পার্কবেঞ্চের কবিতা

নগরজীবনের শৈল্পিক আর্তনাদ

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

‘চলো পাখিদের জলসায় জড়ো হইÑ গান শুনি

চলো পুষ্পের মধুকুঞ্জে হানা দিই।’

(পার্কবেঞ্চের কবিতা)

বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি প্রগতিময় হচ্ছে কবিতা। আদিযুগে শ্লোকরূপে জন্ম নিয়ে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে কবিতা আজ মুক্তক গদ্যের সলিলবতী সময় হতে টানাগদ্যে জীবনবতী হয়েছে। কবিতার এই যাত্রাপথে একেক কবি যেমন একেক কাব্যভাষা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন, তেমনি একই কবি নিজ কাব্যভাষাকে সময়োপযোগী করে এগিয়ে গিয়েছেন কবিতার যাত্রার সাথে। ফলে কবির সূচনার ভাষা হতে পরিণতির ভাষার মধ্যে রূপান্তর এসেছে বিস্তর। এ কথা সহজে বোঝা যায় জীবনানন্দকে অধ্যয়ন করলে। ‘ঝরাপালক’র জীবনানন্দে যাকে পেয়েছি তিনি রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক তিরস্কৃত হলেও ‘ধূসর পান্ডুলিপি’তে এসে আমূল বদলে গেছেন সময়ের পরিচর্যায়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ‘ভাণুসিংহের পদাবলী’ হতে ‘মানসী’তে এসে পালন করেছেন যুগধর্ম। কবি সৌম্য সালেকের মধ্যেও কবিতার সে প্রগতির প্রখরতা বেশ পরিণতভাবেই লক্ষ্যণীয়। ‘আত্মখুনের স্কেচ’ শব্দচিত্রে এঁকে যিনি অনেককেই বিভ্রান্ত করে তুলেছিলেন শিরোনামে, তিনি ‘ঊষা ও গামিনী’তে এসে ইশারাকে কবিতার হাতিয়ার করে তুলেছিলেন। আবার ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’য় তিনিই বাজিয়ে শোনালেন পত্রমর্মরে জীবনের গান। ধারাবাহিকভাবে পাঠ করে আমরা ‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’য় এসে তাকে পরিণতরূপে পাই যেখানে ভাষা হয়ে ওঠে সূচনার যাত্রা হতে সহজ কিন্তু দর্শন হয়ে ওঠে গভীর। কবিতার ভাষায় আড়াল থাকলেও তা স্বচ্ছতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। শিরোনাম হতে বুঝা যায় কবি সৌম্য সালেক তার এ কাব্যগ্রন্থে নাগরিক জীবনকে চিত্রায়িত করতে চেয়েছেন নিজের জীবন-অভিজ্ঞানে। সূচনার এপিগ্রামেই আমরা তার কর্মক্লান্ত যান্ত্রিক জীবন হতে মুক্তির আকুতি শুনতে পেয়েছি, যিনি একটুখানি ফুরসতে পার্কের নির্জন বেঞ্চে বসে সময়কে নিজের করে পেতে চেয়েছেন। পার্কে বসে আপনমনে তন্ময় হয়ে তিনি পাখিদের গানের জলসায় অবগাহন করে মনের ক্লেদ মুছে মুক্ত হতে চেয়েছেন। তিনি যে নিজে একা তা চেয়েছেন তাও নয়, বরং তার মতো কর্ম-যাতনায় পিষ্ঠদেরও আহ্বান জানিয়েছেন যাতে সবাই ফুল-পাখিদের সহজ জীবনের সুন্দরকে অবলোকন করে ব্যস্ততা-তাড়িত মনকে প্রশান্তি দিতে পারেন। পার্কের বেঞ্চে সময় যেখানে থমকে থাকে, তিনি সেখানে বসে কবিতার যে প্রহরকে ফিরে পেয়েছেন, তা দিয়েই ‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’কে মলাটবন্দি করেছেন। দুহাজার বাইশের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় কবি প্রকাশনী হতে চল্লিশটা কবিতা নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন মা রৌশন আরা বেগম ও খালা ফাতেমা বেগমকে। মোস্তাফিজ কারিগরের প্রচ্ছদে কবিতা ও মলাট অভিন্ন হয়ে ফুটে উঠেছে।

