উত্তরবঙ্গের পর্যটন ও সম্ভাবনা : একটি অনুভাবনা

মাসুদুল হক

উত্তরবঙ্গ হলো বাংলাদেশের উত্তর দিকে অবস্থিত একটি ভৌগোলিক অঞ্চল। উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগ রাজশাহী ও রংপুরকে একত্রে আমরা উত্তরবঙ্গ বলে চিহ্নিত করি। প্রাচীন বঙ্গ রাজ্যের ভৌগোলিক নাম উত্তরবঙ্গ থেকেই এই নামের ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে এই অংশটি সমগ্র বাংলাদেশের উত্তরে বলেই, উত্তরবঙ্গ বলা হয়ে থাকে। রংপুর বিভাগ গঠন করার পূর্বে, পুরো উত্তরবঙ্গই রাজশাহী বিভাগের মধ্যে ছিল। মোট ১৬টি জেলা নিয়ে উত্তরবঙ্গ গঠিত হয়েছে। নাটোরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় প্রশাসনিক বাসভবন অবস্থিত; পাকিস্তান আমলেও তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় সদরদপ্তর ছিল এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে নাটোরকে দেশের দ্বিতীয় প্রশাসনিক রাজধানী ও দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি তথা উত্তরা গর্ভামেন্ট হাউসকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা করেন।

উত্তরবঙ্গের জনজীবন, ভূপ্রকৃতি, নিসর্গ, নদী, লোকসংস্কৃতি ও স্থাপত্যশৈলীর একটা নিজস্ব গড়ন দাঁড়িয়ে হাজার বছরের ধারাবাহিক চর্যা ও চর্চায়।

সময়ের পরিবর্তনে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কখনো কখনো এই অঞ্চলের কোন সভ্যতা বা কোন স্থান হয়ে উঠে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রস্থল ও ঐতিহ্যের ধারকবাহক তথা বাঙালি জাতির উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে। আবার কালক্রমে কখনো কখনো উত্তরবঙ্গের সেই সভ্যতার জৌলুস ও ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। সেই উত্তরবঙ্গের মানবসভ্যতার এই প্রকাশের মধ্যে ধীরে ধীরে পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা ও বিকাশের পথ গড়ে উঠেছে, তা আমরা অনেক সময় আলাদাভাবে ভেবেই দেখি না। পর্যটনের মাধ্যমে আমরা যেমন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি, তেমনি আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে পর্যটনের ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের অভিজ্ঞতাকে শাণিত করে পর্যটন আর শিল্প ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা প্রাচীন স্থাপত্যের রীতি ও সৌন্দর্য আমাদের ঐতিহ্যের সন্ধানী করে তোলে। সব মিলিয়ে আমাদের জাতির মনন ও রুচির স্বরূপ অন্বেষণ করা যায় পর্যটনের মাধ্যমে। শুধু মনন কেন? পর্যটনকে শিল্পে প্রবর্তন করতে পারলে তা নিয়ে আসতে পারে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। সেই ভাবনা থেকেই উত্তরবঙ্গের পর্যটন ও এর সম্ভাবনাকে আমরা জাতীয় সমৃদ্ধির বিবেচনার সূচকে নিয়ে আসতে পারি।

উত্তরবঙ্গের সভ্যতার দিকে তাকালে দেখা যায়, মৌর্য ও গুপ্তা রাজাদের শাসনামলে মহাস্থানগড় হয়ে উঠেছিল ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এবং সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে। উত্তরবঙ্গের পুন্ড্রুনগর ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী। আজ হয়তোবা রাজারানীর রাজ্যের স্মৃতি চিহ্ন আছে, আগের সেই জৌলুস নেই কিন্তু পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো দর্শনীয় স্থান, নিজস্ব লোকসংস্কৃতিগত খাবার ও আবেদন ছরিয়ে-ছিটিয়ে আছে আঞ্চলের জেলাগুলোর বিভিন্ন স্থানে, যা পর্যটকদের ভুলিয়ে দেবে ভ্রমণের সব আবসাদ আর ক্লান্তিকে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের খ্যাতি বাংলাদেশব্যাপী। ভ্রমণপিপাসু মানুষগুলো চাইলে আমের মৌসুমে সেখানে আম বাগানে গিয়ে পাকা আমের স্বাদ গ্রহণের পাশাপাশি বিলভাতিয়া, বিলচুড়াইল, বিলহোগলা, ছোট সোনা মসজিদ, দাসবাড়ি মসজিদে ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় ইতিহাসের পাতাকে খুলে দেখবার প্রেরণা পেতে পারেন।

