জাগো বহ্নিশিখা

সজীব ওয়াফি

আমাদের এই পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে রাখা হয়েছে ভোগের পণ্য করে। কি রাজনীতি, কি চাকরিজীবী অথবা সমাজের উচ্চ অধিকাংশ পর্যায়ে একেই অবস্থা বিরাজমান। নারী যেন চার দেয়ালের আবদ্ধ কোন প্রাণী। একটুখানি স্বাধীনতা দেখলেই বিশেষ শ্রেণীর চোখ রাঙানি, গেল গেল সমাজটা রসাতলে গেল; আর নিরাপত্তাহীনতায় পরিবারের অনিচ্ছা তো আছেই। একটা ছেলের পক্ষে পরিবারের ত্রিচক্র ভাঙা যতটা সহজ, ঠিক ততটাই কঠিন একটা মেয়ের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা ত্রিচক্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে আবার অনেক ক্ষেত্রে গুমরে মরতে হয়। যারা টপকে আসতে পারে তারা ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমী হয়েই তাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। শিক্ষা শেষে চাকরি-বাকরি কিছু একটা জুটলে ভালো, না জুটলে বা পারিবারিক অসম্মতি থাকলে সেই হাঁড়ি ঠেলার কেচ্ছা।

গৌরচন্দ্রিকা মূলে প্রবেশের আগে ছোট একটা প্রশ্ন রাখি, বলতে পারবেন রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নগণ্য কেন? উত্তরটা অত্যন্ত সহজ, কিন্তু বাস্তবতা প্রচন্ড কঠিন। প্রতিটি রাজনৈতিক দলে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। আদতে এই হার ৩৩ শতাংশে নেই। ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ কমতির দিকে। সেখানে কেউ হয়তো কোন নেতার স্ত্রী, কেউ বোন কিংবা দুই একজন যারা বিভিন্নভাবে এসেছেন। বড় দলগুলোতে কিছুসংখ্যক নারী অংশগ্রহণ করলেও পারতপক্ষে, যা দেখা যাচ্ছে ওগুলো পুরুষতান্ত্রিকতারই চরিত্র। কেন পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র সে বিষয়ে পরে আসি, তার আগে পরিষ্কার হওয়া দরকার আমাদের নারীদের অংশগ্রহণ রাজনৈতিকাঙ্গনে এভাবে নেতিবাচক হলো কেন! সাধারণভাবে বললে বিষয়টি দাঁড়ায় নিরাপত্তা। আরেকটু বিস্তর আলাপ করলে পুরুষ সহকর্মী বা সহযোদ্ধার যৌন দৃষ্টিভঙ্গির অনাকাক্সিক্ষত ভয়। এমনকি আমাদের সমাজে নারীর রাজনীতি খুব একটা ভালোভাবে নেয় না। মনে করা হয় রাজনীতি করা মেয়েরা উশৃঙ্খল বা বেপরোয়া জীবনযাপনে আকৃষ্ট।

নারীদের জীবন-সংগ্রামে প্রতিকূলতার ছোট একটা উদাহরণ দেই, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে ওঠার খানিকটা আগে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের ঘটনা। বাসের জন্য অনেকক্ষণ ধরে দুজন নারী অপেক্ষমাণ। এই রাস্তায় যারা চলাচল করেন তারা হয়তো জানেন মেডিকেল পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে বাস যা আসে, সবগুলোই যাত্রীতে ঠাসা থাকে। ওনারাও নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কোন বাসেই ওঠার জায়গা পাচ্ছিলেন না। অথচ ছেলেরা এবং পুরুষ লোকজন অনায়াসেই ঠাসা বাসে নিজের জায়গায় করে নিচ্ছিল। পরিশেষে যাত্রী বোঝাই একটা বাসে উঠতে গেলেন, হেল্পার উঠতে নিষেধ করলেন; বললেন দাঁড়ানো যাত্রীতেই বাস ঠাসা, সিট ফাঁকা নেই। তারপরও লড়াই করেই যখন উঠেছেন, অনেকের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। এই তো গেল শুধু গণপরিবহনে চলাচলের একটামাত্র উদাহরণ। এ রকমের নানা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে আমাদের নারীরা শিক্ষাঙ্গনে পৌঁছান। পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাদের অনেকাংশই হাল ছেড়ে দেন।