কাব্যগ্রন্থের শিরোনামজুড়ে পার্কবেঞ্চের অবতারণা করার মূলসূত্র লুকিয়ে আছে ‘ঢাকায় আটকে পড়ে’ কবিতার দেহের ভেতরে। তিনি আক্ষেপে আকুতিতে বলেছেন, ‘এ শহর ঢাকা পড়েছে ক্লেদে-কোলাহলে/... যারা সবুজের কাছাকাছি/ দেখে যাও, কী হালে ঢাকায় আছি।’ যান্ত্রিক নগরীতে আটকে থাকা প্রাণের যে আকুতি তা যেন নগরবাসীদের আদিগন্ত আর্তনাদ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইথারে। কবি ‘ভিন্ন কোন সন্ধানে’ কবিতায় মানুষকে খুঁজে বেড়িয়ে প্রকৃত মানুষ না পাওয়ার বেদনায় পুড়ে স্বগতোক্তি করেন, ‘লাখ লাখ বছরে আর কোনো পরামুখ আর কোনো পত্র-কোরক সৃজিত হলো না মানুষের!’ কবি তাই অসহিষ্ণু হয়ে মৃদু-সংকোচে সন্ধান করেন এই নাগরিক পৃথিবীতে অন্যকোন অভিরূপ, অজ্ঞাত কোনো অধিলোক, যেখানে কাক্সিক্ষত মানুষের নতুন কোরকের দেখা মিলবে। কবির কাছে মানুষের জয়গানই মুখ্য। কবি মারিমত্ত পৃথিবীর বুকে মারিজয়ী মানুষের বন্দনাগীত গেয়ে ওঠেন, ‘প্লেগে-মারিতে ক্ষয় হলো মানুষের তবু সে-মানুষ অবকাশে আজও বসে আছে পুষ্পহারÑ ছিন্ন লেগুনের পাশে/ কাছে তার রমণীয় রাস।’

কবি নিজের অস্থিরতার কথা চেপে রাখতে পারেননি প্রেমে নিমগ্ন থেকে। সেই কারণে ‘বার বার প্রেমে পড়ে হয়েছি অস্থির/... তাই একা গানে গানে ফেরি করি প্রেমের কাহন’ যেনো কবির বাসনার ইশতেহার। ‘সোনালী দুঃখ’ কবিতায় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ত্রিস্তান’-এর প্রেমে ভালোই মজেছেন। ‘কারুবাসনা’ কবিতায় কবি বর্ণনা করেন জীবনের পরিণতি: ‘এখন / দুই তীরে জীবনের ক্ষয় ও ক্ষরণ/ মাঝে বয় নদী নীল...’।

‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’র বিষয়বস্তুতে যে বৈচিত্র্য আমরা দেখতে পাই, তাতে কবির সংবেদী মনের যেমন পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের জয়ধ্বনিও আমরা শুনতে পাই। কবি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আনন্দিত হয়ে ‘আলোর অভিমুখে যাত্রা’-কবিতায় লেখেন: ‘আপনি ফিরে এলেন সাথে নিয়ে মুক্তির আলো/ স্বাধীনতা হয়েছে স্বাধীন।’ । বাস্তবিক অর্থেই ষোল ডিসেম্বরে বিজয় এলেও জাতির জনকের প্রত্যাবর্তন আমাদের সে বিজয়কে সত্যিকারের স্বাধীন করে তুলেছে। ‘বিজয় এসেছে বলে’ কবিতায় কবি সারাবাংলার এক উৎসবমুখর ছবি এঁকেছেন পঙক্তির মূর্ততায়। তিনি মিলনের আবাহনে বাংলার গ্রাম ও নগরে নতুন সাড়া জাগার আনন্দে বিভোর হয়ে ওঠেন।

