চড়া দামে কাগজ কিনছেন নোট-গাইড ব্যবসায়ীরা

সংকটে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ

নিষিদ্ধ নোট-গাইড ও সহায়ক বইয়ের প্রকাশকদের দাপটে সংকটে পড়েছে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপা কাজ। সরকার ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপা শেষ করতে চায়। কিন্তু বাজারে কাগজের চলমান সংকটকে প্রকট করছে নোট-গাইড ও সহায়ক বইয়ের প্রকাশকরা। তারা চড়া দামে খোলাবাজার থেকে সব কাগজ কিনে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাঠ্যবই ছাপার কাজ পাওয়া ছাপাখানা মালিকদের।

এই পরিস্থিতি ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে নোট-গাইড ও সহায়ক ছাপার কাজ বন্ধ রাখতে ‘পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’র সভাপতিকে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং নজরদারি বাড়াতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে।

গতকাল ‘পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’র সভাপতি বরাবর দেয়া চিঠিতে এনসিটিবি সচিব নাজমা আখতার বলেন, ‘আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত অন্য সব পুস্তক ছাপা স্থগিত রেখে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়ার সরকারি অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সহযোগিতা করার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি।’

এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে দেশে এমনিতেই কাগজের সংকট। এই অবস্থায় প্রিন্টার্সরা (ছাপাখানা মালিকরা) আমাদের জানিয়েছে, যারা নোট-গাইড বা সহায়ক বইয়ের ব্যবসা করে তারা বেশি দামে বাজার থেকে সব কাগজ কিনে নিচ্ছেন। এতে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এজন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক ছাপা সব ধরনের বই ছাপা বন্ধ রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’

জানতে চাইলে ‘পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’র সহ-সভাপতি শ্যামল পাল গতকাল সন্ধ্যায় সংবাদকে বলেন, ‘আমরা চিঠি এখনও পাইনি। চিঠি পেলে অবশ্যই সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো, সরকারি কাজে পূর্ণ সহযোগিতা করবো। তবে এই চিঠি দেয়ার আগে এনসিটিবির উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে বসা, আলোচনা করা। এতে আমরা আরও বেশি সহযোগিতা করতে পারতাম।’

এখন তাদের বইয়ের ব্যবসা ভালো চলছে না দাবি করে শ্যামল পাল বলেন, ‘আমরা এমনিতেই নিউজপ্রিন্টের কাগজে বই ছাপি। পাঠ্যবই এই কাগজে ছাপায় না। এরপরও ভালোমানের কাগজের সংকটের জন্য আমাদের দায়ী করা হবে কেন?’

বিশ^ব্যাপী মূল্যস্ফীতি, দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস সংকট এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অভাবে এমনিতেই কাগজ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নিয়মিত বাড়ছে কাগজ ও অন্যান্য পণ্যের দাম। শুধু কাগজ চড়া দামে কাগজ কেনা নয়; সরকারকে সংকটে ফেলতে ‘মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহে কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের’ও বেশি পারিশ্রমিক দিয়ে ভাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে নিষিদ্ধ বইয়ের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়টিও এনসিটিবির চিঠিতে উঠে এসেছে।

‘শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত অন্য কোন সহায়ক পুস্তক জানুয়ারি-২০২৩ এর পূর্বে না ছাপানো’ শীর্ষক এনসিটিবির চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন এবং শিক্ষার স্বার্থে এনসিটিবি প্রকাশিত প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম-দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে মুদ্রণ, বাঁধাই এবং সরবরাহ করতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ নির্বিঘেœ করার জন্য মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন।’

এ বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান সংবাদকে বলেন, নোট-গাইড যদি ‘অবৈধ হয়ে থাকে’ তাহলে তা বন্ধ রাখার জন্য তাদের বলার কী দরকার, পুলিশ দিয়েই তা বন্ধ করা যায়।

নোট-গাইড ও সহায়ক বইয়ের কারণে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ব্যাহত হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বারতোফা ও অনুপমসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসা করে। তাদের পাঠ্যবই ছাপার কাজও দেয়া হয়েছে। তারা মূলত ব্যবসা করে; তারা পাঠ্যপুস্তকের আগেই নোট-গাইড বাজারে আনার চেষ্টা করবে-এটাই স্বাভাবিক। এরজন্য দায়ী কে?’

