চনপাড়া নয়, ফারদিনকে অন্য কোথাও হত্যা করা হয়েছে : ডিবি

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশকে সর্বশেষ একটি সিসি ক্যামেরায় যাত্রাবাড়ীতে দেখা গেছে। ডিবি পুলিশ বলছে, ৩ থেকে ৪ জন যুবক তাকে লেগুনায় উঠিয়ে নিয়ে যায় রূপগঞ্জের তারাবোর দিকে। ওই লেগুনার চালক ও আরোহীদের খোঁজা হচ্ছে।

গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের জানান, চনপাড়ায় নয়, ফারদিনকে অন্য কোথাও হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করছে ডিবি। তবে রামপুরার পর ফারদিন কেন চারটি স্থান ঘুরে যাত্রাবাড়ী গেলেন এবং সেখান থেকে কেন তারাবোর লেগুনায় উঠলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও জানতে পারেনি ডিবি।

হারুন অর রশীদ বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ঘটনার দিন রাত সোয়া ২টার দিকে ফারদিনকে যাত্রাবাড়ীতে দেখা গেছে। সাদা পোশাক পরা এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে লেগুনায় ওঠে সে। এরপর লেগুনা তারাবো বিশ্বরোডের দিকে চলে যায়। ওই লেগুনায় আরও চার ব্যক্তি ছিলেন।

তিনি বলেন, সাদা পোশাক পরা ব্যক্তি, লেগুনার চালক ও লেগুনায় আগে থেকে থাকা চারজনকে শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। সময় ও দূরত্ব বিবেচনায় ওই রাতে যাত্রাবাড়ী থেকে ফারদিনের চনপাড়ায় যাওয়া সম্ভব নয় মন্তব্য করে ডিবি প্রধান বলেন, ওখান থেকে চনপাড়ার দিকে রওয়ানা দিলেও রাত আড়াইটার মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই খুন চনপাড়ায় নয়, অন্য কোথাও হতে পারে বলে ধারণা করছি আমরা। রহস্য উদঘাটনে ডিবি কাজ করছে বলে জানান তিনি।

ডিবির প্রধান হারুন বলেন, ৪ নভেম্বর রাত ৯টা থেকে সোয়া ২টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন ফারদিন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে বন্ধু বুশরার রিকশা থেকে রামপুরায় নামার পর ১১টার দিকে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় ছিলেন তিনি। সেখান থেকে তিনি পুরান ঢাকার জনসন রোডে আসেন সোয়া ১১টার কাছাকাছি সময়ে। রাত ১টার দিকে তার অবস্থান ছিল গুলিস্তান এলাকায়। এরপর তাকে রাত সোয়া ২টায় দেখা যায় যাত্রাবাড়ীতে। তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ী এলাকায় আমরা তাকে হাঁটতে দেখেছি। কিছুক্ষণ হাঁটার পরে সাদা গেঞ্জি পরা একটি ছেলে এসে তাকে নিয়ে গেল। সাদা লেগুনায় উঠলেন ফারদিন। সেই লেগুনায় তিন-চারজন লোক ছিল। তখন আনুমানিক সোয়া ২টা বাজে।

এক মাস পর যার স্পেনে এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় যাওয়ার কথা, সেই ফারদিনের পরীক্ষার আগের রাতে এমন বিক্ষিপ্ত ঘোরাঘুরির কারণ জানা যাচ্ছে না। হারুন বলেন, ‘এই যে সে বিভিন্ন জায়গাগুলোতে যাচ্ছে, আসলে সে কেন যাচ্ছে? আসলে তার মন-মানসিকতা খারাপ ছিল কি না বা সে কোন চিন্তায় ছিল কি না অথবা কয়দিন পর তার বিদেশ যাওয়ার কথা, তার টাকা-পয়সা সংগ্রহ হয়েছে কি না, এরকম কোন টেনশনে ছিলেন কি না, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন কি না? সবকিছুই আমরা তদন্ত করছি। রাত-দিন এক করে ডিবির টিম কাজ করছে। এদিকে র‌্যাব জানিয়েছেন হত্যাকান্ডে কারা জড়িত তাদের আমরা প্রায় শনাক্ত করতে পেরেছি।,