‘বুনো স্বপ্নের গ্রাফিতি’ কবিতায় কবি প্রতিটি ঘৃণা থেকে একেকটি বারূদের ছেলা জন্ম নেয়ার ভয়ানক সত্য জানান দিয়ে আমাদের সতর্ক করে তুলেছেন। আবার ‘টিকাটুলির মোড়ে’ কবিতায় কবি যাদের জ্ঞান-কর্ম আছে তারা যেনো সর্বোতভাবে চিরদিন জ্ঞানদীপ বয়ে নেয় সে কথা বলতে চেয়েছেন।

কবি জানেন, বাংলাদেশ এক স্বর্ণ-সৌধ যার মাটিতে লুকিয়ে আছে সোনালী সম্ভার। ‘সৌধ’ কবিতায় কবি এ সত্যকে উদ্ঘাটন করে বলে উঠেছেন পুলকে, ‘সৌধ সোনার বীজ বঙ্গ জঠরে/ চাষারু পুত্র পায় অনার্য আমারে।’

বাস্তব জীবনের কষাঘাতকে কবি দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ‘কাক ও কেরানি’ কবিতায়। কবি একক কণ্ঠে জনতার কণ্ঠস্বর ধারণ করেন। কবির কণ্ঠ তাই শতকণ্ঠ হয়ে বলে ওঠে অকপটে: ‘রাতে বেঘোরে উদর পুরিয়ে অভ্যস্ত রমণীর খাঁজে দুঘা চার-ছক্কা হাঁকিয়ে/ মোষের মতো ঘুমিয়ে/ জীবন পার করার কোনো মানে নেই।’ কবিকে মাতৃহারাদের বেদনা যেমন ছুঁয়ে গেছে, তেমনি ছুঁয়ে গেছে কান্না ও মৃত্যুর মিথ। ‘নিখর্ব রাত্রির গাথা’য় মধ্য-সাগরের নাদে আর সাহারার রুক্ষ-বিবরণে ভরা বিশ^খ্যাত মিশরীয় শিল্পী উম্মে কুলসুমের গানে সমস্ত নিদ্রা উবে যাওয়ার কথা আমরা যেমন জানতে পেরেছি, তেমনি ‘নীল গ্রন্থণা’য় কামারের বজ্র অনলে হৃদয় পোড়ানোর কথাও জানতে পেরেছি।

কবি জানেন, যত সংশয় সংসারে। তাই ‘বন-সুন্দরের পালা’য় তিনি দাবি করেন, ‘লেখা হোক মানুষের কথা/ যারা মধু- আহরণে, যারা মৎস্য আনে/ জলে ভেসে জাগায় জীবন।’ অস্থির কবির কাছে জীবনÑ ‘কিছু ঘর বালিয়াড়ি’র মতোই পলকা মনে হয়। তাই তার অনন্ত জিজ্ঞাসা, ‘মানুষ এত কই যায়?’ (মাটির সিথানে)

মারি আক্রান্ত পৃথিবীতে কবি সংশয়ে ভুগে অনুকূল সময়ের প্রতীক্ষায় থেকে বলেন, ‘জানা নেই, চেনা রূপে ফিরবে কবে চরাচর/ অতল রাত্রি কেটে কখন নামবে প্রভা/ ফুটবে কবে স্বর্ণচাঁপাটি!’ হেমন্তের বরপুত্র কবি জীবনানন্দের কাছে দীক্ষা নিয়ে কবি যেন ‘এই শীতে’ কবিতায় পুরনো ক্রিয়াপদকে জীবন্ত করে তুলেছেন। ‘হাড়ের পেখম’ কবিতার চিত্রকল্পে আমরা দেখতে পাই, কবির বুকে ছোটে তরুণ মৃগপাল। মৃগপালের নাগাল হারিয়ে কবি ‘একটি বিষম গান’-এ জীবনের ঔরসে জন্ম নেয়া মরণের অপরূপ রং-লীলা-সাজে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। অতঃপর ‘শূন্য বীক্ষণ’-এ প্রকাশ করেন জীবন-অভিজ্ঞান, ‘মাঝে মাঝে শূন্য হতে হয়/ শূন্য পকেট, শূন্য হাত/ এমনকি জ্ঞানশূন্য।’

