মাউশি : চারগুণ কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও ৪ বছরে নতুন প্রকল্প নেই

চলমান প্রকল্পগুলো ডুবছে অনিয়ম-দুর্নীতিতে

অনিয়মে ডুবতে বসেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) উন্নয়ন প্রকল্পগুলো। সংস্থার ১০ প্রকল্পের প্রায় সবকটিই মন্তর গতিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে। নির্ধারিত মেয়াদে একটি প্রকল্পের বাস্তবায়নও শেষ হয়নি। মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখায় পদের চেয়ে চারগুণ বেশি কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও তারা গত চার বছরে নতুন কোন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারেনি। চলমান প্রকল্পগুলোর স্থবিরতাও দূর হচ্ছে না। মাউশি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ‘অসহযোগিতা’র অভিযোগ করছেন প্রকল্প পরিচালকরা (পিডি)।

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দাপ্তরিক কাজ ফেলে রেখে শীর্ষ কর্মকর্তারা বিভিন্ন সভা-সেমিনা ও কর্মশালায় ব্যস্ত থাকছেন। ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ করছেন। প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও নতুন প্রকল্প গ্রহণেও কারো নজর নেই। বিদেশ ভ্রমণ, সভা-সেমিনারে ‘সম্মানী’ ও ‘আর্থিক সুবিধা’ থাকায় শীর্ষ কর্মকর্তারা সেদিকেই বেশি সময় দিচ্ছেন বলে ওই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত চার বছরে নতুন কোন প্রকল্প নিতে পারেনি মাউশি। ২০১৪ সালের জুনে চলমান সব প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়ে যাবে। ওই সময় মাউশির অধীনে নতুন কোন প্রকল্প থাকবে না।

১০টি প্রকল্পের মধ্যে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তিনটি, ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে পাঁচটি এবং ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে একটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্পন্ন হবে। চলমান কোন প্রকল্পের অগ্রগতিই ‘সন্তোষজনক’ নয় বলে ওই প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। অন্য একটি টিএ (টেকনিক্যাল অ্যাসিসটেন্স) প্রকল্পের বাস্তবায়নও আগামী মাসে (ডিসেম্বর) শেষ হচ্ছে।

মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের মূল কাজ হলো প্রকল্পের বাস্তবায়ন তদারকি ও নতুন প্রকল্প গ্রহণ। একজন পরিচালকের (অধ্যাপক) ও একজন যুগ্ম-পরিচালকের নেতৃত্বে এই শাখায় স্থায়ী কর্মকর্তার পদ ছয়টির মতো। বর্তমানে এই শাখায় অন্তত ২৬ জন কর্মকর্তা পদায়ন আছেন। পদের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি কর্মকর্তা থাকার পরও প্রকল্পের দৈন্যদশা নিয়ে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন পিডিরা।

জানতে চাইলে মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের পরিচালক অধ্যাপক ড. একেএম শফিউল আজম সংবাদকে বলেন, ‘সরকার যখন ২০১৭ সালে এসইডিপি (সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম) গ্রহণ করে, তখন বলা হয়েছিল নতুন কোন প্রকল্প নেয়া যাবে না। আগামী বছর এসইডিপি শেষ হবে, তখন নতুন প্রকল্প নেয়া যাবে। বেশ কয়েকটি প্রকল্প এখন পাইপলাইনে আছে।’

চলমান ১০ প্রকল্পেই স্থবিরতা

‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের (৩৩২টি) উন্নয়ন প্রকল্প’র বাস্তবায়ন ২০১৭ সালের জুনে শুরু হয়। এই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়া কথা রয়েছে। তিন হাজার ২৮৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পের গত জুন পর্যন্ত প্রায় ৫০১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ হিসাবে আর্থিক ও ভৌত অগ্রগতি দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ।

৩৩২ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক নাসির উদ্দিন সংবাদকে জানান, প্রকল্প দলিলের কিছু বিষয় সংশোধন হচ্ছে। এগুলো দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়, এজন্য কিছু কাজে সময় লাগছে। তবে বাকি কাজগুলো চলমান রয়েছে।

‘৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের’ বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। আগামী বছরের জুনে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ৪৬৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন নাগাদ প্রায় ১৬২ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ হিসাবে আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশের মতো।