এ বিষয়ে এনসিটিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, যারা নিষিদ্ধ বইয়ের ব্যবসায় জড়িত তাদের আগামী বছর পাঠ্যপুস্তক ছাপার দরপত্রে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে না। দরপত্রে কঠোর শর্ত জুড়ে দেয়া হবে।

নোট-গাইড প্রকাশকদের কাজে কাগজ না বিক্রির অনুরোধ

মানসম্মত কাগজ উৎপাদন এবং আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত নোট-গাইড ও সহায়ক বইয়ের ব্যবসায়ীদের কাছে কাগজ বিক্রি না করতে দেশে কাগজ উৎপাদনকারী মিল মালিকদের কাছে অনুরোধ করেছে এনসিটিবির কর্মকর্তারা। তারা সরকারের পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ পাওয়া ছাপাখানাগুলোর মালিকদের কাছে চুক্তি অনুযায়ী মানসম্মত কাগজ সরবরাহের অনুরোধ করেছেন।

কাগজ মিল মালিকদের গতকাল রাজধানীর মতিঝিল এনসিটিবি ভবনে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক লুৎফর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘কিছু ছাপাখানায় নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পূর্বের চুক্তিপত্র অনুযায়ী, মানসম্মত কাগজ সরবরাহ করতে মিল মালিকদের অনুরোধ করা হয়েছে।’

এছাড়া নোট-গাইড বা সহায়ক বইয়ের প্রকাশকদের কাছে এখন কাগজ বিক্রি না করতে অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানান এনসিটিবি সদস্য।

নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার অভিযোগ

দরপত্রের চুক্তি অনুযায়ী, পাঠ্যপুস্তক ছাপা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে এনসিটিবি কর্মকর্তারা। তারা ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাগজ ছাপার অযোগ্য বা বাতিল ঘোষণা করেছেন।

এনসিটিবি নিয়োজিত ‘ইন্সপেকশন এজেন্ট ‘ইনডিপেডেন্ট ইন্সপেকশন সার্ভিস বিডি’র প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ২৩ অক্টোবর ‘নূরুল ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস’র কাগজ বাতিল ঘোষণা করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)।

এছাড়া ভাই ভাই নামের একটি ছাপাখানায় নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা।

এদিকে যথাসময়ে বই ছাপার কাজ শুরু না করায় কয়েকটি ছাপাখানাকে সতর্ক করে চিঠি দিতে যাচ্ছে এনসিটিবি। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘মক্কা আল মুকাররম, আনোয়ার প্রিন্টার অ্যান্ড পাবলিকেশন, রাব্বিল প্রিন্টং প্রেস অন্যতম।

এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেশ কয়েকটি ছাপাখানার বিপুল সংখ্যক বই ‘বিনষ্ট’ করা হয়েছে। আবার কয়েকটি ছাপাখানার বাতিল করা কাগজে পুনরায় বই ছাপার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, দরপত্র আহ্বানের তারিখের প্রাক্কলিত দর নির্ধারণের সময় যে মূল্যে মুদ্রণ কাগজ পাওয়া যেতো পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে সে মূল্যে কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। ভার্জিন পাল্প আমদানি না হওয়ায় এবং বেশিরভাগ কাগজ মিল সেকেন্ডারি পাল্প (ব্যবহৃত কাগজ) ব্যবহার করে মুদ্রণ কাগজ উৎপাদন করায় দরপত্রে চাহিত ন্যূনতম ৮৫ শতাংশ ব্রাইটনেস (উজ্জ্বলতা) এর মুদ্রণ কাগজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছে।

২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক ছাপতে গত জুনে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রের শর্তে উন্নতমানের অর্থাৎ ‘ভার্জিন পাল্পযুক্ত’ কাগজেই বই ছাপার কথা বলা রয়েছে। প্রাথমিক স্তরের বই ৮০ শতাংশ জিএসএমের (গ্রাম/স্কয়ার মিটার) কাগজে ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা বা ভার্জিন পাল্প থাকতে হয়। এই পাল্প ছাড়া কাগজে উজ্জ্বলতা ঠিকমত আসে না বলে এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কিন্তু এবার কয়েকটি ছাপাখানায় মাত্র ৭০ শতাংশের কম জিএসএম কাগজে বই ছাপার প্রমাণ পেয়েছে এনসিটিবি।

এ বিষয়ে তোফায়েল খান বলেন, ‘দেশে এই মুহূর্তে মাত্র দুটি মিলে ৮০ জিএসএমের কাগজ উৎপাদন হয়। বাকি সব মিলই নিউজপ্রিন্টের মতো ৭০ জিএসএমের কাগজ উৎপাদন করছে। কিন্তু বেশি টাকা দিয়ে এখন বাজারে ৭০ জিএসএমের কাগজও পাওয়া যাচ্ছে না।’

বুধবার, ১৬ নভেম্বর ২০২২ , ০১ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২০ রবিউস সানি ১৪৪৪