কবির জীবন-বীক্ষণে মৌলানা রুমির প্রভাব অপরিমেয় হলেও আপামর বাঙালির ন্যায় রবীন্দ্র-নজরুলও তার মনোযোগ কেড়ে নেয়। উ™£ান্ত-অনাস্থ দিনে কবি এঁদের শরণেই খুঁজে নেন আত্ম-প্রশান্তি। কিন্তু ততক্ষণে জীবন তাকে একটা অভিজ্ঞান দিয়ে গ্যাছে। সেই ‘অভিজ্ঞান’ হতে তিনি বুঝতে পারেন, ‘সিন্দুকে স্বর্ণ রেখে সব গৃহী মেতে ওঠে পাহারায়।’

কবির জীবনে হাতে গোনা যে ক’জন নারীর ভূমিকা আমাদের মানসগোচর তাদের মধ্য মাতামহীর ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পিতৃভূমিতে মাকে ছেড়ে এসে শৈশব হতেই বালক কবি মাতামহীর আদরে লালিত হন। তিনি তাকে বালক থেকে প্রতিপালন করে বাড়িয়ে তুলেছেন। তাই অনিবার্যভাবেই পরিণত প্রয়াণযাত্রী মাতামহীর স্মরণে কবি রচনা করেছেন শোকগাথা। ‘মাতামহীর জন্য গাথা’ শীর্ষক শোক-কবিতায় কবি তার প্রিয় মাতামহীর উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘দেখে যাও, রুক্ষ আজ অমল সে মুখ’। কবি তার কবিতায় কিছু চমৎকার চিত্রকল্প রচনা করেছেন। তারমধ্যে, ‘জলভোগী জন্তুরা সামন্ত সেনার মতো দাঁড়িয়ে’Ñ এই চিত্রকল্পে যেনো জান্তব হয়ে ওঠে মানুষের সংকটকালীন পরিপ্রেক্ষিত।

‘হৃদয় লেখা’ শীর্ষক ‘দ্বৈত কবিতা’ আমাদের প্রণয়ীর দেহ নয় বরং হৃদয়ের ছবি দেখানোর জন্যে উদগ্রীব করে তোলে। কবি প্রত্যয়দীপ্ত হয়ে প্রণয়ীকে তাই আহ্বান করেন, ‘তোমার সে হৃদয়ের লোভে জীবনের কৃষ্ণ-কলিঙ্গে লড়ে যাব আপ্রাণ/ দেহ নয় হৃদয়ের চিত্র দেখাও!’

কবি সীমাহীন দেশের গান শুনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সীমান্তপ্রাচীরের কারণেই তা শুনতে পাচ্ছেন না। কবি জানেন, কবিতা আম জনতার জন্যে নয়। কেননা তিনি বোঝেন, তার কবিতা মানুষের হাটে বিকোবে না কোনোদিন। তাই তিনি কবিতাকে ছড়িয়ে দেন সীমানা পেরিয়ে। তার কবিতা যে ভোলা রাখালের বাঁশির সুরের মতোই সর্বগামী।

কবি সৌম্য সালেকের কাব্য ‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’ ভাষাগতভাবে পরিণতি পেলেও এতে পূর্ববর্তী সময়ের কয়েকটি কবিতাও স্থান পেয়েছে। কিছু কিছু কবিতায় রচনাকাল এবং রচনা-স্থান সন্নিবেশিত হলেও অধিকাংশ কবিতা এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছে। কবিতাগুলো সন্নিবেশনের ধারাবাহিকতা আরেকটু পূর্ণতা পেতে পারতো যদি কালানুক্রমে কবিতাগুলো সজ্জিত হতো। ‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’ শিরোনামের কাব্যগ্রন্থটি কবির মুকুটে নক্ষত্র হয়ে উঠুক।

পার্কবেঞ্চের কবিতা: সৌম্য সালেক। প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর। প্রকাশন: কবি প্রকাশনী। প্রকাশকাল: বইমেলা ২০২২। দাম: ১৬০ টাকা