বরেন্দ্রভূমির রাজধানী হিসেবে খ্যাত রাজশাহী বরাবরই ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করে। বরেন্দ্র জাদুঘর, পুটিয়া রাজবাড়ী, সারদা পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ভদ্রাপাক, পদ্মার চরে ভ্রমণের মধ্য দিয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চেতনায় ঋদ্ধ হতে পারবেন পর্যটকের। মনে রাখতে হবে এই অঞ্চলের ভ্রমণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের মধ্য সীমাবদ্ধ নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরে বিস্তৃত করা প্রয়োজন। রাজশাহীতে যে ধরনের নাগরিক সুবিধা বেড়েছে, এটাকে কেন্দ্র করে বিদেশি পর্যটকদের বিচরণ ক্ষেত্র আমরা অনায়াসে গড়ে তুলতে পারি।

নাটোরের কাচাগোল্লার ঐতিহ্যকে ব্যবহার করে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী, নাটোরের রাজবাড়ী, চৌগ্রাম জমিদার-বাড়িকে পর্যটকদের জন্য সুবিধায় পরিপূর্ণ করতে পারলে উত্তরবঙ্গের সমৃদ্ধির জন্য সহায়ক হবে।

নওগাঁয় কুসুম্বা মসজিদ, পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার, পালরাজাদের স্মৃতিচিহ্ন, বলিহার রাজবাড়ী, জবাই বিল, জগদ্দল বিহার, পত্নীতলা দিব্যক জয়স্তম্ভ এখনো জেগে আছে ইতিহাসের স্মারকচিহৃ রূপে। সেই সঙ্গে পতিসরে রবীন্দ্র-কুঠিবাড়ি... পর্যটনের জন্য উৎকৃষ্ট স্থান। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের।

যমুনা সেতু সিরাজগঞ্জ জেলাকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন মাত্রায়। বেলকুচির তাতিদের তাত পল্লী ও তাদের তাঁতশিল্প, শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি, দরগাহ মসজিদ, শিব মন্দির ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করবেই, সেদিকে লক্ষ্য রেখে পর্যটনের সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন।

জয়পুরহাট বহু দিন গৌড়ের পাল ও সেন রাজাদের রাজ্যভুক্ত ছিল। রাঙ্গাদিঘী, নান্দাইল দিঘি, লাকমা রাজবাড়ী, পাথরঘাটা দর্শনীয় স্থানগুলোতে দর্শনার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, এই বিষয় উত্তরবঙ্গের পর্যটন প্রসারে গুরুত্ব বহন করছে।

হাওর-বাঁওড় ও বিল দিয়ে সাজানো পাবনা জেলা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল চলন বিলের একটা অংশ এই জেলাকে ঘিরে। বর্ষার সময় ভরা বিলে নৌকা নিয়ে মাছ ধরা ও টাটকা মাছ দিয়ে খাবার খাওয়া এক নতুন অনুভূতির জোগান দেবে। এ ছাড়া পাকসি, ঈশ্বরদীর চিনির কারখানা দেখার সুযোগ থাকবেই।

উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র নামে পরিচিত বগুড়াকে ওই এলাকার রাজধানী বলেই সবার কাছে জানা। উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত। মহাস্থানগড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বহু রাজাদের রাজ্য ... এখনো সেই রাজাদের রাজ্যের স্মৃতিচিহৃ রয়ে গেছে, তা অনায়াসেই পর্যটনের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এ ছাড়া মাজার শরিফ, কাঁটাবিহীন বড়াইয়ের গাছ, পশুরামের প্রাসাদ ও প্রাচীর, গোবিন্দভিটা, মহাস্থানগড় জাদুঘর, বেহুলার বাসরঘর, শিলা দেবীর ঘাট, ভাসুবিহার, বাংলাদেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্রে সজ্জিত হয়ে আছে বগুড়া... শুধু প্রয়োজন পর্যটকদের সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলা।

কথিত আছে রাজা গোবিন্দের ষাট হাজার গরুর গো-চরণভূমির নামে গাইবান্ধা জেলার নামকরণ হয়েছে। গাইবান্ধা জেলায় পর্যটকদের মনকাড়ার মতো অনেক জায়গা আছে তার মধ্যে গোবিন্দগঞ্জের কুটিবাড়ী, পলাশবাড়ী এডুকেশন পার্ক, ড্রিমল্যান্ড পার্ক, মাটির নিচে সবুজ ঘর ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার, কাষ্ট কালীর মন্দির, বালাসী ঘাট, যমুনার চরসমূহ।

রংপুর জেলার ভিন্ন জগৎ, বেগম রোকেয়ার বাড়ি, নীলদরিয়াবিল, তাজহাট জমিদারবাড়ী, রংপুর চিড়িয়াখানা, চিকলী বিল বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে বেশ পরিচিতি পাচ্ছে। এই অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানের জীবনমুখর ব্যাপ্তি আর লোকসংস্কৃতির বৈচিত্র্যের স্বাদকে পর্যটনশিল্পের উপকরণে পরিণত করা যেতে পারে সহজেই। শুধু প্রয়োজন উদ্যোগ।

দিনাজপুরের লিচুর স্বাদ এক কথায় অতুলনীয়। বাংলাদেশের লিচুর রাজধানী দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির, রামসাগর দিঘির সৌন্দর্য ভ্রমণপিপাসুদের বিমোহিত করছে। এ ছাড়া এই জনপদের ভূপ্রকৃতি ও লোকসংস্কৃতির চলমান ধারা পর্যটনশিল্পে নান্দনিক সংযোজন ঘটাতে পারে; যাতে করে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করবে।

ঠাকুরগাঁও জেলার কিছু স্থান পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়তে শুরু করেছে। এখানকার গ্রামগুলো ছবিতে আঁকা চিত্রের মতো। কুমিল্লা হাড়িপিকনিক কর্তার, খুনিয়া দিঘিতে লোক সমাগম দিন দিন বেড়েই চলেছে।

নীলফামারী জেলাকে নীলের দেশ বলা হয়। একসময় ব্রিটিশরা এখানকার চাষিদের বাধ্য করত নীল চাষ করতে। এই জেলার প্রতিটি স্থান এক একটি ইতিহাসের সাক্ষী। ইতিহাস জানার পাশাপাশি ভ্রমণকারীরা দেখতে পারবেন নীলসাগর, ময়নামতি দুর্গ, সিন্ধুরমতি দীঘি, মীরজুমলার মসজিদ।

মহা রাজা বিশ্বসিংহের কুড়িটি পরিবারের দেশ থেকেই কুড়িগ্রাম জেলা। বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোই এখানকার প্রধান আকর্ষণ। এ ছাড়া শাহী মসজিদ, বীর প্রতীক প্রাপ্ত তারামন বিবিরবাড়ী, নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়ী, চিলমারী বন্দর পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ছিটমহল ছিল লালমনিরহাট জেলায় যা আজ বিলুপ্ত। ছিটমহলগুলোর বৈশিষ্ট্য আলাদা দেখে মনে হবে বাংলাদেশের মধ্যে আরেকটি ছোট্ট বাংলাদেশ। এই বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো ঘুরে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা যোগ করতে পারবেন পর্যটকের।