‘৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের’ পিডি অধ্যাপক রায়হানা তসলিম সংবাদকে বলেন, তার প্রকল্পভুক্ত তিনটি স্কুলের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। অন্য স্কুলের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। তিনি আশা করছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলেও কাছাকাছি পৌঁছে যাবে।

‘তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজসমূহের (১৫শ’টি) উন্নয়ন প্রকল্প’র বাস্তবায়ন ২০১২ সালে শুরু হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত আর্থিক ও ভৌত অগ্রগতি প্রায় ৮৭ শতাংশ।

১৫শ’ কলেজ প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক ড. আশফাকুস সালেহীন সংবাদকে জানান, তার প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তবে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য কলেজের স্থান ঠিক না হওয়া ও পরিবর্তন হওয়ায় কয়েকটি কাজ আটকে ছিল। সেগুলোতে খুব দ্রুত নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে।

পাঁচ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত চার হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী, আগামী ডিসেম্বরেই বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

২০১০ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয় ‘শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা সদরে অবস্থিত সরকারি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজসমূহের (৭০টি) উন্নয়ন প্রকল্পটি’। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পটির ১২ বছরেরও বেশি সময়ে বাস্তবায়ন অগ্রগতি দাঁড়ালো ৯০ শতাংশে।

প্রায় ১৭শ’ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ১২শ’ কোটি টাকা। একাধিকবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ সংশোধন অনুযায়ী ২০২৩ সালের জুনে বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা।

২০১৪ সালের জানুয়ারি ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ)’ এর বাস্তবায়ন শুরু হয়। প্রায় তিন হাজার ৮২৭ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত তিন হাজার ৩৮০ টাকার মতো ব্যয় দেখানো হয়েছে, যা মোট অর্থের প্রায় ৯৬ শতাংশ। কয়েক দফা মেয়াদ বৃদ্ধির পর সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরে বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

‘ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিজ’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়। ‘দুর্নীতি ও অনিয়মের’ দায়ে একাধিকবার এই প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ও অন্যান্য কর্মকর্তা বদল করা হলেও বাস্তবায়ন খুব একটা গতি পাচ্ছে না।

পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের মেয়াদও একাধিকবার বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রায় ৪২২ কোটি টাকার এই প্রকল্পের অধীনে গত জুন পর্যন্ত মাত্র ৭৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ হিসাবে প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি মাত্র ১৮ শতাংশ।

‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০১৬ সালে শুরু হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় সারাদেশের মোট ৩১ হাজার ৩৪০টি হাইস্কুলে একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করার কথা ছিল।

দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বারবার হোঁচট খেয়েছে প্রকল্পের বাস্তবায়ন। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে অন্তত তিনবার পিডি বদলের পাশাপাশি নিচের স্তরের কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। অথচ কারো শাস্তি হয়নি। তবে অনিয়মের তদন্ত করায় একজন অধ্যাপককে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছিল।

এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার আইসিটি প্রকল্পের গত জুন পর্যন্ত প্রায় ১১৬ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ হিসাবে প্রকল্পের মোট অগ্রগতি মাত্র ২১ শতাংশ। এই টাকার বেশিরভাগই কর্মীদের বেতনভাতা ও প্রশিক্ষণের নামে ব্যয় দেখানো হয়েছে।

‘ঢাকা শহরে নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পে’র বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে। এই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা। অথচ প্রায় ৬৭৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৮২ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩৬ শতাংশ।

‘সরকারি কলেজসমূহের (৩২৩টি) বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ প্রকল্প’র বাস্তবায়ন ২০১৮ সালের জুলাই শুরু হয়। ২০২৪ সালের জুনে এর বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়ার কথা। দুই হাজার ৫১১ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত ৫৪৫ কোটি টাকার বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ হিসাবে আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়ায় ২২ শতাংশ। অনিয়মের দায়ে এই প্রকল্পেও একবার পিডি বদল করা হয়েছে।

‘জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্প, পার্যায়-২’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০১৯ সালের জুলাই শুরু হয়েছে। প্রায় দশ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন নাগাদ প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এই প্রকল্পটি আগামী মাসেই শেষ হওয়া কথা রয়েছে।