গত কয়েক দিন আগে প্রথমে কথা উঠল নারীদের ছোট পোশাক পরা নিয়ে। তারপর সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২২ আমাদের নারীরা জয়ী হয়ে আসলে অনেকের বুকজ্বালা শুরু হলো। নারীকে কীভাবে ঘরের ভেতরে আটকানো যায়, তাদের উন্নতি ঠেকানো যায় এই তাদের বুদ্ধিশুদ্ধি। কে কি পোশাক পরবে, এটা যিনি পরবেন তার হাতেই ছেড়ে দেয়া উচিত। এটা নিয়ে অহেতুক কথা বলার মতো বাতুলতা আর নেই। তারপরও এটা নিয়ে পরে থাকতে হবে। যদি একটু খোঁজ নেয়া যায় দেখা যাবে, সারাদিন এগুলো নিয়ে নেতিবাচকভাবে চিৎকার করা ছেলেগুলোই হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ায়, বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়। পরের বেলায় শুধু নৈতিকতার বুলি কপচানো। অনেকে আবার যুক্তি দিবেন ছোট পোশাক নারীর জন্য অশালীন। হ্যাঁ, সাংস্কৃতিক চিন্তার জায়গা থেকে অনেকের কাছে অনেক জিনিসই অশালীন হতে পারে। যেটা আমার দেশের বুলি, সেটা অন্য দেশে গালি হিসেবেও ব্যবহার হতে পারে। যেমন এই ধরুন মাথার চুল শব্দটাকেই। চিন্তাগতভাবে মজ্জায় সারাদিন অপরাধ প্রবণতা ঘুরঘুর করলে ছোট পোশাক বা হিজাব বলে কিছু নেই, অপরাধ সংঘটিত করবেই। শুধু ছোট পোশাক বড় পোষাকের দোহাই দিয়ে পাশ কাটানোর চেষ্টা। যে লোকটা বোরকা বা হিজাব হিজাব করে বেড়ায়, তাকে একবার ওই পোশাকটা প্যাঁচিয়ে দিলেই বুঝবে, ওটা কি যন্ত্রণার!

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের খ্যাতনামা একটি মহিলা কলেজে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের চিত্র ছড়িয়েছে। অভিযোগ উঠেছে নানা অনৈতিক কাজে ছাত্রলীগ শাখা সভাপতি-সম্পাদক আবাসিক শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেন। অভিযোগের যে তীর ছুড়েছে, সেটা খুবই গুরুতর। এই গুরুতর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরিণতি কি ঘটতে পারে কেউ ধারণা করতে পারছেন কি না, জানি না। তবে এটা বাস্তব যে পরবর্তী সময়ে কলেজটিতে মেয়েদের ভর্তি করাতে বাবা-মায়েরা সাতপাঁচ ভেবে অতঃপর ভর্তি করবেন। কোন বাবা-মা চাইবেন না তার সন্তান জেনে বা না জেনে বিপদে নিমজ্জিত হোক। তারা জানেন তার মেয়েটাকে একটা সময় সামাজিক আইনকানুন মেনে বিয়ে দিতে হবে। সুতরাং ভালো কোন পাত্রস্থ হওয়াই তাদের চিন্তার জগৎ। অথচ যে পরিস্থিতি আমরা দেখলাম! এরপর কেউ কি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন ওই কলেজের মেয়েরা মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার হবেন না? পারবেন না। বরং অধিকাংশই যে যেমন পারবেন পরিচিত বন্ধুদের ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলবেন। সবাই কি অভিযোগের ওই সব কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত? তারপরও দায় নিতে হচ্ছে সবাইকেই। পূর্বেই বলেছি এই পরিস্থিতির অন্যতম পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র। ফলাফলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে নারী শিক্ষার।