পাঁচটি গড়ের সমন্বয়ে গঠিত পঞ্চগড় জেলা। যেমনি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর তেমনি অসাধারণ অতিথিপরায়ণ মানুষের বসতি, চা-বাগান ও পাথরে সমৃদ্ধ এই জেলাকে। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয়ের অধিকারী এই জেলার মানুষেরা। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংযোগ এখানকার অর্থনীতিকে করেছে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। হিমালয়ের কন্যা পঞ্চগড় যেন হিমালয়ের কৃপার দান। বাংলাবান্ধা পর্যটকদের কাছে হয়ে উঠছে অন্য রকম আবেদনের জায়গা।

উত্তরবঙ্গের পর্যটনের উন্নয়ন ও পরিকল্পনা সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রয়োজন শুধু প্রচার-প্রসার ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি দেশের গণমাধ্যমগুলো যদি উত্তরবঙ্গ পর্যটন স্থাপনা ও স্থানগুলোকে প্রচার-প্রসারে কাজ করে তাহলে উত্তরবঙ্গ পর্যটনের নতুন একটি দিগন্তের উন্মোচন হবে। বেড়ে যাবে অথনৈতিক সমৃদ্ধি। কমিউনিটি ভিত্তিক ট্যুরিজমের মাধ্যমে কমানো সম্ভব হবে স্থানীয়দের বেকার সমস্যা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের পর্যটন সহায়ক মনোভাব বদলে দিতে পারে উত্তরবঙ্গ পর্যটনের সম্ভাবনাকে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার দিকেই আমরা ক্রমশ ধাবমান দেশ। এই গতির সঙ্গে উত্তরবঙ্গের পর্যটনশিল্পের সংযোগ ঘটালে নিঃসন্দেহে বেড়ে যাবে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃত্তি ও জাতীয় সমৃদ্ধি।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

শুক্রবার, ০৭ অক্টোবর ২০২২ , ২২ আশ্বিন ১৪২৯ ১০ সফর ১৪৪৪

উত্তরবঙ্গের পর্যটন ও সম্ভাবনা : একটি অনুভাবনা

মাসুদুল হক

উত্তরবঙ্গ হলো বাংলাদেশের উত্তর দিকে অবস্থিত একটি ভৌগোলিক অঞ্চল। উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগ রাজশাহী ও রংপুরকে একত্রে আমরা উত্তরবঙ্গ বলে চিহ্নিত করি। প্রাচীন বঙ্গ রাজ্যের ভৌগোলিক নাম উত্তরবঙ্গ থেকেই এই নামের ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে এই অংশটি সমগ্র বাংলাদেশের উত্তরে বলেই, উত্তরবঙ্গ বলা হয়ে থাকে। রংপুর বিভাগ গঠন করার পূর্বে, পুরো উত্তরবঙ্গই রাজশাহী বিভাগের মধ্যে ছিল। মোট ১৬টি জেলা নিয়ে উত্তরবঙ্গ গঠিত হয়েছে। নাটোরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় প্রশাসনিক বাসভবন অবস্থিত; পাকিস্তান আমলেও তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় সদরদপ্তর ছিল এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে নাটোরকে দেশের দ্বিতীয় প্রশাসনিক রাজধানী ও দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি তথা উত্তরা গর্ভামেন্ট হাউসকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা করেন।

উত্তরবঙ্গের জনজীবন, ভূপ্রকৃতি, নিসর্গ, নদী, লোকসংস্কৃতি ও স্থাপত্যশৈলীর একটা নিজস্ব গড়ন দাঁড়িয়ে হাজার বছরের ধারাবাহিক চর্যা ও চর্চায়।

