কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ ৪ জনসহ ৭ জঙ্গি আটক

কুমিল্লা থেকে ‘নিখোঁজ’ ৮ যুবকের মধ্যে ৪ জনসহ ৭ জনকে ‘জঙ্গি সম্পৃক্ততার’ অভিযোগে আটকের খবর জানিয়ে র‌্যাব বলছে, তারা একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। তারা ‘সশস্ত্র জিহাদের’ উদ্দেশ্যে ‘ঘর ছেড়েছিলো’। নতুন এ সংগঠনের নাম “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া”। গতকাল র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আট তরুণের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় নিখোঁজ সংক্রান্তে ২৫ আগস্ট কুমিল্লার কোতয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। র‌্যাব নিখোঁজের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের উদ্ধারে ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘরছাড়া চার তরুণকে হেফাজতে নিয়ে ৬ সেপ্টেম্বর পরিবারের কাছে ফিরিয়েও দেয় র‌্যাব। গত বুধবার রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১১ এর অভিযানে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে হোসাইন আহম্মদ (৩৩), নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়ের (৩৪), বণি আমিন (২৭) ও চার নিরুদ্দেশ তরুণ ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত (১৯), হাসিবুল ইসলাম (২০), রোমান শিকদার (২৪) ও সাবিতকে (১৯) আটক করে। এ সময় নব্য জঙ্গি সংগঠনের প্রচারপত্র, বিস্ফোরক তৈরির নির্দেশিকা, নব্য জঙ্গি সংগঠনের কর্মপদ্ধতি, উগ্রবাদী বই, জিহাদি ভিডিও সংবলিত একটি ট্যাব উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাবের ভাষ্য, নব্য জেএমবির মতো জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ সমমনারা ফিরছে নতুন প্ল্যাটফর্মে। নব্য জেএমবিসহ অধিকাংশ জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধ হওয়ায় ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন প্ল্যাটফর্ম যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালে। এর নামকরণ হয় ২০১৯ সালে। ২০১৭ সাল থেকেই তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে এই নতুন মঞ্চে ভেড়ানোর চেষ্টা শুরু হয়। তাদের পরিকল্পনা ও কতজন তরুণ উদ্বুদ্ধ হয়ে এ প্ল্যাটফর্মে ভিড়েছে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা না গেলেও ঘরছাড়া তরুণদের ভোলার চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

র‌্যাবের ভাষ্য, গ্রেপ্তার ৭ জনের মধ্যে ৩ জন হোসাইন আহমেদ, নেছার উদ্দিন ওরফে ওমায়ের এবং বনি আমিন নতুন জঙ্গি সংগঠন “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া” (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) এর সক্রিয় সদস্য। মূলত এদের কাজ হলো এই সংগঠনের জন্য অল্পবয়সী তরুণদের ঘর ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করা।

র‌্যাব দাবি করেছে, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ সংগঠন, বিশেষত জেএমবি, আনসার আল ইসলাম এবং হুজির বিভিন্ন পর্যায়ের কতিপয় নেতা ও কর্মীরা একত্রিত হয়ে এই উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। গ্রেপ্তারকৃত হোসাইন সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া তিনি সদস্যদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। তিনি ২০১৪-১৫ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে সিরাজ নামক এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হন। অদ্যাবধি ১৫-২০ জন সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন।

গ্রেপ্তারকৃত নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়ের ভোলায় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২০১৯-এর আগে উগ্রবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হন। তিনি হিজরতকৃত সদস্যদের প্রশিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এছাড়া তিনি সদস্যদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। তিনি ৯-১০ জন সদস্যের তত্ত্বাবধান ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গ্রেপ্তারকৃত বণি আমিন উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে পটুয়াখালী এলাকায় কম্পিউটার সেলস অ্যান্ড সার্ভিসের ব্যবসা। সে সদস্যদের আশ্রয় প্রদান ও তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিল। সে ২০২০ সালে হোসাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। অদ্যাবধি ২২-২৫ জন সদস্যকে আশ্রয় প্রদান ও তত্ত্বাবধানে জড়িত ছিল।