বাংলাদেশ সর্বশেষ তিন দশক নারী প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরগুলোর প্রধানও নারী। দীর্ঘদিন ধরে সংসদের স্পিকার পদে নারীর অবস্থানও লক্ষণীয়। চাকরি পেশাজীবী ক্ষেত্রগুলোতেও নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে সত্য। এত কিছুর পরেও সেই পুরুষতান্ত্রিকতার বহিঃপ্রকাশ, নারীর প্রতি যত অবিচার। অনেকে তো ঢাকঢোল পিটিয়ে বলেই বেড়ান নারীদের জয় হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণে যে পুরুষতান্ত্রিকতার পতন ঘটেনি, নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়নি; উপরন্তু নানান ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করা নারীরাই নিজের অজান্তে পুরুষতান্ত্রিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছেন এ কথা কে বোঝাবে! যদি অভূতপূর্ব পরিবর্তনই ঘটবে তবে কেন সরকারি ওই মহিলা কলেজের মেয়েদের পক্ষে কোন আন্দোলন দাঁড়ায়নি! পোশাক নিয়েই কেন এই আধুনিকোত্তর যুগে প্রশ্ন উঠবে! অনেকে বলবেন নারীবাদীরা কথা বলেনি, অনেকে বলবেন বিষয়টা রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সত্যি বলতে যারা একের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে ব্যস্ত তারা নিজ অবস্থান থেকে সামান্যতম প্রতিবাদ করলেই নারীরা শেকল মুক্ত হতে পারত। সরকার কিংবা বিরোধীরা কেউ এর দায় এড়াতে পারে না। অথচ করেনি। এই তো পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা!

চারিদিকে শুধু অন্ধকারের ঘনঘটা। শকুনের খুবলে খাওয়ার চিৎকার। এমতাবস্থায় আমরা হয়তো তোমাদের পথ প্রসস্থ করতে পারব না হে আলোর অভিযাত্রী। আমরা সংখ্যায় কম, কিন্তু মনে রেখ তোমাদের সহযাত্রী হতে পারব, তোমাদের সাহস সঞ্চার করতে পারব। মূল লড়াইটা তোমাদেরই লড়তে হবে ভগিনীগণ। শক্ত হাতে দাঁড়াতে হবে দেবী দুর্গা যেভাবে অশুভশক্তির বিনাশ ঘটান। নচেৎ এ ধরায় বাঁচার কোন পথ নেই, বেঁচে থেকেও বাঁচার মাহাত্ম্য নেই; সব দুয়ারই ক্রমাগত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুভ হোক তোমাদের মঙ্গল যাত্রা। জাগো বহ্নিশিখা জাগো!

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

শুক্রবার, ০৭ অক্টোবর ২০২২ , ২২ আশ্বিন ১৪২৯ ১০ সফর ১৪৪৪

জাগো বহ্নিশিখা

সজীব ওয়াফি

আমাদের এই পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে রাখা হয়েছে ভোগের পণ্য করে। কি রাজনীতি, কি চাকরিজীবী অথবা সমাজের উচ্চ অধিকাংশ পর্যায়ে একেই অবস্থা বিরাজমান। নারী যেন চার দেয়ালের আবদ্ধ কোন প্রাণী। একটুখানি স্বাধীনতা দেখলেই বিশেষ শ্রেণীর চোখ রাঙানি, গেল গেল সমাজটা রসাতলে গেল; আর নিরাপত্তাহীনতায় পরিবারের অনিচ্ছা তো আছেই। একটা ছেলের পক্ষে পরিবারের ত্রিচক্র ভাঙা যতটা সহজ, ঠিক ততটাই কঠিন একটা মেয়ের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরা ত্রিচক্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে আবার অনেক ক্ষেত্রে গুমরে মরতে হয়। যারা টপকে আসতে পারে তারা ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমী হয়েই তাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। শিক্ষা শেষে চাকরি-বাকরি কিছু একটা জুটলে ভালো, না জুটলে বা পারিবারিক অসম্মতি থাকলে সেই হাঁড়ি ঠেলার কেচ্ছা।

গৌরচন্দ্রিকা মূলে প্রবেশের আগে ছোট একটা প্রশ্ন রাখি, বলতে পারবেন রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নগণ্য কেন? উত্তরটা অত্যন্ত সহজ, কিন্তু বাস্তবতা প্রচন্ড কঠিন। প্রতিটি রাজনৈতিক দলে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক রাখা হয়েছে। আদতে এই হার ৩৩ শতাংশে নেই। ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ কমতির দিকে। সেখানে কেউ হয়তো কোন নেতার স্ত্রী, কেউ বোন কিংবা দুই একজন যারা বিভিন্নভাবে এসেছেন। বড় দলগুলোতে কিছুসংখ্যক নারী অংশগ্রহণ করলেও পারতপক্ষে, যা দেখা যাচ্ছে ওগুলো পুরুষতান্ত্রিকতারই চরিত্র। কেন পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র সে বিষয়ে পরে আসি, তার আগে পরিষ্কার হওয়া দরকার আমাদের নারীদের অংশগ্রহণ রাজনৈতিকাঙ্গনে এভাবে নেতিবাচক হলো কেন! সাধারণভাবে বললে বিষয়টি দাঁড়ায় নিরাপত্তা। আরেকটু বিস্তর আলাপ করলে পুরুষ সহকর্মী বা সহযোদ্ধার যৌন দৃষ্টিভঙ্গির অনাকাক্সিক্ষত ভয়। এমনকি আমাদের সমাজে নারীর রাজনীতি খুব একটা ভালোভাবে নেয় না। মনে করা হয় রাজনীতি করা মেয়েরা উশৃঙ্খল বা বেপরোয়া জীবনযাপনে আকৃষ্ট।