সময়ের পরিবর্তনে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কখনো কখনো এই অঞ্চলের কোন সভ্যতা বা কোন স্থান হয়ে উঠে সাংস্কৃতিক কেন্দ্রস্থল ও ঐতিহ্যের ধারকবাহক তথা বাঙালি জাতির উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে। আবার কালক্রমে কখনো কখনো উত্তরবঙ্গের সেই সভ্যতার জৌলুস ও ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে। সেই উত্তরবঙ্গের মানবসভ্যতার এই প্রকাশের মধ্যে ধীরে ধীরে পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা ও বিকাশের পথ গড়ে উঠেছে, তা আমরা অনেক সময় আলাদাভাবে ভেবেই দেখি না। পর্যটনের মাধ্যমে আমরা যেমন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারি, তেমনি আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে পর্যটনের ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের অভিজ্ঞতাকে শাণিত করে পর্যটন আর শিল্প ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা প্রাচীন স্থাপত্যের রীতি ও সৌন্দর্য আমাদের ঐতিহ্যের সন্ধানী করে তোলে। সব মিলিয়ে আমাদের জাতির মনন ও রুচির স্বরূপ অন্বেষণ করা যায় পর্যটনের মাধ্যমে। শুধু মনন কেন? পর্যটনকে শিল্পে প্রবর্তন করতে পারলে তা নিয়ে আসতে পারে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। সেই ভাবনা থেকেই উত্তরবঙ্গের পর্যটন ও এর সম্ভাবনাকে আমরা জাতীয় সমৃদ্ধির বিবেচনার সূচকে নিয়ে আসতে পারি।

উত্তরবঙ্গের সভ্যতার দিকে তাকালে দেখা যায়, মৌর্য ও গুপ্তা রাজাদের শাসনামলে মহাস্থানগড় হয়ে উঠেছিল ঐতিহ্যের ধারক-বাহক এবং সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে। উত্তরবঙ্গের পুন্ড্রুনগর ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী। আজ হয়তোবা রাজারানীর রাজ্যের স্মৃতি চিহ্ন আছে, আগের সেই জৌলুস নেই কিন্তু পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো দর্শনীয় স্থান, নিজস্ব লোকসংস্কৃতিগত খাবার ও আবেদন ছরিয়ে-ছিটিয়ে আছে আঞ্চলের জেলাগুলোর বিভিন্ন স্থানে, যা পর্যটকদের ভুলিয়ে দেবে ভ্রমণের সব আবসাদ আর ক্লান্তিকে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের খ্যাতি বাংলাদেশব্যাপী। ভ্রমণপিপাসু মানুষগুলো চাইলে আমের মৌসুমে সেখানে আম বাগানে গিয়ে পাকা আমের স্বাদ গ্রহণের পাশাপাশি বিলভাতিয়া, বিলচুড়াইল, বিলহোগলা, ছোট সোনা মসজিদ, দাসবাড়ি মসজিদে ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় ইতিহাসের পাতাকে খুলে দেখবার প্রেরণা পেতে পারেন।

বরেন্দ্রভূমির রাজধানী হিসেবে খ্যাত রাজশাহী বরাবরই ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করে। বরেন্দ্র জাদুঘর, পুটিয়া রাজবাড়ী, সারদা পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ভদ্রাপাক, পদ্মার চরে ভ্রমণের মধ্য দিয়ে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চেতনায় ঋদ্ধ হতে পারবেন পর্যটকের। মনে রাখতে হবে এই অঞ্চলের ভ্রমণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের মধ্য সীমাবদ্ধ নয়, আন্তর্জাতিক পরিসরে বিস্তৃত করা প্রয়োজন। রাজশাহীতে যে ধরনের নাগরিক সুবিধা বেড়েছে, এটাকে কেন্দ্র করে বিদেশি পর্যটকদের বিচরণ ক্ষেত্র আমরা অনায়াসে গড়ে তুলতে পারি।

নাটোরের কাচাগোল্লার ঐতিহ্যকে ব্যবহার করে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী, নাটোরের রাজবাড়ী, চৌগ্রাম জমিদার-বাড়িকে পর্যটকদের জন্য সুবিধায় পরিপূর্ণ করতে পারলে উত্তরবঙ্গের সমৃদ্ধির জন্য সহায়ক হবে।