চড়া দামে কাগজ কিনছেন নোট-গাইড ব্যবসায়ীরা

সংকটে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ

রাকিব উদ্দিন

image

নিষিদ্ধ নোট-গাইড ও সহায়ক বইয়ের প্রকাশকদের দাপটে সংকটে পড়েছে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপা কাজ। সরকার ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের প্রায় ৩৫ কোটি পাঠ্যবই ছাপা শেষ করতে চায়। কিন্তু বাজারে কাগজের চলমান সংকটকে প্রকট করছে নোট-গাইড ও সহায়ক বইয়ের প্রকাশকরা। তারা চড়া দামে খোলাবাজার থেকে সব কাগজ কিনে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাঠ্যবই ছাপার কাজ পাওয়া ছাপাখানা মালিকদের।

এই পরিস্থিতি ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে নোট-গাইড ও সহায়ক ছাপার কাজ বন্ধ রাখতে ‘পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’র সভাপতিকে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং নজরদারি বাড়াতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে।

গতকাল ‘পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’র সভাপতি বরাবর দেয়া চিঠিতে এনসিটিবি সচিব নাজমা আখতার বলেন, ‘আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত অন্য সব পুস্তক ছাপা স্থগিত রেখে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে ১ জানুয়ারি পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়ার সরকারি অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সহযোগিতা করার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি।’

এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম সংবাদকে বলেন, ‘বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে দেশে এমনিতেই কাগজের সংকট। এই অবস্থায় প্রিন্টার্সরা (ছাপাখানা মালিকরা) আমাদের জানিয়েছে, যারা নোট-গাইড বা সহায়ক বইয়ের ব্যবসা করে তারা বেশি দামে বাজার থেকে সব কাগজ কিনে নিচ্ছেন। এতে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এজন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক ছাপা সব ধরনের বই ছাপা বন্ধ রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।’

জানতে চাইলে ‘পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’র সহ-সভাপতি শ্যামল পাল গতকাল সন্ধ্যায় সংবাদকে বলেন, ‘আমরা চিঠি এখনও পাইনি। চিঠি পেলে অবশ্যই সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো, সরকারি কাজে পূর্ণ সহযোগিতা করবো। তবে এই চিঠি দেয়ার আগে এনসিটিবির উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে বসা, আলোচনা করা। এতে আমরা আরও বেশি সহযোগিতা করতে পারতাম।’

এখন তাদের বইয়ের ব্যবসা ভালো চলছে না দাবি করে শ্যামল পাল বলেন, ‘আমরা এমনিতেই নিউজপ্রিন্টের কাগজে বই ছাপি। পাঠ্যবই এই কাগজে ছাপায় না। এরপরও ভালোমানের কাগজের সংকটের জন্য আমাদের দায়ী করা হবে কেন?’

বিশ^ব্যাপী মূল্যস্ফীতি, দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাস সংকট এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের অভাবে এমনিতেই কাগজ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। নিয়মিত বাড়ছে কাগজ ও অন্যান্য পণ্যের দাম। শুধু কাগজ চড়া দামে কাগজ কেনা নয়; সরকারকে সংকটে ফেলতে ‘মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহে কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের’ও বেশি পারিশ্রমিক দিয়ে ভাগিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে নিষিদ্ধ বইয়ের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়টিও এনসিটিবির চিঠিতে উঠে এসেছে।

‘শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ব্যতীত অন্য কোন সহায়ক পুস্তক জানুয়ারি-২০২৩ এর পূর্বে না ছাপানো’ শীর্ষক এনসিটিবির চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন এবং শিক্ষার স্বার্থে এনসিটিবি প্রকাশিত প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম-দশম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে মুদ্রণ, বাঁধাই এবং সরবরাহ করতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ নির্বিঘেœ করার জন্য মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন।’

এ বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান সংবাদকে বলেন, নোট-গাইড যদি ‘অবৈধ হয়ে থাকে’ তাহলে তা বন্ধ রাখার জন্য তাদের বলার কী দরকার, পুলিশ দিয়েই তা বন্ধ করা যায়।

নোট-গাইড ও সহায়ক বইয়ের কারণে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ব্যাহত হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বারতোফা ও অনুপমসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নোট-গাইড বইয়ের ব্যবসা করে। তাদের পাঠ্যবই ছাপার কাজও দেয়া হয়েছে। তারা মূলত ব্যবসা করে; তারা পাঠ্যপুস্তকের আগেই নোট-গাইড বাজারে আনার চেষ্টা করবে-এটাই স্বাভাবিক। এরজন্য দায়ী কে?’