নারীদের জীবন-সংগ্রামে প্রতিকূলতার ছোট একটা উদাহরণ দেই, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে ওঠার খানিকটা আগে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের ঘটনা। বাসের জন্য অনেকক্ষণ ধরে দুজন নারী অপেক্ষমাণ। এই রাস্তায় যারা চলাচল করেন তারা হয়তো জানেন মেডিকেল পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে বাস যা আসে, সবগুলোই যাত্রীতে ঠাসা থাকে। ওনারাও নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কোন বাসেই ওঠার জায়গা পাচ্ছিলেন না। অথচ ছেলেরা এবং পুরুষ লোকজন অনায়াসেই ঠাসা বাসে নিজের জায়গায় করে নিচ্ছিল। পরিশেষে যাত্রী বোঝাই একটা বাসে উঠতে গেলেন, হেল্পার উঠতে নিষেধ করলেন; বললেন দাঁড়ানো যাত্রীতেই বাস ঠাসা, সিট ফাঁকা নেই। তারপরও লড়াই করেই যখন উঠেছেন, অনেকের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। এই তো গেল শুধু গণপরিবহনে চলাচলের একটামাত্র উদাহরণ। এ রকমের নানা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে আমাদের নারীরা শিক্ষাঙ্গনে পৌঁছান। পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাদের অনেকাংশই হাল ছেড়ে দেন।

গত কয়েক দিন আগে প্রথমে কথা উঠল নারীদের ছোট পোশাক পরা নিয়ে। তারপর সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২২ আমাদের নারীরা জয়ী হয়ে আসলে অনেকের বুকজ্বালা শুরু হলো। নারীকে কীভাবে ঘরের ভেতরে আটকানো যায়, তাদের উন্নতি ঠেকানো যায় এই তাদের বুদ্ধিশুদ্ধি। কে কি পোশাক পরবে, এটা যিনি পরবেন তার হাতেই ছেড়ে দেয়া উচিত। এটা নিয়ে অহেতুক কথা বলার মতো বাতুলতা আর নেই। তারপরও এটা নিয়ে পরে থাকতে হবে। যদি একটু খোঁজ নেয়া যায় দেখা যাবে, সারাদিন এগুলো নিয়ে নেতিবাচকভাবে চিৎকার করা ছেলেগুলোই হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ায়, বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়। পরের বেলায় শুধু নৈতিকতার বুলি কপচানো। অনেকে আবার যুক্তি দিবেন ছোট পোশাক নারীর জন্য অশালীন। হ্যাঁ, সাংস্কৃতিক চিন্তার জায়গা থেকে অনেকের কাছে অনেক জিনিসই অশালীন হতে পারে। যেটা আমার দেশের বুলি, সেটা অন্য দেশে গালি হিসেবেও ব্যবহার হতে পারে। যেমন এই ধরুন মাথার চুল শব্দটাকেই। চিন্তাগতভাবে মজ্জায় সারাদিন অপরাধ প্রবণতা ঘুরঘুর করলে ছোট পোশাক বা হিজাব বলে কিছু নেই, অপরাধ সংঘটিত করবেই। শুধু ছোট পোশাক বড় পোষাকের দোহাই দিয়ে পাশ কাটানোর চেষ্টা। যে লোকটা বোরকা বা হিজাব হিজাব করে বেড়ায়, তাকে একবার ওই পোশাকটা প্যাঁচিয়ে দিলেই বুঝবে, ওটা কি যন্ত্রণার!