নওগাঁয় কুসুম্বা মসজিদ, পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার, পালরাজাদের স্মৃতিচিহ্ন, বলিহার রাজবাড়ী, জবাই বিল, জগদ্দল বিহার, পত্নীতলা দিব্যক জয়স্তম্ভ এখনো জেগে আছে ইতিহাসের স্মারকচিহৃ রূপে। সেই সঙ্গে পতিসরে রবীন্দ্র-কুঠিবাড়ি... পর্যটনের জন্য উৎকৃষ্ট স্থান। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের।

যমুনা সেতু সিরাজগঞ্জ জেলাকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন মাত্রায়। বেলকুচির তাতিদের তাত পল্লী ও তাদের তাঁতশিল্প, শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি, দরগাহ মসজিদ, শিব মন্দির ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করবেই, সেদিকে লক্ষ্য রেখে পর্যটনের সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন।

জয়পুরহাট বহু দিন গৌড়ের পাল ও সেন রাজাদের রাজ্যভুক্ত ছিল। রাঙ্গাদিঘী, নান্দাইল দিঘি, লাকমা রাজবাড়ী, পাথরঘাটা দর্শনীয় স্থানগুলোতে দর্শনার্থীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, এই বিষয় উত্তরবঙ্গের পর্যটন প্রসারে গুরুত্ব বহন করছে।

হাওর-বাঁওড় ও বিল দিয়ে সাজানো পাবনা জেলা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল চলন বিলের একটা অংশ এই জেলাকে ঘিরে। বর্ষার সময় ভরা বিলে নৌকা নিয়ে মাছ ধরা ও টাটকা মাছ দিয়ে খাবার খাওয়া এক নতুন অনুভূতির জোগান দেবে। এ ছাড়া পাকসি, ঈশ্বরদীর চিনির কারখানা দেখার সুযোগ থাকবেই।

উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র নামে পরিচিত বগুড়াকে ওই এলাকার রাজধানী বলেই সবার কাছে জানা। উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত। মহাস্থানগড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বহু রাজাদের রাজ্য ... এখনো সেই রাজাদের রাজ্যের স্মৃতিচিহৃ রয়ে গেছে, তা অনায়াসেই পর্যটনের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এ ছাড়া মাজার শরিফ, কাঁটাবিহীন বড়াইয়ের গাছ, পশুরামের প্রাসাদ ও প্রাচীর, গোবিন্দভিটা, মহাস্থানগড় জাদুঘর, বেহুলার বাসরঘর, শিলা দেবীর ঘাট, ভাসুবিহার, বাংলাদেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্রে সজ্জিত হয়ে আছে বগুড়া... শুধু প্রয়োজন পর্যটকদের সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলা।

কথিত আছে রাজা গোবিন্দের ষাট হাজার গরুর গো-চরণভূমির নামে গাইবান্ধা জেলার নামকরণ হয়েছে। গাইবান্ধা জেলায় পর্যটকদের মনকাড়ার মতো অনেক জায়গা আছে তার মধ্যে গোবিন্দগঞ্জের কুটিবাড়ী, পলাশবাড়ী এডুকেশন পার্ক, ড্রিমল্যান্ড পার্ক, মাটির নিচে সবুজ ঘর ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার, কাষ্ট কালীর মন্দির, বালাসী ঘাট, যমুনার চরসমূহ।

রংপুর জেলার ভিন্ন জগৎ, বেগম রোকেয়ার বাড়ি, নীলদরিয়াবিল, তাজহাট জমিদারবাড়ী, রংপুর চিড়িয়াখানা, চিকলী বিল বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে বেশ পরিচিতি পাচ্ছে। এই অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানের জীবনমুখর ব্যাপ্তি আর লোকসংস্কৃতির বৈচিত্র্যের স্বাদকে পর্যটনশিল্পের উপকরণে পরিণত করা যেতে পারে সহজেই। শুধু প্রয়োজন উদ্যোগ।