আইসিটি প্রকল্পের মালামাল ফেরত দেয়ার নির্দেশ

আইসিটি প্রকল্পের সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরকারি মালামাল ‘অবৈধভাবে’ নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই প্রকল্পের ‘সরঞ্জামাদি ও আসবাবপত্র’ ফেরত চেয়ে সাবেক পিডি অধ্যাপক আবদুস সবুর খান, উপপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ জাকির হোসেন ও মোহাম্মদ আবুল হোসেন এবং সহকারী পরিচালক নওসের আলী, আবদুস ছামাদ, মীর মো. জাকির হোসেন ও মিজানুর রহমানকে চিঠি দেন বর্তমান পিডি অধ্যাপক ড. মোরশীদুল হাসান।

ওইসব কর্মকর্তাকে গত ২৪ অক্টোবর দেয়া মোরশীদুল হাসানের চিঠিতে দেখা গেছে, বদলি হওয়ার পর প্রকল্পের সাবেক কর্মকর্তারা সরকারি অর্থে কেনা বিপুল সংখ্যক শিক্ষা উপকরণ নিয়ে গেছেন। এগুলোর মধ্যে কম্পিউটার ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, মডেম, সিম, ইউপিএস, ফাইল কেবিনেট, চেয়ার, টেলিফোন, ইন্টারকম, প্রিন্টার মেশিন, দেয়াল ঘড়ি, ওয়্যালফ্যান, বড় টেবিল, গেস্ট চেয়ার, কম্পিউটার টেবিল, এসি, সিলিং ফ্যান, আলমিরা অন্যতম।

একটি চিঠিতে মোরশীদুল হাসান বলেন, ‘দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের জন্য আপনার নামে ইস্যুকৃত অফিস সরঞ্জামাদি ও উদ্বৃত্ত ব্যবহার্য দ্রব্যাদি বদলিকালে আপনি অফিসে জমা দেন নাই। এমতাবস্থায় প্রকল্প কার্যালয়ে আপনার দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের জন্য আপনার নামে ইস্যুকৃত অফিস সরঞ্জামাদি ও উদ্বৃত্ত ব্যবহার্য দ্রব্যাদি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য আপনাকে অনুরোধ করা হলো।’

বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২২ , ০২ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২১ রবিউস সানি ১৪৪৪

মাউশি : চারগুণ কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও ৪ বছরে নতুন প্রকল্প নেই

চলমান প্রকল্পগুলো ডুবছে অনিয়ম-দুর্নীতিতে

রাকিব উদ্দিন

অনিয়মে ডুবতে বসেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) উন্নয়ন প্রকল্পগুলো। সংস্থার ১০ প্রকল্পের প্রায় সবকটিই মন্তর গতিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে। নির্ধারিত মেয়াদে একটি প্রকল্পের বাস্তবায়নও শেষ হয়নি। মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখায় পদের চেয়ে চারগুণ বেশি কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও তারা গত চার বছরে নতুন কোন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারেনি। চলমান প্রকল্পগুলোর স্থবিরতাও দূর হচ্ছে না। মাউশি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ‘অসহযোগিতা’র অভিযোগ করছেন প্রকল্প পরিচালকরা (পিডি)।

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দাপ্তরিক কাজ ফেলে রেখে শীর্ষ কর্মকর্তারা বিভিন্ন সভা-সেমিনা ও কর্মশালায় ব্যস্ত থাকছেন। ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ করছেন। প্রকল্পের বাস্তবায়ন ও নতুন প্রকল্প গ্রহণেও কারো নজর নেই। বিদেশ ভ্রমণ, সভা-সেমিনারে ‘সম্মানী’ ও ‘আর্থিক সুবিধা’ থাকায় শীর্ষ কর্মকর্তারা সেদিকেই বেশি সময় দিচ্ছেন বলে ওই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত চার বছরে নতুন কোন প্রকল্প নিতে পারেনি মাউশি। ২০১৪ সালের জুনে চলমান সব প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়ে যাবে। ওই সময় মাউশির অধীনে নতুন কোন প্রকল্প থাকবে না।

১০টি প্রকল্পের মধ্যে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তিনটি, ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে পাঁচটি এবং ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে একটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্পন্ন হবে। চলমান কোন প্রকল্পের অগ্রগতিই ‘সন্তোষজনক’ নয় বলে ওই প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। অন্য একটি টিএ (টেকনিক্যাল অ্যাসিসটেন্স) প্রকল্পের বাস্তবায়নও আগামী মাসে (ডিসেম্বর) শেষ হচ্ছে।

মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের মূল কাজ হলো প্রকল্পের বাস্তবায়ন তদারকি ও নতুন প্রকল্প গ্রহণ। একজন পরিচালকের (অধ্যাপক) ও একজন যুগ্ম-পরিচালকের নেতৃত্বে এই শাখায় স্থায়ী কর্মকর্তার পদ ছয়টির মতো। বর্তমানে এই শাখায় অন্তত ২৬ জন কর্মকর্তা পদায়ন আছেন। পদের চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি কর্মকর্তা থাকার পরও প্রকল্পের দৈন্যদশা নিয়ে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন পিডিরা।

জানতে চাইলে মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের পরিচালক অধ্যাপক ড. একেএম শফিউল আজম সংবাদকে বলেন, ‘সরকার যখন ২০১৭ সালে এসইডিপি (সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম) গ্রহণ করে, তখন বলা হয়েছিল নতুন কোন প্রকল্প নেয়া যাবে না। আগামী বছর এসইডিপি শেষ হবে, তখন নতুন প্রকল্প নেয়া যাবে। বেশ কয়েকটি প্রকল্প এখন পাইপলাইনে আছে।’

চলমান ১০ প্রকল্পেই স্থবিরতা

‘সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের (৩৩২টি) উন্নয়ন প্রকল্প’র বাস্তবায়ন ২০১৭ সালের জুনে শুরু হয়। এই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়া কথা রয়েছে। তিন হাজার ২৮৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পের গত জুন পর্যন্ত প্রায় ৫০১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ হিসাবে আর্থিক ও ভৌত অগ্রগতি দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ।

৩৩২ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক নাসির উদ্দিন সংবাদকে জানান, প্রকল্প দলিলের কিছু বিষয় সংশোধন হচ্ছে। এগুলো দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়, এজন্য কিছু কাজে সময় লাগছে। তবে বাকি কাজগুলো চলমান রয়েছে।

‘৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের’ বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। আগামী বছরের জুনে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ৪৬৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন নাগাদ প্রায় ১৬২ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ হিসাবে আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশের মতো।

‘৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের’ পিডি অধ্যাপক রায়হানা তসলিম সংবাদকে বলেন, তার প্রকল্পভুক্ত তিনটি স্কুলের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। অন্য স্কুলের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। তিনি আশা করছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলেও কাছাকাছি পৌঁছে যাবে।

‘তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নির্বাচিত বেসরকারি কলেজসমূহের (১৫শ’টি) উন্নয়ন প্রকল্প’র বাস্তবায়ন ২০১২ সালে শুরু হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত আর্থিক ও ভৌত অগ্রগতি প্রায় ৮৭ শতাংশ।

১৫শ’ কলেজ প্রকল্পের পিডি অধ্যাপক ড. আশফাকুস সালেহীন সংবাদকে জানান, তার প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তবে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য কলেজের স্থান ঠিক না হওয়া ও পরিবর্তন হওয়ায় কয়েকটি কাজ আটকে ছিল। সেগুলোতে খুব দ্রুত নির্মাণ কাজ শুরু হচ্ছে।

পাঁচ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত চার হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী, আগামী ডিসেম্বরেই বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

২০১০ সালে বাস্তবায়ন শুরু হয় ‘শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা সদরে অবস্থিত সরকারি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজসমূহের (৭০টি) উন্নয়ন প্রকল্পটি’। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পটির ১২ বছরেরও বেশি সময়ে বাস্তবায়ন অগ্রগতি দাঁড়ালো ৯০ শতাংশে।

প্রায় ১৭শ’ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ১২শ’ কোটি টাকা। একাধিকবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ সংশোধন অনুযায়ী ২০২৩ সালের জুনে বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা।

২০১৪ সালের জানুয়ারি ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ)’ এর বাস্তবায়ন শুরু হয়। প্রায় তিন হাজার ৮২৭ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত তিন হাজার ৩৮০ টাকার মতো ব্যয় দেখানো হয়েছে, যা মোট অর্থের প্রায় ৯৬ শতাংশ। কয়েক দফা মেয়াদ বৃদ্ধির পর সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরে বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

‘ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅ্যাবিলিটিজ’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়। ‘দুর্নীতি ও অনিয়মের’ দায়ে একাধিকবার এই প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ও অন্যান্য কর্মকর্তা বদল করা হলেও বাস্তবায়ন খুব একটা গতি পাচ্ছে না।

পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের মেয়াদও একাধিকবার বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রায় ৪২২ কোটি টাকার এই প্রকল্পের অধীনে গত জুন পর্যন্ত মাত্র ৭৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এ হিসাবে প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি মাত্র ১৮ শতাংশ।

‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০১৬ সালে শুরু হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় সারাদেশের মোট ৩১ হাজার ৩৪০টি হাইস্কুলে একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করার কথা ছিল।

দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বারবার হোঁচট খেয়েছে প্রকল্পের বাস্তবায়ন। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে অন্তত তিনবার পিডি বদলের পাশাপাশি নিচের স্তরের কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। অথচ কারো শাস্তি হয়নি। তবে অনিয়মের তদন্ত করায় একজন অধ্যাপককে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছিল।

এক হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার আইসিটি প্রকল্পের গত জুন পর্যন্ত প্রায় ১১৬ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ হিসাবে প্রকল্পের মোট অগ্রগতি মাত্র ২১ শতাংশ। এই টাকার বেশিরভাগই কর্মীদের বেতনভাতা ও প্রশিক্ষণের নামে ব্যয় দেখানো হয়েছে।

‘ঢাকা শহরে নিকটবর্তী এলাকায় ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পে’র বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে। এই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা। অথচ প্রায় ৬৭৩ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৮২ কোটি টাকা। এ হিসাবে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩৬ শতাংশ।

‘সরকারি কলেজসমূহের (৩২৩টি) বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ প্রকল্প’র বাস্তবায়ন ২০১৮ সালের জুলাই শুরু হয়। ২০২৪ সালের জুনে এর বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়ার কথা। দুই হাজার ৫১১ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত ৫৪৫ কোটি টাকার বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ হিসাবে আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়ায় ২২ শতাংশ। অনিয়মের দায়ে এই প্রকল্পেও একবার পিডি বদল করা হয়েছে।

‘জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্প, পার্যায়-২’ প্রকল্পের বাস্তবায়ন ২০১৯ সালের জুলাই শুরু হয়েছে। প্রায় দশ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গত জুন নাগাদ প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এই প্রকল্পটি আগামী মাসেই শেষ হওয়া কথা রয়েছে।

আইসিটি প্রকল্পের মালামাল ফেরত দেয়ার নির্দেশ

আইসিটি প্রকল্পের সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরকারি মালামাল ‘অবৈধভাবে’ নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই প্রকল্পের ‘সরঞ্জামাদি ও আসবাবপত্র’ ফেরত চেয়ে সাবেক পিডি অধ্যাপক আবদুস সবুর খান, উপপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ জাকির হোসেন ও মোহাম্মদ আবুল হোসেন এবং সহকারী পরিচালক নওসের আলী, আবদুস ছামাদ, মীর মো. জাকির হোসেন ও মিজানুর রহমানকে চিঠি দেন বর্তমান পিডি অধ্যাপক ড. মোরশীদুল হাসান।

ওইসব কর্মকর্তাকে গত ২৪ অক্টোবর দেয়া মোরশীদুল হাসানের চিঠিতে দেখা গেছে, বদলি হওয়ার পর প্রকল্পের সাবেক কর্মকর্তারা সরকারি অর্থে কেনা বিপুল সংখ্যক শিক্ষা উপকরণ নিয়ে গেছেন। এগুলোর মধ্যে কম্পিউটার ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, মডেম, সিম, ইউপিএস, ফাইল কেবিনেট, চেয়ার, টেলিফোন, ইন্টারকম, প্রিন্টার মেশিন, দেয়াল ঘড়ি, ওয়্যালফ্যান, বড় টেবিল, গেস্ট চেয়ার, কম্পিউটার টেবিল, এসি, সিলিং ফ্যান, আলমিরা অন্যতম।

একটি চিঠিতে মোরশীদুল হাসান বলেন, ‘দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের জন্য আপনার নামে ইস্যুকৃত অফিস সরঞ্জামাদি ও উদ্বৃত্ত ব্যবহার্য দ্রব্যাদি বদলিকালে আপনি অফিসে জমা দেন নাই। এমতাবস্থায় প্রকল্প কার্যালয়ে আপনার দাপ্তরিক কাজে ব্যবহারের জন্য আপনার নামে ইস্যুকৃত অফিস সরঞ্জামাদি ও উদ্বৃত্ত ব্যবহার্য দ্রব্যাদি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য আপনাকে অনুরোধ করা হলো।’