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের খ্যাতনামা একটি মহিলা কলেজে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের চিত্র ছড়িয়েছে। অভিযোগ উঠেছে নানা অনৈতিক কাজে ছাত্রলীগ শাখা সভাপতি-সম্পাদক আবাসিক শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেন। অভিযোগের যে তীর ছুড়েছে, সেটা খুবই গুরুতর। এই গুরুতর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরিণতি কি ঘটতে পারে কেউ ধারণা করতে পারছেন কি না, জানি না। তবে এটা বাস্তব যে পরবর্তী সময়ে কলেজটিতে মেয়েদের ভর্তি করাতে বাবা-মায়েরা সাতপাঁচ ভেবে অতঃপর ভর্তি করবেন। কোন বাবা-মা চাইবেন না তার সন্তান জেনে বা না জেনে বিপদে নিমজ্জিত হোক। তারা জানেন তার মেয়েটাকে একটা সময় সামাজিক আইনকানুন মেনে বিয়ে দিতে হবে। সুতরাং ভালো কোন পাত্রস্থ হওয়াই তাদের চিন্তার জগৎ। অথচ যে পরিস্থিতি আমরা দেখলাম! এরপর কেউ কি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন ওই কলেজের মেয়েরা মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার হবেন না? পারবেন না। বরং অধিকাংশই যে যেমন পারবেন পরিচিত বন্ধুদের ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলবেন। সবাই কি অভিযোগের ওই সব কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত? তারপরও দায় নিতে হচ্ছে সবাইকেই। পূর্বেই বলেছি এই পরিস্থিতির অন্যতম পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র। ফলাফলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে নারী শিক্ষার।

বাংলাদেশ সর্বশেষ তিন দশক নারী প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরগুলোর প্রধানও নারী। দীর্ঘদিন ধরে সংসদের স্পিকার পদে নারীর অবস্থানও লক্ষণীয়। চাকরি পেশাজীবী ক্ষেত্রগুলোতেও নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে সত্য। এত কিছুর পরেও সেই পুরুষতান্ত্রিকতার বহিঃপ্রকাশ, নারীর প্রতি যত অবিচার। অনেকে তো ঢাকঢোল পিটিয়ে বলেই বেড়ান নারীদের জয় হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণে যে পুরুষতান্ত্রিকতার পতন ঘটেনি, নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়নি; উপরন্তু নানান ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করা নারীরাই নিজের অজান্তে পুরুষতান্ত্রিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছেন এ কথা কে বোঝাবে! যদি অভূতপূর্ব পরিবর্তনই ঘটবে তবে কেন সরকারি ওই মহিলা কলেজের মেয়েদের পক্ষে কোন আন্দোলন দাঁড়ায়নি! পোশাক নিয়েই কেন এই আধুনিকোত্তর যুগে প্রশ্ন উঠবে! অনেকে বলবেন নারীবাদীরা কথা বলেনি, অনেকে বলবেন বিষয়টা রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সত্যি বলতে যারা একের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে ব্যস্ত তারা নিজ অবস্থান থেকে সামান্যতম প্রতিবাদ করলেই নারীরা শেকল মুক্ত হতে পারত। সরকার কিংবা বিরোধীরা কেউ এর দায় এড়াতে পারে না। অথচ করেনি। এই তো পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা!

চারিদিকে শুধু অন্ধকারের ঘনঘটা। শকুনের খুবলে খাওয়ার চিৎকার। এমতাবস্থায় আমরা হয়তো তোমাদের পথ প্রসস্থ করতে পারব না হে আলোর অভিযাত্রী। আমরা সংখ্যায় কম, কিন্তু মনে রেখ তোমাদের সহযাত্রী হতে পারব, তোমাদের সাহস সঞ্চার করতে পারব। মূল লড়াইটা তোমাদেরই লড়তে হবে ভগিনীগণ। শক্ত হাতে দাঁড়াতে হবে দেবী দুর্গা যেভাবে অশুভশক্তির বিনাশ ঘটান। নচেৎ এ ধরায় বাঁচার কোন পথ নেই, বেঁচে থেকেও বাঁচার মাহাত্ম্য নেই; সব দুয়ারই ক্রমাগত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুভ হোক তোমাদের মঙ্গল যাত্রা। জাগো বহ্নিশিখা জাগো!

[লেখক : প্রাবন্ধিক]