র‌্যাবের বক্তব্য বিশ্বাস করেন না ফারদিনের বাবা

ফারদিন হত্যায় চনপাড়ার রায়হান গ্যাং জড়িত বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিশ্বাস করে না পরশের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা। গতকাল ডিবি কার্যালয়ে ছেলে হত্যার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নূর উদ্দিন। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। নূর উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলে হত্যার শিকার হয়েছে। আর মামলাটা কী? এসব বলে মামলাটাই পাল্টে দিচ্ছেন। আগাম কথাবার্তা বলা উচিত নয়।’

‘রায়হান গ্যাংয়ের সঙ্গে আমার ছেলের কী নিয়ে বিরোধ থাকবে? বুঝলাম সে (রায়হান) একটা খারাপ মানুষ। কিন্তু আমাকে বোঝান, আমার ছেলেটাই কেন তার টার্গেটে পড়বে? সে কেন ওখানে (চনপাড়ায়) যাবে? কীভাবে সম্ভব সেটা! কোন তথ্যের ভিত্তিতে দেখাবেন সেখানে আমার ছেলেটা মুভ করেছে? সে যদি সেখানে না থেকে থাকে তাহলে এসব বলার অর্থ কী?’

মামলায় কোন মোটিভ পাওয়ার বিষয়ে তদন্তকারী সংস্থা কিছু জানিয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে নূর উদ্দিন রানা বলেন, ‘না, আমাকে সেরকম কিছু জানানো হয়নি। তারা (ডিবি) আমাকে ডেকেছে, ছেলের পড়াশুনা, বয়স, মাদকে জড়ানোর বিষয়ে জানতে চেয়েছে। সে মুক্তমনা ছিল কি না, যেসব জায়গায় গিয়েছে সেসব জায়গায় অন্য কোন বন্ধু রয়েছে কি না, এসব বিষয় জানতে চেয়েছে।’

আপনি আগে বলেছিলেন, বাসা থেকে ফারদিনের হলে ফেরার কথা ছিল। হলে যাওয়ার কথা বলেই ফারদিন বের হয়েছিল। কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে ফারদিন হলে না ফিরে যাত্রাবাড়ীতে গেছে। এর আগে সে এ রকম করেছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে নুর উদ্দিন রানা বলেন, ‘অতীতে এমন রেকর্ড নেই। পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করে বা জানিয়ে সব করে সে। নিখোঁজ হওয়ার আগ পর্যন্ত সে তার মাকে যা জানিয়েছে, সে অনুযায়ী চলতে দেখেছি। কিন্তু এখন ঠিক বুঝতে পারছি না সে আসলে কেন গিয়েছিল যাত্রাবাড়ীতে।’

মাদকের সঙ্গে জড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাদকে জড়ানোর বিষয়ে ডিবি কিছুই বলেনি আমাকে। মাদকের সংশ্লিষ্টতাও পাওয়া যায়নি, সেটা ডিবি পুলিশ ক্লিয়ার করেছে। আমিও এর আগে বলেছি। আমার ছেলে কখনো ধূমপান করত না। এমনকি ধোঁয়াও সহ্য করতে পারত না।’

বিদেশ যাওয়া নিয়ে কোন স্ট্রেস বা অবসাদে ভুগছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, সে রকম কিছু নয়। আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই গল্প উপন্যাস পড়ে বড় হয়েছে। বিদেশ যাওয়া হলো না বলে ভেঙে পড়ার মতো ছেলে সে নয়। ওর চরিত্রের মধ্যে সেরকম কিছু নেই। হত্যার বিষয়ে ডিবি পুলিশ ও র‌্যাব জোর দিয়ে তদন্ত করছে। থানায় গিয়েছিলাম জিডি করার পর। যেহেতু সাসপেক্ট করা হচ্ছে। পরিকল্পিত কি না সেটা বের করতে হলে সময় লাগতে পারে। সব বিষয়ে আমরা তো অনুমান করতে পারি না।’