যেভাবে তরুণরা নিখোঁজ হয়েছিল

র‌্যাব দাবি করে আসছিল, সম্প্রতি কুমিল্লা থেকে যে ৮ যুবক নিখোঁজ হয়েছে এবং তাদের সন্ধান চেয়ে পরিবারের সদস্যরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে তারপর থেকে ওই ৮ যুবকের বাড়ি ছাড়ার কারণ নিয়ে অনসুন্ধান করে আসছিল র‌্যাব ও অন্য গোয়েন্দা ইউনিটগুলো। নানা কারণে তখন তাদের মনে হয়েছিল ঘরছাড়া যুবকরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ঘর ছেড়েছে। এরপর তারা অনুসন্ধান করে মোট ৫০ জন বিভিন্ন বয়সী তরুণর বিভিন্ন সময়ে নিখোঁজ হওয়ার তথ্য সংগ্রহ করে যারা নিখোঁজ হওয়ার পর পরিবারের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল।

র‌্যাবের ভাষ্য, কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ আট তরুণের মধ্যে শারতাজ ইসলাম নিলয় (২২) নামের তরুণ গত ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কল্যাণপুরের নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। র‌্যাব ফিরে আসা নিলয়কে তার পরিবারের হেফাজতে রেখে নিখোঁজ বাকি সাত সদস্য ও জড়িতদের গ্রেপ্তার করে। এর আগে গত ২৩ আগস্ট সকাল ১০টায় নিলয়সহ নিখোঁজ পাঁচ তরুণ নিজ বাড়ি ছেড়েছিল। কুমিল্লা টাউন হল এলাকা থেকে সোহেলের (গ্রেপ্তার হয়নি) নির্দেশনায় তারা দুই ভাগ হয়ে লাকসাম রেল ক্রসিংয়ের কাছে হাউজিং স্টেট এলাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। সেখান থেকে তাদের অজ্ঞাত এক ব্যক্তি লাকসামের একটি বাড়িতে নিয়ে যান। সেখান থেকে নিলয়, নিহাল, সামি ও শিথিলকে কুমিল্লা শহরের একটি মাদ্রাসার মালিক নিয়ামত উল্লহর কাছে পৌঁছে দেয় সোহেল। তার তত্ত্বাবধানে একদিন থাকার পর সোহেল চারজনকে নিয়ে ঢাকায় আসেন এবং নিহাল, সামি ও শিথিলকে অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছে বুঝিয়ে দিয়ে নিলয়কে পটুয়াখালীর একটি লঞ্চের টিকেট কেটে পটুয়াখালীতে পাঠায়। পটুয়াখালীতে গ্রেপ্তার বণি আমিন নিলয়কে গ্রহণ করে স্থানীয় এক মাদ্রাসায় নিয়ে যায় এবং গ্রেপ্তার হুসাইন ও নেছার ওরফে উমায়েরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বণি আমিন নিলয়কে তিন দিন তার বাসায় রাখে। তার বাসায় অতিথি আসায় পর নিলয়কে হুসাইনের মাদ্রাসায় রেখে আসে। নিলয় মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর কল্যাণপুরে নিজ বাড়িতে ফিরে আসে।

র‌্যাবের দাবি, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তার হাসিব ও রিফাত (নিখোঁজ ৮ জনের দুইজন) এক বছর আগে কুমিল্লার কোবা মসজিদের ইমাম হাবিবুল্লাহর কাছে সংগঠনের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা পায়। হাবিবুল্লাহ তাদের উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করে ফাহিম ওরফে হাঞ্জালার কাছে নিয়ে যায়। ফাহিম তাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান দেয়। এভাবে তাদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে আগ্রহী করে তোলে।