এ বিষয়ে এনসিটিবির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, যারা নিষিদ্ধ বইয়ের ব্যবসায় জড়িত তাদের আগামী বছর পাঠ্যপুস্তক ছাপার দরপত্রে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হবে না। দরপত্রে কঠোর শর্ত জুড়ে দেয়া হবে।

নোট-গাইড প্রকাশকদের কাজে কাগজ না বিক্রির অনুরোধ

মানসম্মত কাগজ উৎপাদন এবং আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত নোট-গাইড ও সহায়ক বইয়ের ব্যবসায়ীদের কাছে কাগজ বিক্রি না করতে দেশে কাগজ উৎপাদনকারী মিল মালিকদের কাছে অনুরোধ করেছে এনসিটিবির কর্মকর্তারা। তারা সরকারের পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ পাওয়া ছাপাখানাগুলোর মালিকদের কাছে চুক্তি অনুযায়ী মানসম্মত কাগজ সরবরাহের অনুরোধ করেছেন।

কাগজ মিল মালিকদের গতকাল রাজধানীর মতিঝিল এনসিটিবি ভবনে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক লুৎফর রহমান সংবাদকে বলেন, ‘কিছু ছাপাখানায় নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পূর্বের চুক্তিপত্র অনুযায়ী, মানসম্মত কাগজ সরবরাহ করতে মিল মালিকদের অনুরোধ করা হয়েছে।’

এছাড়া নোট-গাইড বা সহায়ক বইয়ের প্রকাশকদের কাছে এখন কাগজ বিক্রি না করতে অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানান এনসিটিবি সদস্য।

নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার অভিযোগ

দরপত্রের চুক্তি অনুযায়ী, পাঠ্যপুস্তক ছাপা নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে এনসিটিবি কর্মকর্তারা। তারা ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাগজ ছাপার অযোগ্য বা বাতিল ঘোষণা করেছেন।

এনসিটিবি নিয়োজিত ‘ইন্সপেকশন এজেন্ট ‘ইনডিপেডেন্ট ইন্সপেকশন সার্ভিস বিডি’র প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত ২৩ অক্টোবর ‘নূরুল ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস’র কাগজ বাতিল ঘোষণা করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)।

এছাড়া ভাই ভাই নামের একটি ছাপাখানায় নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা।

এদিকে যথাসময়ে বই ছাপার কাজ শুরু না করায় কয়েকটি ছাপাখানাকে সতর্ক করে চিঠি দিতে যাচ্ছে এনসিটিবি। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ‘মক্কা আল মুকাররম, আনোয়ার প্রিন্টার অ্যান্ড পাবলিকেশন, রাব্বিল প্রিন্টং প্রেস অন্যতম।

এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেশ কয়েকটি ছাপাখানার বিপুল সংখ্যক বই ‘বিনষ্ট’ করা হয়েছে। আবার কয়েকটি ছাপাখানার বাতিল করা কাগজে পুনরায় বই ছাপার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, দরপত্র আহ্বানের তারিখের প্রাক্কলিত দর নির্ধারণের সময় যে মূল্যে মুদ্রণ কাগজ পাওয়া যেতো পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে সে মূল্যে কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। ভার্জিন পাল্প আমদানি না হওয়ায় এবং বেশিরভাগ কাগজ মিল সেকেন্ডারি পাল্প (ব্যবহৃত কাগজ) ব্যবহার করে মুদ্রণ কাগজ উৎপাদন করায় দরপত্রে চাহিত ন্যূনতম ৮৫ শতাংশ ব্রাইটনেস (উজ্জ্বলতা) এর মুদ্রণ কাগজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছে।

২০২৩ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক ছাপতে গত জুনে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্রের শর্তে উন্নতমানের অর্থাৎ ‘ভার্জিন পাল্পযুক্ত’ কাগজেই বই ছাপার কথা বলা রয়েছে। প্রাথমিক স্তরের বই ৮০ শতাংশ জিএসএমের (গ্রাম/স্কয়ার মিটার) কাগজে ৮৫ শতাংশ উজ্জ্বলতা বা ভার্জিন পাল্প থাকতে হয়। এই পাল্প ছাড়া কাগজে উজ্জ্বলতা ঠিকমত আসে না বলে এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কিন্তু এবার কয়েকটি ছাপাখানায় মাত্র ৭০ শতাংশের কম জিএসএম কাগজে বই ছাপার প্রমাণ পেয়েছে এনসিটিবি।

এ বিষয়ে তোফায়েল খান বলেন, ‘দেশে এই মুহূর্তে মাত্র দুটি মিলে ৮০ জিএসএমের কাগজ উৎপাদন হয়। বাকি সব মিলই নিউজপ্রিন্টের মতো ৭০ জিএসএমের কাগজ উৎপাদন করছে। কিন্তু বেশি টাকা দিয়ে এখন বাজারে ৭০ জিএসএমের কাগজও পাওয়া যাচ্ছে না।’