আপনি মামলার বাদী, ছেলে হারিয়েছেন কিন্তু তদন্ত সংশ্লিষ্ট সবাই নিশ্চিত করেছেন ফারদিন হত্যায় তার বন্ধু বুশরা জড়িত নয়। বুশরার জন্য আপনার খারাপ লাগা আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বুশরার জন্য প্রচন্ড রকমের খারাপ লাগা তো আছেই। কিন্তু বুশরার সঙ্গে ফারদিনের ৫/৬ ঘণ্টা কাটানোর কথা নয়। এই মেয়ে এতটা সময় কাটানোর কথা নয়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না বুশরা জড়িত নয়।’

র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ফারদিন হত্যায় জড়িতদের প্রায় খুঁজে বের করা হয়েছে। নজরদারিতে আছে। র‌্যাবের দাবি, চনপাড়ার রায়হান গ্যাং ও তার সহযোগীরা মিলে ফারদিনকে হত্যা করেছে। রায়হান ও সহযোগীদের আটক করা হয়েছে বলে খবরও বেরিয়েছে। র‌্যাব কি আপনাকে ডেকে এসব ব্যাপারে কিছু জানিয়েছে? আপনি কী মনে করেন, ফারদিন চনপাড়ায় হত্যার শিকার হয়েছে?

এসব প্রশ্নের জবাবে বাবা নূরউদ্দিন বলেন, ‘র‌্যাব থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তবে মামলা দায়েরের পর থেকে তারা কোন আপডেট দেয়নি। এই যে ম্যাসেজটা দিলো, কারা দিলো, কোন সংস্থা দিলো তা আপনারা জানেন। বিচারাধীন বিষয়ে এমন তথ্য দেয়াটা কতটা যথাযথ? ওখানে যে ফুটেজ দেখানো হলো, রায়হান গ্যাংয়ের সঙ্গে আমার ছেলেটার কী বিরোধ থাকবে?’

এদিকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রায়হান গ্যাং ফারদিন হত্যার নেপথ্যে কাজ করেছে। আলোচিত এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় রায়হানসহ বেশ কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গত মঙ্গলবার ও বুধবার বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেছেন, হত্যাকান্ডে কারা জড়িত তাদের আমরা প্রায় শনাক্ত করতে পেরেছি। চনপাড়ার আশপাশে হত্যাকান্ডটি ঘটানো হতে পারে। আমরা অনেকটাই নিশ্চিত যে চনপাড়ার রায়হান গ্যাংয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এখানে। রায়হানকে যদি আমরা আইনের আওতায় আনতে পারি তাহলে ফারদিন খুনের মোটিভ বের করতে পারব। তবে ফারদিন চনপাড়ায় কেন গিয়েছিল সে কারণটা এখনও বের করতে পারেনি র‌্যাব।

তিনদিন নিখোঁজ থাকার পর গত ৭ নভেম্বর বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। মরদেহ ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসকরা জানান, তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। মরদেহ উদ্ধারের দুই দিন পর ১০ নভেম্বর ফারদিনের বন্ধু ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্রী বুশরাসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে রামপুরা থানায় মামলা করেন ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা। এ মামলায় বুশরাকে গ্রেপ্তার করে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি পুলিশ। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। রিমান্ডে বুশরার কাছ থেকে কী তথ্য পাওয়া গেছে বা আদৌ কোন তথ্য পাওয়া গেছে কি না তা এখনও জানায়নি ডিবি।

শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর ২০২২ , ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪২৯, ২২ রবিউস সানি ১৪৪৪