র‌্যাব দাবি করেছে, গ্রেপ্তার রোমান স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রাামের জন্য ৪০ দিন আগে নিরুদ্দেশ হয় এবং গ্রেপ্তার সাবিত দুই মাস আগে পটুয়াখালী থেকে নিখোঁজ হয়। সোহেল (গ্রেপ্তার হয়নি) নামক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পটুয়াখালী ও ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠায়। নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের বিভিন্ন সেফ হাউজে রেখে পটুয়াখালী এলাকার সিরাজ ওরফে রবি (গ্রেপ্তার হয়নি) নামক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে পটুয়াখালী ও ভোলার বিভিন্ন চর এলাকায় সশস্ত্র হামলা, বোমা তৈরি, শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। গ্রেপ্তার হোসাইন আহম্মদ পটুয়াখালীর একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। নিষিদ্ধ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন থেকে কিছু সদস্যদের একীভূত করে ২০১৭ সালে এই নব্য জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০১৯ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) হিসেবে সংগঠনটির নামকরণ করা হয়।

গ্রেপ্তার রিফাত কুমিল্লাতে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত ছিল। গ্রেপ্তার হাসিব উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে অধ্যয়নরত এবং একটি অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। তারা হাবিবুলল্লহর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে দীক্ষিত হতে গত ২৩ আগস্ট বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়। গ্রেপ্তার রোমান পূর প্রকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমা করে গোপালগঞ্জে ইলেকট্রিক্যাল ও স্যানিটারি কাজ করত। সে অনলাইনে বিভিন্ন ভিডিও দেখে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে সংগঠনটি সম্পর্কে ধারণা পায়। পরে সে প্রায় এক মাস আগে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়। গ্রেপ্তার সাবিত উত্তরা এলাকায় প্রায় এক মাস আগে একটি ছাপাখানায় স্টোর কিপারের কাজ করত। সে তার একজন আত্মীয় ও অনলাইনে ভিডিও দেখার মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়। সে জুন মাসে ঢাকায় সিরাজের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর প্রায় দুই মাস আগে নিখোঁজ হয় বলছে র‌্যাব।

শুক্রবার, ০৭ অক্টোবর ২০২২ , ২২ আশ্বিন ১৪২৯ ১০ সফর ১৪৪৪

কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ ৪ জনসহ ৭ জঙ্গি আটক

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

কুমিল্লা থেকে ‘নিখোঁজ’ ৮ যুবকের মধ্যে ৪ জনসহ ৭ জনকে ‘জঙ্গি সম্পৃক্ততার’ অভিযোগে আটকের খবর জানিয়ে র‌্যাব বলছে, তারা একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। তারা ‘সশস্ত্র জিহাদের’ উদ্দেশ্যে ‘ঘর ছেড়েছিলো’। নতুন এ সংগঠনের নাম “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া”। গতকাল র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আট তরুণের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় নিখোঁজ সংক্রান্তে ২৫ আগস্ট কুমিল্লার কোতয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। র‌্যাব নিখোঁজের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের উদ্ধারে ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘরছাড়া চার তরুণকে হেফাজতে নিয়ে ৬ সেপ্টেম্বর পরিবারের কাছে ফিরিয়েও দেয় র‌্যাব। গত বুধবার রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১১ এর অভিযানে মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে হোসাইন আহম্মদ (৩৩), নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়ের (৩৪), বণি আমিন (২৭) ও চার নিরুদ্দেশ তরুণ ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত (১৯), হাসিবুল ইসলাম (২০), রোমান শিকদার (২৪) ও সাবিতকে (১৯) আটক করে। এ সময় নব্য জঙ্গি সংগঠনের প্রচারপত্র, বিস্ফোরক তৈরির নির্দেশিকা, নব্য জঙ্গি সংগঠনের কর্মপদ্ধতি, উগ্রবাদী বই, জিহাদি ভিডিও সংবলিত একটি ট্যাব উদ্ধার করা হয়।

র‌্যাবের ভাষ্য, নব্য জেএমবির মতো জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ সমমনারা ফিরছে নতুন প্ল্যাটফর্মে। নব্য জেএমবিসহ অধিকাংশ জঙ্গি সংগঠন নিষিদ্ধ হওয়ায় ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন প্ল্যাটফর্ম যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালে। এর নামকরণ হয় ২০১৯ সালে। ২০১৭ সাল থেকেই তরুণদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে এই নতুন মঞ্চে ভেড়ানোর চেষ্টা শুরু হয়। তাদের পরিকল্পনা ও কতজন তরুণ উদ্বুদ্ধ হয়ে এ প্ল্যাটফর্মে ভিড়েছে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা না গেলেও ঘরছাড়া তরুণদের ভোলার চরাঞ্চলে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