বৃহস্পতিবার, ০৬ অক্টোবর ২০২২ , ২০ আশ্বিন ১৪২৯ ০৮ সফর ১৪৪৪

পার্কবেঞ্চের কবিতা

নগরজীবনের শৈল্পিক আর্তনাদ

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

image

‘চলো পাখিদের জলসায় জড়ো হইÑ গান শুনি

চলো পুষ্পের মধুকুঞ্জে হানা দিই।’

(পার্কবেঞ্চের কবিতা)

বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি প্রগতিময় হচ্ছে কবিতা। আদিযুগে শ্লোকরূপে জন্ম নিয়ে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে কবিতা আজ মুক্তক গদ্যের সলিলবতী সময় হতে টানাগদ্যে জীবনবতী হয়েছে। কবিতার এই যাত্রাপথে একেক কবি যেমন একেক কাব্যভাষা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন, তেমনি একই কবি নিজ কাব্যভাষাকে সময়োপযোগী করে এগিয়ে গিয়েছেন কবিতার যাত্রার সাথে। ফলে কবির সূচনার ভাষা হতে পরিণতির ভাষার মধ্যে রূপান্তর এসেছে বিস্তর। এ কথা সহজে বোঝা যায় জীবনানন্দকে অধ্যয়ন করলে। ‘ঝরাপালক’র জীবনানন্দে যাকে পেয়েছি তিনি রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক তিরস্কৃত হলেও ‘ধূসর পান্ডুলিপি’তে এসে আমূল বদলে গেছেন সময়ের পরিচর্যায়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ‘ভাণুসিংহের পদাবলী’ হতে ‘মানসী’তে এসে পালন করেছেন যুগধর্ম। কবি সৌম্য সালেকের মধ্যেও কবিতার সে প্রগতির প্রখরতা বেশ পরিণতভাবেই লক্ষ্যণীয়। ‘আত্মখুনের স্কেচ’ শব্দচিত্রে এঁকে যিনি অনেককেই বিভ্রান্ত করে তুলেছিলেন শিরোনামে, তিনি ‘ঊষা ও গামিনী’তে এসে ইশারাকে কবিতার হাতিয়ার করে তুলেছিলেন। আবার ‘পাতাঝরার অর্কেস্ট্রা’য় তিনিই বাজিয়ে শোনালেন পত্রমর্মরে জীবনের গান। ধারাবাহিকভাবে পাঠ করে আমরা ‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’য় এসে তাকে পরিণতরূপে পাই যেখানে ভাষা হয়ে ওঠে সূচনার যাত্রা হতে সহজ কিন্তু দর্শন হয়ে ওঠে গভীর। কবিতার ভাষায় আড়াল থাকলেও তা স্বচ্ছতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। শিরোনাম হতে বুঝা যায় কবি সৌম্য সালেক তার এ কাব্যগ্রন্থে নাগরিক জীবনকে চিত্রায়িত করতে চেয়েছেন নিজের জীবন-অভিজ্ঞানে। সূচনার এপিগ্রামেই আমরা তার কর্মক্লান্ত যান্ত্রিক জীবন হতে মুক্তির আকুতি শুনতে পেয়েছি, যিনি একটুখানি ফুরসতে পার্কের নির্জন বেঞ্চে বসে সময়কে নিজের করে পেতে চেয়েছেন। পার্কে বসে আপনমনে তন্ময় হয়ে তিনি পাখিদের গানের জলসায় অবগাহন করে মনের ক্লেদ মুছে মুক্ত হতে চেয়েছেন। তিনি যে নিজে একা তা চেয়েছেন তাও নয়, বরং তার মতো কর্ম-যাতনায় পিষ্ঠদেরও আহ্বান জানিয়েছেন যাতে সবাই ফুল-পাখিদের সহজ জীবনের সুন্দরকে অবলোকন করে ব্যস্ততা-তাড়িত মনকে প্রশান্তি দিতে পারেন। পার্কের বেঞ্চে সময় যেখানে থমকে থাকে, তিনি সেখানে বসে কবিতার যে প্রহরকে ফিরে পেয়েছেন, তা দিয়েই ‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’কে মলাটবন্দি করেছেন। দুহাজার বাইশের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় কবি প্রকাশনী হতে চল্লিশটা কবিতা নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন মা রৌশন আরা বেগম ও খালা ফাতেমা বেগমকে। মোস্তাফিজ কারিগরের প্রচ্ছদে কবিতা ও মলাট অভিন্ন হয়ে ফুটে উঠেছে।