চনপাড়া নয়, ফারদিনকে অন্য কোথাও হত্যা করা হয়েছে : ডিবি

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

image

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশকে সর্বশেষ একটি সিসি ক্যামেরায় যাত্রাবাড়ীতে দেখা গেছে। ডিবি পুলিশ বলছে, ৩ থেকে ৪ জন যুবক তাকে লেগুনায় উঠিয়ে নিয়ে যায় রূপগঞ্জের তারাবোর দিকে। ওই লেগুনার চালক ও আরোহীদের খোঁজা হচ্ছে।

গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের জানান, চনপাড়ায় নয়, ফারদিনকে অন্য কোথাও হত্যা করা হয়েছে বলে মনে করছে ডিবি। তবে রামপুরার পর ফারদিন কেন চারটি স্থান ঘুরে যাত্রাবাড়ী গেলেন এবং সেখান থেকে কেন তারাবোর লেগুনায় উঠলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও জানতে পারেনি ডিবি।

হারুন অর রশীদ বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ঘটনার দিন রাত সোয়া ২টার দিকে ফারদিনকে যাত্রাবাড়ীতে দেখা গেছে। সাদা পোশাক পরা এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে লেগুনায় ওঠে সে। এরপর লেগুনা তারাবো বিশ্বরোডের দিকে চলে যায়। ওই লেগুনায় আরও চার ব্যক্তি ছিলেন।

তিনি বলেন, সাদা পোশাক পরা ব্যক্তি, লেগুনার চালক ও লেগুনায় আগে থেকে থাকা চারজনকে শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। সময় ও দূরত্ব বিবেচনায় ওই রাতে যাত্রাবাড়ী থেকে ফারদিনের চনপাড়ায় যাওয়া সম্ভব নয় মন্তব্য করে ডিবি প্রধান বলেন, ওখান থেকে চনপাড়ার দিকে রওয়ানা দিলেও রাত আড়াইটার মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই খুন চনপাড়ায় নয়, অন্য কোথাও হতে পারে বলে ধারণা করছি আমরা। রহস্য উদঘাটনে ডিবি কাজ করছে বলে জানান তিনি।

ডিবির প্রধান হারুন বলেন, ৪ নভেম্বর রাত ৯টা থেকে সোয়া ২টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন ফারদিন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে বন্ধু বুশরার রিকশা থেকে রামপুরায় নামার পর ১১টার দিকে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় ছিলেন তিনি। সেখান থেকে তিনি পুরান ঢাকার জনসন রোডে আসেন সোয়া ১১টার কাছাকাছি সময়ে। রাত ১টার দিকে তার অবস্থান ছিল গুলিস্তান এলাকায়। এরপর তাকে রাত সোয়া ২টায় দেখা যায় যাত্রাবাড়ীতে। তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ী এলাকায় আমরা তাকে হাঁটতে দেখেছি। কিছুক্ষণ হাঁটার পরে সাদা গেঞ্জি পরা একটি ছেলে এসে তাকে নিয়ে গেল। সাদা লেগুনায় উঠলেন ফারদিন। সেই লেগুনায় তিন-চারজন লোক ছিল। তখন আনুমানিক সোয়া ২টা বাজে।

এক মাস পর যার স্পেনে এক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় যাওয়ার কথা, সেই ফারদিনের পরীক্ষার আগের রাতে এমন বিক্ষিপ্ত ঘোরাঘুরির কারণ জানা যাচ্ছে না। হারুন বলেন, ‘এই যে সে বিভিন্ন জায়গাগুলোতে যাচ্ছে, আসলে সে কেন যাচ্ছে? আসলে তার মন-মানসিকতা খারাপ ছিল কি না বা সে কোন চিন্তায় ছিল কি না অথবা কয়দিন পর তার বিদেশ যাওয়ার কথা, তার টাকা-পয়সা সংগ্রহ হয়েছে কি না, এরকম কোন টেনশনে ছিলেন কি না, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন কি না? সবকিছুই আমরা তদন্ত করছি। রাত-দিন এক করে ডিবির টিম কাজ করছে। এদিকে র‌্যাব জানিয়েছেন হত্যাকান্ডে কারা জড়িত তাদের আমরা প্রায় শনাক্ত করতে পেরেছি।,