র‌্যাবের ভাষ্য, গ্রেপ্তার ৭ জনের মধ্যে ৩ জন হোসাইন আহমেদ, নেছার উদ্দিন ওরফে ওমায়ের এবং বনি আমিন নতুন জঙ্গি সংগঠন “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া” (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) এর সক্রিয় সদস্য। মূলত এদের কাজ হলো এই সংগঠনের জন্য অল্পবয়সী তরুণদের ঘর ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করা।

র‌্যাব দাবি করেছে, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ সংগঠন, বিশেষত জেএমবি, আনসার আল ইসলাম এবং হুজির বিভিন্ন পর্যায়ের কতিপয় নেতা ও কর্মীরা একত্রিত হয়ে এই উগ্রবাদী জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করে। গ্রেপ্তারকৃত হোসাইন সংগঠনের জন্য সদস্য সংগ্রহ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া তিনি সদস্যদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। তিনি ২০১৪-১৫ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে সিরাজ নামক এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হন। অদ্যাবধি ১৫-২০ জন সদস্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন।

গ্রেপ্তারকৃত নেছার উদ্দিন ওরফে উমায়ের ভোলায় একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২০১৯-এর আগে উগ্রবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হন। তিনি হিজরতকৃত সদস্যদের প্রশিক্ষক ও তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এছাড়া তিনি সদস্যদের বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সদস্যদের সশস্ত্র হামলার বিষয়ে প্রস্তুত করে তুলতেন। তিনি ৯-১০ জন সদস্যের তত্ত্বাবধান ও প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গ্রেপ্তারকৃত বণি আমিন উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে পটুয়াখালী এলাকায় কম্পিউটার সেলস অ্যান্ড সার্ভিসের ব্যবসা। সে সদস্যদের আশ্রয় প্রদান ও তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিল। সে ২০২০ সালে হোসাইনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। অদ্যাবধি ২২-২৫ জন সদস্যকে আশ্রয় প্রদান ও তত্ত্বাবধানে জড়িত ছিল।

যেভাবে তরুণরা নিখোঁজ হয়েছিল

র‌্যাব দাবি করে আসছিল, সম্প্রতি কুমিল্লা থেকে যে ৮ যুবক নিখোঁজ হয়েছে এবং তাদের সন্ধান চেয়ে পরিবারের সদস্যরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে তারপর থেকে ওই ৮ যুবকের বাড়ি ছাড়ার কারণ নিয়ে অনসুন্ধান করে আসছিল র‌্যাব ও অন্য গোয়েন্দা ইউনিটগুলো। নানা কারণে তখন তাদের মনে হয়েছিল ঘরছাড়া যুবকরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ঘর ছেড়েছে। এরপর তারা অনুসন্ধান করে মোট ৫০ জন বিভিন্ন বয়সী তরুণর বিভিন্ন সময়ে নিখোঁজ হওয়ার তথ্য সংগ্রহ করে যারা নিখোঁজ হওয়ার পর পরিবারের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল।