কাব্যগ্রন্থের শিরোনামজুড়ে পার্কবেঞ্চের অবতারণা করার মূলসূত্র লুকিয়ে আছে ‘ঢাকায় আটকে পড়ে’ কবিতার দেহের ভেতরে। তিনি আক্ষেপে আকুতিতে বলেছেন, ‘এ শহর ঢাকা পড়েছে ক্লেদে-কোলাহলে/... যারা সবুজের কাছাকাছি/ দেখে যাও, কী হালে ঢাকায় আছি।’ যান্ত্রিক নগরীতে আটকে থাকা প্রাণের যে আকুতি তা যেন নগরবাসীদের আদিগন্ত আর্তনাদ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইথারে। কবি ‘ভিন্ন কোন সন্ধানে’ কবিতায় মানুষকে খুঁজে বেড়িয়ে প্রকৃত মানুষ না পাওয়ার বেদনায় পুড়ে স্বগতোক্তি করেন, ‘লাখ লাখ বছরে আর কোনো পরামুখ আর কোনো পত্র-কোরক সৃজিত হলো না মানুষের!’ কবি তাই অসহিষ্ণু হয়ে মৃদু-সংকোচে সন্ধান করেন এই নাগরিক পৃথিবীতে অন্যকোন অভিরূপ, অজ্ঞাত কোনো অধিলোক, যেখানে কাক্সিক্ষত মানুষের নতুন কোরকের দেখা মিলবে। কবির কাছে মানুষের জয়গানই মুখ্য। কবি মারিমত্ত পৃথিবীর বুকে মারিজয়ী মানুষের বন্দনাগীত গেয়ে ওঠেন, ‘প্লেগে-মারিতে ক্ষয় হলো মানুষের তবু সে-মানুষ অবকাশে আজও বসে আছে পুষ্পহারÑ ছিন্ন লেগুনের পাশে/ কাছে তার রমণীয় রাস।’

কবি নিজের অস্থিরতার কথা চেপে রাখতে পারেননি প্রেমে নিমগ্ন থেকে। সেই কারণে ‘বার বার প্রেমে পড়ে হয়েছি অস্থির/... তাই একা গানে গানে ফেরি করি প্রেমের কাহন’ যেনো কবির বাসনার ইশতেহার। ‘সোনালী দুঃখ’ কবিতায় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ত্রিস্তান’-এর প্রেমে ভালোই মজেছেন। ‘কারুবাসনা’ কবিতায় কবি বর্ণনা করেন জীবনের পরিণতি: ‘এখন / দুই তীরে জীবনের ক্ষয় ও ক্ষরণ/ মাঝে বয় নদী নীল...’।

‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’র বিষয়বস্তুতে যে বৈচিত্র্য আমরা দেখতে পাই, তাতে কবির সংবেদী মনের যেমন পরিচয় পাওয়া যায়, তেমনি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের জয়ধ্বনিও আমরা শুনতে পাই। কবি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আনন্দিত হয়ে ‘আলোর অভিমুখে যাত্রা’-কবিতায় লেখেন: ‘আপনি ফিরে এলেন সাথে নিয়ে মুক্তির আলো/ স্বাধীনতা হয়েছে স্বাধীন।’ । বাস্তবিক অর্থেই ষোল ডিসেম্বরে বিজয় এলেও জাতির জনকের প্রত্যাবর্তন আমাদের সে বিজয়কে সত্যিকারের স্বাধীন করে তুলেছে। ‘বিজয় এসেছে বলে’ কবিতায় কবি সারাবাংলার এক উৎসবমুখর ছবি এঁকেছেন পঙক্তির মূর্ততায়। তিনি মিলনের আবাহনে বাংলার গ্রাম ও নগরে নতুন সাড়া জাগার আনন্দে বিভোর হয়ে ওঠেন।