র‌্যাবের বক্তব্য বিশ্বাস করেন না ফারদিনের বাবা

ফারদিন হত্যায় চনপাড়ার রায়হান গ্যাং জড়িত বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিশ্বাস করে না পরশের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা। গতকাল ডিবি কার্যালয়ে ছেলে হত্যার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নূর উদ্দিন। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। নূর উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলে হত্যার শিকার হয়েছে। আর মামলাটা কী? এসব বলে মামলাটাই পাল্টে দিচ্ছেন। আগাম কথাবার্তা বলা উচিত নয়।’

‘রায়হান গ্যাংয়ের সঙ্গে আমার ছেলের কী নিয়ে বিরোধ থাকবে? বুঝলাম সে (রায়হান) একটা খারাপ মানুষ। কিন্তু আমাকে বোঝান, আমার ছেলেটাই কেন তার টার্গেটে পড়বে? সে কেন ওখানে (চনপাড়ায়) যাবে? কীভাবে সম্ভব সেটা! কোন তথ্যের ভিত্তিতে দেখাবেন সেখানে আমার ছেলেটা মুভ করেছে? সে যদি সেখানে না থেকে থাকে তাহলে এসব বলার অর্থ কী?’

মামলায় কোন মোটিভ পাওয়ার বিষয়ে তদন্তকারী সংস্থা কিছু জানিয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে নূর উদ্দিন রানা বলেন, ‘না, আমাকে সেরকম কিছু জানানো হয়নি। তারা (ডিবি) আমাকে ডেকেছে, ছেলের পড়াশুনা, বয়স, মাদকে জড়ানোর বিষয়ে জানতে চেয়েছে। সে মুক্তমনা ছিল কি না, যেসব জায়গায় গিয়েছে সেসব জায়গায় অন্য কোন বন্ধু রয়েছে কি না, এসব বিষয় জানতে চেয়েছে।’

আপনি আগে বলেছিলেন, বাসা থেকে ফারদিনের হলে ফেরার কথা ছিল। হলে যাওয়ার কথা বলেই ফারদিন বের হয়েছিল। কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে ফারদিন হলে না ফিরে যাত্রাবাড়ীতে গেছে। এর আগে সে এ রকম করেছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে নুর উদ্দিন রানা বলেন, ‘অতীতে এমন রেকর্ড নেই। পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করে বা জানিয়ে সব করে সে। নিখোঁজ হওয়ার আগ পর্যন্ত সে তার মাকে যা জানিয়েছে, সে অনুযায়ী চলতে দেখেছি। কিন্তু এখন ঠিক বুঝতে পারছি না সে আসলে কেন গিয়েছিল যাত্রাবাড়ীতে।’

মাদকের সঙ্গে জড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাদকে জড়ানোর বিষয়ে ডিবি কিছুই বলেনি আমাকে। মাদকের সংশ্লিষ্টতাও পাওয়া যায়নি, সেটা ডিবি পুলিশ ক্লিয়ার করেছে। আমিও এর আগে বলেছি। আমার ছেলে কখনো ধূমপান করত না। এমনকি ধোঁয়াও সহ্য করতে পারত না।’

বিদেশ যাওয়া নিয়ে কোন স্ট্রেস বা অবসাদে ভুগছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, সে রকম কিছু নয়। আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই গল্প উপন্যাস পড়ে বড় হয়েছে। বিদেশ যাওয়া হলো না বলে ভেঙে পড়ার মতো ছেলে সে নয়। ওর চরিত্রের মধ্যে সেরকম কিছু নেই। হত্যার বিষয়ে ডিবি পুলিশ ও র‌্যাব জোর দিয়ে তদন্ত করছে। থানায় গিয়েছিলাম জিডি করার পর। যেহেতু সাসপেক্ট করা হচ্ছে। পরিকল্পিত কি না সেটা বের করতে হলে সময় লাগতে পারে। সব বিষয়ে আমরা তো অনুমান করতে পারি না।’

