্ন ফোঁড় তুলে যায়। বর্ষণের সমস্ত মুখজুড়ে এক অনাবিল মর্মভেদি মায়া বিরাজিত। বর্ষণ নিজের দুই হাত নেড়ে নেড়ে বিশেষ রকম ভঙ্গিমা-আকারে ইঙ্গিতে বিশেষ ভাষায় কথা বলে রনকের সাথে। একই কায়দায় রনকও উত্তর দেয়। বর্ষণ নেমে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে হতে পাখাটা ধরিয়ে দেয় পদ্মপাতার হাতে। ভাষাহীন বিষণ্ণতায় পাতার দৃষ্টি অগ্রসর হয় বর্ষণের চলে যাবার দিকে।

“পদ্ম ওঠ্, নামতে হবে”

বাবার কথায় পদ্মপাতা উঠে এগোয়। প্লাটফর্মে নেমে ডানে বামে সামনে পেছনে দূরে পাতা উদ্বিগ্নভাবে তাকায়; খোঁজে একটু আগেই সম্মুখে ছিলো যে ক্ষণকালের-অতিআপন মুখখানা।

হঠাৎ পাখায় তালপাতার ডাঁটায় গোঁজা চিরকুট দেখে চমকিত হয়। ছোট্ট ভাঁজ খুলে দেখতে যায়, ঠিক এমন মুহূর্তের ভীষণ বাতাস এসে উড়িয়ে নেয় পাতার আঙুলে আলতো করে ধরা চিরকুটটা। এলোপাতাড়ি উড়তে উড়তে রেললাইনের দূরে গিয়ে হারায়, বোধহয় কোনো পাথরের খাঁজে। হু হু বাতাস উদ্বেলিত করে বয়ে গেলো পাতার হৃৎপি- বরাবর। তীর্যকভাবে আসা তুমুল বৃষ্টি সমস্ত প্লাটফর্ম ভিজিয়ে দিচ্ছে। পদ্মপাতার সমস্ত মুখ বৃষ্টিভেজা, চোখজোড়া জলে ঝাপসা।