‘বুনো স্বপ্নের গ্রাফিতি’ কবিতায় কবি প্রতিটি ঘৃণা থেকে একেকটি বারূদের ছেলা জন্ম নেয়ার ভয়ানক সত্য জানান দিয়ে আমাদের সতর্ক করে তুলেছেন। আবার ‘টিকাটুলির মোড়ে’ কবিতায় কবি যাদের জ্ঞান-কর্ম আছে তারা যেনো সর্বোতভাবে চিরদিন জ্ঞানদীপ বয়ে নেয় সে কথা বলতে চেয়েছেন।

কবি জানেন, বাংলাদেশ এক স্বর্ণ-সৌধ যার মাটিতে লুকিয়ে আছে সোনালী সম্ভার। ‘সৌধ’ কবিতায় কবি এ সত্যকে উদ্ঘাটন করে বলে উঠেছেন পুলকে, ‘সৌধ সোনার বীজ বঙ্গ জঠরে/ চাষারু পুত্র পায় অনার্য আমারে।’

বাস্তব জীবনের কষাঘাতকে কবি দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ‘কাক ও কেরানি’ কবিতায়। কবি একক কণ্ঠে জনতার কণ্ঠস্বর ধারণ করেন। কবির কণ্ঠ তাই শতকণ্ঠ হয়ে বলে ওঠে অকপটে: ‘রাতে বেঘোরে উদর পুরিয়ে অভ্যস্ত রমণীর খাঁজে দুঘা চার-ছক্কা হাঁকিয়ে/ মোষের মতো ঘুমিয়ে/ জীবন পার করার কোনো মানে নেই।’ কবিকে মাতৃহারাদের বেদনা যেমন ছুঁয়ে গেছে, তেমনি ছুঁয়ে গেছে কান্না ও মৃত্যুর মিথ। ‘নিখর্ব রাত্রির গাথা’য় মধ্য-সাগরের নাদে আর সাহারার রুক্ষ-বিবরণে ভরা বিশ^খ্যাত মিশরীয় শিল্পী উম্মে কুলসুমের গানে সমস্ত নিদ্রা উবে যাওয়ার কথা আমরা যেমন জানতে পেরেছি, তেমনি ‘নীল গ্রন্থণা’য় কামারের বজ্র অনলে হৃদয় পোড়ানোর কথাও জানতে পেরেছি।

কবি জানেন, যত সংশয় সংসারে। তাই ‘বন-সুন্দরের পালা’য় তিনি দাবি করেন, ‘লেখা হোক মানুষের কথা/ যারা মধু- আহরণে, যারা মৎস্য আনে/ জলে ভেসে জাগায় জীবন।’ অস্থির কবির কাছে জীবনÑ ‘কিছু ঘর বালিয়াড়ি’র মতোই পলকা মনে হয়। তাই তার অনন্ত জিজ্ঞাসা, ‘মানুষ এত কই যায়?’ (মাটির সিথানে)

মারি আক্রান্ত পৃথিবীতে কবি সংশয়ে ভুগে অনুকূল সময়ের প্রতীক্ষায় থেকে বলেন, ‘জানা নেই, চেনা রূপে ফিরবে কবে চরাচর/ অতল রাত্রি কেটে কখন নামবে প্রভা/ ফুটবে কবে স্বর্ণচাঁপাটি!’ হেমন্তের বরপুত্র কবি জীবনানন্দের কাছে দীক্ষা নিয়ে কবি যেন ‘এই শীতে’ কবিতায় পুরনো ক্রিয়াপদকে জীবন্ত করে তুলেছেন। ‘হাড়ের পেখম’ কবিতার চিত্রকল্পে আমরা দেখতে পাই, কবির বুকে ছোটে তরুণ মৃগপাল। মৃগপালের নাগাল হারিয়ে কবি ‘একটি বিষম গান’-এ জীবনের ঔরসে জন্ম নেয়া মরণের অপরূপ রং-লীলা-সাজে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। অতঃপর ‘শূন্য বীক্ষণ’-এ প্রকাশ করেন জীবন-অভিজ্ঞান, ‘মাঝে মাঝে শূন্য হতে হয়/ শূন্য পকেট, শূন্য হাত/ এমনকি জ্ঞানশূন্য।’