দিনাজপুরের লিচুর স্বাদ এক কথায় অতুলনীয়। বাংলাদেশের লিচুর রাজধানী দিনাজপুরের কান্তজির মন্দির, রামসাগর দিঘির সৌন্দর্য ভ্রমণপিপাসুদের বিমোহিত করছে। এ ছাড়া এই জনপদের ভূপ্রকৃতি ও লোকসংস্কৃতির চলমান ধারা পর্যটনশিল্পে নান্দনিক সংযোজন ঘটাতে পারে; যাতে করে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করবে।

ঠাকুরগাঁও জেলার কিছু স্থান পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়তে শুরু করেছে। এখানকার গ্রামগুলো ছবিতে আঁকা চিত্রের মতো। কুমিল্লা হাড়িপিকনিক কর্তার, খুনিয়া দিঘিতে লোক সমাগম দিন দিন বেড়েই চলেছে।

নীলফামারী জেলাকে নীলের দেশ বলা হয়। একসময় ব্রিটিশরা এখানকার চাষিদের বাধ্য করত নীল চাষ করতে। এই জেলার প্রতিটি স্থান এক একটি ইতিহাসের সাক্ষী। ইতিহাস জানার পাশাপাশি ভ্রমণকারীরা দেখতে পারবেন নীলসাগর, ময়নামতি দুর্গ, সিন্ধুরমতি দীঘি, মীরজুমলার মসজিদ।

মহা রাজা বিশ্বসিংহের কুড়িটি পরিবারের দেশ থেকেই কুড়িগ্রাম জেলা। বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোই এখানকার প্রধান আকর্ষণ। এ ছাড়া শাহী মসজিদ, বীর প্রতীক প্রাপ্ত তারামন বিবিরবাড়ী, নাওডাঙ্গা জমিদারবাড়ী, চিলমারী বন্দর পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ছিটমহল ছিল লালমনিরহাট জেলায় যা আজ বিলুপ্ত। ছিটমহলগুলোর বৈশিষ্ট্য আলাদা দেখে মনে হবে বাংলাদেশের মধ্যে আরেকটি ছোট্ট বাংলাদেশ। এই বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো ঘুরে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা যোগ করতে পারবেন পর্যটকের।

পাঁচটি গড়ের সমন্বয়ে গঠিত পঞ্চগড় জেলা। যেমনি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর তেমনি অসাধারণ অতিথিপরায়ণ মানুষের বসতি, চা-বাগান ও পাথরে সমৃদ্ধ এই জেলাকে। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয়ের অধিকারী এই জেলার মানুষেরা। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংযোগ এখানকার অর্থনীতিকে করেছে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। হিমালয়ের কন্যা পঞ্চগড় যেন হিমালয়ের কৃপার দান। বাংলাবান্ধা পর্যটকদের কাছে হয়ে উঠছে অন্য রকম আবেদনের জায়গা।

উত্তরবঙ্গের পর্যটনের উন্নয়ন ও পরিকল্পনা সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রয়োজন শুধু প্রচার-প্রসার ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি দেশের গণমাধ্যমগুলো যদি উত্তরবঙ্গ পর্যটন স্থাপনা ও স্থানগুলোকে প্রচার-প্রসারে কাজ করে তাহলে উত্তরবঙ্গ পর্যটনের নতুন একটি দিগন্তের উন্মোচন হবে। বেড়ে যাবে অথনৈতিক সমৃদ্ধি। কমিউনিটি ভিত্তিক ট্যুরিজমের মাধ্যমে কমানো সম্ভব হবে স্থানীয়দের বেকার সমস্যা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের পর্যটন সহায়ক মনোভাব বদলে দিতে পারে উত্তরবঙ্গ পর্যটনের সম্ভাবনাকে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার দিকেই আমরা ক্রমশ ধাবমান দেশ। এই গতির সঙ্গে উত্তরবঙ্গের পর্যটনশিল্পের সংযোগ ঘটালে নিঃসন্দেহে বেড়ে যাবে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃত্তি ও জাতীয় সমৃদ্ধি।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]