র‌্যাবের ভাষ্য, কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ আট তরুণের মধ্যে শারতাজ ইসলাম নিলয় (২২) নামের তরুণ গত ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কল্যাণপুরের নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। র‌্যাব ফিরে আসা নিলয়কে তার পরিবারের হেফাজতে রেখে নিখোঁজ বাকি সাত সদস্য ও জড়িতদের গ্রেপ্তার করে। এর আগে গত ২৩ আগস্ট সকাল ১০টায় নিলয়সহ নিখোঁজ পাঁচ তরুণ নিজ বাড়ি ছেড়েছিল। কুমিল্লা টাউন হল এলাকা থেকে সোহেলের (গ্রেপ্তার হয়নি) নির্দেশনায় তারা দুই ভাগ হয়ে লাকসাম রেল ক্রসিংয়ের কাছে হাউজিং স্টেট এলাকার উদ্দেশে যাত্রা করে। সেখান থেকে তাদের অজ্ঞাত এক ব্যক্তি লাকসামের একটি বাড়িতে নিয়ে যান। সেখান থেকে নিলয়, নিহাল, সামি ও শিথিলকে কুমিল্লা শহরের একটি মাদ্রাসার মালিক নিয়ামত উল্লহর কাছে পৌঁছে দেয় সোহেল। তার তত্ত্বাবধানে একদিন থাকার পর সোহেল চারজনকে নিয়ে ঢাকায় আসেন এবং নিহাল, সামি ও শিথিলকে অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছে বুঝিয়ে দিয়ে নিলয়কে পটুয়াখালীর একটি লঞ্চের টিকেট কেটে পটুয়াখালীতে পাঠায়। পটুয়াখালীতে গ্রেপ্তার বণি আমিন নিলয়কে গ্রহণ করে স্থানীয় এক মাদ্রাসায় নিয়ে যায় এবং গ্রেপ্তার হুসাইন ও নেছার ওরফে উমায়েরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বণি আমিন নিলয়কে তিন দিন তার বাসায় রাখে। তার বাসায় অতিথি আসায় পর নিলয়কে হুসাইনের মাদ্রাসায় রেখে আসে। নিলয় মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর কল্যাণপুরে নিজ বাড়িতে ফিরে আসে।

র‌্যাবের দাবি, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তার হাসিব ও রিফাত (নিখোঁজ ৮ জনের দুইজন) এক বছর আগে কুমিল্লার কোবা মসজিদের ইমাম হাবিবুল্লাহর কাছে সংগঠনের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা পায়। হাবিবুল্লাহ তাদের উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করে ফাহিম ওরফে হাঞ্জালার কাছে নিয়ে যায়। ফাহিম তাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান দেয়। এভাবে তাদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে আগ্রহী করে তোলে।

র‌্যাব দাবি করেছে, গ্রেপ্তার রোমান স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রাামের জন্য ৪০ দিন আগে নিরুদ্দেশ হয় এবং গ্রেপ্তার সাবিত দুই মাস আগে পটুয়াখালী থেকে নিখোঁজ হয়। সোহেল (গ্রেপ্তার হয়নি) নামক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পটুয়াখালী ও ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠায়। নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের বিভিন্ন সেফ হাউজে রেখে পটুয়াখালী এলাকার সিরাজ ওরফে রবি (গ্রেপ্তার হয়নি) নামক ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে পটুয়াখালী ও ভোলার বিভিন্ন চর এলাকায় সশস্ত্র হামলা, বোমা তৈরি, শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। গ্রেপ্তার হোসাইন আহম্মদ পটুয়াখালীর একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। নিষিদ্ধ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন থেকে কিছু সদস্যদের একীভূত করে ২০১৭ সালে এই নব্য জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০১৯ সালে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) হিসেবে সংগঠনটির নামকরণ করা হয়।

গ্রেপ্তার রিফাত কুমিল্লাতে অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত ছিল। গ্রেপ্তার হাসিব উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে অধ্যয়নরত এবং একটি অনলাইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। তারা হাবিবুলল্লহর মাধ্যমে জঙ্গিবাদে দীক্ষিত হতে গত ২৩ আগস্ট বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়। গ্রেপ্তার রোমান পূর প্রকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমা করে গোপালগঞ্জে ইলেকট্রিক্যাল ও স্যানিটারি কাজ করত। সে অনলাইনে বিভিন্ন ভিডিও দেখে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে সংগঠনটি সম্পর্কে ধারণা পায়। পরে সে প্রায় এক মাস আগে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়। গ্রেপ্তার সাবিত উত্তরা এলাকায় প্রায় এক মাস আগে একটি ছাপাখানায় স্টোর কিপারের কাজ করত। সে তার একজন আত্মীয় ও অনলাইনে ভিডিও দেখার মাধ্যমে উগ্রবাদে অনুপ্রাণিত হয়। সে জুন মাসে ঢাকায় সিরাজের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর প্রায় দুই মাস আগে নিখোঁজ হয় বলছে র‌্যাব।