আপনি মামলার বাদী, ছেলে হারিয়েছেন কিন্তু তদন্ত সংশ্লিষ্ট সবাই নিশ্চিত করেছেন ফারদিন হত্যায় তার বন্ধু বুশরা জড়িত নয়। বুশরার জন্য আপনার খারাপ লাগা আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বুশরার জন্য প্রচন্ড রকমের খারাপ লাগা তো আছেই। কিন্তু বুশরার সঙ্গে ফারদিনের ৫/৬ ঘণ্টা কাটানোর কথা নয়। এই মেয়ে এতটা সময় কাটানোর কথা নয়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না বুশরা জড়িত নয়।’

র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ফারদিন হত্যায় জড়িতদের প্রায় খুঁজে বের করা হয়েছে। নজরদারিতে আছে। র‌্যাবের দাবি, চনপাড়ার রায়হান গ্যাং ও তার সহযোগীরা মিলে ফারদিনকে হত্যা করেছে। রায়হান ও সহযোগীদের আটক করা হয়েছে বলে খবরও বেরিয়েছে। র‌্যাব কি আপনাকে ডেকে এসব ব্যাপারে কিছু জানিয়েছে? আপনি কী মনে করেন, ফারদিন চনপাড়ায় হত্যার শিকার হয়েছে?

এসব প্রশ্নের জবাবে বাবা নূরউদ্দিন বলেন, ‘র‌্যাব থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তবে মামলা দায়েরের পর থেকে তারা কোন আপডেট দেয়নি। এই যে ম্যাসেজটা দিলো, কারা দিলো, কোন সংস্থা দিলো তা আপনারা জানেন। বিচারাধীন বিষয়ে এমন তথ্য দেয়াটা কতটা যথাযথ? ওখানে যে ফুটেজ দেখানো হলো, রায়হান গ্যাংয়ের সঙ্গে আমার ছেলেটার কী বিরোধ থাকবে?’

এদিকে র‌্যাবের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী রায়হান গ্যাং ফারদিন হত্যার নেপথ্যে কাজ করেছে। আলোচিত এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় রায়হানসহ বেশ কয়েকজনকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গত মঙ্গলবার ও বুধবার বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেছেন, হত্যাকান্ডে কারা জড়িত তাদের আমরা প্রায় শনাক্ত করতে পেরেছি। চনপাড়ার আশপাশে হত্যাকান্ডটি ঘটানো হতে পারে। আমরা অনেকটাই নিশ্চিত যে চনপাড়ার রায়হান গ্যাংয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এখানে। রায়হানকে যদি আমরা আইনের আওতায় আনতে পারি তাহলে ফারদিন খুনের মোটিভ বের করতে পারব। তবে ফারদিন চনপাড়ায় কেন গিয়েছিল সে কারণটা এখনও বের করতে পারেনি র‌্যাব।

তিনদিন নিখোঁজ থাকার পর গত ৭ নভেম্বর বিকেলে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ফারদিনের মরদেহ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। মরদেহ ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসকরা জানান, তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। মরদেহ উদ্ধারের দুই দিন পর ১০ নভেম্বর ফারদিনের বন্ধু ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্রী বুশরাসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে রামপুরা থানায় মামলা করেন ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা। এ মামলায় বুশরাকে গ্রেপ্তার করে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি পুলিশ। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠান। রিমান্ডে বুশরার কাছ থেকে কী তথ্য পাওয়া গেছে বা আদৌ কোন তথ্য পাওয়া গেছে কি না তা এখনও জানায়নি ডিবি।