কবির জীবন-বীক্ষণে মৌলানা রুমির প্রভাব অপরিমেয় হলেও আপামর বাঙালির ন্যায় রবীন্দ্র-নজরুলও তার মনোযোগ কেড়ে নেয়। উ™£ান্ত-অনাস্থ দিনে কবি এঁদের শরণেই খুঁজে নেন আত্ম-প্রশান্তি। কিন্তু ততক্ষণে জীবন তাকে একটা অভিজ্ঞান দিয়ে গ্যাছে। সেই ‘অভিজ্ঞান’ হতে তিনি বুঝতে পারেন, ‘সিন্দুকে স্বর্ণ রেখে সব গৃহী মেতে ওঠে পাহারায়।’

কবির জীবনে হাতে গোনা যে ক’জন নারীর ভূমিকা আমাদের মানসগোচর তাদের মধ্য মাতামহীর ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। পিতৃভূমিতে মাকে ছেড়ে এসে শৈশব হতেই বালক কবি মাতামহীর আদরে লালিত হন। তিনি তাকে বালক থেকে প্রতিপালন করে বাড়িয়ে তুলেছেন। তাই অনিবার্যভাবেই পরিণত প্রয়াণযাত্রী মাতামহীর স্মরণে কবি রচনা করেছেন শোকগাথা। ‘মাতামহীর জন্য গাথা’ শীর্ষক শোক-কবিতায় কবি তার প্রিয় মাতামহীর উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘দেখে যাও, রুক্ষ আজ অমল সে মুখ’। কবি তার কবিতায় কিছু চমৎকার চিত্রকল্প রচনা করেছেন। তারমধ্যে, ‘জলভোগী জন্তুরা সামন্ত সেনার মতো দাঁড়িয়ে’Ñ এই চিত্রকল্পে যেনো জান্তব হয়ে ওঠে মানুষের সংকটকালীন পরিপ্রেক্ষিত।

‘হৃদয় লেখা’ শীর্ষক ‘দ্বৈত কবিতা’ আমাদের প্রণয়ীর দেহ নয় বরং হৃদয়ের ছবি দেখানোর জন্যে উদগ্রীব করে তোলে। কবি প্রত্যয়দীপ্ত হয়ে প্রণয়ীকে তাই আহ্বান করেন, ‘তোমার সে হৃদয়ের লোভে জীবনের কৃষ্ণ-কলিঙ্গে লড়ে যাব আপ্রাণ/ দেহ নয় হৃদয়ের চিত্র দেখাও!’

কবি সীমাহীন দেশের গান শুনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সীমান্তপ্রাচীরের কারণেই তা শুনতে পাচ্ছেন না। কবি জানেন, কবিতা আম জনতার জন্যে নয়। কেননা তিনি বোঝেন, তার কবিতা মানুষের হাটে বিকোবে না কোনোদিন। তাই তিনি কবিতাকে ছড়িয়ে দেন সীমানা পেরিয়ে। তার কবিতা যে ভোলা রাখালের বাঁশির সুরের মতোই সর্বগামী।

কবি সৌম্য সালেকের কাব্য ‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’ ভাষাগতভাবে পরিণতি পেলেও এতে পূর্ববর্তী সময়ের কয়েকটি কবিতাও স্থান পেয়েছে। কিছু কিছু কবিতায় রচনাকাল এবং রচনা-স্থান সন্নিবেশিত হলেও অধিকাংশ কবিতা এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছে। কবিতাগুলো সন্নিবেশনের ধারাবাহিকতা আরেকটু পূর্ণতা পেতে পারতো যদি কালানুক্রমে কবিতাগুলো সজ্জিত হতো। ‘পার্কবেঞ্চের কবিতা’ শিরোনামের কাব্যগ্রন্থটি কবির মুকুটে নক্ষত্র হয়ে উঠুক।

পার্কবেঞ্চের কবিতা: সৌম্য সালেক। প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর। প্রকাশন: কবি প্রকাশনী। প্রকাশকাল: বইমেলা ২০২২। দাম: ১৬০ টাকা